(নয়)
সেদিন টিপ টিপ করিয়া বৃষ্টি হইতেছিল। গ্রামের দুই তিনজন লোকের সঙ্গে আজাহের ঘরের বারান্দায় বসিয়া গল্প করিতেছিল আর পাটের দড়ি পাকাইতেছিল। এমন সময় আচকান পায়জামা পরা দুইজন যুবক মৌলবী আসিয়া ডাকিল,–”আজাহের মিঞা! বাড়ি আছেন নাকি?”
আজাহের তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে যাইয়া পাড়ার একটা ছোকরাকে কি যেন বলিল। সেই ছোকরাটি আওগাইয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আজাহের মিঞারে কি জন্যি।”
মৌলবী দুইজন বলিলেন, “আমরা পীরপুরের মৌলানা সাহেবের তালেব-এলেম। মৌলানা সাহেব এদেশে তছরীফ আনছেন। সেই জন্য আজাহের মিঞারে খবর বলতে আইলাম।“
আজাহের ঘরের মধ্য হইতে সমস্তই শুনিতেছিল। সে যখন বুঝিতে পারিল উহারা মৌলবী সাহেবের লোক, শহর হইতে পরওয়ানা লইয়া কোন পেয়াদা আসে নাই তখন সে তাড়াতাড়ি আসিয়া তালেব-এলেমদের সামনে দাঁড়াইল। তাঁহারা আচ্ছালামু আলায়কুম বলিয়া আজাহেরের হাত ধরিয়া দরূদ পড়িল। এমন সম্মানের সহিত আজাহেরের সঙ্গে কেহই ব্যবহার করে নাই। আজাহের মৌলবীদের ব্যবহারে একেবারে মোহিত হইয়া গেল। মৌলবীদের মধ্যে যে একটু বড় সে আজাহেরের মুখের কাছে হাত ছোঁয়াইয়া সেই হাত চুম্বন করিয়া কহিলেন, “গ্রামে আসতেই খবর শুনলাম, আজাহের মিঞা, তা নামেও যেমনি কামেও তেমনি। আপনার মতন ভাগ্যবান লোক দুনিয়ায় হয় না।”
দ্বিতীয় মৌলবী আরবী হইতে সুর করিয়া একটা শ্লোক পড়িলেন, “খোদাওয়ান তায়ালা জাল্লা জালালুহু কোরান শরীফ মে ফরমাইয়াছেন,–”আয়ুর্যেবিল্লাহে মিনাশ শয়তানের রাজিম। অর্থাৎ কিনা যে নাকি পরহেজগার নেকবক্ত আল্লাহ তায়ালা হঠাৎ তার কপালডারে খ্যাডেড় পালাডার মত উচা কইরা দেন।”
বড় মৌলবী তার সুর আরো একটু চড়া করিয়া পড়িলেন, “আলহামদো লিল্লাহে রাব্বেল আলামিন আর রহমানের রহিম মালেকে ইয়াউমেদ্দিন।”
অর্থাৎ কিনা, আমার খোদাওয়ান করিম বলেছেন–হে আমার বান্দাগণ, আমার যদি হুকুম না হয় তবে হস্তি দিয়াও তুমি মাকড়ের আঁশ ছিড়বার পারবা না।
খোদাওয়ান তায়ালা আরো বইলাছেন, আমার যদি হুকুম না হয় তবে বন্দুক দিয়া দ্যাওড় কইরা কাতরা, লাঠি, কুড়াল মাইরা একটা বনের মশারেও তুমি মারবার পারবা না।” এই পর্যন্ত বলিয়া বড় মৌলবী সাহেব হাঁপাইতে লাগিলেন।
ছোট মৌলবী সাহেব আবার আরম্ভ করিলেন, “আমার খোদা জাল্লা জালালাহু পাক পরওয়ারদেগার আরো ফরমাইয়াছেন, হে আমার বান্দাগণ আমি যদি ইচ্ছা করি, আমার যদি দিলে কয় তবে আকাশের চান্ডার উপরে আমি একজন পথের ফকিরকে বসাইতে পারি।”
প্রথম মৌলবী এবার তছবীহ জপিতে জপিতে কাঁদিয়াই ফেলিলেন। “দেখ মিঞা আজাহের! খোদা আইজ তোমারে মুক তুইল্যা চাইলেন। আকাশের চান-সুরুজ আইনা তোমার হাতে দিলেন। গ্রামের সকল লোক তোমার নছিবের জন্য হিংসা করবি।” আজাহের সমস্ত শুনিয়া অবাক হইয়া ভাবিতেছিল,–কি সৌভাগ্য আজ তাহার হইল।
দ্বিতীয় মৌলবী এবার খুব জোরে জোরে খানিক মোনাজাত করিয়া বলিলেন,–”দেখেন মিঞা আজাহের! আজ পিরান পীর ছৈয়দে মক্কা-মদীনা শাহসুফি মোহাম্মদ তজুম্বর আলি খাকসার সাহেব জনাবে নিজামুদ্দীন আলায়হে ছালাম পীরপুরী আপনার বাড়িতে তছরীফ আনত্যাছেন। পীর সাহেবের বজরা শরীফ বাদামতলীর ঘাট হইতে রওয়ানা হইয়া আপনার বাড়ির দিক আসত্যাছেন।”
দ্বিতীয় মৌলবী আবার বলিতে আরম্ভ করিলেন, “দেখেন মিঞা আজাহের! খোদার। তারিফের কি খুবী, ঐ গেরামে আরো তো কত আলেম, ফাজেল, জমিদার, জোদ্দার। সাহেবান আছেন। তারা সকলেই পীর সাহেবকে পাইলে তোলা তোলা চান্দি রূপার মত তানারে মাথায় করিয়া নিয়া যাব্যানে।”
প্রথম মৌলবী হাতের তছবীর মালাটি চুম্বন করিয়া বলিতে লাগিলেন, “ও গিরামের গৈজদ্দী খালাসী কাইল পীর সাহেবের দুই পা জড়ায়া ধইরা কত কানতে লাগলেন। পীর সাহেব! একটু পায়ের ধূলি আমার বাড়িতে দিয়া যান। পীর সাহেব রাজী হইলেন না। কিন্তু আপনার কি ভাগ্য যে বিনি দাওয়াতে পীর সাহেব আজই আপনার বাড়িতে তছরীফ আনত্যাছেন। ওই যে ধলা জল-পিংলাসের নাও সাজায়া পীর সাহেব আসত্যাছেন। জলদী বাড়ির ভিতর যান। পীর সাহেবের জন্য সামিয়ানা তয়ার করেন গ্যা।”
এই সব শুনিয়া আজাহেরের মন আনন্দে মশগুল হইয়া গেল। সত্যই ত কত বড় সৌভাগ্য তার! সে তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতর যাইয়া তিনটি মুরগী জবাই করিয়া ফেলিল। বউকে তাড়াতাড়ি ভাত রাধিতে বলিয়া দিল। মিনাজদ্দী মাতবরের বাড়ি হইতে হাতল ভাঙ্গা চেয়ারখানা আনিয়া পীর সাহেবের বসার জায়গা করিল। পীরপুরের মৌলানা সাহেব আজাহেরের বাড়িতে আসিতেছেন। এ খবর শুনিয়া গ্রামের আরো আট দশজন লোক তাহার বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল। পীর সাহেবের প্রেরিত তালেবে-এলেম দুইজন। তাহাদের সকলেরই হাতে হাত মিলাইয়া দরূদ পড়িলেন এবং তাহাদের দাড়িতে হাত ছুঁয়াইয়া সেই হাত চুম্বন করিলেন। গ্রামের লোকেরা যেন কৃতার্থ হইয়া গেল। তাহারা। সকলেই স্বীকার করিল, এমন বড় মৌলানা তাহাদের দেশে আর কখনও আসে নাই। সুতরাং আজাহের তাহার গরুর ঘরখানা পরিষ্কার করিয়া খড় বিছাইয়া তাহার উপরে খেজুরের পাটির বিছানা পাতিয়া রাখুক।
শুভক্ষণে মৌলানা সাহেবের বজরা আজাহেরের বাড়ির ঘাটে আসিয়া ভিড়িল। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা জলপিংলাসের নৌকা কখনও দেখে নাই। তাহারা দৌড়াদৌড়ি করিয়া নৌকা দেখিতে আসিল। আজাহেরের গায়ে কাঁটা দিয়া উঠিল। প্রকাণ্ড বজরার মধ্যে মৌলানা সাহেব বসিয়া তছবীহ জপ করিতেছেন। পৃথিবীর কোন দিকে তাঁহার খেয়াল নাই। মনে হয় যেন শত শত বৎসর ধরিয়া তিনি এইভাবেই তছবীহ জপ করিতেছেন। বিস্ময় বিস্ফারিত নয়নে আজাহের মৌলানা সাহেবের দিকে চাহিয়া রহিল। মৌলানা। সাহেবের গালভরা পাকা দাড়ি, তাহাতে লাল খেজাব মাখা। গায়ে খুব দামী সিল্কের পোশাক। এতবড় লোক আজ তাহার বাড়িতে তছরীফ আনিয়াছেন। তালেব-এলেমরা আজাহেরের কানে কানে আসিয়া কহিল, “আজাহের মিঞা! শিগগীর যায়া থালির উপরে পান আর দশটা টাকা মৌলবী সাহেবের সামনে নজর ধরেন, এতবড় মৌলানা তানার মান। ত রাখতি অবি।”
সুতরাং পাট বেচা টাকা হইতে দশটি টাকা লইয়া আজাহের তাহার মাটির সানকির। উপরে রাখিল। তার পাশে কয়েকটি পান সাজাইয়া আজাহের মৌলানা সাহেবের সামনে আসিয়া নজর ধরিল। মৌলানা সাহেব একটু মৃদু হাস্যে আজাহেরকে করুণা করিয়া টাকা দশটি জায়নামাজের পাটির একপাশে রাখিয়া দিলেন। তারপর আগেরই মত কোরান পড়ায় মন দিলেন, যেন দুনিয়াদারীর কোন খেয়াল রাখেন না। সাকরেদ দুইজন চোখের ইসারায় আজাহেরকে দেখাইলেন, কত খোদাপরস্ত তাঁহাদের পীর সাহেব।
মৌলানা সাহেবের সাগরেদদের উপদেশ ও পরামর্শে দুপুরের আহারটা মৌলানা। সাহেবের উত্তম রকমেরই হইল। রাতে মৌলবী সাহেব ওয়াজ করিবেন। মিনাজী মাতবরের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া আজাহের দুই গ্রামের সকল লোক দাওয়াৎ করিয়া
আসিল। রাতে আজাহেরের উঠানের উপর চাদোয়া টাঙান হইল। তাহার তলে পীরান পীর মৌলানা সাহেব মৌলুদ পড়িতে আরম্ভ করিলেন। চারি পাশে গ্রামের লোকেরা বিস্ময় বিস্ফারিত নয়নে মৌলবী সাহেবের ওয়াজ(বক্তৃতা) শুনিতে লাগিল। প্রথমে তিন চারি জন তালেব-এলেম লইয়া মৌলবী সাহেব আরবী এবং ফারসীতে গজল পড়িলেন। তারপর সুদীর্ঘ মোনাজাত করিয়া মৌলবী সাহেব আরম্ভ করিলেন, “খোদা তায়ালা জাল্লা জালালুহু পাক পরওয়ারদেগার কোরান শরিফমে ফরমাইছে,“–এই পর্যন্ত বলিতেই গায়ের একটি বৃদ্ধ লোক আহা-হা করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, মৌলানা সাহেব তাহার প্রতি একটা শুভ দৃষ্টিপাত করিয়াই আবার আরম্ভ করিলেন,– “আমার খোদা কি ফরমাইয়াছেন, হে আমার বান্দাগণ! যদি তোমাদের বাড়িতে কোন মৌলবী আসিয়া উপস্থিত হন, তানি মাথায় করিয়া খোদার রহমত নিয়া আসেন। তখন কি হয়? চারজন। ফেরেস্তা একটা বেহেস্তি চাঁদরের চার কানি ধরিয়া সেই গেরস্তের বাড়ির উপরে আসিয়া দাঁড়ায়। গৃহস্থ যদি মৌলবী সাহেবকে দেখিয়া তাড়াতাড়ি আসিয়া তাহার সঙ্গে আচ্ছালামু আলায়কুম না করে তবে কি হয়? ওই যে চারজন ফেরেস্তা চাঁদরের চার কানি ধরিয়া রাইখ্যা ছিল, তার একজন চাঁদরের এক কানি ছাইড়া দেয়। তারপর যদি গৃহস্থ ওজুর পানি ও জায়নামাজের পাটি আইনা মৌলবী সাহেবের সামনে না ধরে, তবে দ্বিতীয়। ফেরেস্তা চাঁদরের আর এক কানি ছাইড়া দিয়া যায়। তারপর গৃহস্থ যদি তাজিমের সাথে মৌলবী সাহেবের সামনে খানাপিনা না ধরে অর্থাৎ কিনা মুরগী জবাই কইরা খুব ভালমত তাকে না খাওয়ায়, তখন তৃতীয় ফেরেস্তা চাঁদরের আর এক কানি ছাইড়া দিয়া যায়। শোনেন মিঞা সাহেবরা, আমার কথা নয়, আমার খোদা বইলাছেন, তারপর সেই গৃহস্থ যদি মৌলবী সাহেবের সামনে কিছু নজরানা না দেন তখন সেই চতুর্থ ফেরেস্তা কাতে কাতে বলে, “হারে কমবক্ত! তোর বাড়িতে আমার মৌলবী সাহেব বেহেস্তি নিয়ামত নিয়া আইছিল তুই তারে খালি হাতে বিদায় করলি! যদি তার হাতে এক টাকাও ভইরা দিতি আমার খোদা তোরে রোজহাশরের বিচারের দিন সত্তর টাকা বকশিশ করত। এই বইলা ফেরেস্তা কানতি কানতি চইলা যায়।“ এই পর্যন্ত বলিয়া মৌলানা সাহেব বাম হস্তের রঙীন গামছা দিয়া চোখ মুছিলেন। সভার মধ্যে বৃদ্ধ দুই একজন লোকও মৌলবী সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছিলেন। মৌলবী সাহেব আবার বলিতে লাগিলেন, “শোনেন মোমিন মুসলমান ভাইরা–শোনেন আমার ঈমানদার ভাইরা! আবার মৌলবী সাহেবকে যদি কেউ একটা ছাতি দান করেন–রোজ কেয়ামতের দিন সেই ছাতি তাহার মাথার উপরে ঝুলতি থাকবি। এখানকার সূর্যের সত্তর গুণ গরম লইয়া সে দিন মাথার উপরে সূর্য উঠপি। এখানকার সূর্য আসমানের উপরে জ্বলে কিন্তু সেদিনকার সূর্য মাথার আধ হাত উপরে জ্বলবি। শোনেন ভাই সাহেবরা, আমার মৌলবী সাহেবরে যিনি আজ ছাতা দান করবেন। সেদিন তাহার মাথায় সেই ছাতা শুধু ঠাণ্ডা হাওয়া ছাড়বি। একটুকও গরম লাগবি না। শোনেন আমার ঈমানদার ভাইরা, মৌলবী সাহেবরে যে একজোড়া জুতা দান করবি, পুলছুরাতের পুলের উপর দিয়া সে যখন চলবি তখন ওই জুতা আইনা ফেরেস্তারা তার পায় পরাইয়া দিবি। সেই জুতা পায় দিয়া সে অনায়াসে পুলছুরাতের চুলের সেতু পার হইয়া যাবি।” এই পর্যন্ত বলিয়া মৌলবী সাহেব হাঁপাইতে লাগিলেন। তালেম এলেমরা সুর করিয়া গাহিতে লাগিলেন :
“মৌলবীর মফেলতে মোমবাতি চাহিরে,
মৌলবীর মফেলতে আতর গোলাপ চাহিরে।
মৌলবীর মফেলতে ছোরমাদানী চাহিরে,
মৌলবীর মফেলতে নজরানা চাহিরে।”
কিছুক্ষণ বাদে হাতের ইশারায় তাহাদিগকে থামাইয়া দিয়া মৌলবী সাহেব আবার ওয়াজ করিতে আরম্ভ করিলেন, “খোদা ওয়াতায়ালা জাল্লা জালালুহু পাক পরওয়ারদেগার কোরান শরিফমে ফরমাইয়াছেন, ”হে আমার বান্দাগণ, তোমরা কখনও আমার মৌলবী সাহেবের কথার অবহেলা করিবে না। যদি মৌলবী সাহেবকে অবহেলা কর তবে আমি তোমাদিগকে কখনও ক্ষমা করিব না। মৌলবী সাহেব হইল আমার নায়েবে-নবী। নায়েবে-নবী কারে কইছে? আমার ভাইরা একটু খেয়াল করিয়া শুনবেন। যেমন আপনারা দেখছেন মহারাণীর চৌকিদার। এই চৌকিদারকে যদি কেহ অমান্য করে, প্রথমে দারগা তাহার বিচার করব, দারগা যদি না করে হাকিম তাহার বিচার করব, হাকিম যদি না করে ছোটলাট তাহার বিচার করব, ছোটলাট যদি বিচার না করে বড়লাট তাহার বিচার করব, বড়লাট যদি না করে মহারাণী নিজে আসিয়া তার বিচার করব। তা হইলে বোঝেন ভাই সাহেবরা, চৌকিদার যদি অপমান হৈল, দারগা অপমান হৈল, ছোটলাট অপমান হৈল, বড়লাট অপমান হৈল, মহারাণী নিজেও অপমান হৈল। এইরূপ নায়েবে-নবী হইলেন মৌলবী সাহেব।”
এই পর্যন্ত বলিয়া মৌলবী সাহেব একটা গল্প আরম্ভ করিলেন : একজন চাষী লোকের বাড়ি কবে একজন মৌলবী যাইয়া উপস্থিত। চাষী তাহাকে ভালমত আদর না করাতে মৌলবী সাহেব বেজার হইয়া ফিরিয়া আসিলেন। তাহাতে সে বছর চাষীর খেতে ফসল হইল না। চাষীর পাঁচটি গরু আছড়াইয়া মরিয়া গেল। তারপর চাষীর বউ কি করিয়া সেই মৌলবী সাহেবকে দাওয়াৎ করিয়া আনাইল, কি করিয়া মৃত বলদগুলির প্রাণ দেওয়াইল এই সকল কথা মৌলবী সাহেব সবিস্তারে বর্ণনা করিলেন। কখনও কাঁদিয়া কখনও হাসাইয়া সমস্ত আসরকে তিনি যেন নিজের হাতের ক্রীড়নক করিয়া তুলিলেন। প্রায় শেষ রাত্রে আজাহেরের বাড়িতে মৌলুদের বৈঠক ভাঙিল। সমবেত লোকেরা আহার করিয়া যার যার বাড়ি চলিয়া গেল। আজাহের তাহাদের খাওয়ার এত যে বন্দোবস্ত করিয়াছিল সে সকলের প্রশংসা তাহারা একবার মুখেও আনিল না। সকলের মুখেই মৌলবী সাহেবের তারিফ। এমন জবরদস্ত মৌলানা তাহারা জীবনে কখনও দেখে নাই। এমন অপূর্ব আওয়াজ তাহারা কখনও শোনে নাই। সুতরাং এ-বাড়িতে সে-বাড়িতে মৌলবী সাহেবকে আরো কয়েকদিন নিমন্ত্রণ রাখিতে হইল। গরীব গাঁয়ের লোকেরা সাধ্যের অতীত অর্থ আনিয়া মৌলবী সাহেবের নজরানা দিয়া সস্তায় বেহেস্তের পথ প্রসার করিয়া লইল। যদিও অপরিচিত জেলার লোকেরা মৌলবী সাহেবের জন্য ঘন ঘন পত্র লিখিতে লাগিলেন তথাপি আশপাশের গ্রামগুলির মুসলমান ভাইদের ঈমানদারীর জন্য মৌলবী সাহেব এখানেই কিছুদিন রহিয়া গেলেন।
উত্তেজনার প্রথম ঝুঁকিটি কাটিয়া গেলে, আজাহের আর তার বউ রাত্রিকালে অতি গোপনে মাটির তলা হইতে কলসীর টাকাগুলি উঠাইয়া গুণিতে বসিল। হায়! হায়! তাহারা করিয়াছে কি? এই কয়দিনে তাহারা তিনশত টাকা খরচ করিয়া ফেলিয়াছে। ওদিকে শরৎ সাহার দেনা পড়িয়া রহিয়াছে। সেদিন কেমন করিয়া শরৎ সাহা শাসাইয়া গিয়াছে, যদি সত্য সত্যই নালিশ করিয়া থাকে তবে উপায় হবে কি? অবশ্য মোড়ল তাহাকে অনেক সাহস দিয়াছে কিন্তু সদরের পিয়ন আসিয়া যদি তাহার গরু বাছুর ক্রোক করিয়া লইয়া যায় তখন মোড়ল তাহাকে কতটুকু সাহায্য করিতে পারিবে?
আজাহেরের বউ-এর চোখ দুটি জলে ভরিয়া উঠিল। “তুমি এমন নামালের কাজ করলা ক্যান। এতগুলি টাকা এই কয়দিনের মধ্যে খরচ কইরা ফালাইলা।” গামছার খোট দিয়া বউ-এর চোখ মুছাইতে যাইয়া আজাহের নিজেও কাঁদিয়া ফেলে। তবু বউকে সান্তনা দেয়, “পরলোকের কাম ত করছি। এক পয়সা খরচ করলি রোজহাশরের ময়দানের দিন সত্তর পয়সা পাব। বউ তুমি কাইন্দ না।” বউ বলে, “পরলোকের জন্যে ত ছবাব কিনলাম। কিন্তু এখন আমরা খাব কি?” পৃথিবীতে যাহারা কিছুই সঞ্চয় করিতে পারিল না। পরলোকের সঞ্চয়ের স্বপ্ন রচনা করিয়া তাহারা ক্ষণিক সান্তনা লাভ করে। কিন্তু রোজহাশরের ময়দানের সুখ-সুবিধার কথা আজাহের যতই ভাল করিয়া ভাবিতে চায় শরৎ সাহার শাসানির কথা ততই উজ্জ্বল হইয়া তাহার মনে ভাসে।
“বোবা কাহিনী” উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ