(তেত্রিশ)

সেদিন বছির টিনের থালায় করিয়া এক গ্লাস ভাত মুখে দিয়া আর এক গ্লাস হাতে লইয়াছে। এমন সময় উকিল সাহেব তাহার সামনে আসিয়া বলিলেন, “খবর পেলাম, তুমি আরজান ফকিরের বাড়ি যেয়ে একরাত কাটিয়ে এসেছ। আমরা তাকে একঘরে করেছি। তার বাড়িতে যেয়ে তুমি ভাত খেয়েছ। আমার এখানে আর তোমার থাকা হবে না। বই-পত্র নিয়ে শিল্পীর সরে পড়। তোমার মুখ দেখলে আমার গা জ্বালা করে।” এই বলিয়া উকিল সাহেব অন্দরে প্রবেশ করিলেন।

বছিরের হাতের ভাত হাতেই রহিল। হতভম্বের মত সে বসিয়া রহিল। কখন যেন হাতের ভাত থালায় পড়িয়া গেল সে টেরও পাইল না। টিনের থালাখানা হাতে করিয়া বছির বাহিরে আসিয়া ভাতগুলি ফেলিয়া দিল। কতকগুলি কাক আসিয়া সেই ভাত খাইতে খাইতে ছিটাইয়া একাকার করিল। তেমনি করিয়া তাহার বালক-জীবনের স্বপ্নখানিকেও কে। যেন দু’পায়ে দলিয়া-পিষিয়া টুকরো টুকরো করিয়া ইতস্ততঃ ছড়াইয়া দিল।

এখন বছির কোথায় যাইবে! কোথায় যাইয়া আশ্রয় পাইবে? বই-পুস্তক নিজের লুঙ্গিখানায় বাধিয়া বছির পথে বাহির হইল। আজ আর স্কুলে যাওয়া হইবে না।

শহরের মসজিদে কয়েকটি মাদ্রাসার ছাত্র থাকিত। সেখানে মজিদ নামে একটি ছেলের সঙ্গে তাহার আলাপ হইয়াছিল। সে মসজিদে থাকিয়া পড়াশুনা করিত। ছুটির সময় গ্রামে গ্রামে লোকজনের কাছে সাহায্য ভিক্ষা করিত। তাই দিয়া শহরের হোটেলে একপেটা আধপেটা খাইয়া কোন রকমে তাহার পড়াশুনা চালাইত। তাহার সঙ্গে আরও যে চার পাঁচটি ছাত্র থাকিত তাহারাও এইভাবে তাহাদের পড়াশুনার খরচ চালাইত।

অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া বছির মজিদের আস্তানায় আসিয়া উঠিল। মজিদ অতি সমাদর করিয়া চৌকির উপর তাহার ময়লা লুঙ্গিখানা বিছাইয়া বছিরকে বসিতে দিল। সমস্ত শুনিয়া মজিদ বলিল, “ভাই! আল্লার ওয়াস্তে তুমি আমার মেহমান হয়া আইছ। তোমার কুনু চিন্তা নাই। আমি তোমারে আশ্রয় দিলাম।”

বছির বলিল, “ভাই! তুমি নিজেই পেট ভরিয়া খাইবার পাও না। তার উপরে আমারে খাওন দিবা কেমন কইরা?”

মজিদ বলিল, “ভাই! আমার কাছে আট আনার পয়সা আছে, চল এই দিয়া দুইজনে ভাত খায়া আসি। তারপর আর সব কথা শুনবানে।”

বছির জিজ্ঞাসা করিল, “এই আট আনা দিয়া তুমি আমারে খাওয়াইবা। কালকার খাওন কুথায় থনে অইব?”

উত্তরে মজিদ বলিল, “ভাইরে! আইজকার কথা বাইবাই বাঁচি না। কালকার কথা বাবলি ত আমরা গরীব আল্লার দইনা হইতে মুইছা যাইতাম। আমাগো কথা ঐল আইজ বাইচা থাহি। কাইলকার কথা কাইল বাবব। চল যাই, হৈটালত্যা খায়া আসি।”

সামনে হাফেজ মিঞার হোটেল। বাঁশের মাচার উপর হোগলা বিছানো। তার এখানে। সেখানে তরকারি পড়িয়া দাগ হইয়া আছে। রাশি রাশি মাছি ভন ভন করিয়া উড়িতেছে। পিছনের নর্দমার সামনে একরাশ এঁটো থালা-বাসন পড়িয়া আছে। কতকগুলি ঘেয়ো কুকুর। সেখানে কাড়াকাড়ি করিয়া সেই ভুক্তাবশিষ্ট ভাতের উপর পড়িয়া কামড়া-কামড়ি করিতেছে। হোটেলওয়ালা আসিয়া সেই কুকুরগুলিকে নির্দয়ভাবে প্রহার করিয়া তাড়াইয়া দিতেছে; আবার তাহারা আসিয়া যথাস্থান দখল করিতেছে।

বছিরকে সঙ্গে করিয়া মজিদ সেই মাচার উপর হোগলা বিছানায় আসিয়া বসিল। হোটেলের চাকর সেই এঁটো থালা বাসনগুলি হইতে চল্টা-ওঠা দু’খানা টিনের থালা সামান্য পানিতে ধুইয়া নোংরা একখানা কাপড় দিয়া মুছিয়া তাহাদের সামনে দিল। মজিদ বলে, “দুই থালায় তিন আনার করিয়া ভাত আর এক আনার করিয়া ডাল দাও!” শুনিয়া হোটেলওয়ালা হাফেজ মিঞা বলিল, “মিঞা! রোজই শুধু ডাল ভাত চাও? আমার তরকারি বেচপ কার কাছে! আইজকার মত দিলাম, কিন্তুক আর পাইবা না। ভাত বিক্রী হয়া যায়, তরকারি পইড়া থাহে।”

মজিদ কথার উত্তর না দিয়া সেই ডাল-ভাত মাখাইয়া দুইজনে খাইতে বসিল। খাইতে খাইতে মজিদ চাকরটাকে বলিল, “বাই ত বাল, দুইডা কাঁচা মরিচ আর দুইডা পেঁয়াজ আইনা দাও।” চাকর তাহাই আনিয়া দিল। হাফেজ মিঞা তাহার দিকে কটমট করিয়া চাহিতে লাগিল। অল্প এতটুকু ডালে অর্ধেক ভাতও খাওয়া হইল না। মজিদ হোটেল-ওয়ালাকে বলিল, “হাফেজসাব! আজই এক ছিপারা কোরান শরীফ পইড়া আপনার মা-বাপের নামে বকশায়া দিবানি। আমাগো একটু মাছের ঝোল দেওনের হুকুম করেন।

হোটেলওয়ালা বলিল, “অত বকশানের কাম নাই। পয়সা আছে যে মাছের ঝোল দিব?”

মজিদ বলিল, “আমরা তালেম-এলেম মানুষ। আমাগো দিলি আল্লা আপনাগো বরকত। দিব। না দিলি আল্লা বেজার হবেন।”

হোটেলওয়ালা মনে মনে ভাবিল, না যদি দেই তবে হয়ত ইহারা অভিসম্পাত দিবে। শত হইলেও তালেম–এলেম! ইহাদের কথা আল্লা শোনে। নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে দুই চামচ মাছের ঝোল তাহাদের পাতে ঢালিয়া দিল।

খাইয়া লইয়া হোটেলওয়ালারে ভাতের দাম দিয়া তাহারা আবার সেই মসজিদের ঘরে আসিয়া বসিল! স্কুলের ঘন্টা কখন পড়িয়া গিয়াছে। তবু বছির বই-পত্র লইয়া স্কুলের পথে রওয়ানা হইল।

বিকালে স্কুলের ছুটির পর সে মজিদের আস্তানায় ফিরিয়া আসিল। তখন মাদ্রাসার আর আর ছেলেরাও আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। মজিদ তাহাদের কাছে বছিরকে পরিচিত করাইয়া দিল। যাহারা সব সময় অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করিতেছে তাহারাই অভাবী লোকের দুঃখ সকলের আগে বুঝিতে পারে। মাদ্রাসার ছেলেরা সকলেই বছিরকে আপনজনের মত গ্রহণ করিল।

কথায় কথায় তাহারা আলাপ করিতে লাগিল, আজ বিকালে তাহারা কোথায় খাওয়ার ব্যবস্থা করিবে? ছাত্রদের মধ্যে করিম একটি রোগা-পটকা ছেলে। পড়াশুনা বিশেষ কিছুই করে না কিন্তু কোথায় কাহার বাড়ি ফাতেহা হইবে, কোথায় বিবাহ উপলক্ষে ভোজের ব্যবস্থা হইবে, তার সমস্ত খবর সে সংগ্রহ করিয়া আনে। সেই জন্য সঙ্গী-সাথীরা তাহাকে বড়ই ভালবাসে। মজিদ করিমকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “করিম ভাই! বল ত আজ তুমি আমাগো জন্যি কুন জায়গায় দাওয়াতের বন্দোবস্ত করছাও?”

করিম বলিল, “চিন্তা কইর না বাই! আজ খান বাহাদুর সায়েবের মায়ের ফাতেহা। এহনই চল! খতম পড়তি অবি। যার যার ছিপারা লয়া চল।”

বছির মজিদের কানে কানে বলিল, “আমি যে বাল আরবী পড়তি জানি না।”

মজিদ বলিল, “আমরাই কি বাল মত জানি বাই? তোমারে একখান ছিপারা দিব। আমাগো মতন দুইলা দুইলা পড়ার অভিনয় করবা। কেউ টের পাবি না।”

ইতিমধ্যে হোটেলে যাইয়া যে ভাবে মজিদ মাছের ঝোল চাহিয়া লইয়াছে তাহা বছিরের মনঃপুত হয় নাই। এখন আবার আল্লার কোরান শরীফ লইয়া পড়ার অভিনয় করিতে তাহার কিছুতেই মন উঠিতেছিল না।

সে মজিদকে বলিল, “ভাই! তোমরা সগলে যাও। সকালে আমি এত খাইছি যে আমার মোটেই ক্ষিধা নাই। তাছাড়া আল্লার কালাম লয়া মিথ্যা অভিনয় করবার পারব না।”

মজিদ বলিল, “ভাই বছির! আল্লার দইনায় কোন সত্য আর কোন মিথ্যা কওন বড় মুস্কিল! আমরা যে এমন কইরা আধ পেটা খায়া আল্লার কালাম পড়তাছি আর খান বাহাদুর সাবরা কতক খায় কতক ফেলায়া দ্যায়। একবারও আল্লার নাম মুহি আনে না! এডাই কি আল্লার হুকুম? আমরা বইসা বইসা কোরান শরীফ পড়ব আর তার ছওয়াব পাইব খান বাহাদুর সাবের মরা মা, এডাই কি সত্য! বাইরে! আমাগো বাইচা থাকার চায়া সত্য আর দুইনায় নাই। অতসব ভাবতি ঐলি আর লেহা পড়া করতি অবি ন্যা। বাড়ি যায় লাঙল ঠেলতি অবি।” এই বলিয়া বছিরকে টানিয়া লইয়াই তাহারা খান বাহাদুর সাহেবের বাড়ি রওয়ানা হইল।

পরদিন সকালে বছির তার বই-পুস্তক লইয়া পড়িতে বসিল! খান বাহাদুর সাহেবের বাড়ি যাইয়া রাতের খাওয়া ত তাহারা খাইয়াই আসিয়াছে। তাহার উপরে এক একজন পঁচ সিকা করিয়া পাইয়াছে। সুতরাং দুইদিনের জন্য আর তাহাদিগকে ভাবিতে হইবে না।

পরদিন সকালে মসজিদের বারান্দায় আরও অনেকগুলি নূতন তালেব-এলেম আসিয়া যার যার কেতাব সামনে করিয়া সুর করিয়া পড়িতে লাগিল। বলা বাহুল্য মজিদ ও তার বন্ধুরা আসিয়াও তাহাদের সঙ্গে যোগ দিল। সকলে সুর করিয়া যখন পড়িতেছিল দূর হইতে মনে হইতেছিল, মসজিদে যেন হাট বসিয়াছে। কিছুক্ষণ পরে ইমাম সাহেব। আসিলেন। তাহাকে দেখিয়া সকল ছাত্র দাঁড়াইয়া সিলামালকি দিল। তিনিও যথারীতি উত্তর প্রদান করিয়া আসন গ্রহণ করিলেন। দুইজন ছাত্র তাড়াতাড়ি যাইয়া ইমাম সাহেবকে বাতাস করিতে লাগিল। ইহার পুরস্কার স্বরূপ তিনি তাহাদিগের প্রতি চাহিয়া একটু মৃদু হাসিলেন। তাহাতেই যেন তাহারা কৃতার্থ হইয়া আরও জোরে জোরে পাখা চালাইতে লাগিল।

বহুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া ইমাম সাহেব বয়স্ক তিন চারটি ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমাগো পড়া ওইছে?” তাহারা এক বাক্যে বলিল, “ওইছে মাওলানাসাব।”

তাহারা আসিয়া ইমাম সাহেবের সামনে দাঁড়াইল! তিনি তাহাদের বলিলেন, “পড়।” তোতা পাখির মত তাহারা একে একে যার যার পড়া পড়িয়া যাইতে লাগিল। চারিদিকে আর আর ছাত্রেরা ভীষণ শব্দ করিয়া পড়িতেছিল। তাহাদের গণ্ডগোলে এই ছাত্র কয়টি কি পড়া দিল ইমাম সাহেব তাহা শুনিতেও পাইলেন না। তিনি কেতাব দেখিয়া তাহাদিগকে। নূতন পড়া দেখাইয়া অপর একদল তালেব-এলেমকে ডাক দিলেন। এইভাবে সকল ছাত্রের। পড়া লইতে প্রায় ঘন্টা দুই কাটিয়া গেল। তখন ইমাম সাহেব তাহাদিগকে ছুটি দিলেন। তাহারা কলরব করিয়া যার যার বাড়ি চলিয়া গেল। বছির এক কোণে বসিয়া তাহার দিনের পড়া তৈরী করিতে লাগিল।

মসজিদে আসিয়া বছিরের পাঁচ ছয় দিন কাটিয়া গিয়াছে। এই সময়ের মধ্যে সে মসজিদের ছাত্রদের সম্বন্ধে অনেক কিছু জানিতে পারিল। তাহারা প্রায় সকলেই এই জেলার বিভিন্ন গ্রাম হইতে আসিয়াছে। মাওলানা সাহেবেরা ওয়াজ করিয়া তাহাদের অভিভাবকদের বুঝাইয়াছেন, যে পিতা-মাতা তাহার সন্তানদিগকে ইসলামী শিক্ষার জন্য এই ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় পাঠাইবেন আল্লা রোজ হাশরের আজাবের সময় তাহার মাথায় একটি ছত্র ধরিবেন। যে বাড়িতে একজন মাদ্রাসার ছাত্র পড়ে সে বাড়িতে আল্লার বেহেশত নামিয়া আসে। আলেম লোকদের চৌদ্দ পুরুষ পর্যন্ত বেহেশতে যায়। যখন একটি ছাত্র। প্রথম দিন মাদ্রাসার সিঁড়ির উপর আসিয়া দাঁড়ায় তখন তাহার মৃত মুরুব্বীরা দোয়া দরূদ পড়িতে পড়িতে বলেন, “এই যে আমাগো আওলাদ আইজ মাদ্রাসায় পড়তি আইল, তার যবান হইতে যখন আল্লার কালাম বাহির হইবে তখন আমাগো সকল গোর আজাব কাটিয়া যাইবে।”

ইত্যাকার বক্তৃতা শুনিয়া সরল-প্রাণ গ্রামবাসীরা সস্তায় পরকালে এই সব সুযোগ-সুবিধা। পাইবার জন্য নিজ নিজ ছেলেদিগকে মসজিদের ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় পাঠাইয়াছে। কোন। কোন ছাত্র সাত আট বৎসর ধরিয়া এই মাদ্রাসায় যাওয়া আসা করিতেছে। এখন পর্যন্তও তাহারা আরবীর প্রথম ভাগ কেতাবখানাই পড়িয়া শেষ করিতে পারে নাই। মসজিদের ইমাম সাহেব হাফেজী পাশ। প্রথম শিক্ষার্থীদের আরবী অক্ষর ও ভাষা শিক্ষা দেওয়ার কোনই পদ্ধতি তিনি জানেন না। জানিলেও তিনি তাহা প্রয়োগ করা প্রয়োজন বোধ করেন না। কারণ মাদ্রাসায় পড়িতে আসিয়া ছাত্রেরা কেহই বেতন দেয় না। দুই ঈদের ফেতরা এবং যাকাত আদায় করিয়া তিনি বৎসরে ত্রিশ-চল্লিশ টাকা পান। তা ছাড়া নিকটস্থ গ্রামগুলিতে কেহ মারা গেলে তাহার নামে কোরান শরীফ খতম করার জন্য মাঝে মাঝে তিনি দাওয়াত পান। তাহাতে মাসে পাঁচ সাত টাকার বেশী আয় হয় না। সুদূর নোয়াখালী জেলা হইতে তিনি আসিয়াছেন। দেশে বৃদ্ধ পিতা-মাতা। তাহারা একবেলা খায় ত আর একবেলা অনাহারে থাকে। কত করুণ করিয়া তাহারা মাঝে মাঝে পত্র লেখে। এই সামান্য আয়ের সবটাই তাহাকে দেশে পাঠাইতে হয়। স্ত্রীর একটি ছোট ছেলে হইয়াছে আজ ছয় মাস। টাকা পয়সার অভাবে এখনও ছেলেকে দেখিতে যাইতে পারেন নাই।

ছাত্রেরা যখন ইমাম সাহেবকে ঘিরিয়া পড়া জিজ্ঞাসা করিতে থাকে তখন তাহার মন উধাও হইয়া ছুটিয়া যায় সেই নোয়াখালী জেলায় একটি অখ্যাত গ্রামে।

যে চার পাঁচজন মসজিদে থাকিয়া পড়াশুনা করিত, অল্প সময়ের মধ্যেই তাহাদের সঙ্গে বছিরের বড় ভাব হইয়া গেল। তাহারা প্রত্যেকেই কোরান শরীফে হাফেজ হইবার জন্য তৈরী হইতেছে। সকলেরই অবস্থা বছিরের মত। কিন্তু তাহার মত তাহারা কোন প্রতিকূল অবস্থায় নিরাশ হইয়া পড়ে না। অভাব ত তাহাদের লাগিয়াই আছে। কিন্তু সেই অভাব হইতে মুক্ত হইবার কোন পথ তাহাদের জানা না থাকিলে সেই পথ তাহারা তৈরী। করিয়া লইতে পারে। তাই নিত্য-নূতন ফন্দিতে তাহাদিগকে জীবিকার সংস্থান করিতে হয়।

যেদিন করিম কোথাও কোন দাওয়াতের খোঁজ পায় না, সেদিন তাহারা দুই তিনটি দলে বিভক্ত হইয়া শহর হইতে দুই তিন মাইল দূরের গ্রামগুলির বাড়ি বাড়ি যাইয়া কবর জেয়ারত করে। সুরেলা কণ্ঠে মোনাজাত করিয়া গৃহকর্তার মঙ্গল কামনা করে। তাহারা খুশী হইয়া সামান্য কিছু দান করে। রাত্র হইলে পেট ভরিয়া খাওয়াইয়া দেয়!

কোন কোনদিন তাহাদের একজন গ্রামে যাইয়া বলে, “মসজিদে ঘুমাইয়াছিলাম। আমার কোরান শরীফখানা চোরে লইয়া গিয়াছে। আজ কয়দিন কোরান শরীফ পড়িতে পারি নাই। আপনি যদি একখানা কোরান শরীফ কিনিয়া দেন আপনার নামে খতম পড়িয়া সমস্ত ছওয়াব বখশাইয়া দিব।”

গৃহস্বামী বলে, “আমরা নিজেই খাইতে পাই না। আপনার কোরান শরীফ কেনার পয়সা কোথায় পাইব?”

ছাত্রটি উত্তরে বলে, “মিঞা সাহেব! আধা পেটা খাইয়া ত প্রায়ই দিন কাটান। না হয় আরও দু’চারদিন কাটাইবেন, কিন্তু পরকালের এই নেকির কাজটি করিয়া রাখেন। রোজ হাশরের বিচারের দিন অনেক কাজ দিবে।” সরল গৃহবাসী তাহার কষ্টের সঞ্চয় হইতে সামান্য কিছু ছাত্রটির কোরান শরীফ কেনার জন্য দান করে।

এ সব কাজ বছিরের পছন্দ হয় না। সে মজিদের কাছে বার বার এর জন্য প্রতিবাদ করে। কিন্তু মজিদের সেই এক কথা, “আমাগো ত বাই বাচতি অবি। নিজে বাঁচনের জন্যি এই সামান্য মিথ্যা আল্লায় মাফ করবেন। দেখছাও না আল্লার দইনায় কেউ বড়লোক, কেউ গরীব। আল্লা কি আমাগো গরীব কইরা জন্ম দিছিলেন? গরীবগো মুখির বাত কাইড়া নিয়া ওরা বড়লোক ঐছে। দুই চারডা ধর্মের কতা কয়া আমরা যদি ওগো ঠগাইয়া কিছু লই তাতে গুনা অবে না। ওরাও ত আমাগো ঠগাইছে।”

বছির বলে, “বড়লোকগো ঠগাও সেটা না হয় বুঝলাম কিন্তুক এইসব গরীব লোকগো ঠগায়া পয়সা আনা ত আমি ভাল বইলা মনে করি না।”

মজিদ উত্তর করে, “তুমি হাসাইলা বছির আমারে! এইসব লোকগো আমরা যদি না ঠগাই অন্যলোকে আয়া ঠগাবি। দিনে দিনে এরা ঠগতিই থাকপি। আমরা যদি এহন ওগো ঠগায়া লেহা-পড়া শিখতি পারি, আলেম ঐতি পারি, মৌলবী হয়া ওগো কাছে যায়া এমুন ওয়াজ করুম যাতে কেউ আর ওগো ঠগাইবার পারবি না।”

এ যুক্তিও বছিরের পছন্দ হয় না। এদেরই মত কত ছাত্র ত আলেম হইয়া গ্রাম-দেশে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। তাহারা ত কেহই এইসব গ্রাম্য-লোকদিগকে শোষণের হাত হইতে বাঁচাইবার জন্য কোন বক্তৃতা করে না। বরঞ্চ আরও অভিনব মিথ্যার জাল পাতিয়া দেশের অজ্ঞ জনসাধারণকে ঠকাইয়া বেড়ায়। কিন্তু যে অসাধারণ অধ্যবসায়ের সহিত এই ছাত্র কয়টি পড়াশুনা করে তাহা দেখিয়া বছির বিস্মিত হয়। ওরা দুই তিনজন প্রায় গোটা কোরান শরীফখানিই মুখস্থ করিয়া ফেলিয়াছে। তাও কি শুধু মুখস্থই, কেরায়াত করিয়া কোরান শরীফ পড়িতে কোথায় স্বরকে বিলম্বিত লয়ে লম্বা করিতে হইবে, কোথায় খাটো করিতে হইবে, কোথাও থামিতে হইবে, উহার সব কিছু তাহারা মুখস্থ করিয়া আয়ত্ত করিয়া লইয়াছে। দিন নাই-রাত্র নাই–সকাল নাই–বিকাল নাই, অবসর পাইলেই ইহারা কেতাব লইয়া বসে। নিয়মিত খাওয়ার সংস্থান নাই, কতদিন অনাহারে কাটাইতে হয়। শীতে গরম বস্তু নাই। গ্রীষ্মের রৌদ্রে মাথার চান্দি ফাটিয়া যাইতে চাহে। প্রকৃতি ইহাদের কাছে দিনে দিনে নিষ্ঠুর হইতে নিষ্ঠুরতর হয়। তার উপর আছে অনাহারের ক্ষুধা,–সংক্রামক রোগের আক্রমণ! এই নিভকি জীবন যোদ্ধাগুলি দিনের পর দিন সকল রকম প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে সংগ্রাম করিয়া চলিতেছে।

পথ হয়ত ইহাদের ভ্রান্ত হইতে পারে। এই সংগ্রামের শেষ ফসলও হয়তো এই যুগোপযোগী হইয়া তাহাদের ভবিষ্যৎ জীবনকে ধন-ধান্যে ভরিয়া দিবে না, কিন্তু এই জীবন্ত বিদ্যাসাগরেরা আমাদের পিছাইয়া পড়া মুসলিম সমাজে জ্ঞান-তপস্যার যে কঠোর সাধনা-ধারার আদর্শ রাখিয়া যাইতেছে তাহার প্রভাব কি আমাদের সমাজে পড়িবে না?

ছোট ছেলে বছির। অত শত ভাবিতে পারে না। কিন্তু মসজিদের এই তালেব-এলেমগুলির প্রতি একান্ত শ্রদ্ধায় তাহার মন ভরিয়া ওঠে। সেই শ্রদ্ধা প্রকাশ করিতে সে তাহাদের ঘর-সংলগ্ন পায়খানা ও প্রস্রাবখানার উপর বালতি বালতি পানি ঢালিয়া দেয়। দুই বেলা ঝাট দিয়া ঘরখানিকে পরিষ্কার করিয়া রাখে। তাহাদের ময়লা জামা-কাপড়গুলি ভাজ করিয়া সুন্দর করিয়া টাঙাইয়া রাখে। তাহারাও বছিরকে বড়ই স্নেহ করে। সকলেই অভাবী বলিয়া একে অপরের অভাব বুঝিতে পারে। কেহ বাড়ি হইতে সামান্য চিড়া বা মুড়ি লইয়া আসিলে সকলে মিলিয়া তাহা ভাগ করিয়া খায়।

মসজিদের খাদেম সাহেব এই তালেব-এলেমদিগকে পড়াইতে বিশেষ উৎসাহ দেখান । প্রায়ই নানা ওজর-আপত্তি দিয়া তিনি পড়াইবার সময় অন্য কাজ করেন। এজন্য তাহারা মনঃক্ষুণ্ণ হয় না। আরও মনোযোগের সহিত ওস্তাদের খেদমত করিয়া তাহারা তাহার অনুগ্রহ পাইতে চেষ্টা করে। যেখানে সেখানে ইমাম সাহেবের প্রশংসা করিয়া তাহার জন্য দাওয়াতের বন্দোবস্ত করে। তাহার গোছলের পানি, ওজুর পানি পুকুর হইতে আনিয়া কলসীতে ভরিয়া রাখে। তাহার জামাকাপড় সাবান দিয়া পরিষ্কার করিয়া দেয়। তিনি শুইয়া পড়িলে কেহ পাখার বাতাস করে, কেহ অতি যত্নের সঙ্গে তাহার পা টিপিয়া দেয়। তাহাদের ধারণা, ওস্তাদের সেবা করিয়া তাহার ভিতর হইতে বিদ্যা বাহির করিয়া লইতে হইবে। যখন তিনি তাহাদিগকে পড়াইতে কৃপণতা করেন, তাহারা আরও বেশী করিয়া তাহার খেদমত করে। এইভাবে প্রায় ছয় মাস কাটিয়া গেল। বছির আগের মতই স্কুলে যাইয়া পড়াশুনা করে।

মাঝে মাঝে আজাহের আসিয়া ছেলের খবর লইয়া যায়। বাড়ি হইতে গামছায় বাঁধিয়া কোনদিন সামান্য চিড়া বা ঢ্যাপের খই লইয়া আসে। মাদ্রাসার ছাত্রদের সঙ্গে বছির সেগুলি কাড়াকাড়ি করিয়া খায়। দেখিয়া আজাহেরের বড়ই ভাল লাগে। আহা! যদি তার সঙ্গতি থাকিত সে আরও বেশী করিয়া চিড়া লইয়া আসিত। যত পারিত ওরা সকলে মিলিয়া খাইত।

ওদের খাওয়া হইলে আজাহের এক পাশে বসিয়া থাকে। তালেব-এলেমরা যার যার কেতাব লইয়া পড়িতে বসে। বছিরও জোরে জোরে তাহার বই পড়ে। আজাহের বসিয়া বসিয়া শোনে। এই পড়ার সুর যেন তাহার বুকের ভিতর হইতে বাহির হইতেছে। সেই সুরের উপর সোয়ার হইয়া আজাহের ভাসিয়া যায়। ছেলে মস্ত বড় বিদ্বান হইয়া শহরের কাছারিতে হাকিম হইয়া বসিয়াছে! কত উকিল, মোক্তার, আমলা, মুহুরি তাজিমের সঙ্গে তাহার সঙ্গে কথা বলিতেছে। এমন সময় আজাহের সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার পরনে সেই ঘেঁড়া লুঙ্গি। গায়ে কত ধূলাবালি। ছেলে এজলাস হইতে নামিয়া আসিয়া তাহাকে উঠাইয়া লইয়া তাহার আসনের পাশে আনিয়া বসাইল। পায়ের ধূলী মাথায় লইয়া সমবেত উকিল, মোক্তারদিগকে বলিল, “এই যে আমার বাজান। আমার লেখাপড়ার জন্য ইনি কত অভাব-অভিযোগের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়াছেন। নিজে অনাহারে থাকিয়া আমার পড়ার খরচ চালাইয়াছেন।” ‘না-না’ আজাহের কিছুতেই এইভাবে ছেলের সামনে যাইয়া উপস্থিত হইবে না। তাহা হইলে কি ছেলের মান থাকিবে? সে ছেলের উন্নতির জন্য যত ত্যাগ স্বীকার করিয়াছে তাহা চিরকালের জন্য যবনিকার অন্তরালে গোপন হইয়া থাকিবে! তাহার ত্যাগের জন্য সে কোনই স্বীকৃতি চাহে না। সকল বাপই ছেলের জন্য এইরূপ করিয়া থাকে। ছেলের উন্নতি হোক–ছেলের সম্মান বাড়ুক, দেশে বিদেশে ছেলের সুখ্যাতি ছড়াইয়া পড়ুক, তাই দেখিয়া আজাহের প্রাণ-ভরা তৃপ্তি লইয়া মাটির গোরে চিরজনমের মত ঘুমাইয়া পড়িবে!

ছেলের কাছে বিদায় লইয়া আজাহের কত কথা ভাবিতে ভাবিতে গৃহে ফিরিয়া যায়।

সেদিন বছির রহিম মল্লিকের বাড়ি বেড়াইতে গেল। রহিম মল্লিক তাহাকে জড়াইয়া ধরিল। “ওগো হুনছ নি? আমার মিঞাবাই আইছে। শীগগীর পাও ধুবার পানি দাও! মাথার ক্যাশদা পিড়াহান মুইছা আমার মিঞাবাইরে বসতি দাও।”

বউ হাসিয়া বারান্দায় একটি খেজুর পাটি বিছাইয়া দিতে দিতে বলিল, “আমার দাদাভাই আইছে। ভাই আমার জন্যি কি লয়া আইছে?”

বছির বলিল, “হোন দাদী! তোমার জন্যি কুদাল ভাইঙ্গা নথ গড়াইতে দিছি, আর কাঁচি ভাইঙ্গা হাসলি গড়াইতে দিছি সোনারু বাড়িতি। এহন কি খাবার দিবা তাই আন।” বউ বলিল, “তয় আমিও ইন্দুরের মাটি দ্যা তোমার জন্যি পায়েস রাইন্দা রাখছি। ক্যালার। ডাউগ্যার খাসী কইরা রাইন্দা রাখছি তোলই চেরা হাঁড়িতি। বইও কুটুম বইও, আইনা দিত্যাছি।”

শুনিয়া রহিমদ্দীন হাসিতে হাসিতে বলিল, “তোমরা দাদী নাতি যত খুশী দেওয়া নেওয়া কর। আমি ইয়ার মদ্দি নাই।”

দাদী তাড়াতাড়ি কোলা হইতে মুড়ি আনিয়া একটি সাজিতে করিয়া বছিরকে খাইতে দিল।

বছির বলিল, “না দাদী! এত সব বাল বাল খাওয়ার সামগ্রীর নাম করলা, শুইনাই জিহ্বায় পানি আইসা গেছে। তা থুইয়া আমার জন্যি শুধু মুড়ি আইনা দিলা! ওই সব না ঐলে খাব না।”

দাদী আঁচল দিয়া বছিরের মুখ মুছাইয়া বলিল, “সে সব বানাইতি ত সময় লাগবি। ততক্ষণে এই মুড়িগুলি খাও কুটুম!”

মুড়ি খাইতে খাইতে বছির রহিমদ্দীর হাল-হকিকত শুনিতে লাগিল। এই অঞ্চলের মধ্যে রহিমদ্দী সব চাইতে ভাল জামদানী শাড়ী বুনাইতে পারিত। লাল, নীল, হলদে সূতা নাইলে পরাইয়া সে শাড়ীর উপর কত রকমের নকসাই না করিত। দেশ-বিদেশ হইতে বেপারীরা আসিত তাহার শাড়ী কিনিতে। শুধু কি জামদানী শাড়ীই সে বুনাইত? মনখুশী, দিলখুশী, কলমীলতা, কাজল লতা, গোলাপ ফুল, রাসমণ্ডল, বালুচর, কত শাড়ীর নাম করিবে সে? কিন্তু এখন দেশে সূতা পাওয়া যায় না। যে সূক্ষ্ম সূতা দিয়া সে আগে শাড়ী বুনাইত তাহা এখন বাজারে পাওয়া যায় না। চোরাবাজারে যা পাওয়া যায় তাহা দিয়া শাড়ী বুনাইলে দাম বেশী পড়ে। লোকসান দিয়া বেচিতে হয়। লোকের রুচিও এখন বদলাইয়া গিয়াছে। শহরের বড়লোকেরা এখন নকসী শাড়ীর পরিবর্তে সাদা থানের উপর নানা রঙের ছাপ দেওয়া শাড়ী পরে।

“কি কব দাদা বাই! আমাগো এখন মরণ। দেহ আইসা, নকসী শাড়ীর ফর্মাগুলি ইন্দুরে কাটত্যাছে।” এই বলিয়া রহিমদ্দী তাহার ডানা ধরিয়া টানিয়া লইয়া গিয়া দেখাইল, ঘরের চালের সঙ্গে অনেকগুলি ফর্মা অযত্নে ঝুলিতেছে। তাহার উপর মাকড়সারা স্বেচ্ছায় জাল বুনাইয়া চলিয়াছে।

বছির বলিল, “আচ্ছা দাদা! সরু সূতা যহন পাওয়া যায় না তহন মোটা সূতার কাপড়ই বানাও না কেন?”

রহিমদ্দী বলে, “ভাইরে! এই হাতে সরু শাড়ীর নকসাই আসে। তবু অনেক কষ্টে মোটা সূতা কিনা গামছা বুনাই। কিন্তু সে সূতাও চোরাবাজারে কিনতি অয়। তাতে মোটেই লাভ অয় না। একবেলা খাই ত আর একবেলা না খায়া থাহি। গরীবের মরণ আর কি! আমাগো জন্যি কেউ বাবে না।”

খাইতে খাইতে বছির জিজ্ঞাসা করে, “আচ্ছা, দাদা! সগল কারিকরগো অবস্থাই তোমার মত নাকি?”

রহিমদ্দী বলে, “তাগো অবস্থা আরও খারাপ। কারিকর পাড়ায় হাহাকার পইড়া গ্যাছে।”

এত সব কথা বছিরকে বলিয়া কি লাভ হইবে? তবু তার কাছেই রহিমদ্দী সকল কথা ইনাইয়া বিনাইয়া বলে। দুঃখের কথা বলিয়াও হয়ত কিছুটা তৃপ্তি পাওয়া যায়।

রহিমদ্দীর কাছে বছির আরও অনেক খবর পাইল। মেনাজদ্দী মাতবর ভেদবমি হইয়া মারা গিয়াছে। মৃত্যুর পর তার যা কিছু জমি-জমা সাতে ভূতে দখল করিয়া লইয়াছে। সেন। মশায় ডিক্রী জারী করিয়া তাহার বিধবা বউকে পথের ফকির করিয়াছে। এ-বাড়ি ও-বাড়ি করিয়া এখন তাহার দিনাতিপাত চলে।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x