(আট)

আষাঢ় মাসের পরে শাওন মাসের মাঝামাঝি ঘন বৃষ্টি পড়িতেছে। চারিদিক অন্ধকার করিয়া আকাশ ভরা মেঘ। বর্ষার জল আসিয়া সমস্ত গ্রামখানাকে ভরিয়া তুলিয়াছে। আউস ধানের খেতগুলিতে কে যেন সোনা ছড়াইয়া দিয়াছে।

কলার ভেলাখানি লগিতে ঠেলিতে ঠেলিতে আজাহের তাহার খেতে আসিয়া উপস্থিত হইল। মোটা মোটা আউস ধানের ছড়াগুলি এক হাঁটু পানির উপরে মাথা তুলিয়া বাতাসে দুলিয়া সুগন্ধ ছড়াইতেছিল। এদের প্রত্যেকটি ধানের গুচ্ছের সঙ্গে আজাহেরের পরিচয় আছে। ওরা এতটুকু ছিল। নিড়াইয়া কুড়াইয়া সে তাহাদের এতবড় করিয়াছে। আর দুই তিনদিন যদি বর্ষার পানি না বাড়ে তবে আজাহের আঁটি আঁটি ধান কাটিয়া বাড়ি লইয়া যাইবে। খেতের মধ্যে কোথা হইতে কতকগুলি আগাছা পানা আসিয়া জড় হইয়াছে। সে একটি একটি করিয়া পানা তুলিয়া তাহার ভেলায় আনিয়া জড় করিতে লাগিল। সেইগুলি সে অন্যত্র ফেলিয়া দিবে।

এমন সময় শরৎ সাহা একখানা নৌকায় করিয়া আট দশজন কামলা লইয়া খেতের কাছে আসিয়া উপস্থিত হইল।

“সা-জী মশায় স্যালাম।” আজাহের সেলাম করিয়া জিজ্ঞাসা করে, “তা কি মনে কইরা?”

“এই এলাম দেখতে খেতের ধানগুলো পেকেছে কিনা। ওরে, তোরা দাঁড়িয়ে রইলি কেন? কেটে ফেল, কেটে ফেল ধানগুলো।”

আট দশজন কামলা কাস্তে লইয়া ধান কাটিতে আরম্ভ করিল। অনেকক্ষণ আজাহের কোন কথাই বলিতে পারিল না। তাহারই খেতের ধান অপরে কাটিয়া লয়। কিন্তু কি করিয়া প্রতিবাদ করে আজাহের তাহাও জানে না।

শরৎ সাহা তাহার পুরাতন চশমা জোড়া চাঁদরের খোটে মুছিতে মুছিতে তাহার লোকজনদের বলে, “ওরে তাড়াতাড়ি কর, তাড়াতাড়ি কর। একদিনের মধ্যেই সমস্ত ধান কেটে নিয়ে যেতে হবে। এখন কলিকালের দিন ত। কে কোথা থেকে এসে বাধা দেয় বলা ত যায় না।”

নিজের খেতের ধানগুলি উহারা লইয়া যাইতেছে। কাস্তের আঘাতে ধানগুলি খসখস করিয়া কাটিতেছে। আজাহেরের বুকের ভিতরে যাইয়া যেন কাস্তের আঘাত লাগিতেছে। সে হঠাৎ খেতের মাঝখানে আসিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল। “দোহাই সা-জী মশায়! আমার খেতের ধান কাটপেন না।”

শরৎ সাহা যেন আকাশ হইতে পড়িয়া গেল, “শুনছ কামলা মিঞারা! কইলাম না? কলিকাল কাকে বলেছে? তোর জমিতে আমি ধান কাটতে এসেছি। তোর জমি? তোর দখলে আছে? পরচা আছে? আরে আজাহের! কলিকাল হ’লেও ধরাটাকে সরা জ্ঞান করা যায় না। আজ আশি বছর ধরে আমার বাবার আমল থেকে এই জমি ভোগ-দখল করছি। আর আজ তুই এসে বলছিস, এ জমি আমার!”

আজাহের এ কথার আর কি জবাব দিবে? সে শুধু বলিল, “সা-জী মশায়! আপনারা ভদ্দর লোক, মুখি যা বলেন তাই লোকে বিশ্বাস করবি। কিন্তুক আইজও রাইত দিন বইতাছে। কন ত দেহি গত সন ভাদ্র মাসে চার কুড়ি টাহা নিয়া এই জমি আমারে দিছিলেন কিনা? উচা মুখে নিচা কথা কইবেন না।”

সা-জী মশায় কাষ্ঠ হাসি হাসিয়া বলিলেন, “শোন কামলা মিঞারা। আশি টাকায় দুই বিঘা জমিন ওরে আমি দিয়েছিলাম? দুই বিঘা জমির দাম দু’শ টাকা। ও আমার নাত জামাই কি না, সেই খাতিরে ওকে আশি টাকায় জমি দিয়েছিলাম।”

“দিছিলেন না সা-জী মশায়? কইছিলেন না? এখন আশি টাকা দে, আগামী সন পাট বেইচা বাকি কুড়ি টাকা দিস। আমি চলার মতন চার কুড়ি টাহা আপনারে গইনা দিয়া আইলাম।”

এইসব কথা শুনিয়া কামলারা ধান কাটা রাখিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। শরৎ সাহা তাদের তাড়া দিয়া বলিলেন, “আরে মিঞারা! শীগগীর শীগগীর কর। দেখছ না কোথাকার বাতাস কোথায় গিয়ে লাগে?”

কামলারা আবার কাজ আরম্ভ করিল। আজাহের সা-জী মশায়ের পা দু’টি জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, “সা-জী মশায়! আপনারও যদি জমিন অয়, আমি ত ধান বুইনাছি। সারা বছর কি খায়া থাকপ? অর্ধেক আমার জন্য রাইখা যান।”

সা-জী মহাশয় পা দিয়া আজাহেরকে ঝাড়া দিয়া ফেলিয়া বলিল, “তুমি কি খাবে তার খবর কি আমি রাখব? জমি চাষ করেছ। আমার কাছ থেকে গত বছর পনর টাকা কর্জ নিয়েছিলে। তারই সুদে তুমি আমার জমি চাষ করেছ।”

কামলারা ধান কাটিতেই ছিল। আজাহের এবার তাহাদের সামনে আসিয়াই দুই হাত উর্দ্ধে তুলিয়া চীৎকার করিয়া বলিল, “দোহাই দিছি কোম্পানী বাহাদুরের, দোহাই মহারাণী মার। মিঞারা তোমরা আগগাওরে, আমার জমির ধান কাইটা নিয়া গ্যাল। ও মাতবরের পো! ও বরান খাঁ। তোমরা আগগাও–আমার জমির ধান কাইটা লয়া গেল।”

চীৎকার শুনিয়া মিনাজদ্দী মাতবর নৌকা বাহিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার নৌকায় দশ বার জন লোক। বরান খাও কলার ভেলা বাহিয়া আসিল।

আজাহের এবার আরো জোরে জোরে চীৎকার করিয়া বলিতে লাগিল, “দোহাই দিছি কোম্পানীওয়ালার, দোহাই দিছি ইংরাজ বাহাদুরের, মিঞারা তোমরা দেইখা যাও, আমার জমির ধান কাইটা নিয়া গ্যাল।”

শরৎ সাহা আস্তে আস্তে তার কামলাদের বলিল, “আরে তোরা এসব কথার মধ্যে থাকবিনে। তাড়াতাড়ি ধান কেটে ফেল। ডবল দাম দিব আজকের রোজের।”

মিনাজদ্দী মাতবর শরৎ সাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “বলি সা-জী মশায়! খবরডা কি?”

“এই যে মাতবর এসেছে, ভালই হয়েছে। তোমরাই এর বিচার কর। তোমরা ছোটলোক হ’লেও তোমাদের মধ্যে ত ন্যায়-অন্যায় বিচার আছে। তোমাকেই সালিস মানলাম তুমি এর বিচার কর।”

“ওমন কথা মুহিও আনবেন না কর্তা। আপনারা ঐছেন মানি লোক। আপনাগো বিচার আমরা করতি পারি? কতাডা কি তাই আগে আমাকে বলেন।”

“শোন তবে বলি মাতবর। জান ত তোমার অনুরোধেই সে বছর আমি ওকে পনর টাকা কর্জ দিলাম। গত ভাদ্র মাসে ও আমাকে যেয়ে ধরল, কর্তা, গরীব মানুষ। এবারকার সুদের টাকা দিতে পারব না। হাতে পায়ে যেয়ে ধরতে লাগল। তখন কি করি! দয়ার শরীর ত। তোমরা আমাকে যাই মনে কর না কেন, কেউ এসে ধরলে আমি আপনা থেকেই গলে যাই। গলে যখন গেলাম তখন আর কি করি? বললাম আমার দুই বিঘা জমি চাষ করে দে, এ বছরে তোর থেকে আর কোন সুদ নিব না। তোমাদের মাতবর! সবাই বলে ছোটজাত। তা ছোটজাত হলেই কি লোকের ধর্ম-জ্ঞান থাকে না। এখন আজাহের বলে যে ওর জমিতে ও ধান বুনেছে। আমি জোর করে সেই ধান কাটতে এসেছি।”

“দেখেন সা-জী মশায়। বারবার আমাগো ছোটজাত কইছেন। আপনারা ত বড়জাত কিন্তুক বড়জাতের মত ব্যবহারডা ত দেখলাম না।”

“মিনাজদ্দী! মুখ সামলায়া কথা কইও। মনে রেখ তুমিও আমার কাছে দু’শ টাকা ধার।”

“মুখ সামলাব কার কাছে মশায়। আপনার ত কুত্তার মুখ। আমি জানি না? গত সন ভাদ্র মাসে এই বেচারী গরীব মানষির কাছ থাইকা আশি টাহা নিছেন জমির দাম। আইজ কইবার আইছেন জমি আপনার। দয়ার শরীর আপনার, জমিটা এরে দয়া কইরাই বুনবার দিছেন! আজ দয়া কইরাই গরীব মানষীর মুখির বাত কাইড়া নিবার আইছেন। এ জমির ধান আপনারে কাটপার দিব না।”

“দেখ মিনাজদ্দী! সাপ নিয়ে খেলা খেলছ–মনে রেখ। সদর কোর্ট, দেওয়ানী আদালত। মনে যেন থাকে। বড়শি দিয়ে টেনে এনে তবে নাগরদোলায় চড়াব।”

“আরে মশায়! দেখাওগ্যা তোমার দেওয়ানী আদালত। আমাগো আদালতের বিচারডা আগে কইরা নেই। আজাহের! চহি দেখতাছ না? ধান কাটপার লাইগা যাও।”

মিনাজদ্দী মাতবরের লোক আজাহেরের সঙ্গে ধান কাটা আরম্ভ করিয়া দিল।

শরৎ সাহা খানিকক্ষণ চাহিয়া দেখিয়া তাহার লোকজন লইয়া চলিয়া গেল।

সত্য সত্যই মিনাজদ্দী মাতবরের লোক আজাহেরের খেতের সমস্ত ধান একদিনেই কাটিয়া আনিল। আজাহেরের সমস্ত বাড়িখানা ধানে ভরিয়া গেল। আজাহের উঠানের এক পাশে ধানগুলি পরিপাটি করিয়া সাজাইল! সমস্ত বাড়িখানা নতুন ধানের গন্ধে ভরিয়া গেল। আজাহের একবার ধানের পালার দিকে চাহে আর একবার পাকা ধানেরই মত গায়ের রঙ তার বউয়ের দিকে চাহে। বউ-এর আজ মোটেই অবসর নাই। ধান উড়াইতে, ধান রোদে দিতে, কোন দিক দিয়া যে বেলা কাটিয়া যায় তা বুঝিতেও পারে না। বর্ষার দিনে যখন তখন মেঘ করিয়া বৃষ্টি নামে। তাড়াতাড়ি উঠানের ধানগুলি ঘরে আনিতে হয়। এত যে কাজ তবু তার এতটুকু পরিশ্রম হয় না।

সময় মত খাওয়া হয় না। সুন্দর করিয়া খোঁপা বাঁধা হয় না। বউ-এর সারা গায়ে ধানের কুটো জড়ানো। মাথার চুলে গুচ্ছ গুচ্ছ ধান ঝুলিতেছে। এগুলিতে আজ তাকে যা মানাইয়াছে! আজাহের ভাবে সোনা-রূপার গহনা পরিয়া সাজিয়া গুঁজিয়া যদি বউ থাকিত তাতেও তাকে অতটা মানাইত না।

ধান কাটা হইতে না হইতে পাট আনিয়া আজাহের বাড়িতে জড় করিল।

এই সব কাজকর্মে আজাহের শরৎ সাহার ভয় দেখানোর কথা সমস্তই ভুলিয়া গেল। গত বছর পাট বেচিয়া আজাহের ঠকিয়াছিল। এবার সে কিছুতেই ঠকিবে না। গ্রামের ফড়িয়া, পাটের বেপারীরা–নানা রকম গাল-গল্প করিয়া আজাহেরের প্রশংসা করিয়া বৃথাই ফিরিয়া গেল। আজাহের সমস্ত পাট মাপিয়া পাঁচ সের করিয়া ধড়া বাঁধিয়া মিনাজদ্দী মাতবরের নৌকায় করিয়া ফরিদপুরের হাটে যাইয়া পাট বেচিয়া আসিল। এবার পাট বেচিয়া আজাহের পাঁচশত টাকা পাইল। এই টাকা আনিয়া সে একটা মাটির হাঁড়িতে আবদ্ধ করিয়া হাঁড়িটা ঘরের মেঝেয় গাড়িয়া রাখিল।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x