(সাত)
সত্য সত্যই আজাহেরের জমিতে সোনা ফলিল। চার বিঘা জমির দুই বিঘাতে সে। পাট বুনিয়াছে আর দুই বিঘাতে ধান। পাটের ডগাগুলি যেন ল্যাক ল্যাক করিয়া আকাশ ছুঁইতে চায়। আর তার জমিতে যা ধান হইয়াছে, আকাশের মেঘভরা আসমানখানা কে তাহার জমিতে লেপিয়া দিয়াছে। বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ চলিয়া গেল। আষাঢ় মাসের শেষের দিকে খেতের শোভা দেখিয়া আজাহেরের আর বাড়িতে আসিতে ইচ্ছা করে না। খেতের মধ্যে একটা ঘাস গজাইলেই সে তাহা নিড়াইয়া ফেলে। তার চার বিঘা জমির উপর দিয়া যখন বাতাস দুলিয়া যায়, তখন তার অন্তরের মধ্যেও ঢেউ খেলিয়া যায়। সমস্ত খেতের শস্যগুলি যেন তার সন্তান। আজাহেরের ইচ্ছা করে, প্রত্যেকটি ধানের গাছ ধরিয়া, প্রত্যেকটি পাটের চারা ধরিয়া সে আদর করিয়া আসে।
সন্ধ্যা বেলায় আজাহের ঘরে ফিরিয়া যায়। ঘরে ফিরিতে ফিরিতেও আজাহের দুই তিনবার তার খেতের দিকে পিছন ফিরিয়া চায়। খেতের শোভা দেখিয়া তার আশ মেটে না। বাড়ি আসিয়া দেখে, বউ রান্না করিতেছে। তার পাশে একখানা পিড়ি পাতিয়া বসিয়া আজাহের বউ-এর সঙ্গে গল্প করিতে বসে। আর কোন গল্প নয়। ধানক্ষেতের গল্প, পাটক্ষেতের গল্প। ও-পাড়ার বরান খা আজ আজাহেরের খেতের আলি দিয়া যাইতে যাইতে বলিয়া গিয়াছে, তোমার খেতে খুব কামিল-কারী করিয়াছে মিঞা! তোমার ধানখেত না যেন সবুজ টিয়া পাখিগুলি শুইয়া আছে।
সেই কথা আজাহের আরো বাড়াইয়া বউ-এর কাছে বলে। শুনিতে শুনিতে বউ-এর মুখ খুশীতে ভরিয়া উঠে।
তারপর গামছার একটি খুঁট খুলিতে খুলিতে আজাহের বলে, “আমার পাটখেতে বউটুবানী ফুল ঐছিল। তোমার জন্যি নিয়া আইলাম।”
ফুলগুলিকে খোঁপায় জড়াইতে জড়াইতে বউ বলে, “ওবেলা যে পাট শাক তুইলা আনবার কইছিলাম, তা আমাগো বাড়ির উনি আনছে নি?”
“দ্যাহ, পাট শাক আমার তুলিতি ইচ্ছা করে না। ওরা যখন বাতাসের সঙ্গে হেইলা ল্যাগ ল্যাগ করে আমার মনে অয়, যিনি ওরা আমাগো পোলাপান। ওগো গায় ব্যথা দিতি মনডা যিনি কেমন করে।”
বউ এবার কতটা লজ্জা লজ্জা ভাব মিশাইয়া বলে, “দেহ, তোমারে একটা কথা কইবার চাই।”
“আমাগো বাড়ির উনি কি কতা কইবার চায় হুনি?”
“না কব না।”
“ক্যান কইবা না! কইতি অবি।”
আজাহের যাইয়া বউ-এর হাতখানা ধরে।
“ছাইড়া দাও। খুব লাগতাছে।”
“না ছাড়ুম না।”
এবার বউ আজাহেরের হাতখানায় কৃত্রিম কামুড় দিতে গেল।
আজাহের বলে, “আইচ্ছা কামড়াও, কুত্তা যখন ঐছ, তহন কামড়াও।”
“কি আমাগো বাড়ির উনি আমারে কুত্তা কইল? আমি কুনু কতা কইব না।”
“না না কুত্তা ঐবা ক্যান? তুমি ঐলা আমার ধানখেত, তুমি ঐলা আমার পাটখেত। তোমারে আমি নিড়ায়া দিব। তোমার গায়ে আমি পানি ঢালব।”
“হ হ বুজা গ্যাছে! তুমি খালি কতার নাগর। সারাদিন খেতে বইসা থাহ। আমার কতা একবার মনেও কর না। কও ত! খালি বাড়ি, আমি একলা বউ থাহি কি কইরা? যাও তুমি তোমার পাট লইয়াই থাহ গিয়া। রাত্তিরি আর বাড়ি আইলা ক্যান?” বলিতে বলিতে বউ কাঁদিয়া দিল।
সত্য সত্যই একথা ত আজাহেরের মনে হয় নাই। গত তিন মাস সে মাঠে মাঠেই কাটাইয়াছে। বাড়ি আসিয়া বউ-এর সঙ্গে খেত-খামারের কথাই আলাপ করিয়াছে। বউ-এর দিন কেমন করিয়া কাটে, সে কেমন আছে তাহার দিকে ত আজাহের একবারও ফিরিয়া তাকায় নাই। কাঁধের গামছার খোটে বউ-এর চোখ মুছিতে মুছিতে আজাহের নিজেই। কাঁদিয়া ফেলিল। সত্য সত্যই ত বউ-এর ঠোঁট দুখানা যেন কেমন নীল হইয়া গিয়াছে, শরীর যেমন ভার ভার। বউ-এর একখানা হাত নিজের বুকের মধ্যে পুরিয়া আজাহের বলে, “মনি! তুমি রাগ কইর না। আমি চাষা মানুষ। তোমারে কি কইরা আদর-যত্তন করতি অবি তা জানি না। আহারে! তোমার সোনার অঙ্গ মইলান অয়া গ্যাছে। আমি কি করবরে আজ?”
এবার বউ খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল, “কেমুন তুমারে জব্দ করলাম কি না?”
“আচ্ছা আমি পরাস্ত মানলাম। এবার কও ত সোনা! কি কতা কইবার চাইছিলা?”
“কইলি কি অবি? তুমি বুজবা না।”
“আচ্ছা কওই না একবার?”
“আইজ দুই মাস ধইরা আমার কেবলই গা বমি বমি করে, কিছুই খাইবার ইচ্ছা করে না।”
“তয় এদ্দিন কও নাই ক্যান? আমি এহনি রামে-রাজরে ডাইকা আনবানি, তোমারে ওষুধ করবার জন্যি।”
আজাহেরের মুখে একটা ঠোকনা দিয়া বউ বলিল, “তুমি কিছুই বোঝ না।”
“ক্যান বুঝব না? তোমার অসুখ ঐছে। আমি বুঝব না ত কি বুঝবি? তুমি বইস, আমি রামে-রাজরে ডাইকা আনি গিয়া।”
“আরে শোন? আমার খালি চাড়া চাবাইতে ইচ্ছা করে।”
“তা ঐলি তুমার অসুখ আরো কঠিন। রামে-রাজরে এহনি ডাকতি অবি।”
আজাহেরের মুখে আর একটি ঠোকনা মারিয়া বউ বলিল,–”তুমি ছাই বোঝ।”
এবার বউ হাসিয়া গড়াইয়া পড়িল। আজাহের ব্যস্ত সমস্ত হইয়া গামছাখানা মাথায় জড়াইয়া রামে-রাজের বাড়ি যায়ই আরকি। বউ তাহার হাত দুখানা ধরিয়া বলিল, “শোনই না একবার? আমারে দেইখা ও বাড়ির বু’জী কইছে কি!”
“কি কইছে? কও–কও।”
বউ আর একটু লজ্জিত হাসি হাসিয়া বলিল, “আমি কইবার পারব না। আমার সরম লাগে।”
“আমার সুনা, আমার নককী তুমি আমারে কও। আমার কাছে তুমার সরম কিসির?”
“তবে তুমি আমার মুহির দিগে চাইবার পারবা না। ওই দিগে চাও, আমি কই।”
আজাহের পিছন ফিরিয়া চাহিয়া বলিল, “এই আমি দুই হাতে চোখ বন্ধ করলাম, এবার তুমি কও।”
“তুমি কইলা না? তুমার খ্যাতের ধানগুলান তুমার কাছে কিসির মত লাগে যিনি?”
এবার আজাহের বউ-এর দিকে ফিরিয়া চাহিয়া বলিল, “কইলাম ত খ্যাতের ধানগুলা না যেন আমার একখ্যাত ভরা পুলাগুলা নাচত্যাছে।”
বউ আজাহেরের মুখে আর একটা ঠোকনা দিয়া বলিল, “যাও তুমি আমার দিগে চাইতাছ।”
“না না এই যে আমি অন্য দিগে চাইলাম।”
“ও বাড়ির বুজী কইছে কি, আর কয়মাস পরে আমার তাই ঐব।”
“কি কইলা? পুলা ঐব। আমার পুলা ঐব। ও মাতবরের বেটা, হুইনা যান। হুইনা যান। রবানের বাপরে ডাক দেন।”
“আরে চুপ চুপ! মানুষ হুনলি কি কইবি।” বউ তার দুখানা সোনার হাত দিয়া আজাহেরের মুখখানা চাপিয়া ধরিল। কিন্তু আজাহেরের মনের তুফানে সেই সুন্দর হাত দু’খানা কোথায় ভাসিয়া গেল। ডাক শুনিয়া মিনাজদ্দী মাতবর আসিয়া উপস্থিত হইল। রবানের বাপ আসিয়া উপস্থিত হইল। বউ ত লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশিয়া যাইতে চায়। সেদিকে আজাহেরের কোন খেয়ালই নাই।
“কি আজাহের খবর কি?”
“বসেন মাতবর সাহেব। খবর বড় ভাল খবর। আমাগো ও-পাড়ার বচন মোল্লারে ডাক দিতি অবি। রহিমদ্দী কারিকররেও ডাকতি অবি?”
“ক্যান মিঞা! লগনডা কি?”
“লগন আর কি! আমার বাড়িউয়ালী, কইবার ত চায় না। অনেক নিরায়া পিরায়া করতি করতি তয় কইছে, আর একমাস পরে আমার একটা পুলা অবি!”
বউ রান্নাঘরের ও-পাশ হইতে আজাহেরকে কত রকম ইসারা করিতেছে সেদিকে আজাহেরের খেয়ালই নাই।
“বুজছেন নি মাতবরের পো? আমার একটা পুলা অবি! খ্যাতে যহন দুইপার বেলা। তিষ্টাতে ছাতি ফাঁইটা যাইতি চাবি তহন আমার পুলা পানির বদনা নিয়া খ্যাতে যাবি। তামুক সাইজা নিয়া হাতে উক্কা দিবি। পুলার হাতে লাঙলের গুটি সইপা দিয়া একপাশে দাঁড়ায়া তামুক খাব আর পুলার হাল বাওয়া দেখপ।”
“খুব খুশীর কতা আজাহের। তবে আইজ খুশীর দিনি তোমার বাড়ি একটু গান-বাজনা ওক। খাড়াও, আমি গেরামের সগলরে ডাক দিয়া আনি! তুমি পান-তামুক জোগার কর।”
আধঘণ্টার মধ্যে আজাহেরের সমস্ত বাড়িখানা ভরিয়া গেল। ও-পাড়া হইতে রহিমদ্দী কারিকর আসিল। বচন মোল্লা আসিল। তিলাজুদ্দী, ভুমুরদ্দী কেউ কোথাও বাদ রহিল না। খুঞ্জরীর বাজনায় আর গ্রাম্য-গানের সুরে সমস্ত গ্রামখানা নাচিয়া উঠিল।
প্রায় শেষ রাত পর্যন্ত গ্রামবাসীরা আনন্দ কোলাহল করিয়া যার যার বাড়ি চলিয়া গেল।
আজাহেরের মুখে ঠোকনা মারিয়া বউ বলিল, “বলি আমাগো বাড়ির উনির কি লজ্জা সরম একেবারেই নাই? এত লোকের মধ্যে ওই কথা কইল, সরম করল না?”
“সরম আবার কিসের? আমাগো পুলা অবি। তা সগলরে জানাইয়া দিলাম। আমি এবার পুলার বাপ। ও-পাড়ার ঝড়! এতটুকুন ছাওয়াল, আমারে ডাকে, ও আজাহের! হুইনা যাও। ইচ্ছা করে যে মারি এক থাপর তার মুখ পাইচা। আমি যেন কেউকেডা নয়। এবার মানষি জানুক আমি পুলার বাপ। আমার গুণে যদি আমারে মানতি না চায় আমার পুলার গুণে মানবি।”
“পুলা হওয়ার আগেই ত তুমি অহঙ্কারে ফাঁইটা পড়লা। আগে পুলা হোক ত।”
তারপর দুইজনে বিছানায় শুইয়া গলাগলি ধরিয়া কথা আরম্ভ হইল। এবার পাট বেচিয়া আজাহের পুলার পায়ের ঝাজ কিনিয়া আনিবে। নারকেল গাছের পাতা দিয়া ভেপু বাঁশী বানাইবে। বউ পুলার কাথার উপর বিড়াল আঁকিয়া রাখিবে। পুলা দুধের বাটি মুখে দিতে দিতে বলিবে,–”ওমা! বিলাই খেদাইয়া যাও। আমার দুধ খায়া গেল।”
আজাহের বলে, সে পুলার জন্য শোলা কাটিয়া পাখি বানাইয়া দিবে। পুলা তার মাকে ডাকিয়া বলিবে,–”ওমা! আমারে ত খাইবার দিলা। আমার পাখিরে ত দিলা না?”
এমনই কত রকমের কথা। পুলা বড় হইয়া খেত হইতে ধান টোকাইয়া আনিবে। মাকে আসিয়া বলিবে, “ওমা! এখুনি আমারে এই ধান দিয়া পিঠা বানায়া দাও।”
এমনই কথায় কথায় কখন যে রাত কাটিয়া গেল, তাহারা টেরও পাইল না।
“বোবা কাহিনী” উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ