(ছয়)
“বলি, সা–জী মশায়! বাড়ি আছেন নাকি?”
“এই দুপুর বেলা কে এল? আজাহের নাকি?”
“স্যালাম কর্তা স্যালাম।”
“স্যালাম, স্যালাম;–তা কি মনে করে আজাহের?”
“এই আইলাম কর্তা, আপনার টাহা কয়ডা দিবার জন্যি।”
“বটে! এরই মধ্যে টাহা জোগাড় করে ফেললি! তুই ত কম পাত্র নস রে!”
“হে কর্তা! আজই পাট বেচলাম কিনা। তা ভাবলাম আপনার টাহা কয়ডা দিয়া আসি।”
“তা কত টাকা বেচলি?”
“এই বেশী নয় সা–জী মশায়। চাইর কুড়ি টাহা।”
সা–জী মশায় এবারে চেয়ারের উপর একটু ঘুরিয়া বসিলেন। আজাহের মাটির উপর একখানা ছালা টান দিয়া তাহার উপর বসিল।
বলিল, “কিরে এত টাকায় পাট বেচেছিস? তবে এবার এক কাজ কর। এই টাকা দিয়ে আরো কিছু জমি কিনে ফেল।”
“জমি আর কি কইরা কিনব কর্তা! আপনার কর্জ টাহা শোধ দিতি অবি। তা ছাড়া। বছরের খোরাকি আছে।”
“আরে আমার টাকার জন্য তুই ভাবিস নি। পনর টাকার ভারি ত সুদ। মাসে মাত্র দু’আনা কম দুটাকা। এ তুই যখন পারিস দিস। এক কাজ কর গিয়া। পলার চরে আমার দুই বিঘা জমি আছে। তার দাম দুইশ’ টাকা। তা তোকে আমি একশ টাকায় দিতে পারি।”
“এত টাহা কোথায় পাব কর্তা! মাত্র চার কুড়ি টাহা পাট বেচছি।”
“তার জন্য ভাবিস না। তুই আশি টাকা এখন দে। তারপর আগাম সন জমিতে ফসল হোলে বাকি টাকাটা দিয়ে দিস!”
“এত দয়া যদি করেন কর্তা, তা ঐলে ত গরীর মানুষ আমরা বাইচা যাই।”
“আরে গরীর–গরবা দেখতে হয় বলেই ত মারা গেলাম। এই দেখ, চরের জমিটার জন্য ও পাড়ার কালু সেখ এসে সেদিন একশ’ পঞ্চাশ টাকা নিয়ে কত সাধাসাধি। কিন্তু তোকে দেখে একশ টাকায়ই দিয়ে ফেললাম। আমার গিন্নি ত আমার উপর রেগেই আছে। বলে যত গরীব গরবাকে দয়া করা তোমার কারবার। আরে দয়া কি আমি করি–দয়া উপরওয়ালার।” এই বলিয়া সা–জী মশায় দুই হাত কপালে ঠেকাইলেন।
কলকেটি আগুনের পাতিলের কাছে পড়িল ছিল। কথা বলিতে বলিতে আজাহের তাহাতে তামাক ভরিয়া নিপুণ হাতে তার উপর আগুন সাজাইয়া সা–জী মশায়ের হাতে দিল। সা–জী মশায়ের সামনের রূপা বাধান হুঁকোটির মাথায় কলকেটি বসাইয়া খানিকক্ষণ টানিয়া আজাহেরের হাতে দিল। দুই হাতের আঙ্গুলের মধ্যে কলকেটি সুন্দর করিয়া জড়াইয়া আজাহের সমস্ত শরীরের দম লইয়া গলগল করিয়া কলকেটিতে টান দিল। টানের চোটে কলকের মাথায় আগুন জ্বলিয়া উঠিল। নাকে মুখে একরাশ খুঁয়ো বাহির করিয়া আজাহের কহিল–”তা বাইবা দেহি সা–জী মশায়। ও বেলা আসপানি।” “অত ভাবিস যদি, কাজ নাই তবে জমি কিনে। আজ বিকালে কালু সেখের আসার কথা আছে। সে যদি আরো কিছু দাম বাড়ায় তবে হয়ত তাকেই দিয়ে ফেলতে হবে। তোর বরাত মন্দ–কি করবো?”
“না, সা–জী মশায়! আমি এক্কে দৌড়ে যাব আর এক্কে দৌড়ে আসপ। আপনি জমিনটা অন্যেরে দিবেন না।”
“আরে হাকিম নড়ে ত হুকুম নড়ে না। কথা যখন একবার তোকে দিয়ে ফেলেছি তখন তুই যদি জমি নিস অন্য কাউকে দিব না। তাড়াতাড়ি টাকা নিয়ে আয়।”
আজাহের সা–জী মশায়কে সালাম করিয়া তাড়াতাড়ি টাকার জন্য বাড়িতে ছুটিল।
জীবন ভরিয়া আজাহের মানুষের কাছে শুধু ঠকিয়াছে। কতবার সে প্রতিজ্ঞা করিয়াছে–আর সে মানুষকে বিশ্বাস করিবে না। নিজের প্রাপ্য একটি কানাকড়িও সে কাউকে ছাড়িয়া দিবে না। কিন্তু হতভাগ্য আজাহের জানে না, এই পৃথিবীতে যাহারা ঠকাইয়া বেড়ায়, নিত্য নিত্য তাহারা নিজেদের পোশাক বদলাইয়া চলে, ধর্ম নেতার বেশে, সাধু–মহাজনের বেশে, গ্রাম্য মোড়লের বেশে, কত ছদ্মবেশেই যে এই ঠকের দল ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, মূর্খ আজাহের কি করিয়া তাহাদের হাত হইতে রক্ষা পাইবে? এ–পথে সাপিনীর ভয় ওপথেতে বাঘে খায়। এই ত জীবনের পথ।
বাড়ি হইতে টাকা লইয়া আসিতে আসিতে আজাহেরের মনে দু’একবার যে সা–জী মশায়ের সাধুতার প্রতি সন্দেহ না হইল তাহা নহে, কিন্তু এমন ধার্মিক লোক, এমন মিষ্টি যার মুখের কথা, এমন ধোপ–দোরস্ত পোশাক পরিয়া যে সব সময় ফেরে তার প্রতি কি সত্য সত্যই সন্দেহ করা যায়? নিজের মনে মনে সে তাহার সাধুতার প্রতি যে সন্দেহ পোষণ করিয়াছে, সে জন্য সে অনুতাপ করিল। সা–জী মশায়ের বাড়ি যাইয়া, চলার মত। আশিটি টাকা সে গণিয়া দিয়া আসিল। না লইল কোন রসিদ পত্র, না রহিল কোন সাক্ষী–সাবুদ!
সা–জী মশায় হাসিয়া বলিল, “তাহলে আজাহের আজ হ’তে তুই জমির মালিক হলি।”
আল্লাদে আজাহেরের বুকখানা দুলিয়া উঠিল। সা–জী মশায়কে সালাম জানাইয়া জোরে জোরে সে পা চালাইয়া বাড়ি চলিল। যাইবার সময় আজাহেরের নাচিতে ইচ্ছা করিতেছিল। সব মিলিয়া এখন তাহার চারি বিঘা পরিমাণ জমি হইল। সেই চারি বিঘা জমিতে আজাহের পাট বুনিবে, ধান বুনিবে, সরষে ফলাইবে, মটরশুটি ফলাইবে। তার বউ সেই খেতে এক মাথা ঘোমটা পরিয়া শাক তুলিতে আসিবে।
“বোবা কাহিনী” উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ