(পাঁচ)
দুপুরের রোদে আজাহের সেই কোমরে বাধা টাকাগুলি লইয়া শরৎ সাহার বাড়ির দিকে রওয়ানা হইল।
আলীপুরের ওধারে সাহা পাড়া। হালটের দুইধারে বড় বড় টিনের ঘরওয়ালা বাড়িগুলি। আম, জাম, কাঁঠালগাছগুলি শাখা বাহু বিস্তার করিয়া এই গ্রামগুলিকে অন্ধকার করিয়া রাখিয়াছে। হালটের পথে সাহাদের সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়েগুলি খেলা করিতেছে। তাহাদের প্রায় সকলের গলায়ই মোটা মোটা সোনার হার। কাহারো বাহুতে সোনার তাবিজ বাধা। কপালে সিঁদুর পরিয়া কাঁখে পিতলের কলসী লইয়া দলে দলে সাহা গৃহিণীরা নদীতে জল আনিতে যাইতেছে। তাহাদের কাখের ঘসামাজা পিতলের কলসীর উপর দুপুর বেলার রৌদ্র পড়িয়া ঝকঝক করিতেছে। সাহারা এই অঞ্চলে সবচাইতে অবস্থাপন্ন জাতি, কিন্তু পানীয় জলের জন্যে মুসলমানদের মত তাহারা বাড়িতে টিউবওয়েল বা পতাকুয়া বসায় না। তাহাদের, মেয়েরাই নদী হইতে জল লইয়া আসে। সেই জন্য গ্রামে কলেরা হইলে আগে সাহা পাড়ায় আরম্ভ হয়। নানা রকমের সংক্রামক রোগে তাই ধীরে ধীরে উহাদের বংশ লোপ পাইতে বসিয়াছে।
পূর্বে সাহারা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য দেশে-বিদেশে গমন করিত। এদেশের মাল ও-দেশে লইয়া গিয়া, ও-দেশের মাল এ-দেশে আনিয়া তাহারা দেশের সম্পদ বাড়াইত। পল্লী-বাংলার অনেকগুলি রূপরেখা তাই সাহা, সাধু-সওদাগরদের কাহিনীতে ভরপুর। আজও পল্লী গ্রামের গানের আসরগুলিতে গায়কেরা কত সাধু-সওদাগরের, শখ-বণিকের দূরের সফরের কাহিনী বর্ণনা করিয়া শত শত শ্রোতার মনোরঞ্জন করে। কবে কোন নীলা-সুন্দরীর মাথার কেশে-লেখা প্রেম-লিপি পড়িয়া কোন সাহা বণিকের ছেলে সুদূর লঙ্কার বাণিজ্যে বসিয়া বিরহের অশ্রুবিন্দু বিসর্জন করিয়াছিল, তাহার ঢেউ আজো গ্রাম্য-রাখালের বাঁশীতে রহিয়া রহিয়া বাজিয়া উঠে।
কিন্তু কিসে কি হইয়া গেল! সাহারা আয়াসপ্রিয় হইয়া পড়িল। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের অদুনা পদুনার শাড়ীর অঞ্চল ছাড়িয়া তাহারা আর সংগ্রাম-সঙ্কুল বিদেশের বাণিজ্যে যাইতে চাহিল না। পুব বাংলার দেশ-বিদেশের বাণিজ্য-ভার সাহাদের হাত হইতে সরিয়া গিয়া বিদেশী মাড়োয়ারী এবং অন্যান্য জাতির উপর পড়িল। নানা বিলাস ব্যসনে ডুবিতে ডুবিতে তাহারা লাভ-মূল সবই খোয়াইল। বাংলার সাহা সমাজ কুসীদজীবীতে পরিণত হইল। সামান্য ব্যবসা-বাণিজ্য যা তাহারা করে তাহাও নামে মাত্র। এখন তাহাদের মুখ্য ব্যবসা মূর্খ গেঁয়ো চাষীদের মধ্যে উচ্চহারের সুদে টাকা খাটান।
সাহাদের প্রত্যেক বাড়িতে একখানা করিয়া বৈঠকখানা। সেই বৈঠকখানার একধারে চৌকি পাতা। তাহার উপরে চাদর বিছান। তারই এক কোণে কাঠের একটি বাক্স সামনে করিয়া বাড়ির মূল মহাজন বসিয়া থাকেন। পাশে দুই একজন বৃদ্ধ বয়সের গোমস্তা। ডানাভাঙ্গা চশমায় সূতো বাধিয়া কানের সঙ্গে আঁটকাইয়া তাহারা বড় বড় হিসাবের খাতা লেখে। মূল মহাজন মাঝে মাঝে কানে কানে কি বলিয়া দেন। তাহারা ইসারায় সায় দিয়া আবার খাতা লেখায় মনোনিবেশ করে। মহাজনের মাথার উপর গৌরাঙ্গদেবের সন্ন্যাসের ফটো। তারই পাশে নামাবলি গায়ে হরিনাম জপ-রত মহাজনের গুরুঠাকুর বা পিতৃদেবের ফটো। তাহার উপরে চন্দনের ফোঁটা। প্রতিদিন সকালে বিকালে ধূপ ধুনা দিয়া সেখানে নত হইয়া মহাজন পূজা করেন। এই সমস্ত উপকরণই যেন তার কুসীদজীবী নিষ্ঠুর জীবনের মর্মান্তিক উপহাস। ঘরের চৌকির ওপাশের মেঝে লেপাপোছা। একধারে কতকগুলি ছালা গোটান। সমবেত খাতকেরা এবং টাউটেরা সেই ছালার উপরে বসিয়া নানা রকমের চাটুবাক্য বলিয়া মহাজনের মনস্তুষ্টি করিবার চেষ্টা করে। একপাশে একটি আগুনের পাতিল। তাহা হইতে ঘুটার ধুয়া উঠিতেছে। তারই পাশে চার পাঁচটি পিতল বাধান তেলো হুঁকো। তাহার একটি ব্রাহ্মণের জন্যে, একটি কায়স্থের জন্য, একটি মূল মহাজনের জন্যে। সমবেত মুসলমান খাতকদের জন্য কোন হুঁকো নাই। তাহারা কলিকায়ই তামাক সেবন করে।
মহাজনের খাতাগুলি আবার নানা ধরনের। যাহারা তামা-কাসা বন্ধক রাখিয়া অল্প টাকা লয় তাহাদের জন্য এক খাতা, যাহারা সোনা-রূপা বন্ধক দিয়া টাকা লয় তাহাদের জন্য এক খাতা, যাহারা কোনকিছু বন্ধক না দিয়াই টাকা কর্জ করে তাহাদের জন্য এক খাতা, আবার যাহারা মহাজনের বাড়িতে তিন বৎসর খাঁটিয়া যাইবে এই অজুহাতে বিনা সুদে টাকা কর্জ করিয়াছে তাহাদের জন্য এক খাতা।
মহাজনের টাকা আবার নানা নামে খাটে।
কতক টাকা কর্জ দেয় স্ত্রীর নামে, সেই কবে স্ত্রী বউ হইয়া ঘরে আসিয়াছিল, তখন মহাজনের পিতা দশটি টাকা দিয়া নববধূর মুখ দর্শন করিয়াছিলেন, আজ সেই টাকা সুদে ফাপিয়া দশ হাজার টাকায় পরিণত হইয়াছে। তার ছেলে শহরে যাইয়া পড়াশুনা করে। জলপানের টাকা হইতে বাঁচাইয়া সে পিতার নিকট সুদে খাটাইবার জন্য পাঁচ টাকা দিয়াছিল তিন বৎসর আগে। তাহাও এখন সুদে ফঁপিয়া তিনশত টাকায় পরিণত হইয়াছে। এইভাবে নানা তহবিল হইতে মহাজনকে নানা প্রকারের টাকা কর্জ দিতে হয়।
ইহা ছাড়া জমা উসুল বকেয়া, পূজার বৃত্তি, পুণ্যার বৃত্তি আরও কত রকমের জটিল। হিসাব তাহাকে রাখিতে হয়। মহাজনের গদীর অর্ধেক স্থান জুড়িয়া কেবল খাতার উপরে খাতা। কিন্তু এতসব খাতাতে দিনের পর দিন চার পাঁচজন গোমস্তা বসিয়া শুধু কলমের খোঁচায় যে অঙ্কের উপর অঙ্কের দাগ বসাইয়া যাইতেছে, তাহার সবগুলি অক্ষর মহাজনের কণ্ঠস্থ। যদি বা কখনো এতটুকু ভুল হইবার উপক্রম হয় পাশের গোমস্তারা তাড়াতাড়ি করিয়া তাহা সংশোধন করিয়া দেয়।
সাহাপাড়া আসিয়া আজাহের দেখিল লোকে লোকারণ্য। আশেপাশের নানা গ্রাম হইতে চাষী মুসলমান ও নমঃশূদ্রেরা এখানে আসিয়া ভীড় করিয়াছে। কেহ টাকা কর্জ লইয়া হাসিতে হাসিতে বাড়ি যাইতেছে। কেহ কর্জ টাকা দিতে আসিয়া সুদের অঙ্ক শুনিয়া মহাজনের পা ধরিয়া কঁদিতেছে, কেহ বউ-এর গহনা আনিয়া মহাজনের গদিতে ঢালিয়া দিতেছে। মহাজন নিক্তিতে করিয়া অতি সাবধানে সেই সোনা-রূপার গহনা মাপিয়া লইতেছে।
এইসব দেখিতে দেখিতে আজাহের শরৎ সাহার বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইল। শরৎ সাহার বাড়িতে লোকজনের ভীড় খুব কম। কারণ কুলোকে বদনাম রটাইয়াছে “চীনা জেঁকে ধরিলেও ছাড়িয়া যায় কিন্তু খাতকের শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকিতে শরৎ সাহা ছাড়ে না।” এত যে তার টাকা, কিন্তু সকালে একমুঠো চাউল মুখে দিয়া সে জলযোগ করে। বাজার যখন ভাঙ্গি ভাঙ্গি করে তখন শেষ বাজারে শরৎ সাহা যাইয়া পচা পুঁটিমাছ অথবা টাকিমাছ কিনিয়া আনে। এজন্য গৃহিণীর সঙ্গে তাহার প্রায়ই ঠোকাঠুকি লাগে।
বড় মেয়েটিকে বিবাহ দিয়াছে মানিকগঞ্জ গ্রামে। কাল জামাই আসিয়াছিল। এই খবর পাইয়াই শরৎ সাহা খিড়কীর দরজা দিয়া ভাঙ্গা ছাতির আড়াল করিয়া সেই যে সকাল বেলা তাগাদা করিতে ভাটপাড়ার গ্রামে গিয়াছিল আর ফিরিয়া আসিয়াছে রাত বারোটার সময়। শ্বশুরবাড়িতে দুপুর বেলায় শুকনো ডাটার ঝোল আর পচা আউস চাউলের ভাত খাইয়া জামাই চলিয়া গিয়াছে। অতরাত্রে বাড়ি আসিয়া গৃহিণীকে ঘুমাইতে দেখিয়া আহ্লাদে শরৎ সাহার নাচিতে ইচ্ছা করিতেছিল। গৃহিণী জাগিয়া থাকিলে নথ-নাড়া দিয়া বকিতে বকিতে তাহাকে সারা রাত্রি ঘুমাইতে দিত না। না হয় সে সারাদিন খায় নাই কিন্তু রাত্রটা ত সে ঘুমাইতে পারিবে। এই আনন্দে কলসী হইতে তিন গ্লাস জল লইয়া এক মুঠি চাউলসহ গলাধঃকরণ করিয়া সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু সকাল বেলা উঠিয়া গৃহিণীর হাত হইতে সে নিস্তার পায় নাই। যতই সন্ধ্যা আহ্নিক করার অজুহাতে সে মালা-চন্দন লইয়া জপে মনোযোগ দিতে চেষ্টা করিয়াছে গৃহিণীর ঝঙ্কার ততই উদারা মুদারা ছাড়াইয়া তারায়–পঞ্চমে উঠিয়াছে।
পরে গৃহিণীর জ্বালায় অস্থির হইয়া সে বলিয়াছে,”ভাল মানুষীর বউ। একটু মন দিয়া শোন। জামাইর সঙ্গে যদি আমি দেখা করতাম তবে বাজারে যেতে হত। বড় একটা রুইমাছ না হলেও অন্ততঃ দেড় টাকা দিয়ে একটা ইলিশমাছ কিনতে হত। দুধও আনতে হ’ত। বলত পাঁচ টাকার কমে কি বাজার করতে পারতাম? আমার বুকের হাড্ডির মত এই পঁচটা টাকা বাজারে নিয়ে ঢেলে দিয়ে আসতে হত। এই পাঁচটাকা সুদে খাটালে পাঁচ বছরে দুশো টাকা হবে। দশবছরে হাজার টাকা হবে।”
গৃহিণী ঝঙ্কার দিয়া উত্তর করিয়াছে, “ওরে মুখ-পোড়া! টাকার প্রতি যদি তোর এত দরদ তবে মেয়ের জন্ম দিয়েছিলি কেন? শ্বশুর বাড়িতে শুকনো ডাটার ঝোল খেয়ে জামাই আমার মেয়েকে যখন খোটা দিবে তখন কি তোর টাকা তার উত্তর দিতে যাবে? আজ পাঁচ বচ্ছর মেয়েটাকে বিয়ে দিয়েছি, একখানা পান-বাতাসা হাতে করে মেয়েটাকে দেখতে গেলে না! মেয়েকে আনার নাম করলে ত চোখ চড়ক গাছ।”
শরৎ সাহা এবার রাগিয়া উত্তর করিয়াছে, “সব কাজেই কেবল তোমার খরচ করবার। মতলব। কিসে দু’টো পয়সা আসে সে দিকে খেয়াল নেই। ছিলে ত গরীব বাপের বাড়ি, এক বেলাও আখায় হাঁড়ি চড়তো না!”
তারপর গৃহিণীর সঙ্গে শরৎ সাহার যে ধরনের কথাবার্তা হইয়াছে পৃথিবীর কোন ভাষা তাহা ধরিয়া রাখিবার শক্তি রাখে না। নিতান্ত সাধারণ রুচির কষ্টিপাথরে ঘষিয়া মাজিয়া তাহার কিঞ্চিৎ আমরা লিপিবদ্ধ করিলাম।
“কি! তুমি আমার বাপের খোটা দিয়ে কথা বল? বলি ও যুয়ান কি শোগা! তোর মত বুড়ো শুশানের-মড়ার সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে আমার বাপ-মা যে তোকে সাতকুলে উঠিয়েছে তা কি তোর মনে নেই? তোর ঘরে খেটে খেটে আমি জীবন ক্ষয় করলাম, একদিন একখানা ভাল শাড়ী কারে কয় দেখলাম না।”
“শাড়ীরই যদি দরকার তবে তোমার বাপ-মা তোমাকে তাঁতীদের বাড়ি বিয়ে দিল না। কেন?”
“তাও যদি দিত আমার শত গুণে ভাল হ’ত। তোর বাড়িতে এসে কোনদিন একটা মিষ্টি কথা শুনতে পেলাম না। দিনরাত তোর শুধু টাকা, টাকা, টাকা। বলি ও গোলামের নাতি! সারাদিন টো টো করে ঘোরো খাতকের পাড়ায় পাড়ায়, আর বাড়িতে এসে মহাজনি খাতা সামনে করে মরা-খেকো শকুনের মত বসে থাকো। বলি ও কুড়ের নাতি!–তোর ঐ খাতা পত্তর আজ আমি উনুনে দিয়ে পুড়িয়ে ফেলব।”
“আহা হা গিন্নি রাগ করো না। এই খাতা পত্তরগুলো হ’ল আমার বুকের পাজর। ওর পাতা ছিড়লে আমি বাচবো না। একটা কথা শোন–লোকে বলে শরৎ সাহা খায় না। তার শরীরে বল নেই। কিন্তু আমার বল যে ওই হিসাবের খাতাগুলো। ও গুলো দিনে দিনে। যত বাড়ে আমার বুকের তাগতও তত বাড়ে, একথা কেউ জানে না। এই খাতাগুলোর জোরে আজ আমি দশগ্রামের মধ্যে একটা কেউকেটা। আমার হুকুমে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়। তোমার যে দশটাকা ভাটপাড়া গাঁয়ে সুদে খাঁটিয়েছিলাম, চার বছরে তা বেড়ে একশ টাকা হয়েছে। কাল সেই টাকাটা পেয়েছি।”
“দাও তবে আমার সে টাকা। সেই টাকা দিয়ে আমি মেয়ের বাড়িতে তথ্য পাঠাব।”
“এইত, এই তুমি একটা নামাঙ্কুলের মত কথা বললে। টাকা কি আমি বাড়িতে নিয়ে এসেছি? তখন তখনই টাকাটা অপরের কাছে সুদে লাগিয়ে এলাম। বাড়িতে যদি নিয়ে আসতাম, সারারাত তাই পাহারা দিতে ঘুম আসত না। লোকে বলে, শরৎ সাহা লাখপতি না কোটীপতি, কিন্তু বাপের নাম করে প্রতিজ্ঞা করে বলতে পারি–জীবনে কোনদিন একত্রে পাঁচশত টাকার মুখও দেখি নি!”
“তবে তোমার অত মুরাদ কিসের?”
“আরে গিন্নি–একটু মনোযোগ দিয়ে শোন। আমার লাখ টাকা আছে না কোটী টাকা আছে তা তোমাকে দেখাতে পারব না, কিন্তু আমার সারাটি জীবন ভরে পাওনাগণ্ডার হিসাব লিখে যত সব খাতা পত্তর লিখেছি তা মাটিতে বিছিয়ে দিলে গয়া, কাশী, বৃন্দাবন পর্যন্ত সমস্ত পথ আমি মুড়ে ফেলতে পারি। টাকা, টাকা, টাকা! টাকা ঘরে এনে কি হবে! টাকায় টাকা আনে। সেই জন্য টাকা ছড়িয়ে দিয়েছি। আমার পাঁচ’শ ঘর খাতক আছে সুন্দরবন অঞ্চলে। হাজার ঘর খাতক আছে বঙ্গোপসাগরের ওপারে কুতুবদিয়ার চরে। দশ হাজার খাতক আছে সন্দ্বীপে, ভাটপাড়া, মুরালদাহ, কত গ্রামের নাম তোমাকে বলবো। মুন্সীগঞ্জে ইকিড়ি মিকিড়ি কথা বলে, বেদের দল, নায়ে নায়ে ঘুরে বেড়ায়, সেখানে আছে আমার বিশ হাজার খাতক। আর তুমি গিন্নি। তুলসীতলায় পেন্নাম করে আমার জন্য। দেবতার আশীর্বাদ এনো। আর যদি কুড়ি বছর বেঁচে থাকি তবে কৃষ্ণের গোলকখানি আমার খাতকে ভরে যাবে। জান গিন্নি সাধে কি লোকে বলে আমার নাম শরৎ সাহা!”
“পাড়ার লোকেরা বলে কি জান? সকাল বেলা উঠে তোমার নাম যদি মুখে আসে তবে সেদিন তাদের আহার জোটে না। কঞ্জুস যক্ষ কোথাকার! আমার কাশি দিয়ে রক্ত পড়ছে কতদিন। লোকে বলে যক্ষ্মা হয়েছে। আমার জন্য একফোঁটা ঔষধ কিনে আনলে না?”
“তোমাকে না বলেছিলাম রামেরাজকে ডেকে জল পড়িয়ে খেও। তা খাওনি? তোমার কেবল টাকা খরচের দিকে মন?”
“রামেরাজের পড়া জল ত কত খেলাম কিন্তু আমার অসুখ একটুও কমলো না। দেখ, তোমার পায়ে পড়ি, আমাকে একটু ভাল ঔষধ আনিয়ে দাও।”
“দেখ গিন্নি! টাকা পয়সা খরচের দিকে তুমি কিছুতেই আমাকে নিতে পারবে না। তোমার আগে আমি আরও দুই বিয়ে করেছিলাম। বড় জন বড়ই সুন্দরী ছিল। সান্নিপাতিক জ্বর হ’ল, মরে গেল, পয়সা খরচ করে ডাক্তার দেখালাম না। তারপর যিনি এলেন, তার ছিল বড় ঝুঁজ, এই তোমারই মতন, একদিন সিন্দুকের চাবি চুরি করে টাকা বের করে তার বাপকে দিয়েছিল। আমি তার মুখে কলকে পোড়া দিয়ে ছাপ লাগিয়ে দিয়েছিলাম। সেই লজ্জায় সে গলায় দড়ি দিয়ে মরল।”
“তারা মরে সকল জ্বালা জুড়িয়েছে। ওগো তোমার পায়ে পড়ি, তুমি আমাকে গলাটিপে মেরে ফেল। তোমার মত কঞ্জুসের ঘর করার চেয়ে আমার মরাও ভাল। বলি ও মরা কাঠ! তোর ঐ টাকা কে খাবে? আমার এমন সুন্দর ছেলেটি পাঁচ বছর বয়সে বাড়ির এখানে সেখানে হরিণের মত ঘুরতো। ওলাউঠা ব্যারাম হোল। বিনা চিকিৎসায় মারা গেল। পয়সা খরচ হবে বলে একজন ডাক্তার এনে দেখালে না।”
এমন সময় বাহিরে গলা খেকর দিয়া আজাহের ডাক ছাড়িল, “সা-জী মশায় বাড়ি আছেন নাকি?”
আজাহেরের কণ্ঠস্বর শুনিয়া গৃহিণী অন্দরে চলিয়া গেল।
বস্তুতঃ গৃহিণীর সঙ্গে উপরোক্ত বাক্যালাপ করিয়া শরৎ সাহার মেজাজ খারাপ হইয়া পড়িয়াছিল কিন্তু খাতকের কণ্ঠস্বর যেন বাঁশীর স্বরের মত, তাহাকে আপন মূর্তিতে প্রতিষ্ঠিত করিল।
“বোবা কাহিনী” উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ