(চল্লিশ)
আজ তিন চার দিন বছির বাড়ি আসিয়াছে। সেই যে সেদিন নিজের বোনা কথাখানা গোটাইয়া লইয়া ফুলী চলিয়া গিয়াছে আর সে ফিরিয়া আসিয়া বছিরের সঙ্গে দেখা করে নাই।
সেদিন বিকালে বছির কি একখানা বই খুলিয়া বসিয়া আছে। এমন সময় ফুলী আসিয়া ঘরের দরজা ধরিয়া দাঁড়াইল। বই-এর মধ্যে বছির এমনই মশগুল, সে চাহিয়াও দেখিল না কে আসিয়াছে। বৃথাই ফুলী দুই হাতের কাঁচের চুড়িগুলি নাড়িল চাড়িল। পরনের আঁচলখানা মাথা হইতে খুলিয়া আবার যথাস্থানে বিন্যস্ত করিল। বছির ফিরিয়াও চাহিল না। তখন যেন নিরুপায় হইয়াই ফুলী ডাকিল, “বছিরবাই!”
বছির বই-এর মধ্যেই মুখ লইয়া বলিল, “ফুলী! তুমি মার সঙ্গে যায়া কথা কও। আমি এহন খুব দরকারি একখানা বই পড়ত্যাছি।”
ফুলীর ইচ্ছা করিতেছিল বলে, “বছিরবাই! তুমি এমন নিষ্ঠুর ঐলা ক্যান? এবার বাড়ি আইসা আমার সঙ্গে একটাও কথা কইলা না। কও ত আমি তোমার কাছে কি অপরাধ করছি?” ভাবিতে ভাবিতে দুই চোখ পানিতে ভরিয়া আসে। তাড়াতাড়ি আঁচলে চোখ মুছিয়া ফুলী যেন মরিয়া হইয়াই বলিল, “বছিরবাই! চল তোমারে সঙ্গে কইরা বড়ুর কবরে যাই। তার কবরের উপর আমি যে কুলের গাছে সোনালী লতা দিছিলাম না? সমস্ত গাছ বাইয়া গ্যাছে সেই লতায়?”
বই-এর মধ্যে মুখ লুকাইয়া বছির উত্তর করিল, “নারে! আমার সময় নাই। তুই এখন যা। আমার একটা খুব জরুরী বই পড়তি ঐত্যাছে।”
ফুলী আবার বলিল, “মা তোমারে যাইবার কইছে। তুমি না ঢ্যাপের খই-এর মোয়া পছন্দ কর। তোমার জন্যি মা খাজুইর্যা মিঠাই দিয়া ঢ্যাপের মোয়া বাইন্দা রাখছে!”
বছির তেমনি বই-এর মধ্যে মুখ লইয়াই বলিল, “চাচীরে কইস, আমার সময় নাই। কাল-পরশু আমারে চইলা যাইতি অবি। আমার কত কাম পইড়া রইছে।”
বছিরের কথাগুলি যেন কঠিন ঢেলার মত ফুলীর হৃদয়ে আসিয়া আঘাতের পর আঘাত হানিল।
বহু কষ্টে কান্না থামাইয়া সে ধীরে ধীরে সেখান হইতে সামনের বনে যাইয়া প্রবেশ করিল। পাকা ডুমকুর খাইতে বছির খুব ভালবাসে। সেই ডুমকুর দিয়া একছড়া মালা গাথিয়া সে বছিরের জন্য আনিয়াছিল। তাহা সে ছিঁড়িয়া কুটি কুটি করিয়া বনের মধ্যে ইতস্তত : ফেলিয়া দিল। আঁচলে বাধিয়া কয়েকটি পাকা পেয়ারা আনিয়াছিল। তাহা সে পা দিয়া চটকাইয়া ফেলিল।
আজ কত পরিপাটী করিয়া সে চুল বাধিয়া খোঁপায় একটি কুমড়ার ফুল খুঁজি। দিয়াছিল। তাহা সে খোঁপা হইতে খুলিয়া দূরে ছুঁডিয়া ফেলিয়া দিল। বাড়ি হইতে আসিবার সময় সে পাকা পুঁই দিয়া দুটি হাত রাঙা করিয়াছিল। এখন সেই হাতে চোখের পানি মুছিতে মুছিতে সে রঙ ধুইয়া গেল।
বার বার তার বালিকা-মনে প্রশ্ন জাগে, কেন এমন হইল!–কেন এমন হইল! কি করিয়াছে ফুলী যার জন্য তার এত আপনার বছিরভাই পাষাণ হইয়া গেল? কি অপরাধ করিয়াছে সে? কে তাহাকে এ কথার জবাব দিবে?
গ্রাম্য চাষী-মোড়লের ঘরের আদুরে মেয়েটি সে। ছোটকাল হইতেই অনাদর কাকে বলে জানে না। বছিরের এই অবহেলায় তার বালিকা-হৃদয়খানিকে ক্ষত-বিক্ষত করিয়া দিল। তবু বছিরের কথা ভাবিতে কেন যেন লজ্জায় ফুলুর মুখোনি রাঙা হইয়া ওঠে। বুকের মধ্যে কেমন যেন একটা অনুভূতি জাগে। অলক্ষিতে সে যে বছিরকে ভালবাসিয়াছে এ কথা পোড়া মুখী নিজেও জানে না। তাহাদের পাড়ায় তারই সমবয়সিনী কত মেয়েকে সে দেখিয়াছে। বাপ মা যাহার সঙ্গে বিবাহ দিয়াছে, শাড়ী গহনা পরিয়া সে তাহারই ঘর করিতে গিয়াছে। ভালবাসা কাহাকে বলে তাহাদের গ্রামে কোন মেয়ে ইহা জানে না। কোন বিবাহিতা মেয়ের কাছেও সে ভালবাসার কথা শোনে নাই। এ-গায়ে ও-গায়ে কৃচিৎ দুএকটি মেয়ে স্বামীর ঘর ছাড়িয়া অপরের সঙ্গে বাহির হইয়া গিয়াছে। তাহাদিগকে সকলেই কুলটা বলিয়া গালি দিয়াছে। ভালবাসার কথা সে কোনদিন কাহারো মুখে শোনে নাই।
বছিরভাই তাহাকে অবহেলা করিয়াছে। তাহাতে তাহার কি আসে যায়? সেও আর বছিরভাইর নাম মুখে আনিবে না। কিন্তু এ কথা ভাবিতে কোথাকার সাত সাগরের কান্নায় তার বুক ভাসিয়া যায়। কি যেন তাহার সর্বনাশ হইয়াছে! কোথায় যেন তার কত বড় একটা ক্ষতি হইয়াছে! সে ক্ষতি হয়ত সারা জীবনেও আর পূরণ হইবে না! কিন্তু কিসের ক্ষতি হইয়াছে, কে সেই ক্ষতি করিয়াছে কিছুই সে বুঝে না। বন-হরিণীর মত বনের এ পথে সে পথে সে ঘুরিয়া বেড়াইল। তারপর বড়র কবরের পাশে আসিয়া কান্দিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িল। এই কবরের মাটির মতই সে মূক। তাহার বেদনার কথা পৃথিবীর কেহই কোনদিন জানিবে না। তাই এই কবরের মূক-মাটির উপর বসিয়া সে অঝোরে কাঁদিতে লাগিল।
কিন্তু মূক-মাটি কথা কহে না। মাটির তলায় যে ঘুমাইয়া আছে সেও কথা কহে না।
বড়ু! তুই আর কত কাল ঘুমাইবি? তুই–শুধু তুই আমার কথা বুঝিতে পারিবি। মাটিতে মাথা ঘসিয়া ঘসিয়া ফুলী সমস্ত কপাল ক্ষত-বিক্ষত করিয়া ফেলিল। এ মাটি কথা বলে না। তবু এই মাটির কবরের উপর বসিয়া কাদিতে তাহার ভাল লাগে। মাটি যেন তাহাকে চেনে। বড় শীতল এই মাটি। তার বুকে বুক মিশাইলে বুক জুড়াইতে চাহে।
“মাটি! তুই আমারে জায়গা দে। যেখানে বড় ঘুমাইয়া আছে তারই পাশে আমাকে স্থান দে। আমরা দুই বন্ধুতে ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া বছিরভাইর স্বপ্ন দেখিব। হয়ত মাঝে মাঝে বছিরভাই এখানে আসিয়া দাঁড়াইবে। আমার কথা মনে করিয়া আসিবে না। কিন্তু বড়ু! তোকে সে কোনদিন ভুলিবে না। তোর কথা মনে করিয়া সে যখন এখানে আসিয়া দাঁড়াইবে, কবরের ঘুমে বসিয়া আমি তার চাঁদ মুখখানা দেখিতে পাইব। বড়–আমার পরানের সখি বড়–তুই আমারে সঙ্গে নে।”
“বোবা কাহিনী” উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ