(সাইত্রিশ)

মাঠের কাজ করিতে করিতে আজাহের ছেলের কথা ভাবে। ছেলে তাহার কি পড়িতেছে তাহা সে বুঝিতে পারে না। হয়ত আকাশে যত তারা আছে–পাতালে যত বালু আছে সব সে গণিয়া কালি করিতে পারে। আরও কত কত বিষয় সে জানে! কিন্তু এ তার ভাবনার প্রধান লক্ষ্য নয়। সে যেমন খেতের একদিক হইতে লাঙলের ফোড় দিয়া অপর দিকে যাইতেছে তেমনি তার ছেলে বড়লোক হওয়ার পথে আওগাইয়া যাইতেছে–ভদ্রলোক হইবার রাস্তায় হাঁটিয়া যাইতেছে। যে ভদ্রলোকেরা তাহাকে ঘৃণা করে–যে ভদ্রলোকেরা তাহাকে অবহেলা করে, তাহার ছেলে তাদেরই সামিল হইতে চলিয়াছে। গর্বে আজাহেরে বুক ফুলিয়া ওঠে। সে যেন মানসলোকে স্বপ্ন দেখিতেছে।

বাড়ি ফিরিয়া দুপুরের ভাত খাইতে খাইতে আজাহের বউ-এর সঙ্গে ছেলের বিষয়ে আলাপ করে। সে যেন গাজীর গানের দলের কোন অপরূপ কথাকার বনিয়াছে।

আজাহের বলে, “ছেলে আমার লেখাপড়া শিখিয়া মানুষ হইয়া আসিবে। আজ যাহারা আমাদিগকে গরীব বলিয়া অবহেলা করে, একদিন তাহারা আমাদিগকে মান্য করিবে-সম্মান দেখাইবে। বউ! তুমি আরও মনোযোগ দিয়া সংসারের কাজ কর। ছেলের বউ আসিবে ঘরে। নাতি নাতকুর হইবে। বাড়ির ওইধারে পেয়ারার গাছ লাগাও–এধারে মিঠা আমের গাছ। আমার নাতিরা গাছে উঠিয়া পাড়িয়া খাইবে। আমরা চাহিয়া চাহিয়া দেখিব। আর শোন কথা; এবারের পাট বেচিব না। ঘরে বসিয়া রশি পাকাইব। তুমি সুতলী পাকাইও। পাটের দামের চাইতে রশির দাম বেশী–সুতলীর দাম বেশী।”

রাত্রে সামান্য কিছু আহার করিয়া আজাহের ঝুড়ি বুনাইতে বসে। বউ পাশে সুতলী বুনায়। এই বুননীর পাকে পাকে ওরা যেন ছেলের ভবিষ্যৎ বুনাইয়া চলিয়াছে।

কোন কোনদিন গরীবুল্লা মাতবর আসে। পাড়ার তাহের আসে–ছমির আসে-কুতুবদী আসে। উঠানে বসিয়া তারা আজাহেরের কাছে তার ছেলের কাহিনী শোনে। সেই উকিল সাবের বাড়ি হইতে কি করিয়া বছির মসজিদে যাইয়া আস্তানা লইল, তারপর সেখান হইতে চরকেষ্টপুর আরজান ফকিরের বাড়ি–এ-কাহিনী যেন রূপকথার কাহিনীর চাইতেও মধুর। কারণ এ যে তাহাদের নিজেদের কাহিনী। একই গল্প তাই শুনিবার জন্য তাহারা বার বার আসে। যে বিদ্বান হইয়া আসিতেছে সে ত শুধু আজাহেরের ছেলে নয়, সে যে তাহাদের সকল গ্রামবাসীর ছেলে। সে বড় হইয়া আসিলে তাহাদের গ্রামের সুনাম হইবে। গ্রামবাসীদের গৌরব বাড়িবে। তাহাদের দুঃখ-কষ্ট দূর হইবে।

গরীবুল্লা মাতবর বলে, ”আজাহের! তোমার ছাওয়ালের বই-পুস্তক কিনার জন্যি আমি দিব পাঁচ টাহা। কও তো মিঞারা তুমরা কে কি দিবা?” ছমরুদ্দী দিবে দুই টাকা, তাহের দিবে তিন টাকা, তমু টাকা দিতে পারিবে না। সে ছেলের নাস্তা করিবার জন্য দশ সের চিড়া কুটিয়া দিবে। মিঞাজান দিবে এক হাঁড়ি খেজুরে-গুড়।

রবিবারে হাটের দিন এই সব লইয়া আজাহের ছেলের সঙ্গে দেখা করে। সমস্ত জিনিস নামাইয়া টাকাগুলি গণিয়া আজাহের তার গামছার খোট খুলিয়া কতকটা কাউনের ছাতু বাহির করে। “এ গুলান তোর মা পাঠাইছে। আমার সামনে বইসা খা। আর এক কথা,” গামছার আর এক কোণা খুলিয়া আজাহের দুইগাছি ডুমকুরের মালা বাহির করে। “আসপার সময় ফুলী দিয়া গ্যাছে। আর কইছে, বছির বাই যিনি এই ডুমকুরির মালা দুইগাছ গলায় পইরা একটা একটা কইরা ছিড়া খায়।”

আরজান ফকিরের ঘরের মেঝের বসিয়া আজাহের ছেলের সঙ্গে কথা কয়। তাম্বুলখানায় সমস্ত গ্রামের মায়া-মমতা সে যেন ছেলের কাছে লইয়া আসিয়াছে। “বাজান! তুমি কুনু চিন্তা কইর না। তুমার লেহনের বই-কাগজের জন্যি বাইব না। সগল গিরাম তোমার পাছে খাড়ায়া আছে। আমি যেডা না দিতি পারব ওরা সেডা আইনা দিবি। বাজান! তুমি আরও মন দিয়া লেহাপড়া কর।”

বাপের কথা শুনিয়া বছিরের দুই চোখে পানি আসিতে চাহে। বছির শুধু একাই শত সহস্র অভাব অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করিতেছে না। তাহার গ্রামবাসীরাও তাহার পিছনে থাকিয়া তাহার জন্য ছোট-খাট কত আত্মত্যাগ করিতেছে। এই সব

ছোট-খাট উপহার সামগ্রীর মধ্যে তাহাদের সকলের শুভ কামনা তাহার অন্তরকে আরও আশান্বিত করিয়া তোলে।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x