(ছত্রিশ)
আরজান ফকিরের বাড়ি আসিয়া বছির স্কুলে যাওয়া আসা করিতে লাগিল। ভাসান চর হইতে আরও তিন চারজন ছাত্র স্কুলে যায়। তাহারা সকলে আসিয়া বছিরের আস্তানায় জড় হয়। তারপর দল বাধিয়া স্কুলের পথে রওয়ানা হয়। স্কুলে যাইবার সময় তাহারা খুব আনন্দেই যায় কিন্তু ফিরিবার পথে সকলেরই পেট ক্ষুধায় জ্বলিতে থাকে। পথের দুইধারে গাছে গাছে যে দিনের যে ফল তাহা তাহাদের নখদর্পণে। ফিরিবার পথে তাহারা। গাছের ডাঁসা কাঁচা যত ফল খাইয়া দারুণ ক্ষুধার কিঞ্চিত নিবৃত্তি করে। এত পথ আসা যাওয়া করিয়া যখন তাহারা বাড়ি ফেরে তখন অতিরিক্ত আহারের ফলে ঘুমে তাহারা জড়াইয়া পড়ে। তবু পাঠ্যবইগুলি সামনে মেলিয়া ধরিয়া কিছুক্ষণ পড়িতে চেষ্টা করে। তারপর সাতরাজার ঘুম আসিয়া তাহাদিগকে পাইয়া বসে। তাই স্কুলের পরীক্ষায় তাহারা ভাল করিতে পারে না। কেহ কেহ একাদিক্রমে দুই তিনবার ফেল করে।
প্রথমে এখানে আসিয়া বছিরেরও সেই দশা হইল। সে বাড়ি আসিয়া খাইয়াই ঘুমাইয়া পড়ে। এই ভাবে সাত আটদিন যাওয়ার পরে সে ভাবিতে বসিল, এমন করিয়া ঘুমাইলে ত। তাহার চলিবে না! তার যে বড় হইতে হইবে। বড় হইয়া সে যে নিজ সমাজের অনেক। অনাচার দূর করিবে। বড়ুর কবরে বসিয়া সে যে নিজে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, বার বার সেই কথা সে মনে মনে আওড়ায়। নানা কিছুতেই তাহার ঘুমাইলে চলিবে না। সে একখণ্ড কাগজ লইয়া বড় বড় অক্ষরে লিখিল, “ঘুম শক্র”।
তারপর সেই কাগজখানা ঘরের বেড়ায় টানাইয়া রাখিল। তারই সামনে বসিয়া বইপত্র লইয়া বছির জোরে জোরে পড়ে। পড়িতে পড়িতে যখন চোখ ঘুমে ঢুলু ঢুলু হয় তখন সে উঠিয়া চোখে মুখে পানির ছিটা দেয়। ঘরের বাহিরে যাইয়া খানিকটা দৌড়াইয়া আসে। ঘুম কাটিয়া গেলে সে আবার পড়িতে বসে। ঘুমের সময় অঙ্ক কষিলে ঘুম পায় না। পড়িতে পড়িতে সে ঘুম তাড়ানোর এই অভিজ্ঞতা আবিষ্কার করিয়াছে। সে যতক্ষণ পড়ে ফকিরনী তাহার মুখের দিকে চাহিয়া জাগিয়া থাকে। বছিরের সঙ্গে সেও যেন পরীক্ষার পড়া তৈরী করিতেছে। বছির পরীক্ষায় পাশ করিবে। ফকিরনীর পরীক্ষা কোন দিনই শেষ হইবে না। যাহারা মমতার বন্ধনে জড়াইয়া পড়ে, সর্বস্ব দিয়াও তাহাদের মনের অতৃপ্তি মেটে না।
ফকিরনীর পাশেই বছিরের শুইবার স্থান। পড়াশুনা করিয়া বছির ঘুমাইয়া পড়ে। পার্শ্বে বসিয়া ফকিরনী তাহাকে বাতাস করে। ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়া চাঁদের আলো আসিয়া বছিরের শ্যামল লাবণ্যভরা মুখোনির উপর পড়ে। ফকিরনী যেন বিছানার কাঁথার গায়ে এই কিশোর-দেবতাটিকে তুলি দিয়া আঁকিয়া লইতেছে। সে পাখার বাতাস করিতে করিতে স্বপ্ন দেখে, সন্ধ্যার রঙিন মেঘগুলি আসিয়া তাহাকে বলিল, “আমরা তোমার তুলিতে ভর করিব। আমাদের রঙ দিয়া তোমার কিশোর-দেবতাটিকে গড়িয়া লও।” ফকিরনী বলিল, “না, তোমরা ওইখানে দাঁড়াইয়া দেখ।” সাতনরি হার গলায় পরিয়া রামধনু আসিয়া তাহার সামনে আসিয়া বলিল, “কৌটা খুলিয়া আমি ডালায় জড়াইয়া আনিয়াছি সাতটি রঙ। আমাকে তুমি লও।”
ফকিরনী বলিল, “না, তোমাকেও আমি চাহি না। তুমি ওইখানে দাঁড়াইয়া দেখ।” চাঁদের কলসী কাখে লইয়া জোছনা ছড়াইতে ছড়াইতে কে একটি মেয়ে আসিয়া বলিল, “আমি দিব সোনালী স্বপনের ঝিকিমিকি। আমাকে তুমি লও।”
ফকিরনী বলিল, “না–না, তুমিও লও। তোমাকে আমি চাই না! তুমি ওখানে দাঁড়াইয়া থাক।” আকাশের আঙিনায় নাচের নক্সা আঁকিতে আঁকিতে বিজলী আসিয়া বলিল, “আমি দিব রঙ আর গতি। তুমি আমাকে লও।” ফকিরনী বলিল, “না-না, তোমাকেও আমি চাহি না।”
তখন প্রথম আষাঢ়ের মেঘ তার কালো কাজল অঙ্গ বকের পাখা দিয়া মাজিতে মাজিতে সামনে আসিয়া দাঁড়াইল। ফকিরনী বলিল, “তোমাকে আমি চাই। তোমার কালো কাজল রঙ আমাকে দাও। আমি এই কিশোর দেবতার অঙ্গে মাখিয়া দিব।” নানা বরনের সবুজ অঙ্গে পরিয়া কচি ধান খেত আসিয়া সামনে খাড়া হইল। ফকিরনী বলিল, “তোমার জন্যই আমি অপেক্ষা করিতেছি। তুমি কৃষাণের স্বপ্ন হইয়া সারা মাঠ ভরিয়া তোমার শ্যামল অঞ্চল বিছাইয়াছ। তুমি দাও তোমার সজীবতা আর নানা ছাদের সবুজ সুষমা! এইসব লইয়া নিপুণ তুলি ধরিয়া মনের মতন করিয়া ফকিরনী যেন তার কিশোর-দেবতাটিকে অঙ্কন করিল। তখন জগতের যত স্নেহাতুর মাতা তারা দল বাঁধিয়া আসিয়া তাহাদের নিজ নিজ বাছনীদিগকে আদর করিতে যে চুম্বন দেয়, সেই চুম্বন যেন তারা একে একে সেই কিশোর বালকের গায়ে মুখে মাখিয়া দিয়া গেল। পাশে দাঁড়াইয়া সন্ধ্যার মেঘ, আকাশের রামধনু আর চাঁদ আর বিদ্যুৎ সমবেত কণ্ঠে গাহিল–সুন্দর–ওহে শ্যামল সুন্দর।
অশিক্ষিত গ্রামের মেয়ে ফকিরনী অত শত ভাবিতে পারে কিনা জানি না। হয়ত পারে! গ্রাম্যরচনাকারীদের ভাবে এবং রসে যে কথাকলি ফুটিয়া আছে হয়ত এর চাইতেও সুন্দর কথা তার মনে উদয় হয়।
কত কথাই ফকিরনী ভাবে। ভাবিতে ভাবিতে রাত প্রায় শেষ হইয়া আসে। কোথাকার এক শূন্যতা আসিয়া যেন ফকিরনীর সমস্ত মনে ঘুরিয়া ঘুরিয়া হাহাকার করে। তার কেবলই ইচ্ছা করে ওই ঘুমন্ত শ্যামল মুখোনি যদি সে চুমায় চুমায় ভরিয়া দিতে পারিত তবে বুঝি তার মনের সকল হাহাকার মিটিত। বাছা আমার ঘুমাইয়া আছে! আহা! সে ঘুমাইয়া থাক!
শেষ রাত্রে বছির জাগিয়া উঠিয়া দেখে, ফকিরনী তখনও তার শিয়রে বসিয়া পাখার বাতাস করিতেছে। সে বলে, “একি ফকির-মা! তুমি ঘুমাও নাই?” এই মা ডাক শুনিয়া তার বুভুক্ষু অন্তর যেন জুড়াইয়া যায়।
সে তাড়াতাড়ি প্রদীপ জ্বালাইয়া দেয়। তারই আলোকে বছির পড়িতে বসে।
ভাসানচরের ইয়াসীন, শামসু আর নবী ভালমত পড়াশুনা করিত না। নবী আর শামসু পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। ইয়াসীন পড়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে। বছির তাহাদিগকে বলিয়া দিল, “ভাই! তোমরা রোজ সকালে আমার এহানে আইসা পড়াশুনা করবা আমি যতটা পারি, তোমাগো সাহায্য করব।”
দিনে দিনে ফকিরের বাড়িখানি যেন পড়ুয়াদের আড্ডায় পরিণত হইল।
দেখিতে দেখিতে বর্ষা আসিয়া পড়িল। সমস্ত চর পানিতে ডুবু ডুবু। এ-বাড়ি হইতে ও বাড়ি যাইতে নৌকা লাগে। বর্ষার জলধারায় পদ্মা নদী ফাঁপিয়া ফুলিয়া উঠিয়াছে। আগে যে খেয়া-নৌকা দিয়া পার হইয়া বছির তাহার সঙ্গী-সাথীদের লইয়া স্কুলে যাইত তাহা উঠিয়া গিয়াছে। এখন তাহারা স্কুলে যাইবে কেমন করিয়া? ইয়াসীনের বাপ গ্রামের বর্ধিষ্ণু কৃষক। বছির তার ছেলেকে পড়াইতেছে দেখিয়া বছিরের প্রতি তাহার মনে খুব স্নেহ। ইয়াসীনের বাড়িতে দুই তিনখানা নৌকা। ইয়াসীনের বাপ তাহার একখানা ডিঙ্গি নৌকা তাহাদের পারাপারের জন্য ছাড়িয়া দিল। তিনজনের বই পুস্তক নৌকার পাটাতনের উপর। রাখিয়া তাহারা রোজ নৌকা বাহিয়া স্কুলে যায়। আলীপুরের মোড়ে নৌকা বাধিয়া রাখে। স্কুলের ছুটি হইলে আবার নৌকা বাহিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসে। আগে হাঁটাপথে স্কুলে যাতায়াত করিতে হইত। তাহাতে স্কুলে পৌঁছিতে তাহাদের এত ঘন্টা লাগিল। এখন ধান খেতের পাশ দিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া নাও দাঁড়া দিয়া নৌকা চালাইতে হয়। তাই দেড় ঘন্টার। আগে তাহারা স্কুলে পৌঁছিতে পারে না। যেদিন বৃষ্টি হয় একজন বসিয়া বুকের তলায় বই-পত্রগুলিকে কোন রকমে বৃষ্টির হাত হইতে রক্ষা করে। কিন্তু তিনজনেই ভিজিয়া কাকের ছাও হইয়া যায়। সেই ভিজা জামা কাপড় শুদ্ধই তাহারা স্কুলে যায়। স্কুলে যাইয়া গায়ের জামা খুলিয়া শুখাইতে দেয়। পরনের ভিজা কাপড় পরনেই থাকে।
ফিরিবার পথে নৌকায় উঠিয়া তাহাদের কতই যে ক্ষুধা লাগে। ইয়াসীন বছিরকে বলে, “বছির ভাই! আমাগো বাড়ি যদি শহরে থাকত তয় কত মজাই ঐত! এতক্ষণে বাড়ি যায় খায়া লয়া খেলাইতি যাইতাম।”
বছির বলে, “ভাই! একজন লোক কইছে, বড় হওয়া মানে অনেক অসুবিধার ভিতর দিয়া নিজেরে চালায়া নেওয়া–অভাবের আগুনের মদ্দি জ্বইলা পুইড়া নিজেরে সোনা করা। ভাই ইয়াসীন! দুঃখ আর অভাব একটা বড় রকমের পরীক্ষা হয়া আমাগো সামনে আইছে। এই পরীক্ষায় পাশ করতি অবি।”
ইয়াসীন বলে, “কিন্তুক বাই। এ পরীক্ষায় পাশের নম্বর আমাগো কেউ দিবি না।”
উত্তরে বছির বলে, “দিবি ভাই–একদিন দিবি, যদি আমরা বালমত পাশ করবার পারি, এই যে কত দুঃখ কষ্ট সইবার অভ্যাস আমাগো ঐল, এই অভ্যাস আমাগো কামে দিবি। জানস, আমাগো নবীজীরে কত দুস্কের মদ্দী দ্যা চলতি ঐছিল। সেই জন্যি ইত। তানি দুঃখী জনের বন্ধু।”
নৌকা বাহিতে বাহিতে তাহারা পদ্মানদী পার হইয়া আসিল। সামনে কলিমদ্দীর ধানের খেতের পাশ দিয়া নাও দাঁড়া। বামধারে মেছের সেখ ডুবিয়া পাট কাটিতেছে। এক এক ডুব দেয় আর পাট গাছের আগাগুলি নড়িয়া ওঠে। ধারালো কচির আঘাতে গুচ্ছ গুচ্ছ পাট কাটিয়া সে আঁটি বাধিতে থাকে। এক আঁটিগুলি পরে এক জায়গায় জড় করিয়া তবে জাগ দিবে। জাগের উপর কচুরিপানার ভারা দিবে; যাহাতে পাটের জাগ ভাসিয়া অন্যত্র চলিয়া না যায়। সেই পাটখেত ছাড়াইয়া তাহারা মিঞাজানের ধান খেতের পাশ দিয়া চলিল। কি সুন্দর গুচ্ছ গুচ্ছ পক্ষিরাজ ধান পাকিয়া আছে। কালো রঙের ধানগুলি। প্রত্যেক ধানের মুখে সাদা রেখা যেন পাখা মেলিয়া আছে। ধানের পাতাগুলি রৌদ্রে সোনালী রাঙালি রঙ ধরিয়াছে। বর্ষার পানির উপরে যেন একখানা পটে আঁকা ছবি। হাজার হাজার পাখি কোথায় যেন উড়িয়া চলিয়াছে। বাতাসের মৃদু ঢেউএ ধান গাছগুলি দুলিতেছে। যেন পাখিগুলির পাখা নড়িতেছে। এই ধান সকল মানুষের আশা ভরসা। চাষীর মনের স্বপ্ন জীবন্ত হইয়া পানির উপর ভাসিতেছে। বছির বলে, “ভাই ইয়াসীন!–ভাই আজিম। তোমরা পরাণ ভইরা দেইখা লও। এই সুন্দর ছবি শহরের লোকেরা কুনু দিন দেহে নাই। আর শোন ভাই! এত পানি ঠেইলা এই ধান গাছগুলি উপরে মাথা উঠাইয়া ধানের ভরে হাসত্যাছে। আমরাও একদিন এমনি দুস্কের সঁতার পানি ঠেইলা জীবনের সুফল লয়া হাসপ।”
ইয়াসীন বলে, “কিন্তু ক ভাই! আমরা কি এই পানি ঠেইলা উঠতি পারব?”
বছির উত্তর করে, “আলবৎ পারব ভাই! আমার যা বিদ্যা বুদ্ধি আছে তাই দিয় তোমাগো পড়াব। আমরা সগলেই পইড়া বড় অব। দুঃখ দেইখা আমাগো ভয় পাইলি চলবি না।”
বছিরের কথা শুনিয়া তাহার সাথীদের মনে আশায় সঞ্চার হয়। তাহারা আরও জোরে। জোরে নৌকা চালায়।
“বোবা কাহিনী” উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ