(বত্রিশ)
বাড়ি হইতে শহরে আসিয়া বছির অনেক খবর পাইল, কমিরদ্দী সরদারের নামে জমিদার খাজনার নালিশ করিয়াছেন। তা ছাড়া সেদিনের মারামারি উপলক্ষ করিয়া থানার পুলিশ তাহাকে ও তাহার ছেলেকে গ্রেফতার করিয়াছে। এইসব মামলার তদবির-তালাশী করিতে কমিরদ্দী সরদারকে তার এত সখের দৌড়ের নৌকাখানা অতি অল্প টাকায় বিক্রী করিতে হইয়াছে। কারণ আশে পাশের গ্রামগুলিতে উকিল সাহেবের লোকেরা প্রচার করিয়া দিয়াছেন, মুসলমান হইয়া যাহারা নৌকা বাইচ খেলাইবে তাহারা দোজখে যাইয়া জ্বলিয়া-পুড়িয়া মরিবে, আর তাহাদিগকে একঘরে করিয়া রাখা হইবে। সুতরাং মুসলমান হইয়া কে সেই বাইচের নৌকা কিনিবে? সাদীপুরের এছেম বেপারী মাত্র ষাট টাকা দিয়া এত বড় নৌকাখানা কিনিয়া সেই নৌকা লইয়া এখন পাটের ব্যবসা করিতে আরম্ভ করিয়াছে। গ্রামের লোকেরা এখন আর কমিরদ্দী সরদারের কথায় ওঠে বসে না। তাহারা নানা দলে বিভক্ত হইয়া একে অপরের ক্ষতি করিতে চেষ্টা করিতেছে। গ্রামে ঝগড়া মারামারি লাগিয়াই আছে। আজ উহার পাটের খেত ভাঙিয়া আর একজন ধান বুনিয়া যাইতেছে। কেহ লাঙল বাহিবার সময় পার্শ্ববর্তী লোকের জমির কিছুটা লাঙলের খোঁচায় ভাঙিয়া লইতেছে। এইসব উপলক্ষে বহুলোক রমিজদ্দীন সাহেবের বাসায় যাইয়া মামলা দায়ের করিতেছে। উকিল সাহেবের পশার এত বাড়িয়াছে যে এখন আর তিনি গ্রাম-দেশে নিজে যাইয়া বক্তৃতা করিবার অবসর পান না। আঞ্জুমাননে ইসলামের মৌলবী সাহেবরা এ-গ্রামে সে-গ্রামে যাইয়া যথারীতি বক্তৃতা করেন। মাঝে মাঝে উকিল সাহেব আঞ্জুমানে ইসলামের জমাত আহ্বান করেন। গ্রামের লোকদের নিকট হইতে চাদা তুলিয়া সেই টাকায়। কলিকাতা হইতে বক্তা আনাইয়া বক্তৃতা করান। চারিদিকে উকিল সাহেবের জয় জয়কার পড়িয়া যায়। ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের ইলেকসনে উকিল সাহেব বহু ভোট পাইয়া মনোনীত হইয়াছেন। উকিল সাহেবের বাসায় লোকজনের আরও ভীড়।
এইসব গণ্ডগোলে বছিরের পড়াশুনার আরও ব্যাঘাত হইতে লাগিল। রাস্তার লাইট পোস্টের সামনে দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া পড়াশুনা করিতে রাত্র জাগিয়া তাহার শরীর আরও খারাপ হইয়া পড়িল।
এক শনিবার বছির বাড়ি যাওয়ার নাম করিয়া সন্ধ্যাবেলা আরজান ফকিরের বাড়ি যাইয়া উপস্থিত হইল। ফকির তাহাকে সস্নেহে ধরিয়া একটি মোড়ার উপর আনিয়া বসাইল। ফকিরের বউ আসিয়া আঁচল দিয়া তাহার মুখ মুছাইতে মুছাইতে বলিল, “আমার বাজান বুঝি তার ম্যায়ারে দেখপার আইছে? ও বাজান! এতদিন আস নাই ক্যান?”
এই মেয়েটির কথায় যেন স্নেহের শতধারা বহিয়া যাইতেছে। তাহার মা বড়ই লাজুক। ছেলেকে আড়াল-আবডাল হইতে ভালবাসে। এই মেয়েটির মত এমন মিষ্টি করিয়া কথা বলিতে পারে না। আজ এমন স্নেহ-মমতার কথা শুনিয়া বছিরের চোখ হইতে পানি গড়াইয়া পড়িতে চাহে।
ফকির বলিল, “বাজানরে ক্যাবল মিঠা মিঠা কতা শুনাইলিই চলবি না। এত দূরের পথ হাঁইটা আইছে। কিছু খাওনের বন্দোবস্ত কর।”
“তাই ত! আমার ত মনেই পড়ে নাই। বাজান! তুমি বইয়া ফকিরের লগে কথা কও। আমি আইত্যাছি!”
তাড়াতাড়ি ফকিরের বউ এক বদনা পানি আনিয়া দিল হাত পা ধুইতে। তারপর সাজিতে করিয়া কিছু মুড়ি আর একটু গুড় আনিয়া বলিল, “বাজান খাও।” যতক্ষণ বছির খাইল ফকিরের বউ এক দৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। সুন্দর শ্যামল মুখোনি বছিরের। কচি ধানপাতার সমস্ত মমতা কে যেন সেখানে মাখাইয়া দিয়াছে। ফকিরের সন্তান হয় নাই। কিন্তু এই কিশোর বালকটিকে ঘিরিয়া কোন স্নেহের শতধারায় যেন তার সমস্ত অন্তর ভরিয়া যাইতেছে। ঘরে ত বিশেষ কিছু খাবার নাই। সামান্য কিছু আতপ চাউল আর গুড় যদি থাকিত, তবে সে মনের মত করিয়া কত রকমের পিঠা তৈরী করিয়া এই কিশোর-দেবতাটির ভোগ দিত। টাটকা মুড়ি চিবাইতে চিবাইতে বছিরের মুখে যে শব্দ হইতেছিল; একান্তে বসিয়া ফকির-বউ সেই শব্দ শুনিতে লাগিল। ফকিরের সারিন্দা বাজানও বুঝি কোনদিন তার কাছে এমন মিষ্টি লাগে নাই।
খাওয়া শেষ হইলে ফকিরের বউ বলিল, “বাজান! তোমারে কিবা খাওয়াইমু। যার লগে আমারে বিয়া দিছিলা হে আমারে বালুর চরায় ঘর বাইন্দ্যা দিছে। একটা ঢেউ আইসাই ঘর ভাইঙ্গা যাবি। কি ঠগের লগেই আমারে জুইড়া দিছিলা, শিশিরের গয়না দিল গায়–না দেখতেই সে গয়না উইবা গেল। কুয়াশার শাড়ী আইন্যা পরাইল, গায়ে না জড়াইতেই তা বাতাসে উড়ায়া নিল। শুধু সিন্তার সিন্দুরখানিই কপাল ভইরা আগুন জ্বাইলা রইল।”
এই বলিয়া ফকির-বউ গান রিল। ফকিরও সারিন্দা বাজাইয়া তাহার সঙ্গে যোগ দিল।
কে যাসরে রঙিলা নার মাঝি!
সামের আকাশরে দিয়া,
আমার বাজানরে কইও খবর,
নাইওরের লাগিয়ারে।
গলুইতে লিখিলাম লিখন সিস্তার সিন্দুর দিয়া,
আমার বাপের দেশে দিয়া আইস গিয়া
–রে রঙিলা নার মাঝি!
আমার বুকের নিশ্বাস পালে নাও ভরিয়া,
ছয় মাসের পন্থ যাইবা ছয় দণ্ডে চলিয়া,
–রে রঙিলা নার মাঝি!
গান গাহিতে গাহিতে ফকির আর ফকিরনী কাঁদিয়া আকুল হইতেছিল। মাঝে মাঝে গান থামাইয়া ফকির সারিন্দা বাজাইতেছিল আর ফকিরনী চোখের পানি ফেলিতেছিল।
পরের ছেলের সঙ্গে বাজান আমায় দিলা বিয়া,
একদিনের তরে আমায় না দেখলা আসিয়া।
এই গান শেষ করিয়া ফকিরনী বলিল, “বাজান! একদিনও ত ম্যায়ারে দেখতি আইলা । আমি যে কত পন্থের দিকে চায়া থাহি।” ফকিরী-কথার যে অন্তনিহিত ভাব বছির তাহা বুঝিতে পারে না কিন্তু গানের সুরের কি এক মাদকতা তাহাকে যেন পাইয়া বসিল।
বছিরকে কোলের কাছে বসাইয়া ফকিরনী আবার গান ধরিল,
ও তুমি আমারে বারায়া গেলারে
কানাই রাখাল ভাবে।
তোরো মা যে নন্দ রানী,
আজকে কেন্দে গোপাল পাগলিনীরে;
–কানাই রাখাল ভাবে।
এখন ক্ষুধার হয়েছেরে বেলা,
তুমি ভেঙে আইস গোঠের খেলারে;
–কানাই রাখাল ভাবে।
কতদিন যে নাহি শুনি।
তোরো মুখে মা বোল ধ্বনিরে,
–কানাই রাখাল ভাবে।
এই গানের পিছনে হয়ত কত গভীর কথা লুকাইয়া আছে তাহা বছির বুঝিতে পারে না। কিন্তু গানের সুরে সুরে এই পুত্র-হীনা মেয়েটির সমস্ত অন্তর স্নেহের শতধারা হইয়া তাহার দেহে-মনে বর্ষিত হইতেছে তাহা যেন আবছা আবছা সে বুঝিতে পারে।
গান শেষ করিয়া ফকিরনী বলিল, “বাজান! আইজ তুমি আমাগো এহানে বেড়াও। রাত্তিরে আরও অনেক লোক আসপ্যানে। তোমারে পরান বইরা গান শুনাবানে।”
ফকিরনীর কথায় এমন মধুঢ়ালা যে বছির না বলিতে পারিল না। ফকির তার সারিন্দায়। নতুন তার লাগাইতে বসিল। বছির উঠানে দাঁড়াইয়া এ-দিক ওদিক দেখিতে লাগিল। ছোট্ট একখানা বাকা দুইচালা ঘর ফকিরের। তার সঙ্গে একটি বারান্দা। সেখানে সাত আটজন লোক বসিতে পারে। সামনে ছোট্ট উঠানখানা সুনিপূণ করিয়া লেপা-পোছা। তারই পাশে লাউ কুমড়ার জাঙলা। কত লাউ ধরিয়াছে। ওধারে জাঙলা ভরিয়া কনে-সাজানী শিমলতা লালে-নীলে মেশা রঙে যেন সমস্ত উঠানখানি আলো করিয়া আছে। ওধারে শিমূল গাছে কত ফুল ফুটিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে। গাছের ডালে ডালে কুটুম পাখি, বউ কথা কও পাখি, ডাকিয়া ডাকিয়া এইসব ফুলের রঙ যেন গানের সুরে ভরিয়া মহাশূন্যের উপর নক্সা আঁকিতেছে। বাড়ির সামনে দিয়া গ্রাম্য-হালটের পথ দূরের মাঠ পার হইয়া আকাশের কোলে কালো কাজল রেখা আঁকা অজানা কোন গ্রামে মিশিয়া কোথায় উধাও হইয়া গিয়াছে। কেউ পথের উপর এখানে সেখানে গরুর পাল লইয়া রাখাল ছেলেরা নানারূপ শব্দ করিয়া ঘরে ফিরিতেছে। কোন কোন রাখাল গ্রাম্য-যাত্রায় গাওয়া কোন বিলম্বিত লয়ের গানের একটি কলি বার বার গাহিয়া গোধূলীর উদাস মেঘেভরা সমস্ত আকাশখানিকে আরও উদাস করিয়া দিতেছে। গরুর পায়ের খুরের শব্দ সেই গানের সঙ্গে যেন তাল মিলাইতেছে। পিছনে যে ধূলী উড়িয়া বাতাসে ভাসিতেছে তাহার উপরে সন্ধ্যার রঙ পড়িয়া কি এক উদাস ভাব মনে জাগাইয়া দিতেছে। বছির মনে মনে ভাবে, ফকিরের এই গ্রামখানার মাঠ, ঘাট, পথে, বাড়ি-ঘর, ফুল-ফলের গাছ সকলে মিলিয়া যেন বৃহত্তর একটি সারিন্দা-যন্ত্র। এই যন্ত্র সকালে বিকালে রাত্রে প্রভাতে এক এক সময় এক এক সুরে বাজিয়া সমস্ত গ্রামের মর্মকথাটি যেন আকাশে বাতাসে ছড়াইয়া দেয়। তারই ক্ষুদ্র প্রতীক করিয়া গ্রাম্য-ফকির তাহার সারিন্দাটি গড়িয়া লইয়াছে। তাহার সুরের মধ্যেও গ্রামের প্রাণ-স্পন্দন শোনা যায়।
দেখিতে দেখিতে চারিদিক অন্ধকার করিয়া রাত্র আসিল। কোন্ গ্রাম্য-চাষীর মেয়েটি যেন আকাশের নীল কথাখানার উপর একটি একটি করিয়া তারার ফুল বুনট করিয়া তুলিতেছিল। তাহারই নকল করিয়া সমস্ত গ্রামের অন্ধকার কথাখানার উপর একটি একটি করিয়া সান্ধ্য প্রদীপের নক্সা বুনট হইতেছিল। ছোট্ট ছেলে বছির। অত শত ভাবিতে পারিল কিনা জানি না। কিন্তু বাহিরের এই সুন্দর প্রকৃতি তার অবচেতন মনে কি এক প্রভাব বিস্তার করিয়া রাত্রের গানের আসরের জন্য তাহার অন্তরে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরী করিতেছিল। উদাস নয়নে বছির বাহিরের আকাশের পানে বহুক্ষণ চাহিয়াছিল। ফকিরনীর গান শুনিয়া তাহার চমক ভাঙ্গিল।
ক্ষুধার হয়েছে বেলা
এখন ভাইঙ্গা আইস গোঠের খেলারে
–কানাই রাখাল ভাবে।
“আমার গোপাল! মুখোনি খিদায় মৈলাম হয়া গ্যাছে। বাজান! চল খাইবার দেই।” আঁচল দিয়া জড়াইয়া ধরিয়া ফকিরনী বছিরকে ঘরে লইয়া গেল। মাটির সানকীতে করিয়া ভাত আর লাউ শাক। পাতের এক পাশে দুইটা কুমড়াফুল ভাজা। এই সামান্য খাবার। ফকিরনী বলে, “বাজান! আর কি খাইওয়াবো তোমারে। আমাদের গোপালের ভোগে এই। শাক আর ভাত!”
বছির আস্তে আস্তে খায়। ফকিরনী পুত্র-স্নেহের ক্ষুধার্ত দৃষ্টি লইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিয়া থাকে। বছিরের খাওয়া যখন শেষ হইয়াছে, ফকিরনী গান ধরিল–
কি দিয়ে ভজিব তোর রাঙা পায়,
আমার মনে বড় ভয় দয়ালরে।
গানের সুর শুনিয়া ফকির তাহার সারিন্দা বাজাইয়া ফকিরনীর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাইল। ফকিরনী গাহিতে লাগিল,
দুগ্ধ দিয়া ভজিব তোরে
সেও দুধ বাছুরিতি খায়।
চিনি দিয়া ভজিব তোরে
সে চিনি পিঁপড়ায় লইয়া যায়।
কলা দিয়া ভজিব তোরে
সেও কলা বাদুরিতি খায়।
মন দিয়া ভজিব তোরে
সেও মন অন্য পথে ধায়।
দয়ালরে–
আমি কি দিয়া ভজিব তোর রাঙা পায়!
ফকিরনীর এই রকম ভাব-সাব দেখিয়া বছিরের বড়ই লজ্জা করে। সে বুঝিতে পারে না, তাহাকে উপলক্ষ করিয়া তাহারা এরূপ করে কেন? ফকিরনী নিজে বছিরের হাতমুখ ধোয়াইয়া আঁচল দিয়া তাহার মুখ মুছিয়া দিল। তারপর তাহারা দুইজনে খাইতে বসিল।
ইতিমধ্যে ও-পাড়া হইতে ফকিরের দুই তিনজন শিষ্য আসিল, সে-পাড়া হইতে জয়দেব বৈরাগী তাহার বৈষ্টমীকে সঙ্গে করিয়া আসিল। জয়দেবের কাঁধে একটি দোতারা। সে আসিয়াই দোতারায় তার যোজনা করিতে লাগিল। ফকির হাতমুখ ধুইয়া তাহার সারিন্দা লইয়া বসিল। সারিন্দার তারগুলি টানিয়া ঠিক করিতে করিতে তাহার শিষ্যদিগকে বলিল, “আইজ আমার শ্বশুর আইছে গান হুনবার। তোমরা বাল কইরা গীদ গাইও।”
জয়দেব বছিরের লাবণ্য ভরা শ্যামল মুখোনির দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিল, “আপনার শ্বশুর কিন্তু আমার কাছে আমার কেষ্ট ঠাকুর। আইজ বৃন্দাবন ছাইড়া আইছে। আমাগো বজ্রবাসীগো অবস্থা দেখপার জন্যি। দেখছেন না, কেমন টানা টানা চোখ ঠাকুরের। আর গায়ের রূপে যেন তমাল লতার বন্নক। এবার হাতে একটা মোহন বাঁশী থাকলেই একেবারে সাক্ষাৎ কেষ্ট ঠাকুর হৈত! মানুষের মধ্যেই ত রূপে রূপে বিরাজ করেন তিনি। যারে দেইখ্যা বাল লাগে তারির মদ্দিই ত আইসা বিরাজ করেন ঠাকুর।”
ফকির বলিল, “এবার তবে আমার শ্বশুরকে গান শুনাই।” প্রথমে বন্দনা গান গাহিয়া ফকির গান ধরিল,
কে মারিল ভাবের গুলি
আমার অন্তর মাঝারে,
এমন গুলি মাইরা চইলা গ্যাল
একবার দেখল না নজর করে।
জগাই বলে ওরে মাধাই ভাই!
শিকার খেলিতে আইছে গয়ুর নিতাই;
আমার এত সাধের পোষা পাখি
নিয়া গ্যাল হরণ করে।
গান গাহিতে গাহিতে ফকির আর গাহিতে পারে না। হাতের সারিন্দা রাখিয়া অঝোরে কান্না করে। সঙ্গের শিষ্যেরা একই পদ বার বার করিয়া গাহে,
জগাই বলে ওরে মাধাই ভাই!
শিকার খেলিতে আইছে গয়ূর নিতাই;
আমার এত সাধের পোষা পাখি
নিয়া গ্যাল হরণ করে।
তারপর ফকির গান ধরিল,
ও দীন বন্ধুরে
আমি ভাবছিলাম আনন্দে যাবে দিন।
বাল্যকাল গ্যাল ধূলায় খেলায়
আমার যৈবুন গ্যাল হেলায় ফেলায়,
এই বৃদ্ধকালে ভাঙল দিনের খেলারে।
জঙ্গলে জঙ্গলে ফিরি,
আমি আইলা ক্যাশ নাহি বান্দি হে;
আমি তোরো জন্যে হইলাম পাগলিনীরে।
শুনেছি তোর মহিমা বড়,
তুমি পাতকী তরাইতে পার হে;
আমার মতন পাতক কেবা আছে ভবেরে।
এই গান শেষ করিয়া ফকির আরও কতকগুলি গান গাহিল।
আমার ফকিরের বাড়ি নদীর ওপারে। এ-পারে বসিয়া আমি তাহার জন্য কান্দিয়া মরি। হাতে আসা বগলে কোরান সোনার খড়ম পায়ে দিয়া আমার ফকির হাঁটিয়া হাঁটিয়া যায়–তার মুখে মৃদু মৃদু হাসি। সকলে বলে আমার দয়াল কেমন জনা। আন্ধার ঘরে যেমন কাঞ্চা সোনা জ্বলে, কাজলের রেখার উপর যেমন চন্দনের ছটা, কালিয়া মেঘের আড়ে যেমন বিজলির হাসি তেমনি আমার দয়াল চান। তার তালাশে আমি কোন দেশে যাইব?
চাতক হইয়া আমি মেঘের দিকে চাহিয়া থাকি। মেঘ অন্য দেশে ভাসিয়া যায়। আশা করিয়া আমি বাসা বাধিলাম। আমার আশা বৃক্ষের ডাল ভাঙিয়া গেল।
গান গাহিতে গাহিতে ফকির আর গাহিতে পারে না। তাহার সমস্ত অঙ্গ কি এক ভাবাবেশে দুলিতে থাকে। জয়দেব বৈরাগী তখন গান ধরিল,–
আমি বড় আশা কইরা দয়াল ডাকিরে তোরে,
আমি বড় আফসোস কইরা দয়াল ডাকিরে তোরে।
হাপন যদি বাপ মা হইতারে দয়াল চান!
ও লইতা ধূল ঝাইড়া কোলেরে।
কোলের ছেলে দূরে না ফেইলারে দয়াল চান!
তুমি রইলা কোন দ্যাশেরে।
যেনা দেশে যাইবা তুমিরে দয়াল চান!
আমি সেই দেশে যাবরে।
চরণের নূপুর হয়ারে দয়াল চান!
ও তোমার চরণে বাজিবরে।
গান শেষ হইতে পূর্ব আকাশের কিনারায় শুকতারা দেখা দিল। ফকিরেরা গান থামাইয়া যার যার বাড়ি চলিয়া গেল। কেহ কাহারও সঙ্গে একটি কথাও বলিল না। গানের আসরে কি এক মহাবস্তু যেন তাহারা আজ পাইয়াছে। সকলেরই হৃদয় সেই গানের আবেশে ভরপুর।
ফকিরনী নিজের বিছানার এক পাশ দেখাইয়া বছিরকে বলিল, “বাজান! আইস শুইয়া পড়।” বছির শুইলে ফকিরনী তাহার গায়ে বাতাস করিতে লাগিল। একহাতে মাথার চুলগুলি বিলি দিতে লাগিল। শুইয়া শুইয়া বছিরের কিন্তু ঘুম আসিল না।
দূরবর্তী চরের কৃষাণ কুটিরগুলি হইতে চেঁকি পারের শব্দ আসিতে লাগিল। চাষী-মেয়েরা শেষ রাত্রিতে উঠিয়া ধান ভানিতেছে। শেষ রাতের শীতল বাতাসে টেকি পারাইতে তত হয়রান হইতে হয় না। কত রকম সুরেই যে মোরগ ডাকিতে লাগিল। চাষীরা এখনই উঠিয়া মাঠে লাঙল দিতে চলিয়াছে! তাহাদের গরু তাড়াইবার শব্দ কানে আসিতেছে। ক্রমে ক্রমে দিনের পাখিগুলি গাছের ডালে জাগিয়া উঠিল। নদী-তীর হইতে চখা-চখী ডাকিতে লাগিল। সে কি মধুর সুর! সমস্ত বালুচরের মনের কথা যেন তাহারা সুরে সুরে ছড়াইয়া দিতেছে।
মাঝে মাঝে এক ঝাক বেলে হাঁস আকাশে উড়িয়া কখনো অর্ধ গোলাকার হইয়া কখনো লম্বা ফুলের মালার মত হইয়া দূর শূন্য পথে ঘুরিতেছিল। ঘরের বেড়ার ফাঁক দিয়া বছির দেখিতেছিল।
ফর্সা হইয়া যখন সকাল হইল বছির উঠিয়া বসিল। ফকিরনী বছিরের হাতমুখ ধোওয়াইয়া তাহাকে সামান্যকটি ভিজানো ছোলা আনিয়া খাইতে দিল।
বিদায়ের সময় ফকিরনী বলিল, “বাজান! ম্যায়ারে দেখপার জন্যি কিন্তুক আইস। আমি পথের দিগে চায়া থাকপ।”
যতক্ষণ বছিরকে দেখা গেল ফকিরনী ঘরের বেড়া ধরিয়া ঠায় দাঁড়াইয়া রহিল। তারপর সে যখন দূরের ঝাউ গাছটির আড়ালে অদৃশ্য হইয়া গেল তখন একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িল। আহা! এই শ্যামল রঙের ছেলেটিকে সে কোন মায়ার পাশে বাঁধিবে? আর কি সে আসিবে? তারই গায়ের রঙ মাখিয়া দুরের শস্য খেতগুলি যেন মায়ায় দুলিতেছে। আকাশের কিনারায় দূরের মেঘগুলি যেন তারই ছায়া গায়ে মাখিয়া ওমন পেলব হইয়াছে। গোপাল–আমার গোপাল–আমি যে তোর মা যশোদা! গোঠের খেলা ভঙ্গ করিয়া তুই আমার বুকে আয়!
“বোবা কাহিনী” উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ