(একত্রিশ)
দেখিতে দেখিতে গ্রীষ্মের ছুটি আসিয়া পড়িল। বছির বই-পত্র লুঙ্গীতে বাধিয়া বাড়ি বলিয়া রওয়ানা হইল। পথে চলিতে চলিতে পথ যেন আর ফুরায় না। মায়ের জন্য, পিতার জন্য তাহার মন কাঁদিয়া উঠে। আহা! মা যেন কেমন আছে! যদি তার কোন অসুখ করিয়া থাকে, হয়ত সেই অসুখের মধ্যে মা তার নাম করিয়া প্রলাপ বকিতেছে। যত সব অলক্ষুণে কথা তার মনে আসিয়া উদয় হয়। যতই সে ভাবে এই সব কথা সে মনে আনিবে না, ততই এই সব কথাগুলি কে যেন তার মনের পর্দায় বিদ্ধ করিয়া দিয়া যায়। বছির আরও জোরে জোরে পা ফেলায়।
সন্ধ্যা হইবার ঘন্টাখানেক আগে সে বাড়ি আসিয়া পৌঁছিল। মা রান্না করিতেছিল। তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিয়া তাহার গা মুখ আঁচলে মুছাইয়া দিল। ঘরের বারান্দায় আনিয়া বসাইয়া তালের পাখা লইয়া ছেলেকে বাতাস করিতে লাগিল। আহা! ছেলের শরীর কেমন রোগা হইয়া গিয়াছে। “হারে! সেহানে দুই ব্যালা প্যাট ভইরা খাইবার ত পাস। তোর চেহারা এমুন খারাপ হয়া গ্যাছে ক্যান?”
ছেলে মিথ্যা করিয়া বলে, “মা! তুমি কও কি? শহরে উকিল সাহেবের বাড়ি, কত সন্দেশ, রসগোল্লা গড়াগড়ি যায়।”
“তয় তোর চেহারা এমুন খারাব ঐল ক্যান?”
“মা তুমি কি কও? সেহানে দিন রাইত খালি বই পড়তি অয়। রাইত জাইগা জাইগা পড়ি। তয় চেহারা খারাপ অবি না?”
এমন সময় আজাহের মাঠ হইতে আসিয়া উপস্থিত হইল। মা স্বামীকে দেখিয়া মাথায় অপরিসর ঘোমটাটি টানিয়া লইতে বৃথা চেষ্টা করিয়া বলিল,”দেহ কিডা আইছে? য়্যাহেবারে শুহায়া কাঠ হয়া আইছে।”
“তুমি যাও। উয়ার জন্য খাওনের জোগাড় কর।”
মা তাড়াতাড়ি খাবার বন্দোবস্ত করিতে গেল।
বহুদিন পরে বছির বাড়ি আসিয়াছে। নারকেল গাছের তলায় নারকেল ফুলের কি এক রকম সুবাস। সেই সুবাসে বছিরের মনে যেন কত কালের কি অনুভূতি জাগে। বনের গাছে। গাছে নানা রকমের পাখি ডাকিতেছে। মূক মাটি তাহাদের কণ্ঠে আপন ভাষা তুলিয়া দিয়া নীরবে শুনিতেছে! সেই গান শুনিতে শুনিতে সারাদিনের পরিশ্রমে শ্রান্ত বছির অল্প সময়েই ঘুমাইয়া পড়িল।
পরদিন সকালে ফুলী বেড়াইতে আসিল। ফুলী এখন কত সুন্দর হইয়াছে দেখিতে। হলদে রঙের একখানা শাড়ী পরিয়াছে। তাহাতে তাহার গায়ের রঙ যেন আরও খুলিয়াছে!
“বছির বাই! তুমি আইছ খবর পায়াই তোমারে দেখতি আইলাম।” সুন্দর ভঙ্গীতে বসিয়া ফুলী দুই হাতে বছিরের পা ছুঁইয়া সালাম করিল। যেন কোন পীর সাহেবকে তার একান্ত ভক্ত সালাম জানাইতেছে।
বছির বলিল “কিরে ফুলী! কেমন আছিস?”
কোথাকার লজ্জা আসিয়া যেন তাহার সকল কথা কাড়িয়া লইল। বছিরের মায়ের আঁচল মুখে জড়াইয়া ফুলী কেবলই ঘামিতে লাগিল।
বছির তাহাকে আবার জিজ্ঞাসা করিল, “চাচী কেমুন আছে রে? তোরে ত আমি বই দিয়া গেছিলাম পড়বার। পড়ছাস ত?”
এ কথারও ফুলী কোন উত্তর দিতে পারিল না। বছিরের মা উত্তর করিল, “পড়ছে না? হগল বই পইড়া ফালাইছে।”
বছির বলিল,”এবার তোর জন্যি আর একখানা বই আনছি। দেখ, কেমন ছবিওয়ালা।”
এই বলিয়া তার বই-পত্রের বোচকা খুলিয়া একখানা ছোট বই বাহির করিয়া দিল। ফুলী বইখানা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিতে তাহার মুখে মৃদু লজ্জা মিশ্রিত হাসি ফুটিয়া উঠিল। বছিরের মা দুই সাজীতে করিয়া মুড়ী আনিয়া বছির ও ফুলীর হাতে দিয়া বলিল, “তোরা খা। আমি ইন্দারা ত্যা পানি লয়া আসি।”
এবার ফুলীর মুখ খুলিল, ”বছির বাই! তুমি এবার এত দেরী কইরা আইলা ক্যান? আমি সব সময় তোমার পথের দিকে চায়া থাহি। ওই মাঠ দিয়া জামা কাপড় পরা কেউ। আইলি বাবি, এই বুজি বছির বাই আসত্যাছে।”
এই বলিয়া ফুলী কান্দিয়া ফেলিল। বছির ফুলীর আঁচল দিয়া তার মুখ মুছাইতে মুছাইতে বলিল, “আমারও বাড়ি আসপার জন্যি মন ছুঁইটা আইত, কিন্তুক পড়াশুনার এত চাপ যে কিছুতেই বাড়ি আসপার পারলাম না। এবার বাড়ি আইসা অনেকদিন থাকপ।”
ফুলী তখন আঁচলের ভিতর হইতে এক টুকরা কাপড় বাহির করিয়া বলিল, “দেহ বছির বাই! তুমার জন্যি একখানা রুমাল বানাইছি।”
রুমালখানা মেলিয়া ধরিয়া বছির বলিল, “বারি ত সুন্দর ঐছেরে। কি সুন্দর ফুল বানাইছাস? এ কিরে তুই যে মুড়ি খাইতাছস না? আয় দুই জনের মুড়ি একাত্তর কইরা আমরা খাই।”
এই বলিয়া নিজের মুড়িগুলি ফুলীর সাজিতে ঢালিয়া দিয়া দুইজনে খাইতে বসিল। খাওয়া শেষ হইলে ফুলী বলিল, “বছির বাই! আমার সঙ্গে আইস।”
এই বলিয়া বছিরকে টানিতে টানিতে বড়র কবরের পাশে লইয়া আসিল। এখানে আসিলে দুইটি কিশোর হিয়া যেন বড়ুর বিয়োগ ব্যথায় এক হইয়া যায়। বছির চাহিয়া দেখিল, বোনের কবরের উপরে সেই কুল গাছটির প্রায় সবগুলি ডাল বেড়িয়া সোনালতা জড়াইয়া আছে। ফুলীর তাজমহল ধীরে ধীরে প্রসারিত হইতেছে, কিন্তু বছিরের তাজমহল ত শুধু সোনালতার শোভায়ই শেষ হইবে না। সে যে ছেলে। তাকে জীবনের তাজমহল গড়িতে হইবে। আরও বেশী করিয়া পড়াশুনা করিতে হইবে। আরও বহু কষ্ট করিতে হইবে। বহুদিন আধাপেটা খাইয়া থাকিতে হইবে। জীবনের সম্মুখে সুদীর্ঘ কণ্টক পথ লইয়া সে আসিয়াছে। এই পথের মোড়ে মোড়ে অবহেলা-অপমান-অনাহার–বুভুক্ষা–সব তাকে অতিক্রম করিয়া চলিতে হইবে।
বহুক্ষণ দুইজনে নীরবে সেই কবরের পাশে বসিয়া রহিল। দুইজনের চোখ হইতেই ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু ধারা গড়াইয়া পড়িয়া কবরের মাটি সিক্ত করিতে লাগিল।
এই মূক কবরের তলা হইতে বড় যেন জাগিয়া উঠিয়া বছিরের কানে কানে বলিতেছে, “মিঞা ভাই! পানি পানি করিয়া আমি মরিয়াছি। তুমি এমন কাজ করিও, আমার মত আর কাউকে যেন এমনি পানি পানি কইরা মরতি না হয়।”
মনে মনে বছির আবার প্রতিজ্ঞা করিল, “সোনা বইন! তুমি ঘুমাও! আমি জাগিয়া রহিব। যতদিন না আমি তোমার মত সকল ভাই-বোনের দুঃখ দূর করিতে পারি ততদিন জাগিয়া থাকিব। দুঃখের অনল দাহনে নিজের সকল শান্তি সকল আরাম-আয়াস তিলে তিলে দান করিব। সোনা বইন! তুমি ঘুমাও–ঘুমাও!”
ভাবিতে ভাবিতে বছির উঠিয়া দাঁড়াইল। ফুলীও তাহার সঙ্গে সঙ্গে আসিল। ফুলী ভাবিয়াছিল, বছির ভাইকে সে সঙ্গে লইয়া বনের ধারে ডুমকুর ফল টুকাইবে। সে নিজে পাকা ডুমকুরের এক গাছ মালা গাথিয়া তাহার গলায় পরাইয়া দিবে। সেই মালা পাইয়া তাহাকে সুখী করিবার জন্য বছির গাছে উঠিয়া তাহার জন্য কানাই লাঠি পাড়িয়া দিবে। কিন্তু বছিরের মুখের দিকে চাহিয়া সে কোন কথাই বলিতে পারিল না। ধীরে ধীরে বাড়ি পৌঁছিয়া বছির তাহার বই-পুস্তক লইয়া বসিল। ফুলী অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়িয়া সেখান হইতে চলিয়া গেল।
দেখিতে দেখিতে গ্রীষ্মের ছুটি ফুরাইয়া আসিতেছে কিন্তু বছির একদিনও তার বই-পুস্তক ছাড়িয়া ঘরের বাহির হইল না। শহরে থাকিতে সে কত জল্পনা-কল্পনা করিয়াছ! দেশে যাইয়া এবার সে সজারুর কাটা টুকাইতে গভীর জঙ্গলে যাইবে। ঘন বেতের ঝোঁপের ভিতর হইতে বেথুন তুলিয়া আনিবে। তল্লা বাঁশের বাঁশী বানাইয়া পাড়া ভরিয়া বাজাইবে। বাঁশের কচি পাতা দিয়া নথ গড়িয়া ফুলীকে নাকে পরিতে বলিবে, কিন্তু ছুটির কয় দিন সে তার বই-পুস্তক ছাড়িয়া একবারও উঠিল না। সন্ধ্যা হইলে সামনের মাঠে যাইয়া বসে। তখনও পাঠ্যবই তার কোলের উপর।
ফুলী কতবার আসিয়া ঘুরিয়া যায়। ডুমকুর গাছ ভরিয়া কাটা। সেই কাটায় ক্ষত-বিক্ষত হইয়া ফুলী পাকা ডুমকুর তুলিয়া মালা গাঁথে। তারপর মালা লইয়া বছিরের সামনে আসিয়া অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকে। বছির একবারও তাহার দিকে ফিরিয়া চাহে না। বহুক্ষণ এইভাবে থাকিয়া সে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলিয়া চলিয়া যায়। যাইবার সময় বছিরের মা ডাকে, “ও ফুলী। এহনি যে চললি? আয়, তোর মাথার চুল বাইন্দা দেই।”
ফুলী ফিরিয়া চাহিয়া বলে, “না চাচী! আমার চুল বান্ধন লাগবি না। বাড়িতি আমার কত কাম পইড়া আছে। মা যেন আমারে কত গাইল-মন্দ করত্যাছে! আমি এহন যাই।”
যাইতে যাইতে সেই ডুমকুর গাছটির তলায় যাইয়া ফুলী সদ্য গাথা মালাগাছটিকে ছিঁড়িয়া কুটি কুটি করে। তারপর কোন সাত সাগরের পানি আসিয়া তার দুই চক্ষে ঢলিয়া পড়ে। অতটুকু মেয়ে। কি তার মনের ভাব কে বলিতে পারে!
“বোবা কাহিনী” উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ