(তিন)
নতুন বউ লইয়া আজাহের বাড়ি ফিরিল। বাড়ি বলিতে তাহার কিছু ছিল না। মোড়ল তাহার বাড়ির ধারেই একটি জায়গা আজাহেরকে ঘর তুলিতে অনুমতি দিয়াছিল। সেইখানে দো-চালা একখানা কুঁড়েঘর তৈরী করিয়া কোনমতে সে একটা থাকার জায়গা করিয়া লইয়াছিল। তারই পাশে ছোট্ট একখানা রান্নাঘর। বউ আনিয়া আজাহের সেই বাড়িতে উঠিল। পাড়ার ছেলেমেয়েরা দৌড়াদৌড়ি করিয়া বউ দেখিতে আসিয়া তার ছোট বাড়িখানা কলরবে মুখর করিয়া তুলিল। সেই কলরবে তরঙ্গে তরঙ্গে আজাহেরের অন্তরের খুশীর তুফান যেন উথলিয়া উঠিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরে গ্রামের লোকজন সকলেই চলিয়া গেল।
আজাহের উঠানে বসিয়া নীরবে হুঁকা টানিতেছিল আর সেই কার ধুয়ার উপরে মনে মনে তাহার ভবিষ্যৎ-জীবনের সুখকর ছবি অঙ্কিত করিতেছিল। সমস্ত বাড়িখানা নীরব। কিন্তু সকল নীরবতা ভঙ্গ করিয়া কে যেন তাহার চারিদিক বেড়িয়া খুশীর ঝাঁঝর বাজাইতেছিল। ঘরের এক কোণে একটা পুটলীর মত জড়সড় হইয়া বউটি বসিয়াছিল। কি করিয়া সে বউটির সঙ্গে কথা বলিবে ভাবিয়া পাইতেছিল না।
বেচারী আজাহের! কত মাঠের কঠিন বুক সে লাঙলের আঘাতে ফাড়িয়া চৌচির। করিয়াছে–কত দৌড়ের গরুকে সে হেলে-লাঠির আঘাতে বশে আনিয়াছে। কত দেশে-বিদেশে সে পৈড়াত বেচিয়া কত বড় বড় লোকের সঙ্গে কথা কহিয়াছে, কিন্তু যে তাহার সারা জীবনের সঙ্গী হইয়া তাহার ঘর করিতে আসিল, তাহার সঙ্গে কথা কহিতে আজাহেরের সাহসে কুলাইয়া উঠিতেছে না, কি করিয়া সে কথা আরম্ভ করে কোন কথা সে আগে বলে কিছুই তাহার মনে আসিতেছে না। বিবাহের আগে সে কত ভাবিয়া রাখিয়াছিল–বউ আসিলে এইভাবে কথা আরম্ভ করিবে। এইভাবে রসিকতা করিয়া বউকে হাসাইয়া দিবে কিন্তু আজ সমস্তই তাহার কাছে কেমন যেন ঘুলাইয়া যাইতেছে।
ভাবিতে ভাবিতে আজাহের ঘামিয়া গেল। উঠানের আমগাছটি হইতে একটা পাখি কেবলই ডাকিয়া উঠিতেছিল, বউ কথা কও, বউ কথা কও। এই সুর সমস্ত নীরব গ্রামখানির উপর ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। চারিধারের ঘনবনের অন্ধকার ভেদ করিয়া ঝি ঝি পোকাগুলি সহস্র সুরে গান গাহিতেছিল, তাহারই তালে তালে বনের অন্ধকার পথ ভরিয়া জোনাকীর আলোগুলি দুলিয়া উঠিতেছিল।
অনেকক্ষণ নীরবে বসিয়া থাকিয়া আজাহের উঠিয়া আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিল। কেরোসিনের প্রদীপটি কতকটা মান হইয়া আসিয়াছিল। আজাহের তাহার সলিতা একটু উস্কাইয়া দিল। তারপর ঘরের মধ্যে ছেঁড়া মাদুরটি বিছাইয়া তাহার উপর শততালি দেওয়া কথাখানা অতি যত্নের সঙ্গে বিছাইল। রসুনের খোসায় তৈরী ময়লা তেল লাগান বালিশটি এক পাশে রাখিল। তারপর বউটিকে আস্তে কোলপাথালী করিয়া ধরিয়া আনিয়া সেই বিছানার এক পাশে শোয়াইয়া দিল।
এবার আজাহের কি যে করে ভাবিয়া পায় না। বিছানার একপাশে সেই শাড়ী-আবৃত বউটির দিকে একদৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। শাড়ীর ফাঁক দিয়া বউ-এর মেহেদী মাখান সুন্দর। পা-দুটি দেখা যাইতেছিল। তারই দিকে চাহিয়া চাহিয়া আজাহেরের সাধ মিটিতেছিল না। ঘোমটার তল হইতে বউটি যেন বুঝিতে পারিল তাহার পা দুইটির পানে একজন চাহিয়া আছে। সে তখন ধীরে ধীরে পা দুইটি শাড়ীর আঁচলে ঢাকিয়া লইল। তাহাতে বউ-এর সুন্দর হাত দুটি বাহিরে আসিল। আজাহের আস্তে আস্তে নিজের দু’খানা হাতের মধ্যে। সেই রঙীন হাত দুখানা লইয়া নীরবে খেলা করিতে লাগিল। শাড়ীর অন্তরাল হইতে মেয়েটির মৃদু নিশ্বাস লওয়ার শব্দ শোনা যাইতেছিল, তাহা যেন আজাহেরের সমস্ত দেহমন গরম করিয়া তুলিতেছিল।
ধীরে ধীরে আজাহের বউএর মাথার ঘোমটাটি খুলিয়া ফেলিল। কেরোসিনের প্রদীপটি সামনে ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলিতেছে। তার আলোয় বউ-এর রাঙা টুকটুকে মুখখানা দেখিয়া দেখিয়া আজাহেরের সাধ মেটে না। বউ যেন ঘুমেই অচেতন। আজাহের মুখোনিকে একবার এদিকে উল্টাইয়া দেখে আবার ওদিকে উলটাইয়া দেখে। বাহুখানি লইয়া মালার মত করিয়া গলায় পরে। চারিদিকে মৃত্যুর মত নীথর স্তব্ধতা। সম্মুখের এই একটি নারীদেহ যেন সহস্র সুরে আজাহেরের মনে বাঁশী বাজাইতেছিল। সেই দেহটি সারিন্দা, তাকে মনের খুশীতে নাড়িয়া চাড়িয়া আজাহের যেন মনে মনে কত শত ভাটিয়ালি সুরের গান আকাশে বাতাসে ছড়াইয়া দিতেছিল। সেই সুরে চারিদিকের স্তব্ধতা ভেদ করিয়া আজাহেরের অন্তরে ছবির পর ছবি ভাসিয়া উঠিতে লাগিল।
তাহার ছোট্ট উঠানটি ভরিয়া একটি রাঙা টুকটুকে বউ ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। তার রাঙা পায়ের ছাপের উপরে কে যেন কলমীর ফুল ছড়াইয়া যাইতেছে। পৌষ মাসের উতল বাতাসে বাড়ির কদম গাছটির তলায় একটি বউ ধান উড়াইতেছে। ঈষৎ বাঁকা হইয়া দুই হাতের উপর কুলাভরা ধানগুলিকে সে বাতাসে উড়াইয়া দিতেছে, হাতের চুড়ীগুলি টুং টুং করিয়া বাজিতেছে। চিটাগুলি উড়িয়া যাইতেছে, ধানগুলি লক্ষ্মীর মত বউ-এর পায়ের কাছে আসিয়া জড় হইতেছে! সুখের কথা ভাবিতে ভাবিতে আরো সুখের কথা মনে জাগিয়া ওঠে। প্রথম অঘ্রাণ মাসে নতুন ধানের গন্ধে গ্রাম ভরিয়া গিয়াছে। আঁটি ভরা গুচ্ছ গুচ্ছ লক্ষ্মী-শালি ধান মাথায় করিয়া আজাহের ঘরে ফিরিতেছে। বাড়ির বেকী বেড়াখানা ধরিয়া বউ তার পথের পানে চাহিয়া আছে। আজাহের আসিতেই বুকের আঁচল দিয়া বউ উঠানের কোণটি মুছিয়া দিল। সেইখানে ধানের আঁটি মাথা হইতে নামাইয়া ঘরের দাওয়ায় বসিয়া তামাক টানিতে টানিতে সে বউ-এর সঙ্গে দুই একটা সামান্য প্রয়োজনের কথা বলিতেছে।
এমনি ছবির পরে ছবি–তারপর ছবি। ভাবিতে ভাবিতে আজাহের কখন যে ঘুমাইয়া পড়িল টেরও পাইল না। অনেক দেরীতে ঘুম ভাঙ্গিয়া আজাহের দেখিতে পাইল বাড়িঘর সমস্ত ঝাট দেওয়া হইয়াছে। উঠানের একধারে তেঁতুল গাছটির তলায় ভাঙা চুলাটিকে পরিপাটি করিয়া লেপিয়া তাহার উপরে রান্না চড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে। সামনের পালান। হইতে বেতে-শাক তুলিয়া আনিয়া কুলার উপর রাখা হইয়াছে। তারই পাশে একরাশ ঘোমটা মাথায় দিয়া বউটি হলুদ বাটিতেছে। রাঙা হাত দুটি হলুদের রঙে আরো রাঙা হইয়া উঠিয়াছে।
অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া আজাহের দেখিল। তারপর তিন চারবার কাশিয়া গলাটাকে যথাসম্ভব মুলাম করিয়া কহিল, “বলি আইসাই তোমার এত কাম করনের কি দরকার ছিল? সকালে উইঠাই চুলা লেপতাছাও। তোমার ত কাল লাইগা জ্বর অবি।”
ঘোমটার তল হইতে কোন উত্তরই আসিল না। আজাহের কোলকেয় তামাক ভরিয়া যেন আগুন আনিতেই চুলার কাছে যাইয়া বসিল। এবার বউটির গায়ের সঙ্গে তাহার। ঘেঁসাঘেঁসি হইল। কোলকেয় আগুন দিয়া ফুঁ পাড়িতে পাড়িতে আজাহেরের ইচ্ছা করে এইখানে এই উনানের ধারে বসিয়া বউ-এর সঙ্গে সে অনেক রকমের গল্প করে। খেত-খামারের কথা, তার ভবিষ্যৎ জীবনের ছোটখাট কথা, আরো কত কি।
আজাহের বলে, “সামনের ভাদ্র মাসে পাট বেইচা তোমার জন্যি পাছা পাইড়া শাড়ী কিন্যা আনব। খ্যাতের ধান পাকলি তুমি মনের মত কইরা পিঠা বানাইও, কেমন?”
বউ কোন কথাই বলে না। নিরুপায় হইয়া আজাহের এবার সোজাসুজি বউকে প্রশ্ন করে, “বলি তোমাগো বাড়ির বড় গরুড়া কেমন আছে! শুনছি তোমার বাপ তোমাগো ছোট বাছুরডা বেচপি? আমারে কিন্যা দিতি পার?”
তবু বউ কথা কহিল না। আজাহেরের মন বড়ই অস্থির হইয়া পড়িল। ওই ছোট্ট রাঙা টুকটুকে মুখখানা হইতে যদি কথা বাহির হইত। রাঙা টুকটুকে কথা। কেন সে কথা বলে না!
এই রঙীন শাড়ীর অন্তরালে কি যে অদ্ভুত রহস্য লুকাইয়া রহিয়াছে! কে যেন কুয়াপের মন্ত্র পড়িয়া আজাহেরকে সেই রহস্যের দিকে টানিতেছে। সে যতই বউটির কথা ভাবিতেছে ততই সে এই রহস্য জালে জড়াইয়া পড়িতেছে।
স্নান করিতে আজাহের নদীতে আসিল। এতদিন স্নান করিতে তার দুইমিনিটের বেশী লাগে নাই, আজ প্রায় একঘন্টা ধরিয়া আঠাল-মাটি দিয়া সমস্ত গা ঘসিয়া সে স্নান করিল। তবু মনে হয় গায়ের সমস্ত ময়লা যেন তার পরিষ্কার হয় নাই। মাথার উস্কখুস্কু চুলগুলিতে আজ ছমাস নাপিতের কচি পড়ে নাই। যদি সময় থাকিত আজাহের এখনই যাইয়া নাপিত বাড়ি হইতে সুন্দর করিয়া ঘাড়ের কাছে খাটো করিয়া চুল কাটাইয়া আসিত।
স্নান করিয়া ভালমত মাথা মুছিয়া থালার উপরে পানি লইয়া রৌদ্রে বসিয়া তাহারই ছায়ায় নিজের মুখখানা সে বার বার করিয়া দেখিল। তারপর ঘরের বেড়া হইতে একখানা কাঠের ভাঙা চিরুণী আনিয়া মাথার অবাধ্য চুলগুলির সঙ্গে কসরৎ করিতে প্রবৃত্ত হইল। এই চিরুণীখানা সে চার বৎসর আগে কুড়াইয়া আনিয়াছিল। এতদিন তাহা কাজে লাগাইবার অবসর হয় নাই। আজ তাহা কাজে আসিল। অনেকক্ষণ চুলের সঙ্গে এই রকম কসরৎ করিয়া আজাহের বিস্ময়ে চাহিয়া দেখিল, বউ তার দিকে চহিয়া মৃদু হাসিতেছে। আজাহেরের চোখে চোখ পড়িতেই তাড়াতাড়ি বউ ঘোমটায় মুখখানা ঢাকিয়া ফেলিল।
বেড়াইতে বেড়াইতে বিকাল বেলা রহিমদ্দী কারিকর আজাহেরের বাড়ি আসিল। আজাহের তাকে বড় আদর করিয়া বসাইল। নিজে তামাক সাজিতে যাইতেছিল। বউ তাড়াতাড়ি আজাহেরের হাত হইতে কলিকাটি লইয়া তামাক সাজিয়া আনিয়া দিল। রহিমদ্দী তামাক টানিতে টানিতে বলিল, “বড় ভাল বউ পাইছসরে আজাহের। বউ বড় কামের অবি।”
রহিমদ্দীর মুখে বউ-এর তারিফ শুনিয়া আজাহের বড়ই খুশী হইল। রহিমদ্দী আস্তে আস্তে আজাহেরের কানের কাছে মুখ লইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বউ-এর সাথে কি কি কথা বার্তা ঐল তোর আজ?”
আজাহের রহিমদ্দীর গায়ের উপর ঝুঁকিয়া পড়িয়া ফিসফিস করিয়া উত্তর দিল, “কি কব চাচা, বউ মোটেই কথা কয় না। বউর বুঝি আমারে পছন্দ অয় নাই।”
রহিমদ্দী বলিল, “দূর পাগলা, নতুন বউ, সরম করে না? একদিনেই কি তোর সঙ্গে কথা কবি?”
আজাহের যেন অকূলে কূল পাইল। সত্যই বউ তবে তাকে অপছন্দ করে না। নতুন বউ সরম করিয়াই তার সঙ্গে কথা বলে না। আজাহের এবার রহিমদ্দীকে একটি গান গাহিতে অনুরোধ করিল। রহিমদ্দী বলিল, “নতুন বউকে গান শুনাইবার চা নাকি?”
‘দূর’ বলিয়া আজাহের রহিমদ্দীকে একটা মৃদু ধাক্কা দিল। হাসিতে হাসিতে রহিমদ্দী গান আরম্ভ করিল,
“মাগো মাগো কালো জামাই ভাল লাগে না,–”
গান শুনিয়া আজাহের হাসিয়া গড়াইয়া পড়িতেছিল। সে যদি লক্ষ্য করিত দেখিতে পাইত নতুন বউ-এর ঘোমটার তল হাসিতে ভরিয়া টুবুটুবু হইয়াছে।
চারিদিকে অন্ধকার করিয়া আবার রাত্রি আসিল। কেরোসিনের কুপিটি জ্বালাইয়া বউ নিজেই বিছানা পাতিল। আজাহের অবাক হইয়া দেখিল তার সেই সাত-তালি দেওয়া ময়লা কাঁথাখানি একদিনেই পরিষ্কার হইয়া উঠিয়াছে। তাহার উপরে রঙীন সূতার দুই তিনটি ফুল হাসিতেছে। সেই বিছানার ফুলগুলিরই যেন সঙ্গী হইয়া বউ একপাশে যাইয়া বসিয়া রহিল। বউটির দিকে বার বার করিয়া যতবার আজাহের তাকায় তার কেবলই মনে হয়, এমন রূপ তার গরীবের কুঁড়েঘরে মানায় না। ভরা মাঠের সরষে খেত কে আজ জীবন্ত করিয়া তার ঘরে ফেলিয়া গেল। কত কষ্টই না তার হইবে। গরীব আজাহের এমন সুন্দর মেয়েটিকে সুখে রাখিতে সব কিছুই করিতে পারিবে। কিন্তু সে কি সুখী হইবে?
আজাহের বলে, “দেহ! আমার এহানে তোমার বড়ই কষ্ট অবি। কিন্তু জাইনো আমাগো দিন এই বাবেই যাবি না। আশ্বিন মাসে পাট বেইচা অনেক টাহা পাব। সেই টাহা দিয়া তোমার জন্য জেওর গড়ায়া দিব। তুমি দুক্ষু কইর না, আমি না খায়া তোমারে খাওয়াব, ঠোঁটের আধার দিয়া তোমারে পালব–তোমারে খুব ভাল জানব–আমার কলজার মধ্যে তোমারে ভইরা রাখপ।”
বউ একটু হাসিয়া আঁচলের বাতাসে কেরোসিনের কুপিটি নিবাইয়া আজাহেরের মুখে, একটি মৃদু ঠোক্কা মারিয়া বিছানার উপর যাইয়া শুইয়া পড়িল। আজাহের বউ-এর সমস্ত দেহটি নিজের দেহের মধ্যে লুকাইয়া তার বুকে মুখে ঘাড়ে সমস্ত অঙ্গে মুখ রাখিয়া কেবলই বলিতে লাগিল, “আমার একটা বউ ঐছে–সোনা বউ ঐছে–লক্ষী বউ ঐছে–মানিক বউ ঐছে। তোমারে আমি বুকে কইরা রাখপ–তোমারে আমি কলজার মধ্যে ভইরা রাখপ–আমার মানিক, আমার সোনা, তোমারে মাথায় কইরা আমি মাঠ ভইরা ঘুইরা আসপ নাকি? তোমারে বুকে কইরা পদ্মা গাঙ সঁতরাইয়া আসপ নাকি? আমার ধানের খ্যাতরে, আমার হালের লাঠিরে–আমার কোমরের গোটছড়ারে–আমার কান্ধের গামছারে। তোমারে আমি গলায় জড়ায়া রাখপ নাকি?”
আজাহের পাগলের মত এমনই আবল তাবল বকিয়া যাইতেছিল। বউটি হাসিয়া কুটি কুটি হইতেছিল। মাঝে মাঝে আজাহেরের মুখে এক একটি মৃদু ঠোকনা দিতেছিল।
ভালবাসার অনেক কথা ওরা জানে না। বউ-এর হাতের মৃদু ঠোনায় আজাহেরের সমস্ত অঙ্গ পুলকে ভরিয়া যায়। আজাহের যেন আজ ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিয়াছে। বউ এর সুন্দর নরম দেহটিকে সে যেন আজ লবঙ্গ এলাচির মত শুকিয়া শুকিয়া নিজের বুকে ভরিয়া লইবে।
এমনই করিয়া কখন যে রাত শেষ হইয়া গেল তাহারা টেরও পাইল না। প্রভাতের মোরগ ডাক দিতেই বউ তাড়াতাড়ি উঠিয়া উঠান ঝাট দিতে আরম্ভ করিল। ঘরের দরজার ফাঁক দিয়া আজাহের দেখিতে পাইল, পূব আকাশের কিনারায় পূব-ঘুমানীর বউ জাগিয়া উঠিয়াছে।
মুখ হাত ধুইতে ধুইতে সমস্ত আকাশ সোনালী রোদে ভরিয়া গেল। ঘর-গেরস্থালীর কাজে বউ এখানে সেখানে ঘুরিয়া ফিরিতেছিল। আজাহের ঘরের দরজার সামনে বসিয়া গান ধরিল
বাড়িতে নতুন বহু আসিয়া,
কথা কয় রাঙা মুখে হাসিয়া;
আমার বাঁশী বাজে তারিয়া নারিয়া নারিয়ারে।
পাড়ায় পাড়ায় বেড়ায় বহু লাল শাড়ী পরিয়া,
লাল মোরগের রঙীন পাখা নাড়িয়া নাড়িয়া;
ও ভাইরে ঝলমল কি চলমল করিয়া।
একাজ ওকাজে যাইতে চোখাচোখী হইতেই বউ-এর মুখখানা কৌতুক হাসিতে ভরিয়া যায়। আজাহের আরো উৎসাহের সঙ্গে গান ধরে–
বউ ত নয় সে হলদে পাখি এসেছে উড়িয়া
সরষে খেত নাড়িয়া
হয়ত বা পথ ভুলিয়া;
আমার মনে বলে রাখি তারে পিঞ্জিরায় ভরিয়া হৃদয়ে পুরিয়া
নইলে যাবে সে উড়িয়া।
ও ভাইরে ফুরপুর কি তুরতুর করিয়া।
গানের শেষ লাইনটি আজাহের বারবার ঘুরাইয়া ফিরাইয়া গাহিতে লাগিল। গান থামিলে ঘোমটার তল হইতে অতি মিহি সুরে বউ বলিল–”বাড়িতে আগুন নাই। ও-বাড়ির ত্যা আমাগো উনি আগুন আনুক গিয়া।”
এই কথা কয়টি আজাহেরের মনে সুধা বর্ষণ করিল। তার নিজের হাতে গড়া সারিন্দা যেন আজ প্রথম বোল বলিল। ব্যস্ত সমস্ত হইয়া সে মোড়লের বাড়িতে আগুন আনিতে ছুটিল। পথে যাইতে যাইতে বউ-এর সেই ছোট্ট কথা কয়টি যেন তাহার কানে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বাজিতে লাগিল।
এমনই করিয়া আরো দুই তিনদিন কাটিয়া গেল। আজাহেরের নিকট তার বউকে যতই ভাল লাগিতেছিল, ততই সে মনে মনে ভাবিয়া অস্থির হইয়া উঠিতেছিল, কি করিয়া সে বেশী করিয়া উপার্জন করিবে? কি করিয়া সে বউকে আরো খুশী করিতে পারিবে?
দিনের বেলা আজাহের পৈড়াত বেচিতে ভিন গায়ে যায়। বাড়ি ফিরিতে সন্ধ্যা পারাইয়া যায়। তখন বাঁশের কঞ্চি বাঁকাইয়া ঝুড়ি তৈরী করিতে বসে। প্রায় অর্ধেক রাত বসিয়া বসিয়া কাজ করে। বউ তার সঙ্গে সঙ্গে পাট দিয়া সরু তাইতা পাকাইতে থাকে। হাটের দিন এগুলি বিক্রি করিয়া তাহারা দুপয়সা জমা করিবে।
পৈড়াত বেচিয়া আজাহের যাহা উপার্জন করে, তাহাতে দুজনের খাওয়া খরচই কুলাইয়া উঠিতে চাহে না! আলীপুরের শরৎ সাহার কাছ হইতে আজাহের পনর টাকা কর্জ করিয়া আনিয়াছে। প্রতি টাকায় মাসে এক আনা করিয়া সুদ। যেমন করিয়াই হোক আজাহের ছয় মাসের মধ্যে সেই টাকা শোধ করিয়া দিবে। দুইজনে মুখামুখি বসিয়া পরামর্শ করে, কি করিয়া আরো বেশী উপার্জন করা যায়। মোড়লের কাছ হইতে আজাহের দুই বিঘা জমি বরগা লইয়াছে। বউ এর বাপের বাড়ি হইতে কয়েক দিনের জন্য বলদ দুইটি সে ধার করিয়া জমিটুকু চষিয়া ফেলিবে। সেই জমিতে আজাহের পাট বুনিবে। খোদা করিলে দুই বিঘা জমিতে যদি ভাল পাট জন্মে, তবে ভাদ্র মাসেই সে তার বরগা ভাগে। এক বিঘা জমির পাটের মালিক হইবে। এক বিঘা জমিতে কমসেকম পনর মণ পাট জমিতে পারে। আগামী বারে যদি পাটের দাম পাঁচ টাকা করিয়াও হয়, পনের মন পাটে সে পাঁচ কম চার কুড়ি টাকার মালিক হইবে! বউ তুমি অত ভাবিও না। শরৎ সাহার দেনাটা শোধ করিয়া যে টাকাটা থাকিবে সেই টাকা দিয়া আজাহের দুইটি ভালো বলদ কিনিবে, আর বউ এর জন্য একখানা পাছাপেড়ে শাড়ী কিনিয়া আনিবে।
বউ বলে, “শাড়ী কিন্যা কি অবি। শাড়ীর টাকা দিয়া তুমি একটা ছাগল কিন্যা আইন। কয় মাস পরে ছাগলের বাচ্চা অবিবাচ্চাগুলান বড় ঐলে বেইচা আরো কিছু জমি অবি।”
আজাহের বলে, “আইচ্ছা–বাইবা দেখপ পরে।”
অনেক বড় হইতে তাহারা চাহে না। মাথা পুঁজিবার মত দুখানা ঘর, লাঙল চালাইবার মত কয়েক বিঘা জমি আর পেট ভরিয়া আহার;–এরি স্বপ্ন লইয়া তাহারা কত চিন্তা করে, কত পরামর্শ করে, কত ফন্দি-ফিকির আওড়ায়।
সকালে বউ রাধে না। পূর্ব দিনের বাসি ভাত যা অবশিষ্ট থাকে তাহাতে জল মিশাইয়া কাঁচা লঙ্কা ও লবণ দিয়া দুইজনে খাইয়া পেট ভরায়। কোন কোন দিন অনাহারেই কাটায়।
এত অল্প খাইয়াও মানুষ বাঁচিতে পারে! তবু তাহাদের কাজের উৎসাহ কমে না! তবু তাহারা গান করে! রাত জাগিয়া গল্প করিতে করিতে কাজ করে! মাথা খুঁজিবার মত একখানা ঘর, পেট ভরিয়া দুই বেলা আহার, একি কম ভাগ্যের কথা!
“বোবা কাহিনী” উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ