(আঠাশ)

ফরিদপুর আসিয়া বছির স্থান পাইল রমিজদ্দীন উকিলের বাসায়। লাকড়ি বেচিতে আসিয়া আজাহের রমিজদ্দীন সাহেবের সঙ্গে পরিচিত হয়। তাহাকে বলিয়া কহিয়া অনেক কাকুতি-মিনতি করিয়া ছেলে বছিরকে তাহার বাসায় রাখিবার অনুমতি পাইয়াছে।

রমিজদ্দীন সাহেব ফরিদপুরের নতুন উকিল। তাঁহার বাড়িতে মামলাকারী মক্কেল বড় আসে না। শূন্য বৈঠকখানায় বসিয়া তিনি মক্কেল ধরিবার নানা রকম ফন্দি-ফিকির মনে মনে আওড়ান। তখনকার দিনে মুসলমান বলিতে কয়েকজন জুতার দোকানদার (হিন্দুরা তখন জুতার ব্যবসা করিত না। কিন্তু জুতা পরিত) কলা কচুর বেপারী আর অফিস আদালতের জনকতক পিওন-চাপরাসী ছাড়া ফরিদপুর শহরে আর কোন মুসলমানের বাস ছিল না। ইহাদিগকে লইয়া উকিল সাহেব একটি আঞ্জুমান-এ-ইসলাম প্রতিষ্ঠান গঠন করিলেন। এই সমিতির পক্ষ হইয়া তিনি মাঝে মাঝে শহরের নিকটবর্তী মুসলমান প্রধান গ্রামগুলিতে যাইয়া বক্তৃতা করিতেন। শহরের সব কিছুই হিন্দুদের অধিকারে। বড় বড় দোকানগুলি হিন্দুরা চালায়। অফিস আদালতের চাকরিগুলি সব হিন্দুরা করে। গরীব মুসলমান ভাইরা শুধু চাহিয়া চাহিয়া দেখে। শহরের উকিল মোক্তার সবই হিন্দু। হিন্দু হাকিম–হিন্দু ডেপুটি হিন্দু জজ। মুসলমানেরা জমা-জমি লইয়া মামলা মোকদ্দমা করে। ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ করিয়া শহরে যাইয়া বিচার চায়। নিজেদের কষ্টের উপার্জিত টাকা তাহারা শহরে যাইয়া হিন্দু উকিল মোক্তাদিগকে ঢালিয়া দিয়া আসে।

“ভাই সব! আপনারা আর মামলা-মোকদ্দমা করিবেন না। যদিই বা করেন, এই খাকসার আপনাদের খেদমত করিবার জন্য প্রস্তুত রহিল। আমাকে যাহা দিবেন তাহাতেই আমি আপনাদের মামলা করিয়া দিব।”

শিক্ষিত সমাজের তেমন কোন দান নাই, অপরপক্ষে দেশের অশিক্ষিত চাষী মুসলমান সমাজে লোক-সাহিত্য ও লোকশিল্পের দান দিনে দিনে শতদলে ফুটিয়া উঠিতেছিল। গত। উনবিংশ শতাব্দিতে হিন্দু শিক্ষিত সমাজ তার সাহিত্য-কলায় ইউরোপীয় ভাবধারা আহরণ । করিয়া যে সাহিত্য-সম্পদ সৃষ্টি করিলেন, মুসলিম চাষী সমাজের লোক-সাহিত্য ও লোক-কলার দান তাহার চাইতে কোন অংশে হীন নয়। বরঞ্চ দেশের মাটির সঙ্গে ইহার যোগ থাকায় স্বকীয়তায় ইহা শ্রেষ্ঠত্বের দাবী করিতে পারে। দেশের আরবী, ফারসী শিক্ষিত সমাজ ইংরেজ যুগে অর্থহীন, সম্মানহীন ও জীবিকাহীন হইয়া দারিদ্রের চরমতম ধাপে নামিয়া গেল। আগেই বলিয়াছি, যাহাদের ঘরে সুখ নাই তাহারা পরের আনন্দে ঈর্ষাতুর। হইয়া পড়ে।

দেশের তথাকথিত মোল্লা সমাজ এই অপূর্ব পল্লী-সম্পদের শত্রু হইয়া পড়িলেন। এই মোল্লা সমাজের হাতে একদিন জেহাদের অস্ত্র ছিল। আদর্শবাদের জন্য লড়াই করিবার। প্রাণ-সম্পদ ছিল। তাহা ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হইল দোজখের ভয়াবহ বর্ণনায়, কঠিন শাস্তির নিষ্ঠুর পরিকল্পনায়, আর নিষেধের নানা বেড়াজাল রচনায়। দেশের জনসাধারণ। যদিও মাওলানাদের আড়ালে-আবডালে আনন্দ-উৎসবে মাতিয়া উঠিত, কিন্তু মাওলানাদের। বক্তৃতার সভায় আসিয়া তাহারা দোজখের ভীষণতর বর্ণনার কথা শুনিয়া ভয়ে কাঁপিয়া উঠিত। তাই অশিক্ষিত মুসলিম সমাজে এই মাওলানাদের প্রভাব ছিল অসামান্য।

রমিজদ্দীন সাহেব অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া এবার এই মাওলানা সাহেবদের তাঁহার। আঞ্জুমান-সমিতির মেম্বার করিয়া লইলেন। তাহাদিগকে সঙ্গে লইয়া তিনি গ্রামে বক্তৃতা করিতে লাগিলেন। শুধুমাত্র গান গাওয়া আর বাদ্য বাজানো হারাম নয়। হাদীসের সূক্ষ্মাতি সূক্ষ আয়াতের ব্যাখ্যা করিয়া তাহার দলের মাওলানা সাহেবরা আরও অনেক নিষেধের প্রাচীর রচনা করিতে লাগিলেন। মাওলানা সাহেবদেরই মত এবার হইতে উকিল সাহেবও গ্রামবাসীদের শ্রদ্ধার ও ভক্তির পাত্র হইয়া উঠিলেন। মাওলানাদের চেষ্টায় দু’একটি। মোকদ্দমাও তিনি পাইতে লাগিলেন। দিনে দিনে তাহার বৈঠকখানা হইতে ধূলি উড়িয়া। গেল। লোকজনে বৈঠকখানা গম গম করিতে লাগিল।

পিতার সঙ্গে আসিয়া বছির রমিজদ্দীন সাহেবের বাসায় স্থান পাইল। বৈঠকখানার এক কোণে একখানা চৌকীর উপর সে তাহার বই-পত্র সাজাইয়া লইল। কিন্তু পড়িবে কখন? সব সময় কাছারী ঘরে লোকজনের কোলাহল। কোন কোন রাত্রে দূরদেশী কোন মক্কেল। আসিয়া তাহার বিছানার অংশী হয়। বছির একেবারেই পড়াশুনা করিতে পারে না। গ্রামদেশে থাকিয়া তাহার অভ্যাস। কিন্তু শহরের এই কোলাহলে রাত্রে তাহার ঘুম আসে না। জাগিয়া থাকিয়া বই পড়িবারও উপায় নাই; কারণ রাত্রে হারিকেন লণ্ঠনটি উকিল সাহেব অন্দর মহলে লইয়া যান।

বিছানায় শুইয়া বছির মায়ের কথা মনে করে পিতার কথা মনে করে। তাহাদের বাড়ির বড় আমগাছটির কথা মনে করে। সেই আমগাছের তলায় ছোট বোন বড়কে লইয়া তাহারা খেলা করিত। সেই বড় আর তাহাদের সঙ্গে খেলিবে না। বড়ুর কবরে বসিয়া বছির প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল, লেখাপড়া শিখিয়া সে বড় ডাক্তার হইবে। কিন্তু পড়াশুনা না। করিলে কেমন করিয়া সে ডাক্তার হইবে! রোজ সকাল হইলে তাহাকে বাজার করিতে : যাইতে হয়। বাজার করিয়া আসিয়া দেখে তাহার চৌকিখানার উপর তিন চারজন লোক বসিয়া গল্প করিতেছে। তাহারই পাশে একটুখানিক জায়গা করিয়া লইয়া সে পড়িতে বসে। অমনি উকিল সাহেব এটা ওটা কাজের জন্য তাহাকে ডাকিয়া পাঠান। শুধু কি উকিল শুনিয়া শ্রোতারা সকলেই সায় দেয়। উকিল সাহেব এ-গ্রামে যান-ও-গ্রামে যান। সকলেরই এক কথা। এবার মামলা করিতে হইলে আপনাকেই আমরা উকিল দিব। কিন্তু মামলা করিতে আসিয়া তাহারা রমিজদ্দীন সাহেবকে উকিল নিযুক্ত করে না। ও-পাড়ায় সেনমশায়-দাসমশায়–মিত্তিরমশায়–ঘোষমশায় কত বড় বড় উকিল। তাহাদের বৈঠকখানায় মক্কেলে গম গম করে। রমিজদ্দীন সাহেবের বৈঠকখানায় রাশি রাশি ধূলি তাহার দীর্ঘ নিশ্বাসের প্রতীক হইয়া বাতাসে উড়িয়া বেড়ায়। তাহারই একপাশে বসিয়া বহুদিনের পুরাতন খবরের কাগজখানা সামনে লইয়া উকিল সাহেব বৃথাই মক্কেলের জন্য অপেক্ষা করিয়া বসিয়া থাকেন।

বিষয় সম্পত্তি হারাইয়া খুনী মোকদ্দমার আসামী হইয়া যাহারা মামলা করিতে শহরে আসে তাহারা উকিল নির্বাচন করিতে হিন্দু মুসলমান বাছে না। নিজেদের বিপদ হইতে উদ্ধার পাইবার জন্য তাহারা ভাল উকিলেরই সন্ধান করে। সব চাইতে ভাল উকিল হয়ত সব সময় তাহারা নির্বাচন করিতে পারে না। কিন্তু কোন উকিলের পশার ভাল তাহা তাহারা জানে। সেই পশার দেখিয়াই তাহারা উকিল নির্বাচন করে। ডাক্তার বা উকিল নির্বাচনে তাই সাম্প্রদায়িক বক্তৃতা কোন প্রভাব বিস্তার করিতে পারে না। যে লোক খুনী মোকদ্দমার আসামী, সে চায় এমন উকিল যে তাহাকে জেল হইতে ফাঁসী-কাষ্ঠ হইতে বাঁচাইতে পারিবে। সে তখন নিজের অর্থ-সামর্থ অনুসারে উপযুক্ত উকিল বাছিয়া লয়। যার ছেলে মৃত্যু শয্যায় সে ক্ষণেকের জন্যও চিন্তা করে না তাহার ডাক্তার হিন্দু না মুসলমান। গ্রামে গ্রামে বহু বক্তৃতা দিয়াও উকিল সাহেব তাই কিছুতেই তার পশার বাড়াইতে পারিলেন না। তখন তিনি মনে মনে আরও নতুন নতুন ফন্দি-ফিকির আওড়াইতে লাগিলেন।

পাক ভারতে মুসলিম রাজত্ব শেষ হইবার পর একদল মাওলানা এদেশ হইতে ইংরেজ তাড়ানোর স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন। সহায়-সম্পদহীন যুদ্ধ-বিদ্যায় অনভিজ্ঞ সেই মুসলিম দল শুধু মাত্র ধর্মের জোরে সে যুগের ইংরেজ-রাজের অত্যাধুনিক অস্ত্র-সজ্জার সামনে টিকিয়া দাঁড়াইতে পারিল না। খাঁচায় আবদ্ধ সিংহ যেমন লৌহ-প্রাচীর ভাঙ্গিতে না পারিয়া আপন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিঁড়িয়া খাইতে চাহে, সেইরূপ এই যোদ্ধার দল নানা সংগ্রামে পরাজিত হইয়া হৃত-সর্বস্ব হইয়া ক্ষোভে দুঃখে আপন সমাজ দেহে আক্রমণ চালাইতে লাগিল। স্বাধীন। থাকিতে যে মুসলিম সমাজ দেশের চিত্রকলায় ও সঙ্গীত-কলায় যুগান্তর আনয়ন। করিয়াছিল, আজ তাহারাই ঘোষণা করিলেন গান গাওয়া হারাম-বাদ্য বাজানো হারাম, মানুষ ও জীব-জন্তুর ছবি অঙ্কন করা হারাম।

ইংরেজ আমলে উচ্চশ্রেণীর মুসলমানেরা আর্থিক অবনতির ধাপে ধাপে ক্রমেই নামিয়া যাইতেছিলেন। আর্থিক সঙ্গতি না থাকিলে মানুষের মধ্যে সঙ্গীত-কলার প্রতি অনুরাগ। কমিয়া যায়। যাহাদের ঘরে দুঃখ তাহারা অপরের আনন্দে ঈর্ষাতুর হইয়া পড়ে। তাই দেখিতে পাই, তখনকার দিনের মুসলিম শিক্ষিত সমাজ এই পরিবর্জনের আন্দোলনে পুরোধা হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন।

ইংরেজের কঠোর শাসনে ধর্ম এখন আর জেহাদের জন্য, মানবতার সেবার জন্য লোকদিগকে আহ্বান করিতে পারে না। প্রথা-সর্বস্ব ধর্ম এখন মানুষের আনন্দমুখর জীবনের উপর নিষেধের পর নিষেধের বেড়াজাল বিস্তার করিতে লাগিল। মুসলমান রাজ ত্বকালে দেশের জনসাধারণের যে অবস্থা ছিল, ইংরেজ আমলে তাহার কোনই পরিবর্তন হইল না। বরঞ্চ ইংরেজের শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রিত শাসনে তাহারা বহিঃশত্রুর হাত হইতে কিছুটা রক্ষা পাইল। সেইজন্য দেখিতে পাই, সাহিত্য-কলা-শিল্পের ক্ষেত্রে দেশের মুসলিম সাহেব? মাওলানা সাহেবরা তাহাকে প্রায়ই পান আনিতে পাঠান-সিগারেট আনিতে পাঠান। ওজুর পানি দিতে বলেন। এইসব কাজ করিয়া কিছুতেই সে তাহার পাঠ্যপুস্তকে মন বসাইতে পারে না। স্কুলে যাইয়া মাষ্টারের বকুনি খায়। রোজকার পড়া রোজ তৈরী করিয়া যাইতে পারে না। ছুটিছাটার দিনে সে যে পড়া তৈরী করিবে তাহারও উপায় নাই। তাহাকে স্বেচ্ছাসেবকের ব্যাজ পরাইয়া উকিল সাহেব মাওলানাদের সঙ্গে লইয়া এ-গ্রামে ও-গ্রামে বক্তৃতা করিতে যান।

যদিও বছির একেবারেই ছেলে মানুষ তবু উকিল সাহেবের অন্দর মহলে তাহার যাইবার হুকুম নাই। একটি ছোট্ট মেয়ে-চাকরানী টিনের থালায় করিয়া সামান্য কিছু ভাত আর ডাল তাহার জন্য দুইবেলা রাখিয়া যায়। ইঁদারা হইতে পানি উঠাইয়া একটি নিকেলের গ্লাসে পানি লইয়া বছির সেই ভাত খায়। সেই অল্প পরিমাণ ভাতে তাহার পেট ভরে না। গ্লাস হইতে পানি লইয়া সে শূন্য পেট ভরায়। বিকালে স্কুল হইতে আসিয়া তাহার এমন ক্ষুধা লাগে যে ক্ষুধার জ্বালায় তখন নিজের গা চিবাইতে ইচ্ছা করে। রাত্রের আহার আশে সেই নয়টার সময়। তখন পর্যন্ত তাহাকে দারুণ ক্ষুদা লইয়া অপেক্ষা করিতে হয়।

উকিল সাহেব যখন মাওলানাদের সঙ্গে লইয়া বক্তৃতা করিতে এ-গ্রামে গ্রামে যান তখন গ্রামের লোকেরা ভালমত খাবারের বন্দোবস্ত করে। সেখানে যাইয়া বছির পেট ভরিয়া খাইতে পায়। উকিল সাহেবের বাসায় আধপেটা খাইয়া তাহার শরীরের যেটুকু ক্ষয় হয় গ্রাম দেশে দাওয়াত খাইয়া সে তাহার ক্ষতিপূরণ করিয়া লয়।

প্রত্যেক সভায়ই উকিল সাহেবের খাস মাওলানা শামসুদ্দীন সাহেব বক্তৃতা শেষ করিয়া সমবেত লোকদিগকে বলেন, “দেখুন ভাই সাহেবরা! এই গরীব ছেলেটিকে উকিল সাহেব দয়া করিয়া বাসায় রাখিয়া খাইতে দেন। আপনারা খেয়াল করিবেন, শহরে একটি ছেলেকে খাওয়াইতে উকিল সাহেবকে কত খরচ করিতে হয়। প্রতিমাসে যদি দশ টাকা করিয়াও ধরেন তবে বৎসরে একশত কড়ি টাকা। এই ছেলে আরও বার বৎসর শহরে থাকিয়া পড়িবে। হিসাব করিয়া দেখিবেন, এই বার বৎসরে উকিল সাহেবকে এক হাজার চার শত চল্লিশ টাকা খরচ করিতে হইবে। এত বড় মহৎপ্রাণ না হইলে,–সমাজ-দরদী না হইলে আপন ইচ্ছায় তিনি এত টাকা কেন খরচ করিবেন? এই টাকা দিয়া তিনি বিবির গহনা গড়াইতে পারিতেন–নিজের বাড়ি-ঘর পাকা করিতে পারিতেন। আজ যে কত কষ্ট করিয়া উকিল সাহেব পায়ে হাঁটিয়া এখানে আসিয়াছেন, ইচ্ছা করিলে তিনি এই টাকা দিয়া মোটর গাড়ি কিনিয়া ধূলি উড়াইয়া আপনাদের এখানে আসিয়া উপস্থিত হইতে পারিতেন! এই নাদান মুসলিম সমাজের জন্য তিনি যে ত্যাগ স্বীকার করিলেন, ভাই সাহেবানরা! আসুন আমরা উকিল সাহেবের জন্য আল্লার দরবারে মোনাজাত করি।”

মোনাজাত শেষ হইলে মাওলানা সাহেব বলিতেন, “ভাইসব! এবার ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের ভোটের দিন আপনারা উকিল সাহেবকে ভুলিবেন না। আর শহরে যাইয়া মামলা-মোকদ্দমা করিতে সকলের আগে আপনাদের জনদরদী-বন্ধু উকিল সাহেবকে মনে রাখিবেন।”

তখন উকিল সাহেব উঠিয়া বক্তৃতা আরম্ভ করেন, “ভাইসব! ইতিপূর্বে মাওলানা সাহেব সব কিছুই বলিয়া গিয়াছেন। আমি মাত্র একটি কথা বলিতে চাই। দুনিয়া যে গাইব হইয়া যাইবে সে বিষয়ে আমার একটু মাত্রও সন্দেহ নাই। আজ আমরা কি দেখিতেছি–মুসলমানের ঘরে জন্ম লইয়া বহু লোকে গান বাজনা করে, সারিন্দা-দোতারা বাজায়, মাথায় লম্বা চুল রাখে আর রাত ভরিয়া গান করে। উহাতে আল্লাহ কত বেজার হন তাহা আপনারা মাওলানা সাহেবের মুখে শুনিয়াছেন! আপনারা খেয়াল করিবেন, দেশে যে এত বালা মুছিবাত আসে, কলেরা, বসন্তে হাজার হাজার লোক মৃত্যুমুখে পতিত হয় তাহা এই গান বাজনার জন্য। ভাইসব! আপনাদের গ্রামে যদি এখনও কেহ গান বাজনা করে তাহাকে ধরিয়া আনিয়া এই ধর্মসভায় ন্যায় বিচার করেন।” এই বলিয়া উকিল সাহেব তাহার বক্তৃতা শেষ করেন।

তখন গ্রামের মধ্যে কে গান করে, কে সারিন্দা বাজায় তাহাদিগকে ধরিয়া আনিয়া বিচার করা হয়।

এইভাবে সভা করিতে করিতে একবার উকিল সাহেব তাহার দলবল লইয়া পদ্মানদী পার হইয়া ভাসানচর গ্রামে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে খুব উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বক্তৃতা করিয়া উকিল সাহেব যখন বসিয়া পড়িলেন, তখন গ্রামের একজন লোক বলিল, “হুজুর! আমাগো গায়ের আরজান ফকির সারিন্দা বাজায়া গান গায়।”

উকিল সাহেব উপস্থিত লোকদিগকে বলিলেন, “আপনারা কেহ যাইয়া আরজান ফকিরকে ধরিয়া আনেন।” বলা মাত্র তিন চারজন লোক ছুটিল আরজান ফকিরকে ধরিয়া আনিতে।

অস্পক্ষণের মধ্যেই বছির দেখিল সৌম্যমূর্তি একজন বৃদ্ধকে তাহারা ধরিয়া আনিয়াছে। তাহার মুখে সাদা দাড়ী। মাথায় সাদা লম্বা চুল। বৃদ্ধ হইলে মানুষ যে কত সুন্দর হইতে। পায় এই লোকটি যেন তাহার প্রতীক। মুখোনি উজ্জ্বল হাসিতে ভরা। যেন কোন বেহেস্তের প্রশান্তি সেখানে লাগিয়া আছে। সে আসিয়া বলিল, “বাজানরা! আপনারা আমারে। বোলাইছেন? দয়ালচানগো এত কাইন্দা কাইন্দা ডাহি। দেহ দেয় না। আইজ আমার, কতই ভাগ্যি দয়ালচানরা আমারে ডাইকা পাঠাইছেন।”

এমন সময় শামসুদ্দীন মাওলানা সাহেব সামনে আগাইয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম আরজান ফকির?”।

ফকির হাসিয়া বলিল, “হয় বাজান! বাপ মা এই নামই রাইখাছিল।”

মাওলানা সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “মিঞা! তুমি মাথায় লম্বা চুল রাখিয়াছ কেন?”

“আমি ত রাখি নাই বাজান! আল্লাহ রাইখাছেন!”

“আল্লার উপর ত তোমার বড় ভক্তি দেখতে পাই! আল্লাহ কি তোমাকে লম্বা চুল রাখতে বলেছেন?”

“বাজান! লম্বাও বুঝি না খাটোও বুঝি না। হে যা দিছে তাই রইছে।”

“চুল কাটো নাই কেন?”

“বাজান! হে যা দিছে তাই রাখছি। যদি কাটনের কতা ঐত, তয় হে দিল ক্যান?”

“আর শুনতে পেলাম, তুমি সারিন্দা বাজিয়ে গান কর। মরাকাঠ, তাই দিয়ে বাদ্য বাজাও।”

“কি করব বাজান? দেহ-কাঠ এত বাজাইলাম, কথা কয় না। তাই মরা লয়া পড়ছি। এহনও কথা কয় নাই। তবে মদ্দি মদ্দি কথা কইবার চায়।”

“তোমার সারিন্দা আমরা ভেঙ্গে ফেলাব।”

“কাঠের সারিন্দা বাঙবেন বাজান? বুকের মদ্দি যে আর একটা সারিন্দা আছে সেডা ভাঙবেন কেমুন কইরা? হেডা যদি ভাঙতি পারতেন তয় ত বাচতাম। বুহির মদ্দি যহন সুর গুমুইরা গুমুইরা ওঠে তখন ঘুম হয় না। খাইতি পারি ন্যা। সেইডার কান্দনে থাকপার পারি না বইলা কাঠের সারিন্দা বানায়া কান্দাই। আমার কান্দনের সঙ্গে হেও কান্দে, তাই কিছুক শান্তি পাই।”

“দেখ ফকির! তোমার ওসব বুজুরকি কথা শুনতে চাইনে। আজ তুমি আমার কাছে তোবা পড়–আর গান গাইতে পারবে না।”

“বাজান! গান বন্দ করার কলা-কৌশল যদি আপনার জানা থাহে আমারে শিহায়া দ্যান। বুকের খাঁচার মদ্দি গান আটকায়া রাখপার চাই। খাঁচা খুইলা পাখি উইড়া যায়। মানষির মনে মনে গোরে। কন ত বাজান! এ আমি কেমন কইরা থামাই?”

“ও সব বাজে কথা আমরা শুনতে চাইনে।”

“বাজান! জনম কাটাইলাম এই বাজে কথা লয়া। আসল কথা ত কেউ আমারে কইল না। আপনারা যদি জানেন, আসল কথা আমারে শিহায়া দ্যান।”

“তোমার মত ভণ্ড কোথাও দেখা যায় না।” “আমিও তাই কই বাজান! আমার মত পাপী তোক আর আল্লার আলমে নাই। কিন্তুক এই লোকগুলান তা বুঝবার পারে না। ওরা আমারে টাইনা লয়া বেড়ায়।”

“শুনতে পেলাম, তোমার কতকগুলান শিষ্য জুটেছে। তারা তোমার হাত পা টিপে দেয়। মাথায় তেল মালিশ করে। জান এতে কত গুনা হয়? আল্লাহ কত বেজার হন?”

“কি করব বাজান? ওগো কত নিষেধ করি। ওরা হোনে না। ওরা আমার ভালবাসায় পড়ছে। প্রেম-নদীতে যে সঁতার দেয় তার কি ডোবার ভয় আছে? এর যে কূল নাই বাজান! ভাইবা দেখছি, এই দেহডা ত আমার না। একদিন কবরে রাইখা শূন্য ভরে উড়াল। দিতি অবি। তাই দেখলাম, আমার দেহডারে ওরা যদি পুতুল বানায়া খেইলা সুখ পায় তাতে আমি বাদী ঐব ক্যান?”

“আচ্ছা ফকির! তুমি হাতের পায়ের নখ কাট না কেন?”

“বাজান! একদিন মানুষ হাতের পায়ের নখ দিয়াই কাইজা-ফেসাদ করত। তাই নখ রাখতো। তারপর মনের নখের কাইজা আরম্ভ ঐল। কলমের নখের কাইজা আরম্ভ ঐল। তহন আতের পায়ের নখের আর দরকার ঐল না। তাই মানষি নখ কাইট্যা ফ্যালাইল। আমার যে বাজান বিদ্যা-বুদ্ধি নাই। তাই মনের নখ গজাইল না। হেই জন্যি আতের পায়ের নখ রাখছি। মনের নখ যদি থাকতো তয় ডিগ্রীজারীতে ডিগ্রী কইরা কত জমি-জমা করতি পারতাম। কত দালান-কোঠা গড়াইতাম। মনের নখ নাই বইলা দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা কইরা খাই। গাছতলায় পাতার ঘরে বসত করি।”

এ পর্যন্ত আরজান ফকির যত কথা বলিল, তার মুখের মৃদু হাসিটি এতটুকুও মলিন হয় নাই। মাওলানা সাহেব যতই কুপিত হইয়া তাহাকে প্রশ্ন করিয়াছেন, সে ততই বিনিত ভাবে তাহার উত্তর করিয়াছে। সভাস্থ সমবেত লোকেরা অতি মনোযোগের সঙ্গে তাহার উত্তর শুনিয়াছে।

উকিল সাহেব দেখিলেন বক্তৃতা করিয়া ইতিপূর্বে তিনি সভার সকলের মনে যে ইসলামী জোশ আনয়ন করিয়াছিলেন, আরজান ফকিরের উত্তর শুনিয়া সমবেত লোকদের মন হইতে তাহার প্রভাব একেবারেই মুছিয়া গিয়াছে। সভার সকল লোকই এখন যেন আরজান ফকিরের প্রতি সহানুভূতিশীল। তাহারা যখন অতি মনোযোগের সঙ্গে আরজান ফকিরের কথাগুলি শুনিতেছিল উকিল সাহেবের মনে হইতেছিল, তাহারা মনে মনে তাহাকে সমর্থন করিতেছে। তিনি ঝানু ব্যক্তি। ভাবিলেন, এইভাবে যদি ফকিরকে কথা বলিবার সুযোগ দেওয়া হয়, তবে তাঁহার আহ্বান করা সভা ফকির সাহেবের সভায় পরিণত হইবে।

তাই তিনি হঠাৎ চেয়ার হইতে উঠিয়া বক্তৃতার সুরে বলিতে লাগিলেন, “ভাইসব! ভেবেছিলাম, আমাকে আর কিছু বলতে হবে না। এই ভণ্ড-ফকিরের কথা শুনে আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। ইহার কথা আপনাদের কাছে আপাততঃ মিষ্ট হইতে পারে। ভাইসাবরা! একবার খেয়াল করে দেখবেন, শয়তান যখন আপনাদের দাগা দেয় এইরূপ মিষ্টি কথা বলেই আপনাদের বশে আনে। আপনারা আগেই আলেমদের কাছে শুনেছেন, গান গাওয়া হারাম! যে কাঠ কথা বলতে পারে না সেই কাঠে বাদ্য বাজানো হারাম। এই ভণ্ড-বেশী ফকির সারিন্দা বাজিয়ে গান করে। এই গান আসমানে সোয়ার হয়ে আল্লার আরশে যেয়ে পৌঁছে আর আল্লার আরশ কুরছি ভেঙে খানখান হয়। বিরাদারানে ইসলাম! এই ভণ্ড-ফকিরের মিষ্টি কথায় আপনারা ভুলবেন না। আমাদের খলিফা হযরত ওমর। (রাঃ) বিচার করতে বসে আপন প্রিয়-পুত্রকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন, মনসুর হাল্লাজকে শরীয়ত বিরোধী কাজের জন্য পারস্যের অপর একজন খলিফা তার অর্ধ অঙ্গ মাটিতে পুঁতে প্রস্তর নিক্ষেপ করে মারার হুকুম দিয়াছিলেন। ভাই সকল! এখন দীন ইসলামী সময় আর নাই। নাছারা ইংরেজ আমাদের বাদশা। এই ফকির যা অপরাধ। করেছে তাকে হত্যা করা হাদীসের হুকুম। কিন্তু তা আমরা পারব না। কিন্তু বিচার আমাদিগকে করতেই হবে। ভাই সাহেবরা! মনে রাখবেন, আপনারা সকলেই আজ কাজীর আসনে বসেছেন। খোদার কছম আপনাদের, কাজীর মতই আজ বিচার করবেন। আপনাদের প্রতিনিধি হয়ে মাওলানা সাহেব এই ফকিরের প্রতি কি শাস্তি হতে পারে তা কোরান কেতাব দেখে বয়ান করবেন। আপনারা ইহাতে রাজী?”

চারিদিক হইতে রব উঠিল, “আমরা রাজী।” তখন উকিল সাহেব মাওলানা সাহেবের কানে কানে কি বলিয়া দিলে মাওলানা সাহেব কোরান শরীফ হইতে একটি ছুরা পড়িয়া বলিলেন, “আল্লার বিচার মত এই ফকিরের মাথার লম্বা চুল কাইটা ফেলতি হবি। আর তার সারিন্দাটাও ভাইঙ্গা ফেলতি হবি।”

উকিল সাহেব বক্তৃতা শেষ করিলেন। দুই তিনজন লোক ছুটিল আরজান ফকিরের সারিন্দা আনিতে। এখন সমস্যা হইল কে ফকিরের মাথায় চুল কাটিবে। গ্রামের লোক কেহই তাহার চুল কাটিতে রাজী হয় না। কি জানি ফকির কি মন্ত্র দিবে। তাহাদের ক্ষতি হইবে। অবশেষে মাওলানা সাহেব নিজে ফকিরের মাথার চুল কাটিবার জন্য আগাইয়া আসিলেন। এমন সময় সভাস্থ দু’একজন লোক আপত্তি করিয়া উঠিল। একজন বলিয়া উঠিল, “আমরা জীবন গেলিও ফকির সাহেবের মাথার চুল কাটবার দিব না।”

আরজান ফকির মৃদু হাসিয়া বলিল, “বাজানরা! বেজার অবেন না। মাওলানা সাহেবের ইচ্ছা ঐছে আমার মাথার চুল কাটনের। তা কাটুন তিনি। খোদার ইচ্ছাই পূরণ হোক। বাজানরা! তোমরা গোসা কইর না। চুল কাটলি আবার চুল ঐব। আল্লার কাম কেউ রদ করতি পারবি না।”

মাওলানা সাহেব কাঁচি লইয়া আরজান ফকিরের মাথার চুল কাটিতে লাগিলেন। সেই কঁচির আঘাত যেন অশিক্ষিত গ্রামবাসীদের বুকের কোন সুকোমল স্থানটি কাটিয়া কাটিয়া খণ্ডিত বিখণ্ডিত করিতেছিল। কিন্তু কোরান হাদীসের কালাম যার কণ্ঠস্থ সেই মাওলানা সাহেবের কাজে তাহারা কোন বাধা দিতে সাহস করিল না। যতক্ষণ চুলকাটা চলিল, আরজান ফকিরের হাসি মুখোনি একটুকুও বিকৃত হইল না। কি এক অপূর্ব প্রশান্তিতে যেন তার শুক্র-শশ্রুভরা মুখোনি পূর্ণ।

এমন সময় দুই তিনজনে আরজান ফকিরের সারিন্দাটি লইয়া আসিল। কাঁঠাল কাঠের সারিন্দাটি যেন পূজার প্রতিমার মত ঝকমক করিতেছে। সারিন্দার মাথায় একটি ডানা-মেলা পাখি যেন সুরের পাখা মেলিয়া কোন তেপান্তরের আকাশে উড়িয়া যাইবে। সেই পাখির গলায় রঙ-বেরঙের পুঁতির মালা। পায়ে পিতলের নূপুর আর নাকে পল্লী-বধূদের। মত একখানা নথ পরানো। সারিন্দার গায়ের দুই পাশে কতকগুলি গ্রাম্য-মেয়ে গান গাহিতে গাহিতে নাচিয়া নাচিয়া কোথায় চলিয়াছে।

এই সারিন্দাটি আনিয়া তিন চারজন লোক মাওলানা সাহেবের হাতে দিল! সারিন্দাটির দিকে একবার চাহিয়া দেখিয়া আরজান ফকিরের মুখোনি হঠাৎ যেন কেমন হইয়া গেল। ফকির দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিল, “বাজানরা! আপনারা যা বিচার করলেন, আমি মাথা পাইত্যা নিলাম। কিন্তু এই মরা কাঠের সারিন্দা আপনাগো কাছে কোন অপরাধ করে নাই। এর উপরে শাস্তি দিয়া আপনাগো কি লাভ? আমার মাথার চুল কাটলেন। এত লোকের মদ্দি আমার বাল-মন্দ গাইলেন। আরও যদি কোন শাস্তি দিবার তাও দ্যান? কিন্তু আমার সারিন্দাডারে রেহাই দ্যান।”

মাওলানা সাহেব বলিলেন, “মিঞা! ও সকল ভণ্ডামীর কথা আমরা কেউ শুনবো না। কোরান কেতাব মত আমাকে কাজ করতি হবি। তোমার ওই সারিন্দা আমি ভাইঙ্গা ফ্যালব।”

ফকির আরও বিনীতভাবে বলিল, “বাজান! আমার এই বোবা সারিন্দাডারে ভাইঙ্গা আপনাগো কি লাভ ঐব? আমার বাপের আতের এই সারিন্দা। মউত কালে আমারে ডাইকা কইল, দেখরে আরজান! টাকা পয়সা তোর জন্যি রাইখা যাইতি পারলাম না। আমার জিন্দিগীর কামাই এই সারিন্দাডারে তোরে দিয়া গেলাম। এইডারে যদি বাজাইতি পারিস তোর বাতের দুঃখ ঐব না। হেই বাপ কতকাল মইরা গ্যাছে। তারির আতের এই সারিন্দাডারে বাজায়া বাজায়া দুঃখীর গান গাই। পেরতমে কি সারিন্দা আমার সঙ্গে কতা। কইত? রাইত কাবার কইরা দিতাম, কিন্তুক সারিন্দা উত্তর করত না। বাজাইতি বাজাইতি। তারপর যহন বোল দরল তহন সারিন্দার সঙ্গে আমার দুঃখীর কতা কইতি লাগলাম। আমার মতন যারা দুঃখিত তারা বাজনা শুইনা আমার সঙ্গে কানত। মাওলানাসাব! আমার এই সারিন্দাডারে আপনারা ভাঙবেন না। কত সভায় গান গায়া কত মানষির তারিফ বয়া। আনছি গিরামে, এই সারিন্দা বাজায়া! হেবার রসুলপুরীর সঙ্গে মামুদপুরীর লড়াই। দুই পক্ষে হাজার হাজার লাইঠ্যাল। কতজনের বউ যে সিন্তার সিন্দুর আরাইত, কতজনের মা যে পুত্ৰ লোগী ঐত সেই কাইজায়। কি করব, দুই দলের মদ্দিখানে যায়া সারিন্দায় সুর দিলাম। দুই দলের মানুষ হাতের লাঠি মাটিতি পাইতা সারিন্দার গান শুনতি লাগল। মাওলানাসাব! আমারে যে শাস্তি দিবার দ্যান, কিন্তু আমার সারিন্দাডারে বাঙবেন না।” এই কথা বলিয়া আরজান ফকির গামছা দিয়া চোখের পানি মুছিল।

চারিদিকের লোকজনের মধ্যে থমথমা ভাব। আরজান ফকিরের সারিন্দার কাহিনী ত সকলেরই জানা। তাহারা মনে মনে ভাবিতে লাগিল, এখানে এমন কিছু ঘটিয়া যাক। যাহাতে ফকিরের সারিন্দাটি রক্ষা পাইতে পারে। কিন্তু কেহই সাহস করিয়া কোন কথা বলিতে পারিল না।

উকিল সাহেব দেখিলেন, আরজান ফকির এই কথাগুলি বলিয়া সভার মন তাহার দিকে ফিরাইয়া লইতেছে। তিনি মাওলানা সাহেবকে বলিলেন, ”আপনি আলেম মানুষ। নায়েবে নবী। কোরান কেতাব দেখে বিচার করেন। এই ভণ্ড-ফকিরকে এসব আবোল-তাবোল বলবার কেন অবসর দিচ্ছেন?”

মাওলানা সাহেব তখন হাঁটুর সঙ্গে ধরিয়া সারিন্দাটি ভাঙিবার চেষ্টা করিলেন। সারি-কাঁঠাল কাঠের সারিন্দা। সহজে কি ভাঙিতে চাহে? সমবেত লোকেরা এক নিবাসে চাহিয়া আছে। কাহার আদরের ছেলেটিকে যেন কোন ডাকাত আঘাতের পর আঘাত করিয়া খুন করিতেছে। কিন্তু ইসলামের আদেশ-কোরান কেতাবের আদেশ। নায়েবে নবী মাওলানা সাহেব স্বয়ং সেই আদেশ পালন করিতেছেন। ইহার উপর ত কোন কথা বলা যায় না।

হাঁটুর উপর আটকাইয়া যখন সারিন্দাটি ভাঙা গেল না, তখন মাওলানা সাহেব মাটির উপর আছড়াইয়া সারিন্দাটি ভাঙিতে লাগিলেন। কসাই যেমন গরু জবাই করিয়া ধীরে ধীরে তাহার গা হইতে চামড়া উঠাইয়া খণ্ড খণ্ড করিয়া মাংসগুলি কাটিয়া লয়, সেইভাবে মাওলানা প্রথম আছাড়ে সারিন্দার খোল ভাঙিয়া ফেলিল। পাখিশুদ্ধ সারিন্দার মাথাটি সামনে মুখঠাসা দিয়া পড়িল। তবু সেই মাথা তারের সঙ্গে আটকাইয়া আছে! টান দিয়া সেই তার ছিঁড়িয়া সারিন্দার খোলের উপরে সানকুনী সাপের ছাউনি ছিঁড়িয়া মাওলানা সাহেব সারিন্দাটিকে দুই তিন আছাড় মারিলেন। সারিন্দার গায়ে নৃত্যরতা মেয়েগুলি যাহারা এতদিন হাত ধরাধরি করিয়া কোন উৎসবের শরিক হইতে সামনের দিকে আগাইয়া চলিতেছিল তাহারা এখন খণ্ড খণ্ড কাঠের সঙ্গে একে অপর হইতে চিরকালের জন্য বিচ্ছিন্ন হইয়া গেল। খুনী যেমন কাহাকে খুন করিয়া হাপাইতে থাকে, সারিন্দাটি ভাঙ্গা শেষ করিয়া মাওলানা সাহেব জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলিতে লাগিলেন।

আরজান ফকির জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাজানরা! আমারে দিয়া ত আপনাগো কাম শেষ ঐছে। আমি এহন যাইতি পারি?”

মাওলানা সাহেব বলিলেন, “হ্যাঁ। তুমি এখন যাইতে পার।”

আরজান ফকির নীরবে সভাস্থান হইতে উঠিয়া চলিয়া গেল। সভার কার্যও শেষ হইল।

সমবেত লোকেরা একে একে যাহার যাহার বাড়ি চলিয়া গেল। কি এক বিষাদে যেন অধিকাংশ গ্রামবাসীর অন্তর ভরিয়া আছে।

রাত্রে গ্রামের মাতবর সাহেবের বাড়িতে কত রকমের পোলাও, কোর্মা, কালিয়া, কাবাব প্রভৃতি খাবার প্রস্তুত হইয়াছিল। মাওলানা সাহেব আর উকিল সাহেব নানা গাল-গল্প করিয়া সে সব আহার করিলেন। বছির সেই উপাদেয় খাদ্যের এতটুকুও মুখে দিতে পারিল না। তাহার কেবলই মনে হইতেছিল, এই সৌম্যদর্শন গ্রাম্য-ফকিরের মাথার চুল সে-ই যেন কাটিয়াছে আর তাহার সারিন্দাটি সে-ই যেন নিজ হাতে ভাঙিয়া চূর্ণবিচূর্ণ করিয়াছে।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x