(চব্বিশ)
রবিবারের দিন পাঠশালার ছুটি। ভোর না হইতেই নেহাজদ্দীন আর তার বোন ফুলী আসিয়া উপস্থিত।
“ও বছির-বাই! তোমরা নি এহনো ঘুমায়া আছ?” ফুলের মতন মুখোনি নাচাইয়া ফুলী ডাকে, “ও বড়ু! শিগগীর আয়।”
বড়ু তাড়াতাড়ি উঠিয়া ডাক দেয়, “ও মিঞা-বাই! ওঠ, ফুলী আইছে–নেহাজ-বাই আইছে।”
হাতের তালুতে ঘুমন্ত চোখ ডলিতে ডলিতে বছির তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসে।
বাড়ির ওধারে গহন জঙ্গল। সেই জঙ্গলের মধ্যে নাভিওয়ালা আমের গাছ। সিন্দুইরা-আমের গাছ। গাছের তলায় ঘন বেত ঝাড়। তারই মাঝ দিয়া সরু পথখানি গিয়াছে। সকলকে পিছনে ফেলিয়া বড় তাড়াতাড়ি আগাইয়া যাইয়া একটা সিন্দুরে-আম কুড়াইয়া পাইল, তারপর আর একটা। ওদিকে ফুলী নাভিওয়ালা আম গাছের তলায় যাইয়া চার পাঁচটা আম পাইল। নেহাজ যাইয়া উঠিল সিন্দুরে-আমগাছে, আর বছির উঠিল গিয়া নাভিওয়ালা আমগাছে। নাভিওয়ালা আম গাছে লাল পিঁপড়ে ভর্তি। হাতে পায়ে অসংখ্য পিঁপড়া আসিয়া বছিরকে কামড়াইয়া ধরিল। সে তাড়াতাড়ি গাছ হইতে নামিয়া আসিল।
“ও মিঞা-বাই! তোমারে যে পিঁপড়ায় কামড়ায়া চাকা চাকা কইরা দিছে। এদিকে ফেরো ত দেহি। হায়! হায়! তোমার মাথার চুলী লাল পিঁপড়া জট মেইলা রইছে। ও ফুলী! খাড়ায়া দেহস কি? মিঞা-বাইর গার ত্যা পিঁপড়া বাছ।” বড় আর ফুলী দুইজনে। মিলিয়া বছিরের গা হইতে লাল পিঁপড়ে বাছিতে লাগিল। সিন্দুরে-আমের গাছ খুব লম্বা। তার আগডালে সাত আটটি আম পাকিয়া লাল টুক টুক করিতেছে কিন্তু নেহাজদ্দী অত উপরে উঠিতে পারিল না। সেও নামিয়া আসিল।
বড় বলিল, “আইজ আর আম পাড়ার কাম নাই। আইস আমরা খেলি। আমার বড় ভাইর যেন বিয়া ঐব।”
ফুলী ভুরু নাচাইয়া বলিল, “বড় ভাইর বোনের বিয়া আগে ওক।”
“না আগে ত বড় ভাই, তবে না বোন। বড়র থইনাই না আরম্ভ করতি অয়।”
ফুলী বলে, “আ’লো তুই ত নেহাজ-ভাইর ছোট বোন। তোর বিয়া আগে ওক।”
“না, তোর,” “না তোর,” “তোর,” “তোর।”
বছির তখন মিমাংসা করে, “আচ্ছা, তোগো দুই জনের বিয়াই একত্তর হোক।” বড় বলে, “তবে তোমাগো বিয়াও একত্তর হোক।” বছির হাসিয়া বলে, “বেশ।” তখন বছিরের বউ সাজিল ফুলী, আর নেহাজদ্দীনের বউ হইল বড়। ফুলীর বিয়ার পর সে চলিয়াছে বরের বাড়ি ডোলায় চাপিয়া। দুইটা বাঁশের কঞ্চি বাকাইয়া কৃত্রিম ডোলা তৈরী হইয়াছে। ডোলার মধ্যে বসিয়া বউ কান্দে, “হু-উ-উ।” বর নেহাজদ্দী বলে, “বউ তুমি কান্দ ক্যান? বউ সুর করিয়া গান ধরে ও।
“মিঞা ভাইর বাঙেলায় খেলছি হারে খেলা সোনার গোলা লয়া নারে।
আমার যে পরাণ কান্দে সেই না গোলার লাইগারে।”
বর নেহাজী বলে, “আমার সাত ভাই-এর সাত বউ, তারা তোমারে হিরার গোলা বানাইয়া দিব খেলনের জন্যি।”
বউ তবু কান্দে, “হু-উ-উ।” বর জিজ্ঞাসা করে, “বউ! তুমি আবার কান্দ ক্যান?” বউ তখন সুর করিয়া বলে,–
“এত যে আদরের, এত যে আদরের
ও সাধুরে মাধন কোথায় রইল নারে।”
বলে বর, “আমার দ্যাশে আছে হারে মাধন
ও সুয়ারে মাধন বলিও তারেরে।”
কনে তখন বলে,
“আম্ব গাছের বাকলরে সাধুর কুমার! চন্দন গাছে ওকি লাগেরে।
তোমার মায়ের মিঠা কথারে সাধুর কুমার, নিম্ব যেমুন তিতা নারে!
আমার মায়ের মুখের কথারে সাধুর কুমার! মধু যেমন মিষ্ট নারে।”
গান শেষ হইতে না হইতেই ফুলী বলে, “ও কিলো। তোরাই বুঝি কতা কবি? আমরা বুঝি কিছু কব না?”
তখন বড় বলে, “আমি ত বউ অয়া তোগো বাড়িতি আইলাম। তুই এহন আমার লগে কতা ক।”
ফুলী তখন নতুন বউ এর ঘোমটা খসাইতে খসাইতে বলে, “ও বউ! আইস বাগুন। কুইট্যা দাও।”
বউ বলে, “বাগুন ত বালা না, পোকা লইগ্যাছে।”
ফুলী বলে, “ও মিঞা-ভাই! শোন কতা। তোমার বউ বাগুন কুটতি পারে না।”
তখন বর নেহাজদ্দীন বউকে লাঠি লইয়া যায় মারিতে।
ফুলী আবার বউকে জিজ্ঞাসা করে, “ও বউ ঘর সুইরা বিছানা কর।”
বউ বলে, “ঘরের মদ্দি মশা ভন ভন করতাছে।”
ফুলী কয়, “ও বউ! কোথায় যাও?”
“মশার জ্বালায় ঘরের পিছনে যাই।”
“ও বউ! আবার কোথায় যাও?”
“ঘরের কাঞ্ছি সাপে পট মেলছে। আমি তার ভয়ে মাঠে যাইত্যাছি।”
“ও বউ! আবার কোথায় যাও?”
“মাঠের মদ্দি কোলা গড়গড় করে। আমি গাঙের গাটে নাইতে যাই।”
গাঙের ঘাটে যাইয়া বউ দেখে তার বাইরা অনেক দূরি নাও বাইয়া যায়। বউ তাগো। ডাইকা কয়–
ও পারেতে লঙ্কা গাছটি রাঙা টুক টুক করে,
গুণবতী ভাই! আমার মন কেমন করে।
হাড় হল ভাজা ভাজা মাংস হৈল দড়ি,
আয়রে কারিন্দার পানি ডুব দিয়া মরি।”
ফুলু ঘাড় দুলাইয়া বলে, “না লো! এ খেলা আমার বাল লাগে না। খালি কান্দন আসে। আয় একটা হাসি-তামাসার খেলা খেলি।”
বড়ু বলে, “আচ্ছা! তোর বরের কাছে একটা জিনিস চা।” কনে ফুলী এবার উ-উ করিয়া কান্দে।
বর বছির তাড়াতাড়ি যাইয়া বলে, “ও বউ! তুমি কান্দ ক্যান?”
বউ বলে, “আমার যে সিন্যা খালি রইছে। আমার জন্যি সিন্দুর আনছ নি?”
পর কচু পাতায় পাকা পুঁই ডাটা ঘসিয়া বলে, “এই যে সিন্দুর আনছি, কপালে পর।”
বউ টান দিয়া সিন্দুরের পাতা ফেলাইয়া দেয়। বড়ু গান ধরে :
“দেশাল সিন্দুর চায় নারে ময়না,
আবেরি ময়না ঢাকাই সিন্দুর চায়,
ঢাকাই সিন্দুর পরিয়া ময়দার গরম লাগে গায়।”
তখন বর ইন্দুরের মাটি আনিয়া বউ-এর হাতে দিয়া বলে, “এই যে ঢাকাই সিন্দুর আইনা দিলাম, এইবার কপালে পর।”
বউ আবার কান্দে, “উ-উ-উ।”
বর বলে, “বউ! আবার কান্দ ক্যান?”
বউ বলে, “আমার পরণের শাড়ী নাই। শাড়ী আছনি?”
বর কলাপাতার শাড়ী আনিয়া দেয়, “এই যে শাড়ী পর।” বউ থাবা দিয়া শাড়ীটা ধরিয়া ছিঁড়িয়া ফেলে।
বড়ু আবার গান ধরে :
দেশাল শাড়ী চায় নারে ময়না,
আবেরি ময়না ঢাকাই শাড়ী চায়;
ঢাকাই শাড়ী পরিয়া ময়নার গরম লাগে গায়।
ডান হস্তে শ্যামলা গামছা,
বাম হস্তে আবের পাখা;
আরে দামান চুলায় বালির গায়।
গান গাহিতে গাহিতে বড় বলে, “ও মিঞা ভাই! তোমার কনেরে আবের পাখা, আর শ্যামলা-গামছা দিয়া বাতাস করতাছ না ত?”
ডাইনের ঝাড় হইতে একটি কচুপাতা আনিয়া বছির কনেকে বাতাস করিতে থাকে।
এই ভাবে শিশু-মনের সহজ কল্পনা লইয়া অভিনয়ের পর অভিনয় চলে। এ অভিনয়ের রচনাকারী, নট-নটি আর দর্শক তারাই মাত্র চারিজন বলিয়া ইহার মধ্যে ত্রুটি থাকে না, শুধুই অনাবিল আনন্দ। এমনি করিয়া খেলিতে খেলিতে দুপুর হইয়া আসিল। তাহারা খেলা শেষ করিয়া কুড়ানো আমগুলি লইয়া বাড়ি চলিল।
হঠাৎ বড় উঠিয়া কান্দিয়া বলিল, “ও মিঞা ভাই। আমার নাকের ফুল আরায়া ফেলাইছি।” গ্রাম্য সুনারুর নিকট হইতে তাহার মা রূপার একটি নাকফুল তাহার জন্য গড়াইয়া দিয়াছিল। চারজনে মিলিয়া সমস্ত জঙ্গল ভরিয়া কত আতিপাতি করিয়া খুঁজিল, কিন্তু সেই ক্ষুদ্র নাক-ফুলটি কোন্ পাতার তলে লুকাইয়া আছে কেহই খুঁজিয়া পাইল না। বড়ু কেবল ফুপাইয়া ফুপাইয়া কান্দে। গামছার খোট দিয়া বোনের চোখ মুছাইতে মুছাইতে বছির বলে, “বড়ু! আমার সোনা বইন। কান্দিস না। আমি বড় হয়া চাকরী করব। তহন। সোনা দিয়া তোর নাক-ফুল গড়ায়া দিব।”
বোন চোখের পানি মুছিতে মুছিতে বলে, “দিবি ত মিঞা বাই?”
বোনকে কাছে ডাকিয়া আদর করিয়া বছির বলে, “আল্লার কছম দিব।”
“বোবা কাহিনী” উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ