(বাইশ)
পরের দিন বছির আর নেহাজদ্দীন পাঠশালায় চলিল। মাষ্টারের নির্দেশ মত রান্না করা। হড়ীর পিছনে লাউপাতা ঘসিয়া তাহাতে পানি মিশাইয়া তাহারা কালি তৈরী করিয়াছে। তাহা দোয়াতে ভরিয়া সেই দোয়াতের মুখে রশি বাধিয়া হাতে করিয়া ঝুলাইয়া লইয়া তাহারা স্কুলে চলিয়াছে। খাগড়া-বন হইতে লাল রঙের খাগড়া বাছিয়া তাহা দিয়া কলম তৈয়ার করিয়াছে। আর কলা পাতা কাটিয়া খণ্ড খণ্ড করিয়া লইয়াছে। তাহার উপরে মাষ্টার মহাশয় ক, খ প্রভৃতি বর্ণমালা লোহার কাঠি দিয়া লিখিয়া দিবেন। তাহারা উহার। উপরে হাত ঘুরাইয়া বর্ণমালা লেখা শিক্ষা করিবে।
গাঁয়ের আঁকা-বাঁকা পথ বাহিয়া ছোট গাঙ। তার উপরে বাঁশের সাঁকো! তাহা পার হইয়াই সেন মহাশয়ের পাঠশালা। মাষ্টার মহাশয় পাঠশালায় আসেন বেলা বারটায়, কিন্তু ছাত্রদের অনেকেই নয়টা বাজিতেই পাঠশালায় আসিয়া উপস্থিত হয়। তাহারা গোল্লাছুট, হাডুডু প্রভৃতি গ্রাম্য খেলা খেলিয়া এর গাছ হইতে,ওর গাছ হইতে, যখন যে-কালের যে ফল ফুল চুরি করিয়া পাড়িয়া মহাকলরবে এই সময়টা কাটাইয়া দেয়। কাহারও মাচানের শশা ছিঁড়িয়া, কাহারও কাঁদিভরা নারিকেল পাড়িয়া, কাহারও খেতের তরমুজ চুরি করিয়া, তাহারা নিরীহ গ্রামবাসীর আতঙ্কের কারণ হইয়া পড়ে। মাঝে মাঝে তাহারা পরস্পরে মারামারি করিয়া মাথা ফাটাফাটি করে। যে যে পথে মাষ্টার মহাশয়ের আসিবার সম্ভাবনা রহিয়াছে সেই সেই পথে ছেলেরা সতর্ক দৃষ্টি রাখে। দূর হইতে মাষ্টার মহাশয়ের ভাঙা ছাতাখানা যার দৃষ্টিতেই আগে পড়ুক সে দৌড়াইয়া আসিয়া আর আর ছেলেদের খবর দেয়। অমনি ছাত্রেরা যে যেখান হইতে ছুটিয়া আসিয়া উচ্চ শব্দ করিয়া পড়িতে মনোযোগ দেয়। দূর হইতে মনে হয় পাঠশালা ঘরখানিতে যেন সমুদ্র গর্জন হইতেছে।
মাষ্টার মহাশয় আসিয়াই প্রথমে গায়ের জামাটা খুলিয়া ঘরের বেড়ার সঙ্গে ঝুলাইয়া রাখিয়া হাতল-ভাঙ্গা চেয়ারখানার উপর বসিয়া পড়েন। অমনি দুই তিনটি ছাত্র মাষ্টার মহাশয়কে বাতাস করিতে আরম্ভ করে। মাষ্টার মহাশয়ের হুঁকোটিকে লইয়া একটি ছাত্র দৌড়াইয়া পানি ভরিতে যায়। আর একজন দৌড়াইয়া যায় কলিকায় তামাক ভরিয়া পাশ্ববর্তী বাড়ি হইতে আগুন আনিতে। এই কার্য প্রায়ই গণশা সমাধা করে। পূর্বে কায় পানি ভরা আর কলিকায় আগুন দেওয়ার ভার গণশার উপরেই পড়িত কিন্তু একজন ছাত্র নাফরমানি করিয়া একদিন মাষ্টার মহাশয়ের কাছে নালিশ করিয়া দিয়াছিল, “মাষ্টার মহাশয়! গণশা আপনার হুঁকায় জোরে জোরে টান দিয়া আনিয়াছে।” অবশ্য গণশা তখনই ঠাকুর দেবতার নাম লইয়া দিব্যি করিয়া বলিয়াছিল সে উহা করে নাই, কিন্তু কোতে টান দিয়া মাষ্টার মহাশয় যখন দেখিলেন, তাহাতে কিঞ্চিৎ মাত্র তামাক অবশিষ্ট নাই এবং গণশার নাক দিয়া তখনও কিঞ্চিৎ ধূম্র বাহির হইতেছে, তখন বেত লইয়া গণশাকে প্রচুর শিক্ষা দিয়া সেই হইতেই নিয়ম করিলেন যে গণশা হুঁকায় পানি ভরিতে পারিবে না, সে শুধু। কলিকায় তামাক ভরিয়া আগুন দিয়া আনিবে। এই ব্যবস্থার ফলে যদিও গণশা মাঝে মাঝে কলিকায় টান দিয়া তামাকের অর্ধেকটা পোড়াইয়া আনে তবু তার মত পরিপাটি করিয়া কলিকায় তামাক ভরিয়া আগুন দিতে আর কেহই পারে না বলিয়া একাজের ভার এখনও গণশার উপরেই রহিয়াছে।
মাষ্টার মহাশয়ের ধূমপান শেষ হইলেই আরম্ভ হইল নালিশের পালা। ও-পাড়া হইতে কমিরউদ্দীনের বিধবা বউ আসিয়া হামলাইয়া কাঁদিয়াপড়িল, “মাষ্টার মহাশয়! আমার ধরন্ত শশা গাছটি আপনার পাঠশালার আবদুল টানিয়া ছিঁড়িয়া দিয়া আসিয়াছে। তখনই আবদুলকে ডাকিয়া আনিয়া মাষ্টার মহাশয় সূর্য-ঘড়ির ব্যবস্থা করিলেন। সূর্য-ঘড়ি মানে ‘হাফ নিল ডাউন হইয়া সূর্যের দিকে চাহিয়া থাকা। ফটিকের বাপ আসিয়া নালিশ করিল, ইয়াসিন ঢিল মারিয়া তাহার ছেলের মাথা ফাটাইয়া দিয়াছে। এই মতে বহু নালিশ এবং তাহার বিচার সমাধান করিয়া মাষ্টার মহাশয় নাম প্রেজেন্ট আরম্ভ করিলেন। নাম প্রেজেন্ট করিয়া দেখা গেল মধু, আজিজ আর করিম আসে নাই। অমনি তিন চারজন ঢেঙা ছাত্র মাষ্টার মহাশয়ের নির্দেশ মত তাহাদের খুঁজিতে ছুটিল। এইবার যথারীতি মাষ্টার মহাশয় উপস্থিত ছাত্রদিগকে পড়ান আরম্ভ করিলেন। পড়ানোর সময় তাঁহার মুখ যতটা চলিল তাহার অধিক হাতের বেতখানা ছাত্রদের পিঠে পড়িতে লাগিল।
নেহাজদ্দী আর বছির নূতন আসিয়াছে। কলাপাতার উপর বর্ণমালা লিখিয়া দিয়া মাষ্টার মহাশয় তাহাদিগকে তাহার উপর হাত ঘুরাইবার নির্দেশ দিলেন। অপটু হাতে কলম ধরিতে হাত কাপিয়া যায়। কলমটি কালির দোয়াতে ডুবাইয়া সেই খাড়া পাতার উপর বুলাইতে কলমের আগা এদিকে ওদিকে ঘুরিয়া যায়। তবু অতি মনোযোগের সঙ্গে সেই খাড়া পাতার উপর তাহারা হাত বুলাইতে থাকে। বছিরের কেবলই বাড়ির কথা মনে হয়। ছোট বোন বড় যেন এখন কি করিতেছে। নেহাজদ্দীনের বোন ফুলী বুঝি এখন আম বাগানের ধারে তার সঙ্গে খেলিতে আসিয়াছে। কে বাশঝাড়ের আগায় উঠিয়া তাহার নাকের নথ গড়িবার জন্য বাঁশের কচি পাতা পাড়িয়া দিবে। এইসব কথা তাহার কলমের আঁকাবাঁকা অক্ষরগুলির মধ্যে প্রকাশ হয় কিনা জানি না, কিন্তু এইসব ভাবিতে তাহার কলমের আগা কলাপাতায় খাড়া অক্ষরের বেড়া ডিঙাইয়া এদিকে ওদিকে যাইয়া পড়ে। অমনি হাতের তালু দিয়া তাহা মুছিয়া ফেলিয়া আবার নূতন করিয়া সেই খাড়া অক্ষরের উপর হাত বুলাইতে থাকে।
অনেকক্ষণ পরে পাঠশালার ঢেঙা ছাত্ররা সেই অনুপস্থিত তিনটি ছাত্রকে ধরিয়া আনিল। বলির পাঠা যেমন কাঠগড়ায় উঠিবার আগে কপিতে থাকে তাহারাও সেইভাবে কপিতেছিল। তাহাদের একজন মাছ ধরিতে গিয়াছিল। হাতে-পায়ে কাদা লাগিয়া আছে। অপর দুইজন গহন জঙ্গলে মৌমাছির চাক হইতে মধু পাড়িবার জন্য সাজ-সরঞ্জাম তৈরী। করিতেছিল। মাষ্টার মহাশয় তাহাদিগকে এমন পিটান পিটাইলেন যে তাহাদের কান্না শুনিয়া বছিরের চোখ দিয়া জল আসিতেছিল।
বহুক্ষণ পরে পাঠশালার ছুটি। বছির আর নেহাজুদ্দীন বাড়ি ফিরিল।
“বোবা কাহিনী” উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ