(সতের)

পাঁচ ছয়দিন কাটিয়া গেল। আজাহের কিছুতেই গরীবুল্লা মাতবরকে সমস্ত কথা খুলিয়া বলিবার অবসর পাইল না। যখনই সে মাতবরকে সমস্ত বলিতে গিয়াছে, মাতবর কৌশলে অন্য কথা পাড়িয়াছে।

ইতিমধ্যে তাহাদের সম্মানে মাতবর গ্রামের সমস্ত লোককে দাওয়াত দিয়াছে। আজ দুপুরে খাসী জবাই করিয়া বড় রকমের ভোজ হইবে। নিমন্ত্রিত লোকেরা প্রায় সকলেই আসিয়া গিয়াছে। এইসব আত্মীয়তার অতি সমাদর আজাহের কিছুতেই সহ্য করিতে পারিতেছিল না। আজ যেমন করিয়াই হোক সে মাতবরকে সমস্ত খুলিয়া বলিবে। ইতিমধ্যে সে বহুবার মাতবরের বাড়িতে এটা ওটা কাজ করিতে গিয়াছে। হালের লাঙল লইয়া মাঠে যাইতে চাহিয়াছে, মাতবর তার কাধ হইতে লাঙল কাড়িয়া লইয়াছে, হাত হইতে কাস্তে কাড়িয়া লইয়াছে। বলিয়াছে “কুটুমির দ্যাশের মানুষ। মিঞা! তুমি যদি আমার বাড়িতি কাম করবা, তয় আমার মান থাকপ? কুটুম বাড়িতে আইছ। বাল মত খাও দাও, এহানে ওহানে হাইট্যা বেড়াও, দুইডা খোশ গল্প কর।” আজাহের উত্তরে যাহা বলিতে গিয়াছে, মাতবর তাহা কানেও তোলে নাই। অন্দরমহলেও সেই একই ব্যাপার। আজাহেরের বউও এটা ওটা কাজ করিতে গিয়াছে, ধান লইয়া কেঁকিতে পাড় দিতে গিয়াছে, হাঁড়ি-পাতিল লইয়া ধুইতে গিয়াছে, মোড়লের বউ আসিয়া তাহাকে টেকি-ঘর হইতে টানিয়া লইয়া গিয়াছে, হাত হইতে হাঁড়ি-পাতিল কাড়িয়া লইয়াছে; আর অভিযোগের সুরে বলিয়াছে, “বলি বউ! হাঁড়ি দিয়া কি করবার লাগছাস? কুটুমবাড়িতি আয়া তুই যদি কাম করবি, তয় লোকে কইব কি আমারে? কত কাম কাইজির বাড়ির থইন্যা আইছাস, এহানে। দুইদিন জিড়া। হাড় কয়খানা জুড়াক।”

আজাহের যখন এইসব লইয়া তাহার বউ এর সঙ্গে গভীর পরামর্শ করিতে বসিয়াছে, তখন মোড়লের বউ আসিয়া বেড়ার ফাঁকে উঁকি মারিয়া বলিয়াছে, “বলি বিয়াইর দ্যাশের কুটুমরা কি গহীন কতা কইবার লাগছে। তা ক-লো বউ ক’। এক কালে আমরাও অমনি কত কতা কইতাম। কতা কইতি কইতি রাত কাবার অয়া যাইত, তবু কতা ফুরাইত না।”

লজ্জায় বউ তাড়াতাড়ি সেখান হইতে পালাইয়া গিয়াছে। মোড়ল-গিনী উচ্চ হাসিয়া। বলিয়াছে, “কি-লো বউ! পালাইলি ক্যান? তোবা, তোবা, কান মলা খাইলাম আজাহের। বাই। আর তোমাগো নিরাল-কতার মদ্দি আমি থাকপ না। না জানি তুমি আমারে মনে। মনে কত গালমন্দ করত্যাছ?”

কলরব শুনিয়া মোড়ল আসিয়া উপস্থিত হয়। “কি ঐছে? তোমরা এত আসত্যাছ ক্যান?” মোড়লের কানে কানে মোড়ল-গিন্নী কি কয়। মোড়ল আরো হাসিয়া উঠে। আজাহের কয়, “আরে বাবিসাব কি যে কন? আমরা কইত্যাছিলাম …..”

“তা বুঝছি, বুঝছি আজাহের বাই! কি কইত্যাছিলা তোমরা নিরালে। তবে আজ কান মলা খাইলাম তোমাগো গোপন কতার মদ্দি আড়ি পাতপ না।” লজ্জায় আজাহের ঘর হইতে বাহির হইয়া যায়। মোড়ল আর মোড়ল-গিন্নী হাসিয়া গড়াইয়া পড়ে। ওদিকে ঘোমটায় সমস্ত মুখ ঢাকিয়া আজাহেরের বউ লজ্জায় মৃত্যু কামনা করে।

এ কয়দিন সমস্ত গ্রাম ঘুরিয়া এ-বাড়ি ও-বাড়ি বেড়াইয়া আজাহেরের নিকট এই গ্রামটিকে অদ্ভুত বলিয়া মনে হইয়াছে। এ গ্রামে কেহ কাহারও সঙ্গে ঝগড়া-মারামারি করে না। কাহারও বিরুদ্ধে কাহারও কোন অভিযোগ নাই। গ্রামের প্রায় অর্ধেক লোক ম্যালেরিয়ায় ভুগিতেছে। সন্ধ্যা হইলেই তাহারা কাঁথার তলে যাইয়া জ্বরে কাঁপিতে থাকে। সকাল হইলেই আবার যে যাহার মত উঠিয়া পান্তা-ভাত খাইয়া মাঠের কাজ করিতে বাহির হইয়া যায়। কেউ কোন ডাক্তার ডাকে না। আর ডাক্তার ডাকিবার সঙ্গতিও ইহাদের নাই। গলায় মাদুলী ধারণ করিয়া কিংবা গ্রাম্য-ফকিরের পড়া-পানি খাইয়াই তাহারা চিকিৎসা করার কর্তব্যটুকু সমাধা করে। তারপর রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে করিতে একদিন চিরকালের মত পরাজিত হইয়া মৃত্যুর তুহীন শীতল কোলে নীরবে ঘুমাইয়া পড়ে। কাহারও বিরুদ্ধে তাহাদের কোন অভিযোগ নাই। কাহারও উপরে তাহাদের মনে কোনদিন। কোন ক্ষোভ জাগে না।

সকলেরই পেট উঁচু, বুকের হাড় কয়খানা বাহির করা, বেশী পরিশ্রমের কাজ কেহ করিতে পারে না। কিন্তু তাহার প্রয়োজনও হয় না। এদেশের মাটিতে সোনা ফলে। কোন রকমে লাঙলের কয়টা আঁচড় দিয়া মাটিতে ধানের বীজ ছড়াইয়া দিলেই আসমানের কালো মেঘের মত ধানের কচি কচি ডগায় সমস্ত মাঠে ছড়াইয়া যায়। আগাছা যাহা ধানখেতে জন্মায় তাহা নিড়াইয়া ফেলার প্রয়োজন হয় না। বর্ষার সময় আগাছাগুলি পানির তলে ডুবিয়া যায়! মোটা মোটা ধানের ডগাগুলি বাতাসের সঙ্গে দুলিয়া লক লক করে। কিন্তু এদেশে শূকরের বড় উৎপাত। রাত্রে শূকর আসিয়া ফসলের খেত নষ্ট করিয়া যায়। বন। হইতে বাঘ আসিয়া গোয়ালের গরু ধরিয়া লইয়া যায়। ম্যালেরিয়ার হাত হইতে রেহাই পাইয়া গ্রামে যাহারা ভাল থাকে তাহারা সারা রাত্র জাগিয়া আগুন জ্বালাইয়া টিন বাজাইয়া শূকর খেদায়, বাঘকে তাড়া করে। তাই পরস্পরের সঙ্গে বিবাদ-বিসংবাদের সুযোগ তাহাদের ঘটে না। তাহাদের বিবাদ বুনো শূকরের সঙ্গে, হিংস্র বাঘের সঙ্গে। এইসব শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করিতে পাড়ার সকল লোকের সমবেত শক্তির প্রয়োজন। সেই জন্য গ্রামের লোকেরা এক ডাকে উঠে বসে। একের বিপদে অপরে আসিয়া সাহায্য করে। শহরের নিকটের গ্রামগুলির মত এখানে দলাদলি মারামারি নাই; মামলা-মোকদ্দমাও নাই।

পূর্বে বলিয়াছি নতুন কুটুমের সম্মানে মোড়ল গ্রামের সব লোককে দাওয়াৎ দিয়া আসিয়াছে। নিমন্ত্রিত লোকেরা আসিয়া গিয়াছে। কাছারী-ঘরে সব লোক ধরে না। সেইজন্য উঠানে মাদুর বিছাইয়া সব লোককে খাইতে দেওয়া হইল। আজাহেরকে সকলের মাঝখানে বসান হইল। তার পাশেই গরীবুল্লা মাতবর আসন গ্রহণ করিল। নানা গল্প-গুজবের মধ্যে আহার চলিতে লাগিল। সকলের দৃষ্টি আজ আজাহেরের দিকে। শহরের কাছে তাহার বাড়ি, তাতে সে আবার মোড়লের কুটুম্ব। সে কেমন করিয়া খায়, কেমন করিয়া কথা বলে, কেমন করিয়া হাসে, সকলেই অতি মনোযোগের সহিত সেদিকে দৃষ্টি দিতে লাগিল। তাহারা অনেকেই শহরে যায় নাই। শহরের বহু রোমাঞ্চকর আজগুবি-কাহিনী শুনিয়াছে। আজ শহরের কাছের এই লোকটি তাই তাহাদের নিকট এত আকর্ষণের।

এত সব যাহাকে লইয়া সেই আজাহের কিন্তু ইহাতে তৃপ্ত হইতে পারিতেছিল না। এই সব জাঁকজমক আজাহেরকে তীব্র কাটার মত বিদ্ধ করিতেছিল। মোড়ল যখন জানিতে পারিবে, সে এখানে আত্মীয় কুটুম্বের মত দুইদিন থাকিতে আসে নাই–সে আসিয়াছে। ভিখারীর মত পেটের তাড়নায় ইহাদের দুয়ারে দয়া প্রার্থনা করিতে; তখন হয়ত কুকুরের মত তাহাদিগকে তাড়াইয়া দিবে। কিন্তু আজই ইহার একটা হেস্তনেস্ত হইয়া যাওয়া ভাল। আজাহের মরিয়া হইয়া উঠিল। তিন চারবার কাশিবার চেষ্টা করিয়া মোড়লের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া আজাহের বলিল, “মোড়ল সাহেব! আমার একটা কতা।” মোড়ল বলিল, “মিঞারা! তোমরা চুপ কর। আমার বিয়াইর দ্যাশের কুটুম কি জানি কইবার চায়।” একজন বলিয়া উঠিল, “কি আর কইব! কুটুম বুঝি আমাগো চিনি-সন্দেশ খাওয়ানের দাওয়াৎ দিতি চায়!” সকলে হাসিয়া উঠিল। কিন্তু আজাহের আজ মরিয়া হইয়া উঠিয়াছে। তাহার সমস্ত ব্যাপার আজ সকলকে না জানাইয়া দিলে কিছুতেই সে সোয়াস্তি পাইবে না।

আবার একটু কাশিয়া আজাহের বলিতে আরম্ভ করিল, “মোড়ল সাহেব! সেঁতের শেহলার মত ভাসতি ভাসতি আমি আপনাগো দ্যাশে আইছি। আমি এহানে মেজবান-কুটুমের মত দুইদিন থাকপার আসি নাই। আমি আইছি চিরজনমের মত আপনাগো গোলামতী করতি।” এই পর্যন্ত বলিয়া সভার সব লোকের দিকে সে চাহিয়া দেখিল; তাহারা কেহ টিটকারী দিয়া উঠিল কি না। কিন্তু সে আশ্চর্য হইয়া দেখিল তাহার কথা সব লোক নীরবে শুনিতেছে। তখন সে আবার আরম্ভ করিল, “বাই সব! আমারও বাড়ি-ঘর ছিল, গোয়ালে দুইডা যুয়ান যুয়ান বলদ ছিল, বেড়ী ভরা ধান ছিল; কিন্তু মহাজনে মিথ্যা দিনার দায়ে নালিশ কইর‍্যা আমার সব নিল্যাম কইরা নিয়া গ্যাছে।” এই পর্যন্ত বলিয়া আজাহের গামছার কানি দিয়া চোখ মুছিয়া আবার বলিতে আরম্ভ করিল, “আধবেলা খায়া উপাস কইরা তবু ভিট্যার মাটি কামড়ায়া ছিলাম। কিন্তুক পুলাপানগুলা

যহন বাত বাত কইরা কানত, তখন আর জানে সইত না। আমাগো মোড়ল মিনাজদ্দী মাতবর তহন কইল, আজাহের! যা, তাম্বুলখানা আমার বিয়াই গরীবুল্লা মাতবরের দ্যাশে যা। তানি তোর একটা কূল-কিনারা করব।”

এই বলিয়া আজাহের আবার কঁদিতে লাগিল। তাহার সঙ্গে সমবেত গ্রাম্য লোকদেরও দুই একজনের চোখ অশ্রু সজল হইয়া উঠিল। মোড়ল নিজের গামছার খোট দিয়া আজাহেরের চোখ মুছাইতে মুছাইতে বলিল, “আজাহের বাই! কাইন্দ না। খোদা যহন তোমারে আমার এহানে আইন্যা ফেলাইছে, তহন একটা গতি হবিই।” আজাহের কি বলিতে যাইতেছিল। মোড়ল তাহাকে থামাইয়া বলিল, “আর কইবা কি আজাহের বাই? তুমি যেদিন পরথমে আইছ, সেই দিনই বুঝতি পারছি, শোগা-ভোগা মানুষ তুমি প্যাটের জ্বালায় আইছ আমাগো দ্যাশে। আরে বাই। তাই যদি বুঝতি না পারতাম তয় দশ গিরামে মাতবরী কইরা বেড়াই ক্যান? কিন্তুক তুমি তোমার দুস্কির কতা কইবার চাইছ, আমি হুনি নাই। কেন হুনি নাই জান? তোমার দুস্কির কতা আমি একলা হুনব ক্যান? আমার গিরামের দশ বাইর সঙ্গে একাত্তর বইসা হুনুম। তোমার জন্যি যদি কিছু করনের অয় তবে দশজনে মিল্যা করুম।” এই পর্যন্ত বলিয়া মোড়ল সকলের মুখের দিকে একবার তাকাইয়া লইল। মোড়ল যে এমনি একটা সামান্য ব্যাপারেও তাহাদের দশজনের সঙ্গে পরামর্শ করিতে বসিয়াছে, এজন্য মোড়লের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধায় ও কৃতজ্ঞতায় তাহাদের মনের ভাব এমনই হইল যে, দরকার হইলে তাহারা মোড়লের জন্য জান পর্যন্ত কোরবানী করিয়া দিতে পারে। তাহাদের মুখের পানে চাহিয়া মোড়ল ইহা বুঝিতে পারে। বহু বৎসর মোড়লী করিয়া তাহার এই অভিজ্ঞতা হইয়াছে। মোড়ল আবার সমবেত লোকদের ডাকিয়া কহিল, “কি বল বাইরা! আজাহের মিঞারে তবে আমাগো গিরামে আশ্রয় দিবা তোমরা?” সকলে এক বাক্যে বলিয়া উঠিল, “তারে আমরা বুকি কইরা রাখপ।”

“শুধু মুহির কতায় কি চিড়্যা ভেজে মিঞারা? কি ভাবে বুকি কইরা রাখপা সে কতাডা আমারে কও?”

সম্মুখ হইতে দীনু বুড়ো উঠিয়া বলিল, “মাতবরের পো! আমার ত পুলাপান কিছুই নাই। মইরা গ্যালে জমি-জমা সাতে-পরে খাইব। আমার বাঘার ভিটাডা আমি আজাহের বাইর বাড়ি করবার জন্যি ছাইড়া দিলাম। এতে আমার কুনু দাবি-দাওয়া নাই।”

দীনু বুড়োর তারিফে সকলের মুখ প্রসন্ন হইয়া উঠিল।

এ-পাশ হইতে কলিমদ্দী উঠিয়া বলিল, আজাহের-বাইর বাড়ি করতি যত ছোন লাগে সমস্ত আমি দিব।”

তাহের নেংড়া বহু দূরে বসিয়া ছিল। সে নেংড়াইতে নেংড়াইতে কাছে আসিয়া বলিল, “তোমার বাড়ি করতি যত বাঁশ লাগবি, আমার ছোপের ত্যা তুমি কাইটা নিয়া যাবা আজাহের-বাই।”

মোড়ল তখন চারিদিক চাহিয়া বলিল, “থাকনের ভিটা পাইলাম, গর তোলনের ছোন পাইলাম। বাশও পাইলাম। কিন্তুক আজাহের বাই ত একলা বাড়ি-গর তুলতি পারবি না?”

সকলে কলরব করিয়া উঠিল, “আমরা সগ্যলে মিল্যা আজাহের-বাইর নতুন বাড়ি তুল্যা দিব। কাইল-ই কাম আরম্ভ কইরা দিব।”

“ক্যাবল কাম আরম্ভ করলিই অবি না। কাইলকার দিনির মদ্দি আজাহের-বাইর নতুন বাড়ি গড়ায়া দিতি অবি। বুঝলানি মিঞারা? পারবা ত?” মোড়ল জিজ্ঞাসা করিল।

সকলে কলরব করিয়া উঠিল, “পারব।”।

“তা ঐলে এই কতাই ঠিক। কাইল সন্ধ্যার সময় আমি দাওয়াৎ খাইতি যাব। আজাহের-বাইর বাড়িতি। দেখি মিঞারা! তোমাগো কিরামত কতদূর।” এই বলিয়া মোড়ল প্রসন্ন দৃষ্টিতে একবার সকলের মুখের দিকে চাহিল। আজাহেরের জন্য ইতিমধ্যে গ্রামের লোকদের মধ্যে যে যতটা স্বার্থত্যাগ করিতে চাহিয়াছিল, সেই দৃষ্টির বিনিময়ে তাহা যেন স্বার্থক হইয়া গেল।

সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া আজাহেরের মনে হইতেছিল সে যেন কোন গ্রাম্য-নাটকের অভিনয় দেখিতেছে। মানুষের অভাবে মানুষ এমন করিয়া সাড়া দেয়? আনন্দের অশ্রুতে তার দুইচোখ ভরিয়া আসিল।

মোড়ল তখন আজাহেরকে লক্ষ্য করিয়া বলিতে লাগিল, “আজাহের-বাই! তোমার দুস্কির কতা তুমি আমারে একলারে হুনাইবার চাইছিলা? কিন্তু সেই হোননের কপাল ত আমার নাই। হেই দিন যদি আমার থাকত তবে গিরামের মানুষ ট্যারও পাইত না, ক্যামুন কইরা তুমি আইল্যা। কাক-কোকিলি জানার আগে তোমার গর-বাড়ি আমি তুল্যা দিতাম। বাগের মত যুয়ান সাতটা ভাজন বেটা ছিল। এক দিনের ভেদ-বমিতে তারা জনমের মত

আমারে ছাইড়া গেল। তারা যদি আইজ বাইচ্যা থাকত, তবে তুমি যেইদিন আইছিলা,  হেইদিন রাত্তিরেই তোমার নতুন গর-বাড়ি তুল্যা দিতাম। আইজ গিরামের মানুষ ডাইকা তোমার গর-বাড়ি তুলবার কইছি।”

আজাহের কি যেন বলিতে যাইতেছিল। মোড়ল তাহাকে থামাইয়া দিয়া বলিল, “আরে বাই! তুমি ত পরথমে গিরামের লোকগো কাছে আস নাই। আইছিলা আমার কাছে। আমি তোমার জন্যি কিছুই করবার পারলাম না। আমার পুলারা যদি আইজ বাইচ্যা থাকত?” গামছার খোট দিয়া মোড়ল চোখের পানি মুছিতে লাগিল।

পাশে বাবরী-চুল মাথায় মোকিম বসিয়াছিল। সে বলিয়া উঠিল, “মোড়ল-ভাই! আপনি কানবেন না। আমরা আপনার পোলা না? আমরা গেরামের সকল পোলাপান মিল্যা আজাহের-বাইর বাড়ি-গর তুল্যা দিব।”

“আরে মোকিম! তুই কি কস?” গামছার খোটে চোখের পানি মুছিতে মুছিতে মোড়ল বলে, “হেই গিরামের মানুষই কি সব আছে? কি দেখছিলাম, আর কি দেখপার জন্যি বইচ্যা আছি? এই গিরামে ছিল হাসেন নিকারী, কথায় বলে হাসেন নিকারীর খ্যালা, তিনডা ভেঁকি হাতের উপর লয়া শূন্যের উপর খেলা দেখাইত। তারোয়ালখানা ওই নাইরকেল গাছটার উপর ছুঁইড়্যা ফেলাইত, বো বো কইরা তারোয়াল যায়া গাছের নাইরকেল কাইট্যা আইন্যা আবার ফিরা আইস্যা হাসেন নিকারীর পায়ের কাছে সেলাম জানাইত।”

দীনু বুড়ো বলিয়া উঠিল, “আপনার মনে নাই বড়-মিঞা! ওই জঙ্গলডার মদ্দি ছিল হাকিম চান আর মেহের চান্দের বাড়ি, দুইজনে যহন জারীগান গাইত বনের পশু-পক্ষী গলাগলি ধইরা কানত?”

“মনে নাই ছোটমিঞা?” মোড়ল বলে, “ফৈরাতপুরির মেলায় যায় গান গায়া রূপার দুইডা ম্যাডাল না কি কয়, তাই লয়া আইল। আমার সামনে তাই দেখায়। কয়, “মোড়ল, এই দুইডা আমাগো বাবির পরন লাগবি। পাগলা কানাইর সঙ্গে গান গায়া তারে হারায়া আইছি। তারই পুরস্কারি পাইছি এই দুইডা, আমাগো বাবি যেন গলায় পরে। অনেক মানা করলাম, অনেক নিয়ারা করলাম, হুনল না। হেই দুইডা মেডিল এহনো আমার বাড়িওয়ালীর গলায় আছে। কিন্তুক হেই মানুষ আইজ কোথায় গেল?”

“মনে আছে বড়মিঞা?” দীনু বুড়ো আগাইয়া আসিয়া কয়, “দিগনগরের হাটের মদ্দি আমাগো গিরামের হনু গেছিল কুশাইর বেচতি, কি একটা কতায় মুরালদার লোকেরা দিল তারে মাইর। আমাগো গিরামের কমিরদ্দী গেছিল মাছ কিনতি। হুইন্যা, একটা আস্ত জিকা গাছ ভাইঙ্গা সমস্ত মুরালদার মানষিরে আট থইনে বাইর কইর‍্যা দিয়া আইল।”

“মনে সবই আছে ছোট-মিঞা! সেই কমিরীর ভিটায় আইজ ঘু ঘু চরত্যাছে। সন্ধ্যা-বাত্তি জ্বালনের একজনও বাইচ্যা নাই।” একটা দীর্ঘ নিশ্বাস লইয়া মোড়ল আবার বলিতে আরম্ভ করিল, “আমাগো তাম্বুলখানার গিরামখানা গমগম করত মানষির। কতাবার্তায়। এ যেন কালকার ঘটনা। স্বপনের মতন মনে হইত্যাছে। রাত-দিন এ-বাড়ি ও-বাড়ি গান, কত আসি, কত তামাসা? এই ম্যালোয়ারী বিমারে সব শেষ কইর‍্যা দিল। আর কি সেই সব দিন ফিরা পাব? গোরস্তানের মদ্দি বুইড়্যা পাহাড়াদার খাড়ায়া আছি। নিজের দুস্কির কতা তোমাগো আর কয়া কি করব? সারা রাইত আমার গুম আসে না। জনমের মত যারা চইল্যা গ্যাছে গিরাম ছাইড়া, নিশির রাত্তিরকালে গোরের থইনে উইঠ্যা তারা আমারে জিগায়, ‘মোড়ল! আমরা ম্যালোয়ারীতে মরলাম, তোমার গিরামের কোন মানুষ এমন হেকমত কি কোন দিন বাইর করতি পারবি, যাতে ম্যালোয়ারী জ্বরের হাত। থইনে আমাগো আওলাদ-বুনিয়াদ যারা বাইচ্যা আছে তাগো বাঁচাইতে পারে? এ কতার আমি কুনু জবাব দিব্যার পারি না। নিজের দুস্কির কাহিনী কইলে ফুরাইবার নয়। আর কত কমু? বাইরা! তোমরা যার যার বাড়ি যাও। আমারও শরীরডা জ্বরায়া আসত্যাছে। এহনই কাঁথার তলে যাইতি অবি। কিন্তুক কাইলকার কতা যেন মনে থাহে। আমি সন্ধ্যা। বেলা যাব নতুন বাড়িতি দাওয়াৎ খায়নের লাগ্যা।”

গ্রামের লোকেরা যে যার মত বাড়ি চলিল। অনেকেরই শরীরে মৃদু জ্বরের কাঁপন অনুভূত হইয়াছে। কিন্তু সমস্ত ছাপাইয়া কি একটা গভীর বিষাদে যেন সকলের অন্তর ভরা। অতীত দিনের অন্ধকারতল হইতে মোড়ল আজ এই গ্রামের যে বিস্মৃত গৌরব-কথার খানিক প্রকাশ করিল, তাহার মৃদু স্পর্শ সকলকেই অভিভূত করিয়া তুলিতেছে।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x