(ষোল)
রাত্র শেষ না হইতে আজাহেরের ছেলে বছির জাগিয়া উঠিল। চারিদিকের বনে কত রকমের পাখিই না ডাকিতেছে। মাঝে মাঝে কাঠ-ঠোকরা শব্দ করিতেছে। দল বাধিয়া শিয়ালেরা মাঝে মাঝে চীৎকার করিয়া উঠিতেছে। আর বনের ভিতর হইতে শো শো শব্দ আসিতেছে। এক রহস্য মিশ্রিত অজানা ভয়ে তাহার সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। কখন সকাল হইবে। কখন সে তাহার সদ্য পরিচিত খেলার সাথীদের সঙ্গে এই অজানা। দেশের রহস্য উদঘাটিত করিয়া তুলিতে পারিবে।
এমন সময় ফুলু আসিয়া ডাক দিল, “বছির-বাই, আইস। আমরা তাল কুড়াইবার যাই।” তাড়াতাড়ি দরজা খুলিয়া বছির বাহির হইয়া পড়িল। মোড়লের পুত্র নেহাজদ্দী আর গেদাও উঠানে অপেক্ষা করিতেছিল। তাহারা সকলে মিলিয়া পানা-পুকুরে ডুবান একটা ডোঙ্গা পেঁচিয়া তাহাতে উঠিয়া বসিল। নেহাজী হাতে লগি লইয়া অতি নিপুণভাবে ডোঙ্গাখানিকে ঠেলিয়া আঁকাবাঁকা নাও দাঁড়া বাহিয়া ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়া সেই বেত ঝাড়ের অন্ধকারে তালগাছ তলায় আসিয়া উপস্থিত হইল। পানির উপরে রাশি রাশি তাল ভাসিয়া বেড়াইতেছিল? যেন তাহাদেরই ছোট ছোট খেলার সাথীগুলি। সকলে মিলিয়া কলরব করিয়া তালগুলিকে ধরিয়া ডোঙ্গায় উঠাইতে লাগিল। তারপর তাল টোকান প্রায় শেষ হইয়া আসিল। ঘন জঙ্গলের আড়ালে লতা পাতার আবরণে দু’একটা তাল তখনও লুকাইয়াছিল।
এবার সেই তালগুলির যেটি যে আগে দেখিতে পাইবে সেটি তাহারই হইবে। দেখা যাক কার ভাগে কয়টি তাল পড়ে। যার ভাগে বেশী তাল পড়িবে সে লগি দিয়া ডোঙা ঠেলিয়া লওয়ার সম্মান পাইবে। তাল খুঁজিতে তখন তাহাদের কি উৎসাহ, “মিয়া-বাই! ওইদিকে লগি ঠ্যাল, ওই যে একটা তাল, ওই যে আর একটা।” ফুলেরই মতন মুখোনি নাচাইয়া ফুলী বলে। এইভাবে তাল টুকাইয়া দেখা গেল, ফুলীর ভাগেই বেশী তাল হইয়াছে। বড় ভাই নেহাজদ্দী বড়ই মনমরা হইয়া তাহার লগি চালানোর সম্মানটি ছোট বোনকে দিতে বাধ্য হইল। কোমরে আঁচল জড়াইয়া ফুলী লগি লইয়া ডোঙা ঠেলিতে। লাগিল। সামনে দিয়া দুই তিনটি সাপ পালাইয়া গেল। একটা সাপ ত ডোঙর মাথায়ই। একেবারে পেচাইয়া গেল। বছির ভয়ে চীৎকার করিয়া উঠিল, “আর সাপ–সাপ, কামুড় দিবি!” অতি সন্তর্পণে লগির মাথা দিয়া সাপটিকে ছাড়াইয়া ফুলী খিল খিল করিয়া হাসিতে লাগিল। তাহার ভাই দুটিও বোনের সঙ্গে হাসিতে যোগ দিল। ইহারা মানুষ না কি! সাপ দেখিয়া ভয় করে না! বছিরের বড় গোস্বা হইল।
ফুলী পূর্বেরই মত হাসিতে হাসিতে বলিল, “বছির-বাই! ওগুলো গাইছা সাপ। আমাগো কি করব?”
“ক্যান কামুড় দ্যায় যদি?” বছির বলিল।
পূর্ববৎ হাসিতে হাসিতে ফুলী বলিল, “কামুড় কেমন কইরা দিবি, আমার হাতে লগি নাই? এক বাড়িতি মাথা ফাটায়া দিব না?” কিন্তু বছির ইহাতে কোনই ভরসা পাইল না। পথে আসিতে আসিতে পুকুর হইতে তাহারা অনেক ঢ্যাপ-শাপলা তুলিল। বছিরের কিন্তু একাজে মোটেই উৎসাহ লাগিতেছিল না। কোন সময় আর একটা সাপ আসিয়া ডোঙা পেচাইয়া ধরিবে কে জানে। কিন্তু তাহাদের দুই ভাই-বোনের উৎসাহের সীমা নাই। এখানে ওখানে অনেক ঢ্যাপ কুড়াইয়া তাহারা বাড়ির ঘাটে আসিয়া ডোঙা ভিড়াইল। তখন বাড়ির। সকল লোক উঠিয়াছে। মোড়ল ঘাটে মুখ হাত ধুইতে আসিয়াছিল। ছেলে-মেয়েদের এই অভিযানের সাফল্য দেখিয়া তাহাদিগকে তারিফ করিল। ইহাতে তাহাদের সারা সকালের সমস্ত পরিশ্রম যেন সার্থক হইয়া উঠিল। ফুলী তার ফুলের মত মুখোনি দুষ্টামীতে ভরিয়া বলিল, “বাজান! ডোঙার আগায় একটা গাইছা সাপ বায়া উঠছিল। তাই দেইখা বছির-বাই একেবারে বয়ে চিক্কর দিয়া উঠছে।” শুনিয়া মোড়ল একটু হাসিল। ইহার ভিতর। কি তামাসার ব্যাপার আছে বছির তাহা বুঝিতে পারিল না।
“বোবা কাহিনী” উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ