(পনের)
ঘন জঙ্গলের আড়াল ঘেরা তালখানা গ্রাম। সূর্য এখানে এক ঘন্টা পরে আলোক দেখায়। সূর্য ডোবার এক ঘন্টা আগে এখানে চারিদিকে রাত্র হইয়া যায়। প্রত্যেকটি বাড়িতে আম, কাঁঠাল, সুপারীর বন। তার পাশে বাঁশ ঝাড়, কলার ঝড়, আর নানা আগাছার বন। প্রত্যেকটি গাছের সঙ্গে নাম–না–জানা লতা, এ–গাছের সঙ্গে ও–গাছকে জড়াইয়া ধরিয়াছে। শেয়াল, খাটাস দিনের বেলায়ই নির্ভয়ে সারা গ্রামে ঘুরিয়া বেড়ায়। বুনো শুয়োরের ঝাক দল বাধিয়া বনের মধ্যে বিচরণ করে। কোন বাড়িতেই বেশী লোকজন নাই। যাহারা আছে তাহাদের পেট উঁচু, বুকের হাড় কয়খানা বাহির করা। এই গ্রামে আসিয়া প্রথমে আজাহের গরীবুল্লা মাতবরের সঙ্গে দেখা করিল।
গরীবুল্লা মাতবর মিনাজদ্দী মাতবরের সম্পর্কে বৈবাহিক। মিনাজদ্দী মাতবর আগেই আজাহেরকে গরীবুল্লা মাতবরের সঙ্গে দেখা করিতে বলিয়া দিয়াছিল।
সারাদিন হাঁটিয়া শ্রান্ত–ক্লান্ত হইয়া প্রায় সন্ধ্যা বেলা তাহারা গরীবুল্লা মাতবরের বাড়িতে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। মাতবর বৈঠকখানায় বসিয়া তামাক টানতেছিল। হঠাৎ এই আগন্তুক লোকদের দেখিয়া আশ্চর্য হইল।
আজাহের মাতবরকে সালাম জানাইয়া কহিল, “আমরা মিনাজদ্দী মাতবরের দ্যাশ অইতে আইছি।”
মোড়ল খুশী হইয়া বলিল, “আরে কুটুমের দ্যাশ অইতে আইছ! তা বইস বাই! বইস।”
তারপর অন্দর–বাড়ির দিকে মুখ লইয়া উঁচু গলায় বলিল, “আরে আমাগো বাড়ির উনি কৈ গ্যাল? এদিক আসুক দেহি। কুটুম আইছে। আজ সকাল বেলা থাইকাই কুটুম–পক্ষি ডাকত্যাছে, তখনই মনে করছিলাম, আইজ কুটুম আইব।”
মোড়লের স্ত্রী হাসি–খুশী মুখে বাড়ির ভিতর হইতে দৌড়াইয়া আসিল। তারপর আজাহেরকে দেখিয়া মুখে লম্বা ঘোমটা টানিয়া দিল। মাতবর কহিল, “আরে শরম কইর না। বেয়াইর দ্যাশের লোক। শীগগীর ওজুর পানি পাঠায়া দাও। আর শোন, এগো বাড়ির মদ্দি নিয়া যাও।”
মোড়লের স্ত্রী আজাহেরের বউ–এর কোল হইতে মেয়েটিকে টানিয়া বুকে লইল। তারপর আজাহেরের বউকে টানিয়া লইয়া বাড়ির ভিতর চলিয়া গেল। একটু পরেই ছোট মেয়েটি পানির বদনা এবং খড়ম আনিয়া বৈঠকখানায় রাখিল। মোড়ল মেয়েটিকে ডাকিয়া কহিল, “দেখ ফুলু! তোর মাকে ক গিয়া বড় মোরগড়া জবাই কইরা দিতি। আইজ বেয়াই–এর দ্যাশের কুটুমরে বাল কইরা খাওয়াইতি অবি।” মেয়েটি রুমঝুম করিয়া পায়ের খাড়ু বাজাইতে বাজাইতে চলিয়া গেল।
আজাহের তাহাকে নিষেধ করিবারও সুযোগ পাইল না। এইসব আদর–আপ্যায়নে আজাহের শরমে মরিয়া যাইতেছিল। সে ত কুটুমের মত দু’একদিনের জন্য এদেশে বেড়াইতে আসে নাই। অনাহারী স্ত্রী–পুত্র লইয়া মোড়লের ঘাড়ে একটা ভার হইতে আসিয়াছে। সমস্ত জানিয়া শুনিয়া মোড়ল তাহাকে কি ভাবে গ্রহণ করিবে, কে বলিবে? একটি পয়সা সে সংগ্রহ করিয়া লইয়া আসিতে পারে নাই। সেই জন্য আগেই আজাহের মোড়লকে তাহার সমস্ত অবস্থা জানাইয়া দেওয়ার সুযোগ খুঁজিতে লাগিল।
একটু কাসিয়া বলিল, “মোড়ল সাহেব! আমাগো জন্যি ব্যস্ত অবেন না। আমাগো সগল হুনলি,”–
“আরে মিঞা! সগল কতাই হুনবানি। আগে বইস্যা জিরাও, নাস্তা খাও।”
এমন সময় মোড়লের মেয়ে ফুলু চীনের রেকাবীতে করিয়া মুড়ি, তীলের নাড়, নারকেলের তক্তি–আর একটি বাটিতে করিয়া ঘন আওটা দুধ আজাহেরের সামনে আনিয়া ধরিল। আজাহের কি বলিতে চাহিতেছিল মোড়ল তাহা কানেও তুলিল না, “আরে মিয়া! আগে নাস্তা খায় লও।”
অগত্যা আজাহের হাত পাও ধুইয়া নাস্তা খাইতে বসিল। মোড়ল তাহার সঙ্গে গল্প করিতে লাগিল।
“আরে মিঞা! তোমরা ঐলা গাঙের দ্যাশের মানুষ, তাও আবার শহরের কাছে বাড়ি। তোমাগো কি আমরা খাতির করতি পারি? এই গই–গিরামে কিবা আছে আর কিবা খাওয়াব?”
আজাহের খাইতে খাইতে মুখ উঠাইয়া বলে, “আরে কি যে কন মোড়ল সাব?”
“কব আর কি আজাহের বাই?” মোড়ল খুশী হইয়া উত্তর করে, “হেবার গেলাম বেয়াইর বাড়িতি! কাছারী গরে কতা কইতাছি, এক দণ্ডও যায় নাই অমনি জিলাপী, হন্দেশ আরও লওয়াজিমা আইন্যা উপস্থিত। কত আর খাব? খাওয়ার পরে বিয়াই কয় চা খাও। চীন্যা–বাটিতে ভইরা চার পানি ত আইন্যা দিল। গরম, মুহি চুমুক দিয়া মুখ পুড়ায়া ফেললাম। তারপর বিয়াইরে কই, ‘বিয়াই! চা ত খাইলাম। এইবার পানি দাও। পানি খাই। বিয়াইন ও–কোণা খাড়ায়া মুহি কাপড় দিয়া আসে। আমি জিজ্ঞাইলাম, আপনার কি অইল বিয়াইন?’ বিয়াই তখন কয়, “তোমার বিয়াইন তোমারে ঠগাইল। চা খায়া পানি খাইতি হয় না। আমি ত এহেবারে নামাকূল আর কি! তোমাগো শহইর্যা দ্যাশের মানষিরী আমরা কি আর খাতির করব? আরে মিয়া! উঠলা যে? ওই উড়মগুলা সবই খাইতি অবি। আর বাটিতে দুধও ত পইড়া রইল?” মোড়ল বাটির সমস্ত দুধ আজাহেরের পাতে ঢালিয়া দিল। নাস্তা খাওয়া শেষ হইলেই মোড়ল নিজের বাশের চোঙ্গা হইতে পান বাহির করিল। পাশের দাখানা লইয়া একটা সুপারি অর্ধেক কাটিয়া আজাহেরের হাতে দিল। “মিঞা! পান–সুপারি খাও।” তারপর খুব গর্বের সঙ্গে বলিতে লাগিল, “পান আমার নিজির বাড়ির, আর সুপারিও নিজির গাছের। চুনডা ক্যাবুল কিনছি।” বলিয়া চুনের পাত্রটি সামনে আগাইয়া দিল। আজাহের পান মুখে দিতে না দিতেই মোড়ল নিজির হাতের হুঁকোটি আনিয়া আজাহেরের হাতে দিল।
বাড়ির ভিতরেও ওদিকে মোড়লের স্ত্রী আজাহেরের বউকে কম খাতির করিল না। ছেলে–মেয়ে দুটি মোড়লের ছেলে–মেয়েদের সঙ্গে মিলিয়া গিয়াছে। মুরগীর ঝোল চুলায় উঠাইয়া দিয়া মোড়লের বউ আজাহেরের বউ–এর চুল লইয়া বসিল।
“পোড়া–কপালী! এমন চুল তোর মাথায়! তাতে ত্যাল নাই।” আঁজলা পুরিয়া তেল লইয়া বউটির মাথায় ঘসিতে বসিল। তারপর বাঁশের চিরুণীখানা লইয়া ভালমত আঁচড়াইয়া সুন্দর করিয়া একটি খোঁপা বাঁধিয়া দিল। “বলি পোড়া–কপালী! দুইদিনের জন্যি ত আইছাস। বালমত আদর কইরা দেই, আমাগো কতা তোর মনে থাকপি।” বউ যেন কি বলিতে যাইতেছিল। মুখে একটা ঠোকনা মারিয়া মোড়ল–গিন্নী বলিল, “বলি আমি তোর বইন অই কিনা? আমার বাড়িতে তুই অযত্তনে থাকপি,–তা দেইখ্যা তোর জামাই। আমারে কি কইব?”
এত আদর–যত্ন পাইয়া আজাহেরের বউ–এরও বড়ই অসোয়াস্তি বোধ হইতেছিল। ভিখারীর মত তাহারা আশ্রয় লইতে আসিয়াছে। তাহাদের প্রতি তেমনি ভিখারীর আচরণ করিলেই সে খুশী হইতে পারিত। কিন্তু মোড়ল–গিন্নী একি করিতেছে? তাহাদিগকে আত্মীয়–কুটুম্বের মত যত্ন করিতেছে। এটা ওটা আনিয়া খাওয়াইতেছে। কাল যখন টের পাইবে, তাহারা পেটের ভুখের তাড়নায়ই এদের বাড়িতে আশ্রয় লইতে আসিয়াছে, তখন
জানি ইহারা কি ভাবে তাহাদের গ্রহণ করিবে? কিন্তু মোড়ল–গিন্নীর মুখোনি যেন সকল দুনিয়ার মমতায় ভরা। রোগা একহারা পাতলা গঠন, বয়স পাঁচ চল্লিশের কাছাকাছি। কিন্তু মুখের হাসিখানি কি করুণ আর মমতায় ভরা। মা বলিয়া কোলে ঝাপাইয়া পড়িতে ইচ্ছা করে। তাকেও আজাহেরের বউ দুই চার বার তাহাদের সমস্ত দুঃখের কাহিনী বলিবার জন্য চেষ্টা করিল। মোড়ল–গিন্নী সেদিকে কানও দিল না।
রাত্রের খাওয়া দাওয়া শেষ হইলে একখানা ঘরে মোড়ল আজাহেরদের শুইবার দিল। মোড়ল–গিন্নীর সুবন্দোবস্তে আজাহেরের ছেলে–মেয়ে দুইটি আগেই বিছানার এক পাশে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে।
“বোবা কাহিনী” উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ