(বারো)

ধীরে ধীরে আকাশ ফর্সা হইয়া আসিল। আজাহেরের ছেলে বছির আস্তে আস্তে উঠিয়া আম গাছের তলায় যাইয়া আম কুড়াইতে লাগিল। এমন সময় আট দশজন লোক বাড়ির উপর আসিয়া আথাল হইতে গরু দুইটির দড়ি খুলিতে লাগিল। বছির চীৎকার করিয়া তার বাপকে ডাকিতে লাগিল, “ও বাজান! জলদী উইঠা আইস। কারা যিনি আমার গরু দুইডারে লইয়া যাইত্যাছে।”

ছেলের ডাক শুনিয়া আজাহের হুড়মুড় করিয়া উঠিয়া আসিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে দেখিতে পাইল,শরৎ সাহা লোকজন লইয়া আসিয়াছে। সঙ্গে সেই আদালতের পিয়ন খাকি পিরানের পকেট হইতে এক খণ্ড কাগজ বাহির করিয়া সদম্ভে পড়িতে লাগিল, “আলীপুর গ্রামের মহামহিম শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র সাহা, পিতা মৃত গোলক চন্দ্র সাহার নিকট হইতে গোবিন্দপুর নিবাসী আজাহের মণ্ডল আজ পাঁচ বৎসর পূর্বে পনর টাকা কর্জ করিয়াছিল। তাহার সুদ, সুদের সুদ, চক্রবন্দীতে বৃদ্ধি পাইয়া পঁচ শত টাকায় পরিণত হইয়াছে। এই টাকা মহামহিম আদালত শরৎ সাহার নামে ডিগ্রী দিয়াছেন। আজ আজাহের মণ্ডল যদি সেই টাকা পরিশোধ না করিতে পারে তবে তাহার স্থাবর, অস্থাবর। সমস্ত মাল ক্রোক হইবে।”

লোকটি প্রতিটি কথা এইরূপ ধমকের সহিত বলিতেছিল, যেন তাহার আঘাতে আজাহেরের বুকের পাজরগুলি ভাঙ্গিয়া যাইতেছিল।

আজাহের সেই আদালতের পিয়নের পা দুইটি জড়াইয়া ধরিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, “দোহাই দিচ্ছি কোম্পানী বাহাদুরের, দোহাই মা মহারাণীর, আমার হালের গরু দুইডা নিবেন না।”

পিয়ন আজাহেরের হাত হইতে পা ছাড়াইয়া লইয়া বলিল, “রাজার হুকুম, আমার কি সাধ্য আছে মিঞা সাহেব? শরৎ সাহার টাকাটা যদি আপনি পরিশোধ করে দিতে পারেন তবে গরু ছেড়ে যেতে পারি।”

এত টাকা সে কেমন করিয়া পরিশোধ করিবে। মাত্র পনর টাকা সে কর্জ করিয়া আনিয়াছিল। তাহার পিছনে কত পনর টাকা সে শরৎ সাহার বাড়ি দিয়া আসিয়াছে। তবু তাহার সেই পনর টাকার সুদের সুদ বাড়িয়া আজ পঁচশত টাকায় পরিণত হইয়াছে। আজাহের আছাড় খাইয়া শরৎ সাহার পা জড়াইয়া ধরিল, “সা–জী মশায়! আমারে মাপ করেন।”

তাহার কান্নাকাটিতে গ্রামের বহু লোকজন আসিয়া উঠানে জড় হইল। মিনাজদ্দী মাতবরও আসিল। কিন্তু আদালতের পিয়ন সামনে দাঁড়াইয়া। তাহার মাজায় আদালতের ছাপ–মারা চাপরাশ ঝকমক করিতেছে। কেহই আজাহেরকে কোন সাহায্য করিতে সাহস পাইল না।

শরৎ সাহা ঝেংটা দিয়া পা ছাড়াইয়া লইয়া কহিল, “কেন মিঞা? সে দিন যে খুব বাড়াবাড়ি করেছিলে? কই মিনাজদ্দী! কথা কও না কেন? আমার মুখ না কুত্তার মত, এখন আজাহেরকে বাঁচাও।”

আজাহের জোড় হাত করিয়া শরৎ সাহাকে বলিতে লাগিল, “বাবু! আমারে বাঁচান। আপনি আমার ধর্মের বাপ। আমার ছাওয়াল–ম্যায়াগো মুখির দিক চায়া আমাকে দয়া করেন।”

“দয়ার কথা আজাহের! শরৎ সাহার জীবনে সব আছে কিন্তু ওই একটা জিনিস কেউ কোন দিন দেখেনি।”

“কিন্তুক আমাগো সব যদি নিয়া যান আমরা খাব কি? আমার ছাওয়াল–ম্যায়াগুলা যে না খায়া মরবি।”

“এসব যদি ভাবতাম তবে কি আর টাকা করতে পারতাম। জান মিঞা! টাকা যেমন শক্ত তেমনি শক্ত মন না করতে পারলে টাকা থাকে না। আমার গিন্নীর ছয়মাস যক্ষমা হয়েছে, এখনও টাকা খরচ করে ডাক্তার দেখাইনি।”

“বাবু! জনম ভইরা আপনার বাড়িতি চাকর খাইটা খাব, যা হুকুম করবেন তাই কইরা দিব।”

“তোমাকে খাটাব? জান, বাড়িতে গিন্নীর অসুখ, রানতে পারে না। নিজের হাতে এক বেলা বেঁধে তিন বেলা খাই তবু চাকর রাখি না। লোকে বলে, শরৎ সাহার লাখ টাকা আছে। সে কি সহজে হয়? যাক তোমার সঙ্গে কথা বলে কি হবে! আরে মিঞা সাবরা! তোমরা যে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলে, ঘরের মধ্যে ধান চাউল যা আছে বের কর।”

শরৎ সাহার লোকেরা ঘরে ঢুকিতেছিল। আজাহেরের বউ দরজায় আসিয়া দাঁড়াইল। “আমার ডোলের ধান আমি কাউরে নিবার দিমু না। আমি কত কষ্টে এই ধান উড়াইছি। কত কইরা বৈদে শুকাইছি। আমার পুলা–ম্যায়ারা বছর ভইরা খাবি। আমি যাবার দিব না কেউরে আমার গরে।”

শরৎ সাহার লোকেরা আজাহেরের বউ এর গায়ে হাত দিতে যাইতেছিল। মিনাজদ্দী মাতবর আর স্থির থাকিতে পারিল না।

সে চীৎকার করিয়া উঠিল, “সাবধান! সাবধান মিঞারা! ম্যায়া লোকের গায় হাত দিবেন না। আপনাগো গরেও মা–বোন আছে।”

এমন সময় পিয়ন সামনে আগাইয়া আসিয়া বলিল, “মাতবর সাহেব! সাপের সঙ্গে খেলা করছেন। রাজার হুকুম। যে এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে তার যথাসর্বস্ব যাবে। দেখছেন না আমার কোমরে কোম্পানীর চাপরাশ। এই আওরত লোকটিকে দরজা ছেড়ে চলে যেতে বলুন।”

“হে যদি না যায় তবে কি করতি চান পিয়ন সাহেব?” মাতবর জিজ্ঞাসা করিল।

“কি করতি পারি শুনতে চান? শোভারামপুরের গনি বেপারী সদর পিয়নকে বে–দখল করেছিল, দেখে আসুন গিয়া আজ গনি বেপারীর বাড়িতে জঙ্গল। উঠানে ঘুঘু চরছে। পীড়নের কথা ছেড়েই দিন। ভাজন ডাঙার বছিরদ্দীন চৌকিদারকে অপমান করেছিল। থানার দারোগা তাকে ডেকে নিয়ে এমন করে মেরেছিল যে সেই মারের চোটেই তিন দিন পরে সে মারা গেল।”

এ সব কথা ত সবই মিনাজদ্দীর জানা! নইলে কার বাপের সাধ্য ছিল আজ আজাহেরের ঘর হইতে এমন করিয়া সব মাল লইয়া যায়। মিনাজদ্দীকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া পিয়ন আবার আরম্ভ করিল, “আমরা যে গ্রাম–ভরে এত বুকটান করে ঘুরি সে নিজের জোরে নয় মাতবর সাহেব! এই চাপরাশের জোরে। এই আওরত লোকটিকে এখনও চলে যেতে বলুন, নইলে এর মান–সম্মান আর রাখা যাবে না।”

মিনাজদী আজাহেরকে বলিল, “আজাহের! বউকে ওখান হইতে চইলা যাইতে কও। আমরা বাইচ্যা থাকতি তোমার কুনুই উপকারে আসলাম না।”

আজাহেরকে আর বলিতে হইল না। বউ আপনা হইতেই দরজা হইতে সরিয়া গেল।

শরৎ সাহার লোকেরা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া বেড়ী হইতে ভারে ভারে ধান আনিয়া ছালায় ভরিয়া গরুর গাড়ীতে তুলিতে লাগিল। হড়ী ভরা কলাই, মসুরী, বীজধান যেখানে যাহা পাইল তাহাই আনিয়া গাড়ীতে তুলিল। এই সব কাজ করিতে তাহারা ঘরের বিছানা পত্র, তৈজস, হাড়ী–পাতিল সমস্ত ছড়াইয়া একাকার করিল।

মোড়ল আজাহেরকে ডাকিয়া কহিল, “আজাহের ভাই! তুই একেবারে ছন্নছাড়া ফকির ছিলি। তোরে আমি নিজের আতে ঘর–গিরস্তালী বানায়া দিছিলাম। ভিন গেরাম হইতে বউ আইন্যা বিয়া দিছিলাম। আইজ তোর সেই যত্তনের বান্দা ঘর–বাড়ি ভাইঙা পড়ত্যাছে। ইয়া আমি আর চক্ষি দেখপার পারি না। পিয়ন সাহেব! যা করবার অয়। করেন, আমি চইল্যা গেলাম।”

এই বলিয়া চাঁদরের খেটে চোখ মুছিতে মুছিতে মিনাজদ্দী মাতবর চলিয়া গেল। শরৎ সাহার লোকেরা দশ মিনিটের মধ্যে ঘরের সমস্ত জিনিস পত্র আনিয়া গাড়ীতে তুলিল। তারপর তাহারা গাড়ী লইয়া রওয়ানা হইবে এমন সময় শরৎ সাহা বলিল, “আরে মিঞারা! তোমরা কি চোখের মাথা খেয়েছ, দেখছ না ঘরের চালে ক’খানা টিন রয়েছে, টান দিয়ে খুলে নাও।”

আজাহের শরৎ সাহার পা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, “বাবু! সব ত নিলেন। আমার মাথা গুজবার জন্যি এই টিন কয়খানা রাইখা যান। ছাওয়াল–ম্যায়া লয়া কোথায় থাকপ?”

“আরে বাপুরে! তোমার ছেলে–মেয়ের দুঃখই যদি ভাবতে পারতাম, তবে আমি শরৎ সাহা হ’তে পারতাম? পিঁপড়ায় যদি গুড় খেয়ে যায় তার মুখ টিপে সেইটুকু বার করে রাখি। সেইজন্য আমার নাম শরৎ সাহা।”

একথা মুখে বলিবার প্রয়োজন ছিল না। গ্রামের সকল লোকই তাহা জানিত। সে জন্য। তাহারা নীরব দর্শকের মতই দাঁড়াইয়া রহিল। কোন কথাই বলিতে পারিল না। শরৎ সাহার লোকেরা দেখিতে দেখিতে ঘরের চাল হইতে টিন খুলিয়া লইয়া গাড়ীতে তুলিল। তাহাদের পায়ের ধাক্কা লাগিয়া ভাতের হাঁড়ী তরকারীর পাতিল ভাঙ্গিয়া ছড়াইয়া পড়িল। আজকে। ছেলে–মেয়েগুলো যে পান্তা–ভাত খাইয়া এ–বেলাটা কাটাইয়া দিবে তাহারও উপায় থাকিল না!

সমস্ত কাজ শেষ করিয়া শরৎ সাহা আজাহেরের বাড়িতে প্রকাণ্ড এক বাঁশ পুঁতিল। তাহার মাথায় এক টুকরা কাপড় বাধা। তখন আদালতের পিয়ন পূর্বের মতই ধমকের সুরে। বলিয়া যাইতে লাগিল, “অদ্য হইতে আজাহের মিঞার বাড়ির স্থাবর–অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তিসহ মহামহিম শ্রীযুক্ত শরৎচন্দ্র সাহা, পিতা মৃত গোলকচন্দ্র সাহা ডিক্রী করিয়া ক্রোক করিলেন। এই জমিতে বাঁশগাড়ী করিয়া উপযুক্ত সাক্ষীসহ নিজের দখল সাব্যস্ত করিলেন।” সমবেত লোকেরা ভয়ে–বিস্ময়ে সেই ধমকের সুর শুনিয়া স্তম্ভিত হইয়া রহিল।

গাড়ী রওয়ানা হইল। শরৎ সাহার লোকেরা খামারের গরু দুইটিকে যখন লইয়া যাইতেছিল তখন আজাহেরের ছেলে বছির গরু দুইটির গলা জড়াইয়া ধরিয়া চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, “গরু দুইডা আমার। আমি নিবার দিমু না।”

শরৎ সাহার লোকেরা বালকের সেই কচি হাত দুইটি ঝেংটা দিয়া ছাড়াইয়া তাহাকে দূরে ধাক্কা দিয়া ফেলিয়া দিল। সে চীৎকার করিয়া কাঁদিতে লাগিল, “বাজান! দেহ আমার গরু দুইটা লয়া গেল।”

আহা! বাজানের আজ কোন সাধ্য নাই এই নরবেশী–দস্যুর হাত হইতে গরু দুইটিকে রক্ষা করে। শরৎ সাহার লোকেরা গরু দুইটির দড়ি ধরিয়া টানে, তাহারা কিছুতেই নড়ে না। মূক–বোবা এই প্রাণী দুইটি হয়ত সমস্তই বুঝিতে পারিয়াছিল। তাহাদের বড় বড় চোখ দুইটি হইতে ঝর ঝর করিয়া জল গড়াইয়া পড়িতে লাগিল। শরৎ সাহার লোকেরা গরু দুইটিকে হেলে–লাঠি দিয়া জোরে জোরে আঘাত করিতে লাগিল। গরু দুইটি তবু নড়িল না।

তাহাদের পিঠে আঘাতের পর আঘাত চলিতে লাগিল। আজাহের আর সহ্য করিতে পারিল না। হামলাইয়া কাঁদিয়া উঠিল। তারপর গরু দুইটির গলা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, “বোবাধন! অনেক কাল তোরা আমার কাছে ছিলি। কত ঠাটা–পড়া রৈদী তোগো দিয়া কাম করাইছি। প্যাট বইরা খাবার দিতি পারি নাই। আমারে মাপ করিস। আমার বাড়ি ছাইড়্যা অন্য বাড়িতে গ্যালি হয়ত বাল মত খাইবার পাইবি।” তারপর বউকে ডাকিয়া বলিল, “বউ! জনমের মত ত ওরা চলল। বাল মত পা দুইডা ধুইয়া দাও।”

বউ আসিয়া কাঁদিতে কাদিতে গরু দুইটার পা ধোয়াইয়া দিল। তারপর গলার কাছে মুখ। লইয়া আরো খানিক কাঁদিয়া আঁচলে বাধা কয়টি ধান–দূর্বা তাদের মাথায় ছড়াইয়া দিল।

তখন আজাহের নিজেই দড়ি ধরিয়া টানিয়া তাহার এত আদরের গরু দুইটিকে সে বাড়ির বাহির করিয়া দিয়া আসিল। গরু দুইটিকে যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ সে তাহাদের দিকে চাহিয়া রহিল। তারপর যখন তাহারা দূরের জঙ্গলের আড়ালে চলিয়া গেল তখন একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া সে গৃহে ফিরিয়া আসিল। এই গরু দুইটি শুধু মাত্র তার হাল বাহিবার বাহনই নয়; নিজের ছেলে–মেয়েদের মতই সে ইহাদের যত্ন করিয়াছে। তাহার পরিবারে যেমন তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে তেমনি এই গরু দুইটি। এদের সঙ্গে সে কথা কহিতে পারিত। এই বোবার ভাষাও সে হয়ত কিছু বুঝিতে পারিত। তার সকল সুখের সঙ্গে সকল দুঃখের সঙ্গে সমসুখী সমদুখী হইয়া ইহারা তাহার স্বল্প পরিসর জীবনটিতে জড়াইয়াছিল।

উঠানে ফিরিয়া আসিয়া আজাহের মাথায় হাত দিয়া ভাবিতে বসিল। কিসে কি হইয়া গেল। গাজীর গানের দলের বাদশার কাহিনীর মত নিমিষে সে পথের ভিখারী হইয়া বসিল।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x