(এগারো)

কোথা হইতে খাকি রঙের জামা পরিয়া কোমরে চাপরাশ আঁটিয়া একটি লোক আসিয়া গ্রামে প্রবেশ করিল। গ্রামের কুকুরগুলি তাহাকে ঘিরিয়া ঘেউ ঘেউ করিতে লাগিল।

কৌতূহলী গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হল্লা করিয়া কলরব করিয়া তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলিল। সেই লোকটিকে দেখিয়া গ্রামের সাবধানী লোকেরা ফিস ফিস করিয়া বলাবলি করিতে লাগিল, “আদালতের পিয়ন আসিয়াছে। তোরা পালারে পালা।”

যে যেখানে পারিল পালাইল কিন্তু সেই লুকান–স্থান হইতে সকলেই তাহার গতিবিধি লক্ষ্য করিতে লাগিল। লোকটির দাপট পদক্ষেপে সকলেরই বুক দুর দুর করিয়া কাপিতে লাগিল।

সারাদিন মাঠের কঠোর পরিশ্রম করিয়া দুপুর গড়াইয়া গেল আজাহের ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের মত ভাতের থালা সামনে লইয়া কেবল বসিয়াছে, এমন সময় সেই লোকটি তাহার বাড়ির সামনে আসিয়া কর্কশ কণ্ঠে কহিল, “এক নম্বর আসামী আজাহের বাড়িতে আছ? তোমার নামে সমন আছে।”

অমনি ভাতের থালাখানা সরাইয়া আজাহের মাচার উপর একটা ডোলের মধ্যে যাইয়া পালাইল। ইতিমধ্যে দুই চারজন ছেলে–মেয়ে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল। আজাহেরের বউ ফিস্ ফিস্ করিয়া তাহাদিগকে শিখাইয়া দিল, “কয়া দেগা বাড়ি নাই।”

পিয়নকে আর ছেলেদের বলিতে হইল না। সে বাহির হইতে শুনিয়া আরো জোরের সঙ্গে চেঁচাইয়া কহিল, “আজাহের মিঞা এক নম্বর আসামী বাড়ি নাই বলিয়া তাহার নামের সমন লটকাইয়া জারি করিলাম।”

এই বলিয়া একখানা কাগজ ঘরের বেড়ার সঙ্গে আটকাইয়া রাখিয়া সে আরো বীরত্বের সঙ্গে পা ফেলিয়া চলিয়া গেল। তাহার দাপটপদক্ষেপে সমস্ত গ্রাম কাপিতে লাগিল। তাহার চলিবার ভঙ্গী এমনই–সে যেন কোথায় একটা কি ভীষণ কাজ করিয়া ফিরিয়া চলিল। গ্রামের কুকুরগুলি ঘেউ ঘেউ করিয়া তাহার পিছন পিছন ছুটিল। পিয়ন চলিয়া গেলে বহুক্ষণ পরে লুকান–স্থান হইতে কৌতূহলী গ্রামের লোকেরা সকলে মিলিয়া আজাহেরের বাড়ির সামনে আসিয়া উপস্থিত হইল। মিনাজদ্দী মাতবরও আসিল। তাহার গলার আওয়াজ শুনিয়া আজাহেরের ধড়ে প্রাণ আসিল। সে লুকান–স্থান হইতে বাহির হইয়া আসিয়া সকলের সামনে উপস্থিত হইল। সকলেরই মুখে একই প্রশ্ন ব্যাপার কি?”

আজাহের আনুপূর্বিক সকল ঘটনা বলিল। ঘরের বেড়ার সঙ্গে লটকান কাগজখানাও দেখাইয়া দিল। মোড়ল অনেক গবেষণা করিয়াও সেই কাগজখানা যে কেন পিয়ন রাখিয়া গেল, তাহার কোন কূল–কিনারা করিতে পারিল না। গ্রামের মধ্যে বচন মোল্লা কিছু লেখাপড়া জানে বলিয়া তাহার কিছু খ্যাতি আছে। ছহি সোনাভান ও জয়গুন বিবির পুঁথি সে সুর করিয়া পড়িয়া গ্রামের লোকদের তাক লাগাইয়া দেয়। সকলে মিলিয়া স্থির করিল বচন মোল্লাকে ডাকাইয়া আনিয়া এই কাগজ পড়াইতে হইবে।

তিন চারজন লোক বচন মোল্লার কাছে ছুটিল। বচন মোল্লা গিয়াছিল ভাটপাড়ার গায়ে দাওয়াত খাইতে। সেখানে যাইয়া তাহারা শুনিল, সে সেখান হইতে গিয়াছে শোভারামপুর তার শ্বশুর বাড়ি। তখন দে ছুট শোভারামপুর বলিয়া, দুই তিন ঘন্টার মধ্যে কৌতূহলী খবরিয়ারা বচন মোল্লাকে লইয়া আসিল। ইতিমধ্যে আজাহেরের বাড়ির সামনে প্রায় পঁচশত কৌতূহলী লোক জড় হইয়াছে। বচন মোল্লা আসিলে তাহাদের মধ্যে সাড়া পড়িয়া গেল। মিনাজদ্দী মাতবর চারিদিক হইতে ভীড় সরাইয়া দিয়া মাঝখানে বচন মোল্লার জন্য জায়গা করিয়া দিল। সেখানে বসিয়া বচন মোল্লা একবার চারিদিকে তাকাইয়া সমবেত লোকগুলি দেখিয়া লইল, মনে যেন এই ভাব, সকলে মনে করে বচন মোল্লা কেউকেটা নয়; এবার দেখুক একখানা চিঠি পড়িতে প্রায় তিন মাইল দূর হইতে তাহাকে ডাকিয়া আনিতে হইয়াছে। সে ছাড়া আর কাউকে দিয়া এ কাজ হইল না।

মিনাজদ্দী মাতবর এবার তাড়াতাড়ি আজাহেরের বেড়ায় লটকান কাগজখানা আনিয়া বচন মোল্লার হাতে দিল। “পড়েন ত মোল্লাজী। এতে কি লেইখাছে?” মোল্লাজী কাগজখানা হাতে লইয়া বেশ নাড়িয়া চাড়িয়া খানিকক্ষণ পড়িবার অভিনয় করিয়া তারপর হাতের গামছাখানা দিয়া মুখ মুছিয়া আবার চারিদিকে চাহিয়া বলিল, “একটু তামুক খাওয়াও।”

অমনি চারি পাঁচজন লোক তামাক সাজিতে ছুটিয়া চলিল। অনেকক্ষণ তামাক টানিয়া কুণ্ডলী করিয়া নাকে মুখে ধূম বাহির করিয়া মোল্লাজী আবার কাগজখানা লইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল।

পড়িয়া পড়িয়া মোল্লাজী বড়ই ক্লান্ত হইয়া পড়িল। তাহার সমস্ত মুখে ঘাম বাহির হইল। সেই ঘাম গামছা দিয়া মুছিয়া আবার পড়িতে আরম্ভ করিল।

মিনাজদ্দী মাতবরের আর ধৈর্য থাকে না। সে মোল্লাজীর দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়া বলিল, “কি পড়লেন মোল্লাজী? কন শীগগীর?”

মোল্লাজী এবার সুর করিয়া সমবেত লোকদিগকে শুনাইয়া পড়িতে লাগিল, “এতে লেইখাছে, ইবার পিয়াইজির দাম পাঁচসিকা মণ, মুরগীর আণ্ডার দাম দুইআনা করিয়া কুড়ি, তামুক পাতার দাম আধা পয়সা, কাঁচা মরিচের দাম তিন পয়সা সের।”

আজাহের আগাইয়া আসিয়া বলিল, “আরে মোল্লাজী! আপিনি ত কোন জিনিসের কি। দাম পইড়া যাইতেছেন। কিন্তুক পিয়ন যে কয়া গ্যাল, আজাহের মিঞা এক নম্বর আসামী বাড়িতি নাই বইলা সমন লটকাইয়া জারি করলাম। সেই যে আমি আসামী ওইলাম, কোন মোকদ্দমার? বালা কইরা পড়েন?” মোল্লাজী একটু বিরক্ত হইয়া আজাহেরের মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, “আরে রাখ মিঞা! আমি আসছি তোমার কতায়। ইয়ার আদি–অন্ত সগল কথাইত পড়তি অবি। আর পড়বই বা কি? তোমারে আসামী দিছে, তাতে কি ঐছে? তোমার ত দেখা পায় নাই। ঘরের বেড়ার সাথে কাগজ লটকাইয়া গ্যাছে। ওই বেড়ায়ই এটা লটকাইয়া থোও। যদি আসামী অয় ত ঘরের বেড়াই অবি।”

মোড়লও এই যুক্তিটি পছন্দ করিল। সরল মনে সকলেই বুঝিল কাগজ যখন পিওন কাহারও হাতে দেয় নাই, ঘরের বেড়ায় লটকাইয়া রাখিয়া গিয়াছে সুতরাং আজাহেরের এ জন্য ভয় করিবার কোনই কারণ নাই। সকলে পরামর্শ করিয়া কাগজখানা বেড়ার যে স্থানে। লটকান ছিল সেই স্থানেই উহা আবার লটকাইয়া রাখিল। বচন মোল্লা সসম্মানে ঘরে ফিরিয়া গেল।

দিনের পরে দিন চলিয়া যাইতে লাগিল। খেত–খামারের কাজে ঘরের বাহির হইতে বেড়া গোজা সেই কাগজের টুকরাটির দিকে চোখ পড়তেই কি যেন আশঙ্কায় আজাহেরের অন্তরটি দুরু দুরু করিয়া কাপিয়া উঠে। রাত্রে বিছানায় শুইয়া শুইয়া আজাহেরের ঘুম আসে না। সেই কাগজের টুকরাটি হিংস্র অজগর হইয়া যেন তাহাকে কামড়াইতে আসে।

কোন কোন দিন আজাহের রাত্রে আধ–তন্দ্রায় স্বপ্ন দেখে, তাহার শিশু পুত্রটি কোলের উপর বসিয়া খেলা করিতেছে। হঠাৎ সেই কাগজের টুকরাটি প্রকাণ্ড একটা হা করিয়া আসিয়া তাহার সেই শিশু পুত্রটিকে গ্রাস করিয়া ফেলিল। চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিয়া আজাহের কোলের ছেলেটিকে বুকের মধ্যে জড়াইয়া ধরে। বউ অবাক হইয়া ভয় পাইয়া জিজ্ঞাসা করে, “কও ত তোমার ওইল কি? এমন কইরা কাইন্দা উঠলা ক্যান?”

আজাহের বলে, “কিছু না বউ! তুমি ঘুমাও।” কিন্তু উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনের ধারায় তাহার সমস্ত বুক ভিজিয়া যায়।

এই সমস্ত চিন্তার হাত হইতে আজাহের একেবারে রেহাই পায় যখন তাহার শিশু পুত্রটি আধ আধ স্বরে তাহাকে বাজান বলিয়া ডাকে। ছোট ছোট পা ফেলিয়া উঠানের এ–ধারে ওধারে ঘুরিয়া বেড়ায়। আজাহের তাহাকে কাঁধে করিয়া মাঠে লইয়া যায়।

“এ খেত আমার। ও খেত আমার।” নিজের সবগুলি ফসলের খেত আজাহের ছেলেকে দেখায়। মাঠের ফুল কুড়াইয়া ছেলের হাতে দেয়। আজাহের ছেলের জন্য কি যে করিবে আর কি যে না করিবে!

কত গ্রাম্য–ছড়াই সে ছেলেকে শিখাইয়াছে। ছেলেকে কোলে করিলে তাহার মুখ যেন ছড়ার ঝুমঝুমি হইয়া বাজিতে থাকে।

আজাহেরের হালের বলদ দুইটিকে দেখিয়া ভয় না করে এমন লোক পাড়ায় খুব কমই। আছে। কিন্তু আজাহেরের এতটুকুন শিশু পুত্রটির কাছে গরু দুইটি যেন একেবারে নিরীহ। সে তাহাদের শিং ধরিয়া ঝকে, লেজ ধরিয়া যখন তখন টানাটানি করে, গরু দুইটি তাহাকে কিছুই বলে না। প্রতিদানে গরু দুইটি যতক্ষণ বাড়ি থাকে সব সময়ই সে তাহাদিগকে কলার খোসাটি, কচি ঘাসের ছোট গুচ্ছটি, আরো কত কি আনিয়া খাইতে দেয়।

গরু দুইটি যখন পেট ভরিয়া খাইয়া ঘুমাইতে থাকে সেও তখন তাহাদের গলা জড়াইয়া ধরিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। কতদিন তাহার মা আসিয়া তাহাকে এমন ঘুমন্ত অবস্থা হইতে তুলিয়া লইয়া গিয়াছে। বাড়িতে নূতন কেহ আসিলে সে তাহাকে টানিয়া লইয়া গরু দুটিকে দেখায়। আর সগর্বে ঘোষণা করে, এই গরু দুটি তাহার নিজের।

ইতিমধ্যে আজাহেরের আরো একটি মেয়ে জন্মিল। সদ্যজাত শিশু বোনটি আজাহেরের ছেলের একটি আশ্চর্য রকমের খেলনা হইয়া দাঁড়াইল।

সে যখন আধ আধ সুরে তাহাকে ভাই বলিয়া ডাকিতে শিখিল তখন তাহার মনে কি যে খুশী! বোনকে কি খাওয়াইবে, কোথা হইতে কি আনিয়া দিবে, গহন–দুর্গম বনের অন্তরাল হইতে কাউয়ার হুঁটির ফল, কাটা গাছের আগডাল হইতে ডুমকুর, আরো কত কি আনিয়া সে বোনের সামনে জড় করে।

আজাহের ছেলের নাম রাখিয়াছে বছির’ আর তার মেয়ের নাম রাখিয়াছে বড়। আজাহেরের ছেলে বছির শেষ রাত্রেই জাগিয়া উঠে। বাপ মা দুই পাশে এখনও ঘুমাইয়া।

ছোট বোন বড়, সেও মায়ের বাহু জড়াইয়া ঘুমাইতেছে–সামনের আমগাছটি হইতে টুপ টুপ করিয়া আম পড়িতেছে। বছিরের বুক তারই তালে তালে নাচিয়া উঠিতেছে, কখন সকাল হইবে–দুইহাতে ধাক্কা দিয়া রাতের আঁধার যদি সরাইয়া দেওয়া যাইত। সামনের কলাগাছের পাতার উপরে শিশির–ফোঁটা পড়ার শব্দ কানে আসিতেছে।

ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়া চোখ পাতিয়া সে বসিয়া আছে, আর কেহ আসিয়া পাকা আমগুলি কুড়াইয়া লইয়া না যায়।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x