(দশ)
সেদিন আজাহের মাঠ হইতে এক আঁটি ঘাস মাথায় করিয়া বাড়ি আসিতেছে, দুর হইতে শুনিতে পাইল তাহার ঘরে ছোট শিশুর ক্রন্দন। এমন সুর যেন আজাহের কোনদিন শোনে নাই। শিশুর মিষ্টি কান্না যেন আজাহেরের সকল অন্তরখানি ধীরে ধীরে দোলা দিতেছিল। আজাহের যা ভাবিতেছে তা যদি সত্য সত্যই সত্য হয় তবে যে আজাহেরের ভারি লজ্জা করে, সে কেমন করিয়া ঘরে যাইবে। আজাহের ঘাসের বোঝাটি মাটিতে নামাইয়া খানিক আওগাইয়া যায়–আবার দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কান পাতিয়া শোনে। আজাহেরের কুঁড়ে ঘরখানি ভরিয়া শিশু–কণ্ঠের কান্নার সুর যেন চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িতেছে। মনের খুশীতে আজাহের আরো খানিক আওগাইয়া যায়। আবার দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া সেই কান্না শোনে। কিন্তু তার যে ভারি লজ্জা করিতেছে। কেমন করিয়া সে ঘরে যাইবে! কিন্তু কি এক অপূর্ব রহস্য যেন তাকে রশি বাধিয়া বাড়ির দিকে লইয়া যাইতে চাহে। দু এক পা যায় আজাহের আবার দাঁড়ায়।
শিশু–কণ্ঠের মিষ্টি কান্নায় সমস্ত দুনিয়া ভরিয়া গেল। এবার বুঝি সেই সুর খোদার। আরশ পর্যন্ত ধাওয়া করিবে, আর আজাহের স্থির থাকিতে পারে না। আস্তে আস্তে যাইয়া। তার ঘরের পিছনে কচুগাছগুলির মধ্যে লুকাইয়া লুকাইয়া শিশুর কান্না শোনে। ঘরের মধ্যে মিনাজদ্দী মাতব্বরের বউ আসিয়াছে। পাড়া হইতে আরো দুচার জন স্ত্রীলোক আসিয়াছে। উঠানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কৌতূহলী দৃষ্টি লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। এত লোকের মধ্যে আজাহের কেমন করিয়া ঘরে যাইবে? তাহার লজ্জা যেন শতগুণ বাড়িয়াছে। এমন সময় শিশুর নাড়ি কাটার জন্য বাঁশের নেইলের সন্ধানে আসিয়া মিনাজদ্দী মাতবরের বউ আজাহেরকে সেই কচুগাছের জঙলের মধ্যে আবিষ্কার করিল।
“ওমা, আজাহের! তুমি এহ্যানে পালায়া রইছ, তোমার যে পুলা ঐছে।”
আজাহের তাড়াতাড়ি কচুগাছের আড়াল হইতে উঠিল–বলিল, “য়্যা–পুলা ঐছে। কিন্তুক আমার যে ভারি সরম লাগে!” বাড়ির ভিতরে মেয়েরা খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। ছোট ছোট ছেলের দল আসিয়া আজাহেরকে ঘিরিয়া ফেলিল। “ও আজাহের চাচা! তোমার পুলা ঐছে।”
“যা! যা! ভারি একটা ইয়া পাইছস তোরা? আমার যে সরম লাগে? তা বুঝতে পারস না।”
ঘোমটার ভিতর থেকে মিনাজদ্দী মাতবরের বউ বলিল, “তা সরম করলি চলবি না। আমাগো ক্ষীর খাওয়াইতি অবি।”
“তা ক্ষীর খাইবা বাবি! তাতে ত আমার আপত্তি নাই। আমি এহনই পাঁচ স্যার কুসাইরা মিঠাই আর দশ স্যার আতপ চাইল কিন্যা আনতাছি–কিন্তুক–” আর বলিতে হইল না। একজন বর্ষীয়সী স্ত্রীলোক পোটলার মত আজাহেরের সেই শিশু পুত্রটিকে আনিয়া তার সামনে ধরিল।
“দেহ আজাহের! তোমার কি সুন্দর ছাওয়াল হইছে!” খুশীতে আজাহেরের নাচিতে ইচ্ছা করিতেছিল। মুখে শুধু বলিল, “আমার যে সরম লাগে ইয়া তোমরা কেওই বুঝবার পার না।” বাড়ি ভরা মেয়ের দল তখন হাসিয়া গড়াইয়া পড়িতেছিল! আজাহের তাড়াতাড়ি কোমরে গামছা বাঁধিয়া কুসুরে গুড় কিনিবার জন্য বন্দরে ছুটিল।
নতুন শিশু পুত্রটি লইয়া আজাহের আর তার বউ বড়ই মুস্কিলে পড়িল। বাড়িতে বর্ষীয়সী কোন স্ত্রীলোক নাই। কেমন করিয়া শিশুকে দুধ খাওয়াইতে হইবে, কেমন করিয়া তাহাকে স্নান করাইতে হইবে, কিভাবে তাহাকে কোলে লইতে হইবে, কোন সময় কিভাবে শিশুকে শোয়াইলে তাহাকে ডাইনীতে পায় না এসব খবর তাহারা কেহই জানে না। আনাড়ী মাতা শিশুকে দুধ খাওয়াইতে যাইয়া তার সমস্ত গায় দুধ জড়াইয়া দেয়, স্নান করাইতে শিশুর নাকে মুখে জল লাগে, সর্দি হয়। বেশী দুধ খাওয়াইয়া শিশুর পেটে অসুখ করে।
দৌড়াইয়া যায় আজাহের রামে–রাজের বাড়ি। তুক–তাবিজের অলঙ্কারে শিশুর সকল অঙ্গ ভরিয়া যায়। পাড়া–প্রতিবেশীরা শিশুর ভালোর জন্য যে বিধান দেয় দুইজনে অক্ষরে অক্ষরে তাহা পালন করে। এইভাবে শিশু দিনে দিনে বাড়িতে থাকে।
এখন তাহারা ঠেকিয়া ঠেকিয়া অনেক শিখিয়াছে। রাত্রে বাহির হইতে আসিয়া ‘শিশুর ঘরে প্রবেশ করিলে শিশুকে প্রেতে পায়! নিমা–সামের কালে শিশুকে বাহিরে আনিলে তাহার বাতাস লাগে। বাতাস লাগিয়া পেটে অসুখ করে। ডাইনী আসিয়া শিশুর সঙ্গে কথা কহিতে চেষ্টা করিলে তাহার জ্বর চমকা লাগে। এ জন্য সাবধানও তাহারা কম হয় নাই।
ঘরের দরজার পাশে একটা মরা–গরুর মাথার হাড় লটকাইয়া রাখিয়াছে। ডাইনীরা তাহা দেখিয়া পালাইয়া যাইবে। কে কখন শিশুকে দেখিয়া নজর দেয়, বলা যায় না ত? সকলের চোখ ভাল না। তাহাতে শিশু রোগা হইয়া যাইতে পারে। উঠানের এক কোণে বাশ পুঁতিয়া তাহার উপরে রান্নাঘরের একটি ভাঙ্গা হাড়ী বসাইয়া রাখিয়াছে। ছেলের দিকে নজর লাগাইলে সেই নজর আবার যদি সেই কালো হাঁড়ীর উপর পড়ে তবে আর তাহাতে ছেলের কোন ক্ষতি হইবে না। ছেলের যাহাতে সর্দি না লাগে সেই জন্য তাহার গলায় একছড়া রসুনের মালা পরাইয়া দেওয়া হইয়াছে।
শেষ রাত্রে শিশু জাগিয়া উঠিয়া হাত পা নাড়িয়া খেলা করিতে থাকে। শিশুর খলখলানিতে বাপ মায়ের ঘুম ভাঙিয়া যায়। ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিয়া শেষ রাত্রের চাঁদ আসিয়া শিশুর মুখের উপর পড়ে। আজাহের আর তার বউ দুইজনে শিশুর দুই পাশে বসিয়া নীরবে চাহিয়া থাকে। কেউ কোন কথা কয় না, তাদের বুকের যত কথা যেন মূর্তি ধরিয়া ওই শিশুর হাসির রঙে ঝলমল করিয়া তাহার নরম ননির মত হাত পাগুলির দোলার সঙ্গে দুলিয়া সেই এতটুকুন দেহখানি ঘিরিয়া যেন টলমল করিতে থাকে।
দুইজনে দুই পাশে বসিয়া কেবলই চাহিয়া থাকে। নিকটে–দূরে আমবাগান হইতে কোকিলগুলি আড়াআড়ি করিয়া ডাকিতে থাকে। স্কুব স্কুব করিয়া কানাকুয়া ডাকে। আকাশের কিনারায় তারাগুলি সারি বাধিয়া ঝিকমিক করে।
.
আজাহের আর তার বউ শিশুর মুখের পানে চাহিয়া নীরবে বসিয়া থাকে। দেখিয়া দেখিয়া আবার দেখিয়া সাধ মেটে না। ।
আকাশের তারাগুলি ভাঙ্গা ঘরের ফাঁক দিয়া উঁকি মারিয়া চায়। কলা পাতার আড়াল হইতে এক ফালি চাঁদ আসিয়া শেষ রাতের উতল বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মুখে নৃত্য করে।
ওরা কি তাদের শিশুটিকে কাড়িয়া লইয়া যাইবে না কি? না না না। তারার সঙ্গে ‘তারা’ হইয়া কতকাল তাদের এই শিশুটি আকাশ ভরিয়া খেলা করিয়া বেড়াইয়াছে। চাঁদের সঙ্গে চাঁদ হইয়া সারা আকাশ ভরিয়া সে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছে। বাঁশী বাজাইয়া সেই চাঁদকে আজাহের ঘরে টানিয়া আনিয়াছে। আজ আকাশ ছাড়িয়া তাই তার ঘরের চাঁদকে দেখিতে আসিয়াছে। চাষার ছেলে আজাহের অতশত ভাবিতে পারে কিনা কে জানে!
কিন্তু এই শিশু পুত্রটির মুখের পানে চাহিয়া চাহিয়া সে যাহা ভাবিতেছে তাহা আকাশের তারার চাইতে ঝলমল করে, আকাশের চাঁদের চাইতে ঝিকমিক করে।
ছেলের মুখের পানে চাহিয়া দেখিতে দেখিতে আবার দেখিতে রাত শেষ হইয়া যায়। তাদের ঐ শিশুটির মত আর একটি শিশুরবি পূব আকাশের কিনারায় হাসিয়া হাসিয়া রঙীন হইয়া উঠে।
প্রভাতের নতুন আলোয় আজাহের বউ–এর মুখের দিকে তাকায়।
রাঙা প্রভাতের মত লজ্জায় রাঙা হইয়া বউ আজাহেরের দিকে তর্জনী ক্ষেপণ করিয়া বলে, “যাও!”
আজাহের তাড়াতাড়ি উঠিয়া লাঙল লইয়া খেতে ছোটে। বউ ঘর–গেরস্থালীর কাজে মনোযোগ দেয়।
“বোবা কাহিনী” উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ