(চৌদ্দ)
চাহিয়া চিন্তিয়া আর কয় দিন কাটান যায়? তবু যে তিন চার দিন আজাহেরের কি করিয়া কাটিয়া গেল তাহা সে–ই জানে। গ্রামে কাহারও অবস্থা ভাল নয়। ইচ্ছা থাকিলে তাহারা সাহায্য করিতে পারে না। বড় আদর করিয়া আজাহের মেয়েটিকে একগাছি রূপার গোটছড়া কিনিয়া দিয়াছিল। সেইটি কি মেয়ে মাজা হইতে খুলিয়া দিতে চায়? অনেক বলিয়া কহিয়াও যখন কিছু হইল না তখন জোড় করিয়া আজাহের সেই গোটছড়া মেয়ের কোমর হইতে খুলিতে যাইয়া তাহা ছিঁড়িয়া ফেলিল। পীর সাহেবের নিকট হইতে ছেলের ভাল–ভালাইর জন্য আজাহের তাহার হাতে একটি রূপার তাবিজ কিনিয়া দিয়াছিল। সেটিও খুলিয়া লইতে হইল। কিন্তু এইভাবে আর কয়দিন কাটান যায়? নিজেদের কথা না হয় নাই ভাবিল, কিন্তু রাত্র প্রভাত হইলেই যে ছেলে–মেয়ে দুইটি ভাত ভাত করিয়া কান্না। চড়ায়, তারপর কঁদিতে কঁদিতে হয়রান হইয়া দুই ভাই–বোন গলাগলি ধরিয়া ঘুমাইয়া পড়ে। দুপুরের বেলা জাগিয়া উঠিয়া আবার ভাত ভাত করিয়া কাদিতে থাকে। এইভাবে আর কতদিন চলা যায়?
আজাহের খবর পাইল, এখান হইতে বিশ মাইল দূরে তাম্বুলখানা গ্রাম। সেখানে অনেক জমি পড়িয়া রহিয়াছে। চাষ করিবার কৃষাণ নাই। সেখানে গেলে জন খাঁটিয়া আজাহের কোন রকমে ছেলে–মেয়ের পেট ভরাইতে পারিবে। প্রথমে সে এ বিষয়ে মিনাজদ্দী মাতবরের সঙ্গে পরামর্শ করিল। মাতবর বলিল, “সেই জঙলা জায়গায়, নদীর দ্যাশের লোক, তোমরা কেমন কইরা থাকপা। হুনছি সেহানে মানষীর জ্বর–জারি লাইগাই আছে।”
আজাহের বলিল, “এহানে থাইকা ত মরণ। জন–কিষাণি খাটপ, তাও কেউ খাটাইবার চায় না।”
মোড়ল বলে, “আজাহের! যা করবি কর। জিজ্ঞাস কইরা শুধু আমারে কান্দাইবারই পারবি। আমি যদি পারতাম, তোরে কি এই গিরাম ছাড়বার দিতামরে?”
আজাহের বলে, “মোড়লসাব! আমাগো জন্যি আপনি বহু কষ্ট করছেন, এইবার গ্রাম ছাইড়া যাওনের দিন–খান ঠিক কইরা দ্যান।”
মোড়লের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া আজাহের যাইবার দিন স্থির করিয়া ফেলিল। মোড়ল বলিল, “আজাহের! হেই দ্যাশে যদি যাবিই, সেহানের গরীবুল্লা মাতবরের বাড়ি যাইস। তানি আমার বিয়াই। আমার কতা কইলি তোরে খাতির করবি।”
আজাহের খুঁটিয়া খুঁটিয়া গরীবুল্লা মাতবরের সব কিছু জানিয়া লইল। নির্দিষ্ট দিনে কিছু পান্তা–ভাত খাইয়া তাহারা রওয়ানা হইবার জন্য প্রস্তুত হইল। সঙ্গে মোট–বহর কিছুই। নাই। বউ–এর কোলে মেয়েটি, আজাহেরের কোলে ছেলেটি। ছেলেটিকে কোল হইতে নামাইয়া আজাহের উঠানের উপরে কয়টি ধান ছড়াইয়া তাহার উপর একটি সালাম জানাইয়া সে আর একবার ভালমত সমস্ত বাড়িখানি দেখিয়া লইল। আজ বাড়ির প্রতিটি জিনিস যেন তাহার সঙ্গে বিদায় সম্ভাষণ করিতেছে। এখানে বউ লাল–নটে খেত করিয়াছে। রঙের পাতা মেলিয়া যেন খেতখানি নক্সী করা কাঁথার মত ঝলমল করিতেছে। ওইখানে শশার জাঙলা। হলুদ রঙের ফুলে সমস্ত জাঙলা হাসিতেছে। তারই পাশে শ্রীচন্দনের লতা যেন তাহাদের স্বল্প পরিসর ক্ষুদ্র চাষী–জীবনের সমস্ত স্নেহ–মমতা লইয়া জীবন্ত হইয়া উঠিয়াছে। এগুলি ছাড়িয়া যাইতে কি মন চায়?
তাহাদিগকে বিদায় দিতে মোড়ল আসিয়াছে, মোড়লের বউ আসিয়াছে। আজাহেরের বউ মোড়ল–গিন্নীর গলা জড়াইয়া ধরিয়া কহিল, “বুবুগো! এই সোনার সংসার ছাইড়া আমরা বনবাসে চলোম। আমাগো কতা মনে রাইখ।” মোড়ল–বউ তাহার গলা জড়াইয়া ধরিয়া নীরবে কাঁদিতে লাগিল। আজাহেরের বউ বলিল, “বুবুগো! এইখানে কন্যে–সাজানী সীমের গাছ বুনছিলাম। আইজ লালে নীলে রঙীন পাতায় আমার সমস্ত জাঙলা ভইরা গ্যাছে। আর কয়মাস পরেই নীলা রঙের সীমে সমস্ত জাঙলা ছায়া যাবি! তহন আয়া তুমি এই সীম পাইড়া নিও। আর আমার মত মন্দ–ভাগিনীর কতা মনে কইর। আর শোন বুবু! এই যে বরবটির চারা ঐছে না? আমার ম্যায়াড়া বড় যত্তনে উয়ারে বুনছিল, পানি না দিলি ওরা শুহাইয়া যাবি। তুমি আইসা মদ্দি মদ্দি ওগো গোড়ায় একটু। পানি ঢাইলা দিও।”
মোড়ল–গিন্নী শুধু নীরবে কাঁদিতে লাগিল। বউ আবার তাহাকে বলিতে লাগিল, “বুবুগো। আমার সোনার গরু দুইডারে লইয়া গ্যাছে। ওগো আমি নিজির পুলাপানগো মতই যত্তন করতাম। বাস্যা গণ্ডা দিনে গাস পাত পাওয়া যায় না। তাই সারা বচ্ছর বইরা কুঁড়া পুঁজি কইরা রাকছিলাম। এই কুঁড়ায় আমার কি অবি? তুমি লইয়া যাও, তোমাগো গরুগুলিরে খাওয়াইও।”
মোড়ল–বউ আজাহেরের স্ত্রীর মাথার চুলগুলিতে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল, “বউ! এতটুকু তুই এখানে আইছিলি। তারপর পোলা ঐল–ম্যায়া ঐল। তোর গরের কলরব শুইনা আমার পরাণ জুড়াইত। আইজ যে তুই বনবাসে চললি, তোর এই ভিটা শূন্য পইড়া খা খা করব। আমি রইলাম পোড়া কপালী তাই দেখপার জন্যি।”
মোড়ল কান্না রাখিতে পারিল না। কাঁধের গামছার খোট দিয়া চোখ মুছিতে লাগিল। মোড়ল–গিন্নী তার আঁচল হইতে কয়েকটি বীজ বাহির করিয়া আজাহেরের বউকে দিতে দিতে বলিল, “বউ! হুনছি, সেই বন–জঙলের দ্যাশে কিছুই পাওয়া যায় না। এই চালকুমড়ার বীজ কয়টা দিলাম, কোনোখানে বুইনা দিস। সেই গাছে যহন চালকুমড়া ধরবি তখন তোর এই বুবুরে মনে করিস। আর এই সোয়া স্যার কুসুম ফুলের বীজ দিলাম। আজাহেররে কইস মাঠে যেন বুইনা দেয়। চৈত্র মাসে রঙীন অয়া যহন কুসুম ফুল ফুটবি, তহন সেই ফুল দিয়া তোর মায়ার শাড়ী খানা রাঙা কইরা দি।”
.
ধীরে ধীরে রোদ হইয়া আসিতে লাগিল। গ্রামের বহুলোক আজাহেরের উঠানে আসিয়া জড় হইল। আজাহের আগে জানিত না, তাহারা তাহাকে এত ভালবাসে। আজ বিদায়ের দিন তাহাদের সকলের গলা জড়াইয়া ধরিয়া তাহারা কাদিতে ইচ্ছা করিতেছে। নিজে কাঁদিয়া সকলকে কাঁদাইয়া আজাহের তার স্ত্রী–পুত্র লইয়া সুদুর তালখানার পথে রওয়ানা হইল। গ্রামের স্ত্রী, পুরুষ, ছোট ছেলে–মেয়ে, প্রায় পঞ্চাশজন বহুদূর পর্যন্ত তাহার সঙ্গে সঙ্গে আসিল। সেই ইদু মল্লিকের তালতলা, সোনাডাঙার বড় বটগাছ, হদু। বেপারীর তালাপ ছাড়িয়া আসিতে আজ কোথাকার কান্নায় আজাহেরের সমস্ত অন্তর ভাঙিয়া যাইতে চাহে। এরাও যে জীবন্ত হইয়া এতদিন তাহার জীবনের সুখের দুঃখের সাথী হইয়াছিল। আজ বিদায়ের বেলা সেই কথাটি আজাহেরের বড় করিয়া মনে পড়িতেছে। কারিকর পাড়ার মোড়ে আসিলে রহিমদ্দী কারিকর আগাইয়া আসিয়া আজাহেরের হাত জড়াইয়া ধরিল, “আজাহের! তুমি তবে চললা?” কারিকরের পায়ে সালাম জানাইয়া আজাহের বলিল, “তোমরা দুয়া কইর চাচা।”– রহিমদ্দী বলে, “আজাহের! বাবছিলাম তোমার যাওনের বেলা আমি দেহা করব না। দুইডা বাতের অভাবেই যে তুমি দ্যাশ ছাইড়া চললা, আমরা তোমারে খাওয়ায়া রাখপার পারলাম না, আল্লা আমাগো এত বদনসীব করছে, সেই জন্যিই আমি পলাইয়াছিলাম। কিন্তু তোমার চাচী হুনল না। এই মশারীখানা নিয়া যাও। হুনছি সেই দ্যাশে ভারী মশার উৎপাত। টানায়া তোমার পুলাপানগো লয়া শুইও। এইডি দিবার জন্যি তোমার চাচী আমারে পাঠাইছে।”
মশারীখানা গামছায় বাঁধিতে বাঁধিতে আজাহের বলিল, “কারিকর চাচা! আর চিরজনমে তোমার গীদ হুনতি পারব না।”
রহিমদ্দী বলিল, “তুই ভাবিস না আজাহের! তাম্বুলখানার আটে আমি কাপড় বেচতি যাব। একদিন তোর ওহানে রাত্রির থাইকা গীদ হুনায়া আসপ।”
গাঁয়ের সব চাইতে বৃদ্ধা কেদারীর মা ভাল করিয়া হাঁটিতে পারে না। তবু আজাহেরকে বিদায় দিতে এত পথ আসিয়াছে। সে আগাইয়া আসিয়া আজাহেরের বউ–এর আঁচলখানি টানিয়া লইয়া বলিল, “বউ! আমি বিধবা মানুষ, আমার ত আর কিছুই নাই। এই মুড়ি চারডা আঁচলে বাইন্দা দিলাম। পথে পুলা–ম্যায়াগো খাইতি দিস।”
এমন সময় মেয়ে–পুরুষ, সমবেত গাঁয়ের লোকদের মোড়ল বলিল, “তোমরা অনেক দূর পর্যন্ত আইছ, আর যায়া কাম নাই। রইদ উইঠা আইল। ওগো তাড়াতাড়ি যাবার দাও।”
আজাহের সকলের দিকে আর একবার ভাল মত চাহিয়া বউকে সঙ্গে করিয়া জোরে জোরে পথ চলিতে লাগিল। গ্রামের লোকেরা নীরবে দাঁড়াইয়া যতক্ষণ তাহাদের দেখা যায় ততক্ষণ অগেক্ষা করিয়া ধীরে ধীরে যার যার বাড়িতে চলিয়া গেল।
আজাহের জোরে জোরে পথ চলিতেছে। একটা ছোট বিড়াল ম্যাঁও ম্যাঁও করিয়া তাহাদের পিছনে পিছনে আসিতে লাগিল। তাহার করুণ কান্না শুনিয়া আজাহেরের মেয়েটি মার কোল হইতে আধ আধ সুরে বলিল, “বাজান! আমার বিলাইডারে লইয়া যাব–ওডারে আমার কোলে দাও।”
এত দূরের পথ। ছেলে–মেয়ে দুটিকে কোলে লইয়া যাওয়াই অসম্ভব। আবার বিড়ালটিকে কেমন করিয়া তাহারা লইয়া যাইবে। কিন্তু কিছুতেই বিড়ালটি পিছন ছাড়ে না। কোলের মেয়েটিও বিড়ালটির জন্য কাঁদে। আজাহের একটা লাঠি লইয়া বিড়ালটিকে আঘাত করিল। ম্যাঁও ম্যাঁও কান্নায় বিড়ালটি পাশের বনে যাইয়া লুকাইল। তারপর আর তাহার কান্না শোনা গেল না।
“বোবা কাহিনী” উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ