কোনও কার্য-কারণ সম্পর্ক ছাড়াই মানসিক কারণে শারীরিক অসুস্থতাকে বলে হিস্টিরিকাল নিউরোসিস—কনভারসন টাইপ।

এই রোগের খোঁজ পাওয়া যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। যুদ্ধরত সেনাদের অনেকেই দৃষ্টি হারায়, শ্রবণশক্তি হারায়, স্মৃতি হারায়।

ডাক্তাররা এর কোনো কারণ খুঁজে পাননি, কারণ, চোখ, কান ঠিক ছিল। রোগীদের পাঠান হয় মনোবিদ ও মনোচিকিৎসকদের কাছে। তাঁরা দীর্ঘ পরীক্ষার পর মত দেন যে—এইসব রোগের কারণ মস্তিষ্ক কোষ। রোগী সেনাদের মন বীভৎস হত্যার ব্যাপকতা সহ্য করতে পারেনি। তারা এত হত্যা-রক্ত দেখতে চাইছিল না, ট্যাঙ্ক, বোমা, বন্দুকের অনবরত শব্দ শুনতে চাইছিল না, যুদ্ধের ভয়ংকর স্মৃতি ধরে রাখতে চাইছিল না। এই না চাওয়ার তীব্র আকুতি থেকেই তারা দৃষ্টি, শ্রবণশক্তি ও স্মৃতি হারিয়েছে ।

মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময় কিছু ছাত্র-ছাত্রীর আঙুল শক্ত হয়ে যায়, কলম ধরার অবস্থায় থাকে না। পরীক্ষাভীতি থেকে এমন ঘটনা ঘটে। এইসব ক্ষেত্রে মনোবিদদের সাহায্য নিলে সমস্যা থেকে মুক্তি মেলে।

 

আংজাইটি নিউরোসিস (Anxiety neurosis) উৎকণ্ঠা

কিছু মানুষ আছে সব সময় বাড়তি টেনশনে ভোগে। সব কিছুতেই উৎকণ্ঠা।

চাকুরে ছেলে অফিস থেকে যখন ফেরে, তার আধঘণ্টা আগে থেকেই মা’র উৎকণ্ঠা শুরু হয়। বাড়ি থেকে বাস স্ট্যান্ড দশ মিনিটের পথ। মা আধঘণ্টা আগে থেকেই বাড়ি ও বাসস্ট্যান্ড যাতায়াত করতে থাকেন। এদের উৎকণ্ঠা সবেই।

ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে কেউ বারবার হিসি করে, পটি করে। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, ট্রান্সফার অর্ডার পেলেই হাঁপানি প্রবলভাবে আক্রমণ করে। এমন বহু রকম উৎকণ্ঠা আছে। এসব ক্ষেত্রে মনোবিদ ও মনোরোগ চিকিৎসক একসঙ্গে কাজ করতে পারেন। আবার মনোবিদ অনেক সময়ই রোগীকে রোগমুক্ত করতে পারেন । কিন্তু শুধুমাত্র ওষুধ দিয়ে এইসব অসুখ সারিয়ে তোলা প্রায় অসম্ভব।

মনে রাখতে হবে উৎকণ্ঠা বা আংজাইটি বহু রোগের কারণ। হার্ট, লাংস, পেশির খিঁচুনি, ঘাড় ও পিঠ ব্যথা, অনিদ্রা, পেটের গোলমাল, কোষ্ঠকাঠিন্য, আলসার, বুক ধড়ফড়, কামশীতলতা, পুরুষত্বহীনতা ইত্যাদি এক বা একাধিক অসুখের সম্ভাবনা থাকে।

 

আতঙ্ক (Phobia) বা (Phobic neurosis)

ফোবিয়া হল যুক্তিহীন আতঙ্ক। অহেতুক আতঙ্ক। কেউ আরশোলা দেখে আতঙ্কিত হয় তো কেউ কুকুর, বিড়াল, টিকটিকি, সাপ দেখে আতঙ্কিত হয়। কেউ বাসে, ট্রামে, ট্রেনে বা লিফটে চড়তে ভয় পায়, কেউ উঁচু জায়গায় উঠলে ভয় পায়, কেউ ফাঁকা মাঠে ভয় পায়, কেউ একা থাকতে ভয় পায় তো কেউ রক্ত দেখে জ্ঞান হারায়, কেউ অন্ধকারকে ভয় পায়, কেউ ভিড়ে ভয় পায়, কেউ আগুনে ভয় পায়, তো কেউ জলে।

এসব ক্ষেত্রে সেরা চিকিৎসা সম্মোহনের সাহায্যে রিল্যাকসেশন নেওয়া। তারপর যেই অবস্থায় ভয় পায়, সেই অবস্থায় সাজেশন দিয়ে নিয়ে আসা এবং তারপর সাজেশন দেওয়া ভয় লাগছে না, ভয় লাগছে না, ভয় লাগছে না…

এই সাজেশন অডিও ক্যাসেটে রেকর্ড করে দিন। রোগীকে বলুন, একটা ফাঁকা ঘরে সুন্দর বিছানায় হালকা পোশাকে শোবেন। ঘরে থাকবে স্বল্প আলো। তারপর ক্যাসেটটা শুনতে থাকুন। যখন ক্যাসেট বন্ধ হবার হয়ে যাবে। আপনি যতক্ষণ ইচ্ছে শুয়ে থাকুন। ফোবিয়া থেকে আপনি মুক্তি পাবেন-ই।

 

হতাশা ও অবসাদ (Depressive neurosis )

প্রেমে ব্যর্থ তরুণ-তরুণী হতাশায় ভোগে। কঠিন অসুখে ভুগতে ভুগতে হতাশা আসে। হতাশার কারণ হতেই পারে দারিদ্র। রাষ্ট্রীয় বা পার্টির প্রবল সন্ত্রাসের মধ্যে থাকতে থাকতে অবসাদ আসে। জাতিদাঙ্গা রায়টে বহু মানুষ অবসাদ ও হতাশা থেকে নানা ধরনের মানসিক রোগের শিকার হয়। আবার অকারণে দুঃখ আসে। এই অকারণ দুঃখ থেকে মনোবিকার দেখা দেয় ।

রিল্যাকসেশনের সাজেশনে কিছুটা মানসিক জোর বাড়াতে পারে।

 

বাধ্যতামূলক পীড়নে অথবা আত্মবিশ্বাসের অভাবে আচ্ছন্ন (Obsessive Compulsive neurosis)

অনেক ধর্মীয় সংগঠনের সন্ন্যাসী, পীর, নানদের কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে, অধ্যাপনা ছেড়ে এই জীবনে এসে শেষ পর্যন্ত অনুভব করছেন, ঈশ্বর-আল্লা সবই অবাস্তব চিন্তা। কিন্তু ফেরার উপায় নেই। যা মিথ্যে তার পক্ষেই প্রচার করতে হচ্ছে। এ হল বাধ্যতামূলক পীড়ন।

অনেকেই অফিসের ড্রয়ার লক করার পরও ফেরার জন্য পা বাড়িয়েও আবার এসে লকটা ঠিক বন্ধ করা আছে কিনা আবার পরীক্ষা করে যায়। অনেক সময় এমনটা করে দুবারেরও বেশি। এ হল আত্মবিশ্বাসের অভাব।

ঘরের দরজা বন্ধ করেও অনেকে আবার ফিরে ফিরে এসে পরীক্ষা করে।

আবার অনেকে এই রোগে শুচিবায়ুগ্রস্ত হয়। বারবার হাত-পা-বাসন-ঘর ধোয়াধুয়ি করে।

কেউ আবার পথ চলতে চলতে প্রতিটি ল্যাম্পপোস্ট ছুঁয়ে যায়। ভাবে, না ছুঁলে অমঙ্গল হবে, কাজে বাধা পড়বে।

ভগবানের ছবি দেখলে কারো কারো মনে হয়, ছবির উপর পা তুলে ফেলবে।

কোনো কোনো ছেলে মহিলাদের চোখের দিকে বা মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে না । তার পায়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলে। কারণ সেই সব ছেলেদের মনে হয় মুখ বা চোখের দিকে তাকাতে গেলেই বুকের দিকে দৃষ্টি চলে যাবেই।

একজন লেখক মনে করেন, হৃদয় থেকেই চিন্তা ও প্রেমের উৎপত্তি হয়। রোগী বুঝতেই পারে না, এটা অমূলক চিন্তা। বিজ্ঞান বই খুলে দেখিয়ে দিলাম মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষই প্রেমের কারণ। তবু তার মাথায় একই চিন্তা ঘুরপাক খায় ৷

 

শরীর ঘিরে দুশ্চিন্তা (Hypochondriacal )

শরীর সর্বস্ব সুন্দরী, মডেলগার্ল, অভিনেত্রীরা যখন জ্ঞানবুদ্ধিতে নিম্ন মেধার হন, তখন শরীর নিয়ে দুশ্চিন্তা ভিড় করে আসে। আসে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে। এই বোধহয় চুল উঠে যাচ্ছে, মোটা হয়ে যাচ্ছি, ত্বক জেল্লা হারাচ্ছে।

ডাক্তার দেখাবার প্রবণতা বাড়ে। দাঁতের ডাক্তার, ত্বকের ডাক্তার ইত্যাদি স্পেশালিস্ট দেখাতে হবে। পা মচকেছে। শুধু ‘ভলিনি’ দিয়ে সারবে না। অস্থি-বিশেষজ্ঞ দেখাও ৷ এক্স-রে করো। এম আর আই করো।

কোনো ডাক্তার-ই নানা পরীক্ষার পরেও রোগের কারণ যখন খুঁজে পান না। তখন রোগী একের পর এক ডাক্তার পান্টাতে থাকেন। যেসব ডাক্তার বোঝাতে চেষ্টা করেন, আসলে আপনার কোনো রোগ নেই, রোগটা মনের। ওমনি রোগী রেগে যান।

এটাই হল শরীর ঘিরে দুশ্চিন্তা অর্থাৎ হাইপোকনড্রিয়াকল অসুখ। এই অসুখের চিকিৎসার জন্য সাইকোথেরাপির প্রয়োজন ।

 

বাতিক, উন্মাদগ্রস্ত (Mania)

আমার পরিচিত এক মহিলা কয়েক বছর ধরে দেখছি খুব হাসি-খুসি, ঝকঝকে কথাবার্তা, অসাধারণ কর্মক্ষম, সব সময় কাজ করছেন, কথা একটু বেশি বলেন। বলেন বেশি। শোনেন কম। মনে করেন উনি এতই সুন্দরী যে, কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য ফ্ল্যাটের বাইরে পা বাড়ালেই আশপাশের ফ্ল্যাটগুলোর জানলা খুলে উঁকি মারে রূপমুগ্ধ পুরুষরা ।

একটু একটু করে মনে করতে শুরু করলেন, বিদ্যায়, বুদ্ধিতে, জ্ঞানে, সৌন্দর্যে তিনি অ্যান-প্যারালাল। ওঁর লেবেল পরিচিতরা কেউ পরিমাপই করতে পারে না।

মধ্যমেধার এই রমণী বড় কোম্পানিতে মাঝারি মাপের ম্যানেজমেন্ট কর্মী। ঘুমের মাত্রা প্রয়োজনের তুলনায় কম ৷

আত্মীয়-বন্ধুদের গিফট্ দিয়ে ইমপ্রেসড করতে চান। নিজের সমালোচনা সহ্য করেন না। এটা বাতিক বা ম্যানিয়া।

ম্যানিয়া রোগীদের মধ্যে অনেকেরই যৌন আগ্রহ বেশি হয়। একসময় তারা বহুজনের সঙ্গে মিলনে আনন্দ পান। একসময় আসে যখন বিষণ্নতায় ভোগেন, নিজেকে অসহায় মনে করেন, প্রিয়জনরা আর আগের মতো ভালোবাসছেন না—মনে করতে থাকেন। এমনকি আত্মহত্যার ইচ্ছেও মনে আসে।

এই রোগ মুক্তির জন্য ওষুধের প্রয়োজন। যেসব ওষুধ হরমোনের কাজকর্মকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং শরীরের নিউরো-কেমিক্যাল ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে, সেই ওষুধ ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া যায় ৷

 

পর্ব- একঃ উঠে আসা নানা প্রশ্ন

অধ্যায়ঃ এক

♦ সম্মোহন

অধ্যায়ঃ দুই

♦ জন্তুদের সম্মোহন করা ব্যাপারটা কি?

অধ্যায়ঃ তিন

♦ ফোটো-সম্মোহন কি সম্ভব?

অধ্যায়ঃ চার

♦ গণ-সম্মোহনের সাহায্যে কি ট্রেন ভ্যানিশ করা যায়?

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ সম্মোহন করে পূর্বজন্মে নিয়ে যাওয়া যায়?

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ জন্মান্তর ও সম্মোহন

অধ্যায়ঃ সাত

♦ সম্মোহন ও নার্কো টেস্ট

অধ্যায়ঃ আট

♦ সম্মোহন করে কথা বলানো যায় ?

অধ্যায়ঃ নয়

♦ প্ল্যানচেটে যে আত্মা আনা হয়, তা কি স্বসম্মোহন বা সম্মোহনের প্রতিক্রিয়া ?

পর্ব- দুইঃ সম্মোহনের ইতিহাস ও নানা মানসিক রোগ

অধ্যায়ঃ এক

♦ সম্মোহনের বিজ্ঞান হয়ে ওঠার ইতিহাস

অধ্যায়ঃ দুই

♦ মনোরোগ, সম্মোহন জানতে মগজের কাজ জানা জরুরি

অধ্যায়ঃ তিন

♦ মানসিক রোগের রকমফের

অধ্যায়ঃ চার

♦ Hysterical neurosis – Conversion type

অধ্যায়ঃ চার

♦ সাইকোসিস (Psychosis) উন্মাদ

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ দেহ-মনজনিত অসুখ (Psycho-somatic disorder)

পর্ব- তিনঃ মনোবিদ ও মনোরোগ চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ এক

♦ মনোবিদ (Psychologist) ) মনোরোগ চিকিৎসক (Phychiatrist)

অধ্যায়ঃ দুই

♦ প্রধান কয়েকটি সাইকোথেরাপি নিয়ে আলোচনায় যাব

অধ্যায়ঃ তিন

♦ টেনশন

অধ্যায়ঃ চার

♦ রিল্যাকসেশান পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ পাঁচ

♦ যৌনতা এবং যৌন-সমস্যা

অধ্যায়ঃ ছয়

♦ ‘যোগ’ মস্তিষ্ক-চর্চা বিরোধী এক স্থবীর তত্ত্ব

পর্ব- চারঃ বিভিন্ন রোগের সম্মোহনের সাজেশন পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ এক

♦ সম্মোহন চিকিৎসা এবং…

অধ্যায়ঃ দুই

♦ রোগীকে সাজেশন দেওয়ার পদ্ধতি

অধ্যায়ঃ তিন

♦ রকমারি রোগ, রকমারি সাজেশন

অধ্যায়ঃ চার

♦ প্রাচীন আমল থেকেই মানসিক রোগ মানেই অশুভ শক্তির কালো হাত

“সম্মোহনের A to Z” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ

⇒ মন্তব্য করুন⇐

error: Content is protected !!