অভিধানে hallucination কথার বাংলা অর্থ দেওয়া আছে ‘অলীক কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস’। অলীক বাঁ অস্তিত্বহীন কোন কিছুর সম্পর্কে অনুভূতি লাভ করাকেই মনোবিজ্ঞানের ভাষায় hallucination বলা হয়। অতএব, hallucination এর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘অলীক বিশ্বাস’ কথাটাই আশা করি ঠিক হবে।

ধরে নিলাম, রামবাবু পুজো আর্চা করেন। অফিস যাওয়ার আগে স্নানটি সেরে ঠাকুরপুজো করে খেতে বসেন। সেদিন শনিবার, কালীর ছবিতে অপরাজিতার মালা পরিয়ে প্রদীপ জ্বেলে ধূপ-ধুনো দিয়ে পূজো করছেন, হঠাৎ দেখতে পেলেন মা কালী ছবি ছেড়ে এক’পা এক;পা করে বেরিয়ে এলেন। Optical hallucination বা Visual hallucination –এর রোগীরা এই ধরনের দৃশ্য দেখেন।

সুন্দরী তরুণী সুমনা বিয়ের এক বছরের মধ্যে স্বামীকে হারিয়েছে। স্বামী শ্যামলেন্দু অফিস যাওয়ার পথে স্কুটার এ্যাকসিডেন্ট করে মারা গেছে। শ্যামলেন্দুর ব্যাঙ্কে সুমনা চাকরি পেয়েছে। সহকর্মী ধ্রুবকে ভালোই লাগে। ধ্রুবও ওকে চায়, সেটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না। একদিন ধ্রুব বিয়ের প্রস্তাব দিল সুমনাকে। আর, সেই রাতেই  শুতে যাওয়ার আগে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে ক্লিনজিং মিল্ক দিয়ে মুখ পরিষ্কার করতে করতে সুমনা তাকাল ড্রেসিং টেবিলে রাখা শ্যামলেন্দুর ছবির দিকে, আর ওমনি স্পষ্ট শুনতে পেল শ্যামলেন্দুর গলা, “তুমি আমাকে এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেছে সুমনা?” Auditory hallucination –এর রোগী এই ধরণের কথা শুনতে পায়।

আমার বন্ধু অমিত সেন-এর বড়দা (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ সত্যেন সেনের ভাইপো) সুজিত সেন মারা যান ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৫ সালে কেদারে। একমাত্র সন্তানের মৃত্যুতে অমিতের বড়দা ও বৌদি খুবই আঘাত পেয়েছিলেন। বেরিয়েছিলেন তীর্থ দর্শনে। কেদারের পথে হাঁটতে হাঁটতেই অমিতের বড়দা হার্টে ব্যথা অনুভব করেন। আত্মীয় বন্ধুহীন এই তীর্থযাত্রায় দাদার একমাত্র সঙ্গী বৌদি পাগলের মতোই সাহায্যের জন্য চেঁচাতে থাকেন। এক সময় বৌদি হঠাৎ-ই দেখতে পান এক সন্ন্যাসী ছুটতে ছুটতে আসছেন। মরণপথযাত্রী বড়দার সামনে দাঁড়িয়ে সন্ন্যাসী বড়দার মুখে প্রসাদ ও কমন্ডলুর জল দিয়ে, যেমন এসেছিলেন তেমনি আবার ছুটতে ছুটতে চলে যান। একটু পরেই বড়দা মারা যান। বৌদি আশ্রয় পেলেন এক আশ্রমে। বড়দার শেষ কাজ বৌদিই করলেন আশ্রমের সন্ন্যাসীদের উপদেশ মতো। সন্ন্যাসীরা এই মৃত্যুকে মহাপুরুষের মৃত্যু হিসেবে ধরে নিয়ে মৃতদেহ না পুড়িয়ে জলে ভাসিয়ে দিলেন। দু-একদিন পরে বৌদি কেদারনাথকে দর্শন করতে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এ কি, এই কি কেদারনাথ? ইনিই তো সেদিন স্বামীর মুখে জল ও প্রসাদ তুলে দিয়েছিলেন।

অমিতের বৌদি ঈশ্বরে বিশ্বাসী, দীর্ঘদিনের সংস্কার, তীর্থক্ষেত্রের ধর্মীয় পরিবেশ, প্রচন্ড মানসিক আঘাতের আবেগ ও সন্ন্যাসীদের আধ্যাত্মিক কথাবার্তা এই ধরনের Visual hallucination সৃষ্টি করেছিল।

আমার সহকর্মী মণি দালালের এক আত্মীয় হঠাৎ-ই একদিন আবিষ্কার করলেন তাঁর বাড়িতে কলকাতা কর্পোরেশনের যে জল আসে তাতে প্রস্রাবের গন্ধ। তাঁর দৃঢ় ধারণা হল এর পেছনে আছেন তাঁরই এক আত্মীয়। বাড়ির লোকজনেরা বোঝালেন এটা অলীক চিন্তা। ভদ্রলোক কিন্তু বুঝলেন না। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করলেন, দুষ্ট আত্মীয়টি কর্পোরেশনের লোকজনদের হাত করে প্রস্রাব মেশাচ্ছেন।

দীর্ঘদিন ধরে আর স্নান করেন নি তিনি। অতি সামান্য জল খেতেন এবং সেই জলও নিজেই নিয়ে আসতেন দূরের এক টিউবওয়েল থেকে। এটা ঘ্রাণভিত্তিক ভ্রান্তির (Olfactiry Hallucination) উদাহরণ।

আমার অফিসের এক বড় অফিসার তাঁর চেম্বারে ডেকে আমাকে বললেন, তাঁর স্ত্রী বোধহয় কোনও তুকতাক করেছে, অথবা কোন পিশাচ ঘরে ঢুকেছে। শাশুড়ির মৃত্যুর পর থেকে তিনি ঘরে পিশাচের গন্ধ পাচ্ছেন। পিশাচের গন্ধ তিনি কি করে চিনলেন, কে জানে? ভদ্রলোক আমাকে একদিন তাঁর বাড়িতেও নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি ‘পিশাচের’ কোনও গন্ধ না পেলেও তিনি কিন্তু তখনও গন্ধ পাচ্ছিলেন, এটাও ঘ্রাণভিত্তিক হ্যালুসিনেশনের দৃষ্টান্ত।

একদিন আড্ডা দিচ্ছিলাম চিত্রকর গণেশ হালুইয়ের সল্টলেকের বাড়িতে। সেই আড্ডায় আমরা দু’জন ছাড়া ছিলেন আর একজন শিল্পী। তাঁর নাম প্রকাশে একটু অসুবিধা থাকায় ধরে নিচ্ছি তাঁর নাম শ্যামবাবু। শ্যামবাবু শ্রীমার পরম ভক্ত। সঙ্গের ওয়ালেটে সব সময় শ্রীমার ছবি থাকে। একদিন তিনি অসতর্কভাবে রাস্তা পার হতে গিয়ে ডবলডেকার বাসে চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে যান। সেদিনের আড্ডায় শ্যামবাবুর প্রতিটি কথা আক্ষরিকভাবে মনে না থাকলেও কথার ভাবটুকু আমার স্মৃতিতে জমা পড়ে রয়েছে। শ্যামবাবু মোটামুটিভাবে সেইদিন এই ধরনের কথা বলেছিলেন, বুঝতে পারছিলাম চাপা পড়বই। আর এক মুহূর্তের মধ্যে আমার জীবন শেষ হয়ে যাবে। শেষ সময়ে শ্রীমা’কে স্মরণ করতেই ঘটে গেল অলৌকিক ঘটনা। দেখতে পেলাম আমার পাশে শ্রীমা। তারপরই অনুভব করলাম একটা হেঁচকা টান। হুড়মুড় করে চলে আসা বাসটা। দেখলাম আমি বেঁচে আছি। সেদিনের সেই অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা বলতে গেছে আজও আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

অস্তিত্বহীন শ্রীমার আত্মা উপস্থিত হয়ে শ্যামবাবুকে বাঁচিয়েছেন এবং শ্যামবাবু স্বচক্ষে শ্রীমাকে দেখেছেন এই অলীক চিন্তাই হল দৃষ্টিভিত্তিক হ্যালুসিনেশন।

অতীন মিত্র একটা আধা সরকারি সংস্থায় মোটামুটি ভালো পদেই কাজ করেন। একমাত্র সন্তান রুণা রসগোল্লা খেতে গিয়ে গলায় আটকে মারা যায়। তারপর থেকেই অতীন বাবুর স্ত্রী কোন মিষ্টি খেতে পারেন না। মুখে দিলেই মনে হয় বিষ তেতো। এটা স্বাদভিত্তিক বা taste hallucination অসুস্থ মস্তিষ্কের ফল। Hallucination ও পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের ওপর নির্ভর করে পাঁচ ভাগে বিভক্ত।

বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থের (chemical stimulus)  সাহায্যেও hallucination সৃষ্টি করা সম্ভব। গাঁজা, আফিম, L.S.D, ভাঙ, কোকেন, চরস ইত্যাদি প্রয়োজনীয় মাত্রায় শরীরে গ্রহণ করলেও অনেক সময় তুরীয় আনন্দ, আধ্যাত্মিক আনন্দ, দেবদর্শন বা দেববাণী শোনা যায়। আমার এক পরিচিত তরুণ আমাকে বলেছিল, সে একবার L.S.D খাওয়ার পর অনুভব করেছিল, তার দেহটা খাটে শুয়ে আছে এবং আত্মা সিলিং-এ ঝুলে রয়েছে।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x