সন্ধ্যায় তার ওখানে, গুলশানের এক রেস্টহাউজে যেখানে সে থাকে, পানের নিমন্ত্রণ করেছে আবদেল, যার সাথে রাশেদের পরিচয় হয় বছর দুয়েক আগে এক পানের আসরে। তাদের সম্পর্ক যে নিবিড়, প্রতিদিন বা প্রতিমাসে যে তাদের দেখা হয়, তা নয়; দেখা হয় তাদের পান উপলক্ষেই, বিশেষ করে যখন আবদেল এরকমভাবে হঠাৎ নিমন্ত্রণ করে। তারা এক প্রজাতির নয়, আকস্মিকভাবেই তারা কাছাকাছি এসেছে; পানশালায় তো কতোজনেরই মুখোমুখি বসতে হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ নানা অভিনব, সামগ্রী উৎপাদন করেছে, স্বাধীনতা সব সময়ই সৃষ্টিশীল হয়ে থাকে; আবদেল তারই একটি, ও তার নামের মতোই চমকপ্রদ। বাঙালি মুসলমানের নামগুলো বুর্জোয়াদের। জন্যে বিব্রতকর, মোহাম্মদ আহাম্মদ আবদুল কেরামত বেজায়েত আকিদুল মোহব্বত চোখে ঝোঁপঝোঁপ দাড়িপুটির দৃশ্য জাগিয়ে তোলে চোখে, তবে ওগুলোকে একটু কাতচিৎ করে নিলে বেশ লাগে; আবদুল বললে ভৃত্য মনে হয়, আর আবদেল বললে মনে হয় শীততাপনিয়ন্ত্রিত আমলা/বলপয়েন্টপিচ্ছিল সাংবাদিক/মতিঝিলের মসৃণ ব্রিফকেস। তারা বন্ধু নয়, হয়তো হবেও না কখনো, চুম্বকের মতো তারা টানে না পরস্পরকে; কিন্তু আবদেলের সাথে দেখা হলে রাশেদ কয়েক ঘণ্টা নষ্ট করতে প্রস্তুত থাকে, কয়েক ঘণ্টা তুচ্ছতায় নষ্ট করেও তার অনুতাপ হয় না, তখন পানটুকুকেই মনে হয় অর্জন; আর আবদেল পছন্দই করে সময় নষ্ট করতে, অন্তত সময়কে সে মূল্যবান। মনে করে না। সে সাধারণত ডাকে পান করতে, পানের ডাকে সাড়া না দিয়ে পারা যায় না; বাঙলার সবুজ মরুভূমিতে এক গেলাশ বিয়ার, একটুকু হুইস্কি বেশাখি বৃষ্টির মতো সুখকর। ভাঁড়রা চারদিক খটখটে করে তুলেছে, গাছপালার দিকে তাকালেও চোখে। কোনো রস ঢোকে না, মেঘের দিকে তাকালে মনে হয় ঝামাপাথর উড়ছে উত্তর দক্ষিণ। পুব পশ্চিম আকাশ জুড়ে; তবে ভাঁড়দের পেট অবশ্য খটখট করছে না, সেখানে নিশ্চয়ই শ্রাবণধারা চলছে হুইস্কির, বন্যায় পেট উপচে হয়তো দামি কার্পেট ভাসিয়ে দিচ্ছে। রাশেদের রক্তে একটা খটখটে ঝমাঝামা ভাব এসে গেছে; রাস্তায় রাস্তায় ট্রাক দেখে। দেখে ঘেন্না ধরে গেছে, তাই আবদেলের ডাক মেঘের ডাকের মতোই মধুর লাগলো। আবদেলের ওখানে পানের সুবিধা হচ্ছে সেখানে সতীগৃহিণীর দোররার নিচে পাপিষ্ঠের মতো পান করতে হয় না। পান করতে করতে যদি মিনিটে মিনিটে মনে পড়ে পাপ করছি, বাড়িঅলি যদি মাঝেমাঝেই ড্রয়িংরুমে এসে স্বামী ও সঙ্গীদের একরাশ ইতর শব্দ উপহার দিয়ে যায়, এবং গালাগাল করতে থাকে পাশের ঘর থেকে, তাহলে পুরো। জলবায়ুই ঘিনঘিনে হয়ে ওঠে, মনে হয় পাড়ায় বা মেথরপট্টিতে বসে ব্যাটারিভেজানো তাড়ি খাচ্ছি। সতী গৃহিণীদের ভাষা এতো চমৎকার যে মনে হয় তারা অন্তত বছর। দশেক পাড়ায় কাটিয়ে এসেছে। আবদেলের রেস্টহাউজে সে-ঝামেলা নেই, সেখানে। কোনো সতী নেই; আবদেলের বউ থাকে বিদেশে, আগে সে আবদেলের একাধিক বন্ধুর বউ ছিলো, এখন আবদেলের; আবদেলের থেকে সে পাঁচসাত বছরের বড়ো, এখন। আবদেলের বা সত্যিই আবদেলের কিনা তা জানে না রাশেদ, তবে তার শরীরটা একান্ত আবদেলের নয়, যেমন আবদেলেরটাও সম্পূর্ণ তার স্ত্রীর নয়। কোনো কিছু, দেহ বা রাষ্ট্র যা-ই হোক, সম্পূর্ণরূপে কারো অধিকারে থাকা খুবই অস্বস্তিকর। আবদেলও বিদেশেই থাকতো, দু-দশক ছিলো, চলে এসেছে, বউ আসে নি; বাঙালি মেয়েরা বিদেশে গেলে সাধারণত ফিরতে চায় না। এটা অবশ্য রাশেদের ভালো লাগে। ওই নারী, যে আবদেলের স্ত্রী, যাকে দেখে নি রাশেদ, কখনো দেখবে না, যার বয়স হয়তো এখন। চুয়ান্নো, তাকে কি বউ বলা যায়? স্ত্রী বলা যায়? বলবে কি পরিবার, যেমন ছেলেবেলায় বুড়োদের মুখে সে শুনেছে? আবদেলের পরিবার আবদেলের সাথে থাকে না বলেই সে এতো আকর্ষণীয়।
আবদেল মদটদ খাওয়ায় মাঝেমাঝে; এটা তার এক মস্ত গুণ, বাঙলায় কে কাকে। খাওয়াতে অর্থাৎ পান করাতে চায়? আহা রাশেদ মুসলমান আহা রাশেদ বাঙালি আহা। রাশেদ বাঙলাদেশি, আর মদদ হচ্ছে মুসলমানের স্বপ্নের ও দুঃস্বপ্নের জিনিশ। মুসলমানের পক্ষে কি মদের কথা ভুলে থাকা সম্ভব? না, বারেকের, তাদের গ্রামের চাষী, কথা মনে পড়ছে রাশেদের; সে হয়তো কখনো মদের কথা ভাবে নি, নাকি তার মনেও পড়তো মদের কথা? একবার শ্রীনগরে রথযাত্রা দেখতে গিয়ে নাকি সে কেমন কেমন। করেছিলো, বারবার ভেঙে ভেঙে জড়িয়ে জড়িয়ে পাশের বাড়ির এক হিন্দু বিধবার নাম করেছিলো, হু হু করে কেঁদেছিলো? রাশেদ যে বাঙালি মুসলমান ভাইদের গোত্রের, তারা আল্লাকে ভুলে থাকতে পারে। তবে আজকাল একটু বেশি করেই তার নাম নিচ্ছে যদিও মনে রাখছে না, কিন্তু ওই বস্তুটিকে ভুলে থাকতে পারে না। মুসলমান ভাইরা মদ খায় বা খায় না, খেতে পায় বা পায় না, কিন্তু কখনো মদের কথা ভুলে থাকতে। পারে না। যে-মুসলমান ভাই মদ খায় সেও মাতাল, যে খায় না সেও মাতাল, একটু বেশি করেই মাতাল। রাশেদ ও তার চারপাশের ভাইরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্মের অন্তর্ভুক্ত; ওই শ্রেষ্ঠ ধর্মটি এসেছে যে-মরুভূমি থেকে, সেখানকার কিছু আধুনিক বেদুইন ভাইকে। সে দেখেছে, তারা উটের মতো গেলে; পার্থক্য হচ্ছে উট একবার গেলার পর অনেক দিন গেলার কথা ভাবে না, আর আধুনিক বেদুইন ভাইরা দিনরাত গিলতে না পারলে চারদিকে মরুভূমি দেখে, আর মুখ খুললেই বলে হারাম। জিনিশটি নিয়ে তার শ্রেষ্ঠ ধর্মে তো সমস্যা রয়েছেই, তার মহান বাঙলা ভাষায়ও সমস্যা রয়েছে; এতে হুইস্কি বিয়ার ওআইন সবই মদ। রাশেদ পছন্দ করে হুইস্কি আর বিয়ার; এগুলো চমৎকার। জিনিশ, যা আছে বলে যেমন মেঘ বা পাবদা বা পুকুরপাড়ে লাউয়ের জাংলা, জীবনকে জীবন মনে হয়। তবে এটা নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ কেননা? মুসলমানের জন্যে মদ নিষিদ্ধ কেননা? মুসলমানের জন্যে নিষিদ্ধ হওয়ার কথা শুধু গন্ধম, ওটাই তো খেতে নিষেধ করা হয়েছিলো স্বর্গে, ওই জ্ঞানটুকুই তো শুধু নিষিদ্ধ, মদ নিষিদ্ধ কেননা? মদ কি কোনো জ্ঞান? কিন্তু নিষেধ কে মানে? ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে নিতে ক্লান্ত আর ঘুষ। খেয়ে খেয়ে ব্যাংক ভরে ফেলেছে যে-মুসলমান বাঙালি ভাইরা, দখল করে ফেলেছে। গুলশান বনানী ধানমণ্ডি বারিধারা উত্তরা, যারা মতিঝিলে আমদানিতে তোপখানায়। দেশের উন্নতিতে উত্তরপাড়ায় দেশরক্ষায় তন্দ্রাহীন, তারা সবাই কমবেশি হুইস্কি বিয়ার টানে, এবং বলে হারাম। একটু ভণ্ডামো করতে হয়, একই সাথে বাঙালি ও মুসলমান হলে একটু ভণ্ডামো না করলে চলে না। কেরামত আলি, রাশেদের এক বন্ধু, পকেটে সব সময় পেয়ারাপাতা রাখে। চাপে পড়ে মানুষ আবিষ্কারক হয়, সেও হয়েছে; সে বের করেছে পেয়ারাপাতা চিবোলে হুইস্কির গন্ধ কেটে যায়, সঙ্গমের সময়ও তার স্ত্রী গন্ধ পায় না, যদিও তার স্ত্রীর গন্ধশক্তি প্রবল; টেলিফোনেও সে মদের গন্ধ পায়, কেরামতকে জিজ্ঞেস করে, মদ খাইছ, গন্ধ পাইতাছি; তাই পানের পর আধঘণ্টা ধরে কেরামত পেয়ারাপাতা চিবোয়, পানও চিবোয়, এবং বাসায় ফিরে বউর সাথে এমন ভাব করে যেনো দিনটা সে বায়তুল মোকররামে কাটিয়েছে, পুরস্কার হিশেবে এখন তার প্রাপ্য একটা প্রথম শ্রেণীর সঙ্গম।
সোনার বাঙলায় প্রাণ ভরে পান করে, গেলে, চোরারাই; ওদের টাকা আছে, আর ওরা গেলে ব’লেই পানের এতো সুনাম। সোনার বাঙলা সব কিছুকে বিকারে, পাপে, অপরাধে পরিণত না করে শান্তি পায় না। প্রেমও এখানে পাপ, বড়ো অপরাধ, জেনার সমান, জোগাড় করারও কঠিন যেমন কঠিন এক বোতল হুইস্কি জোগাড় করা। রাশেদ একবার কেনার চেষ্টা করে দেখেছে সে ছোটোখাটো একটা চোরাকারবারে লিপ্ত হয়ে পড়েছে, যেনো সে সাংঘাতিক অপরাধ করে চলছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। সে শুনেছিলো। চোরাদের ক্লাবের দারোয়ানদের কাছে জিনিশটা পাওয়া যায়, তাই একবার গিয়েছিলো; দারোয়ানটা তার সাথে চল্লিশ মিনিট ধরে ফিসফিস করেছিলো, মনে হচ্ছিলো সে পথনারী ভাড়া করতে গেছে, তারপর রিকশা করে একটি গলিতে নিয়ে বলেছিলো, টাকা দ্যান। রাশেদ সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছিলো টাকা নিয়ে এটা আর ফিরবে না। তাই পানের জন্যে কেউ একটু ডাকলেই সে স্বস্তি পায়, যেমন ডাকে আবদেল। রাশেদ আমলা আর কালোবাজারিগুলোকে চেনে, দু-চারটার সাথে খেয়েও দেখেছে, সেগুলো। পকেট থেকে একটা সিগারেটও বের করে না, অন্যেরটা দশ মিনিট পরপর অন্যমনস্ক অসাধারণ ভঙ্গিতে তুলে নেয়, যেনো নিয়ে কৃপা করছে। মদ ওগুলো একা একা বাসায় ব’সে গেলে, কেনে না, পায় কোথাও থেকে, গিলতে গিলতে বউর সঙ্গে ঝগড়া করে আর গিলে গিলে পাকস্থলি পচায়। বাঙলার বউগুলোও পাকা জিনিশ, ভাতারের হাতে মদের বোতল বা মুখে একটু গন্ধ পেলেই তারা পা থেকে মাথা পর্যন্ত সতীসাধ্বী হয়ে। ওঠে, মুখ থেকে পাড়ার ভাষা বেরোতে থাকে, কয়েক দিনের জন্যে সমস্ত সুড়ঙ্গে তালা লাগিয়ে দেয়। ওদের বাসায় গিয়ে মদ খেতে ভালো লাগে না রাশেদের, লুকিয়ে বেশ্যাবাড়িতে ঢুকে তাড়ি খাওয়ার জলবায়ু তাকে ঘিরে ধরে। একবার একটার বাসায় গিয়েছিলো সে, গিয়েই মনে হয়েছিলো সে কয়েকটা দালালের সঙ্গে বেশ্যাবাড়িতে ঢুকে গেছে, পুলিশ দিয়ে ঘেরাও হয়ে পড়েছে। রাশেদের থেকে পনেরো বছরের বড়ো হবে, একটা ইঞ্জিনিয়র আরেকটা মতিঝিলের ব্রিফকেস, পরিচয়ের দু-দিন পরেই রাশেদকে বাসা থেকে তুলে নেয়, এবং ইঞ্জিনিয়রটার বাসায় ঢুকতে গিয়েই পতিতাপল্লীর জলবায়ুতে পড়ে রাশেদ। দরোজা খুলেই তার পরিবার খ্যাকখ্যাক করে ওঠে, মদ লইয়া আইছ, লগে লোচ্চাগোও লইয়া আইছ। মহিলা খ্যাকখ্যাক করতে থাকে, কলেজের ছাত্র প্রথম বেশ্যাবাড়িতে ঢুকতে গিয়ে যেমন গলির মুখে এসে ভয় পায়, ঢুকবে কি ঢুকবে না করতে থাকে, একটু ঢুকতেই একপাল বেশ্যার আক্রমণে গলি থেকে পালানোর চেষ্টা। করে, কিন্তু পারে না, তেমনি অবস্থা হয় রাশেদের। ইঞ্জিনিয়রটি তার স্ত্রীকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ঠেলতে ঠেলতে শয্যাকক্ষে নিয়ে যায়, বাইর থেকে দরোজা বন্ধ করে দেয়। রাশেদ আরেকটি ঘরে একটি কিশোরী ও একটি তরুণীকে দেখতে পেয়ে অত্যন্ত অপরাধবোধগ্রস্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু ড্রয়িংরুমে ঢুকতে বাধ্য হয়। ইঞ্জিনিয়রটি আধময়লা কয়েকটি গেলাশ ও একটি পানির বোতল নিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে, ঢকঢক করে হুইস্কি ঢালে, আর শয্যকক্ষ থেকে তার স্ত্রী চিৎকার করতে থাকে। রাশেদ বারবার। লোচ্চা, লোচ্চা শব্দ শুনতে পায়। রাশেদের হাতের সবুজ গেলাশটিতে পুঁজ জমে উঠতে থাকে, পোকা থকথক করতে থাকে, বেশ্যার পচে-যাওয়া জিভ থেকে থুতু এসে পড়তে থাকে। রাশেদ দাঁড়িয়ে বলে, আমি যাই, কিন্তু লোক দুটি তার হাত ধরে মাফ চাইতে থাকে। বলে, কিছু মনে করবেন না, একটু খান, যাবেন না। তখন দুজনকেই চমৎকার মানুষ মনে হয় রাশেদের; কিন্তু রাশেদ ভুলতে পারে না শয্যাকক্ষে আটকে রাখা হয়েছে একটি মহিলাকে, যে লোজ্জা লোচ্চা চিৎকার করছে, এবং পাশের ঘরে দুটি মেয়ে তাকে ঘেন্না করছে, তাকেই ঘেন্না করছে বেশি।
লোক দুটি পান করছে খুব দায়িত্বের সঙ্গে, তারা জীবনের একটি বড়ো কাজ সম্পন্ন। করছে; ঢকঢক করে খাচ্ছে, কোনো কথা বলছে না, গেলাশ ও পরস্পরের দিকে। তাকাচ্ছে, এবং রাশেদের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করছে। ঘরে আবছা অন্ধকার, অপরাধের মতো অন্ধকার, পাপের মতো অন্ধকার, পৃথিবীর সমস্ত বাঙালি ও মুসলমান পানের সময় যে-অপরাধরোগে ভোগে তার অন্ধকারে ঘরটি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। লোক দুটি ভুলতে পারছে না মদ খাওয়া পাপ, তবু খাচ্ছে, একটু বেশি করেই খাচ্ছে, ঢকঢক শব্দে তারা সমস্ত উচ্চ ও অশ্রুত শব্দকে ঢেকে ফেলতে চাইছে। লোক দুটি এখন কী দেখতে পাচ্ছে? ছেলেবেলার খেজুরগাছ, মাছের লাফ, কার্তিকের চাঁদ, লাল ঘুড়ি, কাঁচা আম, কোনো বালিকার মুখ দেখতে পাচ্ছে? অমন কিছু দেখছে না বলেই মনে হচ্ছে, তারা কোনো পতিতার নোংরা উরুর দিকে তাকিয়ে আছে বলে মনে হলো রাশেদের। তার ঝুলেপড়া স্তন দেখছে, রোগা উরু দেখছে, ভজ দেখছে, অন্ধকার দেখছে, পুঁজ দেখছে, এবং ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। ওই মহিলা মদ খাওয়াকে এতো খারাপ মনে করে কেননা, মদ খাওয়া কি দরোজা খুলেই মদ লইয়া আইছ, লগে লোচ্চাগোও লইয়া আইছ’ বলার থেকেও খারাপ? ওই মহিলা কখনো মদ খেয়েছে, খেয়ে বুঝতে পেরেছে। খাওয়া খারাপ? নাকি শুনেই বিশ্বাস করে ফেলেছে মদ খারাপ, মদ যারা খায় তারা খুব খারাপ? রাশেদ সারা বাড়ি ভরে একটা বিকারের অজগর দেখতে পেলো, অজগরটি। পিচ্ছিল দেহ দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে এ-বাড়ি, শহর, দেশ, লোক দুটিকে, ওই মহিলাকে, এবং তাকে। লোক দুটি খাচ্ছে এবং ঝিমোচ্ছে, এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠতেই ইঞ্জিনিয়রটি বিব্রত হয়ে পড়লো, চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, কে কে, এবং গলা শুনে ভয় পেয়ে গেলো। সে কাঁপাকাঁপা হাতে বোতলটি টেনে নিয়ে কার্পেটের নিচে লুকিয়ে ফেললো, পারলে নিজেও ঢুকে যেতো কার্পেটের নিচে; রাশেদের গেলাশটি টেনে নিয়ে সোফার নিচে রাখলো, তার বন্ধু ঢক করে পুরোটা গেলাশ গিলে ফেলে গেলাশটি লুকিয়ে ফেললো; এবং সে বললো, জামাই আর মেয়ে এসেছে। জামাই আর মেয়ে তো। আসবেই, যখন তখনই আসবে, শ্বশুর আর বাপের বাড়ি না গিয়ে কোথায় গিয়ে আর। তারা মরবে বাঙলায়? কিন্তু রাশেদের মনে হলো জামাই নয় শ্বশুরই এসেছে। জামাইর কাছে সে একটা প্রকাণ্ড সৎ শ্বশুর থাকতে চায়; জামাই এসেই পায়ে হাত দিয়ে সালাম। করবে, সে তার মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করবে, চমৎকার সুন্দর থাকবে মুসলমান। সমাজ। আদবকায়দায় জামাইটিকে একটা সাচ্চা মুসলমান মনে হলো রাশেদের, কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগলো এ-বদমাশটা কোথায় খায়? নিশ্চয়ই এটা কোথাও খায়, আর ওর বউটা ওকে লোচ্চা বলে গালি দিয়ে দুই উরু চেপে শুয়ে থাকে। জামাই চলে যাওয়ার পর ইঞ্জিনিয়র আবার টেনে বের করলো বোতল আর গেলাশ, আবার ঢক ঢক করে ঢাললো। এবার তাদের দায়িত্ব অনেক, বোতল শেষ করতে হবে, ঢকঢক শব্দ উঠতে লাগলো; রাশেদ মাঝেমাঝে চুমুক দিচ্ছে এবং দেখছে লোক দুটিকে। তারা এখন। টলছে, একটু গানও গাইছে, একজন কবিতার পংক্তিও ভেঙেচুরে টেনে টেনে আবৃত্তি করলো; একদিন তাদের ভেতরেও কবিতা ছিলো। রাশেদ ঘড়িতে দেখলো বারোটা। বাজে, সে ভয় পেয়ে গেলো; তার অনেক আগেই বেরোনো উচিত ছিলো, বারোটা থেকে সান্ধ্য আইন। তখন প্রথম সামরিক যুগ চলছে দেশে, বাঙালি মুসলমান মধ্যরাতের। সান্ধ্য আইনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাশেদ অনেক দিন রাত নটার পর বাইরেই থাকে নি, তাই বুঝতেই পারে নি এরই মাঝে বারোটা বেজে গেছে, এখন রাস্তায় তার অধিকার নেই। সে অপরাধী জাতির সদস্য, তাকে যে দিনের বেলা বাইরে আসতে দেয়া হয়, রাত বারোটা পর্যন্ত পথে চলার অধিকার দেয়া হয়েছে, এইতো বেশি। কিন্তু। রাশেদকে বাসায় ফিরতে হবে; সে উঠে দাঁড়ায়। ওই লোক দুটি তখন পুরোপুরি অন্য পারে চলে গেছে, রাশেদ ভেবেছিলো সে আসি বলে বেরিয়ে পড়লে তারা খেয়ালও করবে না; কিন্তু সে উঠতেই লোক দুটি তার দু পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে, আপনি যাবেন না, আরেকটু খান, আপনি চলে গেলে মনে করবো আপনি আমাদের ঘৃণা করেন। তারা দুজনেই হু হু করে কাঁদতে শুরু করে। রাশেদ পা থেকে তাদের হাত সরিয়ে আসি’ বলে দরোজা খুলে বেরিয়ে পড়ে। তখনো শুনতে পায় তোক দুটি কাঁদছে, আর বলছে, আপনি আমাদের ঘৃণা করবেন না, আপনি আমাদের ঘৃণা করবেন না।
রাশেদ যখন আবদেলের রেস্টহাউজে গিয়ে পৌঁছোলো তখন সন্ধ্যে, রেস্টহাউজটিকে কোমল আবেদনময় তরুণীর মতো দেখাচ্ছে, যেনো কিছুক্ষণ পর সেও রাশেদের পাশে ব’সে বিয়ার বা হুইস্কি খাবে, নেচেও উঠবে পশ্চিমি তালে, এবং এক সময়, এগারোটা বাজার আগেই, সোফায় মাথা নিচু করে বসে বমি চাপার চেষ্টা করে চলবে। তখন তাকে আরো রূপসী দেখাবে, তার শরীর থেকে আরো তীব্র আবেদন গলে পড়তে। থাকবে। দারোয়ান মুলদরোজা খুলে দিলো, রাশেদের মনে হলো সে এক রূপসীর ভেতরে ঢুকছে, তবে এমন হেঁটে ঢোকা মানাচ্ছে না, রূপসী তাতে সুখ পাচ্ছে না; যদি তার একটি গাড়ি থাকতো, সে গাড়িটি ধীরে ধীরে চালিয়ে ভেতরে ঢুকে পশ্চিমে যেখানে ঘন সবুজের মধ্যে লাল লাল ফুল ফুটে আছে, সেখানে পার্ক করতো, তাহলে দারুণ পুলকে কেঁপে কেঁপে চিৎকার করে উঠতো রেস্টহাউজরূপসী। সে ঢুকছে হেঁটে, রেস্টহাউজটি তা বুঝতেই পারছে না, এতে রাশেদ একটু অসহায় বোধ করলো। স্বাধীনতা যে মানুষকে বিকশিত করে এ-রেস্টহাউজটিকেই তার উদাহরণ বলে মনে হয় রাশেদের; সে কখনো এমন একটা ভবনের কথা ভাবতেও পারে নি, কিন্তু বাঙালি তা। বাস্তবায়িত করেছে বলে-হয়তো ব্যাংক থেকে টাকা চুরি করেই বাস্তবায়িত করেছে, কিন্তু তাতে কী আসে যায়-বাঙালি যে এর স্বপ্ন দেখেছে এবং একে বাস্তবায়িত করেছে, সেজন্যে বাঙালিকে, তার স্বাধীনতাকে সে অভিনন্দন জানালো, যেমন জানিয়েছে আগেও, যখনি সে পান করতে এসেছে আবদেলের এখানে। স্বাধীনতায় বাঙালি মুসলমানের ত্বক খুব মসৃণ আর স্পর্শকাতর হয়েছে, বঙ্গীয় গরম ওই ত্বক আর সহ্য করতে পারে না, এটাও সভ্যতার পরিচায়ক; ভাবতে ভালো লাগে রাশেদের এটার স্বাপ্নিক যে, তার। বাপদাদা হয়তো বোশেখ মাসে বোরোখেতে খালি গায়ে রোদে জমি নিডোতে নিডোতে গামছা দিয়ে বারবার গা মুছতো, বাড়ি ফেরার পথে পুকুরে ডুব দিয়ে গামছা পরেই। বাড়ি ফিরতো, আর তার উত্তরপুরুষ, স্বাধীন উত্তরপুরুষ, এখন ওই অসভ্যতা থেকে কতো দূরে। রেস্টহাউজটি তরুণীর মাংসের মতো শীততাপনিয়ন্ত্রিত। আবদেলের বয়স আটচল্লিশ বা পঞ্চাশ হবে; সে পানের জন্যে, রাশেদের মতো দু-একজন ছাড়া, ডাকে। সাধারণত আঠারো থেকে পঁচিশ বছরের তরুণতরুণীদের, যারা পান করার ব্যাপারটিকে প্রফুল্লকর করে তোলে। তরুণতরুনীদের দেহও অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর, ওদের পাশে বসলে গোপনে জীবন ঢুকতে থাকে দেহে, যেমন শেকড় বেয়ে গাছের শরীরে রস ঢোকে। কয়েক বছর আগে রাশেদ এক বুড়োর সাথে গল্প করে বিকেলের পর বিকেল কাটাতো, একদিন সে বুঝতে পারে বুড়োটি নিঃশব্দে তাকে খাচ্ছে, তার ভেতর থেকে রস শুষে নিচ্ছে, পর দিন থেকেই সে বুড়োটির সাথে দেখা করা বন্ধ করে দেয়। কয়েক দিন। পরই রাশেদ খবর পায় বুড়োটির খুব অসুখ হয়েছে, হয়তো বাচবে না; কিন্তু রাশেদ। তাকে দেখতে যায় নি, তা ভয় হতে থাকে বুড়োটি শয্যায় শুয়ে শুয়ে তাকে শুষে নিঃশেষ করে ফেলবে। রাশেদও শুষতে শিখেছে, সে যখন তরুণতরুণীদের সঙ্গ পায়, যদিও তার বয়স ছত্রিশ, সে নিঃশব্দে শোষণ করে তরুণতরুণীদের। কোনো তরুণতরুণী যতোটা জীবন নিয়ে তার কাছে আসে ততোটা জীবন নিয়ে আর ফিরতে পারে না। বসার ঘরে ঢুকেই মুগ্ধ হলো রাশেদ, এতো সুন্দর তরুণতরুণী সে একসাথে অনেক দিন দেখে নি, গাছপালার বাইরে বাঙলাদেশে যে আজো এমন সৌন্দর্য রয়েছে, তার অনেক দিন তা মনেই হয় নি; রাস্তায় আর তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তরুণতরুণীদের দেখে সে ধরে নিয়েছিলো সৌন্দর্য ছেড়ে গেছে দেশটিকে। দশ বারোটির মতো তরুণতরুণী সোফা ও মেঝেতে বসে আছে, খিলখিল করে হাসছে, মেয়েরাই খিলখিল করছে বেশি, গড়িয়ে পাশের তরুণের গায়ে ঝরে পড়ছে, তাদের চুল বাহু গাল চিবুক থেকে সৌন্দর্য ঝরছে। বাদ্য বাজছে, দু-তিন জোড়া তরুণতরুণী নাচছে, তাদের আন্দোলন ও আলিঙ্গন সারা ঘরে অসম্ভব সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। চোখে এসে। আগুনের মতো ঢুকছে তাদের পোশাক, পোশাক উপচে এসে চোখে ঢুকছে তাদের মাংস; বিশেষ করে মেয়েদের বাহু ও বুকের তাতাথৈথৈ সারা ঘরটিকে উত্তেজনায় টানটান করে তুলেছে। আবদেল একটা বড়ো রকমের সংবর্ধনা জানালো রাশেদকে, এটা আবদেলের আরেকটা গুণ, সে মানুষের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয় সহজে।
হুইস্কি আর বিয়ারের ব্যবস্থা করেছে আবদেল; যার যা পছন্দ তুলে নিয়ে উফুল্ল হওয়ার অনুরোধ জানালো সে। একটি বিয়ারের ক্যান ভেঙে রাশেদ গেলাশে ভরলো, তাকিয়ে রইলো উপচানো ফেনার দিকে, বিয়ার উপচে পড়ার দৃশ্য সে উপভোগ করে সব সময়, জীবনপাত্র উচ্ছলিত হওয়ার চিত্রকল্পটি তার মনে পড়ে, সোনালি রঙটিও তার খুব পছন্দ। তরুণতরুণীরা নিজেদের পছন্দমতো হুইস্কি ও বিয়ার নিয়ে সোফায় আর মেঝেতে বসলো, খুব পিপাসাগ্রস্ত তারা, গলা ফেটে বিলের মাটির মতো চৌচির হয়ে আছে; একটি তরুণী নেচে নেচে গিয়ে বসলো আবদেলের কোলে। নাচতে সে যতোটা শিখেছে তার চেয়ে অনেক সুন্দরভাবে শিখেছে কোলে বসতে, জড়িয়ে ধরতে; কার কোলে বসতে হবে, তাও চমৎকার শিখেছে। এ-তরুণীদের সাথে আবদেলের সম্পর্ক। চমৎকার, সে যে-কাউকে জড়িয়ে ধরতে পারে, ধরেও; তারা কিছু মনে করে না, খুশি। হয় একটু বেশি করে, তাদের প্রেমিকেরাও খুশিতে বিহ্বল হয়ে ওঠে। যে এমন পানের সুযোগ দিচ্ছে তাকে এটুকু দিতে তরুণদের বাধছে না, তরুণীরা তো দিতেই উৎসাহী। রাশেদের ভালো লাগলো যে বাঙলার ছেলেমেয়েরা এগিয়েছে, স্বাধীনতাই নিশ্চয়ই। এগিয়ে দিয়েছে, পানটান আর জড়িয়ে ধরা, আর গালে বা চিবুকে বা গ্রীবায় একটু ভেজা চুমোকে তারা আর পাপ মনে করে না, তারা তাদের বাপদাদার অপরাধবোধের মধ্যে নেই। ওই যে-মেয়েটি হাঁটছে আর খাচ্ছে, খোঁপার মতো যার বুক দুটি, তার পুরুষ বন্ধুদের নিয়ে ঘরে ঢুকতেই সে চিৎকার করে উঠবে না, মদ লইয়া আইছ, লগে লোচ্চাগোও লইয়া আইছ। মেঝেতে বসে যে-মেয়েটি হুইস্কির গেলাশে চুমুক দিচ্ছে, ওর ঠোঁটের বাঁক দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও খুব সুখ পাচ্ছে, ও কি বাসায় গিয়ে স্বীকার করবে ও হুইস্কি খেয়েছে? নাকি যখনই আজকের কথা কাউকে বলবে, তখনি বলবে আবদেলের এখানে যারা এসেছিলো তারা সবাই মদ খেয়ে চুর হয়ে গিয়েছিলো, শুধু সে একাই খেয়েছিলো কোমল পানীয়। মদদ সে একদম সহ্য করতে পারে না, কোমল। পানীয়ই তার প্রিয়। সে কি বলতে পারবে হুইস্কি সে পছন্দ করে, হুইস্কিতে খারাপ কিছু নেই? নাকি সেও হবে সেই মাগিটার মতো যে দূতাবাসগুলো চষে বেড়ায়, সব ধরনের বোতল চুষতে চুষতে শেষে দুটি ষাঁড়ের কাঁধে চড়ে বাসায় ফেরে বা ফেরে না, এবং পত্রিকায় গল্পগুজবের পাতায় লেখে পার্টিতে সে শুধু খায় একটু কোমল পানীয়, মদটদ সে একদম সহ্য করতে পারে না? রাশেদের পাশে বসেছে এক ঝকঝকে তরুণ, দাড়িও রেখেছে ঝকঝকে, তাতে তার ঝকঝকে ভাবটা আরো বেড়েছে। তার পাশে বসেছে। যে-মেয়েটি, সে নিশ্চিত তার প্রেমিকা; তারা হাত ধরে থাকছে, একটু বউ বউ ভাবও করছে মেয়েটি, ছেলেটিও একটু স্বামী স্বামী ভাব করছে। মেয়েটি কী খাচ্ছে? বিয়ার? বেশ, কিন্তু যখন এ-বালকের বউ হবে সে, তখন খেতে পারবে তো? বালক তাকে খেতে দেবে তো? নাকি তখন এ-বালক টানবে, বছর বছর মেয়েটির পেট বোঝাই করবে, মেয়েটি পানি ছাড়া কিছু ছোঁবে না, আর বালকটি বন্ধুদের নিয়ে ঘরে ঢুকলেই চিৎকার করবে, মদ লইয়া আইছ, লগে লোজাগোও লইয়া আইছ। টেলিভিশনে আজান শোনা গেলো, আজান শুনলেই রাশেদের কায়কোবাদকে মনে পড়ে, কে মোরে শুনাইল মধুর আজানের ধ্বনি। ছেলেদের কোনো বদল ঘটলো না, মনে হলো না কেউ উঠে গিয়ে অজু করতে শুরু করবে, জায়নামাজ খুঁজবে; কয়েকজন টেলিভিশনে ওই মধুরধ্বনি শুনতে শুনতে গেলাশ ভরলো। তাদের মর্মেমর্মে বেজে চলছে অন্য সুর; কিন্তু মেয়েরা। ঘোমটা দেয়ার জন্যে পাগল হয়ে উঠলো। জিন্সের সাথে তারা ওড়নাও পরে? বাজারে কি এরই মধ্যে ওড়না-জিন্স বেরিয়ে গেছে? ব্যাগে তারা বহন করে ঘোমটা? একটি মেয়ে মাথায় দেয়ার মতো কিছু জোগাড় করতে পারে নি, সে নিজের স্তন দুটি টেনে মাথায় তুলে দিতে চেষ্টা করছে। ধর্ম ও পানের মধ্যে মিলন ঘটিয়েছে তারা, হুইস্কি ও ঘোমটায় কোনো বিরোধ নেই; তারা ঘুমাবে কিন্তু সতীত্ব বিসর্জন দেবে না। হুইস্কির কাজ হুইস্কি করবে, ঘোমটার কাজ করবে ঘোমটা। অন্ধ ধরনের একটি লোক ইসলাম, আল্লা, ও আরো অনেকের মহিমা আবেগে মেতে বর্ণনা করতে লাগলো টেলিভিশনের পর্দা জুড়ে, তাকে দেখেই বোঝা যায় শোবিজ কতো প্রতাপশালী, ধর্মও শোবিজ হয়ে উঠেছে। ধর্মকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হলে শোবিজ ছাড়া উপায় নেই।-আচ্ছা বলুন। তো, রাশেদ আবদেলকে জিজ্ঞেস করলো, আল্লা কি এ-লোকটিকে পছন্দ করতে পারে? তার কথা শুনে সবাই টেলিভিশনের দিকে ভালো করে তাকালো। লোকটির মুখ ভরে কালো কালো দাগ, বড়ো বড়ো গর্ত, গালের পাশটা যেনো ছুরি দিয়ে ফালা করে কেটে নেয়া হয়েছে, কপালটা কালো ঝামা, আর সে চোখ দুটি ওপরে নিচে এমনভাবে নামাচ্ছে উঠোচ্ছে যে তাকে অন্ধ মনে হচ্ছে, তবে সে অন্ধ নয়। সে নিশ্চয়ই ভিডিওখোর, হিন্দি কোনো ক্যাসেট হয়তো বাকি রাখে নি। সে আবৃত্তি করে চলছে অতিশয়োক্তি, যে কেউ যা কেয়ামত পর্যন্ত, ঘিলু ছাড়াই, আবৃত্তি করে যেতে পারে। আবদেল বললো, আমি নিশ্চিত আল্লা একে পছন্দ করতে পারে না, প্রভুর নিশ্চয়ই সৌন্দর্যবোধ রয়েছে। আবদেল তার কোলের তরুণীটির মুখ সকলের দিকে তুলে ধরে বললো, সৌন্দর্যবোধ থাকলে প্রভু পছন্দ করবে একে। সবাই হেসে উঠতে যাচ্ছিলো, তার আগেই রাশেদের পাশের ছেলেটি চিৎকার করে উঠলো, আল্লারে লইয়া আমি ফাঁইজলামি পছন্দ করি না।। দ্যাখেন ইসলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম। তার চিৎকারে চমকে উঠলো সবাই, খুব বিব্রত হয়ে পড়লো তার পাশের মেয়েটি, যে হয়তো তার প্রেমিকা; আবদেলও খুব বিব্রত বোধ করলো। একটি মেয়ে বললো, ইসলাম নিয়ে ফাজলামো আমিও পছন্দ করি না। আমি মুসলমান, ইসলাম যে শ্রেষ্ঠ ধর্ম তাতে কোনো প্রশ্নই থাকতে পারে না। চোদ্দো শো বছর আগে ইসলামই প্রথম নারীদের মুক্তি দিয়েছিলো। রাশেদ চোখের সামনে একটি মুক্ত নারী দেখতে পেয়ে মুগ্ধ হলো, যে চোদ্দো শো বছর ধরে মুক্ত, চোদ্দো শো বছর ধরে যে হুইস্কি খাচ্ছে, জিন্স পরছে, নাচছে। হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো রাশেদ, সময় দেখার জন্যে নয়, শতাব্দী দেখার জন্যে; তার ঘড়িটিতে সেকেণ্ড মিনিট ঘণ্টা দিন মাস। বছর সব ধরা পড়ে, খুব দুঃখ হলো তার যে এটিতে শতাব্দী ধরা পড়ে না। একটু পরেই সে-বালকটি, যে আল্লাকে নিয়ে ফাজলামো পছন্দ করে না, সোফা থেকে গড়িয়ে পড়লো, ভক ভক করে বমি করতে লাগলো। সে এরই মাঝে পাঁচ ছটি বিয়ার আর চার পাঁচটি হুইস্কি শেষ করে দিয়েছে, রাশেদের দ্বিতীয়টিও তখন শেষ হয় নি। বমিতে সে কার্পেট ভাসিয়ে দিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইলো, তাকে টেনে অন্য ঘরে সরিয়ে নিলো আবদেল। সবাই আবার পান করতে লাগলো, আর সে-মেয়েটি যে এর বউ হবে সে খুব অপরাধী। বোধ করতে লাগলো, পান না করে সে মেঝে পরিষ্কার করতে লাগলো। ওই শ্রেষ্ঠ ধার্মিক পান করবে, পান করতে করতে চিৎকার করবে, দ্যাখেন ইসলাম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ। ধর্ম, আর মেয়েটি সারাজীবন ওই ধার্মিকের বমিই পরিষ্কার করে চলবে।
বাসায় ফিরে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলো রাশেদ, তার চোখের পাতায় ভিড় করছিলো তরুণ মুসলমান বাঙালিরা, স্বাধীনতার শস্য ও দেশের ভবিষ্যতেরা, জিন্স পরে হুইস্কি বিয়ারের গেলাশ হাতে যারা মধ্যযুগে ফিরে গেছে। রাত একটার মতো হবে, কলিংবেল বেজে উঠলো; রাশেদ শুনতে পেলো এক লোক জোরে জোরে বলছে, স্যার, আমরা। থানা থেকে এসেছি, আমি ওসি স্যার, একটু ওঠেন, আপনার সাথে একটু কথা আছে স্যার। থানা? তার সাথে থানার কী কথা থাকতে পারে? ঢাকা শহরে অনেক থানা আছে বলে রাশেদ শুনেছে, না থাকলেই ভালো হতো বলেও শুনেছে রাশেদ, কিন্তু কী সম্পর্ক তার থানার সাথে? থানায় কি খবর পৌঁছে গেছে যে রাশেদ আজ পান করেছে, হুইস্কি ও বিয়ার দুটোই, এবং মাঝেমাঝে পান করেছে তরুণীদের বাহু গ্রীবা স্তন থেকে গলে পড়া আবেদনঃ একটি মেয়ের গ্রীবা সে আজ একটু বেশি করেই পান করেছে, তাতে একটু মত্ততাও এসেছিলো, এ-সংবাদ কি থানায় পৌঁছে গেছে? রাশেদ হাত বাড়িয়ে দেখে। নিলো সে বাসায় শুয়ে আছে কিনা, পাশের নারীটি তার বউ কিনা, নাকি সে রাস্তায় মদ খেয়ে মাতলামি করে চলছে, পুলিশ তাকে তুলে নিতে এসেছে। না, এটি তার শয্যাই, ডোরাকাটা বালিশটিও তারই, পাশের নারীটিও তার স্ত্রীই, পরস্ত্রী নয় বেশ্যাও নয়, এবং আজ রাতে তার সাথে সে বৈধ বা অবৈধ কিছুই করে নি। তাহলে কি তার মুখ থেকে খুব গন্ধ বেরোচ্ছে, যা থানা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে, যেহেতু সে পেয়ারাপাতা চিবোয় নি? সামরিক আইনের শুরুর দিকে সব ব্যাটা বড়ো বেশি দায়িত্বশীল হয়ে পড়ে, পুলিশ। একটু বেশি করেই দায়িত্বশীল হয়, ঘুষও নিতে চায় না, নিলে পাঁচ গুণ বেশি নেয়। ঝুঁকি বেশি। সে মদ খেয়েছে, এটা পুলিশ জেনে গেছে, এতে একবার তার খুব শ্রদ্ধা হলো পুলিশের প্রতি। এমন পুলিশ থাকলে শ্রেষ্ঠ ধর্মের কোনো ভয় নেই, দেশের ভয় নেই, তবে পুলিশ কি খায়টায় না? শুধু ঘুষ খায়? মদ ছোয়ও না? রাশেদ দরোজায় এসে জিজ্ঞেস করলো, কে? ওসিটি অত্যন্ত বিনীত, সম্ভবত আইস্ক্রিম দিয়ে তৈরি, গলে গলে সে বলতে লাগলো, স্যার, এতো রাতে আপনাকে ডিস্টার্ব করছি বলে দুঃখিত। স্যার, আমরা তেতলার ফ্ল্যাটটা চেক করবো স্যার, ওখানে অবৈধ কাজ হয় স্যার, আমাদের সাথে একটু থাকতে হবে আপনাকে, স্যার। অবৈধ কাজ? কাকে বলে অবৈধ কাজ? পুলিশ যে তাকে এতো রাতে ডেকে তুলেছে, এটা বৈধ? ভাঁড়রা দেশ দখল করেছে, এটা বৈধ? অবৈধ কাজ, অর্থাৎ তাদের তেতলার ফ্ল্যাটে পতিতাবৃত্তি চলছে? অর্থাৎ অবৈধ সঙ্গম চলছে? মাস তিনেক ধরে ওরা আছে, অথচ একবারও রাশেদের সন্দেহ হয় নি। তিন মাস ধরে এ-দালানটি এক নবযুগের মধ্যে বাস করছে, উল্লাসের মধ্যেও, দালানটির শ্ৰেণীউত্তরণই ঘটে গিয়েছিলো, এটা ভালোই লেগেছে রাশেদের। আগে গাড়ি করে এ-দালানে কেউ আসতো না বা সপ্তাহে এক-আধটি গাড়িতে আসতো কারো না কোনো দূরসম্পর্কিত আত্মীয়, এতে তো খারাপই লাগতো তার, মনে হতো বস্তিতে। পড়ে আছি, দালানে একটাও উন্নত বাঙালির পদধুলি পড়ছে না; আর ওরা আসার পর গাড়ি আসছিলো আর যাচ্ছিলো, বেবি আসছিলো আর যাচ্ছিলো, আসছিলো আর যাচ্ছিলো সুন্দর সুন্দর বালিকারা আর পুরুষেরা। ওদের সম্পর্কে কোনোই সন্দেহ হয় নি তার, শুধু একদিন তার বন্ধু জহির তেতলার জানালার পর্দার আয়তন দেখে বলেছিলো, তোমাদের তেতলায় নিশ্চয়ই পর্দানসিনেরা এসেছে। বাড়িঅলার খচ্চর ঘরজামাইটা, যে দিনরাত অজু করে সামনের কলে, সে তো দাঁড়িয়েই থাকতো ওদের জন্যে, দেখলেই, আফা, ভাল আছেন ত বলতে বলতে পেছনে পেছনে হটতো, কোর্টে যে চোরের জামিন হয় বলে রাশেদ শুনেছে, সেও বুঝতে পারে নি কিছু? বেশ্যা ধরতে রাশেদ পুলিশের। মতো তেতলায় উঠবে? পুলিশকে কি সে বেশ্যাদের থেকে বেশি বৈধ মনে করে? আর। ওরা আছে বলেই তো সেদিন তার এক বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেলো, যার সাথে এক দশক ধরে দেখা নেই, যে খুব উন্নতি করেছে, দুটি কারখানা দিয়ে শিল্পপতি হয়েছে, যে বিশাল গাড়ি নিয়ে ঢুকেছিলো ভেতরে। সে বললো যে তেতলায় বোনের সাথে দেখা করতে এসেছে; তবে সে একা আসে নি, সঙ্গে তার এক বন্ধু ছিলো, যে একটি ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক। রাশেদ পুলিশের সাথে তেতলায় উঠলো, পুলিশেরা অনেকক্ষণ ধরে দরোজা খোলার জন্যে চিৎকার করলো, একসময় এক নারী দরোজা খুলে ওসিকে বললো, আপনি আবার জ্বালাতন করতে এলেন? আপনাকে তো দিচ্ছিই। ওসি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো, রাশেদ পুলিশের সাথে ভেতরে ঢুকলো। একটি সোফায় বসে আছে বছর ষাটেকের একটি লোক, অবাঙালি, আরেকটিতে এক বাঙালি, অত্যন্ত সুদর্শন, চল্লিশের মতো বয়স। একটি যুবক পুলিশ দেখেই দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে চিৎকার করতে লাগলো, আমারে মাপ কইরা দ্যান, আমি নতুন বিয়া করছি, আমারে মাপ কইরা দ্যান, আমি নতুন বিয়া করছি। যুবকটির জন্যে খুব দরদ বোধ করলো রাশেদ; আহা, চাইলে সে এখন, রাত দুটোর সময়, ঘুম থেকে জাগিয়ে বা না জাগিয়ে নতুন বউয়ের সাথে আরেকটি সঙ্গম করতে পারতো, কিন্তু সে এখন পায়খানায় ঢুকে কাঁদছে, বহুদিন আর সুযোগ পাবে না। পাশের ঘরে তিনটি সুন্দর বালিকা, মোলো সতেরো বছর হবে, প্রায় নগ্ন বসে আছে। এ-বালিকা তিনটিকে রাশেদ বহুবার উঠতে নামতে দেখেছে, মুখে। ইংরেজিও শুনেছে, ওদের প্রায় নগ্ন শরীর দেখে একবার কেঁপে উঠলো রাশেদ। ওসি অশ্লীল ভাষায় ব’কে চলছে সবাইকে, বিশেষ করে বাড়িঅলিকে। বাড়িঅলিকে অনেক শ্লীল মনে হলো ওসির, থেকে, সে চলতি বাঙলাই বলছে, ইংরেজিও বলছে। এখন যদি ভোট হয়ে যায় তাহলে রাশেদ কাকে ভোট দেবে, বাড়িঅলিকে, ওই মেয়ে তিনটিকে, না ওসিকে? না, ওসি তার ভোট পাবে না। বুড়োটা বাঙলা-ইংরেজি-উর্দু মিশিয়ে জানালো। সে এক পাকিস্থানি জাহাজের ক্যাপ্টেন। এ-বুড়োটার সাথেই শুয়েছিলো হয়তো ওই। বালিকাদের একটি, বা দুটি, বা তিনটিই; রাশেদের রক্ত খসখস করতে লাগলো। বাঙালি মেয়েরা নিগ্রো হটেনটট জুলু বুশম্যান যার সাথে ইচ্ছে ঘুমুক, রাশেদের আপত্তি নেই; কিন্তু পাকিস্থানির সঙ্গে ঘুমটা তার রক্তে কামড় দিলো। সুদর্শন লোকটির বসার ভঙ্গি দেখেই একটু দমে গিয়েছিলো ওসি, তাকে একবার প্রশ্ন করেই থেকে গেলো। সে শক্তিমান কেউ হবে, হয়তো ছোটোখাটো কোনো ভড় হবে, তাকে বেশি প্রশ্ন করা ঠিক নয়। ওসি অশ্লীল গালি দিয়ে চলছে বাড়িঅলিকে, শক্তির ভাষা এখানে অশ্লীল হতেই হয়। রাশেদ বললো, ওসি সাহেব, আপনি এমন গালাগালি করছেন কেননা? এদের নিয়ে যেতে চাইলে নিয়ে যান। তার কথায় বিস্মিত হলো ওসি, সে এমন আশা করে নি; সে। ভেবেছিলো রাশেদ মুগ্ধ হবে তার গালাগালিতে, তার নৈতিকতা রক্ষার পদক্ষেপকে প্রশংসা করবে, উল্লাসে রাশেদও দু-একটি গালি দেবে। সুদর্শন লোকটি এক সময়। বললো, আমাদের কোথায় নেবেন, চলুন। তারা সবাই পুলিশের সাথে বেরিয়ে গেলো।
স্টেডিয়ামে একটা কাজ পড়েছে রাশেদের, মাঝেমাঝেই আসতে হচ্ছে। একটা যন্ত্র কিনেছিলো, দোকানদার যন্ত্রটির গুণ গাইতে গাইতে রাশেদকে অপরাধী করে তুলেছিলো; রাশেদের মনে হয়েছিলো গুণাধিরাজকে না কেনা বিশ্বাসঘাতকতা হবে, কেননা দোকানদার রাশেদকে দেখেই বিশ্বাস করে ফেলেছিলো রাশেদ যন্ত্রটা কিনবে; কিন্তু কেনার কয়েক দিন পরই সেটি নষ্ট হয়ে যায়। রাশেদের কাজ পড়েছে দোকানে এসে খোঁজ করা ওটি সারাই হয়েছে কিনা। আজও হয় নি, দোকানদার জানিয়েছে। শিগগিরই হবে, এটা এক বড়ো ধরনের আশার কথা। আশাই হতভাগ্যদের, বাঙালির, বাঁচার প্রেরণা। রাশেদ এখন কোথায় যাবে? যাওয়ার জায়গা বেশি নেই দেশে, আর। রাশেদের যাওয়ার জায়গা খুবই কম। আবদেলকে দেখে গেলে কেমন হয়? তার অফিস বেশি দূরে নয়, চৌরাস্তা পেরিয়ে কিছুটা পুবে গিয়ে একটা পাঁচতলায় উঠতে হবে। আবদেল অনেক দিনই বলেছে অফিসে যেতে, আজো যেতে পারে নি রাশেদ, আজ গেলে কেমন হয়? রাশেদের যেতেই ইচ্ছে করছে, যন্ত্রটি গোপনে গোপনে যে-যন্ত্রণা। দিচ্ছে, আবদেলের ওখানে গেলে তার বিষ একটু কমতেও পারে। আবদেলের অফিসে ঢুকে মুগ্ধ হলো রাশেদ, বসার ঘরের কার্পেটে পা রাখতেই তার দ্বিধা হচ্ছিলো, নিজেকে মনে হচ্ছিলো নিজের পূর্বপুরুষ, যে পাটখেত নিড়োতে নিড়োতে সারা গায়ে মাটি মেখে এখানে ঢুকে পড়েছে। তার স্যান্ডলে নিশ্চয়ই মাটি লেগেছে। এ-কার্পেট নিশ্চয়ই। মাটিলাগা স্যাভলেরর জন্যে নয়;-স্বাধীনতা, তুমি বাঙালি মুসলমানকেও কেমন উন্নত ও বিকশিত করো। একটি লোক জানালো, স্যার ভেতরে ব্যস্ত, রাশেদকে একটু বসতে। হবে। এমন অফিস যার, তাকে অবশ্যই ব্যস্ত থাকতে হবে, ভেতরে ব্যস্ত থাকতে হবে বাইরে ব্যস্ত থাকতে হবে। বসে থাকতে চমৎকার লাগছিলো রাশেদের, আবদেল ভেতরে ব্যস্ত থাকুক, তার নিজের কোনো ব্যস্ততা নেই। কিছুক্ষণ পর আবদেলের ঘরের দরোজা ঠেলে একটি তরুণী বেরোলো, সুগন্ধে ভরে উঠলো পৃথিবী, সে প্রজাপতির। মতো উড়ে উড়ে বেরিয়ে গেলো। ওই তরুণীর একজোড়া পা না থেকে একজোড়া পাখনা থাকলেই ভালো হতো। আবদেল কতোক্ষণ ব্যস্ত ছিলো? এমন প্রজাপতি ঘরে ঢুকলে কতোক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয়? আবদেল কতোক্ষণ ব্যস্ত থাকতে পারে? লোকটি রাশেদকে ভেতরে যেতে বললো। রাশেদকে দেখে উল্লাসে ফেটে পড়লো আবদেল; এটা তার গুণ, যেনো তারই জন্যে অপেক্ষা করছিলো আবদেল। কফি, সামরিক আইন, দশটা টেলিফোন, বিলেত, অর্ক, বাঙলাদেশ, সমাজতন্ত্র প্রভৃতিতে আপ্যায়িত হয়ে রাশেদ। যখন উঠবে, আবদেল তার হাতে বেনসনের একটি প্যাকেট দিয়ে বললো, এটা আপনার জন্যে। আবদেল যেভাবে দেয়, তাতে বিনয়েও না করা যায় না। রাশেদ নেমে রিকশা। নিলো। রিকশাটি যখন বায়তুল মোকাররমের উত্তর দিয়ে চলছে, তখন তার ইচ্ছে হলো একটি সিগারেট খেতে। আবদেলের দেয়া সিগারেট প্যাকেট খুলেই সে চমকে উঠলো, ভেতরে এটি কী? কোনো গোলাপি সাপ? আবদেল প্যাকেটে গোলাপি পাতলা মসৃণ। সাপটি ঢুকিয়ে তার হাতে তুলে দিয়েছে। প্যাকেটটি রাশেদের হাত থেকে পড়ে। যাচ্ছিলো, তাড়াতাড়ি পকেটে রাখলো। আবদেল কী ব্যবহার করে? রাজা? রেক্সঃ আবদেল নিশ্চয়ই ব্যস্ত ছিলো প্রজাপতিটির সাথে; তার উত্তপ্ত ব্যস্ততা সে’ ঢেলে দিয়েছে মসৃণ সাপের খোলশে, আর খোলশটি, যার ভেতরে আবদেলের ব্যস্ততা তরল ঠাণ্ডা হয়ে আছে, তুলে দিয়েছে রাশেদের হাতে। আবদেলের কমোডের ফ্ল্যাশ নিশ্চয়ই কাজ করছে না। নামাজিরা বেরিয়ে আসছে, তারা যদি টের পায় তার পকেটে রয়েছে একটি মসৃণ গোলাপি সাপের খোলশ? খোলশের ভেতরে রয়েছে তরল ঠাণ্ডা ব্যস্ততা? তারা পাথর। ছুঁড়তে শুরু করবে। তাদের পকেটে নাকি সব সময় পাথর থাকে, ঢিল থাকে, সাপের। মাথা ঘষার জন্যে। জলপাইরঙের ট্রাক আসছে কয়েকটি, ট্রাকগুলো কি টের পেয়ে গেছে যে তার পকেটে সাপ রয়েছে? না, টের পায় নি; শাই শাই করে ট্রাকগুলো চলে। গেলো। প্যাকটটি খুঁড়ে ফেলে দেবে রাস্তায় রাস্তায় পড়েই যদি প্যাকেট খুলে যায়, ভেতরের সাপ লাফিয়ে বেরোয়, আর মাথা দোলাতে থাকে, মাথা দোলাতে থাকে, মাথা দোলাতে থাকে লোকজন কি তখন সাপের খেলা দেখবে? ডাস্টবিন দেখা যাচ্ছে একটা, ময়লা উপচে পড়ছে, রিকশা থামিয়ে রাশেদ ডাস্টবিনে ফেলে আসবে সাপের বাক্সটি। সবাই সন্দেহ করবে না? এদেশে ডাস্টবিনে কেউ কিছু ফেলে না, সে যদি রিকশা থেকে। নেমে যত্নের সাথে ডাস্টবিনে প্যাকেটটি ফেলে, তখন রিকশাঅলাও তাকে সন্দেহ করবে, মনে করবে সে কোনো বোমা পুঁতে যাচ্ছে। সেগুনবাগিচাটা নির্জন, সেখানে পথের পাশে প্যাকেটটি ফেলার সুযোগ মিলতেও পারে। রাশেদ রিকসাঅলাকে সেগুনবাগিচায় ঢুকতে বললো; কিন্তু না, দেশের বারো কোটি বাঙালি হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান বোধ হয়। টের পেয়ে গেছে তার পকেটে সাপের বাক্স আছে। সাপের খোলশে রয়েছে তরল : ব্যস্ততা। তারা অনেক দিন সাপের খেলা দেখে নি, আজ খেলা দেখতে চায়। রাশেদ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনে রিকশা থেকে নামলো, ভাবলো উদ্যানের কোনো। ঝোঁপের ভেতরে সাপটি ছেড়ে দেবে, সাপটি একেবেঁকে কোনো খোড়লে ঢুকে পড়বে; কিন্তু একটি ঝোঁপের কাছে যেতেই দেখলো এক যুবক খুব ব্যস্ত কাজ করে চলছে এক যুবতীর শুনাঞ্চলে। সে এমনভাবে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে ব্লাউজের ভেতর দিয়ে যে যুবতীটির দম বন্ধ হয়ে আসছে, কিন্তু সে কাজ করে চলছে, কাজই এখন সত্য তার জীবনে; সুন্দর বিকল্প বের করেছে ছেলেটি, সাপের কাজ করে চলছে হাত দিয়ে, ভেতরে ভেতরে সে খুব ব্যস্ত। এ-যুবক কততক্ষণ ধরে এমন ব্যস্ত। ও সাপ দিয়ে ছো দিয়ে খোলশ বদলাতে পারে না? আবদেলের মতো ওর জায়গা নেই। ছেলেটির কাজ শিথিল হয়ে পড়লো, এলিয়ে পড়লো সে। তার ব্যস্ততা শেষ হয়ে গেছে, মেয়েটি একটা বড়ো দম নিলো; এর পর সে এ-কর্মী যুবকের সাথে বেরোনোর সময় ব্লাউজ খুলে। বাসায়ই রেখে আসবে। এখানে রাশেদ সাপটি ছাড়তে পারবে না। রাশেদ আরেকটি ঝোঁপের খোঁজে এগোতে লাগলো। ঝোঁপের ভেতর থেকে একটি লিকলিকে মিশমিশে লোক বেরিয়ে এলো, রাশেদের পাশে বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে ক্যালক্যাল করে জিজ্ঞেস করলো ছার, লাগবো? না, তার এখন কিছু লাগবে না; কিন্তু লোকটি ব্যবসা জানে, রাশেদকে দেখেই বুঝে ফেলেছে তার লাগবে। বললো, স্যার, টিভিস্টার, ফিলিমস্টার, পাচাজার ছার। রাশেদের এসব কিছু লাগবে না, তার দরকার একটি নীরব নির্জন ঝোঁপ, যেখানে সে সাপ ছাড়তে পারে। তার পকেটে এমন একটা সাপ, যেটা ফোঁসফাস করে না ঢুশঢাশ মারে না শুধু দুধভাত খায়। রাশেদ কি একটা বেবি নেবে, শহর পেরিয়ে গিয়ে নদীতে ফেলে আসবে সাপটি? কিন্তু সেটি যদি ভাসতে ভাসতে রাশেদের নাম। বলতে বলতে চলে আসে শহরে, গন্ধ শুকতে শুকতে এসে ঢুকতে চায় তাদের জানালা দিয়ে? ডাক দেয় রাশেদের নাম ধরে? রাশেদ উদ্যানে হাঁটতে লাগলো, হাঁটতে হাঁটতে দেখলো কয়েকটি নেতা জটলা পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ওরা কি সাপ ব্যবহার করতো? তখনো সাপ বেরোয় নি? তাহলে ওরা কী ব্যবহার করতো? কিছুই ব্যবহার করতো না? এজন্যেই আজো ওদের চেহারার মতো কাউকে কাউকে দেখা যায়? রাশেদের ইচ্ছে হলো বীররা কীভাবে ঘুমোয়, একটু দেখতে; তারা মাটির নিচে ঘুমিয়ে আছে, দেখা যাচ্ছে না, তবে ঘুম হচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে। আহা, তখন যদি সাপ বের হতো তাহলে আজ ওরা শান্তিতে ঘুমোতে পারতো; সাপের অভাবে কতো অশান্তিই না ভোগ করতে হয়েছে ওদের। রাশেদের হাতেই ছিলো প্যাকেটটি, কেউ দেখলে ভাববে সে সিগারেট বের করবে এখনি; সে সিগারেট বের করবে না, তার হাত কাঁপছে, তার হাতে সাপের বাক্স, কেঁপে কেঁপে হাত থেকে খসে পরলো প্যাকেটটি কারুকার্যের ওপর। একটি লোক আসছে দেখে সে প্যাকেটটি তোলার জন্যে হাত বাড়ালো; কিন্তু ভয়। লাগলো তার যে সাপটি ঢাকনা খুলে লাফিয়ে বেরিয়ে তাকে ছোবল দেবে। সে হাত টেনে পকেটে রেখে আস্তে আস্তে নিচে নামলো; কিন্তু দেখতে লাগলো পেছনে। কারুকার্যিত মেঝের ওপর সাপটি লাফিয়ে বেরিয়ে পড়েছে, এদিকে সেদিকে ফণা দোলাচ্ছে, আর ফণা দোলাচ্ছে।
“ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল” উপন্যাস বা কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
১. শেষরাতে বিল্পব এবং গুবরেপোকার দল
৩. মুসলমান ও মদ্য ও গোলাপি সাপ
৪. ঘোলা জল, বিড়ালি আর গোলাপ-মেয়ে
৫. তালিমারা মানুষ, ফাটলধরা মানুষ
৮. ২৩৫ ধর্ষণ, ৮৩টি আত্মহত্যা, ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
১১. গোলাপ-মেয়ের সাথে স্বর্গযাত্রা