২রা নভেম্বর ১৯৭৫ সাল। ব্রিগেডিয়ার খালেদ ও তার সঙ্গীরা প্রতিবিপ্লবী ক্যু’দাতা ঘটাবার চেষ্টা করে
সেই ক্রান্তিলগ্নে নিম্মী ছিল আমার পাশেই। সর্বদাই ও আমার সব দুঃখ-কষ্টের সমান ভাগীদার হয়ে থেকেছে। সব বিপদ-আপদের মোকাবেলা করতেও কুন্ঠিত হয়নি কখনো।
২রা নভেম্বর ১৯৭৫ সাল। গত বেশ কয়েকদিন কাজের চাপে বাসায় যাওয়া হয়নি। ঠিক করলাম দুপুরের পর কিছু সময়ের জন্য বাসায় যাব। প্ল্যান মাফিক লাঞ্চের পর এক ফাঁকে চলে এলাম মালিবাগে। বেশ কয়েকদিন বিরতির পর হঠাৎ আমার আগমনে বাসার সবাই খুব খুশী হল। সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া, হৈ-হুল্লোড করা হল আনন্দঘন পরিবেশে। সন্ধ্যায় নিম্মীকে নিয়ে গেলাম মিনু ফুপ্পুর বাসায়। রাতের খাওয়া ওখানেই খেতে হল। বেশ রাত অব্দি গল্প-গুজব করে আমি আর নিম্মী ফিরছিলাম মালিবাগে। হঠাৎ নিম্মী বলল, “আজ আমি তোমার সাথে বঙ্গভবনে থাকব৷” ১৫ই আগষ্টের পর থেকেই বেচারী ভীষণভাবে অবহেলিত। একদম সময় দিতে পারছিলাম না ওকে। বললাম, ঠিক আছে তাই হবে। দু’জনে ফিরলাম বঙ্গভবনে। সময় তখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। তেমন কোন ব্যতিক্রম চোখে পড়ল না। সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় আমার কামরার দিকে এগুচ্ছি, ডিউটিরত হাবিলদার এগিয়ে এসে বলল, “স্যার মেজর হাফিজ এবং ক্যাপ্টেন ইকবাল সাহেব বঙ্গভবন ছেড়ে চলে গেছেন। ১ম ইষ্টবেঙ্গলের গার্ড রিপ্লেসমেন্ট ও এখন পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি ঢাকা ব্রিগেড হেডকোয়াটার্স থেকে। সবাই আপনাকে খুঁজছেন। কর্নেল রশিদ, কর্নেল ফারুক এবং অন্যান্য সব অফিসাররাই প্রেসিডেন্ট সাহেবের সাথে বৈঠক করছেন।” আচমকা খবরটা পেয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু যেভাবে অবস্থা গড়াচ্ছিল তাতে এমন কিছু একটা ঘটতে পারে সেটা অপ্রত্যাশিতও ছিল না। বিগত দিনগুলোর ঘটনা প্রবাহের স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবেই ধরে নিয়েছিলাম সমস্ত ব্যাপারটাকে। নিম্মীকে কামরায় যেতে বলে দ্রুত গিয়ে হাজির হলাম প্রেসিডেন্টের স্যুইটে। প্রেসিডেন্ট সাহেব বেশ কিছুটা বিরক্ত এবং উত্তেজিতভাবে একটা সোফায় পা গুটিয়ে তার নিজস্ব স্টাইলে বসে তার পাইপে তামাক ভরছিলেন। কর্নেল রশিদ রেড টেলিফোনে কার সাথে যেন যোগাযোগের চেষ্টা করছিল। কর্নেল ফারুক আরেকটি সোফায় নিশ্চুপ বসেছিল। ঘরে ঢুকে প্রেসিডেন্টকে সালাম জানিয়ে কর্নেল রশিদের কাছে জানতে চাইলাম, ব্যাপার কি রশিদ, কি হয়েছে?
যা এতদিন সন্দেহের পর্যায়ে ছিল তাই হয়েছে। তোর দুই বন্ধু হাফিজ এবং ইকবাল ১ম ইষ্টবেঙ্গলের সব troops withdraw করে নিয়ে গেছে বঙ্গভবন থেকে। প্রথমে সবাই মনে করেছিলাম এটা routine replacement এর ব্যাপার। কিন্তু সন্ধ্যার পরও যখন replacement এসে পৌঁছালো না তখন থেকেই ক্যান্টনমেন্টে ফোন করে চীফ জেনারেল জিয়া, সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ, ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত কাউকেই কন্ট্যাক্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে খবর পাওয়া যাচ্ছে ক্যান্টনমেন্টে অস্বাভাবিক troops movements হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউই কিছু পরিষ্কার করে বলতে পারছে না ক্যান্টনমেন্টে কি ঘটছে। জেনারেল ওসমানীর সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছি কিন্তু তিনি ও সঠিক কিছু বলতে পারলেন না। তিনি বঙ্গভবনে আসছেন। জেনারেল ওসমানী ব্রিগেডিয়ার খলিলকে ইতিমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছেন বিডিআর-এর দু’টো রেজিমেন্ট বঙ্গভবনে পাঠিয়ে দিতে। হাফিজ এবং ইকবালকেও পাওয়া যাচ্ছে না টেলিফোনে। আমার সাথে কথা শেষ করে কর্নেল ফারুককে বলা হল রেসকোর্সে তার ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের কাছে চলে যেতে।
কর্নেল ফারুক রেসকোর্সে যাবার জন্য উঠে দাড়াতেই আমি বললাম, “ফারুক তুই অবশ্যই রেসকোর্সে যাবি তবে you would not move under any provocation or circumstances whatsoever. সব বিষয়ে পরিষ্কার হবার পরই আমাদের করণীয় কি হবে সেটা বিবেচনা করা হবে। এর আগে আমাদের তরফ থেকে কোন মুভ নেয়াটা যুক্তিসঙ্গত হবে না। প্রথমত : চেষ্টা করতে হবে এই সমস্যার সমাধান শান্তিপূর্ণভাবে করা যায় কিনা। এর জন্য আমি নিজেই যাব ক্যান্টনমেন্টে। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত অথবা আমার কোন কিছু না হওয়া পর্যন্ত no action at all, is that clear?” ইতিমধ্যে জেনারেল ওসমানীও এসে পৌঁছেছেন। তিনিও আমার অভিমতকে সমর্থন জানালেন। আমরা যথন আলোচনায় ব্যস্ত তখন বিডিআর-এর দু’টো রেজিমেন্ট এসে পৌঁছে গেছে সে খবর নিয়ে এল মেজর পাশা, মেজর শাহরিয়ার এবং ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা। নিম্মীই গিয়ে তাদের ঘুম থেকে ডেকে তুলেছিল। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মেজর শাহরিয়ার চলে গেল তার রেডিও বাংলাদেশের কন্ট্রোল সেন্টারে। ক্যাপ্টেন হুদা প্রেসিডেন্ট, জেনারেল ওসমানী এবং কর্নেল রশিদকে সাহায্য করার জন্য বঙ্গভবনেই থাকবে সেটাই সিদ্ধান্ত হল। বাকিরা সবাই প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট এবং ডেপ্লয়েড ইউনিটগুলোর কমান্ড নেবার জন্য যার যার পজিশনে চলে গেল। আমি বেরিয়ে আসছিলাম ঠিক সেই সময় কর্নেল রশিদ আন্তরিকভাবেই বলেছিল,
– ডালিম ভেবে দেখ, এই অবস্থায় ক্যান্টনমেন্টে যাওয়া ঠিক হবে কিনা?
সেই তরল অবস্থায় ক্যান্টনমেন্টে যাওয়াটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও তাৎক্ষণিক জবাব দিয়েছিলাম,
– এই ক্রান্তিলগ্নে দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে someone has to clean the dirty linen then why not me?
প্রেসিডেন্টের স্যুইট থেকে বেরিয়ে চলে এলাম আমার কামরায়। বেচারী নিম্মী অবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করে বেশ কিছুটা ঘাবড়ে গেছে। জিজ্ঞেস করল,
– এখন কি হবে? আমি বললাম,
– তুমি বঙ্গভবন ছেড়ে ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে কোন নিরাপদ জায়গায় চলে যাও । ঠিক বুঝতে পারছি না ঘটনা কোনদিকে মোড় নেয়। যাই হোক না কেন; বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে।
ড্রাইভারকে ডাকিয়ে এনে নির্দেশ দিলাম,
– বেগম সাহেবের হুকুম মত তার সাথেই থাকবে তুমি যতক্ষণ তিনি চান। নিম্মী কিছুক্ষণ ইতস্তত করে নিশী রাতে একা একা বেরিয়ে গেল একরাশ আশঙ্কা মনে নিয়ে অজানা ঠিকানার উদ্দেশ্যে।
যাবার সময় অশ্রুসিক্ত চোখে ধরা গলায় শুধু বলে গেল,
– আল্লাহর হাতেই তোমাকে সোর্পদ করে দিয়ে গেলাম। সাবধানে থেকো।
শান্তির সন্ধানে
অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সংঘাত এবং রক্তক্ষয় এড়ানোটাই ছিল প্রথম কাজ। সৈনিকদের সাথে কথা বলার পর আমার আত্মপ্রত্যয় বেড়ে গিয়েছিল। আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম রক্তক্ষয় এবং সংঘাত দু’টোই এড়ানো সম্ভব হবে।
আমিও ইউনির্ফম পড়ে নিয়ে আমার বিশ্বস্ত গার্ড, এস্কট, অয়্যারলেস অপারেটার এবং ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে গেলাম আজিমপুরে মিসেস মোয়াজ্জেম কহিনূর ভাবীর বাসায়; মেজর নূর রয়েছে সেখানে। সব শুনে নূর বলল,
– রক্তপাত বন্ধ করার একমাত্র উপায় মেজর হাফিজ এবং ক্যাপ্টেন ইকবালের সাথে সরাসরি দেখা করা। এছাড়া রক্তপাত কিছুতেই এড়ানো সম্ভব হবে না।
আমিও নূরের সাথে একমত হয়ে বললাম,
– সেই উদ্দেশ্যেই এসেছি তোমাকে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে যাবার জন্য।
ঠিক করলাম, ক্যান্টনমেন্টে যাবার আগে সার্বিক অবস্থাটা সরেজমিনে আরো একটু ভালো করে বুঝে নেয়া দরকার। আমরা জিপে করে গিয়ে উপস্থিত হলাম ফুলার রোডে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের বাসায়। ওখানে তখন মহুয়া এবং লিটু থাকত। উদ্দেশ্য থাকি পোষাক বদলে সাধারণ কাপড় পরে নেবো। ঘুম থেকে মহুয়াদের ডেকে তুললাম। সংক্ষেপে মহুয়া এবং লিটুকে অবস্থা বুঝিয়ে লিটুর কয়েকপ্রস্ত কাপড় চেয়ে নিয়ে আমরা সবাই ড্রেস পরিবর্তন করে নিলাম। মহুয়া জিজ্ঞেস করল,
– নিম্মী কোথায়? বললাম,
– বঙ্গভবনে ওকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এসেছি। বলে এসেছি ও যেন কোন নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যায়। তুই আত্মীয়-স্বজনদের ফোন করে সতর্ক করে দিস।
এরপর আমরা বেরুলাম শহর প্রদক্ষিন করতে। পুরো ভার্সিটি এলাকা, পিলখানা, নিউ মার্কেট, সেকেন্ড ক্যাপিটাল, রামপুরা টিভি ষ্টেশন, ইন্ডাষ্ট্রিয়াল এরিয়া, রাজারবাগ পুলিশ লাইন। কোথাও কোন অস্বাভাবিক কিছু নজরে পড়ল না। শহরের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের সৈনিকদের সুরক্ষিত চেকপোষ্টগুলোই নজরে পড়ল। strategically deployed tanks গুলোও দেখলাম ঠিকমতই রয়েছে। প্রায় সারা শহরটাই ঘুরে এলাম শাহরিয়ারের কন্ট্রোল রুমে। ওর ঘরে ঢুকতেই দেখি ও কারো সাথে টেলিফোনে কথা বলছে। আমাদের দেখে সংক্ষেপে কথা সেরে জানতে চাইলো,
– কি অবস্থা স্যার, কি বুঝছেন!
আমরা ঘুরে ফিরে যা দেখেছি তাই বললাম। শাহরিয়ার জানাল, তার খবরা-খবরও প্রায় একই রকম; তবে সাভারের বুষ্টার ষ্টেশনের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে অজানা কারণে। ফলে রেডিও ষ্টেশন থেকে কোন কিছু প্রচার করা সম্ভব হচ্ছে না। টিভির প্রচারণাও একই কারণে সম্ভব নয়। তাকে আমরা জানালাম,
– আমরা ক্যান্টনমেন্টে যাচ্ছি রক্তক্ষয়ী সংঘাত বন্ধ করার চেষ্টায়। নিজেদের মধ্যে যে কোন প্রকার সংঘর্ষ বন্ধ করতেই হবে যে কোন উপায়ে যাতে করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র কোন প্রকার হস্তক্ষেপের সুযোগ না পায়।
শাহরিয়ার আরো জানিয়েছিল, অনেক চেষ্টা করেও জেনারেল জিয়ার সাথে সে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়নি। শাহরিয়ারের ওখানে যাবার আগেই সোনাটেঙ্গরে আমার প্রিয় মেঝো ফুপ্পুর (বিভা ফুপ্পু) বাসায় গিয়েছিলাম কতগুলো বিশেষ জরুরী টেলিফোন কল সেরে নেবার জন্য। তাদের ফোনটা খারাপ ছিল কিন্তু ইমান আলী ফুপ্পা পাশেই তার এক কলিগের বাসা থেকে ফোন করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তারা অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথেই আমাদের বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সেখান থেকে বিভিন্ন ইউনিটের সেনা পরিষদের সাথে যোগাযোগ করে বুঝলাম তারা প্রায় সবাই অবস্থা সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। তাদের সংক্ষেপে প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানের আশংকার কথা জানিয়ে অবস্থার গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন থাকার এবং সবকিছু পর্যবেক্ষণ করার নির্দেশ দিয়ে জেনারেল জিয়ার বাসায় ফোন করে বুঝতে পারলাম তার বাসার টেলিফোন লাইন কেটে দেয়া হয়েছে। দেশের অন্যান্য ক্যান্টনমেন্টের সাথেও যোগাযোগ করেছিলাম সেই বাসা থেকেই। যোগাযোগের পর বুঝতে পারলাম ঘটনাটা ঘটানো হচ্ছে অতি সীমিত পরিসরে ঢাকা ভিত্তিক। এতে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। নিশ্চয়ই রক্তপাত এড়ানো সম্ভব হবে।
শাহরিয়ারের ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা চললাম ক্যান্টনমেন্টের দিকে। এয়ারপোট ছাড়িয়ে একটু এগুতেই দুই ট্রাক সৈনিক দেখতে পেলাম মাউন্টেড অবস্থায়। কাছে যেতেই দেখলাম তারা ৪র্থ ইষ্টবেঙ্গলের। Contingent commander-কে জিজ্ঞাসা করলাম,
– তোমরা এখানে কেন?
জবাবে সুবেদার সাহেব স্যালুট করে জানাল,
– আগামীকাল আওয়ামী লীগের প্রসেশন বের হবার সম্ভাবনা আছে; তাই হুকুম দেয়া হয়েছে তাদের এয়ারপোট এলাকায় ডেপ্লয়েড থাকতে হবে আইন-শৃংখলা বজায়ে রাখার জন্য। তার জবাব শুনে বুঝতে পারলাম, খালেদ চক্র ট্রুপসদের কাছে প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুই বলেনি সৈনিকদের সমর্থন না পাওয়ার ভয়ে। তাই মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত তার অধিনস্থ ৪র্থ বেঙ্গলকে চতুরতার সাথে মোতায়ন করেছে just as show of force হিসাবে আমাদের ভয় দেখাবার জন্য। সৈনিকদের কাছে খুলে বলা হয়নি সরকার এবং জিয়া বিরোধী পাল্টা অভ্যুত্থানের কথা। মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লবী পদক্ষেপ গ্রহণ করে জেনারেল জিয়াকে প্রায় বন্দী করা অবস্থায় রাখা হয়েছে এ কথাটা বলার মত সাহস হয়নি ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং তার দোসরদের। কারণ তারা ভালোভাবেই জানতেন, এ ধরণের কোন পদক্ষেপকে কিছুতেই মেনে নেবেনা দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ অফিসার ও সৈনিকরা। সবকিছু দেখে শুনে বুঝলাম, বর্তমান পরিস্থিতিতে সরাসরি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের সাথেও আলোচনা করা সম্ভব। তার বাসাতেই গেলাম প্রথম। বাসায় তাকে পাওয়া গেল না৷ বাসা থেকে বলা হল, তিনি সেনা সদরে গেছেন। পৌঁছালাম সেনা সদরে। সেখানেও কেউ নেই। সেন্ট্রি, ডিউটি অফিসার ও ক্লার্ক ছাড়া পুরো সেনা সদরটা নিস্তব্ধ। সেখান থেকে গেলাম মেজর হাফিজের বাসায়। হাফিজ বাসায় নেই। ইকবালের খোঁজ করে তাকেও পাওয়া গেল না। এরপর গেলাম কর্নেল শাফায়াত জামিলের বাসায়। সেখান থেকে জানানো হল তিনি ব্রিগেড হেডকোয়াটার্স এ গেছেন। সেখান থেকে ব্রিগেড হেডকোয়াটার্স এ যাবার পথে দেখলাম জেনারেল জিয়ার বাসার সামনে অস্বাভাবিক কিছুই নেই। ডিউটিরত গার্ডসরা তাদের দায়িত্ব পালন করছে। ব্রিগেড হেডকোয়াটার্সেও নেই তারা। সেখান থেকে ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টের গেইট দিয়ে ঢুকতেই দেখি ট্রুপসরা সেখানে সব stand to অবস্থায় পজিশন নিয়ে আছে। এ ধরণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কেন জানতে চাইলে আমাদের বলা হল যে, সন্ধ্যার পর রাতের আধাঁরে ৪র্থ বেঙ্গল ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টের দিকে তাক করে তাদের RR (Recoilless Rifle) এবং সৈন্য মোতায়েন করেছে; তাই তারাও পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ৪র্থ বেঙ্গল এবং ২য় ফিল্ড রেজিমেন্ট পাশাপাশি দু’টি ইউনিট। তাদের মধ্যে এ ধরণের উত্তেজনা যেকোন সময় বিষ্ফোরন ঘটাতে পারে। উত্তেজনা কমানোর জন্য সেনা পরিষদের সদস্যদের সার্বিক অবস্থা বুঝিয়ে তাদের বললাম, এই অবস্থায় সতর্ক অবশ্যই থাকতে হবে সবাইকে। আরো জানালাম, আমরা ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং কর্নেল শাফায়াতকে খুঁজছি। ওদের পেলেই উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ৪র্থ বেঙ্গলের উস্কানিমূলক কার্যক্রম বন্ধ করার বন্দোবস্ত করব। সেখানেই জানতে পারলাম মহারথীরা সব ৪র্থ বেঙ্গল হেডকোয়াটার্স এ রয়েছেন। ৪র্থ বেঙ্গলের গেইট দিয়ে ঢুকতেই নজরে পড়ল সাজ সাজ রব। ভীষণ ব্যস্ততা! সৈনিকদের রনসজ্জায় সজ্জিত করে রাখা হয়েছে। কিছুদূর এগুতেই ক্যাপ্টেন কবিরের দেখা পেলাম। একটি এসএমজি কাঁধে ঝুলিয়ে সে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এল কবির। তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
– Where is Brig. Khaled and Col. Shaffat?
– They all here Sir. জবাব দিল কবির।
কবিরের সাথে কথা বলছিলাম এমন সময় ল্যান্সারস-এর ক্যাপ্টেন নাছের এসে উপস্থিত হল।
– Assalamu Alaicum, welcome Sir. বলেই করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল ক্যাপ্টেন নাছের।
কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই করমর্দন করলাম আমি ও নূর।
– স্যার, মোশতাক এবং জিয়াকে দিয়ে আমাদের কোন উদ্দেশ্যই সফল করা সম্ভব হবে না৷ Both of them are self centered and hypocrite. They are not the right kind of people Sir. তাই আমরা ওদের অপসারন and I am sure both of you would be definitely with us.
ওকে অনেকটা থামিয়ে দিয়েই বললাম,
– Is Brig. Khaled around?
– সবাই এখানেই আছেন। মেজর হাফিজ এবং ক্যাপ্টেন ইকবালও রয়েছেন এখানে।
– Naser do me a favour, please find out Hafiz and tell him I would like to talk to him.
– “Ok sir. আমি এখুনি যাচ্ছি তাকে নিয়ে আসার জন্যে। আপনারা ততক্ষণ এ্যাডজুটেন্টের অফিসে অপেক্ষা করুন” বলে চলে গেল নাসের।
এ্যাডজুটেন্টের ঘরে ঢুকে দেখি ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় কর্নেল আমিনুল হক বীর উত্তম ও লেফটেন্যান্ট মুনিরুল ইসলাম চৌধুরী বিষন্ন হয়ে চুপচাপ বসে আছে। কর্নেল আমিনকে জিজ্ঞাসা করলাম,
– কি ব্যাপার স্যার, আপনাদের এই দশা কেন? What’s up?
– You must be jocking at our miserable plight is’nt it Dalim? তুমি কি সত্যিই বুঝতে পারছ না ইউনিট কমান্ডার এবং এ্যাডজুটেন্ট হয়েও নিজেদের ব্যাটালিয়নেই আমাদের এমন নিঃক্রিয় অবস্থায় বসে থাকতে হচ্ছে তার মানেটা কি?
– কিছু মনে করবেন না স্যার। আজকের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কে? এমন কিছু যে ঘটতে পারে সেটাতো অজানা ছিল না আপনাদের অনেকেরই। সময়মত এ্যাকশন না নেবার ব্যর্থতার জন্যই আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তাই নয় কি?
আমার প্রশ্নের ঈঙ্গিত বুঝে কর্নেল আমিন চুপ করে রইলেন। বস্তুতঃ কর্নেল আমিন ও লেফটেন্যান্ট মুন্নাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে না করায় তাদের প্রায় বন্দী অবস্থাতেই রাখা হয়েছে তাদের নিজস্ব ইউনিটেই। খবর পেয়েই হাফিজ এবং ইকবাল এল। আমাদের নিয়ে গিয়ে বসালো পাশের একটি খালি কামরায়।
– এ কি করলে হাফিজ! শেষ পর্যন্ত অঘটনটা ঘটিয়েই ছাড়লে?
– অঘটন বলছ কেন? জিয়া এবং মোশতাকের ঘোড়েল মনের পরিচয় পাবার পরও তারা যে আমাদের উদ্দেশ্যাবলী সম্পর্কে মোটেও আন্তরিক নয় সেটা তোমরা বুঝেও মেনে নিতে পারছ না কেন? Both of them are betraying our cause. উল্টো প্রশ্ন করল হাফিজ। ওদের বাদ দিয়েই এগুতে হবে। আওয়ামী লীগের গড়া সংসদকেও আর কাল বিলম্ব না করে ভেঙ্গে দিতে হবে। এই সঠিক উদ্যোগে বিশেষ করে তোমার, নূর, পাশা, হুদা, রাশেদ, শাহরিয়ার এর মাধ্যমে সেনা পরিষদের সমর্থন এবং সহযোগিতা পাব আশা করছি আমরা। আমি জানি ব্রিগেডিয়ার খালেদ সম্পর্কে তোমাদের যুক্তিসঙ্গত reservations আছে; সেগুলোকে আমিও অস্বীকার করছি না কিন্তু এরপরও ব্রিগেডিয়ার খালেদের চীফ হবার lifelong ambition fulfill করে দিলে জিয়ার তুলনায় তাকে দিয়ে more efficiently কাজ করানো যাবে।
– দেখ হাফিজ, আমি স্বীকার আগেও করেছি এখনো করছি, আশানুরূপভাবে আমাদের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে আমাদের নিরাশ হতে হচ্ছে জেনারেল জিয়া এবং প্রেসিডেন্ট মোশতাকের জন্য। শুধু তাই নয়; অনেকক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতারও সৃষ্টি করছেন তারা বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক, কিন্তু তাই বলে হঠাৎ করে এ ধরণের একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করে আর্মির মধ্যে একটা বিভেদ সৃষ্টি করে অপশক্তিকে সুযোগ করে দিতে হবে to stage back and reverse the process সেটা কিছুতেই যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না এবং আমাদের কাছেও সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। তা যাক, এ নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে; আমার ধারণা- এসমস্ত বোঝাবুঝির সময় পার হয়ে গেছে কারণ যে অঘটন কখনোই সম্ভব হত না সেটাই ঘটিয়ে বসেছো তোমরা। এই অবস্থায় কোন রক্তপাতের সূত্রপাত যাতে না ঘটে তার জন্যই আমরা স্বেচ্ছায় ছুটে এসেছি। এখন চলো ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং কর্নেল শাফায়াতকে সঙ্গে করে সবাই মিলে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা যাক এই সংকটের রাহুগ্রাস থেকে দেশ ও জাতিকে কি করে উদ্ধার করা যায়। এ বিষয়ে যদি কোন আপত্তি থাকে তবে সেটাও বলো পরিষ্কার করে। সেক্ষেত্রে আমরা ফিরে যাব। এরপর যা হবার তা হবে ।
সার্বিক অবস্থার বিশ্লেষনের পর আমার এবং নূরের বিশ্বাস জন্মেছিল, আলোচনার প্রস্তাব কিছুতেই না মানা সম্ভব না খালেদ চক্রের কাছে; কারণ তাদের বিশেষ করে হাফিজ এবং ইকবালের অজানা ছিল না ঢাকায় তো বটেই অন্যান্য সেনানিবাসগুলোতেও সেনা পরিষদের শক্তি ছিল তুলনামূলকভাবে তাদের চেয়ে অনেক বেশি। কি যেন ভাবল হাফিজ এরপর বলল,
– ঠিক আছে, তাই হবে। চলো আমাদের সাথে।
হাফিজ, আমি, নূর এবং ইকবাল ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে বেরুতেই দেখলাম ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং কর্নেল শাফায়াত, ব্রিগেডিয়ার মঈন, ক্যাপ্টেন নাছের, ব্রিগেডিয়ার নূরুজ্জামান, কর্নেল রউফ, কর্নেল মালেক প্রমুখ সবাই অফিস ব্লকের সামনে লনে দাড়িয়ে আলাপ-আলোচনা করছেন নিজেদের মধ্যে। আমরা এগিয়ে যেতেই তারা কথাবার্তা বন্ধ করে দিলেন। আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদকে অভিবাদন জানাতেই তিনি হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,
– আরে এসো এসো, welcome. আমি জানতাম তোমরা দু’জন আসবেই।
তার কথা শেষ হতেই বললাম,
– শেষটায় অঘটনটা ঘটিয়েই ছাড়লেন।
– What do you mean? It’s not my doing. Believe you me Dalim it is their’s doing, these young officers. They think Zia can’t deliver. They also think he will do nothing to achieve the goals of the 15th August revolution at the same time he is also totally incapable to protect the interest of the armed forces. Therefore, they want a change.
– বুঝতে পারলাম স্যার, জেনারেল জিয়ার জায়গায় বসে সেই যোগ্য নেতৃত্ব দেবার জন্যই এই সঙ্কট সৃষ্টি করেছেন অথবা করানো হয়েছে।
– No ! No ! Not at all. I don’t want to be the Chief. Believe me, I have no such ambition. ছেলেরা আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছে তাই আমি এসেছি। দ্যাটস ইট!
কথার মাঝেই কে একজন বলে উঠল,
– We don’t mind to accept Brig. Khaled’s leadership.
– Come on keep quite.
ব্রিগেডিয়ার খালেদ সেই কন্ঠকে চুপ করিয়ে দিলেন।
– যাক স্যার, এ বিষয় নিয়ে কথা বাড়াবার সময় এটা নয়; এতে কোন লাভও নেই। আমি ও নূর এসেছি কোন প্রকার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ যাতে শুরু না হয় সেটা নিশ্চিত করতে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। রশিদ এবং ফারুককে বলে এসেছি আপনাদের সাথে আমাদের আলোচনার ফলাফল জানার আগ পর্যন্ত বঙ্গভবনের নিয়ন্ত্রণাধীন ট্যাংক কিংবা ট্রুপস এর কোন মুভমেন্ট করা হবে না। এখন বলেন, আলোচনায় আপনারা রাজি আছেন কিনা?
আমার কথার ধরণে তারা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে জবাব খোঁজার চেষ্টা করছিলেন সবাই। ব্রিগেডিয়ার খালেদের ঠিক পাশেই দাড়িয়ে ছিল হাফিজ। সে নীচু স্বরে ব্রিগেডিয়ার খালেদকে কিছু বলল। হাফিজের কথা শুনে ব্রিগেডিয়ার খালেদ বললেন,
– তোমাদের আলোচনার প্রস্তাব মেনে নিলাম আমরা। আলোচনা হবে।
– কিন্তু আসার পথে দেখলাম এয়ারপোর্টের কাছে কিছু সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। অবশ্য, তাদের যে কথা বলে ডেপ্লয় করা হয়েছে তার সাথে আপনাদের কার্যকলাপ সঙ্গতিহীন। যাক, সেটা অন্য বিষয়। কিন্তু ৪র্থ বেঙ্গলের উস্কানিমূলক ডেপ্লয়মেন্টকে কেন্দ্র করে ২ ফিল্ড রেজিমেন্টে যে ভয়ংকর উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে সেটা প্রশমিত না করলে যেকোন মুহুর্তে বিষ্ফোরন ঘটতে পারে আর সেটা ঘটলে আমাদের আলোচনার কোন সুযোগই থাকবে না। তাই আমার অনুরোধ, খালেদ ভাই আপনি আলোচনায় বসার আগে ৪র্থ বেঙ্গলকে নির্দেশ দেন অবিলম্বে stand down করার।
আমার কথার গুরুত্ব অনুধাবন করে ব্রিগেডিয়ার খালেদ কর্নেল শাফায়াতকে নির্দেশ দিলেন ৪র্থ বেঙ্গলকে stand down করানোর জন্য। কর্নেল শাফায়াত চলে গেলেন নির্দেশ কার্যকরী করতে।
ঐতিহাসিক এনকাউন্টার
অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির অবসান ঘটানোর জন্য কী করা প্রয়োজন সেটা ঠিক করার জন্য আমি আলোচনার প্রস্তাব দেই। আমার প্রস্তাব গৃহিত হয়। আমরা সবাই ৪র্থ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসারের অফিসে আলোচনায় বসি।
আমরা সবাই গিয়ে বসলাম কমান্ডিং অফিসারের ঘরে। প্রথমেই আমি জানতে চাইলাম জেনারেল জিয়ার সম্পর্কে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ জানালেন তিনি তার বাসাতেই আছেন এবং ভালোই আছেন। তার নিরাপত্তা এবং দেখাশুনার জন্য কিছু অতিরিক্ত সৈনিকে তার বাসার কাছে অবস্থান নিতে বলা হয়েছে এবং কাউকে তার সাথে যোগাযোগ করতে দেওয়া হচ্ছে না সাময়িকভাবে; এর বেশি কিছুই নয়। তার মানে হল, তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে এবং এই কথাটাও সৈনিকদের জানাবার সাহস হয়নি খালেদ চক্রের। আলোচনার আগেই জেনারেল জিয়ার ব্যাপারে একটা বোঝাপড়া করে নিতে হবে। আমি সোজা ব্রিগেডিয়ার খালেদকে বললাম,
– স্যার কোন আলোচনায় বসার আগে একটা বিষয়ে আপনাকে পরিষ্কার করে দিতে চাই- জেনারেল জিয়ার সাথে এ পর্যন্ত যা করা হয়েছে এর বেশি কিছু করা হলে সেটা আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না৷ এ ব্যাপারে you have to give me your explicit assurance.
বুদ্ধিমান লোক ব্রিগেডিয়ার খালেদ। তিনি ঠিকই বুঝতে পারলেন আমি কি বোঝাতে চাচ্ছি। কোন সময় না নিয়েই তিনি জবাব দিলেন,
– Be rest assured, no harm would be done to him. At the most he may be removed as the chief of army staff that’s all. Nothing more than that… আলোচনা শুরু হল। একদিকে আমি ও নূর অন্যদিকে ব্রিগেডিয়ার খালেদের নেতৃত্বে ওদের তরফের উপস্থিত প্রায় সবাই। শুরুতেই আমি সরাসরি প্রশ্ন রাখলাম,
– দেশে একটি জনপ্রিয় সরকার থাকতে এ ধরণের একটা সংঘাতমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্য কি?
আমার প্রশ্নে উপস্থিত সবাই কেমন যেন থমকে গেলেন। মনে মনে সবাই প্রশ্নের উপযুক্ত জবাব খুঁজে পেতে চেষ্টা করছিলেন। নিঃশব্দতা ভঙ্গ করে কর্নেল শাফায়াত বলে উঠলেন,
– We want to dismiss the Mushtaq government and the present parliament because the present parliament is the parliament of Awami-Bksalites.
জবাবে আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
– তারপর?
– We don’t want Gen. Zia to remain as our Chief.
– দেশ চালাবে কে? প্রশ্ন করলাম।
– “We shall form a ‘Revolutionary Council” ক্যাপ্টেন ইকবাল জবাব দিল।
কর্নেল শাফায়াত আবার বলে উঠলেন,
– Khandakar Mushtaq will handover power to the chief justice.
ব্রিগেডিয়ার খালেদ ভিন্ন মত প্রকাশ করলেন,
– Continuation must be maintained and therefore, Khandaker Mushtaq will remain as the President but three Cheif’s must be removed.
বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হল না কোন নির্দিষ্ট ব্লু প্রিন্ট ছাড়াই অঘটন ঘটিয়ে বসেছেন তারা৷ কোন পরিষ্কার পরিকল্পনা কিংবা মতানৈক্য কোনটাই নেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ চক্রের। আলোচনা চলছে হঠাৎ আকাশে জঙ্গী বিমান উড়ার বিকট শব্দে সবাই চমকে উঠলাম। আমি ব্রিগেডিয়ার খালেদকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলাম,
– Sir, why the MIGS are up? For heaven’s sake stop this provocative act. Otherwise, it would be simply impossible to holdback Col. Farooq. He will roll his tanks towards the cantonment.
ব্রিগেডিয়ার খালেদ টেলিফোন রিসিভার উঠিয়ে নিয়ে এয়ারফোর্স কন্ট্রোলের সাথে যোগাযোগ করে জানতে পারলেন, স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত নিজের উদ্যোগেই মিগ নিয়ে আকাশে উড়েছে। খবরটা জেনে তক্ষুণি Air traffic control-এর মাধ্যমে লিয়াকতকে অবিলম্বে নেমে আসার নির্দেশ দিয়ে তাকে ৪র্থ বেঙ্গল হেডকোয়াটার্স এ আসার জন্য বললেন। রিসিভার নামিয়ে রাখার পরপরই মেস ওয়েটার এসে জানাল প্রাতঃরাসের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। গরম গরম আলুভাজি, ডালপুরি এবং চায়ের বন্দোবস্ত করা হয়েছে রেজিমেন্টের ফিল্ড মেসে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ আমন্ত্ৰণ জানালেন নাস্তার জন্য। নাস্তা শেষ করে বেরিয়ে এসেছি হঠাৎ নজরে পড়ল কর্নেল মান্নাফ ইউনিফর্ম পরে দাড়িয়ে আছেন। ব্রিগেডিয়ার বেরিয়ে আসামাত্র তিনি তার দিকে ত্রস্তপায়ে এগিয়ে এসে সেল্যুট করে বললেন, Khaled you are the Boss, I salute you as a deciplined soldier and I am with you. তার ব্যবহার দেখে ভাবলাম কি বিচিত্র চরিত্রের মানুষ এই কর্নেল মান্নাফ! ১৫ই আগষ্ট সকালে ঠিক একই কায়দায় তিনি আমাকে একই কথা বলেছিলেন। সেদিন একজন সিনিয়র অফিসার হিসাবে তার ঐ ধরণের ব্যবহারে আমি বেশ বিব্রতবোধ করেছিলাম। সামান্য একটা চাকুরির জন্য আত্মসম্মানও যারা বিকিয়ে দিয়ে গিরগিটির মত রূপ পাল্টাতে পারেন সেই সমস্ত দুর্বল চরিত্রের অফিসারদের পক্ষে কখনোই তাদের অধিনস্থ সহকর্মীদের কাছ থেকে শ্রদ্ধা এবং আনুগত্য লাভ করা সম্ভব নয়। তার ঐ ধরণের গায়ে পড়া মোসাহেবীপনা সবার কাছেই হাস্যকর মনে হয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার খালেদ তার কথার কোন জবাব দেবার প্রয়োজনও বোধ করলেন না। মুচকি হেসে আমাদের লক্ষ্য করে বললেন,
– Let’s get down to business, we have to discuss a lot.
আমরা সবাই আবার গিয়ে বসলাম আলোচনায়। আলোচনা পুনরায় শুরু হওয়ার পর কর্নেল সাব্বিউদ্দিন এসে আলোচনায় শরিক হলেন।
– তুমি অযৌক্তিকভাবেই সব ঘটনার জন্য আমাকেই দোষারোপ করছ। যা ঘটেছে তার জন্য শুধুমাত্র একা আমি দায়ী নই। জিয়ার বিরুদ্ধে তরুণ অফিসাররা অসন্তুষ্ট। তারা বুঝতে পেরেছে কোন বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা তার নেই। মোশতাক এবং জিয়ার উপর বিতশ্রদ্ধ্য; তাই তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছে এদের বিরুদ্ধে।
বলেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ কর্নেল শাফায়াত, মেজর হাফিজ, ক্যাপ্টেন ইকবাল, ক্যাপ্টেন নাসের, ক্যাপ্টেন কবির প্রমুখদের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করলেন। এদের অনুরোধেই আমাকে এখানে আসতে হয়েছে।
বুঝলাম, তীক্ষ্ম বুদ্ধির অধিকারী চতুর ব্রিগেডিয়ার খালেদ অতি কৌশলে গা বাঁচিয়ে অন্যদের কাঁধে বন্দুক রেখে নিজের উচ্চাভিলাস চরিতার্থ করার উদ্যোগ নিয়েছেন।
– জেনারেল জিয়াকে সরিয়ে তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে যোগ্য নেতৃত্ব দেবার দায়িত্বটা কি আপনিই নিবেন স্যার?
আমার প্রশ্নের জবাবে নিজের সাফাই দেবার জন্য পাল্টা প্রশ্ন করলেন,
– তুমি কি মনে কর চীফ হওয়ার জন্যই আমি এখানে এসেছি?
– আমি কিছুই মনে করছি না, শুধু জানতে চাইছি আপনাদের আসল উদ্দেশ্যটা কি? কি আপনাদের দাবি-দাওয়া? আপনাদের দাবিগুলো পরিষ্কারভাবে জানার পরইতো সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে বের করা সম্ভব তাই নয় কি স্যার? ক্ষমতার লড়াই এবং রক্তপাত বন্ধ করার উদ্দেশ্যেইতো ছুটে এসেছি আমি ও নূর। ইনশাল্লাহ্ দেশ ও জাতিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবোই যেকোন ত্যাগের বিনিময়ে।
আমার বক্তব্য শেষ হতেই ল্যান্সারস এর ক্যাপ্টেন নাসের উঠে বলল,
– Yes, we want Brigadier Khaled to be our Chief.
“Yes, Yes” উৎসাহী সমর্থন শোনা গেল কিছু তরুণ অফিসারের গলায়। ঠিক সেই সময় duty officer খবর নিয়ে এল স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত এসেছে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ duty officer- কে বলল লিয়াকতকে ভিতরে পাঠিয়ে দিতে। লিয়াকত ঘরে ঢুকে সেল্যুট করতেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ জিজ্ঞাসা করলেন,
– What’s up man! Why did you took off?
– Sir, I got information that Col. Farooq had started up his tanks at the racecourse and was mooving towards the cantonment that’s why I went up.
– ডালিম, তুমি বলছ রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্যই তোমরা এখানে এসেছ অথচ তোমাদেরই একজন ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের পায়তারা করছে। Is in’t a contradiction? How can you justify this?
– Sir, please have trust on me. Let me check what is happening. I assure Sir, nothing of that kind would ever happen.
বলেই পাশের ঘরে গিয়ে টেলিফোন তুলে নিলাম কর্নেল রশিদের সাথে যোগাযোগের জন্য। ঘরে ঢুকেই দেখি এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াবকে ইতিমধ্যেই ধরে আনা হয়েছে। বিমর্ষ চিত্তে নির্বাক হয়ে বসেছিলেন তিনি। পাশেই নেভ্যাল চীফ রিয়ার এডমিরাল এম.এইচ. খানও বসে আছেন দেখলাম। তারও একই অবস্থা৷ শংকা-উদ্বেগে দু’জনেই ফ্যাকাশে হয়ে গেছেন। আমাকে দেখে তারা দু’জনেই যেন ধরে প্রাণ ফিরে পেলেন। এয়ার চীফ ত্রস্তে উঠে এসে কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন,
– ডালিম, তুমি এখানে ! কি হচ্ছে বলতো?
তার প্রশ্নের জবাবে শুধু বললাম,
– স্যার ঘাবড়াবেন না। Take it easy. চুপচাপ বসে দেখেন কি হচ্ছে।
টেলিফোন তুলে নিয়ে বঙ্গভবনে কর্নেল রশিদের সাথে যোগাযোগ করলাম।
– রশিদ, ডালিম বলছি ৪র্থ বেঙ্গল হেডকোয়াটার্স থেকে। এখানে ব্রিগেডিয়ার খালেদ, কর্নেল শাফায়াত, মেজর হাফিজ, ক্যাপ্টেন ইকবাল এবং অন্যান্য অনেকেই উপস্থিত রয়েছেন। এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব এবং রিয়ার এডমিরাল এম.এইচ. খানও আছেন। জেনারেল জিয়াকে তার বাসাতেই রাখা হয়েছে। আমার সাথে নূরও রয়েছে। আলোচনা চলছে। ব্রিগেডিয়ার খালেদের নির্দেশে লিয়াকত মিগ উড়ানো বন্ধ করে এখানে ফিরে এসেছে। তারা অভিযোগ করছেন কর্নেল ফারুক নাকি তার ট্যাংক বহর নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে; যদি খবর সত্যি হয়ে থাকে তবে তাকে এ ধরণের উদ্যোগ নিতে নিষেধ কর। No tanks should roll down the street whatsoever. ওদের দাবি-দাওয়া জেনে নিয়ে আমি আসছি বঙ্গভবনে as soon as possible. ব্রিগেডিয়ার খালেদকে বলেছি রক্তক্ষয়ী সংঘাতের হাত থেকে দেশও জাতিকে বাঁচাবার শানি-পূর্ণ উপায় খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে আলোচনার জন্যই আমি ও নূর এসেছি। তারা আলোচনায় যখন রাজি হয়েছেন এবং আলোচনা চলছে সেক্ষেত্রে you have to ensure that no provocative action is initiated from our side. Please talk to Farooq and tell him to restrain himself.
– “আমি এক্ষুণি কর্নেল ফারুকের সাথে যোগাযোগ করে তাকে বলছি এ ধরণের কোন উদ্যোগ না নিতে৷” জবাব দিল কর্নেল রশিদ।
কনফারেন্স রুমে ফিরে এসে ব্রিগেডিয়ার খালেদকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
– Don’t worry Sir, Col. Farooq will not move his tanks.
আমার কথা শোনার পর ব্রিগেডিয়ার খালেদ তাদেরই একজনকে জিজ্ঞেস করলেন,
– Where is Air Vice Marshal Twab?
– “He is here Sir.” জবাব দিল অফিসার।
– “Bring him in.” নির্দেশ দিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ।
এভিএম তোয়াবকে নিয়ে আসা হল কনফারেন্স রুমে। ভিতরে ঢুকে সবাইকে দেখে তিনি কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,
– Well Khaled, would you please tell me why the aircheif has been brought here in such a disgraceful way ! What’s happening? Where do I stand? Am I still the Chief?
তার কথা শেষ না হতেই ক্রোধে চেয়ার ছেড়ে উঠে গর্জে উঠল স্কোয়ার্ডন লিডার লিয়াকত,
– Shut up you! You are no more the Chief. I have taken over the command of the air force.
লিয়াকতের কথার ধরণে স্লিপিং স্যুট পরিহিত এভিএম তোয়াব কুকঁড়ে গিয়ে বসে পড়লেন খালি একটা চেয়ারে।
– “Make him sit in some other place.” বললেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ।
তার আদেশে জনাব তোয়াবকে আবার পাশের ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। এই ড্রামার পর আবার আমাদের আলোচনা শুরু হল। ব্রিগেডিয়ার খালেদ বললেন,
ডালিম, আমাদের দাবি চারটিঃ-
১। খন্দোকার মোশতাকই প্রেসিডেন্ট থাকবেন ।
২। বর্তমানের তিন চীফ অফ স্টাফকে অব্যাহতি দিয়ে তাদের জায়গায় গ্রহণযোগ্য নতুন চীফ অফ স্টাফ নিয়োগ করতে হবে আর্মি, এয়ারফোর্স এবং নেভীতে।
৩। আর্মিতে chain of command re-establish করতে হবে। বঙ্গভবন এবং শহরে deployed সমস্ত ট্রুপস এবং ট্যাংকস ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে।
৪। বাকশালী শাসনতন্ত্র বাতিল ঘোষণা করে বর্তমানের সংসদ ভেঙ্গে দিতে হবে। বহুদলীয় নির্বাচনের পর নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবেন। নির্বাচন হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশ পরিচালিত হবে সামরিক শাসনের মাধ্যমে।
বুঝতে পারলাম, বর্তমানে জনগণের মানসিকতা এবং গ্রহণযোগ্যতার কথা চিন্তা করেই দাবিগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে। অত্যন্ত চতুরতার সাথে সময়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ক্রমান্বয়ে বর্তমান রাজনৈতিক ধারাকে উল্টে দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পরিকল্পনা আঁটা হয়েছে। এ ধরণের সু পরিকল্পনা শুধুমাত্র ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং তার দোসরদের কাজ নয় এবং এর পিছনে যে অজানা চানক্যরা রয়েছেন সেটা বুঝতে মোটেই কষ্ট হল না আমার। যাই হোক, সব শুনে আমি বললাম,
– ঠিক আছে খালেদ ভাই। প্রেসিডেন্টের সাথে আপনাদের দাবিগুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য চলুন তবে বঙ্গভবনে যাওয়া যাক।
আমার প্রস্তাবে ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং অন্যরা কেন জানি দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। নিজেদের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে কর্নেল শাফায়াত ব্রিগেডিয়ার খালেদের হয়ে জবাব দিলেন,
– ব্রিগেডিয়ার খালেদ বঙ্গভবনে যাবেন না। তার প্রতিনিধি পাঠানো হবে।
জবাব শুনে রসিকতাচ্ছলে ব্রিগেডিয়ার খালেদকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
– আমরাতো নিজেরাই ছুটে এসেছি। আপনারা আমাদের সাথে কোন আলোচনা করতে আদৌ রাজি হবেন কিনা সে বিষয়েও আমরা নিশ্চিত ছিলাম না তবু এসেছি। আপনাদের সাথে বসে আলোচনা করতে আমাদেরতো কোন ভয় হচ্ছে না; সেক্ষেত্রে আপনি প্রতিনিধি পাঠাতে চাচ্ছেন কেন? নিজেই চলুন না আমাদের সাথে। ভয় পাচ্ছেন নাকি স্যার? For heaven’s
sake have a heart! We must have mutual trust and confidence and that is the only basis on which we shall succeed to find out a way to salvage the nation from this uncalled for crisis. Don’t you agree with me Sir?
আমার রসিকতার কোন জবাব দিলেন না খালেদ ভাই। ঠিক হল, তাদের তরফের প্রতিনিধি হয়ে কর্নেল মান্নাফ এবং মেজর মালেক যাবেন আমাদের সাথে বঙ্গভবনে। তাদের এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের দু’জনকে সাথে করে আমরা ফিরে এলাম বঙ্গভবনে।
আসার পথে দেখলাম রাস্তাঘাটে মানুষজন নির্লিপ্তভাবে চলাফেরা করছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ঢাকা শহর কর্মচঞ্চল হয়ে উঠছে। স্বাভাবিক অবস্থার আড়ালে কি ভীষণ বিষ্ফোরন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়ে জনগণ এখন পর্যন্ত বে-খবর। অন্যান্য দিনের মতই আজও তারা বেরিয়ে পড়েছে জীবিকার তাড়নায়।
বঙ্গভবন
রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ ছিল স্বাভাবিক। রাজকীয় এবং মনোরম। অস্বাভাবিকতা কিংবা আতংকের কিছুই দৃশ্যতঃ চোখে পড়ছিল না।
বঙ্গভবনের গেটেই নজরে পড়ল বিডিআর-এর সশস্ত্র সৈনিকরা পজিশন নিয়ে আছে। মিলিটারি সেক্রেটারীর কামরায় কর্নেল মান্নাফ ও মেজর মালেককে বসিয়ে আমি ও নুর গিয়ে ঢুকলাম প্রেসিডেন্টের কামরায়। সেখানে প্রেসিডেন্টের সাথে জেনারেল ওসমানী ও কর্নেল রশিদকে আলাপরত অবস্থায় পেলাম। হুদা ব্যস্ত ছিল নোট নেয়ায়। আমরা ঢুকতেই তারা জানতে চাইলেন, ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা কি? আমি বিস্তারিত সবকিছু খুলে বলে জানালাম, ব্রিগেডিয়ার খালেদের নেতৃত্বেই ঘটেছে সব কিছু। তাদের সবার তরফ থেকে চারটি দাবি নিয়ে এসেছেন কর্নেল মান্নাফ এবং মেজর মালেক। এরা দু’জনেই জেনারেল ওসমানীর কাছে বিশেষভাবে পরিচিত; তাই নাম শুনতেই ক্রোধে ফেটে পড়লেন,
How could they give their allegiance to Khaled!
জবাবে আমি বললাম,
স্যার, মানুষের চরিত্র বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবর্তনশীল। এ নিয়ে ভাববার অবকাশ নেই এখন। বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মূল সমস্যা নিয়েই ভাবতে হবে।
সবাই আমাদের অভিমত কি সেটা জানতে চাওয়ায় নূর ও আমার পক্ষ থেকে আমিই আমাদের অভিমত জানালাম,
প্রথমতঃ আমি মনে করি ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং তার দোসরদের এই putch কখনোই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। সামরিক শক্তির দিক দিয়ে আমরাই বেশি শক্তিশালী। জনগণ এবং সৈনিকরা যখন তাদের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে পারবে তখন এই ক্যু’দাতা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাবে। শুধু তাই নয়; তখন তারা এর বিরোধিতা করার জন্যও মানসিকভাবে প্রস্তুত হবে কিন্তু ঠিক এই মুহুর্তে আমাদের তরফ থেকে কোন প্রকার সামরিক অভিযানের তৎপরতা হবে আত্মঘাতী। তাদের আসল চেহারা উন্মোচিত হওয়ার আগে কোন প্রকার সামরিক সংঘর্ষে জড়িয়ে পরলে দেশের জনগণ এবং বিভিন্ন সেনানিবাসের সৈনিকরা দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়বে ফলে দেশে এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটবে; জনগণ এটাকে শুধুমাত্র সামরিক বাহিনীর আভ্যন্তরীন ক্ষমতার লড়াই হিসাবে বিবেচনা করে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পরে সব কিছু থেকে নিজেদের দূরে সরিয়েও রাখতে পারে। এই দুই ধরণের অবস্থারই পূর্ণ সুযোগ নিবে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী ত্রানদাতা হিসাবে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে পরাজিত শক্তিকে আবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে দেশকে আবার নিয়ে যাবে আগষ্ট বিপ্লবের পূর্বাবস্থায়; জনগণের কিছু বোঝার আগেই। এ ধরণের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া কিছুতেই যুক্তিসঙ্গত হবে না৷ পক্ষান্তরে, আমরা যদি এই সময় কোন প্রকার দ্বন্দ্বে না গিয়ে বোঝাপড়ার মাধ্যমে সরে দাড়াই তবে আমার বিশ্বাস, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই খালেদ চক্রের নিজস্ব কীর্তিকলাপের মাধ্যমেই খসে পরবে তাদের মুখোশ; ফলে দেশবাসী এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা জানতে পারবে তাদের আসল পরিচয়। সবাই যখন পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারবে যে, পরাজিত আওয়ামী-বাকশালী স্বৈরশাসন এবং ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার বিনিময়ে ব্রিগেডিয়ার খালেদ তার উচ্চাভিলাস চরিতার্থ করার জন্য তাদের উস্কানি এবং মদদ নিয়েই পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছেন; তখন যদি কোন বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় খালেদ চক্রের বিরুদ্ধে তবে সেই উদ্যোগকে স্বতঃস্ফুর্ত অভিনন্দন ও সমর্থন জানাবে দেশবাসী। ঠিক একইভাবে যেমনটি তারা জানিয়েছিল ১৫ই আগষ্ট বিপ্লবকে। সেক্ষেত্রে জাতীয় বেঈমান ও তাদের বিদেশী প্রভুদের যেকোন হুমকির মোকাবেলায় জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করবে জাগ্রত জনতা। সিপাহী-জনতার ঐক্যের পরিপ্রেক্ষিতে কোন ষড়যন্ত্রই কার্যকরী করা সম্ভব হবে না কারও পক্ষে; যেমনটি হয়নি আগষ্ট বিপ্লবের পর।
দ্বিতীয়তঃ আমি মনে করি জাতিকে ধোকা দেবার জন্য কৌশল হিসাবে ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং তার সহযোগীরা প্রেসিডেন্ট মোশতাককে সামনে রেখে আমাদের নিয়োজিত চীফ অফ স্টাফদের অপসারন করে সমস্ত সামরিক বাহিনীর উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার হীন প্রচেষ্টা করছে। প্রেসিডেন্টকে দিয়ে এই কাজটি হাসিল করার পর অতি সহজেই তাঁকে সরিয়ে তাদের রাজনৈতিক দোসরদের ক্ষমতায় পুনর্বহাল করবে তারা। তাই আমি মনে করি, জাতীয় বেঈমানদের নীলনকশা বাস্তবায়নে প্রেসিডেন্ট মোশতাকের কোনরূপ ভূমিকা রাখা যুক্তিসঙ্গত হবে না। যদি রাষ্ট্রপতি হিসাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব তাকে পালন করতেই হয় তবে সেটা তাকে করতে হবে আগষ্ট বিপ্লবের চেতনার আলোকেই; তার নিজস্ব স্বকীয়তা বজিয়ে রেখেই। ব্রিগেডিয়ার খালেদ চক্রের হাতে ক্রিয়াণক হয়ে নয়। আমার মনে হয়, এ বিষয়ে ব্রিগেডিয়ার খালেদ চক্রকে পরিষ্কার করে বলে দেয়া উচিত। তারা যদি প্রেসিডেন্টের শর্ত মেনে নিতে রাজি না হয় সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব প্রেসিডেন্টের ছেড়ে দেওয়াই উচিত হবে বলে মনে করি আমি। আমার বক্তব্যের আলোকে রুদ্ধদ্বার অবস্থায় আমাদের মধ্যে কিছুক্ষণ আলোচনা হল। আমার যুক্তি মেনে নিয়ে সবাই একমত হলেন এই মুহুর্তে কোনরূপ সামরিক সংঘর্ষে যাওয়া ঠিক হবে না। ব্রিগেডিয়ার খালেদ চক্রের প্রতিনিধিদের কি বলা হবে সেটাও ঠিক করে নেয়া হল।
একজন পাকা স্টেটস্ম্যান হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করলেন রাষ্ট্রপতি খন্দোকার মোশতাক আহমদ
প্রতিনিধিদের মুখোমুখি অত্যন্ত সাহসী ভূমিকা রাখলেন তিনি। অতি কঠোর এবং যথোপযুক্ত উত্তর দিয়েছিলেন তার নিজস্ব চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের আলোচনার পর কর্নেল মান্নাফ এবং মেজর মালেককে ডেকে পাঠানো হল প্রেসিডেন্টের অফিস কক্ষে। তারা দু’জনেই কামরায় ঢুকে প্রেসিডেন্টকে সেল্যুট করে দাড়াল। ভাব গম্ভীর পরিবেশ। আমরাও রয়েছি একপাশে। প্রেসিডেন্ট মোশতাক জানতে চাইলেন,
– বলো, তোমাদের কি বলার আছে ? কর্নেল মান্নাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদদের তরফের দাবিগুলি একটা একটা করে ব্যক্ত করে প্রেসিডেন্টের জবাব জানতে চাইলেন।
সব কিছু শুনে খন্দোকার মোশতাক ধীর স্থিরভাবে তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে দৃঢ়তার সাথে বললেন,
– Well I have heard you patiently, go back and tell the people at the cantonment, if they want me to continue as the President then I shall execute my responsibilities at my own terms for the best interest of the nation and the country. I am not at all prepared to remain as the head of state and government to be dictated by some Brigadier. Before anything I want the chain of command be restored immediately and Khaled should allow my three chief of staffs to come over to Bangabhaban without any further delay. Khaled should also withdraw the troops from the relay station so that the national radio and TV can resume normal broadcasting at the soonest possible time. My priority at this time is to bring back normalcy in the country. আমার নির্দেশ যদি খালেদ মানতে রাজি না হয়; তবে তাকে বলবে he should come over to Bangabhaban and takeover the country and do whatever he feels like. আমি একটা রিক্সা ডাইকা আগামসী লাইনে যামুগা
এসেছিল মুখ দিয়ে অটোম্যাটেকেলি। নিঃস্বার্থভাবে কোন সঠিক এবং মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে এগুলে প্রয়োজনীয় সাহসিকতা হয়তো বা আল্লাহ্তা’য়ালাই যুগিয়ে দেন।
বঙ্গভবনে ফিরে এসে প্রেসিডেন্টকে জানালাম, চক্রান্তকারীরা জাষ্টিস সায়েমের মাধ্যমে ক্ষমতা পুনর্দখলের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সব শুনে প্রেসিডেন্ট মোশতাক জাষ্টিস সায়েমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তার এ সিদ্ধান্তের কথা জেনে নিয়ে কর্নেল মান্নাফ এবং মেজর মালেক বঙ্গভবন থেকে ফিরে যান।
সেনা পরিষদ সাময়িকভাবে চিহ্নিত নেতাদের দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়।
লক্ষ্য অর্জনের জন্য এটা ছিল একটি সাময়িক কৌশল মাত্ৰ।
প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের পর সেনা পরিষদের কার্যনিবাহী কমিটির উপস্থিত সদস্যদের নিয়ে এক জরুরী বৈঠক হয়। বৈঠকে বাস্তব অবস্থার পর্যালোচনার পর সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় যে, শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের exposed নেতারা কৌশলগত কারণে দেশ ত্যাগ করে দেশের কাছাকাছি কোন রাষ্ট্রে সাময়িকভাবে অবস্থান নেবে। সার্বিক বিবেচনায় ব্যাংকক-কেই সর্বত্তোম জায়গা হিসাবে বিবেচিত করা হয়। এরপর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, কি করে খালেদ চক্রের পতন ঘটাতে হবে সেই বিষয়ে। জাতীয় বেঈমান পরাজিত আওয়ামী-বাকশালী গোষ্ঠি এবং তাদের মুরুব্বী ভারতের হাতে ক্রিয়াণক খালেদ চক্রকে উৎখাত করার জন্য সেনা পরিষদ কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন গণবাহিনী এবং জাতীয়তাবাদী-দেশপ্রেমিক অন্যান্য দল ও গ্রুপ নূন্যতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে খালেদ চক্রের মুখোশ উন্মোচিত হবার পর উপযুক্ত সময়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আর একটি অভ্যুত্থান ঘটাবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঐ বৈঠকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল সেটা ছিল প্রেসিডেন্ট মোশতাক এবং জেনারেল জিয়াউর রহমানের সম্পর্কে। সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খালেদ চক্রের পতনের পর সর্বপ্রথম কাজ হবে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করে তাকে আবার সেনা প্রধান হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। নিজ পদে অধিষ্ঠিত হবার পর জেনারেল জিয়াউর রহমান জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদকে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার আহ্বান জানাবেন। আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, নেতৃবৃন্দের যে অংশ ব্যাংককে অবস্থান করবে তার সাথে প্রয়োজনমত যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে সেনা পরিষদ। জরুরী বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টের ইউনিটগুলোকে জানিয়ে দেবার বন্দোবস্ত করা হয়। কর্নেল তাহেরও তখন বঙ্গভবনে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে তিনি বঙ্গভবন ত্যাগ করেন। বৈঠক যখন শেষ হয় তখন প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যাংককে যাবার সব ব্যবস্থা করার জন্য প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারীয়েট থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে নির্দেশ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার খালেদকে আমাদের দেশ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত জানাবার জন্য ফোন করলাম,
স্যার, আমাদের ভবিষ্যত করণীয় সম্পর্কে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এ ব্যাপারে আপনি হয়তো বা জেনেও থাকতে পারেন। তবুও কথা দিয়ে এসেছিলাম তাই কথা রক্ষার্থে জানাচ্ছি: রশিদ, ফারুক, শাহরিয়ার, নূর, পাশা, হুদা, রাশেদ, মহিউদ্দিন, শরফুল, মাজেদ, কিসমত, নাজমুল, মোসলেম, হাশেম, মারফত এবং আমি স্বপরিবারে দেশ ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আজ রাতেই চলে যাব আমরা। প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করা হচ্ছে প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারীয়েটের মাধ্যমে। আপনার সাথে সহযোগিতা করার অনুরোধ রাখা সম্ভব হল না স্যার। দেশ ও জাতির জন্য ভবিষ্যতে আর কিছু করার তৌফিক আল্লাহ্পাক যদি নাই দেন সেটা মেনে নিতে পারব; কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ‘৭১ এর চেতনা এবং নীতির প্রশ্নে আপোষ করে জাতীয় বেঈমান হিসাবে পরিচিতির যে গ্ল্যানি সেটা সহ্য করা আমাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়; হবেও না কোনদিন।
“রশিদ-ফারুক সম্পর্কে আমাদের বিরূপ মনোভাব আছে, তারা দেশ ছেড়ে যেতে চাইতে পারে কিন্তু তোমরা দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছ কেন সেটা এখনো বুঝতে পারছি না।’ আবার কথাগুলোর পুনরুক্তি করলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ।
মুখে আন্তরিকতা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলেও বুঝেছিলাম আমাদের দেশ ত্যাগের খবরটা পেয়ে হাঁফ ছেড়েই বেচেছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং তার সহযোগিরা এটা ভেবে যে, তাদের প্রতিপক্ষের একটি শক্তিশালী গোষ্ঠির threat থেকে রেহাই পেলেন তারা। এভাবেই দেশ ও জাতিকে একটি সম্ভাব্য আত্মঘাতী রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচিয়ে খালেদ চক্র ও নব্য চানক্যদের ষড়যন্ত্রকে পরাস্ত করার কৌশলগত কারণেই ৩রা নভেম্বর ১৯৭৫ সাল রাত সাড়ে দশটায় বিমানের একটি স্পেশাল ফ্লাইটে আমরা দেশ ছেড়ে চলে এসেছিলাম।
৭ই নভেম্বর ১৯৭৫ সালের বৈপ্লবিক সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান
ব্যাংককের উদ্দেশ্যে আমাদের দেশ ত্যাগের পর মাত্র ৩ দিনের মধ্যেই সেনা পরিষদ এবং গণবাহিনীর যৌথ উদ্যোগে ব্রিগেডিয়ার খালেদ চক্রের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। অন্যান্য দেশপ্রেমিক এবং প্রগতিশীল শক্তিসমূহও ঐ অভ্যুত্থানে যোগ দেয়। দেশপ্রেমিক বীর সেনানীদের সাথে স্বতঃস্ফুর্তভাবে যোগ দেয় জাগ্রত জনতা।
আমাদের দেশ ত্যাগের মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে মূলতঃ সেনা পরিষদ এবং কর্নেল তাহেরের অধিনস্থ গণবাহিনীর যৌথ নেতৃত্বে সংঘটিত হয় ৭ই নভেম্বরের ঐতিহাসিক সিপাহী-জনতার বিপ্লব। ক্ষমতাচ্যুত হয় খালেদ চক্র। জাতীয় বেঈমান ও তাদের বিদেশী প্রভুদের সব চক্রান্তের জাল ছিন্নভিন্ন করে দেয় অকুতোভয় দেশপ্রেমিক সৈনিকেরা। দেশের আপামর জনসাধারণ ৭ই নভেম্বরের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানকে স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন জানিয়ে সেনাবাহিনীর বীর জোয়ানদের সাথে যোগ দেয় ঠিক একইভাবে যেভাবে তারা সমর্থন জানিয়েছিল আগষ্ট বিপ্লবকে। এই দুই ঐতিহাসিক দিনে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের সর্বত্র সংগ্রামী জনতার ঢল নেমেছিল পথে-প্রান্তরে, অলিতে-গলিতে, শহরে-গ্রামে। নামাজে শুক্রানা আদায় করেছিলেন মুসল্লিরা মসজিদে-মসজিদে। শহর-বন্দরে খুশীতে আত্মহারা জনগণের মাঝে মিষ্টি বিতরণের ধুম পড়ে গিয়েছিল। সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশ এবং জনগণের একাত্মতায় সৃষ্টি হয়েছিল এক দুর্ভেদ্য জাতীয় ঐক্য। সেই দুই ক্রান্তিলগ্নে সম্মিলিতভাবে তারা বাংলাদেশকে পরিণত করেছিল এক দুর্জয় ঘাঁটিতে। সমগ্র জাতি প্রস্তুত ছিল জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যেকোন আগ্রাসন কিংবা হুমকির বিরোধিতা করার জন্য। সফল বিপ্লবের পর কুচক্রীদের নেতা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং তার কয়েকজন ঘনিষ্ট সহযোগী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন। কর্নেল শাফায়াত জামিল ও অন্যান্যদের বন্দী করা হয়। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করে আবার তাকে আর্মি চীফ অফ স্টাফের পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। তিনি জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদকে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার আবেদন জানান। কিন্তু জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদ জেনারেল জিয়াউর রহমানের আবেদনে পুনরায় রাষ্ট্রপতি হতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পুনরায় গ্রহণ না করার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি ঐদিনই জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দান করে ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানকে পূর্ণ সমর্থন জানান।
১৫ই আগষ্ট এবং ৭ই নভেম্বরের ঐতিহাসিক ঘটনা দুইটি বিচ্ছিন্ন নয়। ঘটনা দুইটি একই সূত্রে বাঁধা৷ একই চেতনায় উদ্বুদ্ধ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশের নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল এই দুইটি বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান। ১৫ই আগষ্ট অগ্রণীর ভূমিকায় ছিল সেনা পরিষদ আর ৭ই নভেম্বর একই দায়িত্ব যৌথভাবে পালন করেছিল সেনা পরিষদ এবং কর্নেল তাহেরের অধিনস্থ গণবাহিনী। এই দুইটি ঐতিহাসিক জনপ্রিয় অভ্যুত্থানের চেতনা ছিল জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার চেতনা, গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেতনা, ইন্দো-সোভিয়েত বলয়ের নাগপাশ ছিন্ন করে জাতীয় স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলার চেতনা, স্বৈরশাসন ও একনায়কত্বের অবসান ঘটিয়ে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার চেতনা- এক কথায় বলতে গেলে ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
৩রা নভেম্বর থেকে ৭ই নভেম্বর এই সময়ের আমার এ ঘটনা বিবরণের স্বপক্ষে প্রমাণ হয়ে আছে ৭ই নভেম্বর সফল বিপ্লবের পর সৈনিক-জনতার মুখে ধ্বনিত শ্লোগানগুলি। সেদিন ঢাকার আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছিল গগনবিদারী শ্লোগানে, নারায়ে তাকবীর। আল্লাহু আকবর।
সিপাহী-জনতা ভাই ভাই। খালেদ চক্রের রক্ত চাই।
খন্দোকার মোশতাক জিন্দাবাদ।বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
মেজর ডালিম জিন্দাবাদ। কর্নেল তাহের জিন্দাবাদ।
ডালিম তাহের ভাই ভাই। বাকশালীদের রক্ষা নাই।
রশিদ-ফারুক জিন্দাবাদ। খালেদ মোশাররফ মুর্দাবাদ।
জেনারেল জিয়া যেখানে, আমরা আছি সেখানে।
১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ এর বৈপ্লবিক সফল অভ্যুত্থান বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। অম্লান হয়ে থাকবে নিজ মহিমায়। সেদিন আগষ্ট বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের মাটি থেকে স্বৈরশাসনের একনায়কত্ব ও একদলীয় শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটেছিল এবং উম্মোচিত হয়েছিল বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দ্বার। আগষ্ট বিপ্লব বাকশালী কালো অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়ে রাজনীতিতে গতিশীলতার সৃষ্টি করে সূচনা করে এক নতুন দিগন্তের। ‘৭৫ এর বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সময় বাকশালী প্রবীণ নেতা মরহুম আব্দুল মালেক উকিল লন্ডন সফর করছিলেন। মুজিব হত্যার প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তখন সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “বাংলাদেশে ফেরাউনের পতন হয়েছে।” আওয়ামী-বাকশালী নেতা জনাব মহিউদ্দিন আহমদ খন্দোকার মোশতাক সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে ছুটে গিয়েছিলেন সোভিয়েত নেতৃবৃন্দকে আগষ্ট বিপ্লবের অপরিহার্যতা বুঝিয়ে তাদের সমর্থন আদায় করার জন্য। জনাব আবু সাইদ চৌধুরী মুজিব সরকারের সাবেক রাষ্ট্রপতিও স্বেচ্ছায় খন্দোকার মোশতাকের বিশেষ দূত হিসেবে ও পরবর্তিকালে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ ও পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্র সফর করে আগষ্ট বিপ্লবের প্রয়োজনীয়তা ও অপরিহার্যতা সম্পর্কে সে সমস্ত দেশের নেতৃবৃন্দকে অবহিত করার দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
১৫ই আগষ্ট বৈপ্লবিক অভুত্থান ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর যে জাতীয়তাবাদী চেতনা ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির উন্মেষ ঘটেছিল জাতীয় জীবনের প্রতিক্ষেত্রে তারই ধারা আজও দুর্বার গতিতে বয়ে চলেছে। নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম ও জাতীয় মুক্তির প্রতীক ১৫ই আগষ্টের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ও তার চেতনা সর্বকালে সর্বযুগে এদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক ও সচেতন নাগরিক ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে প্রেরণা যোগাবে নব্য সৃষ্ট মীরজাফর ও জাতীয় বেঈমানদের উৎখাত করতে। জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করার জ্বলন্ত নিদর্শন ১৫ই আগষ্টের মহান বিপ্লব।
গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল !
শেখ মুজিবকে জাতির পিতা কিংবা বঙ্গবন্ধু হিসেবে মেনে নেওয়ার কোন যুক্তি নেই।
কোন ব্যক্তিকে জাতির পিতার মর্যাদা দেবার বিষয়টি জনগণের আবেগের সাথে জড়িত। শক্তি প্রয়োগ করে কিংবা আইনের দাপটে ঐ আবেগ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। স্বাধিকারের আন্দোলনের মুজিবের অবদান অন্যান্য নেতাদের মতই সর্বজন স্বীকৃত। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিব যখন ক্ষমতাসীন হন তখন তিনি ছিলেন নিঃসন্দেহে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। তার আমলেই দেশের সংবিধান প্রণীত হয়েছিল, সেখানে তাকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার জন্য জনগণের উপর কোন বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়নি। মাত্র তিন বছরের মাথায় দুঃশাসনের জন্য তার জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। ‘৭৫ এর জানুয়ারীতে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে স্বৈরাচারী একদলীয় বাকশাল কায়েম করে তিনি পারিবারিক রাজতন্ত্রই কায়েম করেছিলেন। স্বৈরশাসনের নাগপাশ থেকে জনগণকে মুক্ত করেছিল ১৫ই আগষ্টের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান। অভ্যুত্থানের পর খন্দোকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। তিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান তার সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। বাকশালীয় সাংসদরা মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে সামান্য প্রতিবাদও করলেন না; শেখ মুজিবের মন্ত্রীদের বৃহদাংশ মোশতাক সরকারে যোগ দিলেন। রক্ষী বাহিনীর প্রধান কোন প্রতিক্রিয়াও দেখালেন না। পক্ষান্তরে জনগণের মধ্যে স্বতঃস্ফুর্তভাবে যে প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল সে কথা ঐ সময়ে যাদের বয়স অন্ততঃ ১০/১২ বছর তাদেরও স্পষ্ট মনে থাকার কথা। গত ১৫ই জুলাই ২০০১ সালের রাতে কেয়ারটেকার সরকার কায়েম হবার পরপরই স্বতঃস্ফুর্তভাবে জনগণ বিপুল সংখ্যায় মুক্তির আনন্দ যেভাবে প্রকাশ করেছে, ‘৭৫ এর আগষ্টে জনগণ এর চেয়েও বহুগুন বেশি আবেগ-উচ্ছাস ও আনন্দে মেতে উঠেছিল। উপরোক্ত প্রতিক্রিয়া এ কথাই প্রমাণ করে যে, শেখ মুজিবকে জনগণ জাতির পিতা হিসেবে শ্রদ্ধা করেনি। বরং তার কুশাসন থেকে মুক্তি পেয়ে পরম স্বস্তি বোধ করেছে। এবং আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছে। এতেও প্রমাণিত হয় যে, শেখ মুজিব কখনোই জনগণের মনে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেনি। তা না হলে তার নিহত হবার কারণে রাস্তায় নেমে জনগণ অবশ্যই বিলাপ করতো। বিলাপ করা তো দূরের কথা কেউ প্রকাশ্যে সেদিন “ইন্নালিল্লাহ….” পড়েছে বলেও নাকি জানা যায়নি। বঙ্গবন্ধু উপাধিতে যারা তাকে ভূষিত করেছিল তারাই আবার সে উপাধি ফিরিয়ে নিয়েছিল। এ ব্যাপারে পূর্বে আলোচিত হয়েছে।
♦ পাকিস্তানের রাজনীতির পরিণাম – স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং আমাদের সিদ্ধান্ত
♦ কোলকাতায় অবস্থিত প্রবাসী সরকার এবং মুক্তিযুদ্ধ
♦ ভারতীয় নীলনকশা এবং মুজিব নগর সরকার
♦ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো হল ; আদর্শিক দেউলিয়াপনা, কোন্দল ও ভাঙ্গন
♦ ৭১ এর চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আওয়ামী কুশাসন এবং প্রতিরোধ
♦ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী এবং মুজিব সরকার
♦ আওয়ামী দুঃশাসন এবং দুর্নীতির মুখোমুখি সামরিক বাহিনী
♦ বহুদলীয় গণতন্ত্রকে কবর দিয়ে বাকশালী স্বৈরশাসন কায়েম
♦ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে ১৫ই আগষ্টের মহান বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান
♦ প্রতিবিপ্লবী চক্রান্ত, মোশতাক সরকার এবং সেনা পরিষদ
♦ ৩রা নভেম্বরের ব্যর্থ ক্যু’দাতা এবং ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার সফল বিপ্লব
“আমি মেজর ডালিম বলছি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ