[কবি সম্রাট রবীন্দ্রনাথের “আজি হ’তে শতবর্ষ পরে” পড়িয়া]
আজি হ’তে শত বর্ষ আগে
কে কবি, স্মরণ তুমি করেছিলে আমাদেরে
শত অনুরাগে,
আজি হ’তে শত বর্ষ আগে !
ধেয়ানী গো, রহস্য-দুলাল !
উতারি’ ঘোমটাখানি তোমার আঁখির আগে
কবে এলো সুদূর আড়াল?
অনাগত আমাদের দখিন-দুয়ারী
বাতায়ন খুলি’ তুমি, হে গোপন হে স্বপন-চারী,
এসেছিলে বসন্তের গন্ধবহ-সাথে,
শত বর্ষ পরে যথা তোমার কবিতাখানি
পড়িতেছি রাতে !
নেহারিলে বেদনা-উজ্জ্বল আঁখি-নীরে,
আমনা প্রজাপতি নীরব পাখায়
উদাসীন, গেলে ধীরে ফিরে !
আজি মোরা শত বর্ষ পরে
যৌবন-বেদনা-রাঙা তোমার কবিতাখানি
পড়িতেছি অনুরাগ-ভরে ।
জড়িত জাগর ঘুমে শিথিল শয়নে
শুনিতেছে প্রিয়া মোর তোমার ইঙ্গিত-গান
সজল নয়নে !
আজো হায়
বারে বারে খুলে যায়
দক্ষিণের রুদ্ধ বাতায়ন,
গুমরি’ গুমরি’ কাঁদে উচাটন বসন্ত-পবন
মনে মনে বনে বনে পল্লব-মর্মরে,
কবরীর অশ্রুজল বেণী-খসা ফুল-দল
পড়ে ঝ’রে ঝ’রে !
ঝিরিঝিরি কাঁপে কালো নয়ন-পল্লব,
মধুপের মুখ হ’তে কাড়িয়া মধুপী পিয়ে পরাগ-আসব !
কপোতের চষ্ণুপুটে কপোতীর হারায় কূজন,
পরিয়াছে বনবধূ যৌবন-আরক্তিম কিংশুক-বসন !
রহিয়া রহিয়া আজো ধরণীর হিয়া
সমীর-উচ্ছ্বাসে যেন ওঠে নিঃশ্বসিয়া !
তোমা হ’তে শত বর্ষ পরে—
তোমার কবিতাখানি পড়িতেছি, হে রবীন্দ্র,
অনুরাগ-ভরে !
আজি এই মদালসা ফাল্গুন-নিশীথে
তোমার ইঙ্গিত জেগে তোমার সঙ্গীতে !
চতুরালি, ধরিয়াছি তোমার চাতুরী !
করি চুরি
আসিয়াছ আমাদের দুরন্ত যৌবনে,
কাব্য হ’য়ে, গান হ’য়ে, সিক্তকণ্ঠে রঙ্গিলা স্বপনে।
আজিকার যত ফুল—বিহঙ্গের যত গান
যত রক্ত-রাগ
তব অনুরাগ হ’তে, হে চির-কিশোর কবি,
আনিয়াছে ভাগ !
আজি নব-বসন্তের প্রভাত-বেলায়
গান হয়ে মাতিয়াছ আমাদের যৌবন মেলায়!
আনন্দ-দুলাল ওগো হে চির অমর!
তরুণ তরুণী মোরা জাগিতেছি আজি ত্ব
মাধবী বাসর!
যত গান গাহিয়াছ ফুল-ফোটা রাতে—
সবগুলি তার
একবার—তা’ পর আবার
প্রিয়া গাহে, আমি গাহি, আমি গাহি প্রিয়া গাহে সাথে !
গান-শেষে অর্ধরাতে স্বপনেতে শুনি
কাঁদে প্রিয়া, “ওগো কবি ওগো বন্ধু ওগো মোর গুণী—
” স্বপ্ন যায় থামি’,
দেখি বন্ধু, আসিয়াছ প্রিয়ার নয়ন-পাতে
অশ্রু হ’য়ে নামি’ !
মনে লাগে, শত বর্ষ আগে
তুমি জাগো—তব সাথে আরো কেহ জাগে
দূরে কোন্ ঝিলিমিলি-তলে
লুলিত অঞ্চলে।
তোমার ইঙ্গিতখানি সঙ্গীতের করুণ পাখায়
উড়ে যেতে যেতে সেই বাতায়নে ক্ষণিক তাকায়,
ছুঁয়ে যায় আঁখি-জল-রেখা,
নুয়ে যায় অলক-কূসুম,
তারপর যায় হারাইয়া,—তুমি একা বসিয়া নিঝঝুম !
সে কাহার আঁখিনীর-শিশির লাগিয়া
মুকুলিকা বাণী তব কোনটি বা ওঠে মঞ্জুরিয়া,
কোনটি বা তখনো গুঞ্জরি’ ফেরে মনে
গোপনে স্বপনে !
সহসা খুলিয়া গেল দ্বার,
আজিকার বসন্ত-প্রভাতখানি দাঁড়াল করিয়া নমস্কার !
শতবর্ষ আগেকার তোমারি সে বাসন্তিকা দূতি
আজি নব নবীনেরে জানায় আকুতি!…
হে কবি-শাহান-শাহ্ ! তোমারে দেখিনি মোরা,
সৃজিয়াছ যে তাজমহল—
শ্বেতচন্দনের ফোঁটা কালের কপালে ঝলমল—
বিস্ময়ে-বিমুগ্ধ মোরা তাই শুধু হেরি,
যৌবনের অভিশাপ—“কেন তুই শতবর্ষ করিলি রে দেরী?”
হায়, মোরা আজ
মোতাজে দেখি নি, শুধু দেখিতেছি তাজ !
শত বর্ষ পরে আজি, হে কবি-সম্রাট !
এসেছে নূতন কবি—করিতেছে তব নান্দীপাঠ !
উদয়াস্ত জুড়ি’ আজো তব
কত না বন্দনা-ঋক ধ্বনিয়া উঠিছে নব নব ।
তোমারি সে হারা-সুরখানি
নববেণু-কুঞ্জ-ছায়ে বিকশিয়া তোলে নব বাণী ।
আজি তব বরে
শত বেণু-বীণা বাজে আমাদের ঘরে।
তবুও পুরে না হিয়া ভরে না ক’ প্রাণ,
শতবর্ষ সাঁতরিয়া ভেসে আসে স্বপ্নে তব গান ৷
মনে হয়, কবি,
আজো আছে অস্তপাট আলো করি’
আমাদেরি রবি !
আজি হ’তে শত বর্ষ আগে
যে-অভিবাদন তুমি ক’রেছিলে নবীনেরে
রাঙা অনুরাগে,
সে-অভিবাদনখানি আজি ফিরে চলে
প্ৰণামী-কমল হ’য়ে তব পদতলে !
মনে হয়, আসিয়াছ অপূর্ণের রূপে
ওগো পূর্ণ, আমাদেরি মাঝে চুপে চুপে !
আজি এই অপূর্ণের কম্প্র কণ্ঠস্বরে
তোমারি বসন্তগান গাহি তব বসন্ত-বাসরে—
তোমা হ’তে শত বর্ষ পরে !
“চক্রবাক” কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ