“বশীকরণ কবজে কাজ হয়?” ফোনে আমাকে এই প্রশ্নটা করেছিলেন আমারই এক প্রিয় কবি। আমি হতভম্ব? নন্দন-চত্তর দাপিয়ে বেড়ানো প্রখর বুদ্ধিজীবী হিসেবে চিহ্নিত মানুষটির এ কী ধরনের উদ্ভট চিন্তা?
প্রশ্নটা যে নেহাত হালকা চালে নয়, গভীর সমস্যার খাদ থেকে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টার অঙ্গ—দু’ চার কথায় সেটা বুঝে দুঃখ পেলাম। বোঝাবার চেষ্টা করলাম, “ও’সবে কিচ্ছু কাজ হয় না।”
–“তবে যে তান্ত্রিকরা রোজ পত্রিকায় গ্যারান্টি দিয়ে বশীকরণের বিজ্ঞাপন দিচ্ছে?”
—“ব্যাপারটা হল, তোমাকে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে বশ করে মোটা টাকা হাতিয়ে নেবার গ্যারান্টি। আসল সত্যিটা কী জান? যে যতবড় তান্ত্রিক, সে তত বড় প্রতারক।”
‘নন্দন’ চত্বরে ওই কবির সঙ্গে একদিন দেখা। উদাস দৃষ্টি। “কেমন আছ? তারপর তো আর ফোন পাইনি।” কথাগুলো বলতে বলতে স্বাভাবিক ভালোবাসার অভিব্যক্তি হিসেবে কবির দু’কাঁধে হাত রেখেছিলাম। হাত দুটো ওর বাহু ছুঁয়ে কনুইতে নামতে নামতে টের পেলাম, কবির ডান হাতে একটা ঢাউস তাবিজ। ওঁর পাঞ্জাবির হাতা আমার কাছে তাবিজকে লুকোতে পারেনি বুঝে, সামান্য লজ্জিতভাবে কবি স্বীকার করলেন, এক বশীকরণে সিদ্ধহস্ত মা’য়ের কাছ থেকে তাবিজটা নিয়েছেন। খরচ পড়েছে পঁয়তিরিশ হাজার।
কবির অব্যর্থ বশীকরণ তাবিজ ব্যর্থ হয়েছে। মেয়েটি এখন বিয়ে করে লন্ডনে।
এক দিনের ঘটনা। জবরদস্ত এক রাজনৈতিক নেতা একটা অনুষ্ঠানে আমাকে হাতের কাছে পেয়ে পাকড়াও করলেন। নেতাকে ঘিরে একগাদা চামচা, যেমনটা হয় আর কী। নেতা বললেন, “আপনার অলৌকিক নয়, লৌকিক’ পড়েছি। ভালই। কিন্তু আপনি যেভাবে অলৌকিক কিছুই নেই বলছেন, তা মানি কী করে? আমার সন্তান হচ্ছিল না। তখন … তান্ত্রিক যজ্ঞ করে আমার ওয়াইফের গর্ভসঞ্চার করলেন। আপনি এর কী ব্যাখ্যা দেবেন?” হেঁ-হেঁ করে হাসলেন নেতা।
চামচারাও হেঁ হেঁ করে হাসতে হাসতে সমস্বরে চেঁচাতে লাগলেন, “এর কী ব্যাখ্যা দেবেন?”
আমার ঘাড়ে একটাই মাথা, তাই ব্যাখ্যা দিইনি।
আমার ভায়রার গলায় ক্যানসার ধরা পড়লো। ডাঃ আবিরলাল মুখোপাধ্যায় গলায় একটা বাইপাস অপারেশন করবেন, ঠিক হল। আবার চোখ বুজে দশ-পনেরো বছর ক্যানসারে না মরার নিশ্চিত গ্যারান্টি।
অপারেশনের আগের দিন ভায়রার দুই আত্মীয় শ্যালিকাকে নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে এসে হাজির। তারপর আমার নির্বুদ্ধিতাকে নিয়ে এক হাত নিলেন। ওদের কাছে জানলাম, ক্যানসারে ছুরি ছোঁয়ালেই নাকি দ্রুত কষ্টকর মৃত্যু। শ্যালিকার বড়ি- ল্যাঙ্গুয়েজ বলে দিচ্ছিল, আমি যেন তাঁর বরকে আর একটু হলেই মেরে ফেলতে যাচ্ছিলাম। শিক্ষিত মূর্খ আর সবজানতা ভণ্ডদের সঙ্গে তর্ক করতে নেই। এতে সময় ও শরীর দুই-ই নষ্ট হয়। অতএব চুপ রইলাম ।
ভায়রাকে ওঁরা নিয়ে গেলেন এক অলৌকিক মাতাজীর কাছে। তিরিশ হাজারের বিনিময়ে দিন তিরিশেক বেঁচে ছিলেন। শেষ পনেরো দিন কথা বন্ধ। শেষ দশ দিন খাওয়া বন্ধ। মৃত্যুর দু’দিন আগে থেকে চামচে দিয়ে গলায় ঢালা জলও গিলতে পারতেন না।
মন্ত্রশক্তি বা জাদুশক্তিতে আস্থা রাখা শিক্ষিতের অভাব নেই আমাদের দেশে । কলকাতার বেশ কয়েকটা টিভি চ্যানেল ইতিমধ্যেই ‘তন্ত্র-চ্যানেল’ হয়ে গেছে। টিভি খুললেই তান্ত্রিক-জোতিষীদের রমরমা। ‘সরাসরি ফোনে’ অনুষ্ঠান চলেছে ঝমঝমিয়ে। অনুষ্ঠান পরিচালকদের পক্ষ থেকে তান্ত্রিক-জ্যোতিষীদের নাকি অভয় দেওয়া হচ্ছে— বেয়াড়া প্রশ্ন এলে ফোন লাইন কেটে দেবার দায়িত্ব তাঁদের।
হাস্যময় বুদ্ধের পুতুল রাখলে পরিবারে সৌভাগ্য গড়াগড়ি দেবে—এমন হাস্যকর প্রচারে বিশ্বাস করে ফেংশুইয়ের দোকানে লাইন দেবার মত শিক্ষিতের অভাব আমাদের দেশে নেই । মন্ত্রশক্তিতে বিশ্বাস বা জাদু বিশ্বাসের ভারতীয় ঐতিহ্য অতি প্রাচীন।
বেদের যুগ থেকে এই ঐতিহ্য আমরা সমানে বহন করে চলেছি।
দেশ জুড়ে ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘোরাবার কর্মযজ্ঞ চলছে।
আমজনতাকে অন্ধ বানাবার প্রক্রিয়া চলেছে। অন্ধের
কিবা দিন, কিবা রাত। তবু মনে হয়,
কলজে ফাটিয়ে চিৎকার করি,
“হে অন্ধ, রাত্রি নেমেছে !”
ভারত জুড়ে জাদু বিশ্বাসের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন
ভারতে প্রায় পাঁচশো গুহা খুঁজে পাওয়া গেছে, যেগুলোতে রয়েছে হাজার হাজার গুহাচিত্র। এ’সব চিত্র প্রাগৈতিহাসিক যুগে আঁকা হয়েছিল। স্পেকটোগ্রাফি ইনফ্রারেড ফটোগ্রাফি, কার্বন ১৪ ইত্যাদি প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে এ’সব গুহাচিত্র রচনার কাল নির্ণয় করা হয়েছে। মধ্যপ্রদেশের ‘ভীমভেট্কা’, ‘মানোয়া ভান কি টেরি’, ‘চিতাডুংরি’, ‘পাঁচমারি’, ‘করা’, ‘খারবাঈ’, ‘ভোঁরাবালি’ প্রভৃতি পাহাড়ের গুহাগুলোয় পাওয়া গেছে অস্ত্র, কুডুল, ছুরি, ছোরা, খুন্তি ইত্যাদি গৃহস্থালির জিনিস, হাড়ের, শিংয়ের, দাঁতের, নানা গয়না আর দেওয়ালচিত্র। এগুলো আনুমানিক ১ হাজার থেকে ১০ হাজার বছরের পুরনো।
ভীমভোয় চিত্রধারার উদ্ভবকাল কম-বেশি ১০ হাজার বছর। উত্তর কাশ্মীরের ‘বুর্জহোম’ পর্বতের গুহায় পাওয়া গেছে ৪ হাজার বছর আগের আঁকা দেওয়ালচিত্র। কর্ণাটকের বিভিন্ন পাহাড়ের গুহায় পাওয়া গেছে দুই থেকে আড়াই হাজার বছর আগের দেওয়ালচিত্র। ওড়িশার যোগীমঠ পাহাড়ের গায়ে পাওয়া গেছে দেওয়ালচিত্র। এ’সব গুহাচিত্রে আদিম শিল্পীরা এঁকেছেন নানা পশুর ছবি। যেমন—বাঘ, ভাল্লুক, গণ্ডার, হাতি, হরিণ, মোষ, বরাহ ইত্যাদি। আছে শিকারের ছবি। মধু সংগ্রহ, গাছে ওঠা, মাছ ধরা, ফাঁদ পেতে জন্তু ধরার মত নানা জীবিকার ছবি রয়েছে। রয়েছে দলবদ্ধ নাচ, নগ্ন নারী, পুরুষের-নারীর মিলন সম্পর্কের ছবি, পশু দেবতা, বনদেবতার ছবি। বিভিন্ন গুহায় পাওয়া গেছে নানা জাদু বিশ্বাসের ছবি।
উদাহরণ হিসেবে অন্তত একটি পাহাড়ের গুহাচিত্রকে আলোচনায় টানছি। মধ্যপ্রদেশের রইসেন জেলায় ভীমভেট্কা পাহাড়। বিন্ধ্য পর্বতমালার অংশ । এখানে পাওয়া গেছে আশ্চর্য সব আদিম চিত্রাবলী। ১৯৫৭ সালে পুরাতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ওয়াকানকার ওই গুহাচিত্রগুলো খুঁজে পান। তখন এসবের নির্মাণকাল নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভব হয়নি। তারপর গোটা পৃথিবীর পুরাতত্ত্ববিদদের নজর টানলো ভীমভেট্কা। প্রযুক্তি পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গেছে গুহাচিত্রগুলো ৮০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৈরি হয়েছিল।
ভীমভেটকা ভূপাল থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটারের পথ। বাসে গেলে নামতে হবে ভিয়াপুর গ্রামে। সেখান থেকে পাহাড়ের পাদদেশে ১৫-২০ মিনিটের পথ। গ্রামের মানুষরা প্রায় সকলেই আদিবাসী। ওরা এখনও দুটো কাঠ ঘষে আগুন জ্বালে ৷ ওদের বিশ্বাস, দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম হিড়িম্বাকে বিয়ে করে কিছু দিন এখানে বেটকা অর্থাৎ বাটিকা (বাড়ি) করে ছিলেন। আদিবাসীদের ভিয়াপুর হল ভীমপুর। অজ্ঞাতবাসের সময় পাণ্ডবরা নাকি কিছু দিন ভিয়াপুরের কাছে আস্তানা করেছিলেন। এখন জায়গাটার নাম পাণ্ডাপুর, অর্থাৎ পাণ্ডবপুর।
ভীমভেটকার গুহাগুলোয় যে সব চিত্র পাওয়া গেছে তাতে রয়েছে টোটেম হিসেবে
বরাহ ও বাঘের ছবি, শিকারের দৃশ্য এবং জাদুবিশ্বাসের নানা প্রতীক। পাওয়া গেছে এক আদিম জাদুকরের ছবি। মাথায় হরিণের শিং, দু’হাতে বাঁধা হাড়ের গয়না। বাঁ হাতে ত্রিশূল। নৃত্যরত জাদুকর। নৃতত্ত্ববিদদের অনেকেই যেমন ছবিটিকে জাদুকর এবং জাদুবিশ্বাসের প্রতীক বলে ধরে নিয়েছেন। আবার অনেকে এটিকে আদি নটরাজ এবং জাদুর দেবতা বলে চিহ্নিত করেছেন।
ভীমভোয় গুহাগুলোতে অনেক হাতের ছাপের ছবি পাওয়া গেছে। হাতের ছাপকে জাদুশক্তির প্রতীক বলে মনে করাটা প্রায় বিশ্বজনীন। বিশ্ব জুড়ে প্রায় সব আদিম মানব গোষ্ঠীর মধ্যে এই বিশ্বাস ছিল। আজও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ অশুভ শক্তিকে ঠেকাতে দরজায় বা দেওয়ালে হাতের ছাপ এঁকে রাখে । এই আমাদের ভারত-দর্শন, এই আমাদের ‘ললাট লিখন’।
হরপ্পা সভ্যতা ও জাদু বিশ্বাস
হরপ্পা সভ্যতার নিদর্শনগুলোতে পাওয়া গেছে জাদু বিশ্বাসের বহু প্রতীক। এই হরপ্পা সভ্যতা ছিল আনুমানিক ২৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
হরপ্পা সভ্যতার নিদর্শনগুলোতে পাওয়া গেছে জাদু বিশ্বাসের বহু প্রতীক। এই হরপ্পা সভ্যতা ছিল আনুমানিক ২৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।
এই সভ্যতার প্রত্ননিদর্শন পাওয়া গেছে পূর্বে দিল্লির কাছে আলমপুর, পশ্চিমে ইরান সীমান্তের কাছে সুতকাগেন- দোর, উত্তরে জম্মুর কাছে মান্দা ও দক্ষিণে ভগতরব। অর্থাৎ হরপ্পা সভ্যতার প্রত্ননিদর্শন পাওয়া গেছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে । নতুন নতুন খননে নতুন নতুন হরপ্পা সভ্যতার নগরের নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। যেমন— রাজস্থানে কালিবঙ্গান, পাঞ্জাবে রূপার, গুজরাটে বন্দর শহর লোথাল। নিদর্শন মিলছে পাকিস্তানেও। এখনও পর্যন্ত পাওয়া নিদর্শনের ভিত্তিতে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োই সেরা। হরপ্পা সভ্যতার চরিত্র নগরকেন্দ্রিক। যে কোনও নগর সভ্যতাই টিকে থাকে শস্য উৎপাদনের উপর। শহরগুলোতে শস্য আসতো আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষিজীবীদের কাছ থেকে। শহরগুলোতে সুনির্মিত শস্যভাণ্ডারের সন্ধান পাওয়া গেছে।
যা ‘হরপ্পা সভ্যতা’, তা-ই ‘সিন্ধু সভ্যতা’। আমরা একই সঙ্গে ‘সিন্ধু সভ্যতা’
ও ‘আর্য সভ্যতা’ নিয়ে গর্ব অনুভব করি। অনেকে ভুল করে ‘সিন্ধু সভ্যতা’ ও ‘আর্য সভ্যতা’কে এক ও অভিন্ন মনে করি। সিন্ধু অঞ্চলের লোকেরা উপমহাদেশের উত্তর ও পশ্চিম অঞ্চলের সঙ্গে ফলাও ব্যবসা করতো, পারস্য উপসাগর ও মেসোপটেমিয়ার লোকদের সঙ্গে ফলাও বাণিজ্য চলতো। পারস্য উপসাগর ও মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার নানা নিদর্শন তার-ই স্পষ্ট প্রমাণ।
হরপ্পা যুগে তৈরি ব্রোঞ্চের নারী মূর্তি, নানা গয়না, পালিশ করা মাটির পাত্রের যে-সব নিদর্শন পাওয়া গেছে, তা দেখলে বোঝা যায় সে’যুগে শিল্পকলা কী বিশাল উন্নত ছিল। যে’সব নারী মূর্তি পাওয়া গেছে, তার বেশির ভাগই নগ্নিকা । হরপ্পা থেকে এমন একটি শীল বা শীলমোহর পাওয়া গেছে যার এক পিঠে এক নগ্ন নারী দু’পা দু’দিকে প্রসারিত। যোনি থেকে বেরিয়ে এসেছে গাছ বা শস্য। অনেক পুরাতাত্ত্বিকদের মতে এটি পুরাণে বর্ণিত শাকম্ভরীদেবী, শস্যদেবী বা বসুমতীর প্রাথমিক রূপকল্পনা। শীলটির অপর পিঠে খোদিত আছে, কাস্তেজাতীয় অস্ত্র হাতে একটি পুরুষ একটি নগ্ন নারীকে বলি দিতে যাচ্ছে। পুরাতাত্ত্বিকদের মতে ভূমিদেবী বা বসুমতীর উদ্দেশ্যে উর্বরতা কামনায় মানুষবলির ঘটনা এখানে খোদিত হয়েছে। এই নরবলি জাদুশক্তিতে বিশ্বাস থেকেই এসেছে। নারীর যোনি থেকে শস্যের উৎপত্তির চিত্রও নারীর উৎপাদিকা শক্তির সঙ্গে ভূমির উৎপাদিকা শক্তির প্রতীক হিসেবে ব দেখাটাও জাদুশক্তিতে বিশ্বাসের প্রতিফলন।
হরপ্পা সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যে সব শীল পাওয়া গেছে তার মধ্যে অদ্ভুত চেহারার নানা জন্তুর পাশাপাশি পরিচিত বাঘ, বরাহ, ষাঁড়, কুমির ইত্যাদির ছবিও আছে। পাওয়া গেছে পাথরের তৈরি অসংখ্য লিঙ্গ ও যোনি। লিঙ্গ ও যোনি ভূমির উর্বরতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে জাদু বিশ্বাসের প্রতীক।
‘লিঙ্গ’ শব্দটি অস্ট্রিক থেকে আসা। শব্দটির অর্থ পুরুষাঙ্গ এবং মাটি খোঁটার খুরপি। লাঙল শব্দটিও লিঙ্গেরই রূপ ভেদ। জমি, ভূমি, প্রকৃতিকে নারী রূপে কল্পনা অতিপ্রাচীন। পুরুষ ভূমিতে লাঙল চষে বীজ বপন করে। ভূমির উর্বরতা দেয় শস্য। আবার উর্বরা নারী পুরুষের বীজ বা বীর্য ধারণ করে সন্তানের জন্ম দেয় ৷ একটা সময় শস্য ও মানুষ দুই-ই গোষ্ঠীর সম্পদ বলে বিবেচিত হত। উর্বরতার কামনায় সে-যুগে লিঙ্গ-যোনির পুজো, যৌনমিলন, যৌন আচরণমূলক নানা আচার পালন করা হত। এ’সবই ‘উর্বরতার জাদু বিশ্বাস’ (fertility magic or fertility cult ) বলে মনে করেন পুরাতত্ত্ববিদরা। আজও ভারতের কিছু প্রান্তে বীজবপন ও ফসল ধরার সময় নানা যৌন আচরণের রেওয়াজ আছে। নাগা, ছোটনাগপুরের হো উপজাতি, ওড়িশার ভূঁইয়া, জয়পুরের পাঞ্জা, নীলগিরির কোটা ইত্যাদি উপজাতিদের মধ্যে ভাল ফসলের কামনায় নরনারীরা নানা যৌন আচরণ করে। উদ্দাম এই যৌন আচরণ বা যৌন মিলনকে তারা এক ধরনের ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক’ বা ‘তুক’বলে মনে করে। অসমের বিহু উৎসব এক সময় ছিল ফসল কামনায় যৌন উৎসব।
হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম বড় বৈশিষ্ট্য হলো শীলমোহরগুলো। ছোট, চৌকো বা
আয়তকার, চ্যাপ্টা এইসব শীলমোহরে মানুষ ও পশুর নানা মূর্তি ও লেখা খোদাই করা আছে। হরপ্পা যুগে যে লিপির ব্যবহার ছিল, লেখাগুলো তারই প্রমাণ।
হরপ্পায় যে সব শীল পাওয়া গেছে সে’সব দেখে কিছু নৃতত্ত্ববিদ মনে করেন যে, এইসব শীলের সঙ্গে জড়িত রয়েছে জাদু বিশ্বাস। অশুভ শক্তিকে আটকাতে, শুভ শক্তিকে জয় করতে ও উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি করতে এই শীলগুলো তৈরি, এমনটা মনে করার মত যথেষ্ট কারণ রয়েছে। শীলগুলোর দু’পিঠে মানুষ পশু ও নানা ঘটনা খোদিত হয়েছে। সেই সঙ্গে খোদিত হয়েছে কিছু অক্ষর বা সাংকেতিক চিহ্ন। এইসব অক্ষর বা সাংকেতিক চিহ্নের অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। শীলমোহরগুলোর লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল, প্রায় চাকতিতেই ওপরের দিকে একটা করে ছিদ্র রয়েছে। কেন ছিদ্র? এগুলো কি তবে তাবিজ বা কবজের মত ধারণ করা হতো অশুভ শক্তিকে দূরে রাখতে ও শুভ শক্তির সাহায্য পেতে? জাদুশক্তির প্রতীক হিসেবে কি টোটেম, দেবতা বা ঘটনা খোদিত করা হত? অক্ষর বা সাংকেতিক চিহ্নগুলো কি কোনও জাদুশক্তির মন্ত্র বা সংকেত? ‘শীলমোহর’ বলে আমরা যে শব্দটি ব্যবহার করি, সেই শব্দটির অর্থ—এগুলো ছাপ মারার কাজে ব্যবহৃত হত। ছাপ মারার কাজে শীলমোহর ব্যবহারের পক্ষে কোনও প্রমাণ আমাদের হাতে নেই। এগুলো পণ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হত—এমনটা ভাবার মতো কোনও প্রমাণ আজও মেলেনি।
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, ফাদার হেরাস, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, রামাপ্রসাদ চন্দ, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, পল্লব সেনগুপ্ত প্রমুখ ঐতিহাসিক, ভাষাতত্ত্ববিদ, পুরাতত্ত্ববিদ ও সমাজতত্ত্ববিদরা মনে করেন জাদু বিশ্বাসের প্রতীক হরপ্পার এইসব বহু শীল। শীলগুলোতে জড়িয়ে রয়েছে ‘ফার্টালিটি কাল্ট’ বা উর্বরতামূলক জাদুবিশ্বাস, বলি, লিঙ্গ ও যোনিপুজোর নানা স্মারক। এ’সব প্রতীক ও স্মারক থেকে আলোচ্য পণ্ডিতরা অনুমান করেছিলেন—পরবর্তীকালে
হিন্দু-উপাসনা ধর্মে শিবশক্তির উপাসনা, যোগশাস্ত্র ও তন্ত্রের
যে প্রকাশ আমরা দেখেছি, তার আদিম
রূপ দেখা গিয়েছিল হরপ্পা
সভ্যতার কালে।
হরপ্পা সভ্যতার আবিষ্কার ১৯২১-২২ খ্রিস্টাব্দে। তারপর হরপ্পা নিয়ে বিদেশে গবেষকরাও রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে পল্লব সেনগুপ্তের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছিলেন যে, হরপ্পা সভ্যতার যুগে পাওয়া শীলগুলো ফার্টিলিটি কান্ট’-এর স্মারক। এইসব বিদেশি গবেষকদের মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব হলেন, মার্শাল ম্যাকে, এহরেনফেলস, স্টুয়ার্ট পিগট, হুইলার প্রমুখ ।
চার হাজার বছর পরেও এ’দেশে দিব্বি টিকে আছে ‘ফার্টিলিটি কাল্ট ।
বিপুল জনসংখ্যা বৃদ্ধি সমস্যার পরও লিঙ্গ-যোনির
পুজোয় একটুও ভাটার
টান আসেনি।
ভরা জোয়ার লেগেছে তন্ত্রে। সকালে খবরের কাগজের পাতা খুললেই তান্ত্রিক- জ্যোতিষীদের বিজ্ঞাপনের মিছিল দেখলে বোঝা যায়, বাঙালি সমাজ এগোচ্ছে পিছনের দিকে।
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ৫ম খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
অধ্যায়ঃ এক
ধর্মঃ সংজ্ঞায় গোলমাল
অধ্যায়ঃ দুই
উপাসনা ধর্মঃ প্রাচীন মত
♦ উপাসনা- ধর্মের (religion) উৎপত্তি
♦ একঃ দৈব-প্রত্যাদেশ বা অপৌরুষেয় প্রত্যাদেশ
♦ দুইঃ ঈশ্বরে বিশ্বাস; সহজাত প্রবৃত্তি
♦ তিনঃ ধর্মীয় আচরণ বাদে ঈশ্বর বিশ্বাস
♦ আধুনিক নাস্তিক্যবাদ ‘মার্কসবাদ’
অধ্যায়ঃ তিন
‘সমকালীন যুক্তিবাদ’ নাস্তিক্যবাদের সঙ্গে বাড়তি কিছু
♦ ‘সমকালীন যুক্তিবাদ’ চির নতুন
♦ তোমার আমার দুই চেতনার ভালো-খারাপ
♦ মারাদোনার পায়ের জাদু ও যুক্তিবাদ
♦ প্রেমের রহস্যময়তা ও যুক্তিবাদ
♦ ‘ঈশ্বরে বিশ্বাস’, ‘বিজ্ঞানের বিশ্বাস’ : আকাশ-পাতাল
অধ্যায়ঃ চার
উপাসনা ধর্মঃ আধুনিক মত
♦ উপাসনা-ধর্ম : নৃতত্ত্ব ও সমাজতত্ত্বের দৃষ্টিতে
অধ্যায়ঃ পাঁচ
ভারতবর্ষের জাদু সংস্কৃতি
♦ আদিম উপজাতি, আধুনিক উপজাতিঃ একই কথা
♦ ধর্মীয় জাদু বিশ্বাস ও ম্যাজিক শোঃ দুই পৃথিবী
অধ্যায়ঃ ছয়
তন্ত্রের প্রথম ধাপ যোগ, তারপর…
অধ্যায়ঃ সাত
বৈদিক সাহিত্য, জাদু-বিশ্বাস, যজ্ঞে যৌনাচার
♦ সত্য খোঁজে মুক্তমন, হিসেব কষে ভন্ড
♦ বৈদিক সাহিত্যের গপ্পো ও দুই ডাক্তার
♦ বৈদিক সাহিত্যে জাদু-বিশ্বাস, যজ্ঞের নামে যৌনাচার
অধ্যায়ঃ আট
হিন্দু উপাসনা-ধর্মে তন্ত্র
অধ্যায়ঃ নয়
শক্তিধর্মে তন্ত্র
অধ্যায়ঃ দশ
রেইকি গ্রাণ্ডমাষ্টার, ফেং শুই ক্ষমতার দাবিদার, জ্যোতিষী ও অলৌকিক ক্ষমতার দাবিদারদের প্রতি