হুজুর সাইদাবাদী বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় সুফী সাধক। বছর চল্লিশের এই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারীর দাবিদারের পিছনে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকা যত নিউজ প্রিন্ট খরচ করেছেন, তার ভগ্নাংশও অন্য কোনও পীর বা সাধকদের পিছনে হয়নি। হুজুর মাঝে মাঝেই ভক্তদের টানে কলকাতায় আসতেন। সবাইকে তো আর চিঠি দিয়ে তাঁর আগমনবাণী পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়, তাই হুজুর নিজের ছবিসহ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দিতেন কবে থেকে কবে কলকাতায় থাকবেন, কোথায় থাকবেন, কখন দর্শন দেবেন। সাধারণভাবে তিনি উঠতেন এসপ্ল্যানেডের গ্রান্ট স্ট্রিটের হীরা হোটেলে।
হীরা হোটেল এমন একটা এলাকায়, যে এলাকা শাসন করে কলকাতার অপরাধী জগতের কিছু নামী-দামীরা।
হুজুর সাইদাবাদীর পুরো নামটা বেশ বড়–আলহাজ্ব হুজুর দেওয়ান মোহাম্মদ সাসদুর রহমান চিশতি সাইদাবাদী। সংক্ষেপে হুজুর সাইদাবাদী। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার জনপ্রিয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে কলকাতায় এলেন। জানালেন, থাকবেন ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি।
ঠিক করে ফেললাম, হুজুর সাইদাবাদীর মুখোমুখি হবো। মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা একটিই—পেশাদার গুণ্ডা ও খুনে। খবর পেয়েছি, কলকাতা ভ্রমণকে নিরুপদ্রব রাখতে আধ্যাত্মিক
জগতের হুজুর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা অপরাধ জগতের এক নবাবের সাহায্য নিয়েছেন। পেশাদার গুণ্ডা ও খুনেরা হুজুরকে ঘিরে গড়ে তুলেছে এক বলয়। প্রতিরক্ষার বলয়। কলকাতার যুক্তিবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করার বলয়।
হুজুর সাইদাবাদীর সম্বন্ধে ইতিমধ্যে অনেক খবর সংগ্রহ করেছি। বাংলাদেশের সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ও যুক্তিবাদী বন্ধুরা ইতিমধ্যে পাঠিয়েছেন সেখানে হুজুর সাইদাবাদী বিষয়ে প্রকাশিত কিছু পত্র-পত্রিকা। পড়েছি ‘বর্তমান দিনকাল’, ‘সাপ্তাহিক সাংবাদিক’, ‘সপ্তাহিক নিপুন, ‘বঙ্গবাসী’, ‘পাক্ষিক শেষ সংবাদ’ ইত্যাদি। পত্রিকাগুলো হুজুরের দোয়া আর দাওয়ার কীর্তিতে ঠাসা। গাদা গুচ্ছের দম্পতির ছবি, যারা হুজুরের দয়ায় সন্তান পেয়েছে। ছবি আছে সেসময়কার রাষ্ট্রপতি হুসেন মহম্মদ এরশাদের সঙ্গে হুজুরের। ভক্তদের দাবি বেগম জিয়া থেকে শেখ হাসিনা—প্রত্যেকেই হুজুরের দরবার শরীফে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। দুষ্টেরা বলবেন—একজন সমাজ বিরোধীর হাতে কয়েক লক্ষ ভোটার থাকলে দেশের রাষ্ট্রপতি সমাজ বিরোধীকে সেলাম ঠুকবেন—এ যুগের রাজনীতিতে এটাই নীতি। হুজুরের ভক্ত সংখ্যা তো আরও বেশি। এরশাদ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন এক টাকার বিনিময়ে হুজুরকে ঢাকায় সাড়ে চার বিঘা জমি দিয়েছিলেন। সাড়ে চার বিঘা জমি জুড়ে হুজুরের বিশাল পাঁচতলা বাসভবন। ইসলামি স্থাপত্য শিল্পের এক
নিদর্শন। দরবার শরীফ ঘিরে মাদ্রাজা ও মসজিদ সহ একটা কমপ্লেক্স গড়ে তোলার কাজ চলছে। বহু কোটি টাকার প্রকল্প। এখন যতখানি গড়ে উঠেছে তা কলকাতার পাঁচতারা হোটেল গ্র্যান্ড, পার্ক বা তাজা-বেঙ্গলকে টেক্কা দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। হুজুর এতটা বিত্তবান হওয়া সত্ত্বেও কোলকাতার কোনও পাঁচতারা হোটেলে না উঠে আস্তানা গাড়েন হোটেল হীরায়—এতে অনেকে অবাক হতে পারেন। আমি হই না। এখানে হুজুর গুণ্ডারাজের প্রোটেকশন পান। পান যুক্তিবাদীদের হাত থেকে বাঁচার নিশ্চিত আশ্বাস। পুরো হোটেলটাই বুক করার সুবিধা ।
হুজুরের মাদ্রাসা ইতিমধ্যেই বিশাল আকার নিয়েছে। ১৯৯১-তে মাদ্রাসার ছাত্র সংখ্যা দু হাজারের বেশি। প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার নারী পুরুষের ভিড় হয়। এঁরা আসেন সন্ধান কামনায়, রোগমুক্তি ও সমস্যা মুক্তির বাসনায়। হুজুর দোয়া আর দাওয়া দেন। দর্শনী দশ টাকা, দাওয়ার দাম আলাদা। কমপ্লেক্স গড়ার কাজে কেউ কিছু দিলে নেওয়া হয়। ভক্তদের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক নেতা, শিল্পপতি, সাহিত্যিক, অভিনেতা, পেশায় সফল বিখ্যাত মানুষের অভাব নেই।
১৬ ফেব্রুয়ারি সকালে হাজির হলাম হীরা হোটেলে। বাইরে তখনই কোয়ার্টার কিলোমিটার লম্বা ভক্তের লাইন পড়ে গেছে। লাইনের টোকন দিচ্ছে ও লাইন দেখভাল করছে বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবক। স্বেচ্ছাসেবকদের চেহারা সত্যিই সন্দেহজনক। দেখলাম পরিকল্পনা মত লাইনে আমাদের সমিতির অনেকেই হাজির। ‘আজকাল’ থেকে আসছি, হুজুর সাইদাবাদীর একটা ইন্টারভিউ নিতে চাই’—রিসেপশন কাউন্টারে জানাবার পর জনা তিনেক মাতব্বর গোছের লোকের হাতে হোটেল ম্যানেজার আমাদের তুলে দিলেন। তিনজনের একজন আবার কলকাতার একটি উর্দু পত্রিকার সাংবাদিক। তিনজনই আমির মানুষ—বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। প্রায় এক ঘণ্টার মতো আমাকে ও চিত্র-সাংবাদিক কুমার রায়কে পুলিশি জেরা করলেন। কুমারের পত্নী শ্যামলী, দশ বছরের মিতালি ও হাঁপানিক্লিষ্ট ননী আমাদের সঙ্গী। বোঝালাম, হুজুরের ইন্টারভিউয়ের পাশাপাশি আমার ও কুমারের এই তিন আত্মীয়ের জন্য হুজুরের কৃপা চাইতে এসেছি। একই সঙ্গে ‘রথ দেখা ও কলা বেচা’ সারতে চাইছি। কুমারকে ওর পরিচয়পত্র দেখাতে হল। আমাকে দেখে উর্দু সাংবাদিকের মনে হল চেনা-চেনা। কিঞ্চিৎ মেকাপে একদম যে ধরা পড়িনি এই যথেষ্ট। শেষ পর্যন্ত বাধা টপকে দোতলায় গেলাম আমরা ।
বড় ঘর। ঘর জুড়ে পুরু গদির ওপর দুধ সাদা চাদর পাতা। হুজুর হাসিমুখে আমাদের আহ্বান জানালেন। হুজুরের পরনে ধবধবে সালোয়ার ও সূক্ষ্ম কাজ করা ধবধবে পাঞ্জাবি। একটা সাদা ওড়নায় মাথা-কান-গলা ঢাকা। মুখে চাপ দাড়ি ও গোঁফ। স্বাস্থ্যবান। হুজুরের সামনে একটা জলচৌকি পাতা। জলচৌকিও সাদা কাপড়ে ঢাকা। হুজুরের পাশে আমাদের জেরা করা তিনজনেরই দেখা পেলাম। হোটেলের সবগুলো ঘর হুজুর তাঁর বাংলাদেশী শিষ্যদের জন্য বুক করেছেন। এঁদের নিয়ে গিয়েছিলেন খাজা মাইনুদ্দিন চিশতী-তে। ফেরার পথে কলকাতায়। হোটেল জুড়েই হুজুরের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। প্রশ্নটা করতে উত্তর না দিয়ে হুজুর মোনালিসা মার্কা হাসি ফুটিয়ে তুললেন মুখে
হুজুরের মুখোমুখি বসলাম। কুমার ছবি তুলতে লাগলেন। আমাদের সঙ্গে আনা রোগীদের এই মুহূর্তে ঘরে প্রবেশাধিকার দেননি হুজুর। ওরা এক তলায় সোফায় বসে। ঠিক সময়ে নাকি ওদের ডেকে নেওয়া হবে। হুজুরের একপাশে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত কিছু পত্র-পত্রিকা। আর একপাশে সুন্দর একটি পাত্রে সাজানো আতা, খেজুর, আপেল, আঙুর, কলা। আর একটি পাত্রে আখরোট, খেজুর, কাঠবাদাম, পেস্তা, কাজু ইত্যাদি শুকনো ফল। একটা বেতের ধামায় ডিমের খোসা ।
হুজুরের দাবি, আধুনিক চিকিৎসা যে রোগীদের রোগমুক্ত করতে পারেনি, যে মহিলাদের মা হওয়ার অধিকার দিতে পারেনি, হুজুরের দোয়ায় তাঁরাই রোগমুক্ত হয়েছেন, কোল ভরে সন্তান এসেছে। দাবির সমর্থনে একগাদা পত্র-পত্রিকা আমার ও কুমারের সামনে হাজির করলেন। গাদা গাদা দম্পতির ছবি। এ-সবই নিঃসন্তানের সন্তান লাভের প্রমাণ-পত্র। বর্তমান দিনকাল-এর ২৮ জানুয়ারি-২৬ জানুয়ারি ‘৯১ সংখ্যাটি তুলে দিলেন। প্রচ্ছদ জুড়ে হুজুরের ছবি। ইনসেটে কলকাতার সাক্ষাৎপ্রার্থীদের ভিড়ের রঙিন ছবি। বইয়ের ভেতর বহু পাতাই শুধু কলকাতার ভক্তদের ভিড়ের নানা ছবিতে ঠাসা।
প্রশ্ন রাখলাম, ‘স্বামী জন্মদানে অক্ষম, সেক্ষেত্রেও স্ত্রীর পক্ষে মা হওয়া সম্ভব। কিন্তু যে মহিলার সন্তান-ধারণ ক্ষমতাই নেই তিনিও আপনার দোয়ায় মা হয়েছেন—এমনটা কি ঘটেছে?’
মিষ্টি বাঙাল ভাষায় হুজুর বললেন, ‘আল্লার রহমতে, দোয়ায় সবই সম্ভব। তিনি চাইলে পুরুষ মানুষেরও বাচ্চা হইবো। মেয়েরা হইল গিয়া মায়ের জাত। মা হওনের মধ্যেই তাগো জীবনের সার্থকতা, পূর্ণতা। তাই কেউ যখন মা হওনের বাসনায় আমার কাছে আসে, তারে ফিরাইতে পারি না।’
‘সে-ক্ষেত্রে আপনি কী করেন?’ জিজ্ঞেস করলাম।
‘নিঃসন্তান দম্পতিকে আনতে হয় একটা কাঁচা ডিম ও একটা পাকা কলা। ডিম ধইরা থাকেন বউ। আমি দোয়া পইড়া ডিমে তিনবার টোকা দেই। আল্লার রহমত হইলে কাঁচা ডিম মুহূর্তে সিদ্ধ হয়। ডিমের কুসুম খাইতে বলি মা’রে। কলায় দোয়া পইড়া খাইতে বলি মা’রে।’
‘আর রোগের ক্ষেত্রে?”
‘কাগজে লেখা দোয়া দেই। রোগ বিশেষে দোয়ার কাগজ পানীতে ডুবাইয়া রাইখ্যা, সেই পানী দিনে একবার খাইতে কই। এই পানী সাতদিন থিক্যা আরও বেশি দিন পর্যন্ত খাইতে হইতে পারে। আবার কোনও ক্ষেত্রে দোয়ার কাগজ তেলে ডুবাইয়া রাইখ্যা সেই তেল মালিশ করতে কই। এই মালিশও সাত দিন থিক্যা বেশি দিন পর্যন্ত নির্দেশ দেই।’
তিন টোকায় ডিম সেদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটা দেখে একবার আমার চোখকে সার্থক করতে চাইলাম। দেখলাম পাঁচটি দম্পতি আমাদের সামনে একে একে এলেন। একটি করে দম্পতি ঘরে ঢুকছিলেন। হুজুর প্রতিটি মহিলাকেই ‘মা’ সম্বোধন করে তার মুখোমুখি বসাচ্ছিলেন। দুজনের মাঝে জলচৌকি। আমি পাশে বসে দেখছিলাম। কুমার ছবি তুলছিলেন। দম্পতির কাছে হুজুর সমস্যা জানতে চাইছিলেন। পাঁচ দম্পতিই এসেছেন সন্তান কামনায়। ‘ডাক্তার দেখিয়েছিলেন? কতকদিন ধরে চিকিৎসা করাচ্ছেন? ডাক্তার কী বলেছেন?’ ইত্যাদি প্রশ্নগুলো পরম মমতায় জিজ্ঞেস করছিলেন হুজুর। তারপর পাঁচজনকেই জিজ্ঞেস করলেন—‘কাঁচা ডিম আর পাকা কলা আনছেন?’ প্রত্যেকেই এনেছিলেন। মহিলার হাত থেকে ডিমটা নিয়ে হুজুর জলে ডিমটা ধুয়ে তোয়ালে দিয়ে জলটুকু মুছে ডিমটা তুলে দিচ্ছিলেন মহিলাটির হাতে। তারপর কয়েক সেকেন্ড দোয়া পড়ে ডিমে আঘাত করছিলেন প্রতিটি ক্ষেত্রে। ডিমের খোলা ফেটে যাচ্ছিল। পাঁচটার মধ্যে তিনটি ক্ষেত্রে ডিম কাঁচাই রয়ে গেল। দুটি ক্ষেত্রে অবাক হয়ে দেখলাম ডিম সেদ্ধ হয়ে গেছে ! যাদের ক্ষেত্রে সেদ্ধ হয়নি, তাঁরা যে আল্লার রহমত পাননি, সে কথা অত্যন্ত দুঃখ ও বিনয় মিশিয়ে দম্পতিকে জানিয়ে দিচ্ছিলেন হুজুর। যে দু-জনের ডিম সেদ্ধ হল, তাঁদের কাছে জানতে চাইলেন কলা এনেছেন কি? কলায় দুয়া পড়ে দিয়ে হুজুর সামান্য ইশারা করতেই হাজির দরজার গোড়ায় অপেক্ষামান কোনও শিষ্য। হুজুর আদেশ দিচ্ছেন—‘এনারে সব নিয়ম কানুন ভাল কইরা বুঝাইয়া দাও।’ দম্পতিদের নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন শিষ্যরা। একটা বিষয় লক্ষণীয়—যে দুজনেরই ডিম সিদ্ধ হয়েছে, তাদের সন্তান না হওয়ার কারণ স্বামীর অক্ষমতা। যে তিনজনের ডিম কাঁচা ছিল, সেই তিনজনই জানিয়ে ছিলেন সন্তান না হওয়ার কারণ স্ত্রী’র অক্ষমতা।
হুজুর আমাদের ফল খাওয়ালেন। এবং জানালেন, ‘আর আর নয়। কাল আসেন রোগীগো নিয়া । তারপর আমাকে বললন, ‘কাল রিক্সায় বল বেয়ারিংয়ের একটা লোহার বল অবশ্যই আনবেন।’ কেন লোহার বল বেয়ারিং? এই প্রশ্নটা ভাবতে ভাবতে বারান্দায় পা বাড়াতেই দেখলাম শেষ দম্পতির মহিলা দুই শিয্যের সঙ্গে একটা ঘরে ঢুকছেন। দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। সিঁড়ির গোরায় তখন দম্পতির পুরুষটি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার স্ত্রীকে দেখতে পাচ্ছি না তো?
সব নিয়ম টিয়মগুলো বুঝে আসছে।’ বললেন, সরল মানুষটি।
আজ ভিড় আরও বেশি। আমরা অবশ্য চট্পট্ ওপরে যাওয়ার সুযোগ পেলাম। আমাদের প্রথম রোগী শ্যামলী নাথ। ঠিকানাঃ ১১/৫ যোগীপাড়া রোড, কলকাতা- ২৮। থ্যালাসেমিয়া রোগী। হুজুর বললেন, ‘তোমার তো মা টিবি হইছে।’ হুজুরের রোগ নির্ণয়ে এমন জব্বর ভুল দেখে শ্যামলী হুজুরের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিল। আমি সামাল দিলাম। হুজুরের দু-পাশেই দু-সারিতে সবুজ লাল কালিতে ছাপানো দোয়ার কাগজ রয়েছে। সবুজ কাগজটা দিয়ে বললেন, ‘এটা জলে ডুবিয়ে সকালে রাতে দুবেলা খাবেন এক মাস। লাল কাগজটা তেলে ডুবিয়ে সেই তেল বুকে পিঠে মালিশ করবেন এক মাস। সাড়ে দশ বছরের মিতালি মুখার্জি থাকে ১২৬-এ সুকান্ত সরণি, কলকাতা ৮৫-তে। নেফ্রাটিসে ভুগছে। রোগের কথা বলায় হুজুর বললেন, ‘বয়স কত?’ বয়স শুনে জানালেন বারো বছরের নিচে কারও জন্য দোয়া করেন না। ননী ভৌমিক ২০/১বি জে এন ব্যানার্জি লেন, কলকাতা ৩৬-এর বাসিন্দা। হাঁপানিতে ভুগছেন কুড়ি বছর ধরে। তাঁকে ও সবুজ ও লাল দোয়া দিলেন। জলে ভিজিয়ে পান করতে ও তেল মালিশ করতে বললেন। বেলেঘাটার কোলে ব্যারাকের তিমিরবরণ ঘোষদস্তিদার ও জয়া ঘোষদস্তিদার হাজির হলেন সন্তান কামনায়। জয়ার হাতের ডিমটা হুজুর নিয়ে একটা স্টিলের বাটিতে রেখে একটা বোতল জল ঢাকলেন বাটিতে। ডিমটা একটু ধুয়ে তোয়ালেতে মুছে জয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে কয়েক সেকেন্ড দোয়া পড়ে একটা স্টিলের চামচ দিয়ে আঘাত করলেন ডিমে। খোলা ভেঙে যেতেই দেখা গেল ডিমটা সিদ্ধ হয়ে গেছে। আরও অবাক কাণ্ড, কাঁচা ডিমে ডট পেনে দেওয়া চিহ্ন নেই এই ডিমে। জয়া, তিমির, কুমার এবং আমি ডিম পরীক্ষা করে স্পষ্টতই বুঝলাম ডিমটা পাল্টে দেওয়া হয়েছে তোয়ালে দিয়ে মোছার সময়ে। হুজুর একজন বড় দরের জাদুকর মাত্র। হাতটা সত্যিই ভালো। হুজুরের বিশাল ভাড়াটে সৈন্য-সামন্তের সামনে এই মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়া হঠকারিতা বিবেচনায় আমরা চুপ করে থাকতে বাধ্য হলাম। এরপরই ঢুকলেন আর এক হিন্দিভাষী দম্পতি। আমাকে ও কুমারকে হুজুর থাকতে বললেন। মহিলা ডিম বের করলেন, ডিমের গায়ে নীলাভ আভা দেখে হুজুর বললেন, ‘এই ডিমে হবে না, সাদা ডিম নিয়ে আসতে হবে।’ বুঝলাম, নীলাভ সিদ্ধ ডিম না থাকাতেই হুজুর তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা দেখানো থেকে বিরত থাকলেন।
এবার আমার হাত থেকে লোহার গুলিটা চেয়ে নিয়ে একটা লাল দোয়া লেখা কাগজে রেখে কাগজটা মুড়িয়ে একটা উর্দু লেখা কবচে ঢুকিয়ে মোম দিয়ে কবচের মুখ বন্ধ করে কালো সুতো দিয়ে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এখন দশটা পঁচিশ। ঠিক একটা পঁচিশের পর কবচটা খুলে যদি দেখেন আল্লার রহমতে লোহা সোনা হয়ে গেছে, তবে আপনি এখানে সোজা চলে আসবেন। তিন ঘণ্টার আগে খুলবেন না। তবে কিন্তু রহমত পাবেন না, লোহা লোহাই থেকে যাবে।
রিসেপশন কাউন্টারে দেখা পেলাম উর্দু পত্রিকার সাংবাদিকটির। তাঁর হাতেই খামবন্দি একটা চিঠি দিয়ে বললাম, ‘এটা হুজুর সাহেবকে দেওয়ার কথা ছিল। আর উঠব না। আপনি প্লিজ এটা হুজুর সাহেবের হাতে দিয়ে দেবেন।’
‘কিচ্ছু চিন্তা করবেন না, এক্ষুনি দিয়ে দিচ্ছি।
হোটেল থেকে বেরুতেই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা সমিতির অনেকেই টুক টাক খসে পড়লেন লাইন থেকে। আমরা সকলে মিলে একটু হেঁটে ঢুকলাম একটা চায়ের দোকানে। কবচটা খুললাম। বেরিয়ে এল সোনার গুলি। তিন ঘণ্টা নয়, পনেরো মিনিট পরেই।
ফ্ল্যাটে ফিরে আমরা কয়েকজন পরবর্তী পদক্ষেপের কথা আলোচনা করছি এমনি সময়ে হুজুরের ফোন পেলাম। তিনি নরম মিষ্টি গলায় জানালেন, আমার চ্যালেঞ্জ জানানো চিঠি পেয়েছেন। কিন্তু আমি কী পেয়েছি কবচটা খুলে? লোহা কি সোনা হয়নি? হলে এখনও হাজির হইনি কেন?
জানালাম হোটেল থেকে বেরিয়েই তাবিজ খুলেছি। তখনই তাবিজে লোহার বদলে সোনার গুলি। হাত সাফাই করে গুলি বদলে সোনার গুলি আপনি পুরে দিয়ে থাকলে তিন ঘণ্টা আর তিন মিনিট একই ব্যাপার। খুললে সোনাই পাব ।
এ-সব শোনার পরও হুজুর আকাশের মত উদার গলায় জানালেন—আমার সহযোগিতা চান । সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক থাকলে যেন আগামিকাল সকালে হীরা হোটেলে দেখা করি। দেখার পক্ষে জায়গাটা আমার পছন্দ না হলে এয়ারপোর্টেও দেখা করতে পারি। প্লেনের সময় জানিয়ে দিলেন। এও জানাতে ভুললেন নাা—সহযোগিতা করলে সোনার গুলি গোলা হয়ে যাবে, এক সেরি গোলা। হুজুর দরাজ গলায় হাসলেন ।
না। দেখা করিনি। পরিবর্তে দেখা করেছিলাম কলকাতাস্থিত বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনারের সঙ্গে। তবে তা এপ্রিলের ২৪ তারিখে। ইতিমধ্যে হুজুর সাইদাবাদীকে নিয়ে আমার একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়ে গেছে। ডেপুটি হাইকমিশনারের হাতে যুক্তিবাদী সমিতির প্যাডে লেখা একটি চিঠি তুলে দিই। চিঠির সঙ্গে আজকাল পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের কপি, হুজুর সাইদাবাদীর দেওয়া বিজ্ঞাপনের কপি ও যুক্তিবাদী সমিতির তরফ থেকে হুজুরের হাতে তুলে দেওয়া চিঠির কপি যুক্ত করে দেওয়া হয়।
ডেপুটি হাইকমিশনারকে লেখা চিঠির কপি এখানে তুলে দেওয়া হল—
শ্রদ্ধেয়
বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনার
৯, সার্কাস এভিনিউ
কলকাতা-৭০০ ০১৭
সম্প্রতি আমরা গভীর দুঃখ, শঙ্কা ও তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, আপনার দেশের নাগরিক ‘হুজুর দেওয়ান মোহম্মদ সাইদুর রহমান চিশতি সাইদাবাদী’ নামধারী জনৈক ব্যক্তি মাঝে-মাঝেই আমাদের দেশে আসছেন এবং এ-দেশের পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন—তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার দ্বারা নিঃসন্তান রমণীকে মা করে দেবেন, রোগীদের রোগমুক্ত করবেন এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে দেবেন ।
এই মিথ্যা বিজ্ঞাপনে প্রলুব্ধ করে হুজুর সাইদাবাদী আমাদের দেশের অসহায়, বঞ্চিত, অজ্ঞ ও অন্ধবিশ্বাসী মানুষদের প্রতারিত করছেন। হুজুরের আসল আকর্ষণী ক্ষমতা—দুয়া পড়ে কাঁচা ডিমকে সিদ্ধ করে দেওয়া।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি হুজুর কলকাতায় ছিলেন। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আমি গত ১৬ ফেব্রুয়ারি হুজুরের সঙ্গে দেখা করি। সে সময় হুজুর দাবি করেন, তাঁর অলৌকিক ক্ষমতায় যে কোনও রোগীকে রোগমুক্ত করতে সক্ষম এবং মা হতে ইচ্ছুক মহিলার আনা কাঁচা ডিম ‘দুয়া’ পড়ে সিদ্ধ করে দেন।
১৭ ফেব্রুয়ারি হুজুরের কাছে আমরা তিনজন রোগীকে হাজির করি। তিনি রোগীদের দোয়া দেন। তা সত্ত্বেও রোগীদের অবস্থা গত দুমাসে ভালো হয়নি।
এক দম্পতিকে হাজির করেছিলাম। মহিলাটির হাতে ছিল একটি কাচা ডিম। অজুর দুয়ায় ডিম সিদ্ধ না করে কাঁচা ডিমটি একটি সিদ্ধ ডিমের সঙ্গে পাল্টে দিয়েছিলেন। এই সিদ্ধান্তে আসার কারণ—কাঁচা ডিমে ডট্ পেন দিয়ে যে চিহ্ন করে দেওয়া ছিল, সিদ্ধ ডিমে তা ছিল না।
১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখেই আমাদের সমিতির তরফ থেকে হুজুরকে একটি চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে হুজুরকে প্রকাশ্যে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার প্রমাণ রাখতে আহ্বান জানান হয়েছিল। হুজুর তার দাবিমত আমাদের সমিতির পক্ষ থেকে হাজির করা তিন রোগীকে রোগমুক্ত করতে না পারলে আমরা অবশ্যই ধরে নেব তাঁর দাবিগুলো চূড়ান্ত মিথ্যা এবং তিনি একজন প্রতারক মাত্র ।
আমরা গভীরভাবে আশা রাখি এবং সুনিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি—আপনারা একজন প্রতারককে আমাদের দেশে আসার ‘পাসপোর্ট দিয়ে আমাদের দেশে তাঁর প্রতারণা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সক্রিয় সহযোগিতা করবেন না ।
আমাদের হাজির করা তিন রোগীকে দম্পতির বিষয়ে আপনাকে অবগত করতে ৭ এপ্রিল ১৯৯১ তারিখের আজকাল’ পত্রিকায় প্রকাশিত এই সম্বন্ধীয় একটি লেখার জেরক্স কপি ও ১৮.৪.৯১ ‘বর্তমান’ পত্রিকায় প্রকাশিত হুজুর সাইদাবাদীর বিজ্ঞাপনের একটি জেরক্স কপি পাঠালাম।
হুজুরের সঙ্গে কথা বলে এবং তাঁর সম্বন্ধে বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন পড়ে জেনেছি, তিনি প্রতি দুমাস অন্তর ভারতে জনসেবার নাম করে জনগণকে স্রেফ প্রতারিত করতে আসবেন।
আমরা আশা রাখি, আপনাদের দেশ এমন একজনকে আমাদের দেশে আসার অনুমতি দেবেন না, যিনি আমাদের দেশের জনগণের বিশ্বাস ও সরলতার সুযোগ নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে তাঁদের স্রেফ প্রতারিত করে যাবেন।
আবারও এই আশা রেখে শেষ করছি, আপনি বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে প্রয়োজনীয় সমস্ত রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন ।
শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধাসহ
প্রবীর ঘোষ
সাধারণ সম্পাদক
ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি
যাঁদের চিঠির প্রতিলিপি পাঠান হচ্ছেঃ
একঃ স্বরাষ্ট্র সচিব
পশ্চিমবঙ্গ সরকার
মহাকরণ
কলকাতা
দুইঃ পুলিশ কমিশনার
লালবাজার
কলকাতা
হুজুর সাইদাবাদীকে যে চিঠি সমিতির প্যাডে দেওয়া হয়েছিল, তা হল–
হুজুর সাইদাবাদী,
হীরা হোটেল,
কলকাতা।
ইতিপূর্বে আপনি বাংলাদেশ থেকে কলকাতা এসেছিলেন এবং বিপুল সাড়া জাগিয়েছিলেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আপনার খবর ও বিজ্ঞাপন পড়েছি। আপনি নিঃসন্তান দম্পতিকে ডিম ও কলার কিছু অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ করে সন্তান দেন ও অন্যান্য রোগ মুক্ত করেন এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে থাকেন বলে পত্র-পত্রিকা পাঠে মনে হয়েছে।
আমাদের সমিতি অলৌকিক ক্ষমতার বিষয় জানতে অত্যন্ত আগ্রহী। কোনও অলৌকিক ঘটনা বা কোনও ব্যক্তির অলৌকিক ক্ষমতা বিষয়ে শুনলে আমরা যথাসাধ্য সত্যানুসন্ধান চালিয়ে থাকি। আশা রাখি আমাদের এই ধরনের সত্যানুসন্ধানের প্রয়াসকে প্রতিটি সৎ মানুষের মতই আপনিও স্বাগত জানাবেন এবং সেই সঙ্গে আপনার অলৌকিক ক্ষমতার সত্যানুসন্ধানে আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন।
আপনার সামনে আমরা হাজির করতে চাই পাঁচজন রোগী ও দুটি নিঃসন্তান দম্পতি। আপনি আপনার অলৌকিক ক্ষমতায় রোগীদের এক বছরের মধ্যে রোগ মুক্ত করতে পারলে এবং দুটি দম্পতিকে সন্তান দিতে পারলে আপনার অলৌকিক ক্ষমতা স্বীকার করে নেব এবং প্রণামী হিসেবে আপনাকে ভারতীয় অর্থে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেব, সমিতি ভেঙে দেব। আপনি আমাদের সত্যানুসন্ধানে সহযোগিতা না করলে অবশ্যই ধরে নেব এবং আপনি একজন প্রতারক মাত্র।
নমস্কারান্তে- প্রবীর ঘোষ
সাধারণ সম্পাদক
ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি
আমাদের এই সমস্ত কাজ-কর্মের ফলশ্রুতি হিসেবে এইটুকু হল যে, ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট-এর ‘চিটিং অ্যান্ড ফ্রড’ সেকশনের অফিসার ইনচার্জ আমাকে ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে চিঠি দিয়ে জানালেন, হুজুর সাইদাবাদীর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আপনারা বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনারের কাছে করেছেন এবং সেই চিঠির যে প্রতিলিপি অন্যদের দিয়েছেন, সেই প্রেক্ষিতে আমি উচ্চতর মহল থেকে তদন্ত করার আদেশ পেয়েছি। এখন এই তদন্তের জন্য আপনার পরীক্ষা ও মতামত জানা এই তদন্তের পক্ষে খুবই জরুরী। আপনাকে ভবানী ভবন, কলকাতা – ২৭-এ ১৩.৫.৯১ দুপুর ১২টায় নিম্ন স্বাক্ষরকারীর সঙ্গে দেখা করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
এরপর অফিসার ইনচার্জের সঙ্গে আমাদের সমিতির কয়েকজন গিয়ে দেখা করেছি। বিস্তৃতভবে সব জানিয়েছি। উনি আমাদের বলেছেন শ্যামলী, মিতালী, ননী, তিমিরবরণ ও জয়াকে তাঁদের কাছে হাজির করতে। শ্যামলী ছাড়া অন্যান্যদের হাজির করেছি। অনুরোধ রেখেছি শ্যামলীর ঠিকানায় গিয়ে তদন্তের প্রয়োজনীয় কাজ আমার।
এরপর পুলিশের তরফ থেকে কোনও সাড়া পেলাম না। কিন্তু হুজুর আবার এলেন। বিজ্ঞাপন দিয়েই এলেন। তবে একটু দেরি করে। সেই হীরা হোটেলেই উঠলেন। এ বার সুরক্ষা বাবস্থা আরও জোরালো। আমাদের ছেলেরা তারই মধ্যে প্রচুর পোস্টারে ভরিয়ে দিল হীরা হোটেল ও তার সংলগ্ন স্থান। দেওয়ালে দেওয়ালে সাঁটা হল আজকাল পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি। পোস্টার দাবি জানানো হল হুজুরের গ্রেপ্তারের। হুজুরের ভাড়াটে সেনারা আমাদের দৃঢ়তা দেখে পিছু হটল। হুজুরের ব্যবসাটা সেবার জমল না।
হুজুর আবার এলেন। তবে আরও বড় একটা গ্যাপ দিয়ে। স্থান পাল্টে গেলেন পার্কসার্কাসের হীরা ইন্টারন্যাশন্যাল হোটেল। আমাদের ছেলেরা পিছু ছাড়ল না। কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিকের এক মহিলা সাংবাদিক পার্কসার্কাসে হুজুরের ডেরায় যাবেন ঠিক করে আমার সঙ্গে দেখা করলেন, আমার অনেক দুষ্প্রাপ্য ছবি নিলেন তাঁর পত্রিকাটিতে ছাপার জন্য। বললেন, কপি করে ফেরত দেবেন। আমাদের ছেলেরা এখানেও পোস্টারিং করেছে। হোটেল হীরা ইন্টারন্যাশনালে সাংবাদিক গেলেন। হুজুরের সাক্ষাৎকার নেওয়ার আগে হুজুরের চামচাদের সাক্ষাৎকার দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত তিনি পালাতে বাধ্য হলেন। পত্রিকা দপ্তরে ফিরে তিনি আমাকে ফোন করে গায়ের ঝাল মেটালেন, ভয়ংকর এক বিপদের মুখে তাঁকে ঠেলে দেওয়ার জন্যে আমি নাকি বাস্তব ভয়ংকর চিত্রটা ঠিক মত তুলে না ধরায় তাঁর জীবন বিপন্ন পর্যন্ত হতে পারে । হুজুরের লোক নাকি গাড়ি ফলো করে তাঁর পত্রিকার অফিসটিও দেখে গেছে। এখন তাঁকে নাকি এসকর্ট নিয়ে কিছু দিন চলতে হবে। আর এইসব মুশকিলের কারণ নাকি আমি। শুধু ওই মহিলাই নন, তাঁর সহকর্মী এক সাংবাদিক বন্ধুও ফোনে অভিযোগ করলেন, হুজুরের ভয়ংকর চরিত্রটা আমি তাঁর সহকর্মীকে নাকি জানাইনি। এটা নাকি আমার পক্ষে গর্হিত অন্যায় হয়েছে। ফল-পত্রিকায় আমাকে নিয়ে লেখার পরিকল্পনা বিসর্জন এবং আমার কোনও নথি এবং ছবি ফেরত না দেওয়া ।
যাই হোক, এ তো গেল একটা সাইড স্টোরি। কিন্তু আসল স্টোরি সব সময়ই তার চেয়ে অনেক বেশি রামাঞ্চকর হয়ই। আমরা আমাদের কাজ করে গেছি। লাগাতার ভাবে ঘটনাটা কলকাতা পুলিশের নজরে এনেছি। অবশ্য কলকাতা পুলিশের নজর আমাদের কাজ-কর্মে এমনিতেই আকর্ষিত হচ্ছিল। কারণ হুজুর সাইদাবাদীর বিরুদ্ধে আমাদের পোস্টার অভিযানের ছবিসহ খবর ইতিমধ্যেই আজকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। যে কোনও সময় একটা বড় রকমের ঘটনা যে ঘটতে পারে তাও পুলিশের অজানা ছিল না। পুলিশ কমিশনার পাল্টেছেন, ডি সি ডি ডি পাল্টেছেন। আমরা আমাদের স্ট্যান্ড পাল্টাইনি। প্রত্যেকের কাছে আমরা দাবি জানিয়েছে ‘ড্রাগ ও ম্যাজিক রেমেডিস অ্যাক্ট’ ভঙ্গকারী প্রতারক হুজুর সাইদাবাদীকে গ্রেপ্তার করার জন্য। আমরা এও জানিয়েছি—হুজুরের দোয়ায় কলকাতার যে সব দম্পতি সন্তান লাভ করেছেন বলে দাবি করা হয়েছে, তার সত্যতা জানতে আমরা অনুসন্ধান চালিয়েছি। ওইসব দম্পতির ঠিকানার কোনও হদিস পাইনি।
লাগাতারভাবে লেগে থাকার ফল পেলাম ২১ ফেব্রুয়ারি ’৯৭। ঐতিহাসিক ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক ধর্মগুরু বুজরুকি, প্রতারণা ও ড্রাগ অ্যান্ড ম্যাজিক রেমেডিস অ্যাক্ট ভঙ্গ করার দায়ে গ্রেপ্তার হলেন। গ্রেপ্তার হলেন হীরা হোটেল থেকেই।
এ-বারও আসার আগে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দুটি বাংলা দৈনিকে বিজ্ঞাপন দিয়ে বলা হয়েছিল, হুজুরের দোয়ায় নিঃসন্তান দুই দম্পতির সন্তান লাভের গপ্পো। এক দম্পতির কলকাতার ঠিকানা ছিল।
গোয়েন্দা দপ্তরের অফিসাররা বিজ্ঞাপন দেওয়া দম্পতির ঠিকানার কোনও হদিস পাননি।
২২ ফেব্রুয়ারি শনিবার ছিল হুজুরকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে হাজির করার দিন। সকালে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা দপ্তরের ডেপুটি কমিশনার নজরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হল। জানালাম—আমরাও হুজুরের বিরুদ্ধে পার্টি হতে চাই। ওকে শাস্তি দেওয়ার মতো অনেক তথ্য আমাদের কাছে আছে। ২২ ফেব্রুয়ারি বিচারক রায় দিলেন ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পুলিশ লকআপে রাখার পুলিশ সূত্রে খবর পেলাম ইতিমধ্যেই কলকাতা পুলিশ বিষয়টি জানিয়েছেন বাংলাদেশ মিশন, বিদেশ মন্ত্রক ও রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তরকে। একজন আই পি এস এও জানালেন, আমাদের হাতে যতই তথ্য-প্রমাণ থাক সাইদাবাদীকে আমাদের ছেড়ে দিতেই হবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়করা ফোন করবেন, আমাদের দেশের রাষ্ট্রনায়করা ছেড়ে দেবেন।
ধর্মীয় নেতা, সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় নেতা, বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের কাছে ধর্মীয় নেতাকে শাস্তি দেওয়ার সাধ্য গদি বাঁচাতে সদা তৎপর শাসক গোষ্ঠীর নেই। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও দেশের গণতন্ত্র শক্তিমানেরা নিজের পকেটে রেখে ঘোরেন। তাই হুজুর হয়তো অবাঞ্ছিত বিদেশি হিসেবে এদেশ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে শাস্তি এড়াবেন। তবু পাল্টা স্রোতে চলে যা করা গেল তাই বা কম কী? মহাবৃক্ষের বীজ তো পোঁতা গেল। সেরুলোর মতো হুজুরকেও বড়সড় একটা আঘাত হেনে বোঝানো গেল এ-দেশে বুজরুকি চালানো সম্ভব নয়। বন্ধ করা গেল এ-দেশে ভবিষ্যতে পা রাখার সম্ভাবনা ৷
প্রথম খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ মার্কিন গডম্যান মরিস সেরুলোঃ একটি ইতিহাস
অধ্যায়ঃ দুই
♦ যোগী-জ্যোতিষী হরেকৃষ্ণবাবা !
অধ্যায়ঃ তিন
♦ পঞ্চাশ বছর আগের বালক ব্রহ্মচারী এবং…
অধ্যায়ঃ চার
অধ্যায়ঃ পাঁচ
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
♦ প্রদীপ আগরওয়ালের সম্মোহনে ‘পূর্বজন্মে’ যাত্রা
অধ্যায়ঃ নয়
অধ্যায়ঃ দশ
♦ বরানগরের হানাবাড়িঃ গ্রেপ্তার মানুষ- ভূত
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ এফিডেভিট করে ডাক্তারের প্রশংসাপত্র নিয়ে ওঝাগিরি !
অধ্যায়ঃ বারো
♦ ‘গ্যারান্টি চিকিৎসা’র নামে হত্যাকারীর ভূমিকায় সর্পবিদ হীরেন রায়
অধ্যায়ঃ তেরো
অধ্যায়ঃ চোদ্দ
♦ সাঁইবাবার চ্যালেঞ্জঃ পেটে হবে মোহর !
অধ্যায়ঃ পনেরো
♦ হুজুর সাইদাবাদীঃ মন্তরে সন্তান লাভ !
অধ্যায়ঃ ষোলো
অধ্যায়ঃ সতেরো
♦ বিশ্বাসের ব্যবসায়ীরা ও নপুংসক আইন
দ্বিতীয় খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ খেজুর তলার মাটি সারায় সব রোগ
অধ্যায়ঃ দুই
অধ্যায়ঃ তিন
♦ স্বামী রামদেবঃ সন্ন্যাসী, সর্বযোগসিদ্ধ যোগী, যোগচিকিৎসক !
অধ্যায়ঃ চার
♦ নাকালের দৈব-পুকুরঃ হুজুগের সুনামী
অধ্যায়ঃ পাঁচ
♦ সায়েব যখন রেইকি করে রাঘব বোয়াল চামচা ঘোরে
অধ্যায়ঃ ছয়
♦ লক্ষ্মীমূর্তি কালি হলেন আপন খেয়ালে
অধ্যায়ঃ সাত
অধ্যায়ঃ আট
অধ্যায়ঃ নয়
♦ বিশ্বের বিস্ময় অলৌকিক মাতা জয়া গাংগুলী’র বিস্ময়কর পরাজয় এবং…
অধ্যায়ঃ দশ
♦ আই আই টিতে টেলিপ্যাথি দেখালেন দীপক রাও
অধ্যায়ঃ এগারো
♦ জন্ডিস সারাবার পীঠস্থান ইছাপুর
অধ্যায়ঃ বারো
♦ মালপাড়ার পেশা দাঁতের পোকা বের করা
অধ্যায়ঃ তেরো
তৃতীয় খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ ওঝার ঝাড়ফুঁক আর টেরিজার লকেটে মণিহার রোগমুক্তিঃ কুসংস্কারের দু’পিঠ
অধ্যায়ঃ দুই
♦ ‘মেমারিম্যান’ বিশ্বরূপ-এর একটি বিশুদ্ধ প্রতারণা
অধ্যায়ঃ তিন
♦ কোটিপতি জ্যোতিষী গ্রেপ্তার হলেন
চতুর্থ খন্ড
অধ্যায়ঃ এক
♦ কিস্যা অক্টোপাস পল বিশ্বকাপ ফুটবলের ভবিষ্যৎ বক্তা
অধ্যায়ঃ দুই
♦ কিস্যা জ্যোতিষী বেজান দারওয়ালা
অধ্যায়ঃ তিন
♦ সাধারণ নির্বাচন ২০০৯ নিয়ে সব জ্যোতিষী ফেল
অধ্যায়ঃ চার
♦ মা শীতলার পায়ের ছাপ পুকুরঘাটেঃ রহস্যভেদ
অধ্যায়ঃ পাঁচ
অধ্যায়ঃ ছয়
অধ্যায়ঃ সাত
♦ অলৌকিক উপায়ে সন্তান দেন ডা. বারসি
অধ্যায়ঃ আট
♦ জ্যোতিষীর বাড়িতে অলৌকিক আগুন
অধ্যায়ঃ নয়
♦ সম্মিলিত দুর্নীতির ফসল ‘মোবাইলবাবা’
অধ্যায়ঃ দশ
“যুক্তিবাদীর চ্যালেঞ্জাররা” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ