১৯৬৬ সালের মে মাসের ২৭ তারিখ। স্থান- রাঁচীর উপকন্ঠের পল্লী। সময়- সন্ধ্যা। নায়িকা একটি কিশোরী। প্রচণ্ড মাথা দোলাতে দোলাতে শরীর কাঁপাতে-কাঁপাতে কি সব আবোল তাবোল বলতে লাগল।
সন্ধ্যে বেলায় জল বয়ে আনার পরই এমনটা ঘটেছে, নিশ্চয়ই ভূতেই ধরেছে। বাড়ির লোকজন ওঝাকে খবর দিলেন। ওঝা এসে কাঠকয়লায় আগুন জ্বেলে তাতে ধুনো, সরষে আর শুকনো লঙ্কা ছড়াতে শুরু করল, সঙ্গে নানা অঙ্গভঙ্গি করে মন্ত্র-পাঠ। মেয়েটি কঠিন গলায় ওঝার ওইসব কাজ-কর্মে বিরক্ত প্রকাশ করল। ওঝা দেখলে ভর করা ভূতেরা চিরকালই ক্ষুব্ধ হয়। অতএব ভূতের রাগে ওঝার উৎসাহ তো কমলই না, বরং দ্বিগুণ উৎসাহে মন্ত্রসহ নাচানাচি শুরু করল।
গম্ভীর গলায় মেয়েটি জানাল, সে ভূত নয়, ভগবান, সে ‘বড়ি-মা’ অর্থাৎ মা দুর্গা। ওঝা ওর সামনে বেয়াদপি করলে শাস্তি দেবে। ওঝা অমন অনেক দেখেছে। ভূতের ভয়ে পালাবার বান্দা সে নয়। সে তার মত মন্ত্র-তন্ত্রে পাঠ চালিয়ে যেতে লাগল। মন্ত্র পড়া সরষের কিছুটা কাঠকয়লার আগুনে আর কিছুটা মেয়েটির গায়ে ছুঁড়ে মারতেই মেয়েটি অগ্নিকুন্ড থেকে টকটকে লাল একমুঠো জ্বলন্ত কাঠ কয়লা হাতে তুলে নিয়ে ওঝাকে বলল, “এই নে প্রসাদ।’ ওঝার হাতটা মুহূর্তে টেনে নিয়ে মুহূর্তে ওর হাতে উপুড় করে দিল জ্বলন্ত কাঠকয়লাগুলো।
তাপে ও যন্ত্রনার তীব্রতায় ওঝা চিৎকার করে এক ঝটকায় কাঠ কয়লা উপুড় করে ফেলে দিল। মেয়েটি কিন্তু নির্বিকার। তার চোখে-মুখে যন্ত্রণার সামান্যতম চিহ্ন লক্ষ্য করা গেল না। এমনকি হাতে ফোস্কা পর্যন্ত নয়। উপস্থিত প্রতিটি দর্শক হতচকিত, বিস্মিত। এ মেয়ে ‘বড়ি-মা’ না হয়েই যায় না। প্রথমেই নতজানু হয়ে মার্জনা ভিক্ষা করল ওঝাটি। তার বশ্যতা স্বীকারে প্রত্যেকেরই বিশ্বাস দৃঢ়তর হল।
মেয়েটি তার মা-বাবাকে নাম ধরে সম্বোধন করে জানাল, “আমার কাছে মানত করেও মানত রাখিসনি বলে আমি নিজেই এসেছি।”
মা-বাবা ভয়ে কেঁপে উঠলেন, মানত করে মানত না রাখতে পারার কথাও তো সত্যি। মা-বাবা মেয়ের পায়ের ওপর উপুড় হয়ে পড়লেন। মেয়েটি রাতারাতি ‘বড়ি-মা’ হয়ে গেল। আশপাশের গ্রামগুলো থেকে দলে দলে মানুষ বড়ি-মা’র দর্শনের আশায়, কৃপালাভের আশায়, সমস্যা সমাধানের আশায়, রোগ-মুক্তির আশায় হাজির হতে লাগলেন। কিশোরীটির ব্যবহারে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন এসে গেছে। কেউ জুতো পায়ে, লাল পোশাক পরে বা চশমা পরে ঢুকতে গেলে ভৎসনা এসে গেছে। বড়দেরও নানা ধরনের আদেশ করছে। ভক্তরা ফল, ফুল, মেঠাইয়ে ঘর ভরিয়ে তুলতে লাগলেন। শঙ্খ-ঘণ্টা বাজিয়ে ধূপ-দীপ জ্বালিয়ে চলতে লাগল। বড়ি-মার পুজো। এরই মধ্যে বড়ি-মার কিছু সেবিকাও জুটে গেছে। বড়ি-মার আবির্ভাবের দিন দুয়েকের মধ্যে ক বয়স্কা বিবাহিতা সেবিকা ঘন ঘন ফিট হতে লাগলেন। এক সময় বড়ি-মার মতন মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ঘোষণা করলেন তিনি ‘ছোট-মা’। একই ঘরে দু-মায়েরই পুজো শুরু হয়ে গেল।
কিশোরী ও বিবাহিতা মহিলার ওপর বড়ি-মা ও ছোট মা’র ভরের কাহিনী ঘিরে আশেপাশে বিরাট অঞ্চল নিয়ে তখন দারুণ উত্তেজনা; বলতে ধর্মোন্মদনা। ৩০মে এক অষ্টাদশী তরুণী ঘন ঘন ফিট হতে লাগলেন। পড়শীরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মেয়েটিকে ভূতে পেয়েছে কি ঠাকুরে – বোঝার চেষ্টা করতে লাগলেন। ওঝা আসবে, কি পুজো করবে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে তাঁদের বেশীক্ষন অপেক্ষা করতে হল না। মেয়েটি ঘোষণা করল, সে মা কালী। এখানেও দলে দলে ভক্ত জুটে গেলেন। রাঁচীর আশেপাশে ঈশ্বরের ঘন ঘন আবির্ভাবে ভক্তরা শিহরিত হলেন। বুঝলেন কলির শেষ হল বলে। কলি যুগ ধ্বংস করে আবার সত্য যুগ প্রতিষ্ঠা করতে এবার হাজির হলেন ধ্বংসের দেবতা মহাদেব। আট বছরের একটি বালকের মধ্যে তিনি ভর করলেন।
৩১মে একটি বিবাহিতা তরুণীর ওপর ভর করলেন ‘সাঁঝলি-মা’। সে-রাতেই এক সদ্য তরুণী নিজেকে ঘোষণা করল ‘সাঁঝলি মা’ বলে। এঁদের ক্ষেত্রেও মায়েদের আবির্ভাব সূচিত হয়েছিল ঘন ঘন ফিটও হিস্টিরিয়া রোগীর মতই মাথা ঝাঁকান, শরীর দোলানর মধ্য দিয়ে।
রাঁচীর মানসিক আরোগ্যশালার চিকিৎসকদের দৃষ্টি স্বভাবতই এমন এক অদ্ভুত গণহিস্টিরিয়া ঘটনার দিকে আকর্ষিত হয়েছিল। সাত দিনের মধ্যেই এইসব ভরের রোগীরা তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। রাঁচী মানসিক আরোগ্যশালার চিকিৎসকদের মতে, গ্রামের ভরে পাওয়া রোগীরা প্রত্যেকেই পরিবেশগতভাবে বিশ্বাস করত, ঈশ্বর সময় সময় মানুষের শরীরে ভর করে। একজন মানসিক ভ আরসাম্য হারিয়ে হিস্টিরিয়ার শিকার হলে সে নিজের সত্তা ভুলে গিয়ে ঈশ্বরের সত্তা নিজের মধ্যে প্রকাশিত ভেবে অদ্ভুত সব আচরণ করতে থাকে। স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে বেশির ভাগই শিক্ষালাভে বঞ্চিত, ধর্মান্ধ, যুক্তি-বুদ্ধি কম, আবেগপ্রবণ এবং তাদের মস্তিষ্ককোষের সহনশীলতা কম। ফলে একজনের হিস্টিরিয়া রোগ অন্যের মধ্যে দ্রুত সঞ্চারিত হয়েছে। যারা হিস্টিরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়েছিল, তারা প্রত্যেকেই গভীরভাবে ভাবতে শুরু করেছিল ঈশ্বর তাদের ওপরেও ভর করেছে। শুরুর পর্যায়ে তাদের ভাবনা ছিল আমার ওপরেও যদি ঈশ্বর ভর করে? এক সময় ‘যদি’ বিদায় নিয়েছে। রোগীরা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল ঈশ্বর তার ওপর ভর করেছে। যে ঈশ্বর অপর একজনের ওপর করেছে, সে আমার ওপরেও ভর করতে পারে। এই বিশ্বাস থেকেই তাদের প্রত্যেকের ওপর ভর করেছে এক একটি নতুন নতুন ঈশ্বর।
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ২য় খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
♦ কিছু কথাঃ যুক্তিবাদ প্রসঙ্গে
একঃ ভূতের ভর
♦ ভূতের ভরঃ বিভিন্ন ধরন ও ব্যাখ্যা
♦ গুরুর আত্মার খপ্পরে জনৈকা শিক্ষিকা
♦ প্রেমিকের আত্মা ও এক অধ্যাপিকা
ভূতে পাওয়া যখন ম্যানিয়াস ডিপ্রেসিভ
♦ সবার সামনে ভূত শাড়ি করে ফালা
♦ গ্রামে ফিরলেই ফিরে আসে ভূতটা
♦ একটি আত্মার অভিশাপ ও ক্যারেটে মাস্টার
দুইঃ পত্র পত্রিকার খবরে ভূত
♦ ট্যাক্সিতে ভূতের একটি সত্যি কাহিনী ও এক সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক
♦ এক সত্যি ভূতের কাহিনী ও এক বিজ্ঞানী
♦ বেলঘরিয়ার গ্রীন পার্কে ভূতুরে বাড়িতে ঘড়ি ভেসে বেড়ায় শূন্যে
♦ দমদমের কাচ-ভাঙ্গা হল্লাবাজ-ভূত
তিনঃ যে ভূতুরে চ্যালেঞ্জের মুখে বিপদে পড়েছিলাম
চারঃ ভূতুরে চিকিৎসা
♦ ফিলিপিনো ফেইথ হিলার ও ভূতুরে অস্ত্রোপচার
♦ ফেইথ হিলার ও জাদুকর পি.সি. সরকার (জুনিয়র)
♦ পরকাল থেকে আসা বিদেহী ডাক্তার
♦ বিদেহী ডাক্তার দ্বারা আরোগ্য লাভ
♦ ডাইনী সম্রাজ্ঞী ঈপ্সিতার ভূতুরে চিকিৎসা
পাঁচঃ ভূতুরে তান্ত্রিক
♦ গৌতম ভারতী ও তাঁর ভূতুরে ফটোসম্মোহন
♦ ভূতুরে সম্মোহনে মনের মত বিয়েঃ কাজী সিদ্দীকির চ্যালেঞ্জ
ছয়ঃ ডাইনি ও আদিবাসী সমাজ
বাঁকুড়া জেলা হ্যান্ডবুক, ১৯৫১ থেকে
♦ ডাইনি, জানগুরু প্রথার বিরুদ্ধে কি করা উচিৎ
♦ ডাইনি হত্যা বন্ধে যে সব পরিকল্পনা এখুনি সরকারের গ্রহণ করা উচিৎ
♦ জানগুরুদের অলৌকিক ক্ষমতার রহস্য সন্ধানে
সাতঃ আদিবাসী সমাজের তুক-তাক, ঝাড়- ফুঁক
♦ ‘বিষ-পাথর’ ও ‘হাত চালান’এ বিষ নামান
আটঃ ঈশ্বরের ভর
♦ ঈশ্বরের ভর কখনো মানসিক রোগ, কখনো অভিনয়
♦ কল্যাণী ঘোষপাড়ায় সতীমা’ইয়ের মেলায় ভর
♦ হাড়োয়ার উমা সতীমার মন্দিরে গণ-ভর
♦ আর একটি হিস্টিরিয়া ভরের দৃষ্টান্ত
♦ একই অঙ্গে সোম-শুক্কুর ‘বাবা’ ও মা’য়ের ভর
♦ অবাক মেয়ে মৌসুমী’র মধ্যে সরস্বতীর অধিষ্ঠান (?) ও প্রডিজি প্রসঙ্গঃ
♦ প্রডিজি কি? ও কিছু বিস্ময়কর শিশু প্রতিভা
♦ বংশগতি বা জিন প্রসঙ্গে কিছু কথা
♦ বিস্ময়কর স্মৃতি নিয়ে দু-চার কথা
♦ দুর্বল স্মৃতি বলে কিছু নেই, ঘাটতি শুধু স্মরণে
♦ মানবগুণ বিকাশে বংশগতি ও পরিবেশের প্রভাব
♦ মানবগুণ বিকাশে পরিবেশের প্রভাব
♦ মানব-জীবনে প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব
♦ মানব-জীবনে আর্থ-সামাজিক পরিবেশের প্রভাব
♦ মানব জীবনে সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রভাব
♦ অবাক মেয়ে মৌসুমীর রহস্য সন্ধানে
♦ বক্সিংয়ের কিংবদন্তী মহম্মদ আলি শূন্যে ভাসেন আল্লা-বিশ্বাসে!