উত্তর ২৪-পরগনার হাড়োয়াতে জন্মাষ্টমীর দিন উমা সতীমার মন্দিরে কর্তাভজা আউলিয়া সম্প্রদায়ের হাজার হাজার ভক্ত সমাগম হয়। উমা বিশ্বাস সতীমা হিসেবেই পরিচিতা। এখানেও গদিতে বসেন, ‘বাবুমশায়’ অজিতকুমার কুন্ডু। ভক্তেরা রোগ ও বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বাবুমশায়ের কাছে প্রণামী নিয়ে মানত করে যান, বাবুমশায় নানাজনকে নানা রকমের ব্যবস্থাপত্র দেন।
এখানেও ৬০ থেকে ৮০ জনের ভর হয়। এই ভরও একান্তভাবেই গণ-হিস্টিরিয়া। হিস্টিরিয়াগ্রস্থ রোগীর মতই মাথা দোলানো, মাথা-ঠোকা, হাত-পা ছোঁড়া, সবই করেন এঁরা। শারীরিক তীব্র আক্ষেপের ফলে একসময় রোগীরা ঝিমিয়ে পড়েন। ঝিমিয়ে পড়ে থাকা রোগীদের হাতে বাবুমশায় অজিত কুন্ডু ফুল গুঁজে দিতেই ভর কেটে যায়। রোগীরা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন।
যোগীপাড়ায় শ্রাবণী পূর্ণিমায় গণ-ভর
দমদমের যোগীপাড়ায় জীবনী দাসের মন্দির। জীবনী দাস কর্তাভজা আউলিয়া সম্প্রদায় ভুক্ত। এখানে শ্রাবণী পূর্ণিমায় কর্তাভজা আউলিয়া সম্প্রদায়ের ভক্তরা আসেন। গানের মাঝে ভক্তদের অনেকরই ভর হয়। প্রতি বছরই শ্রাবণী পূর্ণিমার উৎসবে ১৫ থেকে ২৫ জন ভরে পড়েন। এখানেও ভর থাকে মিনিট পয়তাল্লিশের মত। ভর একজনের শুরু হতেই তার দেখাদেখি অন্যরাও ভরে আক্রান্ত হয়। প্রত্যেকেই হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করেন, প্রচণ্ড বেগে মাথা ঘুরিয়ে দোলাতে থাকেন। যখন শরীর আর দেয় না, অবসন্ন হয়ে পড়েন তখন ‘গদি’-র বাবুমশায় অজিত কুন্ডু ভক্তদের হাতে ফুল ধরিয়ে দেন। ভক্তদের ভর কাটে।
সতী-মা মেলার ‘গদি’-র বাবুমশায় যুক্তিবাদী হলেন
১৯ মার্চ ৯০-এর সন্ধ্যা। অজিতকুমার কুন্ডু এলেন আমার ফ্ল্যাটে। কিছুটা অভাবনীয় ঘটনা, সন্দেহ নেই। আমিই সাধারণত অবতার – জ্যোতিষীদের কাছে যাই। তাঁদের আসাটা তুলনায় খুবই কম। অজিত কুন্ডু হাসিখুশি মানুষ। চোখের দৃষ্টিতে যথেষ্ট বুদ্ধির তীক্ষ্মতা। ফর্সা, মেদহীন লম্বা চেহারা। তীক্ষ্ম নাক, কাঁচা-পাকা চুল, পড়নে ধুতি পাঞ্জাবি, যদিও বয়স সাতাত্তার কিন্তু চেহারা ও সপ্রতিভতা দেখে বয়সটা ষাটের বেশি কিছুতেই মনে হয় না।
আসার উদ্দেশ্যটা যখন জানালেন, তখন আরও কিছুটা বিস্মিত হলাম। অজিতবাবু আমাদের সমিতির সদস্য হতে চাইলেন। অবশ্য অজিতবাবুই প্রথম ধর্মীয় নেতা নন, যিনি আমাদের সমিতির সদস্য হতে চাইলেন। এর আগে একাধিক জ্যোতিষী আমাদের সমিতির প্রচেষ্টায় বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন জ্যোতিষ শাস্ত্র আদৌ কোনও বিজ্ঞান নয়, লোক ঠকানোর ব্যবস্থামাত্র এবং তারপর জ্যোতিষ চর্চা বন্ধ করে আমাদের সমিতির সদস্যপদ গ্রহণ করে মানুষ গড়ার কাজে ব্রতী হয়েছেন। একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নেতৃ-স্থানীয় একাধিক ধর্মীয় নেতা আমাদের সদস্য হয়েছেন। তাঁরাই তথাকথিত ধর্মীয় সংস্থাটির অনেক নৈতিক অপরাধ, যৌন বিকৃতির খবর জানিয়েছিলেন। অতি উচ্চ শিক্ষিত এই ধর্মীয় নেতারা প্রতিষ্ঠানটির নামে, ঈশ্বরকে পাওয়ার আকুতিতে, মানব সেবার মধ্য দিয়ে মানবিকতার বিকাশ ইচ্ছাতে সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী হয়েছিলেন। মোহ ভঙ্গ হয়েছে। বুঝেছেন ঈশ্বর দর্শন ও ঈশ্বর অনুভূতি মানসিক ভারসাম্যহীনতা থেকে আসা অলীক দর্শন বা অলীক অনুভুতি মাত্র। আমাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় এমনই এক প্রখ্যাত ধর্মীয় নেতা জানিয়েছিলেন গ্রামাঞ্চলে ভূতে ভর দেখেছেন, আধুনিক মানসিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই সারিয়েছেন, কিন্তু সে বিষয়ে মুখ না খুলে আধ্যাত্মিক ক্ষমতার দ্বারা ভূত তাড়িয়েছেন বলে চালাবার চেষ্টা করেছেন। ধর্মীয় নেতারা এ-ও জানিয়েছেন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন শাখায় তাঁদের উদ্যোগেই গোপনে পড়ান হচ্ছে ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ বইটি। জানিয়েছিলেন, অনেকেই আমাদের সমিতির হয়ে কাজ করতে উৎসাহী। অনেক সন্ন্যাসীই সরাসরি আমাদের হয়ে কুসংস্কার-বিরোধী কাজে সামিল হতে চান ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে বেড়িয়ে এসে। আমাদের কাছে আলোচকরা একটি সমস্যার কথা বলেছিলেন, যেটা আমাদের ও সন্ন্যাসীদের মধ্যে একটা বাধার প্রাচীর তুলে রেখেছে। উচ্চশিক্ষিত সন্ন্যাসীরা চেয়েছিলেন একটি সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করে বহু সন্ন্যাসীরা তাঁদের ধর্ম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন। তবে, তার আগে আমাদের সমিতিকে সন্ন্যাসীদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পুনর্বাসনের মোটামুটি একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
৮৮-র ১১ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক সাংবাদিক সম্মেলনেও আমরা এই প্রসঙ্গটি তুলে জানিয়েছিলাম, সরকারী সহযোগিতায়, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারলে আমরা সাংবাদিক সম্মেলনেই ওই সন্ন্যাসীদের হাজির করব।
সেদিন আর্থিক সঙ্গতি-শূন্য আমরা লড়াকু সন্ন্যাসীদের আরও কাছে আরও লড়াইতে নিয়ে আসতে পারিনি। আজ পর্যন্ত আমরা পারিনি তাঁদের পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিতে।
বাবু মশায় অজিত বাবুকে নিয়ে দ্বিধা ছিল অন্য রকম। তিনি কি বাস্তবিকই ওয়াকিবহাল তাঁর চিন্তাধারার বিপরীত শিবিরে আমাদের বাস। ধর্মগুরু সাজাটা যে মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে লোক ঠকানোরই নামান্তর মাত্র, এটাই তো তথ্য-প্রমাণ সহযোগে আমরা প্রমাণ করি।
অজিতবাবুকে সদস্য করতে আমাদের সমস্যা কোথায়, সবই খোলাখুলি জানালাম। জিজ্ঞেস করলাম, “আমাদের একজন হওয়ার বিনিময়ে সতী মেলার গদীতে বসা বন্ধ রাখতে পারবেন?”
অজিতবাবু জানালেন, “আমি কিন্তু এই উদ্দেশ্যে আসিনি, আপনাদের কাছ থেকে কিছু শিখে নিয়ে, সে-সব কাজে লাগিয়ে আরও বড় অবতার হয়ে বসব। আমার এখানে আসার কারণ আপনার ‘অলৌকিক নয়, লৌকিক’ বইটি। আমি যখন গদিতে বসি, তখন আমি যেন কেমন একটা শক্তি পাই। কেউ যখন প্রণাম করে উপায় জানতে চায়, আমার তখন মনে হয় সতীমাই যেন আমার মুখ দিয়ে কথা বলিয়ে নিচ্ছেন। বছরের পর বছর দেখে আসছি লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁদের মানত জানাতে আসছে। আবার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হতে প্রণাম জানিয়ে যাচ্ছে। আপনার বইটা পড়ার পর মনে হল, আমি ছোটবেলা থেকেই সতীমা, তাঁর অলৌকিক বাকসিদ্ধা ক্ষমতা, সতী মেলায় গদির ক্ষমতা, এইসব শুনে শুনে এগুলোকে পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করেছিলাম। আবার বিশ্বাস, আমার প্রচন্ড আবেগকে, লক্ষ লক্ষ মানুষের ভক্তি, বাউল গান, সতীমার জয়ধ্বনি এইসব মিলিয়ে অদ্ভুত একটা ভক্তিরসাশ্রিত পরিবেশ আরও বেশি প্রভাবিত করত। তারই ফলে গদিতে বসলেই আমি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে মনে করতে থাকতাম আমার মধ্যে একটা অদ্ভুত শক্তি প্রকাশিত হয়েছে। আমার কথাগুলো সতীমারই নির্দেশ।
আপনার বইটার ‘বিশ্বাসে অসুখ সারে’ অধ্যায়টা পড়ার পর আমার মনে হচ্ছে, যারা সতীমার মেলায় এসে রোগ মুক্ত হচ্ছে, তারা সতীমার প্রতি বিশ্বাসে, আমার কথায় বিশ্বাস করেই রোগ মুক্ত হচ্ছে। এবার দোলের মেলায় যাঁদের ভর হয়েছিল, তাদের লক্ষ্য করে আমার মনে হয়েছে আপনার কথাই সত্যি। ওরা প্রত্যেকেই প্রচণ্ড আবেগে, অন্ধবিশ্বাসে হিস্টিরিয়া রোগের শিকার হয়েছিল। একজনের ভর দেখে আরেকজন, তাকে দেখে আরেকজন, এভাবেই জনে জনে স্রেফ হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে উন্মত্ততা দেখিয়েছে, আর তাকেই সাধারণ মানুষ মনে করেছে সতীমার কৃপার ফল, স্থান মাহাত্ম্য ইত্যাদি। যখনই দেখেছি ভরে পাওয়া মানুষগুলো উন্মত্ততা প্রকাশ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়েছে তখনই ওদের হাতে একটা করে ফুল ধরিয়ে দিয়েছি। যারা এখানে আসে তারা এও জানে আমি ফুল হাতে দিলে ভর কেটে যায়। তাদের এই অন্ধ-বিশ্বাসের ফলেই ফুল হাতে পেতে ভর কেটেছে।
১৯ মার্চ ৯০ শেষ সন্ধ্যায় বাবুমশায় অজিতকুমার কুন্ডুকে যুক্তিবাদী অজিত কুন্ডু করে নিয়েছি। লিখিত প্রতিজ্ঞাপত্রে জানিয়েছেন- আগামী বার থেকে আর বাবুমশায়ের ভূমিকা দেনেন না। প্রত্যাশা রাখি, তিনি কথা রাখবেন।
“অলৌকিক নয়,লৌকিক- ২য় খন্ড ” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
♦ কিছু কথাঃ যুক্তিবাদ প্রসঙ্গে
একঃ ভূতের ভর
♦ ভূতের ভরঃ বিভিন্ন ধরন ও ব্যাখ্যা
♦ গুরুর আত্মার খপ্পরে জনৈকা শিক্ষিকা
♦ প্রেমিকের আত্মা ও এক অধ্যাপিকা
ভূতে পাওয়া যখন ম্যানিয়াস ডিপ্রেসিভ
♦ সবার সামনে ভূত শাড়ি করে ফালা
♦ গ্রামে ফিরলেই ফিরে আসে ভূতটা
♦ একটি আত্মার অভিশাপ ও ক্যারেটে মাস্টার
দুইঃ পত্র পত্রিকার খবরে ভূত
♦ ট্যাক্সিতে ভূতের একটি সত্যি কাহিনী ও এক সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক
♦ এক সত্যি ভূতের কাহিনী ও এক বিজ্ঞানী
♦ বেলঘরিয়ার গ্রীন পার্কে ভূতুরে বাড়িতে ঘড়ি ভেসে বেড়ায় শূন্যে
♦ দমদমের কাচ-ভাঙ্গা হল্লাবাজ-ভূত
তিনঃ যে ভূতুরে চ্যালেঞ্জের মুখে বিপদে পড়েছিলাম
চারঃ ভূতুরে চিকিৎসা
♦ ফিলিপিনো ফেইথ হিলার ও ভূতুরে অস্ত্রোপচার
♦ ফেইথ হিলার ও জাদুকর পি.সি. সরকার (জুনিয়র)
♦ পরকাল থেকে আসা বিদেহী ডাক্তার
♦ বিদেহী ডাক্তার দ্বারা আরোগ্য লাভ
♦ ডাইনী সম্রাজ্ঞী ঈপ্সিতার ভূতুরে চিকিৎসা
পাঁচঃ ভূতুরে তান্ত্রিক
♦ গৌতম ভারতী ও তাঁর ভূতুরে ফটোসম্মোহন
♦ ভূতুরে সম্মোহনে মনের মত বিয়েঃ কাজী সিদ্দীকির চ্যালেঞ্জ
ছয়ঃ ডাইনি ও আদিবাসী সমাজ
বাঁকুড়া জেলা হ্যান্ডবুক, ১৯৫১ থেকে
♦ ডাইনি, জানগুরু প্রথার বিরুদ্ধে কি করা উচিৎ
♦ ডাইনি হত্যা বন্ধে যে সব পরিকল্পনা এখুনি সরকারের গ্রহণ করা উচিৎ
♦ জানগুরুদের অলৌকিক ক্ষমতার রহস্য সন্ধানে
সাতঃ আদিবাসী সমাজের তুক-তাক, ঝাড়- ফুঁক
♦ ‘বিষ-পাথর’ ও ‘হাত চালান’এ বিষ নামান
আটঃ ঈশ্বরের ভর
♦ ঈশ্বরের ভর কখনো মানসিক রোগ, কখনো অভিনয়
♦ কল্যাণী ঘোষপাড়ায় সতীমা’ইয়ের মেলায় ভর
♦ হাড়োয়ার উমা সতীমার মন্দিরে গণ-ভর
♦ আর একটি হিস্টিরিয়া ভরের দৃষ্টান্ত
♦ একই অঙ্গে সোম-শুক্কুর ‘বাবা’ ও মা’য়ের ভর
♦ অবাক মেয়ে মৌসুমী’র মধ্যে সরস্বতীর অধিষ্ঠান (?) ও প্রডিজি প্রসঙ্গঃ
♦ প্রডিজি কি? ও কিছু বিস্ময়কর শিশু প্রতিভা
♦ বংশগতি বা জিন প্রসঙ্গে কিছু কথা
♦ বিস্ময়কর স্মৃতি নিয়ে দু-চার কথা
♦ দুর্বল স্মৃতি বলে কিছু নেই, ঘাটতি শুধু স্মরণে
♦ মানবগুণ বিকাশে বংশগতি ও পরিবেশের প্রভাব
♦ মানবগুণ বিকাশে পরিবেশের প্রভাব
♦ মানব-জীবনে প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব
♦ মানব-জীবনে আর্থ-সামাজিক পরিবেশের প্রভাব
♦ মানব জীবনে সমাজ-সাংস্কৃতিক পরিবেশের প্রভাব
♦ অবাক মেয়ে মৌসুমীর রহস্য সন্ধানে
♦ বক্সিংয়ের কিংবদন্তী মহম্মদ আলি শূন্যে ভাসেন আল্লা-বিশ্বাসে!