হযরত আনাস ইবন মালিক (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ইব্ন শিহাব, ইবরাহীম, মূসা ইব্ন ইসমাঈল ও ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ
একদা হযরত হুযায়ফা ইবন ইয়ামান (রা) হযরত উসমান (রা)-এর নিকট আগমন করিলেন। ইতিপূর্বে তিনি আরমেনিয়া ও আজারবাইজানের যুদ্ধে ইরাকী মুসলিম বাহিনীর সহিত সিরিয়াবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াছিলেন। কুরআন মজীদের তিলাওয়াতের বিষয়ে মুসলমানদের মধ্যে নানারূপ মত দেখিয়া তিনি মর্মাহত ও ভীত হইয়া পড়িয়াছিলেন। তিনি হযরত উসমান (রাঃ)-কে বলিলেন- হে আমীরুল মূমিনীন ! ইয়াহুদী ও নাসারা জাতি স্ব-স্ব কিতাব লইয়া যেরূপে মতভেদে লিপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল, এই উম্মত কুরআন মজীদ লইয়া তদ্রূপ মতভেদে লিপ্ত হইবার পূর্বে উহার প্রতি মনোযোগী হউন। এতদশ্রবণে হযরত উসমান (রাঃ) হযরত হাফসা (রাঃ)-এর নিকট বলিয়া পাঠাইলেন, ‘আপনার নিকট রক্ষিত কুরআন মজীদের সংকলন গ্রন্থখানা আমার নিকট পাঠাইয়া দিন। আমি উহার অনুলিপি, রাখিয়া উহা আপনার নিকট প্রত্যর্পণ করিব।’ হযরত হাফসা (রাঃ) উহা হযরত উসমান (রাঃ)-এর নিকট পাঠাইয়া দিলেন। তিনি হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত (রাঃ), হযরত আব্দুল্লাহ্ ইব্ন জুবায়র (রাঃ), সাঈদ ইবন আস (রাঃ) এবং আব্দুর রহমান ইব্ন হারিছ ইব্ন হিশাম (রাঃ)-কে ‘উহার কর্তগুলি অনুলিপি প্রস্তুত করিতে নির্দেশ দিলেন। তাঁহারা উহার কতগুলি অনুলিপি প্রস্তুত করিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, শেষোক্ত কুরায়শী সাহাবীত্রয়ের প্রতি হযরত উসমান (রাঃ)-এর নির্দেশ ছিল, কুরআন মজীদের কোন শব্দের উচ্চারণের বিষয়ে হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত ও তাঁহাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে তাঁহারা যেন উহা কুরায়েশ গোত্রের উচ্চারণ অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করেন। বলা বাহুল্য, তাঁহারা তাঁহার উক্ত নির্দেশ অনুযায়ী স্বীয় কর্তব্য সম্পাদন করিয়াছিলেন। প্রয়োজনীয় সংখ্যক অনুলিপি প্রস্তুত হইবার পর হযরত উসমান (রাঃ) হযরত হাফসা (রাঃ)-এর নিকট হইতে আনীত মূল সংকলনখানা তাঁহার নিকট প্রত্যর্পণ করত ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় একখানা করিয়া অনুলিপি প্রেরণ করিলেন এবং কুরআন মজীদের এতভিন্ন প্রতিটি সংকলন পোড়াইয়া ফেলিতে নির্দেশ দিলেন।(১)
হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে খারিজা ইবন যায়দ ইবন ছাবিত (রাঃ) ও ইব্ন শিহাব যুহরী বর্ণনা করিয়াছেন যে, হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত (রাঃ) বলেনঃ
‘হযরত উসমান (রাঃ)-এর নির্দেশে আমরা যখন কুরআন মজীদের অনুলিপি প্রস্তুত করিতেছিলাম, তখন আমি (মূল সংকলনে) সূরা আহযাবের একটি আয়াত পাইতেছিলাম না। অথচ উক্ত আয়াত আমি নবী করীম (সাঃ)-কে তিলাওয়াত করিতে শুনিয়াছি। অনুসন্ধান করিয়া আমরা উহা হযরত খুযায়মা ইব্ন ছাবিত আনসারী (রাঃ)-এর নিকট রক্ষিত পাইলাম এবং অনুলিপিতে উহা যথাস্থানে লিপিবদ্ধ করিলাম। উক্ত আয়াতটি এইঃ
مِنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالُ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللَّهَ عَلَيْهِ
হযরত আবূ বকর সিদ্দিক (রাঃ)-এর নেতৃত্বে সাহাবীগণ কর্তৃক প্রস্তুত কুরআন মজীদের সংকলনের অনুলিপি প্রস্তুত করত উহা বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করা এবং সন্দেহযুক্ত অন্যান্য সংকলন বিনষ্ট করিয়া দেওয়া হইতেছে হযরত উসমান (রাঃ)-এর একটি বৃহত্তম কীর্তি।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) এবং হযরত উমর (রাঃ) কুরআন মজীদের বিক্ষিপ্ত অংশসমূহ একত্রিত করিয়াছেন। হযরত উসমান (রাঃ) উহা সমগ্র মুসলিম জাহানে প্রচার করত কুরআন মজীদকে বিকৃতির হাত হইতে রক্ষা করিয়াছেন। সকল সাহাবী তাঁহার উক্ত কার্যক্রমের প্রতি সমর্থন দান করিয়াছেন। কুরআন মজীদের অনুলিপি প্রস্তুতকরণ কার্যে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ না পাওয়ায় হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) মনঃক্ষুণ্ণ হইয়াছিলেন এবং হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর নেতৃত্বে সাহাবীগণ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত কুরআন মজীদের সংকলন ভিন্ন সকল সংকলন পোড়াইয়া ফেলিবার জন্য হযরত উসমান (রাঃ) যখন নির্দেশ দিয়াছিলেন, হযরত আব্দুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) তখন স্বীয় সহচরবৃন্দের নিকট রক্ষিত সংকলনকে সর্বসম্মতরূপে প্রস্তুত সংকলনের সহিত সংযোজিত করিয়া দেওয়ার জন্য তাঁহাদিগকে নির্দেশ দিয়াছিলেন বলিয়া একটি রিওয়ায়েতে বর্ণিত রহিয়াছে। তবে পরবর্তীকালে তিনি স্বীয় অভিমত ত্যাগ করত সাহাবীগণের সর্বসম্মত রায়ের সহিত একমত হইয়াছিলেন। এতদসম্পর্কে হযরত উসমান (রাঃ)-এর কার্যক্রমকে সমর্থন করিয়া বলিয়াছেন- ‘হযরত উসমান যাহা করিয়াছেন, তাহা তিনি না করিলে আমিই উহা করিতাম।’ এতদ্বারা প্রমাণিত হইল, কুরআন মজীদ সংগ্রহ, সংকলন ও একত্র করা খলীফা-চতুষ্টয়ের দৃষ্টিতে একটি দীনী মহৎ কাজ বলিয়া বিবেচিত হইয়াছিল। তাঁহাদের সম্বন্ধে স্বয়ং নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন— ‘আমার সুন্নাত এবং আমার পরবর্তীকালের খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত (রীতি-নীতি)-কে তোমরা আঁকড়াইয়া ধরিবে।’
হযরত হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) ছিলেন কুরআন মজীদের সঠিক সংকলনের অনুলিপি বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করিবার অনুপ্রেরণা দাতা। উপরে উল্লেখ করা হইয়াছে, আরমেনিয়া ও আজারবাইজানের যুদ্ধে তিনি ইরাক ও সিরিয়ার অধিবাসীদের সংস্পর্শে আসিয়া জানিতে পারিয়াছিলেন যে, লোকেরা কুরআন মজীদের বিভিন্ন বর্ণের উচ্চারণের বিষয়ে বিভিন্ন মতের অনুসারী হইয়া গিয়াছে। এতদ্দর্শনে তিনি হযরত উসমান (রাঃ)-কে বলিয়াছিলেন- ‘ইয়াহুদী ও নাসারা জাতি তাহাদের প্রতি অবতীর্ণ আসমানী কিতাবের বিষয়ে যেরূপ মতভেদে লিপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল, এই উম্মত কুরআন মজীদ লইয়া সেইরূপ মতভেদে লিপ্ত হইবার পূর্বেই উহাকে রক্ষা করুন।’
ইয়াহুদী ও নাসারা জাতি তাহাদের প্রতি অবতীর্ণ আসমানী কিতাবের বিষয়ে এইরূপে মতভেদে লিপ্ত হইয়াছিল যে, ইয়াহুদী জাতির হাতে তাওরাত কিতাবের একটি সংকলন রহিয়াছে এবং ‘সামেরী’ সম্প্রদায়ের হাতেও উহার একটি সংকলন রহিয়াছে। আর উভয় সম্প্রদায়ের তাওরাতের মধ্যে প্রচুর অমিল দেখিতে পাওয়া যায় । এই অমিল শুধু শব্দের অমিল নহে; বরং অর্থের অমিলও বটে। সামেরীদের তাওরাতে হামযা( الهمزة ), হা (الياء) এবং ইয়া (الياء) এই বর্ণ তিনটি দেখিতে পাওয়া যায় না। পক্ষান্তরে ইয়াহুদীদের তাওরাতে উহা সমুপস্থিত। আবার, নাসারা জাতির হাতেও তাওরাত কিতাবের একটি সংকলন রহিয়াছে। ইয়াহুদী ও ‘সামেরী’ সম্প্রদায়ের তাওরাত এবং নাসারা জাতির তাওরাতের মধ্যেও মিল খুঁজিয়া পাওয়া যায় না।
আবার, নাসারা জাতির হাতে যে ইনজীল (انجيل) কিতাব রহিয়াছে, উহার সংখ্যা একটি নহে; বরং উহার সংখ্যা চারটিঃ (১) মার্ক লিখিত ইন্ন্জীল; (২) লুক লিখিত ইন্জীল; (৩) মথি লিখিত ইন্জীল (৪) যোহন লিখিত ইন্জীল। এইগুলির পরস্পরের মধ্যে প্রচুর অমিল পরিলক্ষিত হয়। এই সকল ইন্জীলের প্রত্যেকটিই কলেবরে অত্যন্ত ক্ষুদ্র। কোনোটি মধ্যম আকারের অক্ষরে চৌদ্দ পাতার কাছাকাছি; কোনোটি উহার দেড়গুণ এবং কোনোটি বা দ্বিগুণ হইবে। উহাতে হযরত ঈসা (আঃ)-এর জীবন বৃত্তান্ত, তাঁহার আচরণাবলী, তাঁহার আদেশ-নিষেধ এবং তাঁহার রচনাবলী লিপিবদ্ধ রহিয়াছে। উহাতে স্বল্প-সংখ্যক এইরূপ বাক্যও রহিয়াছে যাহার সম্বন্ধে নাসারা জাতির দাবী এই যে, সেইগুলি আল্লাহ্ তা’আলার বাণী। উক্ত ত্রুটিরাজির মধ্যে বড় ত্রুটি হইতেছে উহারা পরস্পর বিরোধী। তাওরাতের অবস্থাও তথৈবচ। পরিবর্তন-পরিবর্ধন হইতেছে উহার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য । প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, সাইয়িদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ) কর্তৃক আনীত শরীআত দ্বারা, তাওরাত-ইঞ্জীলের শরীআতসহ সকল শরীআতই রহিত হইয়া গিয়াছে।
মোটকথা, হযরত হুযায়ফা (রাঃ)-এর কথা শুনিয়া হযরত উসমান (রাঃ) উদ্বিগ্ন হইয়া পড়িলেন। তিনি উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফসা (রাঃ)-কে বলিয়া পাঠাইলেন- ‘তিনি যেন তাঁহার নিকট রক্ষিত হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) ও হযরত উমর (রাঃ) কর্তৃক সংকলিত কুরআন মজীদখানা তাঁহাকে প্রদান করেন। তিনি উহার অনুলিপি প্রস্তুত করিয়া মূল সংকলনখানা তাঁহার নিকট প্রত্যর্পণ করিবেন এবং প্রস্তুত অনুলিপিসমূহ মুসলিম জাহানের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করিবেন, যাহাতে লোকেরা কুরআন মজীদের (ভ্রান্ত) সংকলনসমূহ ত্যাগ করত উক্ত বিশুদ্ধ সংকলন গ্রহণ করিতে পারে।’ হযরত হাফসা (রাঃ) উহা হযরত উসমান (রাঃ)-এর নিকট পাঠাইয়া দিলেন। হযরত উসমান (রাঃ) নিম্নোক্ত সাহাবীগণকে উহার অনুলিপি প্রস্তুত করিতে নির্দেশ দিলেনঃ (১) হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত আনসারী (রাঃ)। ইনি নবী করীম (সাঃ)-এর অন্যতম ওহী লেখক ছিলেন। (২) হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবন যুবায়র ইবন আওয়াম আল-কুরায়শী আল-ইযদী (রাঃ)। ইনি একজন গভীর জ্ঞানসম্পন্ন মহৎ চরিত্রের সাহাবী ছিলেন। (৩) হযরত সাঈদ ইব্ন আস ইবন উমাইয়া আল-কুরায়শী আল-উমুবী। ইনি একজন মহৎ হৃদয় ও দানশীল সাহাবী ছিলেন। সাহাবীদের মধ্যে তাঁহার বাচনভঙ্গি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর বাচনভঙ্গির সহিত অধিকতর সামঞ্জস্যশীল ছিল। (৪) হযরত আবদুর রহমান ইব্ন হারিছ ইব্ন হিশাম ইব্ন মুগীরাহ ইব্ন আব্দুল্লাহ্ ইব্ন উমর ইব্ন মাখযুম আল-কুরায়শী আল মাখযূমী (রাঃ)।
উপরোক্ত সাহাবী চতুষ্টয় তাঁহাদের প্রতি অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদন করিবার কালে কোন শব্দের উচ্চারণের বিষয়ে তাঁহাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে উহার নিষ্পত্তির জন্য তাঁহারা হযরত উসমান (রাঃ)-এর শরণাপন্ন হইতেন। একদা التابوت শব্দটির সঠিক বানান লইয়া তাঁহাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিল। হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত (রাঃ) বলিলেন- শব্দটির সঠিক বানান হইবে التابوه তিনি উহার শেষ বর্ণকে التاء না বলিয়া الهاء বলিতেছিলেন ৷ পক্ষান্তরে শেষোক্ত কুরায়শী সাহাবীত্রয় বলিলেন- শব্দটির সঠিক বানান হইবে التابوت তাঁহারা উহার শেষ বর্ণকে الهاء না বলিয়া التاء বলিতেছিলেন। এই বিষয়ে লেখক চতুষ্টয় হযরত উসমান (রা)-এর রায় চাহিলেন। তিনি বলিলেন- ‘উহা কুরায়শ গোত্রের বানান অনুযায়ী লিখ। কারণ, কুরআন মজীদ কুরায়শ গোত্রের ভাষায় নাযিল হইয়াছে।’
হযরত উসমান (রাঃ)-ই কুরআন মজীদের সূরাসমূহকে বর্তমান আকারে বিন্যস্ত করেন। তিনি ‘দীর্ঘ সপ্তক’ (السبع الطوال) অর্থাৎ সূরায়ে বাকারা হইতে সূরায়ে আনফাল পর্যন্ত সাতটি সূরাকে কুরআন মজীদের প্রথমভাগে এবং যে সকল সূরার আয়াতের সংখ্যা একশত বা উহার কাছাকাছি, উহাদিগকে ‘দীর্ঘ সপ্তম’-এর অব্যবহিত পর স্থাপন করেন।(১)
ইমাম ইব্ন জারীর, ইমাম আবূ দাউদ, ইমাম তিরমিযী এবং ইমাম নাসাঈ একাধিক ইমামের মাধ্যমে আওফ আরাবী হইতে, তিনি ইয়াযীদ ফারসী হইতে এবং তিনি ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে নিম্নোক্ত বর্ণনা উদ্ধৃত করেনঃ
আমি হযরত উসমান (রাঃ)-এর নিকট জিজ্ঞাসা করিলামঃ ‘সূরা আনফাল হইতেছে ‘মাছানী’ (المشانى) শ্ৰেণীভুক্ত(২) সূরা। পক্ষান্তরে সূরা তওবা হইতেছে ‘আলমিঈন (المخين) একশত বা উহার নিকর্তী সংখ্যক আয়াতবিশিষ্ট সূরা। উহা একটি নহে; বরং দুইটি সূরা আপনারা কিরূপে উহাদিগকে পরস্পর পাশাপাশি রাখিয়া এবং উহাদের মধ্যে বিসমিল্লাহ্ না লিখিয়া দুইটিকে এক করিয়া দিয়া দীর্ঘ সপ্তক (السبع الطوال) শ্রেণীভুক্ত করিয়াছেন?’
হযরত উসমান (রাঃ) বলিলেন- রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর প্রতি একটি সূরার অংশ বিশেষ অবতীর্ণ হইবার পর সূরার সমগ্রটুকু অবতীর্ণ হইবার পূর্বেই আর এক সূরার অংশবিশেষ অবতীর্ণ হইত। তাঁহার প্রতি কোন সূরার অংশবিশেষ অবতীর্ণ হইলে তিনি ওহী লেখক সাহাবীকে ডাকাইয়া আনিয়া বলিতেন- ‘এই সকল আয়াতকে অমুক সূরার অমুক স্থানে স্থাপন কর।’ সূরা আনফাল হইতেছে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর মদীনার জীবনের প্রথম দিকে অবতীর্ণ সূরা। পক্ষান্তরে সূরা তওবা হইতেছে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর মদীনার জীবনের শেষ দিকে অবতীর্ণ সূরা। কিন্তু উভয় সূরায় বর্ণিত ঘটনাবলীর মধ্যে মিল রহিয়াছে। আমার বিশ্বাস ছিল, উহা দুইটি নহে; বরং একটি সূরা। আমরা প্রকৃত অবস্থা জানিবার পূর্বেই রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) ইন্তিকাল করেন। আমার ধারণা অনুযায়ী আমি উহাদিগকে পাশাপাশি স্থাপন করিয়াছি এবং উভয়ের মধ্যে বিসমিল্লাহ্ লিখি নাই। এইরূপে উহা এক সূরা হইবার ফলে দীর্ঘ সপ্তক (السبع الطوال) শ্ৰেণীভুক্ত হইয়াছে ।
উপরোক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়, সূরাসমূহের আয়াতের বিন্যাস নবী করীম (সাঃ) কর্তৃক (আল্লাহ্র নির্দেশ মত) সম্পন্ন হইয়াছিল । পক্ষান্তরে, সূরাসমূহের বিন্যাস হযরত উসমান (রাঃ) কর্তৃক সম্পাদিত হইয়াছিল।(১) সূরাসমূহের আয়াত নবী করীম (সা) কর্তৃক বিন্যস্ত হইয়াছে
বলিয়াই কোন সূরার আয়াতসমূহের অবস্থান পরিবর্তন করিয়া তিলাওয়াত করা অবৈধ। পক্ষান্তরে, পরবর্তী সূরা পূর্বে তিলাওয়াত করিয়া পূর্ববর্তী সূরা পরে তিলাওয়াত করা অবৈধ নহে। তবে হযরত উসমান (রাঃ) যেরূপে উহাদিগকে বিন্যস্ত করিয়াছেন, তাঁহার অনুসরণে উহাদিগকে সেইরূপে স্থাপন করিয়া তিলাওয়াত করা মুস্তাহাব। আর কোন সূরার তিলাওয়াত শেষ করিবার পর উহার অব্যবহিত পরবর্তী সূরাকে বাদ দিয়া অন্য কোন সূরা তিলাওয়াত করায় কোন দোষ নাই। তবে, এইরূপ না করিয়া উহার অব্যবহিত পরবর্তী সূরা তিলাওয়াত করাই উত্তম। নবী করীম (সাঃ) কখনও জুমুআর নামাযের প্রথম রাকআতে সূরা জুমুআ এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা মুনাফিকূন আবার কখনও প্রথম রাকআতে সূরা আ’লা এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা গাশিয়া তিলাওয়াত করিতেন। পক্ষান্তরে তিনি ঈদের নামাযের প্রথম রাকআতে সূরা কাফ এবং দ্বিতীয় রাকআতে (উহার অব্যবহিত পরবর্তী সূরা আয্যারিয়াত-এর পরিবর্তে ) সূরা কামার তিলাওয়াত করিতেন। হযরত আবূ কাতাদাহ (রাঃ) হইতে ইমাম মুসলিম উপরোক্ত হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফে হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণিত রহিয়াছেঃ নবী করীম (সাঃ) জুমুআর দিনে ফজরের নামাযের প্রথম রাকআতে সূরা আলিফ লাম মীম আস-সাজদাহ এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা দাহর তিলাওয়াত করিতেন।
কোন সূরা তিলাওয়াত করিয়া উহার পূর্ববর্তী অন্য কোন সূরা তিলাওয়াত করায়ও কোন দোষ নাই। হযরত হুযায়ফা (রাঃ) হইতে বর্ণিত রহিয়াছেঃ নবী করীম (সাঃ) প্রথমে সূরা বাকারা, তৎপর সূরায়ে নিসা এবং তৎপর সূরায়ে আলে ইমরান তিলাওয়াত করিয়াছেন। ইমাম মুসলিম উপরোক্ত হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন। হযরত উমর (রাঃ) ফজরের নামাযের প্রথম রাকআতে সূরা নাহল এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা ইউসুফ তিলাওয়াত করিয়াছেন ।
কুরআন মজীদের অনুলিপি প্রস্তুত হইয়া যাইবার পর হযরত উসমান (রাঃ) মূল সংকলনখানা হযরত হাফসা (রাঃ)-এর নিকট ফিরাইয়া দিলেন। উহা তাঁহারই নিকট সংরক্ষিত
রহিল। একদা মারওয়ান ইবন হাকাম তাঁহার নিকট উহা চাহিয়া সংবাদ পাঠাইলে তিনি উহা তাহাকে দিতে অসম্মতি জানাইলেন। এইরূপে তাঁহার মৃত্যু পর্যন্ত উহা তাঁহার নিকট রক্ষিত রহিল। তাঁহার মৃত্যুর পর উহা তদীয় ভ্রাতা হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন উমর (রাঃ)-এর নিকট রক্ষিত রহিল। আমীর মারওয়ান উহা তাঁহার নিকট হইতে লইয়া এই ভয়ে পোড়াইয়া ফেলিলেন যে, উহাতে হযরত উসমান (রাঃ) কর্তৃক প্রস্তুত অনুলিপির সহিত সামঞ্জস্যবিহীন কোন কিছু লিপিবদ্ধ থাকিতে পারে।(১)
হযরত উসমান (রাঃ) একটি অনুলিপি মক্কা শরীফে, একটি অনুলিপি বসরা নগরীতে, একটি অনুলিপি কূফা নগরীতে, একটি অনুলিপি সিরিয়া প্রদেশে, একটি অনুলিপি ইয়ামান প্রদেশে ও একটি অনুলিপি বাহরাইনে প্রেরণ করিলেন এবং একটি অনুলিপি মদীনা শরীফে রাখিয়া দিলেন। আবূ হাতিম সাজিস্তানী হইতে আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদ উপরোক্ত রিওয়ায়েত বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম কুরতুবী অবশ্য বলিয়াছেন, হযরত উসমান (রাঃ) মাত্ৰ চারিখানা অনুলিপি বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার এই অভিমত সমৰ্থিত নহে। জনসাধারণের নিকট কুরআন মজীদের অন্যান্য যে (অসম্পূর্ণ বা সম্পূর্ণ) সংকলন রক্ষিত ছিল, হযরত উসমান (রাঃ) তাহা পোড়াইয়া ফেলিতে নির্দেশ দিলেন- যাহাতে কুরআন মজীদের কিরাআত ও উহার শব্দের উচ্চারণে মুসলমানদের মধ্যে মতভেদ দেখা না দেয়। তাঁহার সময়ের সকল সাহাবী এই কার্যে তাঁহাকে সমর্থন করিয়াছিলেন। যাহারা একত্রিত হইয়া তাঁহাকে হত্যা করিয়াছিল, কেবলমাত্র তাহারাই এই কার্যের বিরোধিতা করিয়াছিল। আল্লাহ্ তাহাদের প্রতি লা’নত বর্ষণ করুন। বিরোধীগণ হযরত উসমান (রাঃ)-এর যে সকল কার্যের বিরূপ সমলোচনা করিয়াছিল, ইহা ছিল সেগুলির অন্যতম। প্রকৃতপক্ষে তাহাদের সমালোচনা ছিল অযৌক্তিক, অমূলক ও ভিত্তিহীন। শীর্ষস্থানীয় সাহাবীগণ ও তাবেঈগণ সকলেই উক্ত কার্যে তাঁহার প্রতি সমর্থন প্রদান করিয়াছিলেন।
সুয়ায়দ ইব্ন গাফলাহ হইতে ধারাবাহিকভাবে জনৈক ব্যক্তি, আলকামা ইব্ন মারসাদ, শু‘বা, ইমাম আবূ দাউদ তায়ালেসী, ইব্ন মাহদী ও গুনদুর বর্ণনা করিয়াছেনঃ
হযরত উসমান (রাঃ) যখন কুরআন মজীদের মূল সংকলন ও উহার অনুলিপি ছাড়া সকল পাণ্ডুলিপি পোড়াইয়া ফেলিলেন, তখন হযরত আলী (রাঃ) মন্তব্য করিলেন, ‘উসমান (রাঃ) উহা না করিলে আমিই উহা করিতাম।’
হযরত মুসআব ইব্ন সা’দ ইব্ন আবী ওয়াক্কাস হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ইসহাক, শু’বা, আবদুর রহমান, আহমাদ ইব্ন সিনান ও আবূ বকর ইবন আবূ দাউদ বর্ণনা করিয়াছেন যে, হযরত মুসআব বলেনঃ
হযরত উসমান (রাঃ) যখন কুরআন মজীদের অনির্ভরযোগ্য পাণ্ডুলিপি পোড়াইয়া ফেলেন, তখন আমি বিপুল সংখ্যক লোককে উপস্থিত দেখিয়াছি। ‘উক্ত কার্য তাহাদিগকে বিস্মিত করিয়াছিল’ অথবা ‘তাহাদের কেহই উক্ত কার্যের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে নাই।’ উক্ত রিওয়ায়েতের সনদ সহীহ।
গুনায়েম ইবন কায়স মাযানী হইতে ধারাবাহিকভাবে ছাবিত ইবন আম্মারাহ আল-হানাফী, ইয়াহিয়া ইব্ন কাছীর ইসহাক ইবন ইবরাহীম সওয়াফ ও আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদ বর্ণনা করিয়াছেন যে, গুনায়েম বলেনঃ
‘আমি কুরআন মজীদকে উভয়বিধ উচ্চারণেই (على الحرفين جميعا) তিলাওয়াত করিয়াছি। হযরত উসমান (রাঃ) যদি কুরআন মজীদের অনুলিপি প্রস্তুত না করিতেন, তবে এক দুঃখজনক অবস্থা দেখা দিত। আল্লাহ্র কসম ! এইরূপ চিন্তাও আমাকে দুঃখ দেয়। প্ৰত্যেক মুসলমানরেই সন্তান থাকে। প্রতিদিন সকাল বেলায় তাহার সন্তান কুরআন মজীদকে নিজের ব্যবহার্য জিনিসপত্রের সহিত স্বীয় সঙ্গী হিসাবে দেখিতে পায়। রাবী বলেন, আমরা (গুনায়েমকে) বলিলাম, ওহে আবুল আম্বার! ইহা কেন বলিতেছেন? তিনি বলিলেন- হযরত উসমান (রা) যদি কুরআন মজীদ লিখিয়া উহা হিফাজত করিবার ব্যবস্থা না করিতেন, তবে লোকে কবিতা পাঠ করিত।
আবূ মাজলায হইতে ধারাবাহিকভাবে ইমরান ইব্ন হাদীর, মুহাম্মদ ইব্ন আব্দুল্লাহ্, ইয়াকূব ইব্ন সুফিয়ান ও আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদ বর্ণনা করিয়াছেনঃ
আবূ মাজলায বলেন- ‘হযরত উসমান (রাঃ) যদি কুরআন মজীদ লিখিবার ব্যবস্থা না করিতেন, তবে লোকদিগকে কবিতা পাঠ করিতে দেখা যাইত।’ ইব্ন মাহদী হইতে ধারাবাহিকভাবে আহমাদ ইবন সিনান ও আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদ বর্ণনা করিয়াছেন ;
ইব্ন মাহদী বলেন- ‘হযরত উসমান (রাঃ) এইরূপ দুইটি মহৎ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন, এমনকি হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) এবং হযরত উমর ফারূক (রা)-ও যাহার অধিকারী ছিলেন না। এক. তিনি অন্যায়ভাবে নিহত হইয়াছেন; কিন্তু শত্রু পক্ষের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করিতে যান নাই। দুই. তিনি বিশ্ববাসীর জন্যে নির্ভুল কুরআন মজীদ পাইবার ব্যবস্থা করিয়াছেন।
পক্ষান্তরে খুমায়র ইব্ন মালিক হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ইসহাক ও ইসরাঈল বর্ণনা করিয়াছেনঃ
‘হযরত উসমান (রাঃ) যখন কুরআন মজীদের মূল সংকলন ও উহার অনুলিপি ভিন্ন অন্য সমুদয় পাণ্ডুলিপি পোড়াইয়া ফেলিবার নির্দেশ দিলেন, তখন হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) উহা সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করিতে পারিলেন না। তিনি (জনসাধারণকে) উপদেশ দিলেন, তোমাদের কেহ কুরআন মজীদের কোন সংকলন গোপন রাখিয়া দিতে পারিলে সে যেন উহা রাখিয়া দেয়। কেহ এইরূপে যাহা রাখিয়া দিতে পারিবে, কিয়ামতের দিনে তাহা লইয়া সে আল্লাহ্ তা’আলার সম্মুখে উপস্থিত হইবে। তিনি বলিলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর পবিত্ৰ মুখ হইতে আমি সত্তরটি সূরা(১) শিখিয়াছি। যায়দ ইব্ন ছাবিত তখন বালক ছিল। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর পবিত্র মুখ হইতে যাহা শিখিয়াছি, তাহা আমি ত্যাগ করিব?’
আবূ ওয়ায়েল হইতে ধারাবাহিকভাবে আ’মাশ, ইব্ন শিহাব, সা’ঈদ ইব্ন সুলায়মান, মুহাম্মদ ইব্ন আব্দুল্লাহ্ ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ নাযর ও আবূ বকর বর্ণনা করিয়াছেনঃ
আবূ ওয়ায়েল বলেন- ‘একদা হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ) মিম্বারে দাঁড়াইয়া আমাদের সম্মুখে বক্তৃতা করিলেন। তিনি বলিলেন, যদি কেহ চুরি করিয়া কিছু করে, তবে কিয়ামতের দিনে সে চুরির বস্তু লইয়া আল্লাহ্ তা’আলার সম্মুখে উপস্থিত হইবে। তোমরা তোমাদের নিকট রক্ষিত কুরআন মজীদের সংকলনকে গোপনে হিফাজত করিয়া রাখিয়া দাও। তোমরা আমাকে কিরূপে যায়দ ইব্ন ছাবিতের কিরাআত অনুযায়ী কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিতে বলো? অথচ আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর পবিত্র মুখে সত্তরের কিছু অধিক সূরা শিখিয়াছি। সেই সময়ে যায়দ ইব্ন ছাবিত ছিল বালক মাত্র। সে বালকদের সহিত আসিত। তাহার মস্তকের অগ্রভাগে দুই গুচ্ছ কেশ ছিল । কুরআন মজীদের প্রতিটি আয়াতের শানে নুযূল সম্বন্ধে আমিই অধিকতর ওয়াকেফহাল। আল্লাহর কিতাব সম্বন্ধে আমার চাইতে অধিকতর জ্ঞানের অধিকারী অন্য কেহ নাই। তবে আমি তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি নহি। আমি যদি জানিতে পারি যেখানে যানবাহন হিসাবে ব্যবহার্য উট পৌঁছিতে পারে, সেইরূপ কোন স্থানে আল্লাহ্র কিতাব সম্বন্ধে আমার চাইতে অধিকতর জ্ঞানের অধিকারী কোন ব্যক্তি রহিয়াছে, তবে আমি তাঁহার নিকট গমন করিব।’ অতঃপর আবূ ওয়ায়েল বলেন- হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ) মিম্বার হইতে নামিবার পর আমি জনতার মধ্যে বসিয়া পড়িলাম। দেখিলাম, হযরত ইবন মাসউদ (রাঃ) যাহা বলিলেন, কেহই উহার বিরোধিতা করিল না।’ উপরোক্ত রিওয়ায়েত বুখারী শরীফ এবং মুসলিম শরীফেও বর্ণিত রহিয়াছে। উহাতে হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-এর উক্তি এইরূপে বর্ণিত হইয়াছেঃ ‘আল্লাহ্র রাসূল হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা)-এর সাহাবীগণ জানেন, আমি আল্লাহ্র কিতাব সম্বন্ধে তাহাদের মধ্যে অধিকতর জ্ঞানের অন্যতম অধিকারী।’
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আবূ ওয়ায়েলের মন্তব্য ‘কেহই হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-এর বক্তব্যের বিরোধিতা করিল না’- ইহার তাৎপর্য এই যে, ‘হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ) কুরআন মজীদ সম্পর্কিত স্বীয় জ্ঞান ও ফযীলত সম্বন্ধে যাহা বলিলেন, কেহই উহার বিরোধিতা করিল না।’ আল্লাহ্ই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী । পক্ষান্তরে অনেকেই কুরআন মজীদের সংকলন লুকাইয়া রাখিবার জন্য তাঁহার পরামর্শের বিরোধিতা করিয়াছিল । আলকামা হইতে ধারাবাহিকভাবে ইবরাহীম ও আ’মাশ বর্ণনা করিয়াছেন যে, আলকামা বলেনঃ একদা আমি সিরিয়ায় আগমন করিলে তথায় হযরত আবূ দারদা (রাঃ)-এর সহিত আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমার নিকট বলিলেন- ‘আমরা আবদুল্লাহ্ (ইব্ন মাসউদ)-কে একজন ভীরু ব্যক্তি মনে করিতাম। তাঁহার কি হইল যে, তিনি আমীরের বিরুদ্ধে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছেন?’
আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদ স্বীয় পুস্তকের একটি পরিচ্ছেদকে “অবশেষে হযরত উসমান (রাঃ) কর্তৃক কুরআন মজীদ সংকলনের প্রতি হযরত ইবন মাসউদের সমর্থন জ্ঞাপন” এই শিরোনাম দিয়াছেন। উহাতে তিনি বর্ণনা করিয়াছেন- ফালফালাহ জা—ফী হইতে ধারাবাহিকভাবে উসমান ইব্ন হাস্সান আল-আমেরী, ওয়ালীদ ইব্ন কায়স, যুহায়ের, আবূ উসামাহ, আবদুল্লাহ্ ইব্ন সাঈদ ও মুহাম্মদ ইবন উসমান আমার (আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদের) নিকট বর্ণনা করিয়াছেনঃ
‘একদা কুরআন মজীদের অনুলিপিসমূহের (প্রস্তুতকরণের) বিষয় লইয়া ভীত হইয়া আমরা কিছু সংখ্যক লোক হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ)-এর নিকট গমন করিলাম। আমাদের মধ্য হইতে জনৈক ব্যক্তি তাঁহাকে বলিল, আমরা আপনার নিকট সৌজন্য সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্যে আগমন করি নাই; বরং (কুরআন মজীদ সম্পর্কিত) এই সংবাদে ভীত হইয়াই আপনার নিকট আগমন করিয়াছি। ইহাতে হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ (রাঃ) বলিলেন- নিশ্চয় সাত প্রকার বিষয়ে সাতটি উচ্চারণে তোমাদের নবীর প্রতি কুরআন মজীদ অবতীর্ণ হইয়াছে। পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহ একটি মাত্র বিষয়ে ও একটি মাত্র উচ্চারণে অবতীর্ণ হইত।’ আমি (ইব্ন কাছীর) বলি, হযরত ইবন মাসউদ (রাঃ)-এর উপরোক্ত মন্তব্য দ্বারা আবূ বকর ইব্ন দাউদের অনুমতি হযরত ইবন মাসউদ (রাঃ)-এর স্বীয় পূর্ব অভিমত প্রত্যাহার করা এবং হযরত উসমান (রাঃ)-এর কার্যের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা প্রমাণিত হয় না। আল্লাহ্ই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী।
হযরত মুসআব ইব্ন সা’দ হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ ইসহাক, ইসরাঈল, আবূ রজা, আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদের পিতৃব্য ও আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদ বর্ণনা করেনঃ
একদা হযরত উসমান (রাঃ) মিম্বারে দাঁড়াইয়া জনতার উদ্দেশ্যে বলিলেন- হে লোক সকল ! তোমাদের নবী তের বৎসর পূর্বে তোমাদের প্রতি দায়িত্ব সঁপিয়া দিয়া তোমাদিগকে ছাড়িয়া গিয়াছেন। আজ তোমরা কুরআন মজীদ সম্বন্ধে সন্দিহান হইয়া পড়িয়াছ। তোমরা (কুরআন মজীদের জন্যে বিভিন্ন কিরাআত উদ্ভাবন করিয়া) বলিয়া থাক, ইহা উবাই (ইবন কা’ব)-এর কিরাআত; ইহা আব্দুল্লাহ্ (ইবন মাসউদ)-এর কিরাআত ইত্যাদি। তোমাদের একজন অন্যজনকে বলিয়া থাকে, ‘আল্লাহ্র কসম! তোমার কিরাআত (জনগণের নিকট) টিকিবে না।’ আমি তোমাদের প্রত্যেককে আল্লাহর কসম দিয়া বলিতেছি, যাহার নিকট কুরআন মজীদের যাহা কিছু আছে, সে যেন উহা লইয়া উপস্থিত হয়। তাঁহার কথায় লোকেরা (কুরআন মজীদের আয়াত সম্বলিত) পত্র ও পশুচর্ম লইয়া তাঁহার নিকট উপস্থিত হইল। তিনি তাহাদের প্রত্যেককে পৃথকভাবে ডাকিয়া ডাকিয়া আল্লাহ্র কসম দিয়া বলিতে লাগিলেন, তুমি কি ইহা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর পবিত্র মুখ হইতে শুনিয়াছ? প্রত্যেকে বলিল – হ্যাঁ ।
অতঃপর হযরত উসমান (রাঃ) লোকদের নিকট জিজ্ঞাসা করিলেন- লিখনকার্যে জনগণের মধ্যে দক্ষতম ব্যক্তি কে? লোকেরা বলিল, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর লেখক যায়দ ইব্ন ছাবিত (রাঃ)। তিনি বলিলেন- বিশুদ্ধ আরবী উচ্চারণে লোকদের মধ্যে কে অধিকতম দক্ষ? লোকেরা বলিল, সাঈদ ইবনুল আস। তিনি বলিলেন- সাঈদ ইবনুল আস কুরআন মজীদের উচ্চারণ বলিয়া দিবে এবং যায়দ ইব্ন ছাবিত উহা লিপিবদ্ধ করিবে। হযরত উসমান (রাঃ)-এর নির্দেশ অনুসারে হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত (রাঃ) কুরআন মজীদের কয়েকখানা অনুলিপি প্রস্তুত করিলেন। হযরত উসমান (রাঃ) উহা লোকদের মধ্যে বিতরণ করিয়া দিলেন। রাবী বলেন- আমি কোন কোন সাহাবীকে বলিতে শুনিয়াছি যে, ‘কুরআন মাজীদের অনুলিপি প্রস্তুত করিয়া হযরত উসমান (রাঃ) একটি মহৎ কাজ করিয়াছে।’ উক্ত রিওয়ায়েতের সনদ সহীহ।
কাছীর ইব্ন আফলাহ হইতে ধারাবাহিকভাবে মুহাম্মদ ইব্ন সীরীন, আবূ বকর ইব্ন হিশাম ইব্ন হাস্সান, ইসহাক ইব্ন ইবরাহীম ইব্ন যায়দ ও আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদ বর্ণনা করেনঃ
‘হযরত উসমান (রাঃ) যখন কুরআন মজীদের অনুলিপি প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিলেন, তখন তিনি এতদুদ্দেশ্যে কুরায়েশ ও আনসারের মধ্য হইতে বারজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে একত্রিত করিলেন। তাঁহাদের মধ্যে হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) এবং হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত (রাঃ)-ও ছিলেন। তাঁহারা হযরত উমর (রাঃ)-এর বাড়িতে রক্ষিত কুরআন মজীদের মূল সংকলনখানা (الر بعة) আনাইলেন। হযরত উসমান (রাঃ) তাঁহাদের কার্য দেখাশুনা করিতেন। কোন বিষয়ে তাঁহাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলে তাঁহারা উহার লিখন স্থগিত রাখিতেন। রাবী মুহাম্মদ ইব্ন সীরীন বলেন, আমি আমার ঊর্ধ্বতন রাবী কাছীর ইব্ন আফলাহর নিকট জিজ্ঞাসা করিলাম- তাঁহারা এইরূপ বিষয়ের লিখন কেন স্থগিত রাখিতেন, তাহা বলিতে পারেন কি?’ কাছীর ইব্ন আফলাহ ছিলেন একজন সুলেখক ব্যক্তি। তিনি নেতিবাচক উত্তর দিলেন। রাবী মুহাম্মদ ইব্ন সীরীন বলেন- আমি ধারণা করিলাম, ‘তাঁহারা বিতর্কিত বিষয়ের লিখনকার্য এই উদ্দেশ্যে স্থগিত রাখিতেন যে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) কর্তৃক হযরত জিবরাঈল (আঃ)-এর সম্মুখে সর্বশেষে আবৃত্ত কুরআন মজীদের তিলাওয়াত সম্বন্ধে যাঁহারা সর্বাধিক ওয়াকেফহাল, তাঁহাদের নিকট হইতে সঠিক তথ্য, আয়াত বা উচ্চারণ জানিয়া লইয়া উহা লিপিবদ্ধ করিবেন।’ উক্ত রিওয়ায়েতের সনদ সহীহ।
আমি (ইব্ন কাছীর) বলিতেছি, উপরোক্ত রিওয়ায়েতে মূল আরবীতে যে الر بعة শব্দ উল্লেখিত হইয়াছে, উহার অর্থ সংকলিত বিষয়সমূহ। উক্ত বিক্ষিপ্ত সংকলনখানা হযরত হাফসা (রাঃ)-এর নিকট সংরক্ষিত ছিল। একত্রিত গ্রন্থাকারে উহার অনুলিপি প্রস্তুত করিবার পর হযরত উসমান (রাঃ) উহা হযরত হাফসা (রাঃ)-এর নিকট প্রত্যর্পণ করিয়াছিলেন। জনগণের নিকট প্রাপ্ত অনির্ভরযোগ্য সংকলনসমূহ পোড়াইয়া ফেলিলেও তিনি উহা পোড়ান নাই। কারণ, উহাকেই অবিকলভাবে পুনঃলিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন। তবে উহা ছিল অবিন্যস্ত। তিনি সুবিন্যস্ত আকারে উহার অনুলিপি প্রস্তুত করিয়াছিলেন।(১) মূল সংকলনখানা পোড়াইয়া না ফেলিবার কারণ এই যে, উহা হযরত হাফসা (রাঃ)-এর নিকট প্রত্যর্পণ করিবার ওয়াদা করিয়াই হযরত উসমান (রাঃ) উহা তাঁহার নিকট হইতে আনিয়াছিলেন। হযরত হাফসা (রাঃ)-এর ইন্তিকাল পর্যন্ত উহা তাঁহারই নিকট রক্ষিত ছিল। তাঁহার ইন্তিকালের পর মারওয়ান ইব্ন হাকাম উহা লইয়া গিয়া পোড়াইয়া ফেলেন। জনসাধারণের নিকট প্রাপ্ত অনির্ভরযোগ্য সংকলনসমূহ পোড়াইয়া ফেলিবার পক্ষে হযরত উসমান (রাঃ) যে যুক্তি প্রদর্শন করিয়াছিলেন, এ ক্ষেত্রে মারওয়ানই সেই যুক্তি প্রদর্শন করিয়াছিলেন ।
সালেম ইব্ন আব্দুল্লাহ্ হইতে ধারাবাহিকভাবে যুরী, শুআয়ব, আবুল ইয়ামান, মুহাম্মদ ইবন আওফ ও আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদ বর্ণনা করেনঃ
‘মারওয়ান ইব্ন হাকাম হযরত হাফসা (রাঃ)-এর জীবদ্দশায় তাঁহার নিকট রক্ষিত কুরআন মজীদের সংকলনখানা চাহিয়া পাঠাইয়া ব্যর্থ হন। হযরত হাফসা (রাঃ)-এর ইন্তিকালের পর তিনি উহা অলঙ্ঘনীয় আদেশক্রমে আবদুল্লাহ্ ইব্ন উমর (রাঃ)-এর নিকট হইতে গ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি উহা ছিঁড়িয়া বিনষ্ট করিয়া দেন। স্বীয় কার্যের পক্ষে মারওয়ান যুক্তি প্ৰদৰ্শন করিতে গিয়া বলেন, আমি উহা এই জন্য করিয়াছি যে, উহার অনুলিপি প্রস্তুত করত সংরক্ষণ
করা হইয়াছে। উহা বিনষ্ট হইলেও কুরআন মজীদ বিনষ্ট হইবার কোন আশংকা নেই। পক্ষান্তরে উহা রাখিয়া দিলে ভবিষ্যতে কোন সন্দেহপরায়ণ ব্যক্তি বলিতে পারে যে, উহাতে লিপিবদ্ধ অংশ-বিশেষ উহার অনুলিপিতে বাদ পড়িয়া গিয়াছে।
উক্ত রিওয়ায়েতের সনদ সহীহ। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, খারিজার পিতা হইতে ধারাবাহিকভাবে খারিজা ও যুহরী কর্তৃক বর্ণিত রিওয়ায়েত বিশেষত গ্রহণযোগ্য নহে। উক্ত রিওয়ায়েতে বর্ণিত হইয়াছে যে, “হযরত উসমান (রাঃ)-এর স্মরণে আসিল যে, সূরা আহযাবের من المؤمنين رجال صدقوا مَاعَاهَدوا الله الخ এই আয়াতটি সংকলনে বাদ পড়িয়া গিয়াছে। অতঃপর অনুলিপি প্রস্তুত করিবার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ উহা যথাস্থানে লিপিবদ্ধ করিলেন।’ প্রকৃতপক্ষে হযরত উসমান (রা)-এর আমলে নহে; বরং হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর আমলে উপরোক্ত ঘটনা ঘটিয়াছিল।
হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে উবায়দ ইব্ন সাব্বাক ও যুহরী কর্তৃক বর্ণিত অপর একটি রিওয়ায়েতে উহা সুস্পষ্টরূপে বিবৃত হইয়াছে। প্রথমোক্ত রিওয়ায়েত গ্রহণযোগ্য না হওয়ার প্রমাণ এই যে, উহাতে বর্ণিত হইয়াছে, ‘আমরা (অনুলিপি প্রস্তুতকারকগণ) উহা উক্ত সূরায় লিপিবদ্ধ করিলাম।’ অথচ উহা হযরত উসমান (রাঃ) কর্তৃক সৃষ্ট অনুলিপির হাশিয়া বা টীকায় নহে; বরং গ্রন্থের অভ্যন্তর ভাগে লিপিবদ্ধ রহিয়াছে।
কুরআন মজীদের সংকলন ছিল একটি মহা মর্যাদাপূর্ণ কীর্তি। হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) এবং হযরত উমর (রাঃ) উক্ত মহৎ কীর্তির প্রথম পর্যায় সম্পন্ন করেন। হযরত উসমান (রাঃ) উহার দ্বিতীয় পর্যায় সম্পন্ন করেন। হযরত সিদ্দীকে আকবর (রাঃ) এবং হযরত ফারূকে আজম (রাঃ) কুরআন মজীদের বিশুদ্ধ সংকলন প্রস্তুত করেন। পক্ষান্তরে হযরত উসমান (রাঃ) উহার মজবুত ও স্থায়ী অনুলিপি প্রস্তুত করত অন্যান্য অনির্ভরযোগ্য সংকলনসমূহ বিনষ্ট করিয়া দিয়া একমাত্র বিশুদ্ধ সংকলনসমূহ বিশ্বে প্রচার করেন। এইভাবে তিনি অশুদ্ধ উচ্চারণে কুরআন মজীদের প্রচলনের পথ রুদ্ধ করত বিশুদ্ধ উচ্চারণের কুরআন মজীদ প্রচারপূর্বক কুরআন মজীদকে হিফাজত করিবার ব্যবস্থা করেন। হযরত জিবরাঈল (আঃ) নবী করীম (সাঃ)-কে রমযান মাসের শেষ দিকে তাঁহার জীবনের সর্বশেষ বারে কুরআন মজীদকে যেরূপে আবৃত্তি করিয়া শুনাইয়াছিলেন, উহা সেইরূপেই বিশ্বময় প্রচারিত হইয়াছে। হযরত জীবরাঈল (আঃ) সর্বশেষ রমযানে নবী করীম (সাঃ)-কে উহা দুইবার শুনাইয়াছিলেন। অন্যান্যবার তিনি উহা একবার শুনাইতেন। তাই নবী করীম (সাঃ) উহার কারণ সম্পর্কে হযরত ফাতিমা (রাঃ)-কে বলিয়াছিলেন- ‘আমার মনে হয়, আমার মৃত্যু নিকটবর্তী।’ বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফে উপরোক্ত রিওয়ায়েত বর্ণিত রহিয়াছে।
বর্ণিত আছে যে, নবী করীম (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পর হযরত আলী (রাঃ) সংকল্প করিলেন যে, কুরআন মজীদ যে তারতীব ও পরম্পরায় নাযিল হইয়াছে, উহাকে সেই তারতীব ও পরম্পরায় সংকলিত করিবেন। এই প্রসঙ্গে মুহাম্মদ ইব্ন সীরীন হইতে ধারাবাহিকভাবে আশআছ, ইব্ন ফুযায়েল, মুহাম্মদ ইব্ন ইসমাইল আহমাসী ও (আবূ বকর) ইব্ন আবূ দাউদ বর্ণনা করিয়াছেনঃ
“নবী করীম (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পর হযরত আলী (রাঃ) শপথ করিলেন যে, তিনি যতদিন কুরআন মজীদকে একখানা সংকলিত গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ না করিবেন, ততদিন জুমুআর নামাব আদায় করিবার সময় ভিন্ন অন্য কোন সময়ে গায়ে চাদর ব্যবহার করিবেন না । শপথ অনুযায়ী তিনি একসময় কুরআন মজীদের সংকলন প্রস্তুত করিয়া ফেলিলেন। ইহাতে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ) কিছুদিন পর তাঁহার নিকট বলিয়া পাঠাইলেন— ‘ওহে আবুল হাসান ! আপনি কি আমার নেতৃত্বকে অপছন্দ করেন?’ তিনি আসিয়া বলিলেন, আল্লাহ্র কসম ! আমি আপনার নেতৃত্বকে অপছন্দ করি না; কিন্তু, আমি শপথ করিয়াছিলাম, কুরআন মজীদের সংকলন প্রস্তুত না করিয়া জুমুআর নামায আদায় করিবার সময় ভিন্ন অন্য কোন সময়ে গায়ে চাদর ব্যবহার করিব না।’ অতঃপর তিনি হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর হাতে বায়আত করত প্রত্যাবর্তন করিলেন ।”
আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদ কর্তৃক বর্ণিত উপরোক্ত রিওয়ায়েতের সনদ বিচ্ছিন্ন। উক্ত রিওয়ায়েত সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করিয়াছেন- উপরোক্ত রিওয়ায়েতের অন্যতম রাবী আশআছ ভিন্ন অন্য কেহ উল্লেখ করে নাই যে, হযরত আলী (রাঃ) কুরআন মজীদের সংকলন লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন। উক্ত ‘আশআছ’ একজন মিথ্যাবাদী ব্যক্তি। অন্যান্য রাবী বর্ণনা করিয়াছেন- “হযরত আলী (রাঃ) বললেন-
حتى اجمع القران অর্থাৎ ‘যতদিন আমি কুরআন মজীদ কণ্ঠস্থ করিবার কার্য সম্পন্ন করিতে না পারিব, ততদিন… । যেমন, جمع فلان القران ‘অমুক ব্যক্তি কুরআন মজীদ কণ্ঠস্থ করিয়াছে।’
আমি (ইব্ন কাছীর) বলিতেছি, আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদের উপরোক্ত মন্তব্যই সঠিক ও গ্রহণযোগ্য। কারণ, হযরত আলী (রাঃ) কর্তৃক লিখিত কুরআন মজীদের কোন সংকলন বা অন্য কোন গ্রন্থ(১) পাওয়া যায় না। তবে হযরত উসমান (রাঃ) কর্তৃক প্রস্তুত কুরআন মজীদের সংকলনের অবিকল অনুকরণে লিখিত এইরূপ কতকগুলি অনুলিপি পাওয়া যায়, যেগুলি সম্বন্ধে কথিত হইয়া থাকে যে, উহা হযরত আলী (রাঃ) লিখিয়াছিলেন। কিন্তু এইরূপ ধারণা সঠিক নহে। কারণ, উহার কোন কোনটিতে লিখিত রহিয়াছেঃ
كتبه على ابن ابو طالب (ইহা হযরত আলী ইব্ন আবূ তালিব লিখিয়াছেন।)(২) উক্ত বাক্যটি আরবী ব্যাকরণগত দিক দিয়া ভুল। হযরত আলী (রাঃ) দ্বারা এইরূপ ভ্রান্তি সংঘটিত হইতে পারে না। তিনি ছিলেন আরবী ব্যাকরণ শাস্ত্রের উদগাতা। আসওয়াদ ইব্ন আমর দুয়েলী তাঁহার নিকট হইতে ব্যাকরণ সম্পর্কিত যাহা বর্ণনা করিয়াছেন, তদ্দ্বারা উহা প্রমাণিত হয়। তিনি আরবী শব্দ الكلمة কে فعل - اسه ও حرف এই তিন প্রকারে বিভক্ত করিয়াছেন। এতদ্ব্যতীত অন্যান্য কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হযরত আলী (রাঃ) কর্তৃক উদ্ভাবিত এবং আবুল আসওয়াদ কর্তৃক সম্প্রসারিত হইয়াছে। গবেষকগণ পরবর্তীকালে উহার সুবিস্তৃত রূপ দান করিয়াছেন। এইরূপে আরবী ব্যাকরণ একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্রে পরিণত হইয়াছে।
হযরত উসমান (রাঃ) কর্তৃক প্রস্তুত কুরআন মজীদের অনুলিপিসমূহের মধ্যে অধিকতর বিখ্যাত হইতেছে দামেস্কের জামে মসজিদের প্রাচীর পরিবেষ্টিত কক্ষের পূর্বাংশে সংরক্ষিত অনুলিপিখানা। উক্ত কক্ষটিতে আল্লাহ্ তা’আলার বিভিন্ন নাম অংকিত রহিয়াছে। উক্ত অনুলিপিখানা পূর্বে ‘তবরিয়্যাহ’ (طبرية) শহরে সংরক্ষিত ছিল। পাঁচশত আঠার হিজরী সনে উহা দামেস্কে স্থানান্তরিত হয়। আমি উহা দেখিবার সৌভাগ্য লাভ করিয়াছি। উহার কলেবর বিপুল। উহার হস্তাক্ষর, সুস্পষ্ট, সুপাঠ্য ও সুন্দর দীর্ঘস্থায়ী রঙের কালিতে উহা লিখিত। উহার পাতা সম্ভবত উটের চামড়ার। আল্লাহ্ সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। উহা মহিমান্বিত মহা সম্মানিত প্রিয় কিতাব । আল্লাহ্ তা’আলা উহার সম্মান, তা’জীম ও ইয্যত বাড়াইয়া দিন |
হযরত উসমান (রাঃ) কর্তৃক প্রস্তুত কুরআন মজীদের অনুলিপিসমূহের কোনটিই হযরত উসমান (রাঃ)-এর নিজ হস্তে লিখিত নহে। সেইগুলি হযরত যায়দ ইব্ন ছাবিত প্রমুখ লেখকবৃন্দ কর্তৃক তাঁহার খিলাফতের কালে লিখিত। যেহেতু হযরত উসমান (রাঃ)-এর উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় লিপিবদ্ধ হইয়াছিল, তাই সেগুলিকে ‘উসমানী মাসাহিফ’ বলা হয় । অবশ্য হযরত উসমান (রা)-এর সম্মুখে সেইগুলি পড়িয়া সাহাবীগণকে শুনানো হইয়াছিল। এইরূপে সাহাবীদের সর্বসম্মত রায়ে নির্ভুল ঘোষিত হইবার পর উহা মুসলিম রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরিত হয় ।
বনূ উসাইদ গোত্রের মুক্তিপ্রাপ্ত দাস আবূ সাঈদ হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ নাযারাহ, সুলাইমান তায়মী, কুরায়েশ ইব্ন আনাস, আলী ইব্ন হারব তাঈ ও আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদ বর্ণনা করিয়াছেনঃ
‘মিসরীয় বিদ্রোহীগণ হযরত উসমান (রাঃ)-এর ঘরে প্রবেশ করিয়া সর্বপ্রথম তাঁহার পবিত্ৰ হস্তে তরবারীর আঘাত হানিল । উহা فسيكفيكهم الله وهو السميع العليم -এই ও আয়াতের উপর পতিত হইল। তিনি স্বীয় হস্ত টার্নিয়া লইয়া বলিলেন- ‘আল্লাহ্র কসম ! এই হাত সর্বপ্রথমে কুরআন মজীদ লিপিবদ্ধ করিয়াছে। ‘
ইবন ওয়াহাব হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ তাহের ও আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদ আরও বর্ণনা করিয়াছেনঃ ইবন ওয়াহাব বলেন- একদা আমি ইমাম মালিকের নিকট হযরত উসমান (রাঃ)-এর কুরআন মজীদ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিলেন । তিনি বলিলেন, উহা বিনষ্ট হইয়া গিয়াছে । হযরত উসমান (রাঃ)-এর কুরআন মজীদ বলিতে প্রশ্নকারী ইব্ন ওয়াহাব বলেন, হযরত উসমান (রাঃ) কর্তৃক স্বহস্তে লিখিত কুরআন মজীদ(১) অথবা মদীনা শরীফে রক্ষিত কুরআন মজীদের অনুলিপিখানা বুঝাইয়াছে। আল্লাহই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ৷
ইবন উমাইয়ার ভগ্নী ‘সহবা বিনতে হারব ইব্ন উমাইয়া’কে বিবাহ করে। এই সূত্রে সে স্বীয় শ্বশুর হাব ইব্ন উমাইয়া এবং শ্যালক সুফিয়ানকে লিখন পঠন শিক্ষা দেয়। অতঃপর উমর ইব্ন খাত্তাব হাব ইবন উমাইয়ার নিকট হইতে এবং মুআবিয়া ইব্ন আবূ সুফিয়ান স্বীয় পিতৃব্য সুফিয়ান ইব্ন হারবের নিকট হইতে উহার শিক্ষা লাভ করেন। কেহ কেহ বলেন, ‘বাক্কা’ নামক জনপদের অধিবাসী ‘তায়’ গোত্রীয় একদল লোক আম্বার শহর হইতে সৰ্বপ্ৰথম আরবী ভাষার লিখন-পঠন শিখিয়া আসে। তাহারা উহাকে অধিকতর উন্নতরূপ দান করিয়া আরব উপদ্বীপে প্রচার করে। এইরূপে আরবী লিখন-পঠন সমগ্র আরবদেশে ছড়াইয়া পড়ে ৷
শা’বী হইতে ধারাবাহিকভাবে মুজাহিদ, সুফিয়ান, আবদুল্লাহ্ ইব্ন মুহাম্মদ, যুহরী ও আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদ বর্ণনা করিয়াছেন যে, শা’বী বলেনঃ
‘একদা আমরা মুহাজির সাহাবীদের নিকট জিজ্ঞাসা করিলাম- আপনারা কোথা হইতে আরবী ভাষার লিখন-পঠন শিখিলেন? তাহারা বলিলেন- আম্বার নামক দেশের অধিবাসীদের নিকট হইতে।’
পুরাকালে আরবী লিখন পদ্ধতি প্রধানত কূফাকেন্দ্রিক ছিল। উযীর আবূ আলী ইব্ন মাকাল্লাহ্ উহাকে উন্নত পর্যায়ে পৌছাইয়া দেন। তিনি আরবী ভাষা লিখনের একটি উন্নত পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। অতঃপর আলী ইব্ন হিলাল বাগদাদী ওরফে ইব্ন বাওয়াব উহার উন্নতি বিধানে আগাইয়া আসেন। জনগণ এই বিষয়ে তাহাকে অনুসরণ করিয়া চলে। তাহার প্রবর্তিত পদ্ধতি সুন্দর ও সুস্পষ্ট।
উপরের আলোচনা দ্বারা আমি বুঝাইতে চাহিতেছি যে, ইসলামের প্রথম যুগে কুরআন মজীদ সংকলিত হইবার কালে যেহেতু আরবী ভাষার লিখন পদ্ধতি উন্নত ও সুস্পষ্ট রূপ পরিগ্রহ করে নাই, তাই উহার সংকলিত হইবার কালে উহার আয়াতসমূহের বিষয়ে নহে; বরং উহার শব্দসমূহের লিখন পদ্ধতির বিষয়ে লেখকদের মধ্যে স্বভাবতই মতভেদ দেখা দিয়াছিল। এই বিষয়ে লেখকগণ পুস্তক প্রণয়ন করিয়াছেন। ইমাম আবূ উবায়দ কাসিম ইবন সাল্লাম (রঃ) স্বীয় পুস্তক ‘ফাযায়েলুল কুরআন’-এ এই বিষয়টিকে গুরুত্ব প্রদান করিয়া আলোচনা করিয়াছেন। হাফিজ আবূ বকর ইব্ন আবূ দাউদও স্বীয় গ্রন্থে উহাকে গুরুত্ব দিয়াছেন। তাঁহারা উভয়ে স্ব-স্ব পুস্তকে একটি স্বতন্ত্র পরিচ্ছেদে এই বিষয়ে আলোচনা করিয়াছেন। কুরআন মজীদের লিখন সম্পর্কিত তাঁহাদের প্রবন্ধ দুইটি অতীব চমৎকার।
কুরআন মজীদের লিখনশিল্প এস্থলে আমার আলোচ্য বিষয় নহে বিধায় তাঁহাদের প্রবন্ধদ্বয়ের বিস্তারিত আলোচনা হইতে বিরত রহিতেছি। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, ইমাম মালিক অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন যে, হযরত উসমান (রাঃ) কর্তৃক প্রস্তুত কুরআন মজীদ সংকলনের লিখন-রীতি ভিন্ন অন্য কোন লিখন-রীতিতে কুরআন মজীদ লিপিবদ্ধ করা বৈধ নহে। অন্যেরা উহাকে অবৈধ বলেন না। তবে তাহারা অক্ষরের রূপ ও নোকতা পরিবর্তনের বিষয়ে একমত নহেন। কেহ কেহ উক্ত পরিবর্তনকে বৈধ এবং কেহ কেহ উহাকে অবৈধ বলেন। অবশ্য আমাদের যুগে কুরআন মজীদের একটি মাত্র সূরাকে, কয়েকটি আয়াতকে, কুরআন মজীদের এক-দশমাংশকে অথবা উহার যেকোন অংশকে পৃথক করিয়া লিখিবার রীতি বহুল প্রচলিত রহিয়াছে। তবে পূর্বযুগের নেককারবৃন্দের (سلف صالحين) অনুসরণই শ্রেয়তর।