আমাদের কথা
‘স্বতন্ত্র ভাবনা’ বইটি মূলত মুক্তমনা-লেখকদের নির্বাচিত প্রবন্ধের একটি সংকলন । অন্ধ বিশ্বাস, ধর্মীয় মৌলবাদ, কূপমণ্ডূকতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, অলৌকিকতা ও কুসংস্কারকে উসকে দেওয়া ইত্যাদি ধ্যান-ধারণার বিপরীতে মুক্তমনার (www.mukto-mona.com) যে আদর্শিক সংগ্রাম শুরু হয়েছিল আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে, এ বইয়ের লেখাগুলো তারই নিদর্শন বহন করছে । প্রচলিত ধ্যান ধারণার গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসানো লেখা নয় এগুলো, নয় প্রচলিত বিশ্বাস এবং সিস্টেমের প্রতি আনত স্তব । বইটি বিশ্বাস ভাঙার, নির্মোহ দৃষ্টিতে সমাজ ও ব্যক্তিকে দেখার । সে হিসেবে এ বইয়ের লেখকদের ভাবনাগুলো স্বতন্ত্র; সমাজে বিদ্যমান পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণাগুলো থেকে অনেকটাই আলাদা । তাই এ বইয়ের নাম ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’।
যুক্তিবাদ, সংশয়বাদ, মানবতাবাদ, নাস্তিকতা কিংবা ইহজাগতিকতার মত ধারণাগুলো সমাজ সচেতন মানুষের কাছে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে । কিন্তু তবুও এ দেশের অধিকাংশ মানুষ ‘বিশ্বাস নির্ভর’ গতানুগতিকতার আবর্তে বন্দি । হাজারো প্রচলিত সংস্কার, তুকতাক, অপবিশ্বাস, ব্যক্তিপূজা আর সনাতন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ইদানীং যুক্ত হয়েছে বৈজ্ঞানিক মোড়কে পুরে সুবেশিত উপায়ে ভাববাদের পরিবেশন । আল-আশারী আর আল-গাজ্জালীর ভাবনাগ্রস্ত সমাজে সে সময়ে যে পশ্চাৎমুখী প্রতিক্রিয়াশীল অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল, আজ তা মরিস বুকাইলি আর হারুন ইয়াহিয়ায় এসে ঠেকেছে । বাংলাদেশে বেশ ক’দশক ধরেই চলছে এক মহানির্বুদ্ধিতার খেলা; এখানে ‘জ্ঞানের কথা’, ‘লজ্জা’, ‘নারী’র মত প্রগতিশীল বই অবলীলায় নিষিদ্ধ করা হয় মানুষের ‘ধর্মানুভূতি’তে আঘাত লাগাবার অজুহাতে, আরজ আলী মাতুব্বরের ‘সত্যের সন্ধান’ আর দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘যে গল্পের শেষ নেই’ পড়ার অপরাধে মুক্তিযোদ্ধা ওহাবকে ‘জুতোর মালা’ পরিয়ে সারা গ্রাম ঘোরানো হয়, তসলিমাকে দেশ থেকে নির্বাসিত করা হয়, মুক্ত বুদ্ধির চর্চা করার জন্য আহমদ শরীফ-শামসুর রাহমান-আলী আসগর-কবীর চৌধুরীদের ‘মুরতাদ’ ঘোষণা করা হয়, ড. হুমায়ূন আজাদকে চাপাতির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়; ইনকিলাব, নয়াদিগন্ত গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে ধমক দেয়া হয় ড. অজয় রায়, হাসান আজিজুল হক ও ড. জাফর ইকবালকে তাদের মুক্তবুদ্ধির সেক্যুলার প্রগতিশীল মতবাদ পোষণের জন্য; প্রাণ দিতে হয় মুক্তবুদ্ধির ধারক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ইউনুসকে। আর অন্যদিকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ও অর্থব্যয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে বের করা হয় ‘Scientific Identification in Holy Quran’ এর মত ছদ্ম-বিজ্ঞান গ্রন্থ (pseudo scientific book)। ভক্তি-রসের বান ডেকে অদৃষ্টবাদ আর অলৌকিকত্বের রমরমা বাজার তৈরি করে ফেলেছে বুকাইলী-মুর-দানিকেনদের বইয়ের ব্যাপক প্রচার আর প্রসার । বাংলাদেশের সারা বাজার এখন ‘আল-কোরান এক মহাবিজ্ঞান’, ‘মহাকাশ ও কোরানের চ্যালেঞ্জ’, ‘বিজ্ঞান না কোরান’, ‘বিজ্ঞান ও আল কোরান’ জাতীয় ছদ্ম-বৈজ্ঞানিক বই-এ সয়লাব । মুক্তমনার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অজয় রায় ‘বিজ্ঞানমনস্কতা ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ নির্মাণ’ নামক একটি নিরীক্ষাধর্মী প্রবন্ধে লিখেছিলেন,
“জ্ঞানের একমাত্র উৎস যদি পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলি হয়, তাহলে সেই সমাজে নেমে আসবে বন্ধ্যাত্ব, সমাজ হবে জড় চেতনা-চিন্তায় আচ্ছন্ন, সৃষ্টিশীলতার স্থান দখল করবে কুসংস্কার, মূর্খতা, কূপমণ্ডূকতা আর অজ্ঞানতা । আমাদের সমাজে দেখা যাচ্ছে কুসংস্কার আর প্রযুক্তিবিদ্যার ফসলকে আত্মস্থ করার পারস্পরিক সহাবস্থান । বিজ্ঞানের যুক্তি চাই না, চাই তার ফসল, পাশে থাক অন্ধবিশ্বাস আর ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণ । এই সমাজেই সম্ভব— ড্রয়িং রুমে রঙিন টেলিভিশন সেট স্থাপন, এবং হিস্টিরিয়া-আক্রান্ত কন্যাকে পীরের চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রেরণ । এই সমাজেই সম্ভব- অণুরসায়নবিদদের রসায়ন চর্চার পাশাপাশি তথাকথিত পীরের পদচুম্বন ৷’
সত্য কথা বলার বিপদ অনেক । আজকের বাংলাদেশে তো এটি আরো প্রকটভাবে সত্য । প্রতিক্রিয়াশীলদের ধ্বংসাত্মক সন্ত্রাসী কার্যক্রমে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে । শায়খ আবদুর রহমান আর বাংলা ভাইদের সন্ত্রাসী জামানায় জননিরাপত্তা কত নীচে নেমে এসেছিল আমরা সবাই তা জানি । তারপরও জগৎ জুড়ে চিন্তাশীল ব্যক্তিরা স্বাধীনভাবে তাদের মত ও বক্তব্য প্রকাশ করতে চান; স্বাধীনভাবে মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে দ্বিধান্বিত হন না । তাদের সেই বিবেকের তাগিদই প্রকাশ পেয়েছে প্রাচীন গ্রীক কবি ইউরিপিডিসের (৪৮০-৪০৬ খ্রি. পূ) একটি বাণীতে ‘Honest words should not be hushed up let everyone hear’ । চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই । চিন্তারাজিকে প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধহয় ভাল।
‘চিন্তার দাসত্বে’র ক্ষেত্রে যে কেবল মৌলবাদীদের একচ্ছত্র আধিপত্য তা ভেবে নিলে কিন্তু ভুল হবে । ভ্রান্ত চিন্তা, কূপমণ্ডূকতা আর অন্ধবিশ্বাস কুরে কুরে খাচ্ছে আজকের বাংলাদেশের তথাকথিত প্রগতিশীল নামধারী বুদ্ধিজীবী সমাজকেও । কার্ল মার্ক্স, স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, রামকৃষ্ণ, মাদার টেরেসা, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ বড়বড় নামগুলো ইতোমধ্যেই তৈরি করে ফেলেছে কিছু মিথ; জন্ম দিয়েছে শত সহস্র স্তাবকের । এ সমস্ত মনীষী অনেক ক্ষেত্রেই প্রগতিশীল · চিন্তা করেছেন সত্যি, কিন্তু সেই সাথে আবার তৈরি করেছেন কিছু অন্ধবিশ্বাসীদের যারা মনে করেন রবীন্দ্রনাথ কিংবা স্বামী বিবেকানন্দের বাণী মানেই অভ্রান্ত সত্যি । এই বড় মানুষদের চিন্তা-চেতনাও কর্মকাণ্ডে সীমাবদ্ধতা ছিল— কালের ঊর্ধ্বে অনেক সময় তাঁরা উঠতে পারেননি- একথা মনে রেখে- একজন প্রকৃত যুক্তিবাদীর দায়িত্ব হচ্ছে ব্যক্তি পূজার ঊর্ধ্বে উঠে নির্মোহ দৃষ্টিতে ব্যক্তি, সমাজ ও সভ্যতাকে বিশ্লেষণ করা।
এ সঙ্কলনের নির্বাচিত প্রবন্ধগুলোর মধ্যে কয়েকটি যুক্তিবাদ নিয়ে দার্শনিক বিশ্লেষণমূলক লেখা । প্রসঙ্গক্রমে ঈশ্বরের অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব এবং মন্দের যুক্তিও এসেছে । কয়েকটি প্রবন্ধে যুক্তিবাদী দৃষ্টিতে ধর্ম, নৈতিকতা ও মানবতাকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে । ‘ধর্ম’ যেহেতু ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার তাই ধর্মনিরপেক্ষ দেশে ধর্মীয় পরিচয় ঢাক ঢোল পিটিয়ে জানানো জরুরি নয় । কিন্তু সমস্যা হল, যারা কোন ধর্ম মানেন না তারা চাকরি বা শিক্ষার ক্ষেত্রে কলামটা খালি রাখতে চাইলেও আপত্তি ওঠে, এমনকি অসম্পূর্ণ বিধায় ফর্ম বাতিল করা হয় । ভারতীয় মানবতাবাদী সমিতি কিভাবে চাকরির ফর্মে ধর্মের জায়গায় ‘মানবতা’ লিখবার আইনি অধিকার আদায় করেছে তা লিপিবদ্ধ হয়েছে ‘মানুষের ধর্ম মানবতা’ প্রবন্ধটিতে । নৈতিকতার উৎস এবং ভিত্তি যে কেবল ধর্ম নয়, তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে ‘নৈতিকতা ও ধর্ম’ প্রবন্ধটিতে। প্রগতিশীল বিজ্ঞানী ও দার্শনিকেরা যুগে যুগে কিভাবে ধর্মবাদীদের কোপানলে পুড়ে আগ্রাসন ও লাঞ্ছনার স্বীকার হয়েছেন, তা তুলে ধরতে ব্রুনো এবং হাইপেশিয়ার প্রসঙ্গ এসেছে, এদের জীবন ও অবদান নিয়ে লেখা হয়েছে দুটি প্রবন্ধ । এই লাঞ্ছনা এবং নিপীড়ন যে কেবল অতীতের ব্যাপার ছিল না, বরং এখনও সময় ও সুযোগ পেলে বিরুদ্ধ মতকে অবদমিত করতে প্রতিপক্ষকে ‘মুরতাদ’ আখ্যা দেয়া হচ্ছে, এ প্রসঙ্গ নিয়ে লেখা হয়েছে ‘কে মুরতাদ’ প্রবন্ধটি । ইসলামের সংশয়বাদী দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের নিয়ে রয়েছে একটি প্রবন্ধ— ‘জীবিত ইসলামের মৃত গৌরবের কথা’ । হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক অতিকথন নিয়ে লেখা হয়েছে একটি প্রবন্ধ । শারিয়ার অমানবিকতা নিয়ে লেখা হয়েছে ‘মানবভিত্তিক সংবিধান ও অমানবিক বিধান’। একজন বিবর্তনবাদী বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে ধর্মকে বিশ্লেষণ করে লেখা হয়েছে ‘ধর্মের উপযোগিতা’ প্ৰবন্ধটি । এছাড়া সমকামিতা, ডারুইনিজম, ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন এবং ক্ল্যাসিকাল এথেন্সের নারীদের নিয়ে রয়েছে আলাদা তিনটি প্রবন্ধ । হুমায়ূন আজাদ, আহমদ শরীফ, আরজ আলী মাতুব্বর, কাজী আবদুল ওদুদ এবং রোকেয়ার মতো প্রয়াত মুক্তমনা লেখকদের একটি করে লেখাও আমরা এতে সংকলিত করেছি ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় । একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, প্রবন্ধে উচ্চারিত মতামত নিতান্তই লেখকের নিজস্ব। দরদী মন নিয়ে গ্রন্থটি প্রকাশের জন্য জনাব মেসবাহউদ্দীন আহমেদসহ ‘চারদিক’-এর সবাইকে ধন্যবাদ। আশা করছি প্রবন্ধগুলো পাঠকদের ভালো লাগবে এবং গ্রন্থটি বাংলাদেশে মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও মুক্তচিন্তা প্রসারে সাহায্য করবে । আমাদের ও প্রকাশকের শ্রম সার্থক হবে ।
সম্পাদকমণ্ডলী
৩১শে ডিসেম্বর, ২০০৭
প্রথম অধ্যায়ঃ যুক্তিবাদ মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্কতা
♦ মন্দের যুক্তি ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব
♦ বিজ্ঞান মনস্কতা ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজনির্মাণ
♦ ইন্টিলিজেন্ট ডিজাইন নিয়ে কূটকচাল
♦ ব্রুনোর আত্মত্যাগ ও যুক্তিবাদ
♦ ইহজাগতিকতা ও আরজ আলী মাতুব্বর- একজন যুক্তিবাদী দার্শনিক
♦ বাংলাদেশে চেতনা-মুক্তির লড়াই
♦ ইসলাম যেভাবে নিজের পথ থেকে সরে গেছে
♦ বিজ্ঞান, বিজ্ঞানমনস্কতা বনাম কোরানিক বিজ্ঞান
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ ধর্ম ও নৈতিকতা
♦ জীবিত ইসলামের মৃত গৌরবের কথা
♦ রামায়ণ কাহিনীর ঐতিহাসিকতা একটি একাডেমিক আলোচনা
♦ মানবতাভিত্তিক সংবিধান এবং অমানবিক বিধান
♦ ধর্মের উপযোগিতাঃ জনৈক বিবর্তনবাদীর দৃষ্টিতে
♦ ধর্মরাষ্ট্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম
♦ মানুষের জন্য ধর্ম, না ধর্মের জন্য মানুষ?
♦ বিজ্ঞান কি উপাসনা-ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বী
তৃতীয় অধ্যায়ঃ অন্যান্য প্রসঙ্গ
♦ হাইপেশিয়াঃ এক বিস্মৃতপ্ৰায় গণিতজ্ঞ নারীর বেদনাঘন উপাখ্যান
♦ শাশ্বত এথেন্সের নারী ও তার বিপর্যস্ত ধারাবাহিকতা
“স্বতন্ত্র ভাবনাঃ মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ