থেমে আসে রজনীর গীত-কোলাহল,
ওরে মোর সাথী আঁখি-জল,
এইবার তুই নেমে আয়—
অতন্দ্র এ নয়ন-পাতায় !
আকাশে শিশির ঝরে, বনে ঝরে ফুল,
রূপের পালঙ্ক বেয়ে ঝরে এলোচুল ;
কোন্ গ্রহে কে জড়ায়ে ধরিছে প্রিয়ায়,
উল্কার মানিক ছিঁড়ে ঝরে পড়ে যায়।
আঁখি-জল, তুই নেমে আয়—
বুক ছেড়ে নয়ন-পাতায় ! …
ওরে সুখবাদী !
অশ্রুতে পেলিনে যারে, হাসিতে পাবি কি তার আদি?
আপনারে কতকাল দিবি আর ফাঁকি?
অন্তহীন শূন্যতারে কত আর রাখিবি রে কুয়াশায় ঢাকি’ ?
ভিখারী সাজিলি যদি, কেন তবে দ্বারে
এসে এসে ফিরে যাস্ নিতি অন্ধকারে?
পথ হ’তে আন্-পথ কেঁদে যাস্ ল’য়ে ভিক্ষা-ঝুলি,
প্রসাদ যাচিস্ যার তারেই রহিলি শুধু ভুলি?
সকলে জানিবে তোর ব্যথা,
শুধু সে-ই জানিবে না কাঁটা-ভরা ক্ষত তোর কোথা ?
ওরে ভীরু, ওরে অভিমানী !
যাহারে সকল দিবি, তা’রে তুই দিলি শুধু বাণী?
সুরের সুরায় মেতে কতটুকু কমিল রে মর্মদাহ তোর?
গানের গহীনে ডুবে’ কতদিন লুকাইবি এই আঁখি-লোর?
কেবলি গাঁথিলি মালা, কার তরে কেহ নাহি জানে !
অকূলে ভাসায়ে দিস্, ভেসে যায় মালা শূন্য-পানে।
সে-ই শুধু জানিল না, যার তরে এত মালা-গাঁথা,
জলে-ভরা আঁখি তোর, ঘুমে-ভরা তার আঁখি-পাতা,
কে জানে কাটিবে কি না আজিকার অন্ধ এ নিশীথ,
হয় ত হবে না গাওয়া কা’ল তোর আধ-গাওয়া গীত,
হয় ত হবে না বলা, বাণীর বুদ্বুদে যাহা ফোটে নিশিদিন !
সময় ফুরায়ে যায়—ঘনায়ে আসিল সন্ধ্যা কুহেলি-মলিন !
সময় ফুরায়ে যায়, চল্ এবে, বল্ আঁখি তুলি-
ওগো প্রিয়, আমি যাই, এই লহ মোর ভিক্ষা-ঝুলি !
ফিরেছি সকল দ্বারে, শুধু তব ঠাঁই
ভিক্ষা-পাত্র লয়ে’ করে কভু আসি নাই ।
ভরেছে ভিক্ষার ঝুলি মানিকে মণিতে,
ভরে নাই চিত্ত মোর ! তাই শূন্য-চিতে
এসেছি বিবাগী আজি, ওগো রাজ-রানী,
চাহিতে আসি নি কিছু ! সঙ্কোচে অঞ্চল মুখে দিও না ক’ টানি’।
জানাতে এসেছি শুধু—অন্তর-আসনে
সব ঠাঁই ছেড়ে দিয়ে—যাহারে গোপনে
চ’লে গেছি বন-পথে একদা একাকী,
বুক-ভরা কথা লয়ে—জল-ভরা আঁখি।
চাহি নি ক’ হাত পেতে তারে কোনোদিন,
বিলায়ে দিয়েছি তারে সব, ফিরে পেতে দিই নি ক’ ঋণ !
ওগো উদাসিনী,
তব সাথে নাহি চলে হাটে বিকি-কিনি।
কারো প্রেম ঘরে টানে, কেহ অবহেলে
ভিখারী করিয়া দেয় বহু দূরে ঠেলে !
জানিতে আসি নি আমি, নিমেষের ভুলে
কখনো বসেছ কি না সেই নদী-কূলে,
যার ভাটি-টানে—
ভেসে যায় তরী মোর দূর শূন্য-পানে।
চাহি না ত কোনো কিছু, তবু কেন রয়ে রয়ে ব্যথা করে বুক,
সুখ ফিরি ক’রে ফিরি, তবু নাহি সহা যায়
আজি আর এ-দুখের সুখ । …
আপনারে ছলিয়াছি, তোমারে ছলিনি কোনোদিন,
আমি যাই, তোমার আমার ব্যথা দিয়ে গেনু ঋণ ৷
“চক্রবাক” কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ