কোন মানুষই তার মৃত্যুর তারিখ জানে না। কিন্তু তীর্থ যাত্রীরা তাদের মৃত্যুর একটা তারিখ ধার্য করে থাকেন। তাঁরা তাঁদের সংসারের জরুরী কাজ কর্ম সমাধা ও দেনবা-পাওনা পরিশোধ করে মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হয়ে তীর্থযাত্রা করেন। আবার সে ফিরে আসুক, বাঁচুক সে আরো দশ বছর, কোন ক্ষতি নাই।
প্রকৃতি রাজে “অনিবার্য সত্য” হচ্ছে এক মাত্র “মৃত্যু” কিন্তু এই একান্ত সত্যটিকে হাতে নিয়েও মানুষ তার পরমায়ুকে অনুভব করে “অসীম” বলে। কেননা সে তার পরমায়ুর সীমা দেখতে পায় না। কাল্পনিক হলেও যদি (তীর্থ যাত্রার মত) পরমায়ুর একটা সীমারেখা টানা যায়, তবে সেটা সংসারীর পক্ষে হয় মঙ্গল জনক যেহেতু এতে সংসারী বাসিরা একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাদের শুভ কাজ গুলো সম্পন্ন করবার ও অশুভ কাজ হতে বিরত থাকবার গরজ অনুভব করতে লাগলাম এবং একটা উপায়ও বের করলাম।
আমার পূর্ব পুরুষদের পাঁচ পুরুষের মধ্যে দশ ব্যক্তির জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ ধরে তাঁদের পরমায়ুর একটা গড় বের করলাম। উহাদের মধ্যে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ বয়ঃসীমা ছিল ৩২-৮০ বছর। কিন্তু সবাইর বয়সের গড় পাওয়া গেল মাত্র ৬০ বছর। তাই আমিও আমার পরমায়ুর পরিমাণ মনে করে নিলাম ঐ রূপই এবং সে হিসাবে আগামী ১৩৬৭ সালে আমার মহাতীর্থ-যাত্রার কথা।
সাধারণতঃ- শৈশবে মানুষের মন থাকে আত্মকেন্দ্রিক, কিন্তু উহা প্রৌঢ়ে হয়ে দাঁড়ায় বৎস কেন্দ্রিক। তখন মানুষ তার নিজের চেয়ে সন্তান-সন্ততীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যেই চিন্তা ও চেষ্টা করে বেশি এবং উহা আমিও করে থাকি।
পরমায়ুর হিসাবটি পাবার পর হতে আমি আমার সংসার পরিচালনার যাবতীয় কাজ কর্ম করে আসছি উক্ত হিসাব ধরেই। জরুরী কাজ গুলোর মধ্যে এখনও বাঁকি রয়েছে- ছেলেদের মধ্যে আমার সম্পত্তি বন্টন করে দেওয়া। উহা জরুরী এই জন্য যে, দেখা যাচ্ছে অনেক বিত্তবান প্রতিভাশালী ব্যক্তি আজীবন অন্য লোকের বিবাদ মিটিয়ে কালাতিপাত করেছেন অথচ তাঁদের অবর্তমানে- তাঁদের ত্যাজ্য সম্পত্তি বন্টনের ব্যাপারে তদীয় সন্তানরা- ঝগড়া- কলহও মামলাদি সৃষ্টি করে সম্পত্তি নষ্ট এবং নানা রূপ দুঃখ দুর্দশা ভোগ করছে। ঐ রূপ অনাচার হতে সন্তানদের রক্ষাকল্পে আমি আমার স্থাবরাস্থাবর যাবতীয় সম্পত্তি ১৩৬৭ সালের পূর্বে নিজ হস্তে সন্তানদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত করলাম। পর পর্যায়ে সাব্যস্ত করলাম আমি অবর্তমানে আমার ওয়ারিশগণ ফরায়েজ মতে যে হারে অংশ প্রাপ্ত হবে, সেই অংশ মোতাবেক আমি আমার সম্পত্তি বন্টন করে দেব। তবে আমার দুই স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান বলে ওঁদের পক্ষ হবে দুটি।
এ সময় আমার ওয়ারিশদের ফরায়েজ মতে অংশ নিম্নরূপঃ
ওয়ারিশদের ফরায়েজ
প্রথম পক্ষ | সম্পত্তির অংশ |
---|---|
স্ত্রী লালমননেছা | এক আনা |
পুত্র আঃ মালেক (নয়া) | দুই আনা ষোল গণ্ডা |
কন্যা ফয়জুন্নেছা | এক আনা আট গণ্ডা |
মোট = | পাঁচ আনা চার গণ্ডা |
ওয়ারিশদের ফরায়েজ
দ্বিতীয় পক্ষ | সম্পত্তির অংশ |
---|---|
স্ত্রী সুফিয়া খাতুন | এক আনা |
পুত্র আঃ খালেক (মানিক) | দুই আনা ষোল গণ্ডা |
পুত্র আঃ বারেক (কাঞ্চন) | দুই আনা ষোল গণ্ডা |
কন্যা মনোয়ারা বেগম (কুসুম) | এক আনা আট গণ্ডা |
কন্যা নুরজাহার বেগম (বকুল) | এক আনা আট গণ্ডা |
কন্যা বিয়াম্মা বেগম (মুকুল) | এক আনা আট গণ্ডা |
মোট = | দশ আনা ষোল গণ্ডা |
(১) ১৩৬৬ সালের ১১ই ভাদ্র। বেলা ২টায় স্থানীয় আমিন আলী সিকদার ও আমার ওয়ারিশগণকে নিয়ে এক বৈঠকে মিলিত হলাম (আমার বসতঘরে)।
পক্ষদ্বয়ের প্রাপ্য অংশ যথাক্রমে পাঁচ আনা চার গণ্ডা ও দশ আনা ষোল গণ্ডা। ইহা সমান ১/৩ ও ২/৩ হতে সামান্য কম বা বেশী। কিন্তু যাবতীয় অস্থাবর সম্পত্তি যথা- ধান, চাল, তিল, মরিচ, পাট, তামাক ইত্যাদি ফসল, পাতিল, হাড়ি, মাইট, মটকী, রেকাবী, গ্লাস ইত্যাদি পাত্র এবং গৃহ সরঞ্জামাদি; প্রথম পক্ষকে ১/৩ ও দ্বিতীয় পক্ষকে ২/৩ অংশ দেওয়া হ’ল।
বর্ষাকাল হেতু সম্পত্তি বন্টন করা হ’ল না। তবে স্থির হ’ল যে, বর্তমান ফসল তুলে উহা পক্ষদ্বয়ের অংশানুযায়ী ভাগ করে দিয়ে পরের সুখনা মৌসুমে জমি বন্টন করে দেওয়া হবে। তবে সিদ্ধান্ত করা হল যে, ভূসম্পত্তি বন্টন করা হবে নির্ধারিত অংশ মতেই। তবে প্রতি খন্ড জমি ঐ রূপ অংশ মতে বন্টন করার ঝামেলা এড়াবার জন্যে ২৭৬ নং খঃ ১৫৫৯ নং দাগ বাদে সমস্ত জমি ১/৩ ও ২/৩ অংশ হিসাবে বন্টন করা হবে এবং এতে- প্রথম ও দ্বিতীয় পক্ষের মধ্যে তাদের প্রাপ্য অংশ থেকে সেই পরিমাণ জমি বেশি ও কম হবে, ১৫৫৯ নং দাগের জমির অংশ পরিবর্তন করে তা সমান করা হবে।
উপরোক্ত সিদ্ধান্ত মতে যাবতীয় ভূসম্পত্তির এক প্রস্থ বাটারার নক্সা, ফিল্ডবুক ও চিঠা তৈরি করে দেওয়া হল। পক্ষদ্বয় এই নক্সা ও ফিল্ড বুক দৃষ্টে জমি বন্টন ও চিঠা দৃষ্টে ভোগ দখল করিবে বলে সাব্যস্ত হ’ল। বন্টন কাজ ও আলোচনা শেষে- স্থাবরাস্থাবর আমার যাবতীয় সম্পত্তির পূর্ণ তালিকা সহ ১৪ দফে শর্ত যুক্ত এক খানা “স্মারকলিপি” লিখে দিলাম। লিপি খানা ৪০ পৃষ্ঠায় সমাপ্ত (উহা আমার “গ্রন্থমালা” এ রক্ষিত আছে)। বিশেষতঃ প্রত্যেক পুত্রকে উক্ত স্মারকলিপির একখানা করে অনুলিপি যত্নের সহিত রাখতে বলা হল। ঐ স্মারকলিপি খানার কিছুটা অংশ এখানে লেখলাম।
“বরাবরতে -১ম পক্ষ আঃ মালেক (নয়া)
-২য় পক্ষ (ক) আঃ খালেক (মানিক)
(খ) আঃ বারেক (কাঞ্চন)
আমি তোমাদের বৃদ্ধ পিতা। বর্তমানে আমি স্বাস্থ্যহীন এবং সাংসারিক কার্য পরিচালনে অক্ষম। হয়ত মৃত্যুও বেশি দূরে নয়। তাই তোমাদের কল্যাণ কামনায় আমার স্থাবরাস্থাবর যাবতীয় সম্পত্তি তোমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বিভক্ত করিয়া তাহার পরিচালনের ভার তোমাদের উপর ভিন্ন ভিন্ন ভাবে অর্পণ করিলাম। তোমরা আমার নিম্ন লিখিত আদেশ ও উপদেশ মতে নিজ নিজ স্টেট পরিচালনা করিবা। ইতি ১৩৬৬ সাল তাং ১১ই ভাদ্র।
ভিখারীর আত্মকাহিনী- প্রথম খন্ড
♦ চর পূর্বাভাস ও জন্ম (১১৫৮-১৩০৭)
♦ উচ্চ শিক্ষার প্রচেষ্টা (১৩৩৫)
ভিখারীর আত্মকাহিনী- দ্বিতীয় খন্ড
♦ মোসলেম সমিতিঃ স্কুল প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষকতা (১৩৩৬-১৩৪১)
♦ ইঞ্জিনিয়ারিং শিখার উদ্যোগ ও মাতৃবিয়োগ (১৩৩৯)
♦ ভিখারীর আত্মকাহিনী- তৃতীয় খন্ড
♦ বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরীর শিক্ষা
♦ অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদিরের সান্নিধ্যে
♦ ভিখারীর আত্মকাহিনী- পঞ্চম খন্ড
“আরজ আলী মাতুব্বর” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ