আমরা বাস করি অনন্ত, নিয়ত বেড়ে চলা, মহাবিশ্বের একটি খুব ছোটো এলাকায়, পৃথিবীতে; আর পৃথিবী বাস করে সৌরজগতে। সূর্য : সৌরজগতের কেন্দ্র, তার নাম অনুসারেই নাম হয়েছে মহাবিশ্বের এ-এলাকাটির। সূর্যকে ঘিরে ঘুরছে নটি গ্রহ- বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপটুন, প্লুটো,; গ্রহগুলোকে ঘিরে ঘুরছে নানা উপগ্রহ; ঘুরছে গ্রহাণুরা; এক বিশাল এলাকা সৌরজগত । পুরোনো কালের মানুষের, তাদের পুরাণ আর ধর্মগ্রন্থের, তাদের দেবতা ও ঈশ্বরদের, কোনো ধারণা ছিলো না সৌরজগত সম্পর্কে; তারা ভাবতো একটি ছোটো বিশ্ব সম্পর্কে, বাস করতো একটি ছোটো বিশ্বে, আর ওই ছোটো বিশ্বই উন্মত্ত ক’রে তুলতো তাদের কল্পনাকে। সৌরজগত ধারণাটি আধুনিক কালের, কোপারনিকাসের সৃষ্টি। সৌরজগত পুরোনো কালের মানুষের কল্পিত বদ্ধ গোলকঘেরা বিশ্বের থেকে অনেক বড়ো। মহাবিশ্ব কীভাবে উদ্ভূত হয়েছে, সেটা এখন জানা হয়ে গেছে; ১০ থেকে ২০ বিলিয়ন, ১০০০ কোটি থেকে ২০০০ কোটি বছর আগে মহাগর্জনের ফলে উদ্ভূত হয়েছে মহাবিশ্ব। কিন্তু সৌরজগতের উদ্ভব ঘটেছে কীভাবে? তার উদ্ভব সম্পর্কে বহু তত্ত্ব পেশ করা হয়েছে গত দু-শো বছরে। হানেস আক্ষভেন, যিনি সৌরজগতের উদ্ভব নিয়ে দীর্ঘকাল কাজ করেছেন, পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার, বলেছেন, ‘সৌরজগতের উদ্ভব উদ্ঘাটন প্রত্নতত্ত্ব, পদার্থবিজ্ঞান নয় ।’ প্রত্নতাত্ত্বিকের মতো সৌরজগতকে খুঁড়ে খুঁড়ে অতীত নিদর্শন আবিষ্কার ক’রে ক’রে আমাদের বের করতে হবে সৌরজগতের উদ্ভবের প্রক্রিয়া; শুধু পদার্থবিজ্ঞান দিয়ে হবে না, দরকার হবে রসায়নবিজ্ঞান, ও ভূবিজ্ঞান । সূর্য যেহেতু সৌরজগতের কেন্দ্র, তাই সূর্যের উদ্ভবের সাথে জড়িয়ে আছে সৌরজগতের উদ্ভবরহস্য; তাই ভালোভাবে খুঁড়ে দেখতে হবে অধীশ্বর সূর্যকে।
রাসায়নিকভাবে সৌরজগতে পাওয়া যায় তিন রকম পদার্থঃ সৌরপদার্থ, ভূপদার্থ, ও বরফজাতীয় পদার্থ। এ-তিন ধরনের পদার্থে, তাদের বিভিন্ন বিন্যাসে, গঠিত সৌরজগতের সব কিছু। আর সৌরজগতে যে-সব গ্রহ-উপগ্রহ ঘুরে চলছে, তাদের আচরণে রয়েছে বিশেষ শৃঙ্খলা; এটা কোনো কল্পিত বিধাতার কাজ নয়, সূর্যের জন্ম থেকেই বিকশিত হয়েছে এটা। যেমনঃ সূর্য ও সবগুলো গ্রহ ঘোরে পশ্চিম থেকে পুবে বা পুরোনো ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে; সবগুলো গ্রহের কক্ষপথ অবস্থিত অনেকটা একই তলে, সূর্যের ঘূর্ণন-বিষুবাঞ্চলও এ-তলের কাছাকাছি; বুধ ও শুক্র ছাড়া সব গ্রহের কক্ষপথ প্রায়-বৃত্তাকার; শুক্র ও ইউরেনাস ছাড়া সব গ্রহ, এবং সূর্য, নিজের অক্ষের ওপর ঘোরে পশ্চিম থেকে পুব দিকে- ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে, তাদের কক্ষপথে পরিক্রমার মতোই; সূর্য থেকে প্রতিটি গ্রহ তার আগের গ্রহের মোটামুটিভাবে দ্বিগুণ দূরে অবস্থিত; অধিকাংশ উপগ্রহ তাদের মাতৃগ্রহের মতোই কক্ষপথে পশ্চিম থেকে পুবে ঘোরে আর অবস্থান করে মাতৃগ্রহের বিষুবাঞ্চলীয় তলের কাছাকাছি; সূর্যের কৌণিক ভরবেগের (জাড্যের জন্যে বিভিন্ন বস্তুর আবর্তন ও প্রদক্ষিণের প্রবণতা, অর্থাৎ যা আগে থেকে ঘুরছিলো পরেও ঘুরতেই থাকবে) থেকে গ্রহগুলোর ভরবেগ অনেক বেশি— সৌরজগতের ভরের ৯৯.৮৬ ভাগ ভরই ধারণ করে সূর্য, তবে তার কৌণিক ভরবেগ মাত্র শতকরা ০.৫ ভাগ; গ্রহ-উপগ্রহপদ্ধতি অনেকটা ক্ষুদ্র সৌরজগতের মতো । এমন আরো বেশ কিছু শৃঙ্খলা দেখা যায় সৌরজগত ভ’রে।
কীভাবে উৎপত্তি হয়েছে সৌরজগতের, তা সফলভাবে বর্ণনা করতে হ’লে এসব ও আরো অনেক ব্যাপার ব্যাখ্যা করতে হবে কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে । সে-তত্ত্বই গ্রহণযোগ্য হবে, যা সুশৃঙ্খলভাবে বর্ণনা করতে পারে সৌরজগতের সমস্ত শৃঙ্খলা ৷ সৌরজগতের উৎপত্তি সম্পর্কে যতো তত্ত্ব প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো দু-প্রকৃতির : এক ধরনের তত্ত্ব নীহারিকাবাদী (নীহারিকাকে লাতিনে বলা হয় নেবুলা, যার অর্থ ‘কুয়াশা’) বা বিবর্তনবাদী- এতে আন্তনাক্ষত্রিক গ্যাস ও ধুলোর মেঘমণ্ডল ঘন হয়ে তৈরি করে একটি সৌর নীহারিকা, যার নাম সূর্য, আর এ থেকে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সংহত রূপ লাভ করে গ্রহগুলো; অন্য ধরনের তত্ত্ব বিপর্যয়বাদী- এতে সূর্য পড়ে এক মহাবিপর্যয়ে বা প্রলয়ে, যার ফলে হঠাৎ উৎপন্ন হয় গ্রহগুলো । এ-দু-ধরনের তত্ত্বের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে দু-শতক ধ’রে, কোনোটিই পুরোপুরি জয়ী হয়ে উঠতে পারে নি এতোদিন; তবে এখন নীহারিকাবাদী বিবর্তনবাদীতত্ত্বই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। নীহারিকাবাদী বা বিবর্তনবাদী তত্ত্বে সূর্যের উদ্ভবের এক স্বাভাবিক পরিণতি হচ্ছে সৌরজগতের উদ্ভব। এ-তত্ত্বের মতে কোনো সূর্য, অর্থাৎ তারা, উদ্ভূত হ’লে স্বাভাবিকভাবেই তার সাথে উদ্ভূত হয় গ্রহ ও উপগ্রহ; তাই আমাদের ছায়াপথে ও অন্যান্য নক্ষত্রপুঞ্জে থাকবে আরো অনেক সৌরজগত- একটি তারা বা সূর্য, তাকে ঘিরে গ্রহ। বিপর্যয়বাদী তত্ত্বে বিপর্যয় এক দুর্লভ ঘটনা; তাই অন্য কোথাও সৌরজগত থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
প্রথম বিবর্তনবাদীতত্ত্ব পেশ করেছিলেন ফরাশি দার্শনিক রেনে দেকার্ত, ১৬৪৪ অব্দে । ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪-১৮০৪) প্রথম পেশ করেন নীহারিকাবাদীতত্ত্ব; তাঁর মতে ধুলোপূর্ণ একটি গোলাকার নীহারিকা থেকে গঠিত হয় সৌরজগত । ফরাশি গণিতবিদ মার্কুইস দ্য লাপ্লাস (১৭৪৯-১৮২৭) তাঁর বিশ্বের সংশয়-এ বর্ণনা করেন সৌরজগতের উৎপত্তির ইতিহাস। তাঁর মতে গ্যাস ও ধুলোর মেঘ ঘন হয়ে উদ্ভূত হয়েছিলো সূর্য, এবং তাঁকে ঘিরে ছিলো পদার্থের অজস্র বলয়। এসব বলয়ের পদার্থের কণার পারস্পরিক সংঘর্ষ ও আভিকর্ষিক আকর্ষণে বস্তু জড়ো হয়ে গঠিত হয় গ্রহ। তারপর এসব গ্রহ কিছু পদার্থ বর্জন করে, যার থেকে গঠিত হয় উপগ্রহ। কান্ট যেমন শনির বলয়ের উদাহরণ দিয়েছিলেন, লাপ্লাসও শনির উদাহরণ দেন । আজকাল এটাই মনে করা হয় যে ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে নীহারিকা থেকে প্রথম গঠিত হয় প্রত্নসূর্য ও তারপর গ্রহগুলো। চ্যাপ্টা এক নীহারিকার মাঝখানে গঠিত হয় সূর্য; এ-নীহারিকা থেকেই জন্মে গ্রহগুলো। গ্রহগুলো গ’ড়ে ওঠে আভিকর্ষিক পতন বা ভাঙাচোরা, উপচয়, ও ঘনীভূতি- এ-তিন প্রধান পদ্ধতিতে। নীহারিকার যে-অঞ্চলে বেশি ভর ছিলো, সেখানে আভিকর্ষিক পতন বা ভাঙাচোরা ও আকর্ষণের ফলে গঠিত হয় গ্রহ; যেখানে ক্ষুদ্র কণা পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে আসে ও লেগে থাকে পরস্পরের গায়ে, সেখানে উপচয়ের ফলে অর্থাৎ বস্তু জ’মে জ’মে বেড়ে গড়ে ওঠে গ্রহ; আর অণু-পরমাণু ঘনীভূত হয়ে তৈরি হয় পদার্থের কণা, এবং এদের ঘনীভূতির ফলে সৃষ্টি হয় গ্রহ।
কান্ট-লাপ্লাসের নীহারিকাবাদীতত্ত্বের বড়ো দুর্বলতা হচ্ছে এ-তত্ত্ব সৌরজগতের বর্তমান কৌণিক ভরবেগের বণ্টন ব্যাখ্যা করতে পারে নি। মনে করতে পারি যে-নীহারিকা থেকে গঠিত হয়েছিলো সূর্য ও গ্রহগুলো, সেটি ধীরেধীরে ঘুরছিলো, পাক খাচ্ছিলো। নীহারিকাটি যখন ভেঙেচুড়ে পড়ে, তার আভিকর্ষিক পতন ঘটে, তখন নিশ্চয়ই বেড়ে গিয়েছিলো তার ঘূর্ণন । সূর্যটি গঠিত হয়েছিলো নীহারিকার মধ্যের অংশ থেকে, তাই সূর্যের খুব দ্রুত পাক খাওয়ার কথা, কয়েক ঘণ্টায় অন্তত একবার। কিন্তু সূর্য এর থেকে ৪০০গুণ ধীরে পাক খায় । যদি সৌরজগতের গ্রহগুলোর কৌণিক ভরবেগ সূর্যের ভরবেগের সাথে যোগ করা হয়, তাহলে সূর্য কয়েক ঘণ্টায় একবার পাক খেতে থাকবে। কৌণিক ভরবেগ সৌরজগতে আছে, কিন্তু যেখানে থাকার কথা, সূর্যে, সেখানে নেই । কান্ট-লাপ্লাসের নীহারিকাবাদীতত্ত্ব তখনই গ্রহণযোগ্য হ’তে পারে, যদি এটা ব্যাখ্যা করতে পারে কৌণিক ভরবেগ বণ্টনের ব্যাপারটি । এটা আগে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় নি, কিন্তু সম্ভব হয়েছে বিশশতকে- কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষণ নীতির সাহায্যে।
বিপর্যয়বাদীতত্ত্ব প্রথম পেশ করেছিলেন ফরাশি বিজ্ঞানী জর্জেস বুফোঁ, ১৭৪৫ অব্দে। বিশশতকের শুরুতে টমাস সি চেম্বারলেইন (১৮৪৩-১৯২৮) ও ফরেস্ট আর মৌল্টন (১৮৭২-১৯৫২) প্রস্তাব করেন একধরনের বিপর্যয়তত্ত্ব, যাতে কৌণিক ভরবেগ বণ্টনের সমস্যাটি নেই। বুফোঁর তত্ত্বের মতো তাঁদের তত্ত্বেও একটি তারা যাচ্ছিলো সূর্যের পাশ দিয়ে, যাওয়ার সময় তারাটি আকস্মিকভাবে তীব্র আঘাত করে সূর্যকে; সৌরজলবায়ুতে ওঠে প্রচণ্ড ঢেউ। ওই সংঘর্ষের ফলে সূর্য ও তারাটি থেকে ছলকে পড়া বস্তুরাশি ঘনীভূত হয়ে গঠিত হয় অণু-গ্রহঃ প্ল্যানেটেসিমাল । এই অণু-গ্রহগুলো ক্রমশ উপচয়ের ফলে বেড়ে বেড়ে তৈরি হয় গ্রহগুলো। গ্রহগুলো যেহেতু তাদের কৌণিক ভরবেগ পেয়েছিলো বিপথগামী তারাটি থেকে, তাই গ্রহগুলোর কৌণিক ভরবেগ বেশি সূর্যের কৌণিক ভরবেগের থেকে।
তবে বিপর্যয়বাদীতত্ত্বগুলো পড়ে চারটি মূল সমস্যায়। প্রথমত, মহাবিশ্বে সূর্য ও কোনো তারার সংঘর্ষের সম্ভাবনা একেবারেই নেই। তারাগুলোর পারস্পরিক দূরত্ব এতো বেশি যে সুদূর অতীতেও যে কোনো সংঘর্ষ ঘটেছিলো, তা মনে করার কোনো কারণ নেই । সূর্য ও কোনো তারার মধ্যে একবার ধাক্কা লাগতে পারে বছরে; অর্থাৎ ১০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০,০০০ বছরে; কিন্তু মহাবিশ্বের বয়সও এতো নয়, মহাবিশ্বের বয়স মোটামুটি ১০১০ বছর; অর্থাৎ ১০,০০০,০০০,০০০ বছর, বা তারচেয়ে কয়েক শো কোটি বছর বেশি। বিপর্যয়তত্ত্বানুসারে সৌরজগত একটিই আছে মহাবিশ্বে, কেননা এটা জন্মেছে এক অস্বাভাবিক আকস্মিক ঘটনার ফলে । দ্বিতীয়ত, সংঘর্ষের ফলে সূর্য ও তারা থেকে যে-গরম পদার্থ ছলকে পড়েছিলো, তা নিশ্চয়ই ছড়িয়ে পড়েছিলো খুব দ্রুত; তাই এতো অল্প সময়ে এতো গরম পদার্থ জমতে পারে না, গ্রহও গ’ড়ে উঠতে পারে না । তৃতীয়ত, সূর্য ও তারা থেকে যে-পরিমাণ পদার্থ ছলকে পড়েছিলো, তা গ্রহগুলো গড়ার জন্যে যথেষ্ট নয়। কেননা ছলকে পড়া পদার্থের ৯৯ ভাগই আবার সূর্যে ফিরে যাওয়ার কথা। চতুর্থত, গ্রহগুলোর উপাদান খুবই ভিন্ন সূর্যের থেকে। তাই মনে করতে পারি যে কোনো মহাবিপর্যয়ের ফলে সৃষ্টি হয় নি সৌরজগত।
বিপর্যয়বাদীতত্ত্ব কোনো ব্যাপার ব্যাখ্যা করে আকস্মিক খামখেয়ালি বিরল ঘটনা হিশেবে; আর নীহারিকাবাদী বা বিবর্তনবাদীতত্ত্বে কোনো কিছু উদ্ভূত হয় আগের কোনো স্বাভাবিক অবস্থা থেকে ধীরেধীরে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে, হঠাৎ কিছুই ঘটে না। তবে বিপর্যয়তত্ত্ব যে কখনোই কাজ করে না, অর্থাৎ বিপর্যয় থেকে যে নতুন কিছু একেবারেই সৃষ্টি হয় না, তা নয়; মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিলো আকস্মিক বিপর্যয়ে- মহাগর্জনে । ৬.৫ কোটি বছর আগে পৃথিবীতেও ঘটেছিলো একটি বিপর্যয়কর ঘটনা, যার ফলে বদলে গিয়েছিলো পৃথিবীর জলবায়ু; লুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো পৃথিবীর অনেক প্রজাতি, এবং উদ্ভূত হয়েছিলো নতুন প্রজাতি। তবে সৌরজগতের উদ্ভব কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনা থেকে ঘটে নি; সৌরজগতের প্রত্নতাত্ত্বিক পরিচয় নিলে বোঝা যায় সৌরজগতের বিকাশ ঘটেছে নীহারিকা থেকে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে।
সূর্য যখন উদ্ভূত হয় নি, তখন নিশ্চয়ই এর পদার্থরাশি আন্তনাক্ষত্রিক মেঘরূপে ছড়িয়ে ছিলো আন্তনাক্ষত্রিক মহাশূন্যে; তারপর ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে ওই মেঘমণ্ডল ঘন হয়ে অভিকর্ষের ফলে গ’ড়ে উঠতে শুরু করেছিলো সূর্য । ওই মেঘ সংকুচিত হয়ে গঠিত হয়েছিলো প্রত্নসূর্য: প্রটোসান। ওই মেঘমণ্ডল যখন সংকুচিত হচ্ছিলো, ঘন হচ্ছিলো কেন্দ্রের দিকে, তখন তা পাক খেতে শুরু করেছিলো তীব্র বেগে; তার ফলে ওই মেঘের কেন্দ্রে উদ্ভূত হয় সূর্য। তার চারদিক ছিলো চ্যাপ্টা থালার মতো; এই গ্যাসের থালার মধ্যেই উদ্ভূত হয় গ্রহগুলো । এজন্যেই সবগুলো গ্রহের কক্ষপথ একই তলে । সূর্যও ছিলো এগুলোর অংশ, তাই সূর্যও ঘোরে একই সমতলে । প্রথম দিকে মেঘমণ্ডল ছিলো খুবই বড়ো, তাই তার পরমাণুগুলো মেঘের কেন্দ্রের দিকে পড়তো অবাধে; কিন্তু অবাধে পড়া এক সময় রোধ হয়ে আসে। যদি পরামাণুগুলো অবাধে পড়তেই থাকতো, তাহলে কয়েক হাজার বছরেই জন্য নিতে পারতো সূর্য; কিন্তু এক সময় পরমাণুগুলো পরস্পরের সাথে সংঘর্ষে আসে এবং সৃষ্টি করে বহির্মুখি চাপ। এজন্যে কেন্দ্রের দিকে সংকোচন শ্লথ হয়ে আসে । ১৮৭১ অব্দে হেরমান ফন হেলমুহোল্টজ দেখান যে কোনো কিছু সংকোচনের ফলে কেন্দ্রের দিকে কম্পন সৃষ্টি হয়. অণুর এ-কম্পনই হচ্ছে তাপ। এ-সূত্রানুসারে প্রত্নসূর্য তপ্ত হয়ে তাপ ছড়াতে থাকে; মেঘমণ্ডলের কেন্দ্রে তাপমাত্রা ওঠে ১০ মিলিয়ন কেলভিনেরও বেশি, শুরু হয় পারমাণবিক বিক্রিয়া, তার ফলে প্রত্নসূর্য হয়ে ওঠে একটি তারা । এ-সময়ে সৌরজগত জুড়ে সৃষ্টি হয় থালার মতো বিশাল এক মেঘমণ্ডল, যা থেকে বিকশিত হয় গ্রহগুলো। আধুনিক কালে তারার জন্মের প্রক্রিয়া পরীক্ষা ক’রে এসব ব্যাপার সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
থালার মতো যে-নীহারিকাটি ঘিরে ছিলো প্রত্নসূর্যকে, তাকে বলা হয় সৌর নীহারিকা। এ-সময়ে নিশ্চয়ই বৃত্তাকারে পাক খাচ্ছিলো গ্যাস ও ধুলোরাশি, এজন্যে এ-গ্যাস ও ধুলোরাশি থেকে উদ্ভূত গ্রহগুলোর কক্ষপথ বৃত্তাকার, আর সূর্য ও গ্রহগুলো ঘোরে একই দিকে- পশ্চিম থেকে পুব দিকে। সৌর নীহারিকার গ্যাস শুরুর দিকে উত্তপ্ত ছিলো ২০০০ কেলভিন; এতো উত্তাপে তখন সব কিছুই ছিলো গ্যাসরূপে। এর অধিকাংশই ছিলো হাইড্রোজেনের অণু, কিছুটা ছিলো সিলিকন, লোহা ও নানা ধরনের অণু, যা দিয়ে গঠিত হ’তে পারে গ্রহ। গ্যাস থেকে কীভাবে গঠিত হয় কঠিন পদার্থ? গ্যাস জ’মে কঠিন পদার্থ হওয়া বেশ স্বাভাবিক ঘটনা, পৃথিবীতে সব সময়ই হয়। নীহারিকার তাপ কমতে থাকে ক্রমশ, এবং গ’ড়ে উঠতে থাকে অ্যালুমিনিয়াম, টিটানিয়াম, লোহা, সিলিকেট ও বিভিন্ন পদার্থ।
অণুকণা থেকে ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে গ’ড়ে উঠেছিলো অণু-গ্রহরাশি আয়তনে যেগুলো ছিলো ১০০০ কিলোমিটারের মতো; এগুলোর উপচয়ের ফলে, পরস্পরের সাথে সংঘর্ষ ও ঘর্ষণের ফলে কোটি কোটি বছরে গ’ড়ে ওঠে গ্রহগুলো । অণু-গ্রহের প্রমাণ পাওয়া গেছে বহু। বিভিন্ন গ্রহে ও উপগ্রহে বহু গর্ত পাওয়া গেছে, যা সৃষ্টি হয়েছিলো অণু-গ্রহের আঘাতে। সূর্যের কাছাকাছি বা অন্তর্ভাগের গ্রহগুলো গ’ড়ে উঠেছিলো অণু-গ্রহগুলোর ধীরসংঘর্ষের ফলে; এটা চলতে থাকে যতো দিন না গঠিত হয় বুধ থেকে পৃথিবীর আকারের গ্রহগুলো। অন্তর্ভাগের অধিকাংশ অণু-গ্রহই গঠিত হয়েছিলো সিলিকেট ধরনের পদার্থে, যার প্রমাণ পাওয়া গেছে পৃথিবী ও চাঁদে। বিশাল আকারের গ্রহগুলোও গ’ড়ে ওঠে অণু-গ্রহের উপচয়ের ফলেই। তবে বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপটুনের ভর যখন বর্তমান পৃথিবীর ভরের ১৫ গুণ হয়ে ওঠে, তখন ঘটে এক চমৎকার ঘটনা । যখন তাদের ভর হয় পৃথিবীর ১৫ গুণ, তারা তাদের তীব্র অভিকর্ষের সাহায্যে চারপাশের সৌর নীহারিকা থেকে গ্যাস টেনে আনতে থাকে নিজেদের দিকে, তাই তাদের ঘিরে আছে গ্যাসের বায়ুমণ্ডল। সৌরজগতে আছে গ্রহাণু, ধূমকেতু প্রভৃতি; এগুলোও সহজেই ব্যাখ্যা করা যায় বিবর্তনতত্ত্বের সাহায্যে। গ্রহাণুগুলো হচ্ছে অণু-গ্রহ, যারা গ্রহ হয়ে উঠতে পারে নি; আর ধূমকেতুগুলো হচ্ছে নোংরা বরফে তৈরি গ্রহাণুর মতো অণু-গ্রহ। এগুলোর অধিকাংশই লুপ্ত হয়ে গেছে বিশাল গ্রহগুলোতে, তবে কয়েক লাখ ছড়িয়ে আছে আের্ট মেঘমগুলে। সূর্যকে ঘিরে যে-সৌরজগত গড়ে উঠেছে, তা অনন্য হওয়ার কথা নয়; তাই মনে করতে পারি মহাবিশ্বে সম্ভবত আছে -আরো অনেক সৌরজগত, তবে সেখানে মানুষ মিলবে না।

সূর্য, আমাদের তারা, সৌরজগতের কেন্দ্র ও অধীশ্বর; তবে মহাবিশ্বের অযুত নিযুত তারার মেধ্য এটি একটি সাধারণ মাঝারি তারা। এর ভরও বেশি নয়, আকারেও এটি খুব বড়ো নয়; কিন্তু এটিই আমাদের জীবনের উৎস, সম্ভবত সারা মহাবিশ্বে এটিকে-ঘিরে-চলা একটি সাধারণ গ্রহেই আছে বুদ্ধিমান প্রাণী- মানুষ । সূর্যের ব্যাস ১,৩১৯,৯৮০ কিলোমিটার বা ৮৬৪,০০০ মাইল, পৃথিবীর ব্যাসের ১০৯ গুণ; সূর্য আকারে পৃথিবীর থেকে ১১৩ মিলিয়ন গুণ বড়ো, অর্থাৎ সূর্যের ভেতরে রাখা সম্ভব দশ লাখেরও বেশি পৃথিবী; কিন্তু এর ভর (বস্তুর পরিমাণ) পৃথিবীর ভরের মাত্র ৩০,০০০ গুণ বেশি – সূর্যের ভর ১.৯৮৯ X ১০৩০ কেজি (অর্থাৎ প্রথম সংখ্যাটিকে ২ ধ’রে তারপর ৩০ শূন্য বসালে যা হবে); এর অভিকর্ষ পৃথিবীর অভিকর্ষের ২৮ গুণ, পৃথিবীতে একটি ১০০ কেজি বস্তুর ভার সূর্যে হবে ২৮০০ কেজি। খুবই প্রকাণ্ড সূর্য, তবে সূর্যের থেকে কয়েক শো গুণ বড়ো তারা আছে, আছে লাখ লাখ গুণ উজ্জ্বল তারা। পৃথিবী থেকে সূর্য বেশ কাছেই, ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল বা ১৫০ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে, সৌরজগতের পাঁচটি গ্রহ আছে পৃথিবী থেকে সূর্যের থেকেও বেশি দূরে । সূর্য থেকে পৃথিবীর গড় দূরত্বকে বলা হয় ১ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক এককঃ অ্যাস্ট্রোনমিক্যল ইউনিট (সংক্ষেপে এ-ইউ = ১.৪৯৫৯৮৫ X ১০৮ কিমি)। সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে লাগে ৮.৩ মিনিট; সূর্যের দিকে তাকালে চোখ ঝলসে যায়, রশফুকো বলেছেন, সূর্য আর মৃত্যুর দিকেই শুধু স্থির চোখে তাকানো যায় না। সূর্যের বিকিরণে প্লাবিত হয়ে আছে পৃথিবী, এর বাইরের স্তরের বায়ুপ্রবাহ, সৌরবাতাস, এসে লাগে পৃথিবীর গায়ে, এর রঞ্জনরশ্মি ও বেতারতরঙ্গ নিরন্তর ধাক্কা দেয় পৃথিবীকে।
সূর্যঃ সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্থিত হাইড্রোজেন ও সূর্যক বা সৌরকে (হিলিয়াম) গঠিত দশ লাখ কিলোমিটার ব্যাসের এক অগ্নিগোলক। এর ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের ১০৯ গুণ । মানুষ হাজার হাজার বছর সূর্য আর তারা দেখেছে, কিন্তু বুঝতে পারে নি যে সূর্য একটি তারা; আর দূরের তারাগুলো সূর্য। সূর্যও স্থির নয়, ঘুরছে, পাক খাচ্ছে; তারাদের সাপেক্ষে একবার পাক খাচ্ছে ২৫.৪ দিনে, আর পৃথিবীর সাপেক্ষে পাক খাচ্ছে ২৭ দিনে। গ্রহগুলোর মতো সূর্যও পাক খাচ্ছে পশ্চিম থেকে পুবে; আর ছায়াপথ ঘিরে কক্ষপথে প্রদক্ষিণ ক’রে চলছে সূর্য।
সূর্য গরম গ্যাসের গোলক; তার ঘনত্বও বেশি নয়, এক ঘনসেন্টিমিটারে ১.৪১ গ্রাম, অর্থাৎ পানির মতো ঘন; তবে তার কেন্দ্রাঞ্চল অত্যন্ত ঘন, সীসার থেকে দশগুণ। সূর্যের ভেতরাঞ্চল খুবই গরম, ১০ মিলিয়ন ডিগ্রি, বাইরের দিকে তাপমাত্রা ৬,০০০ কেলভিনের মতো ৷ এই তাপে সূর্যের বাইরের স্তরগুলোতে গ্যাস আংশিক আয়নিত হয়, আর কেন্দ্রে আয়নিত হয় সম্পূর্ণরূপে; তাই সব ইলেকট্রন ছাড়া পেয়ে যায় তাদের অণু থেকে । সূর্য সংহত হয়ে আছে অভিকর্ষের টানে : এর অণু ও আয়নরাশি পরস্পরকে টানে, তার ফলে সূর্য গোলকার ধারণ ক’রে আছে । সূর্যের ভেতরে নিয়ত চলছে ভারসাম্য রক্ষার প্রক্রিয়া; কেন্দ্রের দিকে চলছে আভিকর্ষিক আকর্ষণ, টানছে সব কিছু ভেতরের দিকে, আবার গরম গ্যাস বাইরের দিকে সৃষ্টি করছে বহির্মুখি চাপ- একে বলা হয় উদ্স্থিতিক ভারসাম্য : হাইড্রোস্ট্যাটিক ইকুইলিব্রিয়াম । অভিকর্ষ ও চাপ সুর্যের সর্বত্র রক্ষা ক’রে চলছে ভারসাম্য । অন্য তারাগুলো যে-সব উপাদানে গঠিত, সূর্যও গঠিত সে-সবে; এর ভরের ৭০ ভাগ হাইড্রোজেন, ২৭ ভাগ হিলিয়াম বা সূর্যক, আর বাকি উপাদানের মধ্যে রয়েছে লিথিয়াম, বেরিলিয়াম, বোরোন, কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, ফ্লুরিন, নিয়ন, ও আরো নানা উপাদান। সূর্যের বাইরের স্তরগুলোতে কোনো পারমাণবিক বিক্রিয়া ঘটে নি ব’লে এ-অঞ্চলের ভরের ৭৯ ভাগই হাইড্রোজেন; এ-দিক দিয়ে সূর্যের রাসায়নিক গঠন অনেকটা বহির্ভাগের গ্রহগুলোর মতো । সূর্যের সমস্ত শক্তির উৎস তার কেন্দ্রস্থল, তার ব্যাসের ভেতরের ১০ ভাগের মধ্যেই উৎপন্ন হয় তার শক্তি। এখানেই পারমাণবিক বিক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় তাপ ও আলোর ফোটোন বা কণা । এ-আলোই বেরিয়ে আসে বাইরে, ছড়িয়ে পড়ে মহাশূন্যে । তবে প্রচণ্ড বাধা পেরিয়ে আলোর কণাকে বাইরে আসতে হয়; একেকটি আলোর কণাকে কেন্দ্র থেকে সূর্যের ওপরতলে পৌঁছোতে লাগে মিলিয়ন বছর, বাধা না পেলে সময় লাগতো দু-সেকেন্ড । যদি সূর্যের ভেতরে এখন শক্তি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সেটা বুঝতে আমাদের লাগবে দশলাখ বছর!
সূর্য ঘোরে অর্থাৎ পাক খায় প্রভেদমূলক রীতিতে। সূর্য তার বিষুবাঞ্চলের দিকে ঘোরে দ্রুত, মেরুর দিকে ঘোরে ধীরে। বিষুবাঞ্চলের দিকে সূর্য ঘোরে ২৫ দিনে একবার, মধ্য অক্ষাংশের দিকে ঘোরে ২৮ দিনে একবার, আর মেরুর দিকে ঘুরতে লাগে আরো বেশি সময়। সূর্যের কেন্দ্রের দিকটা বাইরের দিকের থেকে ঘোরে অনেক বেশি দ্রুত, সম্ভবত কয়েক দিনে একপাক ঘোরে, যেখানে বাইরের দিকে ঘুরতে লাগে ২৫ দিন। সূর্য উৎপাদন করে প্রচণ্ড শক্তি, এটা ক’রে আসছে চার বা পাঁচ বিলিয়ন, চারশো বা পাঁচশো কোটি বছর ধ’রে । কী প্রক্রিয়ায় সূর্য উৎপাদন করে এতো শক্তি? এটা আগে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় নি, হয়েছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাতত্ত্বের পর। তিনি দেখিয়েছেন বস্তু ও শক্তি একই জিনিশ — একটিকে রূপান্তরিত করা যায় অন্যটিতে। এ-রূপান্তরের বিখ্যাত সূত্রটি হচ্ছে ই = এমসি । সূত্রটিতে ই হচ্ছে উৎপন্ন শক্তি, এম হচ্ছে যে-বস্তুটিকে শক্তিতে রূপান্তরিত করা হবে, তার ভর, আর সি হচ্ছে আলোর গতি । এ-সূত্রানুসারে, পারমাণবিক বিক্রিয়ায়, উৎপাদন করা সম্ভব বিপুল শক্তি; সূর্যেও ঘটছে তাই । সূর্যে যে-বিক্রিয়া ঘটছে, যাকে বলা হয় প্রোটন-প্রোটন শেকল, তাতে দেখা যায় এ-প্রক্রিয়ায় আরো বহু বিলিয়ন বছর ধ’রে সূর্য বর্তমান হারে উৎপাদন করতে পারবে শক্তি।
সূর্যের যে-এলাকাগুলোতে ধারাবাহিকভাবে স্বাভাবিক কাজ চলতে থাকে, তাকে বলা হয় ‘শান্ত সূর্য’। সূর্যের বহির্ভাগের স্তরগুলোই শান্ত সূর্য। সূর্যের বহির্ভাগের স্তরগুলোকে কয়েকটি এলাকায় বিভক্ত করা হয়ঃ স্তরগুলোর একটি আলোকমণ্ডলঃ ফটোস্ফেয়ার, এর তাপমাত্রা ৪,০০০ থেকে ৬,৫০০ কেলভিন; আরেকটি এলাকা হচ্ছে বর্ণমণ্ডলঃ ক্রোমোস্ফেয়ার, এর তাপমাত্রা ৬,০০০ থেকে ১০,০০০ কেলভিন; আরেকটি স্তর জ্যোতির্মণ্ডলঃ করোনা, এর তাপমাত্রা ১ থেকে ২ মিলিয়ন ডিগ্রি। সূর্যের দৃশ্যমান মণ্ডলটি হচ্ছে আলোকমণ্ডল; এটি গ্যাসে তৈরি। সূর্য আপাদমস্তক একটি গ্যাসীয় বস্তু। আলোকমণ্ডলটি গ্যাসের একটি পাতলা স্তর- ৫০০ কিলোমিটারেরও কম মোটা, এটি থেকেই আমরা সূর্যের আলোর অধিকাংশ পেয়ে থাকি। আলোকমণ্ডলের নিচে গ্যাস অনেক বেশি ঘন ও গরম; তাই তা বিকিরণ করে বেশি আলো, কিন্তু ওই আলো বাইরের দিকের গ্যাসের স্তরগুলোর জন্যে সূর্য থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। আলোকমণ্ডলের গ্যাস খুবই লঘু; আমরা যতোটা ঘন বাতাস নিশ্বাসে নিই, তেমন গ্যাস পাওয়ার জন্যে সূর্যের কেন্দ্র পর্যন্ত দূরত্বের ১০% ভাগ নিচে নামতে হবে। আলোকমণ্ডলের ভেতরে ও ওপরে ছড়ানো গ্যাসের মণ্ডলকে বলা হয়ে থাকে সৌরজলবায়ু।
আলোকমণ্ডলের ওপরে আছে ১০,০০০ কিলোমিটার পুরু গ্যাসের এক অদৃশ্য স্তর, একে বলা হয় বর্ণমণ্ডলঃ ক্রোমোস্ফেয়ার। এটি আলোকমণ্ডলের থেকে ১০০০গুণ অস্পষ্ট, তাই এটা দেখা যায় শুধু পূর্ণসূর্যগ্রহণের সময়, যখন চাঁদ ঢেকে ফেলে উজ্জ্বল আলোকমণ্ডলটি। তখন কয়েক সেকেন্ডের জন্যে গোলাপি সক রেখারূপে ঝিলিক দিয়ে ওঠে বর্ণমণ্ডল। এর গোলাপি রঙ এর বর্ণালি বা বর্ণচ্ছটার এক রকম প্রকাশ। বর্ণমণ্ডলের গরম স্বল্প ঘন গ্যাস তৈরি করে এক উজ্জ্বল বর্ণালি। বর্ণমণ্ডলে দেখা যায় আলোকশিখার মতো স্পিকুয়েল বা কণ্টক, যেগুলোর ব্যাস ১০০ থেকে ১০০০ কিলোমিটার; তবে এগুলো কখনো কখনো ৫ থেকে ১০ মিনিটের জন্যে আলোকমণ্ডলের ওপরে ১০,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত দাউদাউ ক’রে উঠতে পারে। অনেকে মনে করেন এগুলো হচ্ছে প্রণালি, যা দিয়ে আলোকমণ্ডলের নিম্নাঞ্চল থেকে সূর্যের জ্যোতির্মণ্ডলে প্রবাহিত হয় শক্তি।
সূর্যের সবচেয়ে বাইরের, বর্ণমণ্ডলের ওপরে ছড়ানো, স্তরটি হচ্ছে জ্যোতির্মণ্ডল বা জ্যোতির্বলয় : করোনা। গ্রিক ভাষায় করোনা শব্দের অর্থ ‘মুকুট’; বাঙলায়ও সূর্যের এ-স্তরটিকে মুকুট বলতে পারি। পূর্ণসূর্যগ্রহণের সময়ই শুধু সূর্যের মুকুটটি দেখা যায় খালি চোখে, যখন চাঁদের ছায়া ঢেকে ফেলে উজ্জ্বল আলোকমণ্ডলটি। তখনও মুকুটটি পূর্ণিমার চাঁদের আলোর থেকে কম আলো ছড়ায়। করোনার নিম্নভাগে তাপের পরিমাণ ৫০০,০০০ কেলভিন; বাইরের ভাগে তাপমাত্ৰা হ’তে পারে এমনকি ২,০০০,০০০ কেলভিন। মুকুটের বাইরের দিকটা এতো গরম যে সূর্য সেটা ধ’রে রাখতে পারে না; তখন তীব্র গতিশীল গ্যাসের অণুরাশি প্রবাহিত হ’তে থাকে সূর্য থেকে, একে বলা হয় সৌরবাতাস। পৃথিবীর পাশ দিয়ে সেকেন্ডে ৩০০ থেকে ৮০০ কিলোমিটার বেগে বয়ে যায় এই সৌরবাতাস । তাই পৃথিবী সৌরবাতাসের নিশ্বাস বোধ করে সব সময় । সূর্যের পাশ দিয়ে যখন ধূমকেতুরা চ’লে যায়, তখন তাদের লেজ সব সময়ই থাকে সূর্যের থেকে দূরের দিকে; এর কারণ সৌরবাতাস।
মাঝেমাঝে সূর্যের কোনো কোনো এলাকা অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে, ক্ষিপ্ত হয়, ঘটাতে থাকে অগ্ন্যুৎপাত ও বিস্ফোরণ, গায়ে দেখা দেয় কালো দাগ, ওই অবস্থায় সূর্যের ওই এলাকাকে বলা হয় ‘সক্রিয় সূর্য’ বা ক্ষিপ্ত সূর্য। সূর্য এতো উজ্জ্বল যে খালি চোখে তাকানো যায় না, তাকাতে পারলে দেখা যেতো সূর্যেও আছে কালো দাগ, যাকে বলা হয় সৌরকলঙ্ক : সানস্পট । সৌরকলঙ্ক হচ্ছে সূর্যের ওপরের তলের অন্ধকার ও চারপাশের থেকে শীতল এলাকা। সৌরকলঙ্কের কেন্দ্রকে বলা হয় ছায়া : উম্বা, এটি এর বাইরের সীমানা থেকে বেশি অন্ধকার; বাইরের সীমানাকে বলা হয় পেম্বাঃ উপচ্ছায়া। সৌরকলঙ্কের আকার সাধারণত পৃথিবীর ব্যাসের দ্বিগুণ, এবং স্থায়ী হ’তে পারে এক সপ্তাহের মতো। সৌরকলঙ্ক সাধারণত দলবেঁধে দেখা দেয়, তখন স্থায়ী হয় দু-মাসের মতো সময়। সৌরকলঙ্ক দেখতে কালো, কারণ ওই অঞ্চল আলোকমণ্ডলের থেকে শীতল। ১৯০৮ অব্দে জর্জ এলারি হ্যালে আবিষ্কার করেন যে সৌরকলঙ্কে রয়েছে শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র; এবং এগুলো সাধারণত সূর্যের স্বাভাবিক ক্ষেত্রের থেকে ১০০০গুণ তীব্র। সৌরকলঙ্কগুলো সাধারণত দেখা যায় সূর্যের মধ্য-অক্ষাংশে, সূর্যের বিষুবরেখার ৩৫ ডিগ্রি ওপরে বা নিচে। সূর্যে সৌরকলঙ্ক আছে নির্দিষ্টসংখ্যক, ১০০টির মতো; ১৮৪৩ অব্দে জর্মানির শৌখিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরিশ শোয়াবে আবিষ্কার করেন যে ১১ বছর পর পর সৌরকলঙ্কের সংখ্যা বাড়ে কমে। একে বলা হয় সৌরকলঙ্কচক্র। সূর্যের এই সৌরকলঙ্কচক্র সূর্যের সার্বিক চৌম্বক চক্রের সাথে সম্পর্কিত ব’লে মনে হয়; কেননা দেখা গেছে প্রত্যেকটি সৌরকলঙ্ক-যুগল গঠিত একেকটি চৌম্বক-যুগলে, একটি সৌরকলঙ্ক কাজ করে চৌম্বক উত্তর মেরুর মতো অন্যটি কাজ করে দক্ষিণ মেরুর মতো। আর সৌরকলঙ্কের চক্র পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় চক্র থেকে চক্রে বদলে যায় মেরুত্বঃ চক্রে চক্রে বিপরীত হয়ে ওঠে সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রে মেরুত্ব। সৌরকলঙ্কের চক্র ১১ বছরের, আর সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্র বিপরীত হয়ে যাওয়ার চক্র ২২ বছরের। সূর্যের সম্পূর্ণ চৌম্বক ক্ষেত্র বিপরীতমুখি হয়ে ওঠে ১১ বছরের দুটি চক্রে; এর ফলে ২২ বছরে সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্র সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে ওঠে । সূর্যে ১১ বছর ধ’রে কম্পাসের উত্তর মেরুর কাঁটা যে-দিকে থাকবে, পরের ১১ বছর থাকবে তার বিপরীত দিকে। পৃথিবীরও চৌম্বক ক্ষেত্রের বিপরীতায়ন ঘটে, তবে এতো কম সময়ে নয়, কয়েক হাজার থেকে কয়েক লাখ বছর পর পর । সূর্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ অস্বাভাবিক বা বিকট ঘটনা ঘটে বা খুব বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে সূর্য, একটি অগ্ন্যুৎপাত : প্রোমিনেন্স, আরেকটি বিস্ফোরণ : ফ্লেয়ার। সূর্যগ্রহণের সময় দেখা যায় যে সূর্যের গোলকের ধারে লকলক ক’রে বেরিয়ে আসছে আগুনের দীর্ঘ জিভ, এটাই অগ্ন্যুৎপাত। বিস্ফোরণও অগ্ন্যুৎপাতই, তবে এটা প্রচণ্ড তীব্র; বিস্ফোরণের ফলে সূর্যের ওপর প্রচণ্ড বেগে লাফিয়ে ওঠে আগুনের পর্বত, কয়েক মিনিটে উঠে যায় সর্বোচ্চ শিখরে, আর নামে ঘণ্টাখানেক সময়ে । বিষ্ফোরণের তাপমাত্রা উঠতে পারে ৫০০,০০০ কেলভিনে। বিস্ফোরণের সাথে সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়; এটা ঘটে সৌরকলঙ্কের কাছাকাছি, এবং একই স্থানে ঘটতে পারে বারবার। সৌর বিস্ফোরণের বহু প্রভাব পড়ে পৃথিবীতে, তার একটি হচ্ছে পৃথিবীর চৌম্বক মেরুর কাছে সৃষ্টি হয় এক রকম বিস্ময়কর আলোর ঝলক, যাকে বলা হয় মেরুজ্যোতি বা মেরুপ্রভাঃ অরোরা।

সৌর বিস্ফোরণে পৃথিবীতে ছুটে আসে রঞ্জনরশ্মি, ধাবিত হয়ে আসে পারমাণবিক কণিকা- প্রোটন ও ইলেকট্রন প্রভৃতি। পারমাণবিক কণিকারাশি মেরু অঞ্চলের ওপরে ভেঙেচুরে প’ড়ে জ্বালিয়ে দেয় সেখানকার গ্যাসের অণুরাশিকে, ফলে জ্ব’লে ওঠে উজ্জ্বল আলো। ভূভাগ থেকেও এ-আলো দেখা যায়, এ-আলোই মেরুজ্যোতি । মেরুজ্যোতি সাধারণত দেখা যায় উত্তর ক্যানাডা ও অ্যান্টার্কটিকায় । একে উত্তর মেরুজ্যোতি (অরোরা বোরেআলিস) ও দক্ষিণ মেরুজ্যোতি (অরোরা অস্ট্রালিস)ও বলা হয়। এ-আলোতে স্থির জ্যোতিতে ভ’রে যেতে পারে আকাশ, মনে হয় আকাশে দুলছে লাল, শাদা, সবুজাভ আলোর যবনিকা।
সূর্য কি অবিনশ্বর? মহাবিশ্বের কিছুই অবিনশ্বর নয় । তারারা জন্মে, নানা রূপের ভেতর দিয়ে যায়, তাদের মৃত্যু হয়; আমাদের সূর্য এক সময় প্রথম পরিণত হবে একটি লাল দানবে : রেড জায়েন্ট, তারপর পরিণত হবে একটি শাদা বামনেঃ হোয়াইট ডোয়ার্ফ । তাই আমাদের ও পৃথিবীর নিয়তি নির্ভর করে সূর্যের নিয়তির ওপর । আজ থেকে ৪.৫ বিলিয়ন বছর পরে সূর্যের প্রভা বেড়ে যাবে ১০০ গুণ; ৫ বিলিয়ন বছর পরে প্রভা বাড়বে ৫০০ থেকে ১০০০ গুণ। তখন সূর্যের ব্যাস হবে এখনকার ব্যাসের ৭০ গুণ। ৫ বিলিয়ন বছর পর পৃথিবীর ওপরতলের তাপমাত্রা হবে ১৪০০ কেলভিন; আর তার অনেক আগেই পৃথিবীর সাগরগুলো আর বায়ুমণ্ডল বলক দিয়ে মিলিয়ে যাবে শূন্যে। সূর্য যখন লাল দানবে পরিণত হবে, তখন পৃথিবী থেকে লোপ পাবে সব প্রাণ। তখন পৃথিবী থেকে আকাশের ৩৫ ডিগ্রি জুড়ে থাকবে জ্বলজ্বলে সূর্য। ৫০০ মিলিয়ন বছর পর সূর্য আবার হয়ে উঠবে লাল দানব । তখন খ’সে পড়বে সূর্যের বাইরের আবরণ, দেখা দেবে সূর্যের উত্তপ্ত জমাট ভেতরভাগ; সূর্য হয়ে উঠবে শাদা বামন । পৃথিবী প্লাবিত হয়ে যাবে অতিবেগুনি রশ্মিতে; পৃথিবী থেকে মুছে যাবে প্রাণের শেষ কণা। সূর্য যখন বর্তমান সূর্যের ১/১০০ ভাগ হয়ে উঠবে, পৃথিবীর তাপমাত্রা নামবে ১০০ কেলভিনে। তখন পৃথিবী হয়ে উঠবে একটি তুষারিত গ্রহশব।
“মহাবিশ্ব” বই সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ