সোমনাথ মন্দিরের কথা প্রাইমারী স্কুলের গণ্ডি পেরোনো সকলেরই জানা। বিশ্ববিখ্যাত সেই মন্দিরের বিপুল ধনরত্ন একাদশ শতাব্দীতে লুন্ঠন করেছিলেন গজনীর সুলতান মামুদ। সোমনাথ মন্দিরের শুধু ঐশ্চর্যই সুলতানকে আকর্ষণ করেনি, আকর্ষণের আর একটি প্রধান কারণ ছিল মন্দিরের বিগ্রহের অলৌকিকত্ব।
সোমনাথ মন্দিরের দেবমূর্তির অলৌকিকত্বের কথা যুগ-যুগ ধরে দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। দেব-বিগ্রহ কোন বেদিতে বসানো ছিল না। বিগ্রহ অবস্থান করতেন মন্দিরের মাঝখানে শূন্যে। শূন্যে ভাসমান সোমনাথদেবকে দর্শনের জন্য দূর-দূরান্ত থেকে বহু কষ্ট স্বীকার করেও হাজির হতেন লক্ষ লক্ষ ভক্ত। অলৌকিকের আকর্ষণ বড় আকর্ষণ। চাক্ষুষ অলৌকিক শক্তির প্রকাশ এবং জাগ্রত দেবতাকে দেখার সুযোগ কে-ই বা অবহেলায় নষ্ট করবে? কে-ই বা জীবন্ত দেবতাকে দেখে সব পাপ থেকে মুক্ত হয়ে অক্ষয় স্বর্গবাসের সুযোগ নেবে না? ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা নির্বিশেষে লক্ষ-কোটি দর্শক এসেছেন এবং দেবতার অসাধারণত্ব ও অলৌকিকত্ব দেখে নিজেদের সাধ্যমতো প্রণামী উজার করে ঢেলে দিয়ে গেছেন। দীর্ঘ বছরের সঞ্চয়ে মন্দিরে জমে উঠেছিল কুবেরের ঐশ্চর্য।
শূন্যে ঝুলন্ত দেবমূর্তির অসাধারণত্ব সুলতান মামুদকে আকর্ষণ করে। মামুদ শুধু মন্দিরের ধনরত্ন লুঠ করেই বিরত হননি। তিনি যুক্তিবাদী মন নিয়ে দেবমূর্তির শুন্যে ঝুলে থাকার কারণ জানতে উৎসুক হয়ে ওঠেন। তাঁর সঙ্গে আসা বিজ্ঞানী, ধাতুবিদ ও বাস্তুকারদের নিয়ে মূর্তিটি পরীক্ষা করে দেখেন যে ওটি লোহার তৈরি। বিশেষজ্ঞরা আরও মত প্রকাশ করেন যে, সম্ভবত মন্দিরের দেওয়ালের চারপাশে চুম্বক-পাথর বসানো আছে। এমন করে চুম্বক-পাথর বসানো হয়েছে, যাতে, লোহার মূর্তিটি মাঝামাঝি একটা জায়গায় এনে ছেরে দিলে বিভিন্ন প্রান্তের চুম্বক-আকর্ষণে শূন্যে ভেসে থাকছে।
সুলতান মামুদের নির্দেশে দেবমূর্তিকে আবার শূন্যে স্থাপন করা হল। তারপর, তাঁর লোকজনদের মন্দিরের দেওয়ালে লাগানো পাথরগুলো আস্তে আস্তে খুলে দেলতে বললেন। এক পাশের দেওয়ালের পাথর একটি একটি করে খুলে ফেলতেই খুলে এলো চুম্বক পাথর বা ‘ম্যাগনেটাইট’। দেবমূর্তি শুন্য থেকে পড়ে গেল মেঝেতে। ‘অলৌকিক’ দেবমূর্তির রহস্য ভেদ হল। বোঝা গেল দেবতার বদলে এক টুকরো লোহা রাখলেও ভাসত। মন্দিরের পুরোহিতরা এবং কোন ধাতুবিদ বাস্তুকার তাঁদের জ্ঞানের অপপ্রয়োগ করে শুধু লোক ঠকিয়ে বিপুল অর্থ ও সমীহ আদায় করেছিল।
মামুদ তথাকথিত অলৌকিক কিছু দেখেই যুক্তিহীন হয়ে পড়েননি বলেই প্রকৃত রহস্য উদঘাটিত হয়েছিল। নতুবা আরও কত শত বছর ধরে সোমনাথ মন্দিরের লোক ঠকানোর রমরমা ব্যবসা চলত, তা কে জানে। হয়ত আমাদের দেশের নেতারা নির্বাচনের আগে সোমনাথের আশীর্বাদ দিতে দৌড়তেন। সাধারণ মানুষ অসাধারণদের অনুসরণ করে ভিড় বাড়াতেন।