সেঞ্চুরি-১ হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেঞ্চুরি, কারণ এতে বেশ কিছু বিখ্যাত ঘটনার ব্যাখা আছে। তাই সেঞ্চুরি—১ থেকে ন’টা কবিতার বিশ্লেষণ করলাম। অন্যান্য সেঞ্চুরিতে এত ঘটনার ঘনঘটা নেই। তাই অন্যান্য সেঞ্চুরি থেকে গোটাপাঁচেক করে কবিতার বিশ্লেষণ করেছি ।

 

সেঞ্চুরি এক

ভূমিকাতেই বলেছি, কলেবর ও দামের কথা ভেবে আমি নস্ট্রাডামুসের সমস্ত শ্লোকের ব্যাখ্যা এই বইতে হাজির করলাম না। তবে যে-সব পৃথিবী কাঁপানো শ্লোকের ব্যাখ্যা হাজির করব, আশা করি তা থেকেই পাঠক-পাঠিকাদের নস্ট্রাডামুস-রহস্য ভেদ করা কঠিন হবে না।

প্রথম সেঞ্চুরির কবিতা বা শ্লোক এক আর দুই সমন্ধে গোড়াতেই আলোচনা করেছি। তাই ওই দুটো বাদ দিয়ে পরবর্তী শ্লোকগুলোতে চলে যাচ্ছি।

 

কবিতা-৩(সেঃ–১)

Quand la lecture du tourbillon versee.

Et serout faces de leurs manteaur convers

La republique par gens noubeaur vexce,

Lors blancs & rouges jugerout a l’envers

এর অর্থঃ

ঘুর্ণিঝড়ে যখন বিছানাপত্তর ওলটপালট হয়ে যাবে,

তখন মানুষজন কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকবেঃ

নতুন রাজ্যে অশান্তি লেগে থাকবে,

আর লাল-সাদাবা এলোমেলো রাজ্যশাসন করবে।

 

ব্যাখ্যাকারদেব ব্যাখাঃ ফরাসিবিপ্লব

ব্যাখ্যাকার এরিকা চিটহ্যামের মতে এখানে নাকি ফরাসি বিপ্লবের কথা বলা হয়েছে। ঘুর্ণিঝড় মানেই ফরাসি-বিপ্লব। আর কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকবে বলতে নাকি নস্ট্রাডামুস বলতে চেয়েছিলেন, লোকজনের মুণ্ডু গিলোটিনে কেটে ফেলা হবে। (বুঝুন ব্যাপার) আর ফরাসি, সময়ে রাজ্যে অশান্তি তো ছিলই ।

 

যুক্তিবাদী বিশ্লেষণঃ

এই কবিতাটা আর যুক্তিবাদী বিশ্লেষণ নাই বা করলাম। পাঠকরা তো দেখতেই পাচ্ছেন ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যাটা কেমন বিভৎসরকম হাস্যকর। বিছানাপত্তর এলোমেলো করা ঘূর্ণিঝড় মানেই ফরাসিবিপ্লব ? আর কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা মানেই গিলোটিনে মানুষের মুন্ডু কাটা যাবে। হায়।। লাল-সাদারা তাহলে কে ?

সত্যি বলতে কি, মাথায় একটু বুদ্ধি থাকলে, আর একটু
ইতিহাস জানা থাকলে, নস্ট্রাডামুসের যে কেনো কবিতার যা
খুশি ব্যাখ্যা করে, ইতিহাসের যে কোনো একটা ঘটনার
সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায়। আর ব্যাখ্যাকাররা সেটাই
করছেন ।

 

কবিতা-৪ (সেঃ-১)

Par l’univers sera faict un monarque,

Qu’en paix & vre ne sera longuement,

Lors se perldra la fiscature barque,

Sera regie en plus grand detriment

মানেঃ পৃথিবীর কোনো এক জায়গায় শাসন করবে এক রাজা,

যে শান্তি পাবে না,

আর তার রাজ্যকালও হবে ছোট্টঃ

শান্তি আসবে না তার রাজত্বে।

 

ব্যাখাকারের ব্যাখ্যাঃ নোপোলিয়ানের আবির্ভাব শ্লোকে সূচিত হয়েছে।

সবচেয়ে খ্যাতনামা ব্যাখ্যাকার এরিকা’র মতে এই কবিতাতে নেপোলিয়ানের কথাই হয়েছে। কেন না নেপোলিয়ান মাত্র দশ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তিনি নিজে শান্তি পান নি, প্রজাদেরও পেতে দেন নি ।

 

যুক্তিবাদী বিশ্লেষণঃ 

প্রথম দর্শনে এই ব্যাখ্যা পাঠকদেব ঘাবড়ে দিতেই পারে। কিন্তু ভেবে দেখুন তো, পৃথি বেশিরভাগ রাজাই তো অল্প কয়েক বছর (চার-পাঁচ বছর) রাজত্ব করে সিংহাসন হাতছাড়া করেছেন। বেশিরভাগ রাজাই তো শান্তি পান নি, প্রজাদেরও শান্তি দেন নি। এ বিশেষভাবে নেপোলিয়নের নাম আসছে কেমন করে ? নেপোলিয়ন তো বরং বেশ অনেক বছরই রাজত্ব করেছিলেন, এই সব অসংখ্য ছোট ছোট রাজাদের তুলনায়। তাহলে ?

 

কবিতা-১০ (সে:- ১)

Serpens transmis dans la caige de fer,

Ou les enfans septaines du Roy sont prisঃ

Les vieux & peres sortiront bas de l’enfer,

Ains mourir voir de fruct mort & cris.

অর্থাৎঃ

লোহার ভল্টে রাখা হবে এক কফিন

মৃত রাজা তার মৃত ছয় বোনের দেখা পাবে সেখানেইঃ

পাতাল থেকে উঠে আসবে পূর্বপুরুষরা,

তাদের বংশধরদের এ-হেন মৃত্যুতে শোক করতে।

 

ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যাঃ তৃতীয় হেনরীর মৃত্যু

এরিকার মতে এই কবিতাতে রাজা তৃতীয় হেনরীর মৃত্যুর কথাই বলা হয়েছে। হেনরীর ছিল ছয় ভাই-বোন। ‘পাতাল থেকে উঠে আসবে পূর্বপুরুষরা’ লাইনটা একটু গোলমাল বাধিয়েছে, এরিকা স্বীকার করেছেন ।

 

যুক্তিবাদী বিশ্লেষণঃ

শেষ দুটো লাইন অবাস্তব। ও লাইন দুটো নিয়ে আর কিছু বললাম না। প্রথম আর দ্বিতীয় লাইন দুটো দেখা যাক। তৃতীয় হেনরি এবং তার ছয় ভাইবোনের জন্ম নস্ট্রাডামুসের চোখের সামনেই। এমনকি নস্ট্রাডামুস তাদের বাড়িতে গেছিলেনও, এই সাত শিশুর ঠিকুজি, কুষ্ঠি তৈরি করতে (আগেও বলেছি)। তাই এদের নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করাটা আশ্চর্যজনক কিছু ব্যাপার নয়। ভবিষ্যদ্বাণীতে বলা আছে তৃতীয় হেনরী তাঁর ভাইবোনদের মধ্যে সবার শেষে মারা যাবেন। এটাও ঠিক নয়। তৃতীয় হেনরী সবার শেষে মারা যান নি ॥

 

কবিতা—১৭ (সেঃ-১)

Par quarante ans l’Iris n’ apparoistra,

Par quarante ans tous les jours sera veu

La terre aride en siccite croistra,

Et grans deluges quand sera aperceu

এর অর্থঃ-

চল্লিশ বছর ধরে আকাশে দেখা যাবে না রামধনু,

তারপর চল্লিশ বছর ধরে রোজ দেখা যাবে রামধনুঃ

শুকনো পৃথিবী আস্তে আস্তে সবুজ হয়ে উঠবে,

তারপর চারদিক ভেসে যাবে বন্যায়।

 

ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যাঃ খরা ও বন্যা

এরিকা স্বীকার করেছেন যে, তিনি এই কবিতার ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম। পৃথিবীর কোথাও চল্লিশ বছর খরার পর টানা চল্লিশ বছর বন্যার খবর পাওয়া যায়নি। অতএব……

 

কবিতা –২৩ (সেঃ-১)

Au mois troisiesme se levant le soleil,

Sanglier, Liepard au champ Mars pour combattre

Liepard laisse, an cicl extend son oeil,

Un aigle outour du Soleil voit s’esbattre

অর্থাৎঃ

তৃতীয় মাসে, সূর্যোদয়ের সময়ে

শুয়োর আর চিতাবাঘ

ক্লান্ত চিতাবাঘ স্বর্গের দিকে তাকাবে,

দেখবে একটা ঈগলপাখি সূর্যের আশেপাশে খেলে বেড়াচ্ছে ।

 

ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যাঃ ওয়াটারলু’র যুদ্ধ

এরিকা দেবীর মতে এই কবিতাতে নেপোলিয়ানের ‘ওয়াটারলু’র যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে। তাঁর মতে শুয়োর মানে হ’ল পারস্যের রাজা-ব্লুচার। চিতাবাঘ বলতে নাকি ব্রিটিশদের কথা বলা হয়েছে। আর ঈগলপাখি মানেই নাকি ফরাসি শক্তি। ওয়াটারলু’র যুদ্ধ হয়েছিল ১৮১৫ সালের জুন মাসে। কবিতার প্রথম লাইনে নাকি এই তারিখটারও উল্লেখ আছে।

“তৃতীয় মাসে, সূর্যোদয়ের সময়ে”–মানেই জুন মাসে। কেন ? তারও এক জব্বর ব্যাখ্যা করেছেন এরিকা দেবী। সূর্যোদয় মানেই মার্চ মাস; কেননা মার্চ মাসে পৃথিবীর সর্বত্র দিন- রাত্রি সমান দৈর্ঘ্যের হয়। “তৃতীয় মাসে” মানে মার্চ মাসের থেকে গুণতে আরম্ভ করে তৃতীয় মাস; অর্থাৎ-জুন মাস ।

 

যুক্তিবাদী বিশ্লেষণঃ

যুক্তিবাদী পাঠকরা, এরিকা চিটহ্যাম-এর ব্যাখ্যা পড়ে কি সত্যিই আপনাদের মনে হচ্ছে যে, এই কবিতাতে নস্ট্রাডামুস নেপোলিয়ানের ওয়াটারলু’র যুদ্ধের কথা বলতে চেয়েছিলেন ? শুয়োর মানে পারস্যের রাজা, চিতাবাঘ মানে ইংরেজরা, আর ঈগল মানে ফরাসিরা ? এটা কি চ্যাংড়ামো নাকি ? এই উদ্ভট ব্যাখ্যার কোনো ভিত্তিই নেই। আর তারিখের ব্যাখ্যাটার তো কোনো মাথামুন্ডুই নেই। ‘সুর্যোদয়’ কথাটার অর্থ কোন যুক্তিতে মার্চ মাস ? পৃথিবীর সর্বত্র সমান দৈর্ঘ্যের দিন-রাত্রি হওয়া মানেই “সূর্যোদয়” ? এই যদি হয়, তবে তো সেপ্টেম্বর মাসের কথাও তোলা যায়। কারণ সেপ্টেম্বর মাসেও পৃথিবীর সর্বত্র দিন-রাত্রির দৈর্ঘ্য সমান। সেপ্টেম্বর থেকে গুনতে শুরু করে তৃতীয় মাস হয় ডিসেম্বর। তাহলে এরিকা দেবী কী করে জোর গলায় বলতে পারলেন যে এখানে ডিসেম্বর নয়, জুন মাসের কথাই বলা হয়েছে ? জবাব নেই ৷

 

কবিতা-২৬ (সেঃ-১)

Le grand du fouldre tumbe d’heure diurne,

Mal & predict par porteur postulaire

Suivant presage tumbe d’heure nocturne,

Conflict Reims, Londres, Etrusque pestifere অর্থাৎঃ

মস্ত মানুষটা একদিন মারা পড়বে বজ্রপাতে,

একজন আবেদনকারী আগেই এ বিষয়ে সাবধান করবে,

সাবধানবাণী অনুসারে আরও একজন মরবে রাতে,

দ্বন্দ্ব দেখা দেবে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও ইতালিতে।

 

ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যাঃ কেনেডি হত্যার পূর্বাভাষ

এরিকা জানিয়েছেন, এই শ্লোকে নস্ট্রাডামুস নাকি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জন এফ. কেনেডির হত্যার কথাই বলতে চেয়েছেন। আরও একজন মরবে বলে যে বলা হয়েছে, সে নাকি জন এফ. কেনেডির ভাই রবার্ট অফ. কেনেডি। “একজন আবেদনকারী আগেই ও বিষয়ে সাবধান করবে”—এই লাইনটার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এরিকা একটু বেশিই গোঁজামিল দিয়ে ফেলেছেন। বলেছেন— কেনেডি মারা যাবার আগে একাধিকবার তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা হয়েছিল । আর ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ইতালিতে মারামারি লাগবে বলে যে শেষ লাইনে উল্লেখ করা হয়েছে, তার মানে নাকি এই যে, এই ঘটনাতে সারা বিশ্বে হইচই পড়ে যাবে ?

 

যুক্তিবাদী বিশ্লেষণঃ

এরিকার ব্যাখ্যার প্রথম লাইন থেকেই গোঁজামিল শুরু। কেনেডি কিন্তু বজ্রপাতে মারা যান নি। তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। ভবিষ্যদ্বাণীর দ্বিতীয় লাইনেরও কোনো সুষ্ঠু ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না। এর কোনো আবেদনকারীর খবরই আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, যে কেনেডিকে মৃত্যু বা হত্যার ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে সাবধান করেছিল। তৃতীয় লাইনটার ব্যাখ্যা মোটেই সন্তোষজনক নয়। “আরও একজন মরবে রাত্রে”—এই লাইনটা পড়ে মনে হচ্ছে নস্ট্রাডামুস সেই রাত্রেই অন্য কারো মারা যাবার কথা বলেছিলেন। কিন্তু কেনেডির ভাই বার্ট. এফ. কেনেডি মারা গেছিলেন পাঁচ বছর পরে। এক ভোরবেলায়। “আরও একজন মরবে” বলাতে এরিকা জন-এর ভাইয়ের কথাই বা ভাবলেন কেন ? জনের ভাই-ই যে মরবে, এমন কথা তো কবিতাতে বলা নেই ? চতুর্থ লাইনটাও আর একটা বিদঘুটে গোঁজামিল। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড আর ইতালিতে দ্বন্দ্ব দেখা দেবার কথা বলা হয়েছে কবিতাতে ৷ হইচই পড়ে যাবে বলা হয়নি। নস্ট্রাডামুস স্পষ্টতই ‘Conflict’ কথাটা ব্যবহার করেছেন। ‘কনফ্লিক্ট’ মানে কোনো অর্থেই ‘হইচই’ নয়। আর ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ইত্যালি মানেই কি সারা পৃথিবী ?

অবশেষে আর একটা কথা না বলে পারছি না। এরিকাদেবী এই কবিতাতে কেনেডির নাম বিশেষভাবে পেলেন কোথায় ? এই কবিতাতে যে রাজীব গান্ধীর হত্যার কথা বলা হয়নি, তা কি প্রমাণ করতে পারবেন ? এই কবিতার বিশাল মানুষটি রাজীব হলেও তো মেলে বেশি, যিনি বজ্রপাতের মত এক বিস্ফোরণে মৃত্যু বরণ করেছিলেন। মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা আগে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দপ্তর তামিলনাড়ুর গোয়েন্দা দপ্তরকে সচেতন করে দিয়েছিল—ওখানে রাজীবের জীবনের ওপর আক্রমণ হতে পারে বলে। সে রাতে আরও একজন উল্লেখযোগ্য মানুষ মারা গিয়েছিলেন; তিনি হলেন হত্যাকারী মেয়েটি। রাজীবের মৃত্যুতে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ও ইতালিসহ পৃথিবীর বহুদেশের রাষ্ট্রনায়ক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেই দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল—ভারতবর্ষে গণতন্ত্র টিকবে তো ? লক্ষ্যণীয়, ইতালিতেই রাজীব গান্ধীর শ্বশুরবাড়ি ।

এভাবে নস্ট্রাডামুসের যে কোনো কবিতার যা খুশি ব্যাখ্যা করে ইতিহাসের যে কোনও ঘটনার সঙ্গে ইচ্ছে মতো জুড়ে দেওয়াটা কোনো কঠিন কাজ নয়।

 

কবিতা—৩৪ (সেঃ-১)

L’oiseau de prove volant a la semestre,

Avant conflict faict aux Francois pareure

L’un bon prendra l’un ambigue sinistre,

La partie foible tiendra par bon augure.

মানেঃ

অপরাজেয় পাখি বাঁদিক দিয়ে উড়ছে,

ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধের আগে নেবে প্রস্তুতিঃ

কারো কারো কাছে সে হবে নায়ক, অন্যদের কাছে খলনায়ক,

দুর্বল-শক্তি তাকে শুভ বলে মনে করবে।

 

ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যাঃ হিটলার

এরিকার এই কবিতার ব্যাখ্যা প্রথম নজরে আচ্ছা আচ্ছা লোকের মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে। এরিকা বলেছেন, এখানে হিটলারের কথা বলা হয়েছে। ‘অপরাজেয় পাখি’টি হল হিটলার। ফরাসিদের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ হয়েছিল। তৃতীয় লাইনটা ইতিহাস-বিরোধী হয়ে গেছে । কিন্তু বুদ্ধিমতী এরিকা তারও ব্যাখ্যা করে ফেলেছেন। বলেছেন যে, চতুর্থ লাইনে ‘দুর্বল- শক্তি’ বলতে জার্মানদের কথা বোঝাতে চেয়েছেন নস্ট্রাডামুস । (জার্মানদের এরিকা দুর্বল- শক্তি কেমন করে মনে করলেন জানি না। হিটলারের সময়ে জার্মানী এক মহাশক্তি ছিল বলেই তো জানি ।)

 

যুক্তিবাদী বিশ্লেষণঃ

এ কবিতার ব্যাখ্যায় প্রথমেই একটা মারাত্মক গোলমাল রয়ে গেছে। নস্ট্রাডামুস কিন্তু তাঁর সমস্ত সেঞ্চুরিতে যতবার ‘অপরাজেয় পাখি’ কথাটা ব্যবহার করেছেন, ততবারই এরিকা নেপোলিয়নের প্রসঙ্গ টেনেছেন। এরিকা বলেছেন যে, ‘অপরাজেয় পাখি’ মানেই নেপোলিয়ন । তাহলে এই ৩৪নং কবিতাতে ‘অপরাজেয় পাখি’ নেপোলিয়ন না হয়ে হিটলার হল কেন ? দ্বিতীয় লাইনটার জন্য ?

হিটলার কেন ? ইংরেজরা নয় কেন ? ইংরেজরাও তো ছিল অপরাজেয় । ইংরেজরা ফরাসিদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে একাধিকবার। ইংরেজরা কারো কারো কাছে ছিল নায়ক, কারো কাছে খলনায়ক। এদেশের ‘বাবু’ সম্প্রদায়রা ইংরেজদের মনে করতেন নায়ক, আবার এদেশেরই বিপ্লবীদের কাছে তারা ছিল খলনায়ক। ‘দুর্বল-শক্তি তাকে শুভ বলে মনে করবে এটাও ইংরেজদের ক্ষেত্রে ঘটানো যায়। কারণ ইংরেজরা এমন অনেক দুর্বল রাজ্য দখল করেছিল, যারা ইংরেজদের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। তাদের কাছে ইংরেজরা অবশ্যই শুভ বলে বিবেচিত হয়েছিল।

তাহলে এই কবিতাতে যে ইংরেজদের কথা বলা হয়নি, এরিকা দেবী তা জোরগলায় বলেন কী করে ? পাঠকরা, একটু ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করলে অন্য কারোর সঙ্গেও এই কবিতাটা আপনারা জুড়ে দিতে পারবেন। নস্ট্রাডামুসের কবিতাগুলির মজা এইখানেই ॥

 

কবিতা-৩৫ (সেঃ-১)

এই কবিতাটার বিস্তৃত ব্যাখ্যা করা হয়েছে এই বইয়ের ৩১২ পৃষ্ঠাতে, তাই আর দ্বিতীয়বার আলোচনায় গেলাম না। তবে চতুর ব্যাখ্যাকারদের দৌলতে কবিতাটা সত্যিই মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে। এই কবিতাতে (হেনরি-II-র মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করা আছে বলে দাবী করা হয়েছে ।

 

কবিতা-৫০ (সেঃ-১)

De l’aquatique triplicite naistra,

D’un qui fera le jeudi pour sa feste

Son but, loz, regne, sa puissance coistra,

Par terre & mer aux Oriens tempeste

এর অর্থ হলঃ

তিনটে জলের সঙ্কেত থেকে জন্মাবে এক মানুষ,

যে বৃহস্পতিবারকে তার ছুটির দিন হিসেবে পালন করবে।

তার বিক্রম ছড়িয়ে পড়বে চারদিকে,

আর, পশ্চিমে সে নানা ঝামেলা ডেকে আনবে।

 

ব্যাখ্যাকারদের ব্যাখ্যাঃ আয়াতুল্লা খুয়েমিনী/হিন্দু ধর্মনেতা

এই কবিতাটির দুটি ব্যাখ্যা আমার নজরে এসেছে। ব্যাখ্যাকার দুই ভিন্ন ব্যক্তি। প্রথম ব্যাখ্যাকার অবশ্যই অদ্বিতীয়া এরিকা চিটহ্যাম। তাঁর মতে এই কবিতায় নস্ট্রাডামুস মুসলিম ধর্মনেতা আয়াতুল্লা খুয়েমিনীর আবির্ভাব ও ছড়িয়ে পড়া বিক্রমের কথা বলেছেন । কিন্তু এরিকা এই কবিতাটির ক্ষেত্রে খুব একটা ভালো ব্যাখ্যা হাজির করতে পারেন নি। ব্যাখ্যাতে অনেক অসঙ্গতি রয়ে গেছে। এরিকার মতে, ‘তিনটি জলের সঙ্কেত’ মানে—মীন, কর্কট, আর বৃশ্চিক। আয়াতুল্লার কুষ্ঠিতে নাকি ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে এই ‘তিনটে জলের সঙ্কেত’- এর উল্লেখ আছে। সুতরাং এই কবিতাটা আয়াতুল্লা সম্বন্ধেই। আয়াতুল্লা পশ্চিমে ঝামেলাও ডেকে এনেছিলেন।

দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটি এক দক্ষিণভারতীয়ের। তাঁর নাম—শ্রী হিরন্নাপ্পা। ব্যাঙ্গালোরবাসী এই ব্যাখ্যাকারের বই—’হিন্দু ডেস্টিনি ইন নস্ত্রাদামু’তে এই কবিতার একটা জব্বর ব্যাখ্যা আছে। সেটিই ছাপা হয় ‘আলোকপাত’ এর পাতায়। সেই ‘আলোকপাত’ থেকে পড়ে আবার হুবহু কবিতাটার অনুবাদ এবং ব্যাখ্যা টুকে গেছেন অন্য এক লেখক—সুধীর বেরা। প্রসঙ্গত, এই সুধীব বেরা তাঁর চটি বই—’নস্ট্রাডামের ভবিষ্যদ্বাণী ও ভারতের ভবিষ্যৎ’এ ‘আনন্দমেলা’ (১৪ নভেম্বর ১৯৯০ সংখ্যা) ও ‘আলোকপাত’ থেকে ঢালাও প্রেরণা পেয়েছেন, বইটা পড়লে তা বুঝতে অসুবিধে হয় না বিন্দুমাত্র। তাঁর বই নিয়ে পরে আলোচনায় আসব। এখন বরং ফিরে চলুন হিরন্নাপ্পায় । শ্রী হিরন্নাপ্পার মতে এই কবিতাতে কোনও এক হিন্দু ধর্মনেতা সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। কারণ তিনটে জলের সঙ্কেত মানে হিন্নাপ্পার মতে আরব সাগর, বঙ্গোপসাগর, আর ভারত মহাসাগর। সেখানে থেকে জন্ম নেওয়া মানে ভারতবর্ষে জন্মানো । হিন্দুরা বৃহস্পতিবারকে পবিত্র দিন হিসেবে পালন করেন । কাজেই এ কবিতাতে নির্ঘাৎ কোনো হিন্দু মহর্ষির আগমনবার্তা দেওয়া আছে। কিন্তু কোন মহর্ষি তা অবশ্য বলেননি শ্ৰী হিন্নাপ্পা ।

 

যুক্তিবাদী বিশ্লেষণঃ

এরিকার ব্যাখ্যার কোনো মাথামুণ্ডুই নেই। তিনটে জলের সঙ্কেত মানেই বৃশ্চিক, কর্কট, আর মীন ? গ্লাস, বোতল আর গামলা নয় কেন? ওই তিনটে জিনিসেও তো জল রাখা হয় ? অথবা পুকুর, নদী, সমুদ্র নয় কেন ? এই তিনটেকেও তো জলের সঙ্কেত বলা যেতে পারে ? বৃশ্চিক, কর্কট, মীন—এই তিনটে সঙ্কেত কারও ঠিকুজিতে কিভাবে একসঙ্গে ঠাঁই পেল জানি না, কিন্তু এতে যে আয়াতুল্লা খুয়েমিনীর কথাই বলা হয়েছে, এটা কিন্তু স্পষ্ট হল না। এরিকা একটা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন কবিতাটাকে আয়াতুল্লার সঙ্গে সম্পর্কিত করার। কিন্তু তাঁর যুক্তি যথেষ্ট বলিষ্ঠ নয়।

শ্রীহিরন্নাপ্পার ব্যাখ্যাকে সত্যি ধরলেও ঝাণ্ডটি অনেক। সেই মহাপুরুষটি কে? মহর্ষি রজনীশ, মহর্ষি মহেশযোগী, স্বামী বিবেকানন্দ-এঁরা প্রত্যেকেই ভারতবর্ষের ধর্মীয় নেতা। এবং এঁরা প্রত্যেকেই যথেষ্ট ক্ষমতাশালী বা বিক্রমশালী ধর্মবেত্তা ছিলেন। এঁদের চিন্তায় আকর্ষিত হয়েছিলেন এবং হয়েছেন বহু পশ্চিমী অর্থাৎ পাশ্চাত্যের মানুষ। কিন্তু এখানেই তো শেষ নয় । ইসকনের জয়ের রথ যে বীর বিক্রমে পশ্চিমের দেশগুলো পরিক্রমারত, তাতে এদের যে কোনও একজনকেই তো নস্ট্রাডামুসের কবিতার লক্ষ্য বলে ধরা যায় । কিন্তু নিশ্চিতভাবে কাউকে কি আমরা পেলাম ? অবশ্যই না। কারণ তিনজনের বাইরেও অন্য কোউ হতে পারেন, অথবা অন্য অনেকেই হতে পারেন। ভারতবর্ষ বাবাজী-মাতাজীর অফুরন্ত সরবরাহকারী দেশ। এঁদের অনেকেরই বিশেষ আগ্রহ রয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি। আর সে-সব দেশে যে সব বাবাজী-মাতাজীরা যান, তাঁদের প্রত্যেকেই বেশ কিছু পশ্চিমী শিষ্য- শিষ্যা জুটিয়েই থাকেন। সুতরাং আজ যদি কেউ দাবি করেন, “নস্ট্রাডামুস এই কবিতা স্বামী বিবেকানন্দের আবির্ভাবের কথা বলেছিলেন”, অন্য কেউ নিশ্চয়ই একই যুক্তিতে পাল্টা দাবি করতে পারেন, “ভবিষ্যদ্বাণীটি করা হয়েছিল মহেষযোগীকে লক্ষ্য করে।” অতএব ? এখানেও সেই একই মুস্কিল—যার সঙ্গে খুশি তার সঙ্গেই শ্লোকটাকে জুড়ে দেওয়া যায় ।

 

error: Content is protected !!