হযরত আবূ সাঈদ ইব্ন মু’আল্লা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে হাফস ইব্ন আসিম, খুবায়েব ইব্ন আবদুর রহমান, শু‘বা, ইয়াহ্ইয়া ইবন সাঈদ ও ইমাম আহমদ বর্ণনা করেনঃ
“হযরত আবূ সাঈদ (রাঃ) বলেন- একদিন আমার নামাযরত অবস্থায় নবী করীম (সাঃ) আমাকে ডাকিলেন। আমি তাঁহার ডাকে সাড়া না দিয়া নামায পড়িতে থাকিলাম। নামায শেষ করিয়া তাঁহার নিকট আসিলে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন- ডাকার সঙ্গে সঙ্গে তুমি আসিলে না কেন? আমি আরয করিলাম ইয়া রাসূলাল্লাহ্ ! আমি নামায পড়িতেছিলাম। তিনি প্রশ্ন করিলেন- আল্লাহ তা’আলা কি বলেন নাই;
يُأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَجِيبُوا لِلَّهِ وَالرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمْ لِمَا يُحْيِيكُمْ
হে মু’মিনগণ ! আল্লাহ্ ও রাসূল যখন তোমাদিগকে জীবনদায়ক কোন কিছুর দিকে আহবান করিবে তখন তোমরা তাঁহাদের ডাকে সাড়া দিবে।
আমি চুপ থাকিলাম। অতঃপর তিনি বলিলেন, ‘মসজিদ হইতে তোমার বাহির হইবার পূর্বেই আমি তোমাকে অবশ্যই কুরআন মজীদের শ্রেষ্ঠতম সূরা চিনাইয়া দিব।’ এই বলিয়া তিনি আমার হাত ধরিয়া মসজিদ হইতে বাহির হইবার আয়োজন করিলেন। আমি আরয করিলাম, হে আল্লাহর রাসূল ! আপনি তো বলিয়াছেন, (মসজিদ হইতে নিষ্ক্রমণের পূর্বেই) আমাকে কুরআন মজীদের শ্রেষ্ঠতম সূরা চিনাইয়া দিবেন। তিনি বলিলেন- হ্যাঁ। উহা হইতেছে الْحَمَدٌ للّه رب الْعَالَمِيْنَ এবং উহাই ‘আসাবউল মাছানী’ ও ‘আল-কুরআনুল আযীম’।
ইমাম বুখারী (রঃ) উক্ত হাদীসটি উপরোল্লিখিত রাবী ইয়াহিয়া ইব্ন সাঈদ আল কাত্তান হইতে উপরোক্ত সনদে এবং তাঁহার নিকট হইতে মুসাদ্দাদ ও আলী ইব্ন মাদানীর মাধ্যমে ভিন্ন সনদে বর্ণনা করিয়াছেন।
অন্যত্র ইমাম বুখারী, ইমাম আবূ দাউদ, ইমাম নাসাঈ ও ইমাম ইব্ন মাজাহ উপরোক্ত হাদীসটি উহার অন্যতম রাবী শু’বা হইতে উক্ত সনদে এবং তাহা হইতে অন্যান্য বিভিন্ন রাবীর মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন সনদে বর্ণনা করিয়াছেন।
উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ সাঈদ ইব্ন মু’আল্লা, হাস ইব্ন আসিম, খুবায়ব ইব্ন আব্দুর রহমান, মুহাম্মদ ইব্ন মু’আয আনসারী এবং ওয়াকিদীও উপরোক্ত হাদীসটি অনুরূপ বর্ণনা করিয়াছেন।
ইবন আমের ইবন কুরায়ের গোলাম আবূ সাঈদ হইতে ধারাবাহিকভাবে আ’লা ইব্ন আব্দুর রহমান ইব্ন ইয়াকূব আল খারকী এবং ইমাম মালিক (রঃ) বর্ণনা করেনঃ
‘একদিন মসজিদে নববীতে হযরত উবাই ইবন কা’বের নামায আদায়ের অবস্থায় রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তাঁহাকে ডাকিলেন। নামায শেষ করিয়া তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হইলেন। উবাই ইবন কা’ব বলেন, নবী করীম (সাঃ) তাঁহার হাত আমার হাতের উপর রাখিলেন। তখন তিনি মসজিদ হইতে বাহিরে যাইতেছিলেন। আমার হাতে হাত রাখিয়া তিনি বলিলেন, ‘আমি তোমাকে এইরূপ একটি সূরা অবহিত করিব যাহার সমতুল্য সূরা না তাওরাতে, না ইন্জীলে, না কুরআনে নাযিল হইয়াছে। আশা করি উহার পূর্বে তুমি মসজিদ হইতে বাহির হইবে না।’ আমি তাঁহার আশায় গতি মন্থর করিলাম। কিছুক্ষণ পর আরয করিলাম, হে আল্লাহর রাসূল ! আমাকে কোন্ সূরা জানাইবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন? তিনি প্রশ্ন করিলেন, “নামাযের শুরুতে তোমরা কোন সূরা তিলাওয়াত কর?’ আমি তাঁহাকে আলহামদু লিল্লাহ্ সূরাটি শেষ পর্যন্ত শুনাইলাম। তিনি তখন বলিলেন, উহা হইতেছে এই সূরা। উহাই ‘আস্ সাবউল মাছানী’ এবং আমার প্রতি অবতীর্ণ ‘আল-কুরআনুল আযীম।’
এখানে উল্লেখ্য যে, ইমাম মালিক কর্তৃক বর্ণিত উপরোক্ত হাদীসের অন্যতম রাবী আবূ সাঈদ এবং তৎপূর্বে বর্ণিত হাদীসের রাবী আবূ সাঈদ ইব্ন মু’আল্লা একই ব্যক্তি নহেন। ইবনুল আছীর তাঁহার ‘জামিউল উসূল’ গ্রন্থে উভয় আবূ সাঈদকে একই বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। প্রকৃতপক্ষে প্রথমোক্ত আবূ সাঈদ হইতেছেন একজন আনসার সাহাবা। পক্ষান্তরে শেষোক্ত আবূ সাঈদ হইলেন একজন তাবেঈ এবং খুযাআ গোত্রের একজন গোলাম। প্রথমোক্ত হাদীসটি অবিচ্ছিন্ন সনদে বর্ণিত হাদীস। পক্ষান্তরে শেষোক্ত হাদীসের রাবী আবূ সাঈদ তাবেঈ হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ)-এর সহিত সাক্ষাত লাভ করিবার এবং তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শুনিবার সুযোগ ঘটিয়া না থাকিলে উহা বিচ্ছিন্ন সনদের (حديث منقطع) হাদীসে পরিণত হইবে। যদি অনুরূপ সুযোগ ঘটিয়া থাকে, তাহা হইলে উহা ইমাম মুসলিম কর্তৃক হাদীসের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কিত নির্ধারিত শর্তসমূহে উত্তীর্ণ সহীহ ও অবিচ্ছিন্ন সনদের (حديث منقطع) হাদীস বলিয়া বিবেচিত হইবে। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
উক্ত হাদীস হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) হইতে একাধিক সূত্রে বর্ণিত হইয়াছে। নিম্নোক্ত সূত্রেও উক্ত হাদীস হযরত উবাই ইব্ন কা’ব (রাঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছে।
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবদুর রহমান, আ’লা ইব্ন আবদুর রহমান, আবদুর রহমান ইব্ন ইবরাহীম, ‘আফ্ফান এবং ইমাম আহমদ বর্ণনা করেনঃ
একদিন হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) মসজিদে নামায আদায় করিতেছিলেন। নবী করীম (সাঃ) তাহার নিকট আসিয়া ডাকিলেন, ‘হে উবাই’। উবাই (রাঃ) নবী করীম (সাঃ)-এর প্রতি আড়চোখে তাকাইলেন, কিন্তু কোন সাড়া দিলেন না। তিনি তাড়াতাড়ি নামায সারিয়া নবী করীম (সাঃ)-এর খেদমতে হাযির হইয়া আরয করিলেন- আস্লামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ্ ! নবী করীম (সাঃ) জবাবে বলিলেন, ওয়া আলাইকাস্সালাম, হে উবাই, তুমি আমার ডাকে সাড়া দিলে না কেন? তিনি আরয করিলেন— ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ্ ! আমি নামাযে ছিলাম।’ নবী করীম (সাঃ) বলিলেন, আমার কাছে আল্লাহ্ তা’আলা যেই সব বাণী পাঠাইয়াছেন তাহাতে কি তুমি এই আয়াত দেখ নাইঃ
يايُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اسْتَجِبُوا لِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمْ لِمَا يُحْيِيكُمْ
‘হে মু’মিনগণ ! যাহা তোমাদিগকে জীবন দান করিবে তাহার দিকে আল্লাহ্ ও তাঁহার রাসূল তোমাদিগকে আহ্বান করিলে তোমরা উহাতে সাড়া দিবে।’ তিনি আরয করিলেন, হ্যাঁ, ইয়া রাসূলাল্লাহ্, পুনরায় এইরূপ করিব না। নবী করীম (সাঃ) বলিলেন, তুমি ইহা পছন্দ কর যে, আমি তোমাকে এমন একটি সূরা জানাইয়া দিব যাহার সমকক্ষ সূরা না তাওরাতে, না ইঞ্জীলে, না যবূরে, না কুরআনে নাযিল হইয়াছে? উবাই (রাঃ) বলেন, আমি মসজিদ হইতে বাহির হইবার পূর্বেই আমি তোমাকে উহা জানাইব।’ অতঃপর নবী করীম (সাঃ) আমার হাত ধরিয়া কথা বলিতে বলিতে মসজিদের দরজার দিকে আসিতে লাগিলেন। কথা বলা শেষ হইবার পূর্বেই যেন তিনি মসজিদের দরজায় পৌঁছিয়া না যান সেইজন্য আমি গতি মন্থর করিলাম। দরজার নিকট পৌছিয়া আমি আরয করিলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ্, যে সূরাটি আমাকে জানাইবেন বলিয়া কথা দিয়াছিলেন উহা কোন সূরা? নবী করীম (সাঃ) প্রশ্ন করিলেন- নামাযের শুরুতে কোন্ সূরা পড়?’ আমি তাঁহাকে ‘উম্মুল কুরআন’ পড়িয়া শুনাইলাম। তিনি তখন বলিলেন— যে সত্তার হাতে আমার প্রাণ রহিয়াছে তাঁহার শপথ ! উহার সমকক্ষ সূরা আল্লাহ্ তা’আলা -না তাওরাতে, না ইঞ্জীলে, না যাবূরে, না কুরআনে নাযিল করিয়াছেন। উহা হইতেছে ‘আস্ সাবউল মাছানী’ (নিত্যপাঠ্য বাণীসপ্তক)।
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে ক্রমাগত আবদুর রহমান, আ’লা ইব্ন আবদুর রহমান, দারোয়াদী, কুতায়বা এবং ইমাম তিরমিযীও উপরোক্ত হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। উহাতে অবশ্য এইরূপ বর্ণিত হইয়াছেঃ
‘নবী করীম (সাঃ) বলিলেন, উহা হইতেছে আমাকে প্রদত্ত ‘আস্ সাবউল মাছানী’ ও আল-কুরআনুল আযীম।’
ইমাম তিরমিযী উক্ত হাদীসকে حديث حسن صحيح (হাসান সহীহ হাদীস) নামে আখ্যায়িত করিয়াছেন। হযরত আনাস ইবন মালিক (রাঃ) হইতেও অনুরূপ একটি হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ হুরায়রা (রাঃ), আবদুর রহমান, আ’লা ইব্ন আবদুর রহমান, আবদুল হামীদ ইব্ন জা’ফর, আবূ উসামা, ইসমাঈল ইব্ন আবূ মুআম্মার এবং আবদুল্লাহ্ ইব্ন ইমাম আহমদও উপরোক্ত হাদীস অনুরূপ বা প্রায় অনুরূপভাবে বর্ণনা করিয়াছেন। হযরত উবাই ইব্ন কা’ব (রাঃ) হইতে ক্রমাগত হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ), আবদুর রহমান,’আ’লা ইব্ন আবদুর রহমান, আবদুল হামীদ ইব্ন জাফর, ফযল ইব্ন মূসা, আবূ আম্মার হুসায়ন ইব্ন হারিছ, ইমাম তিরমিযী ও ইমাম নাসাঈ বর্ণনা করিয়াছেনঃ
‘নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, উম্মুল কুরআনের সমতুল্য সূরা আল্লাহ্ তা’আলা না তাওরাতে, না ইঞ্জীলে নাযিল করিয়াছেন। উহা হইতেছে ‘আস্ সাবউল মাছানী। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, উহা আমার ও আমার বান্দার মধ্যে আধাআধি করিয়া বিভক্ত।’
ইমাম তিরমিযী উহাকে একটিমাত্র সনদে বর্ণিত বিশেষ নিয়মে গ্রহণযোগ্য হাদীস (حديث حسن غريب) বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন। হযরত ইব্ন জাবির (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবদুল্লাহ্ ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ন আকীল, হাশিম ইবন ফরীদ, মুহাম্মদ ইব্ন উবায়দ এবং ইমাম আহমদ বর্ণনা করেনঃ
হযরত ইবন জাবির (রাঃ) বলেন, আমি একদিন নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট গেলাম। তিনি তখন সবেমাত্র প্রাতঃক্রিয়া সম্পন্ন করিয়াছেন। আমি বলিলাম- আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ্। তিনি কোন উত্তর দিলেন না। এইরূপে তিনবার তাঁহাকে সালাম দিলাম ৷ কিন্তু তিনি কোন উত্তর দিলেন না। তিনি শুধু হাঁটিতেছিলেন। আমি তাঁহাকে অনুসরণ করিতেছিলাম। এক ফাঁকে তিনি বাড়ীর ভিতরে চলিয়া গেলেন। আমি মসজিদে গিয়া উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত অবস্থায় বসিয়া রহিলাম। কিছুক্ষণ পর তিনি পবিত্রতা অর্জন করিয়া আমার নিকট আসিয়া আমাকে তিনবার বলিলেন- ওয়ালাইকাস্ সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। অতঃপর বলিলেন, ওহে আবদুল্লাহ্ ইব্ন জাবির ! তোমাকে কি কুরআনের শ্রেষ্ঠতম সূরাটি অবহিত করিব? আমি আরয করিলাম, হে আল্লাহ্র রাসূল, হ্যাঁ। তিনি বলিলেন, ‘আল্হামদু সূরাটি শেষ পর্যন্ত তিলাওয়াত কর।
উক্ত হাদীসের সনদ উত্তম। উহার অন্যতম রাবী ইব্ন আকীলকে বড় বড় ইমামগণ গুরুত্ব দিয়া থাকেন এবং তাঁহার বর্ণিত হাদীসকে প্রামাণ্য দলীল হিসাবে বিবেচনা করিয়া থাকেন। হযরত আবদুল্লাহ্ ইব্ন জাবির (রাঃ) সম্পর্কে ইবনুল জাওযী বলেন, তিনি আবদুল্লাহ্ ইব্ন জাবির আল ‘আবদী। আল্লাহ্ই ভাল জানেন। হাফিজ ইব্ন আসাকির উল্লেখ করিয়াছেন, কেহ কেহ বলেন, তিনি হইলেন আবদুল্লাহ্ ইব্ন জাবির আল আনসারী আল বিয়াযী।
উপরোক্ত হাদীসও অনুরূপ অন্যান্য হাদীস দ্বারা অনেক আহলে ইলম প্রমাণ করেন যে, কুরআন মজীদের সকল আয়াত ও সকল সূরার মর্যাদা সমান নহে। বরং এক আয়াত অপর আয়াত অপেক্ষা এবং এক সূরা অপর সূরা অপেক্ষা অধিকতর ফযীলত ও মর্তবার অধিকারী এই মতাবলম্বীদের মধ্যে ইসহাক ইব্ন রাহবিয়াহ্, আবূ বকর ইবনুল আরাবী, ইব্ন হিফার প্রমুখ মালেকী মাযহাবের আহলে ইমামগণের নাম উল্লেখযোগ্য। পক্ষান্তরে এক জামা’আত আহলে ইল্ম বলেন, কুরআন মজীদের কোন আয়াত অন্য আয়াত অপেক্ষা কিংবা কোন সূরা অন্য সূরা অপেক্ষা অধিকতর ফযীলত বা মর্যাদার অধিকারী নহে; বরং উহার সকল আয়াত ও সকল সূরা সমান ফযীলত ও মর্তবার অধিকারী। কারণ, সবই আল্লাহ্ তা’আলার বাণী। অধিকন্তু, এইরূপ পার্থক্য মানিয়া লইলে, যে আয়াত বা সূরাকে অধিকতর মর্যাদা ও ফযীলতের মনে করা হইবে, উহা ভিন্ন অন্যান্য আয়াত ও সূরাকে কম মর্যাদার মনে করা হইবে। ইহার ফলে মানুষের মনে কুরআন মজীদের সামগ্রিক মর্যাদাবোধ হ্রাস পাইবে।
ইমাম কুরতুবী বলেন, আল্ আশ্আরী, আবূ বকর বাকিল্লানী, আবূ হাতিম ইব্ন হাব্বান আল-বাস্তী, আবূ হাইয়ান ও ইয়াহ্ইয়া ইব্ন ইয়াহ্ইয়া শেষোক্ত অভিমতের প্রবক্তা ছিলেন। স্বয়ং ইমাম মালিক হইতেও অনুরূপ একটি অভিমত বর্ণিত হইয়াছে।
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে মুহাম্মদ ইব্ন মা’বাদ, হিশাম, ওয়াহাব ও মুহাম্মদ ইব্ন মুছান্নার বর্ণনার ভিত্তিতে ইমাম বুখারী স্বীয় ‘ফাযায়েলুল কুরআন’ অধ্যায়ে বর্ণনা করেনঃ
‘হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, আমরা একবার সফরের অবস্থায় যাত্রা বিরতি করিলাম ৷ সেখানে একটি মেয়ে আসিয়া আমাদিগকে বলিতে লাগিল, ‘এই গোত্রের সর্দারকে সাপে কামড়াইয়াছে। আমাদের লোকজন বাড়ীতে নাই। আপনাদের মধ্যে কেহ ঝাড়ফুঁক জানেন কি?’ ইহা শুনিয়া আমাদের একজন তাহার সঙ্গে গেল। সে ঝাড়ফুঁক জানে বলিয়া আমাদের জানা ছিল না। অথচ তাহার ঝাড়ফুঁকের ফলে সর্পদষ্ট লোকটি বিষমুক্ত হইয়া গেল। লোকটি তাহাকে ত্রিশটি বকরী পুরস্কার দিল এবং আমাদের সকলকে দুধ পান করাইল। আমরা সেই সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করিলাম- তুমি কি ঝাড়ফুঁক জান? ইহার পূর্বে তুমি কি ওঝাগিরি করিয়াছ? সে বলিল, আমি তো শুধু উম্মুল কুরআন পড়িয়া ঝাড়িয়াছি। আমরা পরস্পর বলাবলি করিলাম, ‘নবী করীম (সাঃ)-এর খেদমতে পৌছিয়া তাঁহার মতামত জানার পূর্বে এ সম্পর্কে কোন মন্তব্য করা ঠিক হইবে না।’
অতঃপর আমরা মদীনায় পৌছিয়া নবী করীম (সাঃ)-এর সমীপে উক্ত ঘটনা বর্ণনা করিলাম। তিনি বলিলেন, সে কি করিয়া জানিল যে, উহা দ্বারা ঝাড়ফুঁক করিলে রোগ সারে? তোমরা সকলে (বকরীগুলি) ভাগ করিয়া লও এবং আমাকেও একভাগ দাও।’
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হইতে ক্রমাগত মা’বাদ ইব্ন সীরীন, মুহাম্মদ ইব্ন সীরীন, হিশাম, আবদুল ওয়ারিছ এবং আবূ মুআম্মারও উপরোক্ত হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন।
ইমাম মুসলিম এবং ইমাম আবূ দাউদও হাদীসটি উপরোল্লিখিত রাবী ইব্ন সীরীন হইতে উপরোক্ত উর্ধ্বতন সনদাংশে এবং ইবন সীরীন হইতে হিশাম ইব্ন হাস্সান প্রমুখ রাবীর মাধ্যমে অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম মুসলিম কর্তৃক বর্ণিত কোন কোন রিওয়ায়েত অনুযায়ী স্বয়ং আবূ সাঈদ سليم (নিরাপদ) নামে আখ্যায়িত করিয়া থাকে।
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ক্রমান্বয়ে সাঈদ ইব্ন জারীর, আবদুল্লাহ্ ইব্ন ঈসা ইবন আবদুর রহমান ইব্ন আবূ লায়লা, আম্মার ইবন যারীক এবং আবুল আহওয়াস সালাম ইবন সালীম প্রমুখ রাবীর বর্ণনা সূত্রে ইমাম মুসলিম ও ইমাম নাসাঈ (রঃ) বর্ণনা করেনঃ
‘একদা নবী করীম (সাঃ)-এর সহিত হযরত জিবরাঈল (আঃ) উপবিষ্ট ছিলেন। এমন সময়ে উপর হইতে একটি উচ্চ শব্দ নবী করীম (সাঃ)-এর কানে আসিল। হযরত জিবরাঈল (আ) উপরের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, ইহা আকাশে একটি সদ্য উন্মুক্ত দ্বারের আওয়াজ। ইতিপূর্বে উহা কখনও উন্মুক্ত হয় নাই। অতঃপর উহার মধ্য দিয়া একজন ফিরিশতা অবতীর্ণ হইলেন। তিনি নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট আসিয়া বলিলেন, আপনাকে দুইটি নূর প্রদানের সুসংবাদ গ্রহণ করুন। ইতিপূর্বে কোন নবীকে উহা প্রদান করা হয় নাই। উহাদের একটি হইতেছে ‘ফাতিহাতুল কিতাব’ ও অপরটি হইল ‘সূরা বাকারার শেষ আয়াতসমূহ।’ উহার যে অংশটিই আপনি পড়িবেন, তদ্বারা প্রার্থিত যে কোন বিষয় আপনাকে প্রদান করা হইবে। (সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহে আল্লাহ্ তা’আলার নিকট নিবেদনযোগ্য অতীব প্রয়োজনীয় বিভিন্ন প্রার্থনা বর্ণিত হইয়াছে।)
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আ’লা ইব্ন আবদুর রহমান ইব্ন ইয়াকুব আল খারকী, সুফিয়ান ইব্ন উয়াইনা, ইসহাক ইব্ন ইবরাহীম আল-হানযালী অথবা ইসহাক ইব্ন রাহবিয়াহ এবং ইমাম মুসলিম (রঃ) বর্ণনা করেনঃ
“নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, যে ব্যক্তি উম্মুল কুরআন বর্জিত কোন নামায পড়ে, তাহার সেই নামায অসম্পন্ন, অসম্পন্ন, অসম্পন্ন।
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ)-কে (উক্ত হাদীসের পরিপ্রেক্ষিতে) একজন বলিলেন, ‘আমরা তো ইমামের পেছনে নামায পড়ি।’ তিনি বলিলেন, তথাপি মনে মনে উহা পাঠ কর। কারণ, আমি নবী করীম (সাঃ)-কে বলিতে শুনিয়াছি, আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ সূরা সালাতকে আমি আমার ও বান্দার মধ্যে আধাআধি করিয়া ভাগ করিয়া দিয়াছি। আমার বান্দা যাহা চায় তাহা তাহাকে প্রদান করা হয়। যখন সে বলে- أَلْحَمْدُ لله رب الْعَالَمِييْنَ তখন আল্লাহ্ বলেন- বান্দা আমার প্রশংসা করিয়াছে। যখন সে বলে, الرَحْمْن الرحيم তখন আল্লাহ্ বলেন- বান্দা আমার গুণ বর্ণনা করিয়াছে। যখন সে বলে, مالك يوم الدَيُن তখন আল্লাহ্ বলেন, বান্দা আমার মাহাত্ম্য বর্ণনা করিয়াছে।
(হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) একবারের বর্ণনায় ‘বান্দা আমার মাহাত্ম্য বর্ণনা করিয়াছে’ স্থলে ‘বান্দা আমার নিকট আত্মসমর্পণ করিয়াছে’ বলা হইয়াছে।)
যখন সে বলে اياك نعبد واياك نُسَّعيْنْ তখন আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, ইহা আমার ও বান্দার ভিতর জড়িত বিষয়। তাই বান্দা যাহা চাহিয়াছে, তাহা সে পাইবে। অবশেষে যখন সে বলে-
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ – صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ – غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِينَ .
তখন আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, ইহা আমার বান্দার অংশ। আমার বান্দা যাহা চাহিয়াছে, তাহা সে পাইবে।” ইমাম নাসাঈও উপরোক্ত হাদীসটি ইসহাক ইব্ন রাহবিয়ার মাধ্যমে বর্ণনা করিয়াছেন।
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে হিশাম ইবন যুহরার গোলাম আবূ সায়েব, আ’লা ইব্ন আবদুর রহমান, মালিক ও কুতায়বা উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেন। একই সনদে ইমাম মুসলিম এবং ইমাম নাসাঈও উপরোক্ত হাদীসটি বর্ণনা করিয়াছেন। ইবন ইসহাক ও আ’লা ইব্ন আবদুর ইব্ন ইয়াকূব আল খারকী, আবূ সায়েব, ‘আলা ইব্ন আবদুর রহমান ও ইব্ন আবূ উয়ায়য প্রমুখ রাবীর বরাত দিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।
ইমাম তিরমিযীর মতে উহা حديث حسن বিশেষ নিয়মে গ্রহণযোগ্য হাদীস। তিনি এই সম্পর্কে আরও বলিয়াছেন যে, ‘আমি একদিন আমার উস্তাদ আবূ যুহরার নিকট উক্ত হাদীস সম্পর্কে প্রশ্ন করায় তিনি বলিলেন, হাদীসটির উভয় সনদই শুদ্ধ। আবদুর রহমান হইতে’ আলা ইব্ন আবদুর রহমানের সনদ যেরূপ সহীহ, তেমনি সহীহ আবূ সায়েব হইতে আ’লা ইবন আবদুর রহমানের সনদ।
হযরত উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ), আবদুর রহমান ইব্ন ইয়াকূব আল খারকী, আ’লা ইব্ন আবদুর রহমান প্রমুখ রাবীর সনদে আবদুল্লাহ্ ইব্ন ইমাম আহমদও উক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেন।
হযরত জাবির ইব্ন আবদুল্লাহ্ (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে কা’ব ইবন উজরাহ, সাঈদ ইব্ন ইসহাক, মুতরাফ ইব্ন তরীফ, আম্বাস ইব্ন সাঈদ, যায়দ ইব্ন হাব্বাব, সালেহ ইব্ন মিসমার আল মারূযী ও ইমাম ইবন জারীর বর্ণনা করেনঃ
‘নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন যে, আল্লাহ্ তা’আলা ফরমাইয়াছেন, আমি (সূরা) সালাতকে আমার ও আমার বান্দার মধ্যে আধাআধি করিয়া ভাগ করিয়া দিয়াছি। সে যাহা চাহিবে তাহা সে পাইবে।’ তাই যখন বান্দা বলেঃ ألْحَمْدُ لله رب الْمَالَمِيْنَ আল্লাহ্ তা’আলা তখন বলেন, বান্দা আমার প্রশংসা করিতেছে। যখন সে বলেঃ الرَحْمْن الرحيم তখন আল্লাহ্ পাক বলেন আমার বান্দা আমার গুণ বর্ণনা করিতেছে। যখন সে বলেঃ مالك يوم الدَيُن তখন আল্লাহ্ বলেন, ইহা আমার প্রাপ্য অংশ। সূরার অবশিষ্টাংশ তাহার প্রাপ্য।’ উপরোক্ত হাদীসটি উল্লিখিত সনদ ভিন্ন অন্য কোন সনদে বর্ণিত হয় নাই ৷