(۲۱)
یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اعۡبُدُوۡا رَبَّكُمُ الَّذِیۡ خَلَقَكُمۡ وَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُوۡنَ
(۲۲)
الَّذِیۡ جَعَلَ لَكُمُ الۡاَرۡضَ فِرَاشًا وَّ السَّمَآءَ بِنَآءً ۪ وَّ اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَخۡرَجَ بِهٖ مِنَ الثَّمَرٰتِ رِزۡقًا لَّكُمۡ ۚ فَلَا تَجۡعَلُوۡا لِلّٰهِ اَنۡدَادًا وَّ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ
২১. হে মানব! তোমরা ইবাদত কর সেই প্রতিপালকের যিনি তোমাদিগকে ও তোমাদের পূর্বপুরুষগণকে সৃষ্টি করিয়াছেন; হয়ত তোমরা মুত্তাকী হইতে পারিবে।
২২. অনন্তর তিনিই পৃথিবীকে তোমাদের জন্য বিছানা ও আকাশকে ছাদ স্বরূপ গড়িয়াছেন এবং আকাশ হইতে পানি বর্ষণ করিয়া তোমাদের জীবিকার জন্য ফল-মূল উৎপাদন করেন। অতএব জানিয়া শুনিয়া কাহাকেও আল্লাহর সমকক্ষ করিও না।
তাফসীরঃ উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ পাক তাঁহার একত্ব ও প্রভুত্বের বর্ণনা দিয়াছেন। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার সৃষ্টিকুলকে অনস্তিত্ব হইতে অস্তিত্ববান করিয়া নিজ বান্দাদের প্রতি বদান্যতার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছেন। তিনি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নানাবিধ নি‘আমাত দান করিয়া তাহাদিগকে ধন্য করিয়াছেন। পৃথিবীকে বিছানার মত আরামদায়ক করিয়া উহার বিভিন্নস্থানে পাহাড়-পর্বত স্থাপন পূর্বক সুস্থির ও অবিচলরূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। তেমনি আকাশকে তিনি তাহাদের জন্য ছাদরূপে গড়িয়া রাখিয়াছেন। তাই আল্লাহ্ তা’আলা কুরআন পাকের অন্যত্র বলেনঃ
وَجَعَلْنًا السَّمَاءَ سَقْفًا مَحْفُوْظًا وَهُمْ مَنْ ايَاتهًا مُعْرضون “আমি আকাশকে সুরক্ষিত ছাদরূপে গড়িয়া রাখিয়াছি। অথচ তাহারা উক্ত নিদর্শনাবলী হইতে ঘাড় ফিরাইয়া নেয়।”
পূর্বোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা আকাশ হইতে পানি বর্ষণ বলিতে ভূ-পৃষ্ঠের প্রয়োজনের সময় মেঘ হইতে বৃষ্টি বর্ষণের কথা বুঝাইয়াছেন । তিনি মেঘ হইতে বারি সিঞ্চনের সাহায্যে ক্ষেত-খামারের ফসল ও বাগ-বাগিচায় ফল-মূল উৎপন্ন করেন। উহাই মানবকুল ও পশুপাখীর জীবিকায় পরিণত হয় । এই ব্যাপারটি কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখিত হইয়াছে। যেমন আল্লাহ্ পাক বলেনঃ
الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضِ قَرَارًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَصَوَّرَكُمْ فَأَحْسَنَ صُوَرَكُمْ ورزقَكُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ ذَالِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ . فَتَبَارَكَ اللهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ
“তিনিই তোমাদের জন্য পৃথিবীকে সুস্থিররূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন এবং আকাশকে গড়িয়াছেন ছাদরূপে। অতঃপর তোমাদিগকে সুন্দর আকৃতিতে সৃষ্টি করিয়াছেন। আর বিভিন্ন ভাল ভাল সুস্বাদু খাবার সরবরাহ করিয়াছেন। এই হইলেন তোমাদের আল্লাহ্। অনন্তর বড়ই মেহেরবান সেই নিখিল সৃষ্টির মহান প্রতিপালক।”
বস্তুত এই সকল আয়াতের সারকথা হইল যে, আল্লাহ্ তা’আলাই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও রিযিকদাতা। সমগ্র বিশ্বময় বসবাসকারী জীবকুল ও ছড়ানো সীমাহীন সম্পদের একমাত্ৰ প্ৰভুত্ব ও মালিকানা তাঁহারই। সুতরাং তিনিই ইবাদত লাভের একমাত্র অধিকারী এবং অন্য কাহারও ইহাতে বিন্দুমাত্র অংশ নাই। তাই আল্লাহ্ তা’আলা আলোচ্য আয়াতে নির্দেশ দিলেনঃ
قلا تَجَعَلُوَا لله أَنْدَادًا و أَنْكُم تَعْلّمُونَ “সুতরাং তোমরা জানিয়া শুনিয়া কাহাকেও আল্লাহ্ তা’আলার অংশীদার বানাইও না।”
বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হইয়াছেঃ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) বলেন-আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ্ তা’আলার কাছে সর্বাপেক্ষা বড় পাপ কোনটি? রাসূল (সাঃ) জবাব দিলেন-আল্লাহ্ তা’আলার সহিত কাহাকেও অংশীদার করা এবং কোন দিক দিয়া কাহাকেও তাঁহার সমকক্ষ ভাবা। অথচ তিনিই তোমাদের সৃষ্টিকর্তা (অসামপ্ত)।
তেমনি মু’আয (রাঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ
নবী করীম (সাঃ) প্রশ্ন করিলেন-তোমরা জান কি, বান্দার কাছে আল্লাহ্ তা’আলার বড় দাবী কি? অতঃপর বলিলেন—তাহা হইল একমাত্র তাঁহারই ইবাদত করা এবং কোনভাবেই কাহাকেও তাঁহার অংশীদার না করা।
অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হইয়াছেঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন-তোমরা কখনও এইরূপ বলিও না, আল্লাহ্ ও অমুক যাহা চাহেন, বরং এইরূপ বল, ‘যাহা আল্লাহ্ চাহেন’ অথবা ‘যাহা অমুক চাহেন।’
তোফায়েল ইব্ন সাখবারাহ (উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা সিদ্দীকার বৈপিত্রেয় ভাই) হইতে যথাক্রমে রবী’ ইবন হারাশ, আব্দুল মালিক ইবন উমায়র ও হাম্মাদ ইবন সালামা বর্ণনা করেনঃ
তোফায়েল ইব্ন সাখবারাহ বলেন-আমি একদিন স্বপ্নে একদল লোক দেখিতে পাইয়া প্ৰশ্ন করিলাম-তেমিরা কাহারা? তাহারা জবাব বলিল-আমরা ইয়াহুদী। অতঃপর আমি প্রশ্ন করিলাম-তোমরা উযায়রকে আল্লাহর পুত্র বল কেন? তাহারা পাল্টা প্রশ্ন করিল-‘তোমরা ‘আল্লাহ্ যাহা চাহেন ও মুহাম্মদ যাহা চাহেন বল কেন? অতঃপর আরেকদল লোক দেখিতে পাইয়া প্রশ্ন করিলাম-তোমরা কাহারা? তাহারা জবাবে বলিল-আমরা খৃস্টান। আমি প্রশ্ন করিলাম-তোমরা ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহ্ পুত্র বল কেন? তাহারা পাল্টা প্রশ্ন করিল-তোমরা আল্লাহ্ ও মুহাম্মদ যহাা চাহেন’ বল কেন? অতঃপর সকাল বেলা আমি কয়েকজনকে এই স্বপ্নের কথা বলিলাম এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট আসিয়া সম্পূর্ণ স্বপ্ন বিবৃত করিলাম। রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞাসা করিলেন-তুমি এই স্বপ্ন আর কাহাকেও শুনাইয়াছ? আমি বলিলাম-হ্যাঁ। তখন তিনি আল্লাহ্ তা’আলার প্রসংশা করিয়া উপস্থিত সকলকে বলিলেন-এই বালক একটি স্বপ্ন দেখিয়াছে, আমি উহা তোমাদিগকে জানাইতেছি। তাহা এই, তোমরা এমন সব কথা বলিয়া থাক যাহা তোমাদেরকে বলিতে নিষেধ করা হইয়াছে। সুতরাং ‘আল্লাহ্ ও মুহাম্মদ যদি চাহেন’-এমন কথা আর কখনও বলিও না। পক্ষান্তরে এইরূপ বল-‘একমাত্র আল্লাহ্ পাকের যাহা মর্জী হয়।’
ইব্ন মারদুবিয়্যা আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় হাম্মাদ ইব্ন সালমাহ হইতে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম ইবন মাজাহও আবদুল মালিক ইবন উমায়র হইতে বর্ণিত উক্ত সনদে অনুরূপ বর্ণনা উদ্ধৃত করেন।
ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যথাক্রমে ইয়াযীদ ইবনুল আসিম ও আল্ আযলাহ ইব্ন আবদুল্লাহ আলকিন্দী ও সুফিয়ান ইব্ন সাঈদ আছছাওরী বর্ণনা করেনঃ
এক ব্যক্তি নবী করীম (সাঃ)-কে বলিল-‘আল্লাহ্ ও আপনি যাহা চাহেন।’ তখন নবী করীম (সাঃ) বলিলেন-তুমি কি আমাকে আল্লাহ্র সমতুল্য করিয়াছ? বরং এইরূপ বল, ‘একমাত্র আল্লাহ্ যাহা চাহেন ৷ ‘
ইব্ন মারদুবিয়্যাও এই হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম নাসাঈ, ইব্ন মাজাহ ও ঈসা ইব্ন ইউনুসও আযলাহ হইতে বর্ণিত সনদে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। উল্লিখিত হাদীসসমূহে আল্লাহ্ পাকের একত্বের উপর জোর দেওয়া হইয়াছে এবং তাঁহার সহিত কাহাকেও সমতুল্য অংশীদার বানাইতে নিষেধ করা হইয়াছে।
ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যথাক্রমে সাঈদ ইব্ন জুবায়র, ইকরামা, মুহাম্মদ ইব্ন আবূ মুহাম্মদ ও মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক বর্ণনা করেনঃ
‘ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলেন- আল্লাহ্ পাক يأيهًا المّاسَْ اعْبُدوا ربكم আয়াতটি কাফির ও মুনাফিক উভয় গ্রুপের জন্য নাযিল করিয়াছেন। উহাতে বলা হইয়াছে ‘তোমাদের প্রতিপালক শুধু ও তোমাদেরই সৃষ্টিকর্তা নহেন, এমনকি তোমাদের পূর্ব পুরুষদেরও সৃষ্টিকর্তা। সুতরাং তাঁহার সহিত কোন দিক দিয়া কাহাকেও শরীক করিও না এবং এককভাবে তাঁহারই প্রভুত্ব স্বীকার কর।’
فَلاْتَجِعَلُوا لله أَنْدَادًا وأنْكُم تَعْلْمُونَ আয়াতের ব্যাখ্যা ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে এইরূপ বর্ণিত হইয়াছে যে, ‘আল্লাহ্ সহিত অন্য কাহাকেও শরীক করিও না এবং কাহাকেও তাঁহার সমতুল্য ভাবিও না। কারণ, তাহারা তোমাদের ক্ষতি বা উপকার কোনটাই করিতে পারে না। তাহারা তোমাদের প্রতিপালকও নহে এবং তোমাদিগকে ও অন্যান্যকে জীবিকাও সরবরাহ করিতে পারে না। তোমরাও একথা ভালভাবেই জান। তোমরা ইহাও ভাল করিয়া জান যে, আল্লাহর রাসূল তোমাদিগকে যে নির্ভেজাল একত্ববাদের আহ্বান জানাইতেছেন, তাহার সত্যতা সম্পর্কে লেশমাত্র সন্দেহের অবকাশ নাই।”
কাতাদাহও আলোচ্য আয়াতের অনুরূপ ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছেন। হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যথাক্রমে ইকরামা, শাবীব ইব্ন বাশার, আবূ আসিম, আবূ যিহাক ইব্ন মুখাল্লাদ, আবূ আমর, আহমদ ইবন আমর ইব্ন আবূ আসিম ও ইব্ন আবূ হাতিম বর্ণনা করেনঃ
فَلاْتَجعَلُوا لله أمداد আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলেন-রাতের আঁধারে কাঁকর বিছানো পথে চলমান পিপীলিকার চাইতেও শির্ক অতিশয় গুপ্ত ও সূক্ষ্ম জিনিস। মানুষ বলিয়া থাকে, ‘আল্লাহ্র কসম ও তোমার জীবনের কসম! এই কুকুরটি না থাকিলে আমার ঘরে চোর আসিত এবং ঘরে হাঁসগুলি না থাকিলে সবকিছু চুরি হইয়া যাইত, ইত্যাদি। এইগুলি শিরিকী কথা এবং আল্লাহ্ সহিত শরীক করার শামিল। ‘যাহা আল্লাহ্ চাহেন ও যাহা তুমি চাহ’—এই ধরনের বাক্যও শিরিকী বাক্য এবং তাওহীদের পরিপন্থী। ‘আল্লাহ্ না হইলে এবং তুমি না হইলে (আমার সর্বনাশ হইত)’—এইরূপ কথাও শিরিকী কথা ৷
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি নবী করীম (সাঃ)-কে ‘আল্লাহ্ যাহা চাহেন এবং আপনার যাহা মর্জী হয়’ বলিলে তিনি প্রশ্ন করিলেন-তুমি কি আমাকে আল্লাহ্ সমতুল্য মনে কর?
অপর এক হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে যে, নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন-আল্লাহ্ সহিত কাহাকেও শরীক না করিলে তোমরা উত্তম জাতি। কিন্তু তোমরা এইরূপ বলিয়া থাক যে, ‘আল্লাহ্ যাহা চাহেন ও অমুকে যাহা চাহেন।’ ইহা শিরিকী বাক্য।
আবুল আলিয়্যা বলেন-‘আল্লাহর সহিত তোমরা কাহাকেও শরীক করিও না এবং কাহাকেও তাঁহার সমতুল্য ভাবিও না।’
রবী‘ ইব্ন আনাস, কাতাদাহ, সুদ্দী, আবূ মালিক, ইসমাঈল ইব্ন আবূ খালিদ প্রমুখ মনীষীগণ অনুরূপ কথাই বলিয়াছেন।
মুজাহিদ فَلاَتَجْعَلُوَا لله أَنْدَادًا وَأنْشُمْ تَعْلَمُوْنَ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলিয়াছেন-‘আল্লাহ্ তা’আলা যে একক ও অদ্বিতীয় সত্তা এবং কোন দিক দিয়া কেহ তাঁহার সমকক্ষ নহে, একথা তাওরাত ও ইঞ্জীল পাঠ করিয়াও তোমরা জানিতে পাইয়াছ। সুতরাং জানিয়া শুনিয়া কাহাকেও তাঁহার শরীক করিও না।’
ইমাম আহমদ বলেন-আমার কাছে আফ্ফান, তাঁহার কাছে আবূ খলফ মূসা ইব্ন খলফ, তাহার কাছে ইয়াহিয়া ইব্ন আবূ কাছীর, তাঁহার কাছে যায়দ ইব্ন সালাম তাহার দাদা আর হারিছুল আশআরী হইতে বর্ণনা করেনঃ
‘মহানবী (সাঃ) বলিয়াছেন-আল্লাহ্ পাক ইয়াহিয়া ইব্ যাকারিয়া (আঃ)-কে তাঁহার নিজের আমলের ও বনী ইসরাঈলদের আমল করাবার জন্য পাঁচটি কাজের আদেশ দিয়াছিলেন। হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) বেখেয়ালে তাহা বনী ইসরাঈলদের জানাইতে বিলম্ব করায় হযরত ঈসা (আঃ) তাঁহাকে বলিলেন, আল্লাহ্ পাক আপনার চলার ও বনী ইসরাঈলদের চালাবার জন্য যে পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিলেন, তাহা তো এখনও আপনি তাহাদের জানাইলেন না। উহা কি আমি তাহাদের জানাইব? তিনি বিব্রত হইয়া বলিলেন, আমিই জানাইব ৷ আপনি জানাইলে আমার ভয় হয়, আমার উপর আযাব আসিবে, হয়তো যমীন আমাকে গ্রাস করিয়া নিবে। অতঃপর ইয়াহিয়া (আঃ) বনী ইসরাঈলদের বায়তুল মুকাদ্দাসে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানাইলেন উহা জনসমাগমে পরিপূর্ণ হইল। তখন তিনি মিম্বরে উপবিষ্ট হইয়া আল্লাহ্ তা’আলার প্রশংসা জ্ঞাপন ও গুণগান করিয়া বলিলেন-আল্লাহ্ পাক আমার ও তোমাদের অনুসরণের জন্য পাঁচটি কাজের নির্দেশ প্রদান করিয়াছেন।
প্রথম কাজটি হইল, একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদত করিবে এবং কাহাকেও তাঁহার সহিত শরীক করিবে না। ইহার উদাহরণ হইল এই যে, এক ব্যক্তি রৌপ্য বা স্বর্ণের বিনিময়ে একটি ভৃত্য ক্রয় করিল এবং তাহাকে আয়-উপার্জনের কাজে নিয়োগ করিল। কিন্তু সে উপার্জিত সম্পদ নিজ প্রভুর বদলে অন্যকে দেয়। তোমরা কি ভৃত্যটির এই আচরণে সন্তুষ্ট হইতে পার? তাই যেই আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের সৃষ্টি করিয়া জীবিকার ব্যবস্থা করিতেছেন, তোমরা কেবল তাঁহারই ইবাদত কর এবং তাঁহার সহিত কাহাকেও শরীক করিও না। দ্বিতীয় কাজটি হইল নামায কায়েম করা। নামাযে যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা এদিক-সেদিক না তাকায়, ততক্ষণ আল্লাহ্ তা’আলা তাহার চেহারার দিকে তাকাইয়া থাকেন। সুতরাং তোমরা এদিক-ওদিক না তাকাইয়া মনোযোগের সহিত নামায পড়িবে। তৃতীয় নির্দেশ হইল, তোমরা রোযা রাখিবে। ইহার উদাহরণ হইল এই যে, এক ব্যক্তির নিকট একটি মিশকের পাত্র রহিয়াছে এবং তাহার সঙ্গীরা উহা হইতে সুঘ্রাণ লাভ করিতেছে। তেমনি রোযাদারের মুখ হইতে আল্লাহ্ তা’আলা মিশক হইতেও বেশী সুঘ্রাণ লাভ করেন । আল্লাহ্ পাকের চতুর্থ নির্দেশ হইল দান-সাদকা করা। ইহার উপমা এই যে, এক ব্যক্তিকে গলায় রশি লাগাইয়া হত্যা করার জন্য লইয়া যাওয়া হইতেছে। তখন সে তাহার যাহা কিছু সম্পদ আছে তাহা মুক্তিপণ হিসাবে দিয়া নিজের প্রাণ বাঁচাইল । তোমাদের প্রতি পঞ্চম নির্দেশটি হইল সর্বদা আল্লাহ্ পাকের যিকির করা। ইহার উদাহরণ হইল এইরূপ যে, এক ব্যক্তি তাহার পশ্চাতে দ্রুতগতিতে ছুটিয়া আসা শত্রুর হাত হইতে বাঁচার জন্য একটি সুরক্ষিত দুর্গে আশ্রয় নিয়া প্রাণে বাঁচিল । মানুষ আল্লাহ্র যিকিরে মশগুল হইলে শয়তানের আক্রমণ হইতে এইভাবে রক্ষা পাইয়া থাকে।
বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর মহানবী (সাঃ) বলিলেন-আমিও তোমাদের এমন পাঁচটি কাজের আদেশ দিতেছি যাহা আল্লাহ্ পাক আমাকে করিবার জন্য নির্দেশ দিয়াছেন। উহা হইল সংঘবদ্ধ থাকা, নেতার কথা শ্রবণ করা, নেতার অনুগত হওয়া, আল্লাহর জন্য হিজরত করা ও আল্লাহ্র পথে জিহাদ করা। যে ব্যক্তি সংঘবদ্ধতা ছাড়িয়া এক বিঘত দূরে সরিল, সে তাহার গর্দান হইতে ইসলামের রজ্জু ছুঁড়িয়া ফেলিল। অবশ্য ফিরিয়া আসিলে অন্য কথা। যে ব্যক্তি জাহিলিয়াতের পথে ডাকিবে, সে জাহান্নামের জ্বালানীতে পরিণত হইবে। সাহাবারা প্রশ্ন করিলেন-হে আল্লাহ্র রাসূল? যদি সে নামায রোযা করে, তবুও? মহানবী (সাঃ) জবাব দিলেন-হ্যাঁ, যদিও সে নামায রোযা করে এবং নিজেকে মুসলমান ভাবে, তবুও। আল্লাহ্ পাক মুসলমানদের যেভাবে মুসলিম, মু’মিন, আল্লাহর বান্দা ইত্যাদি নামে সম্বোধন করিয়াছেন, তোমরাও তাহাদের সেই সব নামে সম্বোধন করিবে। কখনও জাহিলী নামে ডাকিবে না।’
মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে ‘সহীহ-হাসান’ বলিয়াছেন। এই হাদীস দ্বারা তাওহীদ প্রমাণিত হয়। ইহাতে বলা হইয়াছে, ‘আল্লাহ্ তা’আলা যেহেতু তোমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন এবং রিযিকের ব্যবস্থা করিতেছেন, সুতরাং তোমরা কেবলমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই ইবাদত করিবে এবং তাঁহার সহিত কাহাকেও শরীক করিবে না।’
ইমাম রাযী সহ অনেক তাফসীরকার এই হাদীস দ্বারা আল্লাহ্ তাআলার অস্তিত্ব প্রমাণ করিয়াছেন। ঊর্ধ্বজগত ও নিম্ন জগতের সৃষ্টিকুল, সৃষ্টিকুলের আকৃতি-প্রকৃতির অশেষ বৈচিত্র্য, বিশ্বপ্রকৃতি ও উহার সুশৃঙ্খল রীতি-নীতি এবং অজস্র কল্যাণকর ব্যবস্থাপনা মহাকুশলী সৃষ্টিকর্তার কুদরত ও হিকমতের নিদর্শনরূপে সর্বত্র বিরাজমান।
ইমাম রাযী বলেনঃ জনৈক নিরক্ষর আরবের কাছে আল্লাহ্র অস্তিত্বের প্রমাণ চাওয়া হইলে সে উত্তর দিল, না দেখিয়া যেভাবে আমরা উটের অস্তিত্ব এবং পায়ের দাগ দেখিয়া আগন্তকের আগমনের কথা বুঝিতে পাই, সেভাবেই গ্রহ-নক্ষত্রপূর্ণ আকাশ, বৈচিত্র্য বিমণ্ডিত পৃথিবী ও তরঙ্গায়িত সমুদ্রের লীলাখেলা দেখিয়া আল্লাহ্র অস্তিত্ব উপলব্ধি করি।
ইমাম রাযী আরও বলেনঃ বাদশাহ হারুন অর রশীদ ইমাম মালিক (রঃ)-এর নিকট আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ জানিতে চাহিলে তিনি জবাব দিলেন-মানুষের ভাষা, কণ্ঠস্বর ও সুর বৈচিত্র্যের মধ্যেই আল্লাহ্র অস্তিত্বের প্রমাণ বিদ্যমান।
তেমনি ইমাম আবূ হানীফা (রঃ)-কে কতিপয় নাস্তিক আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করিলে তিনি জবাব দিলেন- ‘এসব কথা এখন রাখ। আমি এখন অন্য এক চিন্তায় নিমগ্ন। একদল লোক বলিয়া গেল, বাণিজ্যিক মালামাল বোঝাই বিরাট এক নৌকা আপন হইতেই চলিতেছে এবং সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালা নির্বিঘ্নে অতিক্রম করিয়া যাইতেছে। অথচ উহার কোন চালক নাই।’ প্রশ্নকারী নাস্তিকগণ বলিল, আপনি কি চিন্তায় অযথা সময় নষ্ট করিতেছেন? কোন জ্ঞানী লোকের পক্ষে কি এমন কথা বলা সম্ভব? এত বড় নৌকা তরঙ্গসংকুল সমুদ্রে নাবিক ছাড়া কি করিয়া চলিতে পারে? তখন ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) বলিলেন, তোমাদের জ্ঞানের কথা ভাবিয়৷ আমারও অনুশোচনা জাগে। একটি নৌকা যদি নাবিক ছাড়া না চলিতে পারে, তাহলে এই বিশাল ভূমণ্ডল, আকাশমণ্ডলী ও উহার অসংখ্য সৃষ্টিকুল কি করিয়া পরিচালক ছাড়া সুশৃঙ্খলভাবে চলিতে পারে? জানিয়া রাখ, সেই পরিচালকই হইলেন নিখিল সৃষ্টির স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক আল্লাহ্ তা’আলা। নাস্তিকরা তাঁহার জবাবে বিস্মিত ও হতভম্ভ হইল এবং জবাবের সারবত্তা ও সত্যতা উপলব্ধি করিয়া মুসলমান হইয়া গেল।
ইমাম শাফেঈ (রঃ)-এর কাছে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করা হইলে তিনি জবাব দিলেন-তুত গাছের পাতা এক, তার রং এক. স্বাদ এক, রসও এক। গরু ছাগল, হরিণ, মাকড়, মক্ষিকা, গুটি পোকা ইত্যাকার বহু প্রাণী ও কীট-পতঙ্গ উহার পাতা খায় ও রস পান করে। অথচ গুটি পোকা দেয় রেশম, মক্ষিকা দেয় মধু, ছাগল-গরু দেয় দুধ ও গোবর এবং হরিণ মিল্ক উপহার দেয়। একই পাতায় এভাবে বিভিন্ন উপাদান সৃষ্টির পেছনে কি কোন কুশলী স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভূত হয় না? তিনিই আমাদের মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ তা’আলা।
ইমাম আহমদ ইব্ন হাম্বল (রঃ)-এর নিকট এক সময় আল্লাহ্র অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি দাবী করা হইলে তিনি জবাব দিলেন-মনে কর, এখানে এমন একটি সুদৃঢ় দুর্গ রহিয়াছে যাহার কোন দরজা-জানালা নাই। এমনকি কোন ছিত্রও নাই। দুর্গটির বহির্ভাগ রৌপ্যের ও অভ্যন্তরভাগ স্বর্ণের প্রভায় দীপ্যমান। ডান-বাম ও উপর-নীচ সব দিক দিয়াই দুর্গটি আবদ্ধ। উহাতে জীব-জানোয়ার তো দূরের কথা, বায়ুও প্রবেশ করিতে পারে না। হঠাৎ উহার একটি দেয়াল ভাঙ্গিয়া পড়িল। অমনি উহা হইতে চক্ষু-কর্ণ বিশিষ্ট সুন্দরকায় এমন একপ্রাণী বাহির হইল যাহারা কণ্ঠে রহিয়াছে মন ভুলানো মিষ্টি মধুর কল-কাকলী। বলতো সেই আবদ্ধ দুর্গে সৃষ্ট এই জীবের কোন স্রষ্টা রহিয়াছেন কিনা? সেই সৃষ্টিকর্তাই হইলেন মানব সত্তার অতীত এক মহান সত্তা। তাঁহার ক্ষমতা ও শক্তি কি সীমিত, না সীমাহীন? তিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী ;
ইমাম সাহেব ডিমকে দুর্গের সহিত তুলনা করিয়াছেন। আল্লাহর অস্তিত্বের পক্ষে ইহা একটি বড় প্রমাণ। আবূ নুআস (রঃ)-এর কাছে আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হইলে তিনি জবাব দিলেন-
تأمل فى نبات الارض وانظر الى اثار ما صئع المليك عيون من لجين شاخصات باحداق هى الذهب السبيك على قضب الزبر جد شاهدات بان الله ليس له شريك
আকাশ হইতে বারিবর্ষণ, উহা দ্বারা ধরার বুকে ফসল, ফলমূল ও গাছপালা-তরুলতার জন্মলাভ ও কচি-কচি ডগায় নানাবিধ ফুলের সমারোহ আল্লাহ্র অস্তিত্ব ও একত্বের অকাট্য প্ৰমাণ ‘
فيا عجيا كيف يعصى الا له ام كيف يجحده الجاحد .وفى كل شىء له اية – تدل على انه واحد
‘আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার ও তাঁহার বিরুদ্ধাচরণের কথা ভাবিলে মনে বিস্ময় সৃষ্টি হয় । মানুষ কতই না বেপরোয়া হওয়ার প্রয়াস চালায় । অথচ তাহার আশে পাশের প্রত্যেকটি বস্তুই আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্বের সাক্ষ্য দিতেছে।’
মহামানবগণ বলিয়াছেন-আকাশমণ্ডলীর দিকে দৃষ্টিপাত কর এবং উহার উচ্চতা ও প্রশস্ততা এবং হাতে বিচরণশীল সমুজ্জ্বল গ্রহ-নক্ষত্রের দিকে তাকাও। এদিক-সেদিক প্রবহমান নদ-নদীগুলি পর্যবেক্ষণ কর। দেখ, উহারা কিভাবে স্বীয় স্রোতধারার মাধ্যমে ক্ষেত-খামারের ফসল আর বাগ-বাগিচার গাছপালা ও ফল-মূলের তৃষ্ণা মিটাইয়া যমীনকে সবুজ শ্যামল করিয়া তোলে। ক্ষেত্র-খামার ও বাগিচার ফসল ও ফল-মূলের দিকে তাকাইয়া দেখ, উহারা কিভাবে একই পানির কল্যাণে বিচিত্র রং, রূপ, ঘ্রাণ, স্বাদ লাভ করিতেছে। এমনকি সেইগুলির উপকারীতায়ও রহিয়াছে অশেষ বৈচিত্র। বস্তু জগতের বৈচিত্র্য বিমণ্ডিত এই সৃষ্টিকুল তাহাদের ভাষায় প্রতিনিয়ত জানাইতেছে যে, তাহাদের এক মহান কুশলী সৃষ্টিকর্তা রহিয়াছেন এবং সেই সৃষ্টিকর্তা এক ও অদ্বিতীয় বলিয়াই এত সুশৃঙ্খল ও সুবিন্যস্তভাবে সব কিছু চলিতেছে। এইসব সৃষ্টি প্রত্যেকটি দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তির সামনে আল্লাহ্র অশেষ মহত্ত, অসীম ক্ষমতা, অপরিসীম দয়া ও অনাবিল প্রেম-প্রীতি ও ভালবাসার অনুপম ও অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন তুলিয়া ধরিতেছে । তাঁহার এতসব নজীরবিহীন নি‘আমাত কি তাঁহার সীমাহীন বদান্যতার পরিচয় দেয় না? আমরা কায়মনে বিশ্বাস করি, তিনি ব্যতীত আর কোন প্রতিপালক নাই। তিনিই আমাদের সৃষ্টিকর্তা। তিনিই আমাদের উপাস্য প্রভু। তিনিই আমাদের একমাত্র রক্ষক ও ত্রাণকর্তা । তাই তিনি ব্যতীত আর কোন সত্তা আমাদের অবনত মস্তকে প্রদত্ত সিজদা লাভের যোগ্য নহে। হে দুনিয়ার মানুষ! আমি একমাত্র তাঁহারই দয়ার উপর নির্ভরশীল। আমার যাহা কিছু আশা ভরসা একমাত্র তাঁহারই কাছে। আমার মাথা অবনত করা ও উত্তোলন করা একমাত্র তাঁহারই দরবারে। আমার সকল প্রত্যাশা তাঁহারই কৃপার সহিত সংশ্লিষ্ট। তাঁহারই দয়া ও অনুগ্রহের আশায় কেবলমাত্র তাঁহারই নাম জপনা করিতেছি।
কুরআনের চ্যালেঞ্জ
(۲۳)
وَ اِنۡ كُنۡتُمۡ فِیۡ رَیۡبٍ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلٰی عَبۡدِنَا فَاۡتُوۡا بِسُوۡرَۃٍ مِّنۡ مِّثۡلِهٖ ۪ وَ ادۡعُوۡا شُهَدَآءَكُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ اِنۡ كُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ
(٢٤)
فَاِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلُوۡا وَ لَنۡ تَفۡعَلُوۡا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِیۡ وَقُوۡدُهَا النَّاسُ وَ الۡحِجَارَۃُ ۚۖ اُعِدَّتۡ لِلۡكٰفِرِیۡنَ
২৩. আমি আমার বান্দার উপর যাহা অবতীর্ণ করিয়াছি তাহাতে তোমাদের সন্দেহ সৃষ্টি হইয়া থাকিলে, তোমরা উহার অনুরূপ কোন সূরা আনয়ন কর। তোমাদের কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য আল্লাহ্ ব্যতীত তোমাদের অন্য যত প্রভু আছে তাহাদেরও ডাকিয়া লও।
২৪. তারপরও যদি না পার এবং কখনই পারিবে না, তখন সেই আগুনকে ভয় কর যাহার ইন্ধন হইবে মানুষ ও প্রস্তর। উহা কাফিরদের জন্যই প্রস্তুত করা হইয়াছে।
তাফসীরঃ তাওহীদ ও একত্ববাদের আলোচনার পর আল্লাহ্ পাক তাঁহার রাসূলের রিসালাত এবং নবৃওতের সত্যতা ও শুদ্ধতা প্রথাসিদ্ধ পন্থায় প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। তাই তিনি কাফিরদের সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, আমার বান্দা মুহাম্মদের প্রতি আমি যে কুরআন অবতীর্ণ করিয়াছি, তাহা সম্পর্কে তোমাদের যদি সংশয় সৃষ্টি হইয়া থাকে যে, উহা আল্লাহ্র কথা নহে, মুহাম্মদ নিজেই উহার রচয়িতা, তাহা হইলে কুরআনের কোন সূরার মত একটি সূরা রচনা করিয়া তোমরা দেখাও। এই ব্যাপারে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যে কোন ব্যক্তি বা শক্তির সাহায্য গ্রহণ করিতে পার। কিন্তু তোমরা সমবেত প্রচেষ্টা দ্বারাও তাহা পারিবে না।
ইব্ন আব্বাস (রাঃ) উপরোক্ত আয়াতের شهداء كم শব্দের ব্যাখ্যায় বলিয়াছেন, শব্দটির অর্থ হইল ‘তোমাদের সাহায্যকারী’ অর্থাৎ তোমাদের সাহায্যকারীগণকে অনুরূপ সূরা প্রণয়নের কাজে ডাক।
আবূ মালিকের উদ্ধৃতি দিয়া সুদ্দী বলিয়াছেন, শব্দটির অর্থ হইল তোমরা যাহাদিগকে আল্লাহ্র অংশীদার বানাইয়াছ, তাহাদিগকে ডাক। অর্থাৎ অন্য যতসব সহায়তাকারী তোমাদের রহিয়াছে তাহাদেরকে, এমনকি আল্লাহ্ ব্যতীত তোমাদের যে সকল মা’বূদ রহিয়াছে তাহাদিগকেও ডাকিয়া সকলে মিলিয়া অনুরূপ একটি সূরা তৈরি কর।
উক্ত শব্দের ব্যাখ্যায় মুজাহিদ বলিয়াছেন, ইহা দ্বারা আরবী ভাষাবিদ পণ্ডিত ও আরবের শাসকবর্গকে বুঝানো হইয়াছে। অর্থাৎ তোমরা তোমাদের কবি-সাহিত্যিক ও কর্ণধার-পরিচালক মণ্ডলীকে এই কাজে সাহায্যের জন্য ডাকিয়া লও। কিন্তু ডাকিলেও লাভ হইবে না, সূরা তো দূরের কথা, একটি লাইনও রচনা করিতে সক্ষম হইবে না।
আল্লাহ্ পাক আল-কুরআনের বহুস্থানে এইভাবে চ্যালেঞ্জ প্রদান করিয়াছেন। যেমন আল্লাহ্ পাক সূরা আল-কাসাসে বলেনঃ
قُلْ فَأْتُوا بِكِتَابٍ مِنْ عِنْدِ اللهِ هُوَ أهْدَى مِنْهُمَا اتَّبَعُهُ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ
“হে নবী! বলিয়া দাও, যদি তোমাদের দাবী সত্য হয়, তবে তাওরাত ও কুরআনের চাইতে অধিক পথ প্রদর্শনকারী কোন কিতাব আল্লাহ্র নিকট হইতে নিয়া আস। আমিও সেই কিতাবকে অনুসরণ করিব।”
আল্লাহ্ পাক অন্যত্র বলেনঃ
قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسَ وَالْجِنُّ عَلى أنْ يَأْتُوا بمثل هذا الْقُرْآنِ لا يَأْتُور.
بمثلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْض ظَهِيراً
“হে নবী! জানাইয়া দাও, সমগ্র মানুষ ও জ্বিন সম্প্রদায় একত্রিত হইয়াও যদি কুরআনের ন্যায় গ্রন্থ রচনায় নিয়োজিত হয়, তবুও অনুরূপ গ্রন্থ রচনা করিতে পারিবে না। যদিও সকলের সমবেত প্রচেষ্টা উহাতে নিয়োজিত হয়।”
আল্লাহ্ পাক সূরা হুদে ঘোষণা করেনঃ
آم يَفوْنُْنَ افهْرَهُ كل فَأَكًُا يفنظر سسُوَر بَكْله سفْمْريَات وَادْعْوا من استطفة سَنطعكُم من دون الله ان كنْتم صادقين
“তাহারা কি বলিতেছে যে, তুমি নিজেই এই কুরআন রচনা করিয়াছ? তুমি বল, তোমরা উহার মত দশটি সূরা রচনা করিয়া দেখাও এবং সেই কাজে আল্লাহ্ ব্যতীত যদি কেহ ক্ষমত। রাখে, তাহাকেও ডাকিয়া লও-যদি তোমাদের দাবী সত্য হইয়া থাকে।”
আল্লাহ্ পাক সূরা ইউনুসে বলেনঃ
وما كَانَ هُدًا الْقُرَانْ أن يفْتَرَى من دُوْن الله ولكنْ تَمنْدِيْقَ الّذئ بَيْنَ يديه
وَنفْصِيّلَ الكتاب لأرَيْبَ فِيْه من رب الْعَالمِيْنَ آم يَكوُْوْدَ اثنراه قل فوا
بسورة مثله وادعوا من استطعتم من دون الله إن كَنْنَم صادقين
“এই কুরআন আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাহারও মনগড়া রচনা নহে। পরন্তু ইহা পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবসমূহকে সত্যায়িত করে। আর ইহা সবিস্তারে বর্ণিত কিতাব। নিখিল সৃষ্টির প্রতিপালকের ‘তরফ হইতে অবতীর্ণ এক সংশয় মুক্ত কিতাব। তাহারা কি ইহাকে মিথ্যা বলিতেছে? তুমি বল, কুরআনের অনুরূপ একটি সূরা তৈরি করিয়া দেখাও। আল্লাহ্ ব্যতীত যদি কাহারও ক্ষমতা থাকে তাহাকেও ডাকিয়া যদি পার তাহা হইলেও তোমাদের দাবীর সত্যতা প্রমাণ কর।”
এই ধরনের আয়াত প্রথমে মক্কায় অবতীর্ণ হইয়া মক্কাবাসীকে জব্দ করিয়া কুরআন ও কুরআনের নবীর বিশুদ্ধতা ও সত্যতা প্রমাণ করে। অতঃপর মদীনায়ও একই উদ্দেশ্যে আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হয়।
আয়াতটির অন্তর্গত مثله শব্দের সর্বনাম দ্বারা কি বুঝানো হইয়াছে তাহা লইয়া মতভেদ রহিয়াছে। এক দলের মতে এই সর্বনাম দ্বারা কুরআনকে বুঝানো হইয়াছে। তখন আয়াতের অর্থ এই দাঁড়ায় কুরআনের সূরার মত কোন সূরা রচনা করিয়া দেখাও।’ অপর দল বলেন, উক্ত সর্বনামটি দ্বারা মহানবী (সাঃ)-কে বুঝানো হইয়াছে। সেক্ষেত্রে অর্থ দাঁড়ায়-‘মুহাম্মদের মত নিরক্ষর ব্যক্তির পক্ষে যদি এরূপ সূরা তৈরি করা সম্ভব হয়, তাহা হইলে তোমরাও করিয়া দেখাও।’
প্রথম অভিমতের প্রবক্তা হইলেন মুজাহিদ ও কাতাদাহ (রঃ)। ইব্ন জারীর, তাবারী, যামাখশারী, ইমাম রাযী প্রমুখ ব্যাখ্যাকারগণ এই মতই গ্রহণ করিয়াছেন। হযরত উমর, ইন মাসউদ, ইব্ন আব্বাস (রাঃ) ও হাসান বসরী (রঃ) সহ অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ হইতেও এই অভিমতেরই সমর্থন মিলে।
প্রথমোক্ত অভিমতের প্রাধান্য লাভের আরও কারণ আছে। এক, ইহা দ্বারা এককভাবে ও সমবেতভাবে উভয় পন্থায়ই সকলের প্রতি চ্যালেঞ্জ প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষিত অশিক্ষিতের যেমন পার্থক্য করা হয় নাই, তেমনি পার্থক্য করা হয় নাই আহলে কিতাব-গায়ের আহলে কিতাবেরও। সুতরাং ইহা নিরক্ষরদের প্রতি চ্যালেঞ্জের তুলনায় ব্যাপক ও সার্বজনীন। দুই. উপরোক্ত অন্য আয়াতে ‘অনুরূপ দশটি সূরা রচনা করিয়া দেখাও’ বাক্যাংশটিও প্রমাণ করে যে, উক্ত সর্বনামটির ইঙ্গিত কুরআনের প্রতি, মুহাম্মদের প্রতি নহে। তিন, কুরআনের এই বারংবার চ্যালেঞ্জে আরবী ভাষাবিদ, কবি, সাহিত্যিক যাহার সাহায্য নিয়া সম্ভব তাহাদের সকলকেই শামিল করার আহ্বান জানানো হইয়াছে। তাই ইহা বিশেষ শ্রেণীর চ্যালেঞ্জ নহে; বরং সর্বশ্রেণীর মানুষের প্রতি সর্বকালের জন্য সার্বিক চ্যালেঞ্জ। ফলে বারংবার ইহার উল্লেখ আসিয়াছে এবং পরিশেষে সুস্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দেওয়া হইয়াছে,তোমরা পার নাই আর কখনও পারিবে না।’ মূলত মক্কা ও মদীনার তদানীন্তন সুধীমণ্ডলী চরম বিরোধী মনোভাব রাখিয়াও এই চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হইয়াছে। কুরআন কিংবা উহার দশটি সূরা অথবা উহা ক্ষুদ্রতম সূরাটির কোন আয়াতের অনুরূপ কিছু রচনা করিতেও অপারগ রহিয়াছে। তাই আল্লাহ্ তা’আলা لن تفعلوًا (কখনই পারিবে না) ঘোষণা দ্বারা চ্যালেঞ্জের উপসংহার টানিলেন।
لن تفعلوًا শব্দে ব্যাকরণবিধি অনুসারে ভবিষ্যৎ কালের নিশ্চিত না সূচক (نفى تاكيد) অব্যয় لن ব্যবহৃত হইয়াছে। ইহা কুরআন পাকের অন্যতম মু’জিযা। একমাত্র কুরআনই নির্দ্বিধায় সর্বকালের স্বীয় অবিসংবাদিতার ঘোষণা দিতে পারে। কারণ, একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতে এইরূপ রচনা কখনও কাহারো পক্ষে সৃষ্টি করা সম্ভবপর নহে। নিখিল সৃষ্টির যিনি সৃষ্টিকর্তা তাঁহার রচনার সমকক্ষ কিছু রচনা করা কোন সৃষ্টির পক্ষে কি করিয়া সম্ভব হইবে? কুরআন নিয়া যাহারা গবেষণা ও চিন্তা-ভাবনা করিয়াছে, তাহারা একবাক্যে স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছে যে, ইহার ভাষাশৈলীগত বাহ্যিক রূপ ও মর্মগত আত্মিক স্বরূপ উভয় দিক দিয়াই ইহা অতুলনীয় ও অবিসংবাদিত। তাই আল্লাহ্ বলেনঃ
ألر – كتّاب أحكمّت ايَائّهُ كُّمٌ فُصِلَت مِنْ لَّدنْ حَكيْم خَبِيْر “ইহা এমন কিতাব যাহার আয়াতগুলি প্রথমে দৃঢ়ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা হইয়াছে। অতঃপর মহাজ্ঞানী ও মহাসংবাদ দাতার তরফ হইতে উহার বিশদ রূপ দান করা হইয়াছে।”
তাই কুরআনের ভাষা অত্যন্ত সুসংবদ্ধ ও উহার মর্ম অতিশয় ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। ভাব ও ভাষা উভয় দিক দিয়াই উহা নজীরবিহীন ও বিস্ময়কর। সমগ্র জগত উহার সমকক্ষতার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অপারগতার স্বীকৃতি প্রদান করিয়াছে। উহাতে একদিকে যেমন অতীতের ইতিহাস যথাযথভাবে উপস্থাপিত হইয়াছে, তেমনি অপরদিকে ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিতব্য ঘটনাবলীও সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত হইয়াছে। ন্যায়-অন্যায় ও ভাল-মন্দ সম্পর্কিত সকল কিছুই সুনিপুণভাবে উহাতে সন্নিবেশিত হইয়াছে। তাই আল্লাহ্ পাক ঘোষণা করিলেনঃ
وَنَمَّتْ كَلمَةٌ ربك صدفًا وَعدلاً “তোমার প্রতিপালক তাঁহার বাণীকে সত্য ও সঙ্গতভাবেই পূর্ণাঙ্গতা দান করিয়াছেন।”
অর্থাৎ সংবাদদাতা হিসাবে সত্য সংবাদ ও বিধান দাতা হিসাবে ন্যায়ানুগ বিধান প্রদান করিয়াছেন। ইহার প্রতিটি বিষয়ই সত্য ও ন্যায়ের মানদণ্ড ও পথ প্রদর্শক। ইহাতে কোন রূপকথা, কিংবদন্তী ও কিংবা কাল্পনিক মিথ্যাচারের লেশমাত্র নাই ! মিথ্যা ও কল্পনার ছড়াছড়ি ছাড়া কবিদের কাব্যগাথা রচিত হয় না। উহা ছাড়া নাকি তাহাদের কবিতা-কাব্যের আকর্ষণ উৎকর্ষ সৃষ্টি হয় না। তাই জনৈক কবি বলেনঃ أعجبه أكزبه
অর্থাৎ কল্পনাপ্রসূত মিথ্যার প্রলেপ যত বেশী থাকিবে, কবিতার সৌন্দর্য, কমনীয়তা, মাধুর্য ও মাদকতা ততই বিকশিত হইবে ও পাঠককুলের কাছে তত বেশী সমাদৃত হইবে। উহার অবর্তমানে কবিতা হইবে নিষ্প্রাণ ও ব্যর্থ। তাই বড় বড় কবিরা বিরাট বিরাট কাব্য নারীর রূপ-গুণকীর্তন, পানীয় ও পানপাত্রের বিবরণ, উট-ঘোড়ার সৌন্দর্য বর্ণনা, ব্যক্তি বিশেষের প্রশংসা অর্চনা, যুদ্ধ বিগ্রহের লোমহর্ষক কাহিনী ও বিস্ময়কর চাতুর্যকলা কিংবা ভীতিপ্রদ রোমাঞ্চকর গল্প-গুজবে ভরপুর। উহা দ্বারা কবির শিল্প সৌকর্য ও অন্তলীণ মনোবিকারের বহিঃপ্রকাশ ঘটে বটে; কিন্তু মানব সমাজ আদৌ উপকৃত হয় না। গোটা কাব্যের দু’একটি পংক্তি ছাড়া সবটুকুই অর্থহীন প্রলাপে পর্যবসিত হয়।
পক্ষান্তরে আল্-কুরআনের আগাগোড়া অত্যন্ত উঁচুমানের বাকভঙ্গী ও অতুলনীয় ভাষালংকারে সমুজ্জ্বল ও অনুপম উপমায় সুষমামণ্ডিত প্রতীয়মান হইবে । আরবী ভাষায় সুপণ্ডিত ও গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন মনীষী মণ্ডলীই কেবল কুরআনের ভাষাশৈলী ও ভাব সম্পদের গভীরে প্রবেশ করিতে সমর্থ। কুরআন যখন কোন সংবাদ পরিবেশন করে, হউক তাহা দীর্ঘ কিংবা হ্রস্ব, একবারের জায়গায় যদি তাহা বারংবারও বলা হয়, তথাপি উহার স্বাদ ও মাধুর্যে বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় ঘটে না । যতই পাঠ করিবে ততই যেন অনির্বচণীয় এক স্বাদে চিত্ত উত্তরোত্তর আপ্লুত হইয়াই চলিবে। উহার পৌনঃপুনিক পাঠে যেমন সাধারণ পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে না। তেমনি অসাধারণ পাঠকরাও বিন্দুমাত্র অস্বস্তিবোধ করেন না।
আল্-কুরআনের সতর্ক বাণী ও ভীতি প্রদর্শনমূলক বক্তব্যসমূহ অবলোকন ও অনুধাবন করিলে সুকঠিন মানবাত্মা তো দূরের কথা, সুদৃঢ় পর্বতমালা পর্যন্ত সন্ত্রস্ত ও প্রকম্পিত না হইয়া পারে না। তেমনি উহার আশ্বাসবাণী ও পুরস্কার বিবরণী অবলোকন ও অনুধাবন করিলে অন্ধ মনের বন্ধ দুয়ার প্রলুব্ধ ও উন্মুক্ত হইয়া যায়, রুদ্ধ কর্ণ কুহরও প্রত্যাশ্যার পদধ্বনি শুনিতে পায় আর মৃত অন্তরাত্মা ইসলামের অমিয় সুধা পানের জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠে। এই সব কিছু মিলিয়া অজান্তে হৃদয়রূপ বেতারযন্ত্রে বাজিয়া ওঠে আরশের আকাশ বাণীর প্রচারিত আল্লাহ্ প্রেমের মন মাতানো রাগ-রাগিণীর সুমধুর সুর লহরী। এখানে কয়েকটি আয়াত উদাহরণ স্বরূপ পেশ করিতেছি। যেমন উদ্দীপক বাণীঃ
فَلاً تَعْلَمُ نْفْسَ ما أخفى لهم من قَرَة أعين جزاء لما كَانُوا يُعملون
“নেক কাজের প্রতিদানে নয়ন জুড়ানো কি জিনিস নয়নের অগোচরে বিরাজ করিতেছে তাহা কেহই জানে না। ”
অথবাঃ
وَفِيْهَا ما تَتْتَهيْه الأنْفْسٌوَتَلَدُ الأمْيُنُ وَآَنْتُمَ فيا خَالدُوْنَ
“উহাতে (জান্নাতে) মনের চাহিদা মিটানো আর নয়নের পরিতৃপ্তি লাভের সমস্ত ব্যবস্থাই বিদ্যমান । সেখানে তোমাদের অবস্থান হইবে চিরন্তন।”
কিংবা ভীতিপ্রদ বক্তব্যঃ
أفامتتم أن يمسف بِكُمْ جانب الْبّر “ভূখণ্ডের কোন এক দিক তোমাদের সহ ধ্বসিয়া যাওয়া সম্পর্কে তোমরা কি নিশ্চিন্ত হইয়া গেলে?”
অথবাঃ
أمِنْتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يُخْسِفَ بِكُمُ الْأَرْضِ فَإِذَا هِيَ تَمُورُ – أَمْ أَمِنْتُمْ
مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يُرْسِلَ عَلَيْكُمْ حَاصِبًا – فَسَتَعْلَمُونَ كَيْفَ نَذِيرٌ
“তোমরা কি ঊর্ধ্বজগতের সেই প্রবলতম সত্তার ব্যাপারে নির্ভিক হইলে, যিনি তোমাদিগকে অকস্মাৎ ভূমি সহ ধ্বসাইয়া দিবেন? তোমরা কি মহাকাশের সেই মহাপ্রতাপান্বিত সত্তার ব্যাপারে বেপরোয়া হইলে, যিনি মহাশূন্য হইতে কঙ্কর বৃষ্টি বর্ষণ করিবেন? শীঘ্রই এই সতর্কতার তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করিবে।”
কিংবা হুঁশিয়ারীমূলকঃ
فكلاً أَحَدنًا بذنبه “আমি প্রত্যেককেই পাপের জন্য পাকড়াও করি। অথবাঃ
أفَرَأَيْتَ إِنْ مَتَّعْنَاهُمْ سنينَ ثُمَّ جَاءَ هُمْ مَا كَانُوا يُوعَدُونَ – مَا أَغْنَى عَنْهُمْ مَا
كَانُوا يُمَتَّعُونَ
“তুমি কি দেখ নাই আমি বেশ কয়েক বৎসর তাহাদিগকে ফায়দা লুটিবার সুযোগ দিয়াছি। অতঃপর তাহাদের সামনে প্রতিশ্রুত ব্যাপার হাজির হইয়াছে। তখন ভোগ-বিলাসের উপকরণ তাহাদের কোন উপকারে আসে নাই।”
আল-কুরআনকে এইভাবে ভাব ও ভাষায় সুসমৃদ্ধ ও সুসজ্জিত করা হইয়াছে। ইহার বিষয় বৈচিত্র্য বিস্ময়কর। ভাষালংকারের ঔজ্জ্বল্য, উপদেশের প্রাচুর্য, যুক্তি প্রমাণের অজস্রতা ও তত্ত্বজ্ঞানের বহুলতা কুরআনকে গ্রন্থ জগতে অবিসংবাদীতা দান করিয়াছে। বিধি-নিষেধের বাণীসমূহকে অত্যন্ত ন্যায়ানুগ, কল্যাণকর, আকর্ষণীয় ও প্রভাবময় করা হইয়াছে ৷ ইব্ন মাসউদ (রা) সহ অনেক বিশেষজ্ঞ মনীষী বলিয়াছেন—’ইয়া আইউহাল্লাযীনা আমানূ’ শুনার সঙ্গে সঙ্গে মনোযোগের সহিত কান পাতিয়া পরবর্তী বক্তব্য শুন। কারণ, উহার পর হয় কোন কল্যাণের পথে ডাকা হইবে, নয় তো কোন অকল্যাণ হইতে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হইবে। আল্লাহ্ পাক বলিয়াছেনঃ
يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِم الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ اصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ
‘(আল-কুরআন) তাহাদিগকে ন্যায় কাজের নির্দেশ দেয় ও অন্যায় কাজ করিতে নিষেধ করে এবং তাহাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ বৈধ করে ও অপবিত্র বস্তুসমূহ অবৈধ করে আর পায়ের বেড়ী ও গলার ফাঁস হইতে তাহাদিগকে মুক্তি দেয়।’
আল-কুরআনের কিয়ামত সম্পর্কিত আয়াতসমূহ সেই দিনের বিভীষিকাময় বর্ণনা, জান্নাতের সীমাহীন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিবরণ, জাহান্নামের অপরিসীম দুঃখ দুর্দশার চিত্র নেককারদের বিভিন্ন লোভনীয় পুরস্কার ও বদকারদের নানাবিধ ভয়াবহ শাস্তি, পার্থিব জগতের সহায়-সম্পদ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অসারতা ও পারলৌকিক জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অবিনশ্বরতা ইত্যাকার শিক্ষা ও কল্যাণমূলক আলোচনায় ভরপুর। এই সব বর্ণনা মানুষকে ন্যায়ের পথে উদ্বুদ্ধ করে, হৃদয়কে সন্ত্রস্ত ও বিগলিত করে এবং শয়তানের প্ররোচনাসৃষ্ট অন্তরের কালিমা ধুইয়া-মুছিয়া সাফ করিয়া দেয়।
বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ মানুষের আস্থা লাভের জন্য প্রত্যেক নবীকে কিছু কিছু মু’জিযা দান করা হইয়াছে। আমার মু’জিযা হইল আল-কুরআন। তাই আমি আশা রাখি যে, অন্যান্য নবীর তুলনায় আমার উম্মতের সংখ্যা অধিক হইবে। (কারণ, অন্যান্য নবীর মু’জিযা তাহাদের ইন্তেকালের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হইয়াছে। পক্ষান্তরে আল-কুরআন মহানবী (সাঃ)-এর ইস্তেকালের পরেও বর্তমান রহিয়াছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত উহা বহাল থাকিবে।)
উপরোক্ত হাদীসে মহানবী (সাঃ)-এর উক্তি ‘আমার মু’জিযা হইল আল্লাহর প্রত্যাদেশ’-এর তাৎপর্য এই যে, তাঁহাকে প্রদত্ত আল-কুরআন সর্বকালের সকল মানুষের কাছে অবিসংবাদী গ্রন্থরূপে বিরাজ করিবে। কোন কালের কোন মানুষই ইহার শ্রেষ্ঠত্বের কাছে মাথা নত না করিয়া পারিবে না। এই অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য আর কোন আসমানী গ্রন্থের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। তাই আল-কুরআন যুগে যুগে মহানবী (সাঃ)-এর নবূওতকেও সত্যায়িত করিয়া চলিবে। অবশ্য আল কুরআন ছাড়াও মহানবী (সাঃ)-এর অন্যান্য মু’জিযা রহিয়াছে। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
আল-কুরআনের অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত ও মু’তাযিলা শাস্ত্রবিদগণ অনেক যুক্তি প্রমাণ তুলিয়া ধরিয়াছেন। তাহাদের বক্তব্যের সারকথা হইল এই, কুরআন মুলতই সৃষ্টিকর্তার অবতীর্ণ কিতাব বিধায় কোন সৃষ্টির পক্ষে উহার মত কিছু রচনা করা সাধ্যাতীত ব্যাপার। তাই উহার অপ্রতিদ্বন্দ্বীতা সুপ্রমাণিত সত্য। পক্ষান্তরে যদি তর্কের খাতিরে মানিয়া লওয়া হয় যে, কুরআন স্রষ্টার অবতীর্ণ গ্রন্থ নহে, তাই উহার মত কিছু রচনা করা কোন সৃষ্টির পক্ষে সম্ভব, তাহা হইলেও কুরআনের বারংবার চ্যালেঞ্জ সত্ত্বের উহার কট্টর বিরোধীরাও অদ্যাবধি উহার মত কিছু রচনা করিতে চরম অপারগতা প্রকাশ করায় কুরআনের অপ্রতিদ্বন্দ্বীতা সুপ্রমাণিত সত্যে পরিণত হইল। ইমাম রাযী এই প্রসঙ্গে কুরআনের ক্ষুদ্রতর সূরা ‘আল আসর’-এর অনুরূপ কিছু রচনা করিতেও বিরুদ্ধবাদীদের ব্যর্থতার কথা সবিস্তারে উল্লেখ করিয়াছেন।
আলোচ্য وَقُودوها النَّاسْ والحجارة আয়াতাংশের وقودها শব্দের, ও অক্ষরটি যবর দিয়া পাঠ করা হয়। তাই ইহার অর্থ হইতেছে ‘যাহা দ্বারা অগ্নি প্রজ্বলিত করা হয়।’ যেমন কাষ্ঠ। কুরআন পাকের অন্য আয়াতে বলা হইয়াছেঃ
وآممًا الْقَاسطُون فَكَانُوَا لجَهَنُمُ حطبا “জালিমগণ জাহান্নামের কাষ্ঠে পরিণত হইবে।”
আল্লাহ্ পাক অন্যত্র বলেনঃ
إنَّكُمْ وَمَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ حَصَبُ جَهَنَّمَ اَنْتُمْ لَهَا وَارِدُونَ – لَوْ كَانَ هؤلاء الهَةً مَّا وَرَدُوهَا وَكُلٌّ فِيْهَا خَالِدُونَ
“তোমরা এবং তোমাদের উপাস্যমণ্ডলী অবশ্যই জাহান্নামের কাষ্ঠে পরিণত হইবে। তোমরা সকলেই উহাতে নিক্ষিপ্ত হইবে। তোমাদের উপাস্যরা যথার্থ প্রভু হইলে কখনই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হইত না অথচ উহারা হইবে জাহান্নামের চিরস্থায়ী বাসিন্দা।”
এখানে حجارة বলিতে সুকঠিন বিশাল কালো গন্ধক পাথরকে বুঝানো হইয়াছে। উহা দ্বারা অগ্নি প্রজ্বলিত করা হইলে উহার উত্তাপ তীব্রতর ও স্থায়ী হয়। ইহা হইতে আল্লাহ্ পাক আমাদিগকে রক্ষা করুন।
আবদুল মালিক ইব্ন মাইসারাহ আয যারর্দ, আবদুর রহমান ইব্ন ছাবিত ও আমর ইব্ন মায়মূন ধারাবাহিকভাবে আবদুল্লাহ ইব্ন মাসঊদ (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ الحجارة অর্থ বিরাট কালো গন্ধক পাথর। আল্লাহ্ পাক আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির সময়ই কাফিরদের জন্য উহা সৃষ্টি করিয়া প্রথম আসমানে রাখিয়া দিয়াছেন।’ ইন জারীরও একই ভাষায় হাদীসটি বর্ণনা করেন। আবূ হাতিমও উহা উদ্ধৃত করেন। হাকিম স্বীয় ‘মুস্তাদরাক’-এ উহা বর্ণনা করিয়া বলেনঃ হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমের শর্তমাফিক হইয়াছে।
আস্ সুদ্দী আলোচ্য আয়াতাংশের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আবূ মালিক, আবূ সালেহ, ইব্ন আব্বাস ও মুরাহ ইবন মাসউদ ও একদল সাহাবা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত একটি হাদীস উদ্ধৃত করেন। উহাতে বলা হয়-আয়াতাংশের অর্থ হইল, ‘তোমরা সেই অনলকুণ্ড হইতে বাঁচিয়া থাক যাহার ইন্ধন হইবে মানুষ ও পাথর।” এখানে পাথর বলিতে কালো গন্ধক পাথরের কথা বুঝানো হইয়াছে। উহা দ্বারা আগুন প্রজ্বলিত করিয়া শাস্তি দেওয়া হইবে।
মুজাহিদ বলেনঃ মৃত লাশের দুর্গন্ধের চাইতেও গন্ধক পাথরের দুর্গন্ধ তীব্রতর হইবে। আবূ জা’ফর ইব্ন আলী বলেনঃ এখানে পাথর দ্বারা গন্ধক পাথর বুঝানো হইয়াছে। ইব্ন জুরায়জ বলেনঃ জাহান্নামে কালো গন্ধক পাথর থাকিবে। আমাকে আমর ইবন দীনার বলিয়াছেন-ইহা দ্বারা বিশাল কালো গন্ধক পাথরের কথা বলা হইয়াছে।
একদল ব্যাখ্যাকার বলেনঃ الحجارة বলিতে মূর্তি ও প্রতিমায় ব্যবহৃত পাথরের কথা বলা হইয়াছে। যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ
انُكُم وماتعيدون من دون الله حصب جهنم “নিশ্চয় তোমরা এবং আল্লাহ্ ব্যতীত তোমাদের অন্যান্য উপাস্য প্রভুরা জাহান্নামের কাষ্ঠ হইবে।
ইমাম কুরতুবী এই অভিমত ব্যক্ত করেন। ইমাম রাযীও এই অভিমতের প্রবক্তা। তাঁহারা উভয়ই এই ব্যাখ্যাকে প্রাধান্য দিয়াছেন। তাহারা বলেন-গন্ধক পাথর দ্বারা আগুন জ্বালানো কোন নতুন কথা নহে। সুতরাং এখানে প্রতিমা ও দেব-দেবীর আকার বিশিষ্ট পাথর হওয়াই যুক্তিযুক্ত।
অবশ্য তাহাদের এই যুক্তি যথাযথ নহে। কারণ, গন্ধক পাথরের জ্বালানো আগুন অন্যান্য বস্তুর সাহায্যে জ্বালানো আগুনের তুলনায় অনেক বেশী তীব্র। উহার উত্তপ্ততা ও দহন ক্ষমতা সর্বাধিক। সুতরাং প্রথমোক্ত অন্যান্য ব্যাখ্যাকারের অভিমতই গ্রহণযোগ্য। মূলত আয়াতের উদ্দেশ্য হইল জাহান্নামীদের জন্য প্রজ্বলিত অগ্নির উত্তপ্ততা ও দহন ক্ষমতার তীব্রতা বর্ণনা করা। সেক্ষেত্রে প্রতিমা-মূর্তির সাধারণ পাথরের চাইতে গন্ধক পাথর বহুগুণ বেশী কার্যকর। তাই প্রথমোক্ত ব্যাখ্যাই যুক্তিযুক্ত। আল্লাহ্ পাক বলেনঃ
كُلّمَا خبت زدنًا هم سَعيُرًا “যখন অগ্নি শিখার তীব্রতা কমিয়া যায়, তখন আমি উহা বাড়াইয়া দেই।”
ইমাম কুরতুবীও এই মতকে প্রাধান্য দিয়াছেন। তাঁহার মতে এখানে সেই পাথরকেই বুঝানো হইয়াছে যাহা আগুনের তীব্রতা ও দহন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কার্যকর। কারণ, জাহান্নামীদেরকে কঠোর শাস্তিদান এখানে উদ্দেশ্য। এই ব্যাপারে মহানবী (সাঃ)-এর নিকট হইতে বর্ণিত অনেক হাদীস পাওয়া যায়। একটি হাদীস এইঃ
كل مؤذ فى الثار ইহার অর্থ দুইরূপ বর্ণিত হইয়াছে। এক. ‘মানুষকে কষ্টদায়ক প্রত্যেকেই জাহান্নামে যাইবে।’ দুই. ‘জাহান্নামে প্রত্যেক শ্রেণীর কষ্টদায়ক বস্তু থাকিবে।’ অবশ্য হাদীসটি ত্রুটিমুক্ত ও সুপরিচিত নহে।
أعدت لِلْكَافْر ين আয়াতাংশের তাৎপর্য হইল এই যে, জাহান্নাম কাফিরদের জন্য তৈরি করিয়া রাখা হইয়াছে। এখানে أعدت এর অন্তর্গত সর্বনামটির ইঙ্গিত সুস্পষ্টতই মানুষ ও পাথর দ্বারা প্রজ্বলিত জাহান্নামের দিকে। অবশ্য উক্ত সর্বনামটি পাথরের স্থলাভিষিক্তও হইতে পারে। তখন অর্থ দাঁড়ায়, পাথরগুলি কাফিরদের শাস্তি প্রদানের জন্য তৈরি করিয়া রাখা হইয়াছে। ইব্ন মাসউদ (রাঃ) হইতে অনুরূপ একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। মূলত এই অর্থ দুইটির মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। একটি অপরটির পরিপূরক ও পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আগুন ছাড়া যেমন পাথর জ্বলে না, তেমনি পাথর ছাড়া আগুনের দহন ক্ষমতা বাড়ে না ৷ সুতরাং উভয় বস্তুইও কাফিরদের কঠোর শাস্তি বিধানের জন্য সৃষ্টি করা হইয়াছে। ইব্ন ইসহাক এই মর্মে একটি হাদীস মুহাম্মদ, ইকরামা, সাঈদ ইব্ন জুবায়র ও ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিক সূত্রে বর্ণনা করেন। ইব্ন আব্বাস (রাঃ) أعدت للْكَافْرَيُنَ -এর ব্যাখ্যায় বলেন-কাফিরদের জন্য সেইগুলি প্রস্তুত রাখা হইয়াছে।
আলোচ্য আয়াতাংশ দ্বারা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের ইমামগণ প্রমাণ দেন যে, ‘সৃষ্টির সূচনাকাল হইতেই জাহান্নাম তৈরি করিয়া রাখা হইয়াছে।’ জাহান্নাম যে বাস্তব আকারে বর্তমানে রহিয়াছে তাহার প্রমাণ অনেক হাদীস দ্বারাই পাওয়া যায়। যেমন-জান্নাত ও জাহান্নামের ঝগড়ার বর্ণনা, জাহান্নামের প্রার্থনা মোতাবেক উহাকে বৎসরে শীত ও গ্রীষ্মে দুই বার শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণের অনুমতি প্রদানের বর্ণনা ইত্যাদি। ইব্ন মাসউদ (রাঃ) হইতে বর্ণিত এক হাদীসে আছে, আমরা একটি বিকট শব্দ শুনিয়া মহানবী (সাঃ)-এর নিকট উহার কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেনঃ
“ইহা সত্তর বৎসর পূর্বে জাহান্নামের উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত পাথরের জাহান্নামে পতিত হওয়ার আওয়াজ।’ তেমনি সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের কিংবা মি’রাজের ঘটনাবলী বর্ণনামূলক হাদীসসমূহেও প্রমাণ মিলে যে, আল্লাহ্ পাক জান্নাত ও জাহান্নাম তৈরি করিয়া রাখিয়াছেন। তবে মু’তাযিলাগণ অজ্ঞাতবশত ইহা স্বীকার করে না। অবশ্য স্পেনের কাজী মান্যার ইব্ন সাঈদ আল বালুতী ইহা স্বীকার করিয়াছেন। মু’তাযেলী হইয়াও তিনি জান্নাত-জাহান্নাম বর্তমান থাকিবার অভিমত সমর্থন করিয়াছেন।
বিশেষ জ্ঞাতব্য
فأنوا بسورة من مله আলোচ্য আয়াতাংশ ও সূরা ইউনুসের بسورة من مخْله আয়াতাংশের বক্তব্য হইতেই বুঝা যায় যে, কুরআনের এই চ্যালেঞ্জ উহার ছোট বড় যে কোন সূরার বেলায়ই প্রযোজ্য। কারণ, ব্যাকরণবিদদের মতে শর্তের সহিত অনির্দিষ্ট বিশেষ্য যুক্ত হইলে উহার যে কোন অংশের ক্ষেত্রেই উহা প্রযোজ্য, বিশেষ ক্ষেত্রে আবদ্ধ থাকে না। সুতরাং ছোট বড় সকল সূরাই যে অবিসংবাদিতার দাবীদার তাহা প্রমাণিত হইল। তাই এই ব্যাপারে ব্যাখ্যাকারগণ শ্রেণী নির্বিশেষে মতৈক্য পোষণ করেন।
ইমাম রাযী তাঁহার তাফসীর গ্রন্থে প্রশ্নোত্তর পদ্ধতিতে উহার মীমাংসা প্রদান করেন। তিনি বলেনঃ যদি প্রশ্ন করা হয় যে, فأنوا بسورة من مُمْله চ্যালেঞ্জের আওতায় সূরা আল আসর, সূরা কাওসার ও সূরা কাফিরূন-এর মত ক্ষুদ্র সূরা শামিল করা হইলে এই ধরনের কিংবা উহার কাছাকাছি সূরা রচনা করা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব হইতে পারে। সেক্ষেত্রে এগুলিকে চ্যালেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত করা দীনের উপর অপবাদ চাপানোর নামান্তর নহে কি? ইহার জবাবে আমাদের বক্তব্য এই যে, এই সকল সূরা যদি ভাষালংকারের বিচারেও শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখিয়া চলে তাহা হইলেও আমাদের দাবীর সত্যতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। অবশ্য এই জবাব আমাদের নিকট দুর্বলতর বিবেচিত হইতে পারে। উহার আরেক জবাব হইল এই, যদি তাহা সম্ভব বলিয়া আপাতত মানাও হয়, তথাপি উহার চরম বিরুদ্ধবাদীরাও উহা করিতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হওয়ায় আমাদের দাবীর সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। আমাদের প্রধান যুক্তি হইল এই যে, স্রষ্টার ছোট বড় কোন বাণীর সমকক্ষ বাণী সৃষ্টি করা কোন সৃষ্টির পক্ষে আদৌ সম্ভব নহে।
ইমাম শাফেঈ (রঃ) বলেন, মানুষ যদি শুধু সূরা আল কাওসার নিয়া চিন্তা-ভাবনা করে তাহা হইলেই কুরআনের যে কোন অংশের অবিসংবাদী হওয়া সম্পর্কে তাহারা নিশ্চিত হইতে পারে। আমর ইবনুল আস (রাঃ) হইতে আমাদের কাছে এই বর্ণনা পৌছিয়াছে যে, তিনি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে একদল প্রতিনিধিসহ মুসায়লামাতুল কায্যাবের কাছে গিয়াছিলেন। মুসায়লামা তাহাকে প্রশ্ন করিল-তোমাদের মক্কার বন্ধুর নিকট সদ্য কি কোন ওহী নাযিল হইয়াছে? তিনি জবাব দিলেন-হ্যাঁ, তাহার নিকট অত্যন্ত অলংকারপূর্ণ এক অনুপম সূরা অবতীর্ণ হইয়াছে। সে প্রশ্ন করিল-উহা কি? তিনি জবাবে সূরা আল কাওসার পাঠ করিলেন। সে কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিল-আমার উপরও তদ্রূপ একটি সূরা নাযিল হইয়াছে। তিনি প্রশ্ন করিলেন-তাহা কোন সূরা? সে জবাবে পাঠ করিলঃ
يا وبر يا وبر – انما انت اذنان وصدر – وسائرك حقر فقر
“হে ইঁদুর! হে ইঁদুর! তোর আছে শুধু দুইটি কান ও বুক। আর তো সবই তোর নগণ্য ও হীন।”
উহা পাঠান্তে সে জিজ্ঞাসা করিল-সূরাটি কিরূপ হে আমর! তিনি জবাব দিলেন-আল্লাহর কসম! তুমি অবশ্যই জান যে, আমি নিশ্চয়ই তোমাকে মিথ্যাবাদী বলিয়া জানি।
(۲۵)
وَ بَشِّرِ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَهُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِهَا الۡاَنۡهٰرُ ؕ كُلَّمَا رُزِقُوۡا مِنۡهَا مِنۡ ثَمَرَۃٍ رِّزۡقًا ۙ قَالُوۡا هٰذَا الَّذِیۡ رُزِقۡنَا مِنۡ قَبۡلُ ۙ وَ اُتُوۡا بِهٖ مُتَشَابِهًا ؕ وَ لَهُمۡ فِیۡهَاۤ اَزۡوَاجٌ مُّطَهَّرَۃٌ ٭ۙ وَّ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ
২৫. যাহারা ঈমানদার ও নেক কাজ করিয়াছে, তাহাদিগকে সেই জান্নাতের সুসংবাদ দাও যাহার নিম্নভাগে ঝর্ণাধারা প্রবহমান। যখন তোমাদিগকে উহা হইতে ফলমূল খাইতে দেওয়া হইবে, তখন বলিবে, ইহা তো আমাদিগকে পূর্বেও দেওয়া হইত; দৃশ্যত তাহাদিগকে পূর্বানুরূপ ফলমূলই দেওয়া হইবে। সেখানে তাহাদের জন্য পূত-পবিত্র স্ত্রীগণ রহিয়াছে এবং তাহারা সেখানে অনন্তকাল অবস্থান করিবে।
তাফসীরঃ আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার ও রসূলের দুশমনদের কুফরী ও নিফাকের জন্য নির্ধারিত কঠোর শাস্তি ও লাঞ্ছনার বর্ণনা প্রদানের পরক্ষণেই স্বীয় বন্ধুদের ঈমানদারী ও নেক আমলের অশেষ মর্যাদা ও পুরস্কারের বর্ণনা প্রদান করিতেছেন। এই কারণেই কুরআন পাক ‘মাছানী’ নামে অভিহিত বলিয়া একদল আলিম অভিমত প্রকাশ করেন। এই অভিমতটি সঠিক । আমি যথাস্থানে সবিস্তারে ইহা আলোচনা করিব । উহাতে দেখাইব, কুরআনে সাধারণত ঈমানের পাশাপাশি কুফরীর, সৎ কাজের পাশাপাশি অসৎ কাজের, ভালর পাশাপাশি মন্দের, জান্নাতের পাশাপাশি জাহান্নামের এক কথায় পরস্পর বিপরীত বিষয়গুলি পাশাপাশি উল্লেখ করা হইয়াছে।
আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন-‘নেককার ঈমানদারদের খবর দাও, তাহাদের জন্য রহিয়াছে পাদদেশে ঝর্ণাধারা প্রবহমান জান্নাত।’ এখানে জান্নাতের অবস্থান ও উহার কিছু পরিচয় তুলিয়া ধরা হইয়াছে। বলা হইয়াছে, উহার বাগ-বাগিচা ও ঘর-বাড়ী বিরাজমান এবং সেইগুলির পাদদেশে ঝর্ণাধারা প্রবহমান রহিয়াছে।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে-জান্নাতের পাদদেশে প্রবহমান নহরগুলি (লেকের মতই) অগভীর হইবে, আর হাউজে কাওছারের দুই তীরে লালা-মতির গড়া বিরাট প্রাসাদ সাজানো রহিয়াছে। উহার মাটি মিশকে আম্বরের সুগন্ধে ভরপুর। উহার পথে বিছানো কাঁকরগুলো হইল লাল-জহরত, পান্না-চুন্নি সদৃশ। আমরা আল্লাহ্র কাছে উহার প্রত্যাশী। তিনি পরম করুণাময় ও অশেষ দানশীল।
ইব্ন আবূ হাতিম বলেন-আমাকে রবী’ ইব্ন সুলায়মান বর্ণনা করেন, তাঁহাকে আসাদ ইব্ন মূসা, তাঁহাকে আবূ ছওবান, তাঁহাকে আতা ইব্ন কুর্রা ও তাঁহাকে আব্দুল্লাহ ইব্ন জমরা হযরত আবূ হরায়রা (রাঃ) হইতে এই হাদীসটি শুনানঃ
“রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলিয়াছেন, জান্নাতের নহরগুলি টিলার তলদেশ কিংবা মিশকের পাহাড়ের পাদদেশে হইতে প্রবাহিত হয়।”
আবূ হাতিম ‘আরও বলেন-আমাদের নিকট আবূ সাঈদ ওয়াকী’ আ’মাশ হইতে, তিনি আবদুল্লাহ ইব্ন মুরাহ হইতে ও তিনি মাসরূক হইতে এই হাদীসটি শুনান; জান্নাতের নদী-নালা মিশকের পাহাড় হইতে প্রবাহিত হইতেছে।
كلما ر رْقُوًا منها من فمرة رَرّقًا قَالُوا هذا الذئ من قَيْلٌ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লামা সুদ্দী তাঁহার তাফসীর গ্রন্থে হযরত ইবন মাসউদ (রাঃ) ও একদল সাহাবা হইতে পর্যায়ক্রমে মুরাহ, ইব্ন আব্বাস, আবূ সালেহ ও আবূ মালিক বর্ণিত এই বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেনঃ
“পূর্বেও আমাদিগকে ইহা দেওয়া হইয়াছে”–কথাটির তাৎপর্য এই যে, পার্থিব জগতের ফল-মূলের অনুরূপ ফলমূল জান্নাতে পাইয়া তাহারা বলিবে, ইহা তো আমরা দুনিয়াতেও পাইয়াছিলাম। কাতাদাহ এবং আবদুর রহমান ইব্ন যায়দ ইব্ন আসলামও এই ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ইন জারীরও এই ব্যাখ্যা সমর্থন করেন।
قَالُوًَا هذا الى رزقنًا من قَبْلُ এ আয়াতাংশের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইকরামা বলেন—ইহার অর্থ হইল, ‘গতকাল যাহা পাইয়াছিলাম, আজও তাহাই পাইলাম।’ রবী’ ইব্ন আনাস এই ব্যাখ্যার সমর্থক। উহার ব্যাখ্যায় মুজাহিদ বলেন-‘ইহা পূর্বের মতই দেখায়।’ ইন জারীরও এই ব্যাখ্যা সমর্থন করেন। অন্যান্য ব্যাখ্যাকার বলেন, জান্নাতে প্রদত্ত ফলমূলের পারস্পরিক সাদৃশ্য এত বেশী থাকিবে যে, ভিন্ন ভিন্ন ফলমূল দেখিয়াও জান্নাতীরা বলিবে, ইহাতো পূর্বেও পাইয়াছি।
وأونُوا به مَتشابهَا আয়াতাংশ সম্পর্কে সুনায়দ ইব্ন দাউদ বলেন-আমাদের কাছে মাসীসার শায়েখ আওযাঈর বরাতে ইয়াহিয়া ইব্ন কাছীরের এই বর্ণনাটি শুনানঃ জান্নাতীগণকে খাঞ্চাপূর্ণ আহার্য দান করা হইলে উহা ভক্ষণ করিবে। অতঃপর অন্য আহার্য প্রদান করা হইলে তাহারা বলিবে, এই বস্তুই তো আমাদিগকে পূর্বে দেওয়া হইত। তখন ফেরেশতাগণ বলিবেন-আকার-আকৃতি একরূপ হইলেও স্বাদ ও প্রকৃতি ভিন্ন।
ইমাম আবূ হাতিম বলেন-আমাদিগকে আমার পিতা, তাঁহাকে সাঈদ ইব্ন সুলায়মান ও তাঁহাকে আমির ইবন ইয়াসাফ ইয়াহিয়া ইব্ন কাছীর হইতে এই বর্ণনা শুনান : জান্নাতের তৃণ হইবে জাফরানী রঙের এবং উহার টিলাগুলি মিশকের ঘ্রাণে ভরপুর হইবে। গেলমানগণ খাঞ্চা ভরা ফল-মূল লইয়া জান্নাতীদের কাছে ঘুরিতে থাকিবে। জান্নাতীরা উহা হইতে আহার করিবে। দ্বিতীয়বার অনুরূপ ফল-মূল লইয়া আসিলে তাহারা বলিবে, ইহাতো তোমরা একটু আগেই আমাদিগকে খাওয়াইয়াছ। তখন গেলমানরা বলিবে—ইহা খাইয়া দেখুন, রঙ-রূপ এক দেখা গেলেও স্বাদ-স্বরূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন। وَأُوتُوا بِهِ مُتَشَابِها -এর তাৎপর্য ইহাই।
وأونُوا به مَتشابهَا প্রসঙ্গে আবূ জা’ফর রাযী রবী’ ইব্ন আনাসের বরাত দিয়া আবুল আলীয়া হইতে বর্ণনা করেন : ‘জান্নাতের ফলমূলসমূহ বাহ্যিক দৃষ্টিতে পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ হইলেও স্বাদ হইবে সম্পূর্ণ ভিন্নতর।’ ইব্ন আবূ হাতিম, রবী’ ইব্ন আনাস ও সুদ্দী হইতেও অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়।
উক্ত আয়াতাংশের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইমাম ইব্ন জারীর সুদ্দীর সনদে বর্ণিত একটি হাদীস উদ্ধৃত করেন। ইবন মাসউদও একদল সাহাবা হইতে পর্যায়ক্রমে মুরাহ, ইব্ন আব্বাস, আ সালেহ, আবূ মালিক ও সুদ্দীর বরাতে বর্ণনা করেনঃ জান্নাতী ফলমূলের পারস্পরিক সাদৃশ্যতা হইবে বাহ্যিক আকার-আকৃতির, স্বাদ- প্রকৃতির নহে। ইব্ন জারীর এই মতই গ্রহণ করিয়াছেন।
ইকরামা বলেন-বেহেশতের ফলমূল দুনিয়ার ফলমূলের সহিত দৃশ্যত সামঞ্জস্যপূর্ণ হইবে বটে, কিন্তু দুনিয়ার ফলমূলের চাইতে বেহেশতের ফলমূল অনেক উত্তম হইবে।
সুফিয়ান ছাওরী আ’মাশ হইতে, তিনি আবূ জবিয়ান হইতে ও তিনি ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ ‘দুনিয়ার কোন বস্তুই জান্নাতের কোন বস্তুর মত হইবে না, কেবলমাত্র নাম ছাড়া। অন্য এক হাদীসেও ইহার সমর্থন মিলে। উহাতে বলা হইয়াছে, ‘দুনিয়ার কোন বস্তুই জান্নাতে পাওয়া যাইবে না, শুধু উহার নাম পাওয়া যাইবে।’ বর্ণনাটি আবূ মু’আবিয়া হইতে ছওরী ও ইব্ন আবূ হাতিমের মাধ্যমে ইবন জারীর উদ্ধৃত করেন। আলোচ্য আয়াতাংশ প্রসঙ্গে আবদুর রহমান ইব্ন যায়দ ইব্ন আসলাম বলেন- জান্নাতীরা দুনিয়ার ফলমূলের মতই জান্নাতী ফলমূল দেখিয়াও বলিতে পারিবে, উহা আঙ্গুর, ইহা আপেল ইত্যাদি। তাই তাহারা বলিবে, ইহাতো আমরা দুনিয়াতেও খাইয়াছি। সুতরাং জান্নাতের ফলমূল দৃশ্যত দুনিয়ার ফলমূলের মতই হইবে, তবে স্বাদ হইবে ভিন্নতর।
لَهُمْ فَيّهًا أزواج مَُطَّهّرَةٌ আয়াতাংশ প্রসঙ্গে ইব্ন আব্বাস (রাঃ)-এর বরাত দিয়া ইন আবূ তালহা বলেন- জান্নাতের দম্পতি সর্বপ্রকার অপবিত্রতা ও কষ্ট হইতে মুক্ত হইবে। মুজাহিদ বলেনঃ তাহারা ঋতুস্রাব, মল-মুত্র, সর্দি-কাশি, বীর্য-প্রসূতি ইত্যাকার সকল ঝঞ্ঝাট হইতে মুক্ত থাকিবে। কাতাদাহ বলেন- জান্নাতের দম্পতিগণ দৈহিক ও আত্মিক সর্ববিধ অপবিত্রতা হইতে মুক্ত থাকিবেন। তিনি অপর এক বর্ণনায় বলেনঃ তাহাদের ঋতুস্রাব কিংবা অন্য কোনরূপ কষ্ট-ক্লেশ থাকিবে না। আতা, হাসান, যিহাক, আবূ সালেহ, আতিয়্যা ও সুদ্দী প্রমুখ হইতেও অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায় ৷
ইবন জারীর বলেন- আমার কাছে ইউনুস ইব্ন আবদুল আ’লা ও ইব্ন ওহাব আব্দুর রহমান ইব্ন যায়দ ইব্ন আসলাম হইতে বর্ণনা করেনঃ জান্নাতের হুরগণ এমন পূত-পবিত্র হইবেন যে, তাহাদের কখনও ঋতুস্রাব হইবে না। হযরত হাওয়া (আঃ)-কে তদ্রূপ সৃষ্টি করা হইয়াছিল। তাই তিনি আল্লাহ্ নাফরমানী করিলে আল্লাহ্ পাক তাহাকে বলেনঃ আমি তোমাকে জান্নাতে পূত-পবিত্র করিয়া সৃষ্টি করিয়াছিলাম। শীঘ্রই তোমাকে এই (গন্দম) বৃক্ষের মতই ঋতু প্রভাবাধীন ও ফলপ্রসূ করিব। অবশ্য হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল (গরীব)।
হাফিজ আবূ বকর ইব্ন মারদুবিয়্যাহ বলেনঃ নবী করীম (সাঃ) হইতে পর্যায়ক্রমে আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ), আবূ নাজরাহ, কাতাদাহ, শু’বা আবদুল্লাহ ইব্ন মুবারক, আব্দুর রায্যাক ইবন উমর আল বাযীঈ, মুহাম্মদ ইব্ন উবায়দ আলকিন্দী, আহমদ ইব্ন মুহাম্মদ আল খাওয়ারী ও জা’ফর ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ন হরবের বর্ণিত একটি হাদীস ইবরাহীম ইব্ন মুহাম্মদ আমাদের কাছে বর্ণনা করেন। উহাতে বলা হয়- ولَهُمْ فيهًَا آرواج مُطَهْرَةٌ আয়াতাংশ সম্পর্কে নবী করীম (সাঃ) বলেন, জান্নাতীরা মল-মূত্র, হায়েয-নিফাস, সর্দি-কাশি, থুথু-বমি ইত্যাকার ব্যাপার হইতে সম্পূর্ণ পূত-পবিত্র ও মুক্ত হইবে।
এই হাদীসটিও সনদের দিক দিয়া দুর্বল (গরীব)। অবশ্য হাকিম স্বীয় ‘মুস্তাদরাক সংকলনে মুহাম্মদ ইব্ন ইয়াকূব, আল হাসান ইব্ন আলী ইব্ন আফ্ফান ও মুহাম্মদ ইব্ন উবায়দের ধারাবাহিক সনদে উক্ত হাদীস উদ্ধৃত করিয়া বলেন- হাদীসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী বিশুদ্ধ। কিন্তু, তাঁহার এই দাবী পর্যালোচনা সাপেক্ষ বটে। কারণ, আব্দুর রায্যাক ইব্ন আমর আল বাযীঈ বলিয়াছেন, এই হাদীসের অন্যতম রাবী আবূ হাতিম ইব্ন হিব্বান আল বুস্তীর বর্ণনাকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করা বৈধ নহে।
এ ক্ষেত্রে আমার বক্তব্য এই যে, এই হাদীসের বর্ণনার সহিত ইতিপূর্বে উদ্ধৃত কাতাদার বর্ণিত হাদীসের সুস্পষ্ট মিল রহিয়াছে। وهم فيهًا خالدون আয়াতাংশের মর্ম হইল এই, জান্নাতীরা উহাতে অনন্তকাল অবস্থান করিবে এবং ইহাই সৌভাগ্যের পূর্ণতা বটে। এই স্থানের মতই ইহার নিয়ামতসমূহও চিরস্থায়ী। এখানে মৃত্যু ও বিলুপ্তির বিভীষিকা চিরতরে অন্তর্হিত। জান্নাতীগণ এই স্থান ও ইহার নিয়ামত হইতে কখনও বঞ্চিত হইবে না। এখানে অনন্তকাল পর্যন্ত তাহারা অজস্র নিয়ামত ভোগ করিতে থাকিবে। মহা মহীয়ান আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে আমাদের ঐকান্তিক প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদিগকে জান্নাতীগণের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি অসীম দয়ালু ও অপরিসীম দাতা।
কুরআনে প্রদত্ত উপমা ও ইহার প্রতিক্রিয়া
(٢٦)
اِنَّ اللّٰهَ لَا یَسۡتَحۡیٖۤ اَنۡ یَّضۡرِبَ مَثَلًا مَّا بَعُوۡضَۃً فَمَا فَوۡقَهَا ؕ فَاَمَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا فَیَعۡلَمُوۡنَ اَنَّهُ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّهِمۡ ۚ وَ اَمَّا الَّذِیۡنَ كَفَرُوۡا فَیَقُوۡلُوۡنَ مَا ذَاۤ اَرَادَ اللّٰهُ بِهٰذَا مَثَلًا ۘ یُضِلُّ بِهٖ كَثِیۡرًا ۙ وَّ یَهۡدِیۡ بِهٖ كَثِیۡرًا ؕ وَ مَا یُضِلُّ بِهٖۤ اِلَّا الۡفٰسِقِیۡنَ
(۲۷)
الَّذِیۡنَ یَنۡقُضُوۡنَ عَهۡدَ اللّٰهِ مِنۡۢ بَعۡدِ مِیۡثَاقِهٖ ۪ وَ یَقۡطَعُوۡنَ مَاۤ اَمَرَ اللّٰهُ بِهٖۤ اَنۡ یُّوۡصَلَ وَ یُفۡسِدُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ ؕ اُولٰٓئِكَ هُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ
২৬. নিশ্চয় আল্লাহ্ তা’আলা মশা কিংবা তদুর্ধ্ব কিছু দ্বারা উদাহরণ দিতে লজ্জা পান না। অনন্তর যাহারা ঈমানদার, তাহারা জানেন, নিশ্চয় উহা তাহাদের প্রভুর তরফ হইতে আগত সত্য। পক্ষান্তরে যাহারা কাফির, তাহারা বলে, এই (তুচ্ছতম) উদাহরণ পেশের ভিতর আল্লাহর কি অভিপ্রায় রহিয়াছে? (এইভাবে) অনেককে উহা দ্বারা পথভ্রষ্ট রাখেন ও অনেককে আবার পথপ্রাপ্ত করেন। মূলত ফাসিকগণ ব্যতীত কাহাকেও পথভ্রষ্ট রাখেন না।
২৭. তাহারাই আল্লাহর সহিত সুদৃঢ় ওয়াদা করিয়া উহা ভঙ্গ করিয়াছে এবং আল্লাহর নির্দেশিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়াছে ও পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করিয়াছে। তাহারাই নিশ্চিত ক্ষতিগ্ৰস্ত।’
তাফসীরঃ ব্যাখ্যাকার আস্ সুদ্দী তাঁহার তাফসীর গ্রন্থে ইব্ন মাসউদ ও একদল সাহাবা (রাঃ) হইতে মুরা, ইব্ন আব্বাস, আবূ সালেহ্ ও আবূ মালিকের পর্যায়ক্রমিক একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেন। উহাতে বলা হয়- মুনাফিকদের উপমা প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাকের অবতীর্ণ। مَثلهم كَمَكْلٍ الّذى اسَتَوقَدٌ ثارًا আয়াত ও أو كصيب من السّماء فيه ظلّمات আয়াত সম্পর্কে মুনাফিকরা প্রশ্ন তুলিল, মহান আল্লাহ্ কখনও এই সব নগণ্য ও ক্ষুদ্র উপমা পেশ করিতে পারেন না। এই প্রশ্নের জবাবেই উপরোক্ত আয়াতদ্বয় অবতীর্ণ হয় ৷
মুআম্মার ও কাতাদাহর উদ্ধৃতি দিয়া আবদুর রায্যাক বলেনঃ
আল্লাহ্ পাক যখন পাক কালামে মাকড়শা ও মশা-মাছির উপমা পেশ করেন, তখন মুশরিকগণ বলিল, আল্লাহর কালামে মাকড়শা ও মশা-মাছির মত ক্ষুদ্র কীট-পতংগের উপমা দেওয়া হইবে কেন? তখন আল্লাহ্ পাক ان الله لأيستحى أن يُضرب مَقلاً ما بُعوضةً فَمَا فَوْقَهًا আয়াত নাযিল করেন।
কাতাদাহর বরাত দিয়া সাঈদ বলেন- আল্লাহ্ পাক সত্য প্রকাশের জন্য ছোট বড় যে কোন বস্তুর উল্লেখ করিতে সংকোচ বোধ করেন না। পাক কালামে মাকড়শা ও মশার উল্লেখ করা হইলে ভ্রান্ত লোকরা বলিল, এহেন ক্ষুদ্র বস্তু দ্বারা উপমা পেশ করার ভিতর আল্লাহ্ কি অভিপ্রায় থাকিতে পারে? তখন আল্লাহ্ তা’আলা ان الله لأيستّحى أن يضر ب مَقَّلاً ما يَعوضة فَمَا فَوْقَهَا আয়াত নাযিল করেন।
(আমার বক্তব্য) পূর্বোল্লেখিত কাতাদাহর বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, এই আয়াত মক্কায় অবতীর্ণ হইয়াছে। আসলে তাহা ঠিক নহে। পরে কাতাদাহর উদ্ধৃতি দিয়া সাঈদ যাহা বর্ণনা করেন তাহাই সঠিক মনে হইতেছে। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
ইব্ন জারীরও মুজাহিদের বরাতে কাতাদাহ হইতে বর্ণিত দ্বিতীয় ভাষ্যের অনুরূপ ভাষ্য বর্ণনা করিয়াছেন। ইব্ন আবূ হাতিম বলেন- হাসান ও ইসমাঈল ইব্ন আবূ খালিদ হইতেও সুদ্দী ও কাতাদাহর অনুরূপ ভাষ্য বর্ণিত হইয়াছে।
আলোচ্য আয়াত প্রসঙ্গে আবূ জা’ফর রাযী রবী’ ইব্ন আনাসের উদ্ধৃতি দিয়া বলেন- আল্লাহ্ পার্থিব ভোগ বিলাসমত্ত দুনিয়াদার লোকদিগকে সতর্ক করার জন্য এই উদাহরণ পেশ করেন যে, মশা যতক্ষণ উপবাস থাকে, ততক্ষণ উহা বাঁচিয়া থাকে এবং যখনই সে আহার করিয়া মোটা-তাজা হয়, তখনই তাহার মৃত্যু হয়। উপমাটির তাৎপর্য এই যে, দুনিয়াদার মানুষ ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকিয়া যখন ফুলিয়া ফাঁপিয়া মোটা-তাজা হইতে থাকে, তখন অকস্মাৎ তাহাদের উপর আল্লাহর গজব পতিত হয়।
যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ فَلَمَا نسُوا مَاذْكّرَوَا به فَتَحَنًا علَيُهم أَبُوَاب كُل شىء ‘যখন তাহারা আমার উপদেশের কথা ভুলিয়া যায়, তখন তাহাদের জন্য আমি প্রত্যেকটি বস্তুর দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দেই ৷’
ইব্ন জারীরও অনুরূপ বর্ণনা করেন। ইব্ন আবূ হাতিম, রবী’ ইবন আনাস ও আবুল আলীয়া হইতে আবূ জা’ফর বর্ণিত হাদীসেও অনুরূপ অভিমতের সমর্থন মিলে।
আলোচ্য আয়াতের শানে নুযুল নিয়া যে বিভিন্ন মত দেখা যায়, তাহার কোটি সত্য তাহা আল্লাহ্ পাকই ভাল জানেন। তবে ইব্ন জারীর সুদ্দীর বিবরণকেই গ্রহণ করিয়াছেন। কারণ, তাহার বর্ণনা পূর্ববর্তী আয়াতের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিলক্ষিত হয়। বস্তুত উক্ত আয়াতাংশের অর্থ হইল, আল্লাহ্ তা’আলা ছোট বড় যে কোন বস্তু দ্বারা উপমা পেশ করিতে সংকোচ বোধ করেন না। কেহ কেহ বলিয়াছেন, আল্লাহ্ তা’আলা তাহা বর্ণনা করিতে ভীত হন না।
এই আয়াতাংশে ما শব্দটি স্বল্পতা প্রকাশার্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। আরবী ব্যাকরণের ‘বদলের’ নিয়মমাফিক بعوضة শব্দটি জবরের স্থানে অবস্থান করিতেছে । আরবীতে لاض ر بن ضربا مأ অর্থ হইল ‘আমি অবশ্যই খুব অল্প মারিব।’ সুতরাং এখানে ما দ্বারা ক্ষুদ্রকায় বস্তু বুঝানো হইয়াছে। অথবা এখানে بعوضة শব্দটি অনির্দিষ্ট বিশেষ্য এবং بعوضة শব্দটি উহার বিশেষণরূপে আসিয়াছে। ইব্ন জরীরের মতে এখানে ما শব্দটি أسم موصوله (সংযোজক বিশেষ্য) এবং بعوضة শব্দটি তদনুসারে হরকত গ্রহণ করিয়াছে। আরবী ভাষায় ما ও من শব্দদ্বয় নিজ নিজ অবস্থানুসারে صله -কে হরকত প্রদান করে। কারণ, উহা কখনও نكره হয় এবং কখনও আবার معرفه হয়। হাস্সান বিন ছাবিতের একটি পংক্তিতে উহার ব্যবহার লক্ষ্যণীয়ঃ
يكفى بنا فضلا على من غيرنا – حب النبي محمدايانا
(মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্য ভালবাসায় আমাদের অন্তর যে পরিপূর্ণ, অন্যান্যের উপর আমাদের মহত্ত ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য ইহাই যথেষ্ট।)
কাহারও মতে, এখানে জেরদায়ক শব্দ উহ্য থাকায় জবর বিশিষ্ট হইয়াছে। মূল বাক্যটি এইরূপ ছিলঃ
مَثَلاً مَّا بَيْنَ بَعُوضَةٌ إلى مَا فَوْقَهَا
ব্যাকরণবিদ কাসাঈ ও ফাররা এই অভিমত পোষণ করেন। যিহাক ও ইবরাহীম ইন আবলাহ পেশ দিয়া بعوضة পড়েন। ইব্ন জিন্নীর মতে يعوضة সংযোজক বিশেষ্য ما -এর صله হিসাবে বিরাজ করিতেছে। যেমন কালামে পাকে আছেঃ تماما على الذى احسن ‘পুণ্যবানকে পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হইবে।’
সিবুওয়াই বলেন, এখানে ما শব্দটি الذى শব্দের সমার্থক। সুতরাং ইহার অর্থ এই দাঁড়ায়, ‘সমালোচক তোমার নিকট যাহা বলে আমি তদ্রূপ নহি।
বস্তুত এখানে فما فوقها -এর অর্থ সম্পর্কে দুইটি মত দেখা যায়। প্রথম মত হইল এই, ক্ষুদ্রতা ও তুচ্ছতার দিক দিয়া ইহা হইতেও ক্ষুদ্রতর ও তুচ্ছতর বস্তুর উপমা দিতেও আল্লাহ্ তা’আলা সংকোচ বোধ করেন না। যেমন কেহ কাহারও কৃপণতা বা নীচতা সম্পর্কে কোন উপমা পেশ করিলে শ্রোতারা বলিয়া উঠে, সেই ব্যক্তি উহার চাইতেও অধম। কাসাঈ, আবূ উবায়দুল্লাহ প্রমুখ এই অভিমতের প্রবক্তা। হাদীস শরীফেও aage শব্দ ব্যবহৃত হইয়া অনুরূপ অর্থ প্রদান করিয়াছে। মহানবী (সাঃ) বলেনঃ
لو ان الدنيا تزن عند الله جناح بعوضة – لما سقى الكافر منها شربة ماء
(পার্থিব জগতের মূল্য আল্লাহ্ তা’আলার নিকট যদি মশার একটি ডানা সমতুল্য হইত, তাহা হইলেও তিনি কাফিরদিগকে উহার এক গ্লাস পানিও পান করিতে দিতেন না।)
দ্বিতীয় মত অনুসারে অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা ক্ষুদ্রতম মশা হইতে শুরু করিয়া উপরের যে কোন বস্তুর উপমা দিতে লজ্জিত হন না। এই মতটির প্রবক্তা হইলেন কাতাদাহ ও ইব্ দুআমা। আল্লামা ইব্ন জারীরও এই মত পছন্দ করিয়াছেন। মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ)-এর বর্ণিত এক হাদীসে এই মতের সমর্থন মিলে। মহানবী (সাঃ) বলেনঃ
مامن مسلم يشاك شوكة فما فوقها الا كتب له بها درجة ومحيت عنه بها خـطينت
(কোন মুসলমান একটি কাঁটা বিদ্ধ হইলে কিংবা উহা হইতে কোন বড় আঘাত পাইলে উহার বিনিময়ে তাহার গুনাহ মার্জনা হয় এবং আল্লাহ্র দরবারে তাহার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।)
মোটকথা উক্ত আয়াতাংশের তাৎপর্য হইল এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা মণ কিংবা উহার ছোট ও বড় যে কোন বস্তুর সাহায্যে উপমা পেশ করিতে দ্বিধান্বিত হন না। যেমন তিনি অন্যত্র বলেনঃ
يَاأيهَاالنّاس ضرب مكل فاستمعوا لَه ط ان الَّذينْ تدعون من دون الله
نْ يحْلْقَُا دُبَابًا و لَوْ إجمَسَعُوًا له م وإ يلبهم الدبَابُ شَيْنًا لأيَسْتْقدُو؛
مه ط ضعف الطالب والمطلوب
‘হে মানব! একটি উদাহরণ পেশ করা হইতেছে, মনোযোগ দিয়া শুন। আল্লাহকে ছাড়িয়া তোমরা যাহাদিগকে প্রভু বলিয়া ডাকিতেছ, তাহারা সকলে একত্রিত হইয়াও একটি মাছি সৃষ্টি করিতে পারিবে না। তেমনি মাছি তাহাদের কিছু ছিনাইয়া নিলেও তাহারা উহা ফেরৎ আনিবার ক্ষমতা রাখে না। বান্দা যেমন দুর্বল, মা’বুদও (তেমনি দুর্বল)। তিনি অন্যত্র বলেনঃ
مَثَلُ الَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ أَوْلِيَاءَ كَمَثَلِ الْعَنْكَبوتِ اتَّخَذَتْ بَيْتًا ط
وَإِنَّ أَوْهَنَ البيوت لَبَيْتُ العَنْكَبوتِ – لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ
(আল্লাহ্ ছাড়া যাহাদিগকে তাহারা অভিভাবকরূপে গ্রহণ করিয়াছে, তাহারা যেন মাকড়শা৷ মাকড়শার বানানো আশ্রয়গৃহটি অবশ্যই সর্বাধিক নাজুক। তাহারা যদি ইহা জানিত।)
তিনি আরও বলেনঃ
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ ضَرَبَ اللهُ مَثَلاً كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ أَصْلُهَا ثَابِتُ وَفَرْعُهَا
في السَّمَاء – تُؤْتي أكلها كل حين بإذْنِ رَبِّهَا ط وَيُضرِبُ اللهُ الأَمْثَالَ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ – وَمَثَلُ كَلِمَةٍ خَبِيْضَةٍ كَشَجَرَةٍ خَيْثَة ن جنتَتُنَّتْ مِنْ فَوْقِ الْأَرْضِ مَا لَهَا مِنْ قَرَارٍ يُثبِتُ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَوةِ
الدُّنْيَا وَفِي الآخِرَةِ وَيُضِلُّ الله الظالمين وقف وَيَفْعَلُ الله مايشاء
‘তোমরা কি দেখ নাই কিভাবে আল্লাহ্ তা’আলা উদাহরণ পেশ করেন? কলেমা তায়্যিবা যেন একটি পবিত্র বৃক্ষ । উহার শিকড় সুপ্রতিষ্ঠিত ও শাখা-প্রশাখা নভোমণ্ডলী জুড়িয়া রহিয়াছে । আল্লাহ্র ইচ্ছায় প্রতি মুহূর্তে উহা ফল দান করে । আল্লাহ্ এই উপমা প্রদান মানুষের উপদেশ গ্রহণের জন্য । তেমনি অপবিত্র কলেমার উপমা হইল একটি অপবিত্র বৃক্ষ । উহা ভূমির উপরে ভাসমান। উহার কোনই স্থিরতা নাই। আল্লাহ্ তা’আলা ঈমানদারগণকে দুনিয়া ও আখিরাতে সুদৃঢ় বক্তব্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখেন এবং জালিমদিগকে পথভ্রষ্ট রাখেন। আল্লাহ্র যেমন ইচ্ছা তেমনই করেন।’
অন্যত্র তিনি বলেনঃ
ضرب اللهُ مَثَلاً عَبْدًا مَمْلُوكًا لايقدر عَلَى شَيْءٍ
আল্লাহ তা’আলা এমন এক পরাধীন ভৃত্যের উপমা পেশ করিলেন, স্বেচ্ছায় যাহার কিছুই করার ক্ষমতা নাই।’
তিনি আরও বলেনঃ
ضَرَبَ اللهُ مَثَلاً رَّجُلَيْنِ أَحَدُهُمَا أَبْكَمُ لاَ يَقْدِرُ عَلَى شَيْءٍ وَهُوَ كُلٌّ عَلَى مَوْلَهُ أيْنَمَا يُوجَهُهُ لا يَأْتِ بِخَيْرٍ ط هَلْ يَسْتَوى هُوَ لا وَمَنْ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ
‘আল্লাহ্ পাক দুই ব্যক্তির উদাহরণ পেশ করিতেছেন। একজন বোবা ও বধির। সে কিছু করিতে পারে না, প্রভুর উপর বোঝা হইয়া আছে। অন্যজন ভাল কাজ করে ও ভাল কাজের নির্দেশ দেয়। উভয় কি সমান হইতে পারে?’
তিনি অন্যত্র বলেনঃ
ضَرَبَ لَكُمْ مَّثَلاً مِّنْ أَنْفُسِكُمْ ط هَلْ لَكُمْ مِنْ مَّا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ مِنْ شُرَكَاء فِيمَا رَزَقْنَاكُمْ
‘তোমাদের জন্য আল্লাহ্ পাক তোমাদের দ্বারাই উদাহরণ পেশ করিতেছেন ৷ আমি তোমাদিগকে যে সম্পদ দান করিয়াছি, তোমাদের ভৃত্যগণকে কি উহার অংশীদার মনে কর?” অন্যত্র তিনি বলেনঃ
ضرب الله مَقْلا رجلا فيه شركاء متشاكسون ‘আল্লাহ্ তা’আলা সেই ব্যক্তির উদাহরণ পেশ করিতেছেন, যাহার সমমানের অনেক ঝগড়াটে অংশীদার রহিয়াছে।’
তিনি আরও বলেনঃ
وتلك الأمثال نضربهًا للنّاس وما يَعَقَلَهًَا الا العلمون ‘এইসব উদাহরণ আমি মানুষের জন্য তুলিয়া ধরিয়াছি। তবে আলিম ছাড়া উহা কেহ বুঝিতে পারে না।’
আল-কুরআনে আরও অজস্র উদাহরণ বিদ্যমান। প্রথম যুগের কোন এক মনীষী বলিয়াছেন, আমি কুরআনের কোন উপমার তাৎপর্য অনুধাবনে ব্যর্থ হইলে অনুশোচনায় কাঁদিয়া ফেলি। কারণ, আল্লাহ্ পাক বলিয়াছেন, এইসব উদাহরণ আমি মানুষের জন্য পেশ করিয়াছি বটে। কিন্তু আলিম ছাড়া কেহ উহা বুঝিতে পারিবে না।
ان الله لأيستحى أن يُضرب ممقلا ما بعوضة فَمَا فَُوَقَها আয়াত প্রসঙ্গে মুজাহিদ বলেনঃ ঈমানদারগণ আল্লাহ্ তা’আলার যে কোন ছোট বড় উদাহরণের উপর ঈমান রাখে এবং উহা আল্লাহর তরফ হইতে প্রদত্ত বলিয়া বিশ্বাস করে। সেই সব উদাহরণ দ্বারা আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদিগকে পথ প্রদর্শন করেন।
فامًا الَّدْيْنَ امنوا فيعلمون أنه الحق من ربهم আয়াত প্রসঙ্গে কাতাদাহ বলেনঃ ‘ঈমানদারগণ জানে যে, এই উপমা তাহাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে অবতীর্ণ হইয়াছে। মুজাহিদ, হাসান ও রবী’ ইব্ন আনাস অনুরূপ ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছেন। আবুল আলীয়া উক্ত আয়াত সম্পর্কে বলেনঃ ঈমানদারগণ জানে যে, উহা আল্লাহর তরফ হইতে প্রদত্ত সঠিক উপমা ৷
وأمًا الَّديِنْ كَفْروا فَيَقُوَلُوْنَ مَاذَا راد اللَّهُ بهذا مَقَّلاً আয়াতাংশের অনুরূপ আয়াত সূরা মুদ্দাচ্ছিরেও আসিয়াছে।
মাল্লাহ্ পাক বলেনঃ
وَمَا جَعَلْنَا أَصْحَابَ النَّارِ َالا مَلائِكَةً وَمَا جَعَلْنَا عِدَّتَهُمْ إِلَّا فِتْنَةً لِلَّذِينَ كَفَرُوا لِيَسْتَيْقِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَيَزْدَادًا الَّذِينَ آمَنُوا إِيمَانًا وَلَا يَرْتَابَ الَّذِينَ أوتُوا الْكِتَابَ وَالْمُؤْمِنُونَ ، وَلِيَقُولُ الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مُرْضَ وَالْكَافِرُونَ – مَاذَا أَرَادَ اللَّهُ بِهَذَا مَثَلاً ط كَذَالِكَ يُضِلُّ اللهُ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَمَا ط يعلم جنود رَبَّكَ الَّا هُوَ
‘আমি জাহান্নামীদেরকে ফেরেশতা মুক্ত রাখি নাই এবং উহাদের সংখ্যাকে কাফিরদের দুর্ভাবনার ব্যাপারে পরিণত করিয়াছি। আহলে কিতাবগণও ইহা বিশ্বাস করে এবং ঈমানদারগণের ঈমান আরও বৃদ্ধি করে। এই বিষয়ে আহলে কিতাব ও ঈমানদারগণের কোন সংশয় নাই। কিন্তু ব্যাধিগ্রস্ত অন্তরের লোক ও কাফিররা প্রশ্ন তোলে, এই উপমা দ্বারা আল্লাহ্ তা’আলা কি বুঝাইতে চাহেন? এইভাবে ‘আল্লাহ্ তা’আলা যাহাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট রাখেন এবং যাহাকে ইচ্ছা পথ দেখান। তোমার প্রতিপালকের সেনা-সৈন্যের হদিস তিনি ভিন্ন অন্য কাহারও জানা নাই।’
يُضل به كَثيرًا ويهدئ به كَشْيْرًا- وَمَايْضْل به الا الفاسقين আয়াত সম্পর্কে আস্ সুদ্দী তাঁহার তাফসীর গ্রন্থে ইবন মাসউদ ও একদল সাহাবা (রাঃ) হইতে পর্যায়ক্রমে মুরাহ, ইব্ন আব্বাস, আবূ সালেহ ও আবূ মালিক বর্ণিত এক হাদীস উদ্ধৃত করেন। উহাতে বলা হয়ঃ আয়াতে ‘বহু লোককে পথভ্রষ্ট রাখেন’ বক্তব্যটি মুনাফিকদের জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে। তেমনি ‘বহু লোককে পথ প্রদর্শন করেন’ বক্তব্যটি দ্বারা ঈমানদারগণকে বুঝানো হইয়াছে। আল্লাহ্ প্রদত্ত উপমাকে মিথ্যা জানার দরুন উহাদের ভ্রান্তি বাড়িয়া যায় এবং উহাদের অন্তরের ব্যাধি পূর্ণত্ব প্রাপ্ত হয়। ফলে উহারা অধিকতর বিভ্রান্ত হয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ্ দেওয়া উপমা বিশ্বাস করায় ঈমানদারগণের ঈমানে সংযোজন ঘটে এবং তাহাদের ঈমান প্রবলতর হয়। ফলে তাহারা আরও পথপ্রাপ্ত হয়। ইহাই আল্লাহ্ তা’আলার ভ্রান্ত করা ও পথ দেখানোর তাৎপর্য। আলোচ্য আয়াতের ‘ফাসিক ব্যতীত কাহাকেও পথভ্রষ্ট রাখেন না’ বক্তব্যটিও মুনাফিকদের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হইয়াছে।
وما يُضل به الا الْفُاسقين আয়াতাংশ প্রসঙ্গে আবুল আলীয়া বলেনঃ ফাসিক বলিতে মুনাফিকদের বুঝানো হইয়াছে। রবী’ ইব্ন আনাসও এই অভিমত প্রকাশ করেন। মুজাহিদের বরাত দিয়া ইবন জুরায়জ হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ এখানে ফাসিক অর্থ কাফির। কারণ, এই উপমার তাৎপর্য তাহারা বুঝিয়াও অস্বীকার করিতেছে।
وما يُضل به الأ الْفَاسقين আয়াতাংশ সম্পর্কে কাতাদাহ বলেনঃ আল্লাহ্ পাকের উপমা শুনিয়াও তাহারা মানে না বলিয়া ফাসিক আখ্যা পাইয়াছে। তাহাদের ফাসেকী কার্যের দরুন তাহাদিগকে পথভ্রষ্ট রাখা হইয়াছে।
ইব্ন আবূ হাতিম বলেনঃ আমাকে আমার পিতা, তাঁহাকে ইসহাক ইব্ন সুলায়মান, তাঁহাকে আবূ সিনান, তাঁহাকে আমর ইব্ন মুরাহ, তাঁহাকে মাসআব ইব্ন সা’দ ও তাহাকে তাঁহার পিতা সা’দ এই বর্ণনা শুনান যে, يُضل به كتير আয়াতাংশ দ্বারা খারেজী সম্প্রদায়কে বুঝানো হইয়াছে ৷
শু’বা আমর ইব্ন মুররাহ হইতে, তিনি মাসআব ইবন সা’দ হইতে ও তিনি সা’দ হইতে বর্ণনা করেন- ألَدِيْنَ ينْقُضوْن عَهدَ الله منْ َعْد ميْفَاقه আয়াতাংশ দ্বারা হরুরীয়াগণকে বুঝানো হইয়াছে।
সা’দ ইব্ন আবূ ওয়াক্কাসের সূত্রে বর্ণিত উক্ত হাদীসের সনদ যদিও শুদ্ধ, তথাপি ব্যাখ্যাটিকে শাব্দিক বলা যায় না, উহাকে মর্মগত ব্যাখ্যা বলা যাইতে পারে। কারণ, নাহরাওয়ানে যাহারা হযরত আলী (রাঃ)-এর দল ত্যাগ করিয়া খারেজী হইল, তাহারা উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর আবির্ভূত হইয়াছে। সুতরাং এই আয়াতের মাধ্যমে খারেজীদের গুণ ও বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাইতে পারে বটে, কিন্তু ইহার শানে নুযূল খারেজীরা নহে। ইমামের আনুগত্য পরিত্যাগ ও শরীয়ত প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব বর্জনের কারণে তাহাদিগকে উক্ত আয়াতের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত করা যাইতে পারে। আর এই কারণেই তাহাদিগকে খারেজী বলা হয়। আভিধানিক অর্থে আনুগত্য হইতে যাহারা খারিজ হয় তাহাদিগকে খারেজী বলে। আরবী পরিভাষায় ‘ফাসিক’ অর্থও আনুগত্য মুক্ত। উপরের খোসার বন্ধন মুক্ত হইয়া যখন শাঁস বাহির হয়, তখন আরবগণ বলেন, فسقت তাই আরবী ভাষায় ইঁদুরকে فويسقة বলা হয়। কারণ, ইহা মাটির আবরণ ভেদ করিয়া বাহিরে আসিয়া মানুষের ক্ষতি করে।
বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আয়েশা (রাঃ) হইতে বর্ণিত হাদীসে আছে, নবী করীম (সাঃ) বলেনঃ
خمس فواسق يقتان فى الحل والحرم – الغراب والحداة والعقرب والفارة والكلب والعقور
‘পাঁচ শ্রেণীর অনিষ্টকর জীব হারাম শরীফে কিংবা বাহিরে যেখানে পাইবে হত্যা করিবে। উহা হইল কাক, চিল, বিচ্ছু, ইঁদুর ও কালো কুকুর।’
এই হাদীসের আলোকে বুঝা যায়, কাফির, মুনাফিক ও পাপী সব শ্রেণীই ফাসিক পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত। তবে কাফিরের পাপ ও অত্যাচার অধিক প্রকট ও প্রবল। তাই আলোচ্য আয়াতে ফাসিক বলিতে কাফিরগণকেই বুঝানো হইয়াছে। পরবর্তী আয়াতে বর্ণিত গুণাবলী ও উহার ভাষ্য হইতেও তাহাই প্রমাণিত হয়। যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ
الَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللهُ بِهِ أَنْ يُوْصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ هُمُ الْخَسِرُونَ
‘যাহারা আল্লাহ্ সহিত অঙ্গীকার করার পর উহা ভঙ্গ করে ও আল্লাহ্ পাক যে সম্পর্ক বহাল রাখার নির্দেশ দেন তাহা ছিন্ন করে এবং ভূ-পৃষ্ঠে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে তাহারাই ক্ষতিগ্ৰস্ত।’ উপরে বর্ণিত বিশেষণগুলি কেবল কাফিরদেরই বৈশিষ্ট্য। মু’মিনদের বৈশিষ্ট্য ইহার বিপরীত।
যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ
أَفَمَنْ يَعْلَمُ أَنَّمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَّبِّكَ الْحَقُّ كَمَنْ هُوَ أَعْمَى ط إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أولُوا الأَلْبَابِ – الَّذِينَ يُوفُونَ بِعَهْدِ اللَّهِ وَلَا يَنْقُضُونَ الْمِيْثَاقَ – وَالَّذِينَ يَصِلُونَ ما أمر الله به أنْ يُوصَلَ وَيَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ وَيَخَافُونَ سُوء الحساب وَالَّذِيْنَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ ، أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدار
‘যে ব্যক্তি তোমার প্রভুর নিকট হইতে তোমার কাছে অবতীর্ণ বাণীকে সত্য বলিয়া জানে, সে কি এই ব্যাপারে অন্ধ ব্যক্তির সমান হইতে পারে? শুধুমাত্র জ্ঞানীগণই উপদেশ গ্রহণ করে। যাহারা আল্লাহ্র সহিত কৃত ওয়াদা রক্ষা করে, অঙ্গীকার ভঙ্গ করে না, আল্লাহ্ নির্দেশিত সম্পর্ক বহাল রাখে এবং তাহাদের প্রতিপালককে ভয় করে ও সন্ত্রস্ত থাকে কঠিন শাস্তির ভয়ে …… পক্ষান্তরে যাহারা আল্লাহকে প্রদত্ত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, আল্লাহর নির্দেশিত সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং ভূ-পৃষ্ঠে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাহারাই অভিশপ্ত আর তাহাদের জন্য রহিয়াছে বড়ই নিকৃষ্ট নিরাস।’
এই আয়াতে কাফিরদের যে অঙ্গীকার ভঙ্গের কথা বলা হইয়াছে তাহা কোন্ অঙ্গীকার উহা লইয়া মতভেদ রহিয়াছে। একদল বলেন- আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার নবীর মাধ্যমে অবতীর্ণ কিতাবে মানুষকে যে সৎ কাজের নির্দেশ ও অসৎ কাজের নিষেধাজ্ঞা প্রদান করিয়াছেন, তাহা অমান্য করাকেই ‘অঙ্গীকার ভঙ্গ করা’ বলা হইয়াছে।
অপর দল বলেন, এখানে অঙ্গীকার ভঙ্গকারী ফাসিক বলিতে আহলে কিতাবের কাফির ও মুনাফিকদের বুঝানো হইয়াছে। কারণ, তাহারা তাওরাত-ইনজীলের বিধান মানিয়া চলার অঙ্গীকার করিয়াছিল। উহাতে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আবির্ভাবের পর তাঁহাকে ও তাঁহার উপর অবতীর্ণ গ্রন্থকে মানিয়া চলার নির্দেশ রহিয়াছে। কিন্তু তাঁহার আবির্ভাবের পর তাঁহাকে ভালভাবে চিনিতে পারিয়াও মানিয়া নেয় নাই। ইহাকেই বলা হইয়াছে অঙ্গীকার ভঙ্গ করা। ইব্ন জারীর এই অভিমত পছন্দ করিয়াছেন। মাকাতিল ইব্ন হাইয়ানও এই অভিমত সমর্থন করিয়াছেন।
তৃতীয় দল বলেন- এখানে অঙ্গীকার ভঙ্গকারী ফাসিক বলিতে সকল কাফির, মুশরিক ও মুনাফিকদের বুঝানো হইয়াছে, কোন শ্রেণী বিশেষকে বুঝানো হয় নাই। কারণ, সকল মানুষের নিকট হইতে আল্লাহ্র একক প্রভুত্বকে মানিয়া চলার অঙ্গীকার নেওয়া হইয়াছিল। অথচ উহারা প্রাকৃতিক জগতের অজস্র নিদর্শন ও নবী রাসূলদের প্রদর্শিত অসংখ্য মু’জিযা দেখিয়াও আল্লাহ্ একক প্রভুত্ব মানিয়া নেয় নাই। ইহাই অঙ্গীকার ভঙ্গ করা।
মাকাতিল ইব্ন হাইয়ানের একটি বর্ণনা এই মতকে সমর্থন করে। ইমাম রাযীও এই মতের দিকে ঝুঁকিয়াছেন। তিনি বলেন, আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আল্লাহ্ কোন্ জিনিসের অঙ্গীকার নিয়াছেন? তাহার জবাবে বলিব, মানুষের জ্ঞানজগতে আল্লাহর একত্ববাদের যে প্রমাণ নিহিত রহিয়াছে, মানুষ তাহা মানিয়া চলিবে, এই অঙ্গীকারই আল্লাহ্ তা’আলা মানুষের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছেন।
যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ
وأشهدهم على أنه نفسسهم الست بربكم قَالُوَا بُلى ‘তাহারা নিজেদের অনুকূলে নিজেরাই সাক্ষী হইয়াছিল। প্রশ্ন করা হইল— আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নহি? সকলেই জবাব দিল- হ্যাঁ।’
অতঃপর তাহাদিগকে যত কিতাব প্রেরণ করা হইয়াছে, তাহাতেও অঙ্গীকার নেওয়া। হইয়াছে এবং বলা হইয়াছেঃ
أوفوا بعهدى أوف بعهدكم ‘তোমরা আমাকে প্রদত্ত অঙ্গীকার পূরণ কর, তোমাদিগকে প্রদত্ত অঙ্গীকার পূরণ করিব।’
চতুর্থ দল বলেন- আলোচ্য আয়াতে অঙ্গীকার ভঙ্গের ভাষ্য দ্বারা পৃথিবীতে আসার আগে মানুষের রূহসমূহ হইতে যে অঙ্গীকার আল্লাহ্ তা’আলা গ্রহণ করিয়াছিলেন, উহা ভঙ্গের কথা বুঝানো হইয়াছে। বাবা আদমের পৃষ্ঠদেশ হইতে আত্মাসমূহকে বাহির করার সময়ে আল্লাহ্ তাহাদের নিকট হইতে তাঁহার একক প্রভুত্ব মানিয়া লওয়ার অঙ্গীকার নেন। তিনি বলেনঃ
وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنْ بَنِي آدَمَ مِنْ ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَى أَنْفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوا بَلَى
‘অনন্তর তোমার প্রভু আদমের পৃষ্ঠদেশে তাহার বংশাবলী থাকা অবস্থায় তাহাদের নিকট হইতে অঙ্গীকার নিয়াছিলেন আর নিজেদের অঙ্গীকারের সাক্ষী তাহারা নিজেরাই ছিল- আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নহি? তাহারা সকলেই জবাব দিল- হ্যাঁ, আমরা সাক্ষ্য দিতেছি (তুমিই আমাদের একমাত্র প্রতিপালক প্রভু)।’
সুতরাং অলোচ্য আয়াতে এই অঙ্গীকার ভঙ্গের কথাই বলা হইয়াছে। মাকাতিল ইব্ন হাইয়ান এই মতকেও সমর্থন করিয়াছেন। ইব্ন জারীর তাঁহার তাফসীরে উপরে বর্ণিত সকল মতই উদ্ধৃত করিয়াছেন।
الَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِ ويَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ
يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ هُمُ الْخَسِرُونَ
আয়াত প্রসঙ্গে আবূ জা’ফর রাযী রবী‘ ই আনাস ও আবুল আলীয়ার উদ্ধৃতি দিয়া বর্ণনা করেনঃ আল্লাহর সহিত কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করা মুনাফিকদের কাজ আর মুনাফিকীর পরিচয় হইল নিম্নবর্ণিত ছয়টি চরিত্র।
তাহারা বিজিত অবস্থায় থাকিলেঃ এক. কথা বলিলে মিথ্যা বলে। দুই. ওয়াদা করিলে তাহা ভঙ্গ করে। তিন. আমানত রাখিলে খিয়ানত করে।
তাহারা বিজয়ী অবস্থায় থাকিলেঃ চার. আল্লাহকে প্রদত্ত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে। পাঁচ. আল্লাহর নির্দেশিত সম্পর্ক ছিন্ন করে। ছয়. ভূ-পৃষ্ঠে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে।
আল্লামা সুদ্দী তাঁহার তাফসীরে এই সূত্রে الذين ينقضون عهد الله من بعد ميِفاقه আয়াত প্রসঙ্গে বর্ণনা করেনঃ কুরআনের বিধি-নিষেধ পাঠ করা এবং উহাকে সত্য বলিয়া জানার পর উহাকে অস্বীকার ও অমান্য করাই হইতেছে অঙ্গীকার ভঙ্গ করা।
ويقطعون ما أمر الله به أن مُوصل আয়াতাংশের মর্ম হইতেছে রক্ত সম্পর্কের নিকটাত্মীয়দের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করা, যাহা রক্ষা করার নির্দেশ রহিয়াছে। ইহা কাতাদাহ প্রদত্ত ব্যাখ্যা। এই আয়াতের মর্মের সহিত সামঞ্জস্যশীল অপর আয়াত এইঃ
فهل عسيتم أن تَولَيتم أن تَفُسدِوًَا فى الآرضٍ وتقطعوا أرحامكم ‘তোমরা যদি ফিরিয়া যাও, তাহা হইলে পৃথিবীতে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করা ও তোমাদের রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করার আশু সম্ভাবনা নয় কি?’
ইবন জারীর এই ব্যাখ্যাকেই প্রাধান্য দিয়াছেন। অবশ্য উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইহাও বলা হয় যে, উহার বক্তব্য বিশেষ ধরনের সম্পর্ক বা অবস্থার সহিত সম্পৃক্ত নহে, বরং উহা সাধারণভাবে প্রযোজ্য। আল্লাহ্ পাক যত কিছুর সহিত সম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দিয়াছেন, উহার সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া আল্লাহ্ পাকের নির্দেশ অমান্য করাই এই আয়াতের তাৎপর্য।
هم الخاسرون আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় মাকাতিল ইব্ন হাইয়ান বলেনঃ তাহারা পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। যেমন কুরআন পাকের অন্যত্র বলা হইয়াছেঃ
أو لمك لَهُمْ اللَّعْنْةُ وَلَّهُمْ سوء الذار ‘তাহাদের জন্য রহিয়াছে অভিসম্পাত ও নিকৃষ্ট নিবাস।’
যিহাকের বর্ণনা, ইব্ন আব্বাস বলিয়াছেন- কুরআন পাকে মুসলমান ব্যতীত অন্যান্যদের যেখানেই خاسرون (ক্ষতিগ্রস্ত) বলিয়াছে, সেখানে কাফেরদিগকেই বুঝানো হইয়াছে। আর যেখানে উহা মুসলমানদের জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে, সেখানে পাপী মুসলমানকে বুঝানো হইয়াছে।
أو لمك هم الخسرون আয়াতাংশ প্রসঙ্গে ইব্ন জারীর বলেন, خاسر শব্দের বহুবচন خاسرون অর্থ তাহারা নিজেদের ক্ষতিসাধন করিয়াছে। কারণ, তাহারা নশ্বর পৃথিবীর লালসায় নিমজ্জিত ও আল্লাহ্ তা’আলার অনন্তকালীন রহমত হইতে নিজদিগকে বঞ্চিত করিয়াছে। যেমন কেহ ব্যবসায়ে নামিয়া মূলধন নষ্ট করিলে কিংবা উহাতে ঘাটতি সৃষ্টি করিলে বলা হয় যে, সে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। তেমনি পরকালের পুঁজি আল্লাহর রহমত হইতে কাফির ও মুশরিকরা নিজদিগকে বঞ্চিত করিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। এই ধরনের ক্ষতিগ্রস্তকে আরবী ভাষায় خسر يخسر لحخسرانا خسارا শব্দমালায় ভূষিত করা হয়। কবি জারীর ইন আতিয়্যার কবিতায় আছেঃ
ان سليطافى الخسار انه * اولاد قوم خلقوا اقنه
‘কর্কশভাষী সর্বদাই ক্ষতিগ্রস্ত হর ৷ কারণ, মানব জাতির সন্তান-সন্ততিকে দাসরূপেই সৃষ্টি করা হইয়াছে।
পুনর্জীবনের প্রমাণ
(۲۸)
كَیۡفَ تَكۡفُرُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ كُنۡتُمۡ اَمۡوَاتًا فَاَحۡیَاكُمۡ ۚ ثُمَّ یُمِیۡتُكُمۡ ثُمَّ یُحۡیِیۡكُمۡ ثُمَّ اِلَیۡهِ تُرۡجَعُوۡنَ
২৮. তোমরা কিরূপে আল্লাহ্ তা’আলাকে অস্বীকার কর? অথচ তোমরা মৃত ছিলে; তিনিই তোমাদিগকে প্রাণ দান করিয়াছেন। তিনি আবার তোমাদিগকে মৃত করিবেন এবং পুনরায় তোমাদের জীবন দান করিবেন। অবশেষে তোমরা তাঁহার কাছেই প্রত্যাবর্তন করিবে ৷
তাফসীরঃ আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় অস্তিত্ব, মহাপরাক্রম, অসীম ক্ষমতা এবং সৃষ্টিকুলের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা হওয়ার যুক্তি-প্রমাণ পেশ করিয়াছেন। তিনি ইরশাদ করেনঃ তোমরা কিরূপে সেই আল্লাহ্র অস্তিত্ব ও অপরিসীম ক্ষমতাকে অস্বীকার করিবে কিংবা তাঁহার অংশীদার বানাইয়া উপাসনা করিবে, যিনি তোমাদিগকে অস্তিত্বহীন অবস্থা হইতে অস্তিত্ববান করিয়াছেন এবং আবার অস্তিত্বহীন করিয়া পুনরায় অস্তিত্ববান করিবেন? কুরআন মজীদের অন্যত্র তিনি বলেনঃ
ام خلقوا من غير شىء أم هم الخالقون آم خَلّقُوا السموت والارض – بل لايوفَنْونْ
‘তাহারা কি কোন বস্তু ছাড়াই সৃষ্টি হইয়াছে, না তাহারা নিজেরাই নিজেদের স্রষ্টা? নভোমণ্ডলী ও পৃথিবী কি তাহারাই সৃষ্টি করিয়াছে? তাহা নহে, বরং তাহারা আস্থা স্থাপন করিতেছে না।’
তিনি অন্যত্র বলেনঃ
هل أتئ على الائسان حين من الذهر لم يَكُنْ شَيْمًا مَذَكُوْوًا নিশ্চয় মানুষের সৃজন পরিক্রমায় এমন একটি দিন থাকে যখন তাহারা উল্লেখযোগ্য কোন বস্তু ছিল না।’ কুরআনে এরূপ আরও বহু আয়াত বিদ্যমান। আব্দুল্লাহ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) হইতে পর্যায়ক্রমে আবুল আহওয়াস, আবূ ইসহাক ও সুফিয়ান ছাওরী বর্ণনা করেনঃ হাশরের ময়দানে কাফিরদের বক্তব্য-
قَالُوَا رَبّنًا أمتْنًا انْنْتين وأحَيَيْنًا انْنْتَيْن فَاعَتَرفنًا بذتوبِنَا
(হে আমাদের প্রতিপালক । আমাদিগকে দুইবার মৃত করিয়াছ এবং দুইবার জীবিত করিয়াছ। তাই আমরা আমাদের অপরাধ স্বীকার করিতেছি) এবং আলোচ্য وَكُنْتُمْ أَمُوَافًا فَأَحِيَاكُم م يَمِيْحكُمْ ثم يحييكم আয়াতাংশের বক্তব্যে পূর্ণ সামঞ্জস্য রহিয়াছে। ইব্ন জুরায়জ আতা হইতে ও তিনি আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেন যে, তিনি وكثتم أموانًا فأحياكم ّم يميتكم ثم يحييكم আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় বলেন- তোমরা তোমাদের পিতার পৃষ্ঠদেশে মৃতবৎ ছিলে, তখন তোমরা কোন বস্তুই ছিলে না। অতঃপর আল্লাহ্ পাক তোমাদিগকে সৃষ্টি করিলেন। তারপর আবার মৃত করিলেন। পুনরায় পুনরুত্থান দিবসে জীবিত করিবেন। সুতরাং এই আয়াতের বক্তব্যের সহিত أمتنا اننتين وأحبَينًا امْنْمَيْن আয়াতের বক্তব্য মিলিয়া যাইতেছে।
ইব্ন আব্বাস (রাঃ)-এর উদ্ধৃতি দিয়া যিহাক বর্ণনা করেনঃ رَبنا أَمْنا اهْنْتَيِنَ وأ حَيَينًا أنْنْتَيْن আয়াতে মর্ম হইতেছে এই যে, তোমরা সৃষ্টি করার পূর্বে মাটি ছিলে অর্থাৎ মৃত ছিলে। অতঃপর তোমাদিগকে সপ্রাণ সৃষ্টি করা হইল। ইহা তোমাদের প্রথম জীবন। অতঃপর তোমাদের মৃত ’করা হইবে এবং তোমরা কবরে যাইবে। ইহা তোমাদের দ্বিতীয় মৃত্যু। অবশেষে পুনরুত্থান দিবসে তোমাদিগকে পুনরায় জীবিত করা হইবে। ইহা হইল তোমাদের দ্বিতীয় জীবন। আল্লাহ্ তা’আলা আলোচ্য আয়াতে এই দুইবার মৃত্যু ও দুইবার জীবিত হওয়ার কথা উল্লেখ করিয়াছেন।
আল্লামা সুদ্দী ‘আবূ মালিক হইতে, তিনি আবূ সালেহ হইতে, তিনি ইব্ন আব্বাস ও মুরাহ হইতে এবং তাহারা ইব্ন মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিক সনদে এবং আবুল আলীয়া, আল্ হাসান, মুজাহিদ, কাতাদাহ, আবূ সালেহ, যিহাক ও আতা আল খোরাসানী হইতে তাহাদের স্ব-স্ব সনদে আলোচ্য আয়াতের উপরোক্ত ব্যাখ্যা বর্ণনা করেন । সুদ্দী ও আবূ সালেহের উদ্ধৃতি দিয়া সুফিয়ান ছাওরী আলোচ্য আয়াত প্রসঙ্গে বলেন- কবরে তোমাদিগকে জীবিত করিবেন, আবার মৃত করিবেন৷
ইব্ন জারীর ইউনুস হইতে, তিনি ইব্ন ওহাব হইতে ও তিনি অব্দুর রহমান ইব্ন যায়দ ইব্ন আসলাম হইতে ধারাবাহিক সনদে বর্ণনা করেন- আল্লাহ্ তা’আলা মানুষকে প্রথম বাবা আদমের পৃষ্ঠদেশে সৃষ্টি করেন। সেখানে তিনি তাহাদের নিকট হইেেত আনুগত্যের স্বীকৃতি নেন। অতঃপর তাহাদিগকে মৃত করেন। অতঃপর মাতৃগর্ভে তাহাদিগকে সৃষ্টি করেন। অতঃপর তাহাদিগকে মৃত্যু দান করেন। বিচার দিবসে আবার তাহাদিগকে পুনরুজ্জীবিত করিবেন। ইহাই আল-কুরআনের قَالَوا رَبِنًا أمتنا امْنَتين وأحيينا امْنْتين আয়াতে বর্ণিত হইয়াছে। অবশ্য এই হাদীসটি ও পূর্বোক্ত হাদীসটি সনদের বিচারে ‘গরীব’ শ্রেণীভুক্ত। আলোচ্য আয়াত প্রসঙ্গে ইব্ন মাসউদ, ইব্ন আব্বাস (রাঃ) ও একদল তাবেঈনের যে সব বর্ণনা উদ্ধৃত করা হইয়াছে উহাই সঠিক ও বিশুদ্ধ। তাঁহাদের বর্ণনার সহিত নিম্ন আয়াতের মিল রহিয়াছে। আল্লাহ্ বলেনঃ كل اللهُ يُحِْيْكُمْ ْم يُميْتكُمْ هم َجْمَعُكُمْ إلى يَوْم القيامة لأرَيْبَ فِيْه ‘তুমি বল, আল্লাহ্ই তোমাদিগকে সপ্রাণ করিয়াছেন, অতঃপর তোমাদিগকে নিষ্প্রাণ করিবেন। অতঃপর তোমাদিগকে কিয়ামতের দিন একত্রিত করিবেন- সেই দিনটি সম্পর্কে কোনই সন্দেহ নাই।’
“মুশরিকদের উপাস্য দেব মূর্তিগুলিকেও আল্লাহ্ তা’আলা মৃত বলেনঃ
أموات غَيْرُ أَحياء ج وما يَشْمُرُوْن উহারা সবাই মৃত, কেহই জীবিত নহে। উহাদের বোধশক্তি বলিতেও কিছু নাই।’
আল্লাহ্ পাক ভূমির জীবন-মৃত্যু সম্পর্কে বলেনঃ
وَأيَةً لَّهُمُ الأَرْضُ الْمَيْتَةُ : أَحْيَيْنَاهَا وَأَخْرَجْنَا مِنْهَا حَبًّا فَمِنْهُ يَأْكُلُونَ
‘আর তাহাদের জন্য মৃত-অনুর্বর ভূমিতেও নিদর্শন রহিয়াছে। উহাকে আমিই জীবিত-উর্বর ভূমি করিয়াছি এবং উহা হইতে বীজ-ফসলাদি উৎপন্ন করিয়াছি। তাহা হইতে সকলে আহার করে।’