(۲۱)

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اعۡبُدُوۡا رَبَّكُمُ الَّذِیۡ خَلَقَكُمۡ وَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُوۡنَ

(۲۲)

الَّذِیۡ جَعَلَ لَكُمُ الۡاَرۡضَ فِرَاشًا وَّ السَّمَآءَ بِنَآءً ۪ وَّ اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَخۡرَجَ بِهٖ مِنَ الثَّمَرٰتِ رِزۡقًا لَّكُمۡ ۚ فَلَا تَجۡعَلُوۡا لِلّٰهِ اَنۡدَادًا وَّ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ

২১. হে মানব! তোমরা ইবাদত কর সেই প্রতিপালকের যিনি তোমাদিগকে ও তোমাদের পূর্বপুরুষগণকে সৃষ্টি করিয়াছেন; হয়ত তোমরা মুত্তাকী হইতে পারিবে।

২২. অনন্তর তিনিই পৃথিবীকে তোমাদের জন্য বিছানা ও আকাশকে ছাদ স্বরূপ গড়িয়াছেন এবং আকাশ হইতে পানি বর্ষণ করিয়া তোমাদের জীবিকার জন্য ফল-মূল উৎপাদন করেন। অতএব জানিয়া শুনিয়া কাহাকেও আল্লাহর সমকক্ষ করিও না।

তাফসীরঃ উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ পাক তাঁহার একত্ব ও প্রভুত্বের বর্ণনা দিয়াছেন। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার সৃষ্টিকুলকে অনস্তিত্ব হইতে অস্তিত্ববান করিয়া নিজ বান্দাদের প্রতি বদান্যতার চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়াছেন। তিনি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নানাবিধ নি‘আমাত দান করিয়া তাহাদিগকে ধন্য করিয়াছেন। পৃথিবীকে বিছানার মত আরামদায়ক করিয়া উহার বিভিন্নস্থানে পাহাড়-পর্বত স্থাপন পূর্বক সুস্থির ও অবিচলরূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। তেমনি আকাশকে তিনি তাহাদের জন্য ছাদরূপে গড়িয়া রাখিয়াছেন। তাই আল্লাহ্ তা’আলা কুরআন পাকের অন্যত্র বলেনঃ

وَجَعَلْنًا السَّمَاءَ سَقْفًا مَحْفُوْظًا وَهُمْ مَنْ ايَاتهًا مُعْرضون “আমি আকাশকে সুরক্ষিত ছাদরূপে গড়িয়া রাখিয়াছি। অথচ তাহারা উক্ত নিদর্শনাবলী হইতে ঘাড় ফিরাইয়া নেয়।”

পূর্বোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা আকাশ হইতে পানি বর্ষণ বলিতে ভূ-পৃষ্ঠের প্রয়োজনের সময় মেঘ হইতে বৃষ্টি বর্ষণের কথা বুঝাইয়াছেন । তিনি মেঘ হইতে বারি সিঞ্চনের সাহায্যে ক্ষেত-খামারের ফসল ও বাগ-বাগিচায় ফল-মূল উৎপন্ন করেন। উহাই মানবকুল ও পশুপাখীর জীবিকায় পরিণত হয় । এই ব্যাপারটি কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখিত হইয়াছে। যেমন আল্লাহ্ পাক বলেনঃ

الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضِ قَرَارًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَصَوَّرَكُمْ فَأَحْسَنَ صُوَرَكُمْ ورزقَكُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ ذَالِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ . فَتَبَارَكَ اللهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ

“তিনিই তোমাদের জন্য পৃথিবীকে সুস্থিররূপে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন এবং আকাশকে গড়িয়াছেন ছাদরূপে। অতঃপর তোমাদিগকে সুন্দর আকৃতিতে সৃষ্টি করিয়াছেন। আর বিভিন্ন ভাল ভাল সুস্বাদু খাবার সরবরাহ করিয়াছেন। এই হইলেন তোমাদের আল্লাহ্। অনন্তর বড়ই মেহেরবান সেই নিখিল সৃষ্টির মহান প্রতিপালক।”

বস্তুত এই সকল আয়াতের সারকথা হইল যে, আল্লাহ্ তা’আলাই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ও রিযিকদাতা। সমগ্র বিশ্বময় বসবাসকারী জীবকুল ও ছড়ানো সীমাহীন সম্পদের একমাত্ৰ প্ৰভুত্ব ও মালিকানা তাঁহারই। সুতরাং তিনিই ইবাদত লাভের একমাত্র অধিকারী এবং অন্য কাহারও ইহাতে বিন্দুমাত্র অংশ নাই। তাই আল্লাহ্ তা’আলা আলোচ্য আয়াতে নির্দেশ দিলেনঃ

قلا تَجَعَلُوَا لله أَنْدَادًا و أَنْكُم تَعْلّمُونَ “সুতরাং তোমরা জানিয়া শুনিয়া কাহাকেও আল্লাহ্ তা’আলার অংশীদার বানাইও না।”

বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হইয়াছেঃ ইব্‌ন মাসউদ (রাঃ) বলেন-আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ্ তা’আলার কাছে সর্বাপেক্ষা বড় পাপ কোনটি? রাসূল (সাঃ) জবাব দিলেন-আল্লাহ্ তা’আলার সহিত কাহাকেও অংশীদার করা এবং কোন দিক দিয়া কাহাকেও তাঁহার সমকক্ষ ভাবা। অথচ তিনিই তোমাদের সৃষ্টিকর্তা (অসামপ্ত)।

তেমনি মু’আয (রাঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ

নবী করীম (সাঃ) প্রশ্ন করিলেন-তোমরা জান কি, বান্দার কাছে আল্লাহ্ তা’আলার বড় দাবী কি? অতঃপর বলিলেন—তাহা হইল একমাত্র তাঁহারই ইবাদত করা এবং কোনভাবেই কাহাকেও তাঁহার অংশীদার না করা।

অন্য এক হাদীসে বর্ণিত হইয়াছেঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন-তোমরা কখনও এইরূপ বলিও না, আল্লাহ্ ও অমুক যাহা চাহেন, বরং এইরূপ বল, ‘যাহা আল্লাহ্ চাহেন’ অথবা ‘যাহা অমুক চাহেন।’

তোফায়েল ইব্‌ন সাখবারাহ (উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা সিদ্দীকার বৈপিত্রেয় ভাই) হইতে যথাক্রমে রবী’ ইবন হারাশ, আব্দুল মালিক ইবন উমায়র ও হাম্মাদ ইবন সালামা বর্ণনা করেনঃ

তোফায়েল ইব্‌ন সাখবারাহ বলেন-আমি একদিন স্বপ্নে একদল লোক দেখিতে পাইয়া প্ৰশ্ন করিলাম-তেমিরা কাহারা? তাহারা জবাব বলিল-আমরা ইয়াহুদী। অতঃপর আমি প্রশ্ন করিলাম-তোমরা উযায়রকে আল্লাহর পুত্র বল কেন? তাহারা পাল্টা প্রশ্ন করিল-‘তোমরা ‘আল্লাহ্ যাহা চাহেন ও মুহাম্মদ যাহা চাহেন বল কেন? অতঃপর আরেকদল লোক দেখিতে পাইয়া প্রশ্ন করিলাম-তোমরা কাহারা? তাহারা জবাবে বলিল-আমরা খৃস্টান। আমি প্রশ্ন করিলাম-তোমরা ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহ্ পুত্র বল কেন? তাহারা পাল্টা প্রশ্ন করিল-তোমরা আল্লাহ্ ও মুহাম্মদ যহাা চাহেন’ বল কেন? অতঃপর সকাল বেলা আমি কয়েকজনকে এই স্বপ্নের কথা বলিলাম এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট আসিয়া সম্পূর্ণ স্বপ্ন বিবৃত করিলাম। রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞাসা করিলেন-তুমি এই স্বপ্ন আর কাহাকেও শুনাইয়াছ? আমি বলিলাম-হ্যাঁ। তখন তিনি আল্লাহ্ তা’আলার প্রসংশা করিয়া উপস্থিত সকলকে বলিলেন-এই বালক একটি স্বপ্ন দেখিয়াছে, আমি উহা তোমাদিগকে জানাইতেছি। তাহা এই, তোমরা এমন সব কথা বলিয়া থাক যাহা তোমাদেরকে বলিতে নিষেধ করা হইয়াছে। সুতরাং ‘আল্লাহ্ ও মুহাম্মদ যদি চাহেন’-এমন কথা আর কখনও বলিও না। পক্ষান্তরে এইরূপ বল-‘একমাত্র আল্লাহ্ পাকের যাহা মর্জী হয়।’

ইব্‌ন মারদুবিয়্যা আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় হাম্মাদ ইব্‌ন সালমাহ হইতে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম ইবন মাজাহও আবদুল মালিক ইবন উমায়র হইতে বর্ণিত উক্ত সনদে অনুরূপ বর্ণনা উদ্ধৃত করেন।

ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যথাক্রমে ইয়াযীদ ইবনুল আসিম ও আল্ আযলাহ ইব্‌ন আবদুল্লাহ আলকিন্দী ও সুফিয়ান ইব্‌ন সাঈদ আছছাওরী বর্ণনা করেনঃ

এক ব্যক্তি নবী করীম (সাঃ)-কে বলিল-‘আল্লাহ্ ও আপনি যাহা চাহেন।’ তখন নবী করীম (সাঃ) বলিলেন-তুমি কি আমাকে আল্লাহ্র সমতুল্য করিয়াছ? বরং এইরূপ বল, ‘একমাত্র আল্লাহ্ যাহা চাহেন ৷ ‘

ইব্‌ন মারদুবিয়্যাও এই হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম নাসাঈ, ইব্‌ন মাজাহ ও ঈসা ইব্‌ন ইউনুসও আযলাহ হইতে বর্ণিত সনদে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। উল্লিখিত হাদীসসমূহে আল্লাহ্ পাকের একত্বের উপর জোর দেওয়া হইয়াছে এবং তাঁহার সহিত কাহাকেও সমতুল্য অংশীদার বানাইতে নিষেধ করা হইয়াছে।

ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যথাক্রমে সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র, ইকরামা, মুহাম্মদ ইব্‌ন আবূ মুহাম্মদ ও মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক বর্ণনা করেনঃ

‘ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) বলেন-  আল্লাহ্ পাক يأيهًا المّاسَْ اعْبُدوا ربكم আয়াতটি কাফির ও মুনাফিক উভয় গ্রুপের জন্য নাযিল করিয়াছেন। উহাতে বলা হইয়াছে ‘তোমাদের প্রতিপালক শুধু ও তোমাদেরই সৃষ্টিকর্তা নহেন, এমনকি তোমাদের পূর্ব পুরুষদেরও সৃষ্টিকর্তা। সুতরাং তাঁহার সহিত কোন দিক দিয়া কাহাকেও শরীক করিও না এবং এককভাবে তাঁহারই প্রভুত্ব স্বীকার কর।’

فَلاْتَجِعَلُوا لله أَنْدَادًا وأنْكُم تَعْلْمُونَ আয়াতের ব্যাখ্যা ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে এইরূপ বর্ণিত হইয়াছে যে, ‘আল্লাহ্ সহিত অন্য কাহাকেও শরীক করিও না এবং কাহাকেও তাঁহার সমতুল্য ভাবিও না। কারণ, তাহারা তোমাদের ক্ষতি বা উপকার কোনটাই করিতে পারে না। তাহারা তোমাদের প্রতিপালকও নহে এবং তোমাদিগকে ও অন্যান্যকে জীবিকাও সরবরাহ করিতে পারে না। তোমরাও একথা ভালভাবেই জান। তোমরা ইহাও ভাল করিয়া জান যে, আল্লাহর রাসূল তোমাদিগকে যে নির্ভেজাল একত্ববাদের আহ্বান জানাইতেছেন, তাহার সত্যতা সম্পর্কে লেশমাত্র সন্দেহের অবকাশ নাই।”

কাতাদাহও আলোচ্য আয়াতের অনুরূপ ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছেন। হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যথাক্রমে ইকরামা, শাবীব ইব্‌ন বাশার, আবূ আসিম, আবূ যিহাক ইব্‌ন মুখাল্লাদ, আবূ আমর, আহমদ ইবন আমর ইব্‌ন আবূ আসিম ও ইব্‌ন আবূ হাতিম বর্ণনা করেনঃ

فَلاْتَجعَلُوا لله أمداد আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) বলেন-রাতের আঁধারে কাঁকর বিছানো পথে চলমান পিপীলিকার চাইতেও শির্ক অতিশয় গুপ্ত ও সূক্ষ্ম জিনিস। মানুষ বলিয়া থাকে, ‘আল্লাহ্র কসম ও তোমার জীবনের কসম! এই কুকুরটি না থাকিলে আমার ঘরে চোর আসিত এবং ঘরে হাঁসগুলি না থাকিলে সবকিছু চুরি হইয়া যাইত, ইত্যাদি। এইগুলি শিরিকী কথা এবং আল্লাহ্ সহিত শরীক করার শামিল। ‘যাহা আল্লাহ্ চাহেন ও যাহা তুমি চাহ’—এই ধরনের বাক্যও শিরিকী বাক্য এবং তাওহীদের পরিপন্থী। ‘আল্লাহ্ না হইলে এবং তুমি না হইলে (আমার সর্বনাশ হইত)’—এইরূপ কথাও শিরিকী কথা ৷

হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, এক ব্যক্তি নবী করীম (সাঃ)-কে ‘আল্লাহ্ যাহা চাহেন এবং আপনার যাহা মর্জী হয়’ বলিলে তিনি প্রশ্ন করিলেন-তুমি কি আমাকে আল্লাহ্ সমতুল্য মনে কর?

অপর এক হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে যে, নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন-আল্লাহ্ সহিত কাহাকেও শরীক না করিলে তোমরা উত্তম জাতি। কিন্তু তোমরা এইরূপ বলিয়া থাক যে, ‘আল্লাহ্ যাহা চাহেন ও অমুকে যাহা চাহেন।’ ইহা শিরিকী বাক্য।

আবুল আলিয়্যা বলেন-‘আল্লাহর সহিত তোমরা কাহাকেও শরীক করিও না এবং কাহাকেও তাঁহার সমতুল্য ভাবিও না।’

রবী‘ ইব্‌ন আনাস, কাতাদাহ, সুদ্দী, আবূ মালিক, ইসমাঈল ইব্‌ন আবূ খালিদ প্রমুখ মনীষীগণ অনুরূপ কথাই বলিয়াছেন।

মুজাহিদ فَلاَتَجْعَلُوَا لله أَنْدَادًا وَأنْشُمْ تَعْلَمُوْنَ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলিয়াছেন-‘আল্লাহ্ তা’আলা যে একক ও অদ্বিতীয় সত্তা এবং কোন দিক দিয়া কেহ তাঁহার সমকক্ষ নহে, একথা তাওরাত ও ইঞ্জীল পাঠ করিয়াও তোমরা জানিতে পাইয়াছ। সুতরাং জানিয়া শুনিয়া কাহাকেও তাঁহার শরীক করিও না।’

ইমাম আহমদ বলেন-আমার কাছে আফ্ফান, তাঁহার কাছে আবূ খলফ মূসা ইব্‌ন খলফ, তাহার কাছে ইয়াহিয়া ইব্‌ন আবূ কাছীর, তাঁহার কাছে যায়দ ইব্‌ন সালাম তাহার দাদা আর হারিছুল আশআরী হইতে বর্ণনা করেনঃ

‘মহানবী (সাঃ) বলিয়াছেন-আল্লাহ্ পাক ইয়াহিয়া ইব্‌ যাকারিয়া (আঃ)-কে তাঁহার নিজের আমলের ও বনী ইসরাঈলদের আমল করাবার জন্য পাঁচটি কাজের আদেশ দিয়াছিলেন। হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) বেখেয়ালে তাহা বনী ইসরাঈলদের জানাইতে বিলম্ব করায় হযরত ঈসা (আঃ) তাঁহাকে বলিলেন, আল্লাহ্ পাক আপনার চলার ও বনী ইসরাঈলদের চালাবার জন্য যে পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিলেন, তাহা তো এখনও আপনি তাহাদের জানাইলেন না। উহা কি আমি তাহাদের জানাইব? তিনি বিব্রত হইয়া বলিলেন, আমিই জানাইব ৷ আপনি জানাইলে আমার ভয় হয়, আমার উপর আযাব আসিবে, হয়তো যমীন আমাকে গ্রাস করিয়া নিবে। অতঃপর ইয়াহিয়া (আঃ) বনী ইসরাঈলদের বায়তুল মুকাদ্দাসে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানাইলেন উহা জনসমাগমে পরিপূর্ণ হইল। তখন তিনি মিম্বরে উপবিষ্ট হইয়া আল্লাহ্ তা’আলার প্রশংসা জ্ঞাপন ও গুণগান করিয়া বলিলেন-আল্লাহ্ পাক আমার ও তোমাদের অনুসরণের জন্য পাঁচটি কাজের নির্দেশ প্রদান করিয়াছেন।

প্রথম কাজটি হইল, একমাত্র আল্লাহ্ তা’আলার ইবাদত করিবে এবং কাহাকেও তাঁহার সহিত শরীক করিবে না। ইহার উদাহরণ হইল এই যে, এক ব্যক্তি রৌপ্য বা স্বর্ণের বিনিময়ে একটি ভৃত্য ক্রয় করিল এবং তাহাকে আয়-উপার্জনের কাজে নিয়োগ করিল। কিন্তু সে উপার্জিত সম্পদ নিজ প্রভুর বদলে অন্যকে দেয়। তোমরা কি ভৃত্যটির এই আচরণে সন্তুষ্ট হইতে পার? তাই যেই আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের সৃষ্টি করিয়া জীবিকার ব্যবস্থা করিতেছেন, তোমরা কেবল তাঁহারই ইবাদত কর এবং তাঁহার সহিত কাহাকেও শরীক করিও না। দ্বিতীয় কাজটি হইল নামায কায়েম করা। নামাযে যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা এদিক-সেদিক না তাকায়, ততক্ষণ আল্লাহ্ তা’আলা তাহার চেহারার দিকে তাকাইয়া থাকেন। সুতরাং তোমরা এদিক-ওদিক না তাকাইয়া মনোযোগের সহিত নামায পড়িবে। তৃতীয় নির্দেশ হইল, তোমরা রোযা রাখিবে। ইহার উদাহরণ হইল এই যে, এক ব্যক্তির নিকট একটি মিশকের পাত্র রহিয়াছে এবং তাহার সঙ্গীরা উহা হইতে সুঘ্রাণ লাভ করিতেছে। তেমনি রোযাদারের মুখ হইতে আল্লাহ্ তা’আলা মিশক হইতেও বেশী সুঘ্রাণ লাভ করেন । আল্লাহ্ পাকের চতুর্থ নির্দেশ হইল দান-সাদকা করা। ইহার উপমা এই যে, এক ব্যক্তিকে গলায় রশি লাগাইয়া হত্যা করার জন্য লইয়া যাওয়া হইতেছে। তখন সে তাহার যাহা কিছু সম্পদ আছে তাহা মুক্তিপণ হিসাবে দিয়া নিজের প্রাণ বাঁচাইল । তোমাদের প্রতি পঞ্চম নির্দেশটি হইল সর্বদা আল্লাহ্ পাকের যিকির করা। ইহার উদাহরণ হইল এইরূপ যে, এক ব্যক্তি তাহার পশ্চাতে দ্রুতগতিতে ছুটিয়া আসা শত্রুর হাত হইতে বাঁচার জন্য একটি সুরক্ষিত দুর্গে আশ্রয় নিয়া প্রাণে বাঁচিল । মানুষ আল্লাহ্র যিকিরে মশগুল হইলে শয়তানের আক্রমণ হইতে এইভাবে রক্ষা পাইয়া থাকে।

বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর মহানবী (সাঃ) বলিলেন-আমিও তোমাদের এমন পাঁচটি কাজের আদেশ দিতেছি যাহা আল্লাহ্ পাক আমাকে করিবার জন্য নির্দেশ দিয়াছেন। উহা হইল সংঘবদ্ধ থাকা, নেতার কথা শ্রবণ করা, নেতার অনুগত হওয়া, আল্লাহর জন্য হিজরত করা ও আল্লাহ্র পথে জিহাদ করা। যে ব্যক্তি সংঘবদ্ধতা ছাড়িয়া এক বিঘত দূরে সরিল, সে তাহার গর্দান হইতে ইসলামের রজ্জু ছুঁড়িয়া ফেলিল। অবশ্য ফিরিয়া আসিলে অন্য কথা। যে ব্যক্তি জাহিলিয়াতের পথে ডাকিবে, সে জাহান্নামের জ্বালানীতে পরিণত হইবে। সাহাবারা প্রশ্ন করিলেন-হে আল্লাহ্র রাসূল? যদি সে নামায রোযা করে, তবুও? মহানবী (সাঃ) জবাব দিলেন-হ্যাঁ, যদিও সে নামায রোযা করে এবং নিজেকে মুসলমান ভাবে, তবুও। আল্লাহ্ পাক মুসলমানদের যেভাবে মুসলিম, মু’মিন, আল্লাহর বান্দা ইত্যাদি নামে সম্বোধন করিয়াছেন, তোমরাও তাহাদের সেই সব নামে সম্বোধন করিবে। কখনও জাহিলী নামে ডাকিবে না।’

মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে ‘সহীহ-হাসান’ বলিয়াছেন। এই হাদীস দ্বারা তাওহীদ প্রমাণিত হয়। ইহাতে বলা হইয়াছে, ‘আল্লাহ্ তা’আলা যেহেতু তোমাদিগকে সৃষ্টি করিয়াছেন এবং রিযিকের ব্যবস্থা করিতেছেন, সুতরাং তোমরা কেবলমাত্র আল্লাহ্ তা’আলারই ইবাদত করিবে এবং তাঁহার সহিত কাহাকেও শরীক করিবে না।’

ইমাম রাযী সহ অনেক তাফসীরকার এই হাদীস দ্বারা আল্লাহ্ তাআলার অস্তিত্ব প্রমাণ করিয়াছেন। ঊর্ধ্বজগত ও নিম্ন জগতের সৃষ্টিকুল, সৃষ্টিকুলের আকৃতি-প্রকৃতির অশেষ বৈচিত্র্য, বিশ্বপ্রকৃতি ও উহার সুশৃঙ্খল রীতি-নীতি এবং অজস্র কল্যাণকর ব্যবস্থাপনা মহাকুশলী সৃষ্টিকর্তার কুদরত ও হিকমতের নিদর্শনরূপে সর্বত্র বিরাজমান।

ইমাম রাযী বলেনঃ জনৈক নিরক্ষর আরবের কাছে আল্লাহ্র অস্তিত্বের প্রমাণ চাওয়া হইলে সে উত্তর দিল, না দেখিয়া যেভাবে আমরা উটের অস্তিত্ব এবং পায়ের দাগ দেখিয়া আগন্তকের আগমনের কথা বুঝিতে পাই, সেভাবেই গ্রহ-নক্ষত্রপূর্ণ আকাশ, বৈচিত্র্য বিমণ্ডিত পৃথিবী ও তরঙ্গায়িত সমুদ্রের লীলাখেলা দেখিয়া আল্লাহ্র অস্তিত্ব উপলব্ধি করি।

ইমাম রাযী আরও বলেনঃ বাদশাহ হারুন অর রশীদ ইমাম মালিক (রঃ)-এর নিকট আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ জানিতে চাহিলে তিনি জবাব দিলেন-মানুষের ভাষা, কণ্ঠস্বর ও সুর বৈচিত্র্যের মধ্যেই আল্লাহ্র অস্তিত্বের প্রমাণ বিদ্যমান।

তেমনি ইমাম আবূ হানীফা (রঃ)-কে কতিপয় নাস্তিক আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করিলে তিনি জবাব দিলেন- ‘এসব কথা এখন রাখ। আমি এখন অন্য এক চিন্তায় নিমগ্ন। একদল লোক বলিয়া গেল, বাণিজ্যিক মালামাল বোঝাই বিরাট এক নৌকা আপন হইতেই চলিতেছে এবং সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালা নির্বিঘ্নে অতিক্রম করিয়া যাইতেছে। অথচ উহার কোন চালক নাই।’ প্রশ্নকারী নাস্তিকগণ বলিল, আপনি কি চিন্তায় অযথা সময় নষ্ট করিতেছেন? কোন জ্ঞানী লোকের পক্ষে কি এমন কথা বলা সম্ভব? এত বড় নৌকা তরঙ্গসংকুল সমুদ্রে নাবিক ছাড়া কি করিয়া চলিতে পারে? তখন ইমাম আবূ হানীফা (রঃ) বলিলেন, তোমাদের জ্ঞানের কথা ভাবিয়৷ আমারও অনুশোচনা জাগে। একটি নৌকা যদি নাবিক ছাড়া না চলিতে পারে, তাহলে এই বিশাল ভূমণ্ডল, আকাশমণ্ডলী ও উহার অসংখ্য সৃষ্টিকুল কি করিয়া পরিচালক ছাড়া সুশৃঙ্খলভাবে চলিতে পারে? জানিয়া রাখ, সেই পরিচালকই হইলেন নিখিল সৃষ্টির স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক আল্লাহ্ তা’আলা। নাস্তিকরা তাঁহার জবাবে বিস্মিত ও হতভম্ভ হইল এবং জবাবের সারবত্তা ও সত্যতা উপলব্ধি করিয়া মুসলমান হইয়া গেল।

ইমাম শাফেঈ (রঃ)-এর কাছে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করা হইলে তিনি জবাব দিলেন-তুত গাছের পাতা এক, তার রং এক. স্বাদ এক, রসও এক। গরু ছাগল, হরিণ, মাকড়, মক্ষিকা, গুটি পোকা ইত্যাকার বহু প্রাণী ও কীট-পতঙ্গ উহার পাতা খায় ও রস পান করে। অথচ গুটি পোকা দেয় রেশম, মক্ষিকা দেয় মধু, ছাগল-গরু দেয় দুধ ও গোবর এবং হরিণ মিল্ক উপহার দেয়। একই পাতায় এভাবে বিভিন্ন উপাদান সৃষ্টির পেছনে কি কোন কুশলী স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভূত হয় না? তিনিই আমাদের মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ তা’আলা।

ইমাম আহমদ ইব্‌ন হাম্বল (রঃ)-এর নিকট এক সময় আল্লাহ্র অস্তিত্বের পক্ষে যুক্তি দাবী করা হইলে তিনি জবাব দিলেন-মনে কর, এখানে এমন একটি সুদৃঢ় দুর্গ রহিয়াছে যাহার কোন দরজা-জানালা নাই। এমনকি কোন ছিত্রও নাই। দুর্গটির বহির্ভাগ রৌপ্যের ও অভ্যন্তরভাগ স্বর্ণের প্রভায় দীপ্যমান। ডান-বাম ও উপর-নীচ সব দিক দিয়াই দুর্গটি আবদ্ধ। উহাতে জীব-জানোয়ার তো দূরের কথা, বায়ুও প্রবেশ করিতে পারে না। হঠাৎ উহার একটি দেয়াল ভাঙ্গিয়া পড়িল। অমনি উহা হইতে চক্ষু-কর্ণ বিশিষ্ট সুন্দরকায় এমন একপ্রাণী বাহির হইল যাহারা কণ্ঠে রহিয়াছে মন ভুলানো মিষ্টি মধুর কল-কাকলী। বলতো সেই আবদ্ধ দুর্গে সৃষ্ট এই জীবের কোন স্রষ্টা রহিয়াছেন কিনা? সেই সৃষ্টিকর্তাই হইলেন মানব সত্তার অতীত এক মহান সত্তা। তাঁহার ক্ষমতা ও শক্তি কি সীমিত, না সীমাহীন? তিনি অসীম ক্ষমতার অধিকারী ;

ইমাম সাহেব ডিমকে দুর্গের সহিত তুলনা করিয়াছেন। আল্লাহর অস্তিত্বের পক্ষে ইহা একটি বড় প্রমাণ। আবূ নুআস (রঃ)-এর কাছে আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হইলে তিনি জবাব দিলেন-

تأمل فى نبات الارض وانظر ‏ الى اثار ما صئع المليك ‏ عيون من لجين شاخصات باحداق هى الذهب السبيك ‏ على قضب الزبر جد شاهدات بان الله ليس له شريك

আকাশ হইতে বারিবর্ষণ, উহা দ্বারা ধরার বুকে ফসল, ফলমূল ও গাছপালা-তরুলতার জন্মলাভ ও কচি-কচি ডগায় নানাবিধ ফুলের সমারোহ আল্লাহ্র অস্তিত্ব ও একত্বের অকাট্য প্ৰমাণ ‘

فيا عجيا كيف يعصى الا له ام كيف يجحده الجاحد .وفى كل شىء له اية  – تدل على انه واحد ‏

‘আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার ও তাঁহার বিরুদ্ধাচরণের কথা ভাবিলে মনে বিস্ময় সৃষ্টি হয় । মানুষ কতই না বেপরোয়া হওয়ার প্রয়াস চালায় । অথচ তাহার আশে পাশের প্রত্যেকটি বস্তুই আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্বের সাক্ষ্য দিতেছে।’

মহামানবগণ বলিয়াছেন-আকাশমণ্ডলীর দিকে দৃষ্টিপাত কর এবং উহার উচ্চতা ও প্রশস্ততা এবং হাতে বিচরণশীল সমুজ্জ্বল গ্রহ-নক্ষত্রের দিকে তাকাও। এদিক-সেদিক প্রবহমান নদ-নদীগুলি পর্যবেক্ষণ কর। দেখ, উহারা কিভাবে স্বীয় স্রোতধারার মাধ্যমে ক্ষেত-খামারের ফসল আর বাগ-বাগিচার গাছপালা ও ফল-মূলের তৃষ্ণা মিটাইয়া যমীনকে সবুজ শ্যামল করিয়া তোলে। ক্ষেত্র-খামার ও বাগিচার ফসল ও ফল-মূলের দিকে তাকাইয়া দেখ, উহারা কিভাবে একই পানির কল্যাণে বিচিত্র রং, রূপ, ঘ্রাণ, স্বাদ লাভ করিতেছে। এমনকি সেইগুলির উপকারীতায়ও রহিয়াছে অশেষ বৈচিত্র। বস্তু জগতের বৈচিত্র্য বিমণ্ডিত এই সৃষ্টিকুল তাহাদের ভাষায় প্রতিনিয়ত জানাইতেছে যে, তাহাদের এক মহান কুশলী সৃষ্টিকর্তা রহিয়াছেন এবং সেই সৃষ্টিকর্তা এক ও অদ্বিতীয় বলিয়াই এত সুশৃঙ্খল ও সুবিন্যস্তভাবে সব কিছু চলিতেছে। এইসব সৃষ্টি প্রত্যেকটি দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তির সামনে আল্লাহ্র অশেষ মহত্ত, অসীম ক্ষমতা, অপরিসীম দয়া ও অনাবিল প্রেম-প্রীতি ও ভালবাসার অনুপম ও অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন তুলিয়া ধরিতেছে । তাঁহার এতসব নজীরবিহীন নি‘আমাত কি তাঁহার সীমাহীন বদান্যতার পরিচয় দেয় না? আমরা কায়মনে বিশ্বাস করি, তিনি ব্যতীত আর কোন প্রতিপালক নাই। তিনিই আমাদের সৃষ্টিকর্তা। তিনিই আমাদের উপাস্য প্রভু। তিনিই আমাদের একমাত্র রক্ষক ও ত্রাণকর্তা । তাই তিনি ব্যতীত আর কোন সত্তা আমাদের অবনত মস্তকে প্রদত্ত সিজদা লাভের যোগ্য নহে। হে দুনিয়ার মানুষ! আমি একমাত্র তাঁহারই দয়ার উপর নির্ভরশীল। আমার যাহা কিছু আশা ভরসা একমাত্র তাঁহারই কাছে। আমার মাথা অবনত করা ও উত্তোলন করা একমাত্র তাঁহারই দরবারে। আমার সকল প্রত্যাশা তাঁহারই কৃপার সহিত সংশ্লিষ্ট। তাঁহারই দয়া ও অনুগ্রহের আশায় কেবলমাত্র তাঁহারই নাম জপনা করিতেছি।

কুরআনের চ্যালেঞ্জ

(۲۳)

وَ اِنۡ كُنۡتُمۡ فِیۡ رَیۡبٍ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلٰی عَبۡدِنَا فَاۡتُوۡا بِسُوۡرَۃٍ مِّنۡ مِّثۡلِهٖ ۪ وَ ادۡعُوۡا شُهَدَآءَكُمۡ مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ اِنۡ كُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ

(٢٤)

فَاِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلُوۡا وَ لَنۡ تَفۡعَلُوۡا فَاتَّقُوا النَّارَ الَّتِیۡ وَقُوۡدُهَا النَّاسُ وَ الۡحِجَارَۃُ ۚۖ اُعِدَّتۡ لِلۡكٰفِرِیۡنَ

২৩. আমি আমার বান্দার উপর যাহা অবতীর্ণ করিয়াছি তাহাতে তোমাদের সন্দেহ সৃষ্টি হইয়া থাকিলে, তোমরা উহার অনুরূপ কোন সূরা আনয়ন কর। তোমাদের কথার সত্যতা প্রমাণের জন্য আল্লাহ্ ব্যতীত তোমাদের অন্য যত প্রভু আছে তাহাদেরও ডাকিয়া লও।

২৪. তারপরও যদি না পার এবং কখনই পারিবে না, তখন সেই আগুনকে ভয় কর যাহার ইন্ধন হইবে মানুষ ও প্রস্তর। উহা কাফিরদের জন্যই প্রস্তুত করা হইয়াছে।

তাফসীরঃ তাওহীদ ও একত্ববাদের আলোচনার পর আল্লাহ্ পাক তাঁহার রাসূলের রিসালাত এবং নবৃওতের সত্যতা ও শুদ্ধতা প্রথাসিদ্ধ পন্থায় প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। তাই তিনি কাফিরদের সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, আমার বান্দা মুহাম্মদের প্রতি আমি যে কুরআন অবতীর্ণ করিয়াছি, তাহা সম্পর্কে তোমাদের যদি সংশয় সৃষ্টি হইয়া থাকে যে, উহা আল্লাহ্র কথা নহে, মুহাম্মদ নিজেই উহার রচয়িতা, তাহা হইলে কুরআনের কোন সূরার মত একটি সূরা রচনা করিয়া তোমরা দেখাও। এই ব্যাপারে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যে কোন ব্যক্তি বা শক্তির সাহায্য গ্রহণ করিতে পার। কিন্তু তোমরা সমবেত প্রচেষ্টা দ্বারাও তাহা পারিবে না।

ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) উপরোক্ত আয়াতের شهداء كم শব্দের ব্যাখ্যায় বলিয়াছেন, শব্দটির অর্থ হইল ‘তোমাদের সাহায্যকারী’ অর্থাৎ তোমাদের সাহায্যকারীগণকে অনুরূপ সূরা প্রণয়নের কাজে ডাক।

আবূ মালিকের উদ্ধৃতি দিয়া সুদ্দী বলিয়াছেন, শব্দটির অর্থ হইল তোমরা যাহাদিগকে আল্লাহ্র অংশীদার বানাইয়াছ, তাহাদিগকে ডাক। অর্থাৎ অন্য যতসব সহায়তাকারী তোমাদের রহিয়াছে তাহাদেরকে, এমনকি আল্লাহ্ ব্যতীত তোমাদের যে সকল মা’বূদ রহিয়াছে তাহাদিগকেও ডাকিয়া সকলে মিলিয়া অনুরূপ একটি সূরা তৈরি কর।

উক্ত শব্দের ব্যাখ্যায় মুজাহিদ বলিয়াছেন, ইহা দ্বারা আরবী ভাষাবিদ পণ্ডিত ও আরবের শাসকবর্গকে বুঝানো হইয়াছে। অর্থাৎ তোমরা তোমাদের কবি-সাহিত্যিক ও কর্ণধার-পরিচালক মণ্ডলীকে এই কাজে সাহায্যের জন্য ডাকিয়া লও। কিন্তু ডাকিলেও লাভ হইবে না, সূরা তো দূরের কথা, একটি লাইনও রচনা করিতে সক্ষম হইবে না।

আল্লাহ্ পাক আল-কুরআনের বহুস্থানে এইভাবে চ্যালেঞ্জ প্রদান করিয়াছেন। যেমন আল্লাহ্ পাক সূরা আল-কাসাসে বলেনঃ

قُلْ فَأْتُوا بِكِتَابٍ مِنْ عِنْدِ اللهِ هُوَ أهْدَى مِنْهُمَا اتَّبَعُهُ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ 

“হে নবী! বলিয়া দাও, যদি তোমাদের দাবী সত্য হয়, তবে তাওরাত ও কুরআনের চাইতে অধিক পথ প্রদর্শনকারী কোন কিতাব আল্লাহ্র নিকট হইতে নিয়া আস। আমিও সেই কিতাবকে অনুসরণ করিব।”

আল্লাহ্ পাক অন্যত্র বলেনঃ

قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسَ وَالْجِنُّ عَلى أنْ يَأْتُوا بمثل هذا الْقُرْآنِ لا يَأْتُور.

بمثلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْض ظَهِيراً

“হে নবী! জানাইয়া দাও, সমগ্র মানুষ ও জ্বিন সম্প্রদায় একত্রিত হইয়াও যদি কুরআনের ন্যায় গ্রন্থ রচনায় নিয়োজিত হয়, তবুও অনুরূপ গ্রন্থ রচনা করিতে পারিবে না। যদিও সকলের সমবেত প্রচেষ্টা উহাতে নিয়োজিত হয়।”

আল্লাহ্ পাক সূরা হুদে ঘোষণা করেনঃ

آم يَفوْنُْنَ افهْرَهُ كل فَأَكًُا يفنظر سسُوَر بَكْله سفْمْريَات وَادْعْوا من استطفة سَنطعكُم من دون الله ان كنْتم صادقين ‏

“তাহারা কি বলিতেছে যে, তুমি নিজেই এই কুরআন রচনা করিয়াছ? তুমি বল, তোমরা উহার মত দশটি সূরা রচনা করিয়া দেখাও এবং সেই কাজে আল্লাহ্ ব্যতীত যদি কেহ ক্ষমত। রাখে, তাহাকেও ডাকিয়া লও-যদি তোমাদের দাবী সত্য হইয়া থাকে।”

আল্লাহ্ পাক সূরা ইউনুসে বলেনঃ

وما كَانَ هُدًا الْقُرَانْ أن يفْتَرَى من دُوْن الله ولكنْ تَمنْدِيْقَ الّذئ بَيْنَ يديه

وَنفْصِيّلَ الكتاب لأرَيْبَ فِيْه من رب الْعَالمِيْنَ آم يَكوُْوْدَ اثنراه قل فوا

بسورة مثله وادعوا من استطعتم من دون الله إن كَنْنَم صادقين ‏

“এই কুরআন আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাহারও মনগড়া রচনা নহে। পরন্তু ইহা পূর্বে অবতীর্ণ কিতাবসমূহকে সত্যায়িত করে। আর ইহা সবিস্তারে বর্ণিত কিতাব। নিখিল সৃষ্টির প্রতিপালকের ‘তরফ হইতে অবতীর্ণ এক সংশয় মুক্ত কিতাব। তাহারা কি ইহাকে মিথ্যা বলিতেছে? তুমি বল, কুরআনের অনুরূপ একটি সূরা তৈরি করিয়া দেখাও। আল্লাহ্ ব্যতীত যদি কাহারও ক্ষমতা থাকে তাহাকেও ডাকিয়া যদি পার তাহা হইলেও তোমাদের দাবীর সত্যতা প্রমাণ কর।”

এই ধরনের আয়াত প্রথমে মক্কায় অবতীর্ণ হইয়া মক্কাবাসীকে জব্দ করিয়া কুরআন ও কুরআনের নবীর বিশুদ্ধতা ও সত্যতা প্রমাণ করে। অতঃপর মদীনায়ও একই উদ্দেশ্যে আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হয়।

আয়াতটির অন্তর্গত مثله শব্দের সর্বনাম দ্বারা কি বুঝানো হইয়াছে তাহা লইয়া মতভেদ রহিয়াছে। এক দলের মতে এই সর্বনাম দ্বারা কুরআনকে বুঝানো হইয়াছে। তখন আয়াতের অর্থ এই দাঁড়ায় কুরআনের সূরার মত কোন সূরা রচনা করিয়া দেখাও।’ অপর দল বলেন, উক্ত সর্বনামটি দ্বারা মহানবী (সাঃ)-কে বুঝানো হইয়াছে। সেক্ষেত্রে অর্থ দাঁড়ায়-‘মুহাম্মদের মত নিরক্ষর ব্যক্তির পক্ষে যদি এরূপ সূরা তৈরি করা সম্ভব হয়, তাহা হইলে তোমরাও করিয়া দেখাও।’

প্রথম অভিমতের প্রবক্তা হইলেন মুজাহিদ ও কাতাদাহ (রঃ)। ইব্‌ন জারীর, তাবারী, যামাখশারী, ইমাম রাযী প্রমুখ ব্যাখ্যাকারগণ এই মতই গ্রহণ করিয়াছেন। হযরত উমর, ইন মাসউদ, ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) ও হাসান বসরী (রঃ) সহ অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ হইতেও এই অভিমতেরই সমর্থন মিলে।

প্রথমোক্ত অভিমতের প্রাধান্য লাভের আরও কারণ আছে। এক, ইহা দ্বারা এককভাবে ও সমবেতভাবে উভয় পন্থায়ই সকলের প্রতি চ্যালেঞ্জ প্রদান করা হয়। এক্ষেত্রে শিক্ষিত অশিক্ষিতের যেমন পার্থক্য করা হয় নাই, তেমনি পার্থক্য করা হয় নাই আহলে কিতাব-গায়ের আহলে কিতাবেরও। সুতরাং ইহা নিরক্ষরদের প্রতি চ্যালেঞ্জের তুলনায় ব্যাপক ও সার্বজনীন। দুই. উপরোক্ত অন্য আয়াতে ‘অনুরূপ দশটি সূরা রচনা করিয়া দেখাও’ বাক্যাংশটিও প্রমাণ করে যে, উক্ত সর্বনামটির ইঙ্গিত কুরআনের প্রতি, মুহাম্মদের প্রতি নহে। তিন, কুরআনের এই বারংবার চ্যালেঞ্জে আরবী ভাষাবিদ, কবি, সাহিত্যিক যাহার সাহায্য নিয়া সম্ভব তাহাদের সকলকেই শামিল করার আহ্বান জানানো হইয়াছে। তাই ইহা বিশেষ শ্রেণীর চ্যালেঞ্জ নহে; বরং সর্বশ্রেণীর মানুষের প্রতি সর্বকালের জন্য সার্বিক চ্যালেঞ্জ। ফলে বারংবার ইহার উল্লেখ আসিয়াছে এবং পরিশেষে সুস্পষ্ট ভাষায় জানাইয়া দেওয়া হইয়াছে,তোমরা পার নাই আর কখনও পারিবে না।’ মূলত মক্কা ও মদীনার তদানীন্তন সুধীমণ্ডলী চরম বিরোধী মনোভাব রাখিয়াও এই চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হইয়াছে। কুরআন কিংবা উহার দশটি সূরা অথবা উহা ক্ষুদ্রতম সূরাটির কোন আয়াতের অনুরূপ কিছু রচনা করিতেও অপারগ রহিয়াছে। তাই আল্লাহ্ তা’আলা لن تفعلوًا (কখনই পারিবে না) ঘোষণা দ্বারা চ্যালেঞ্জের উপসংহার টানিলেন।

لن تفعلوًا শব্দে ব্যাকরণবিধি অনুসারে ভবিষ্যৎ কালের নিশ্চিত না সূচক (نفى تاكيد) অব্যয় لن ব্যবহৃত হইয়াছে। ইহা কুরআন পাকের অন্যতম মু’জিযা। একমাত্র কুরআনই নির্দ্বিধায় সর্বকালের স্বীয় অবিসংবাদিতার ঘোষণা দিতে পারে। কারণ, একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতে এইরূপ রচনা কখনও কাহারো পক্ষে সৃষ্টি করা সম্ভবপর নহে। নিখিল সৃষ্টির যিনি সৃষ্টিকর্তা তাঁহার রচনার সমকক্ষ কিছু রচনা করা কোন সৃষ্টির পক্ষে কি করিয়া সম্ভব হইবে? কুরআন নিয়া যাহারা গবেষণা ও চিন্তা-ভাবনা করিয়াছে, তাহারা একবাক্যে স্বীকার করিতে বাধ্য হইয়াছে যে, ইহার ভাষাশৈলীগত বাহ্যিক রূপ ও মর্মগত আত্মিক স্বরূপ উভয় দিক দিয়াই ইহা অতুলনীয় ও অবিসংবাদিত। তাই আল্লাহ্ বলেনঃ

ألر – كتّاب أحكمّت ايَائّهُ كُّمٌ فُصِلَت مِنْ لَّدنْ حَكيْم خَبِيْر “ইহা এমন কিতাব যাহার আয়াতগুলি প্রথমে দৃঢ়ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা হইয়াছে। অতঃপর মহাজ্ঞানী ও মহাসংবাদ দাতার তরফ হইতে উহার বিশদ রূপ দান করা হইয়াছে।”

তাই কুরআনের ভাষা অত্যন্ত সুসংবদ্ধ ও উহার মর্ম অতিশয় ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। ভাব ও ভাষা উভয় দিক দিয়াই উহা নজীরবিহীন ও বিস্ময়কর। সমগ্র জগত উহার সমকক্ষতার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত অপারগতার স্বীকৃতি প্রদান করিয়াছে। উহাতে একদিকে যেমন অতীতের ইতিহাস যথাযথভাবে উপস্থাপিত হইয়াছে, তেমনি অপরদিকে ভবিষ্যতে অনুষ্ঠিতব্য ঘটনাবলীও সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত হইয়াছে। ন্যায়-অন্যায় ও ভাল-মন্দ সম্পর্কিত সকল কিছুই সুনিপুণভাবে উহাতে সন্নিবেশিত হইয়াছে। তাই আল্লাহ্ পাক ঘোষণা করিলেনঃ

وَنَمَّتْ كَلمَةٌ ربك صدفًا وَعدلاً “তোমার প্রতিপালক তাঁহার বাণীকে সত্য ও সঙ্গতভাবেই পূর্ণাঙ্গতা দান করিয়াছেন।”

অর্থাৎ সংবাদদাতা হিসাবে সত্য সংবাদ ও বিধান দাতা হিসাবে ন্যায়ানুগ বিধান প্রদান করিয়াছেন। ইহার প্রতিটি বিষয়ই সত্য ও ন্যায়ের মানদণ্ড ও পথ প্রদর্শক। ইহাতে কোন রূপকথা, কিংবদন্তী ও কিংবা কাল্পনিক মিথ্যাচারের লেশমাত্র নাই ! মিথ্যা ও কল্পনার ছড়াছড়ি ছাড়া কবিদের কাব্যগাথা রচিত হয় না। উহা ছাড়া নাকি তাহাদের কবিতা-কাব্যের আকর্ষণ উৎকর্ষ সৃষ্টি হয় না। তাই জনৈক কবি বলেনঃ أعجبه أكزبه

অর্থাৎ কল্পনাপ্রসূত মিথ্যার প্রলেপ যত বেশী থাকিবে, কবিতার সৌন্দর্য, কমনীয়তা, মাধুর্য ও মাদকতা ততই বিকশিত হইবে ও পাঠককুলের কাছে তত বেশী সমাদৃত হইবে। উহার অবর্তমানে কবিতা হইবে নিষ্প্রাণ ও ব্যর্থ। তাই বড় বড় কবিরা বিরাট বিরাট কাব্য নারীর রূপ-গুণকীর্তন, পানীয় ও পানপাত্রের বিবরণ, উট-ঘোড়ার সৌন্দর্য বর্ণনা, ব্যক্তি বিশেষের প্রশংসা অর্চনা, যুদ্ধ বিগ্রহের লোমহর্ষক কাহিনী ও বিস্ময়কর চাতুর্যকলা কিংবা ভীতিপ্রদ রোমাঞ্চকর গল্প-গুজবে ভরপুর। উহা দ্বারা কবির শিল্প সৌকর্য ও অন্তলীণ মনোবিকারের বহিঃপ্রকাশ ঘটে বটে; কিন্তু মানব সমাজ আদৌ উপকৃত হয় না। গোটা কাব্যের দু’একটি পংক্তি ছাড়া সবটুকুই অর্থহীন প্রলাপে পর্যবসিত হয়।

পক্ষান্তরে আল্-কুরআনের আগাগোড়া অত্যন্ত উঁচুমানের বাকভঙ্গী ও অতুলনীয় ভাষালংকারে সমুজ্জ্বল ও অনুপম উপমায় সুষমামণ্ডিত প্রতীয়মান হইবে । আরবী ভাষায় সুপণ্ডিত ও গভীর দৃষ্টিসম্পন্ন মনীষী মণ্ডলীই কেবল কুরআনের ভাষাশৈলী ও ভাব সম্পদের গভীরে প্রবেশ করিতে সমর্থ। কুরআন যখন কোন সংবাদ পরিবেশন করে, হউক তাহা দীর্ঘ কিংবা হ্রস্ব, একবারের জায়গায় যদি তাহা বারংবারও বলা হয়, তথাপি উহার স্বাদ ও মাধুর্যে বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় ঘটে না । যতই পাঠ করিবে ততই যেন অনির্বচণীয় এক স্বাদে চিত্ত উত্তরোত্তর আপ্লুত হইয়াই চলিবে। উহার পৌনঃপুনিক পাঠে যেমন সাধারণ পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে না। তেমনি অসাধারণ পাঠকরাও বিন্দুমাত্র অস্বস্তিবোধ করেন না।

আল্-কুরআনের সতর্ক বাণী ও ভীতি প্রদর্শনমূলক বক্তব্যসমূহ অবলোকন ও অনুধাবন করিলে সুকঠিন মানবাত্মা তো দূরের কথা, সুদৃঢ় পর্বতমালা পর্যন্ত সন্ত্রস্ত ও প্রকম্পিত না হইয়া পারে না। তেমনি উহার আশ্বাসবাণী ও পুরস্কার বিবরণী অবলোকন ও অনুধাবন করিলে অন্ধ মনের বন্ধ দুয়ার প্রলুব্ধ ও উন্মুক্ত হইয়া যায়, রুদ্ধ কর্ণ কুহরও প্রত্যাশ্যার পদধ্বনি শুনিতে পায় আর মৃত অন্তরাত্মা ইসলামের অমিয় সুধা পানের জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠে। এই সব কিছু মিলিয়া অজান্তে হৃদয়রূপ বেতারযন্ত্রে বাজিয়া ওঠে আরশের আকাশ বাণীর প্রচারিত আল্লাহ্ প্রেমের মন মাতানো রাগ-রাগিণীর সুমধুর সুর লহরী। এখানে কয়েকটি আয়াত উদাহরণ স্বরূপ পেশ করিতেছি। যেমন উদ্দীপক বাণীঃ

فَلاً تَعْلَمُ نْفْسَ ما أخفى لهم من قَرَة أعين جزاء لما كَانُوا يُعملون ‏

“নেক কাজের প্রতিদানে নয়ন জুড়ানো কি জিনিস নয়নের অগোচরে বিরাজ করিতেছে তাহা কেহই জানে না। ”

অথবাঃ

وَفِيْهَا ما تَتْتَهيْه الأنْفْسٌوَتَلَدُ الأمْيُنُ وَآَنْتُمَ فيا خَالدُوْنَ ‏

“উহাতে (জান্নাতে) মনের চাহিদা মিটানো আর নয়নের পরিতৃপ্তি লাভের সমস্ত ব্যবস্থাই বিদ্যমান । সেখানে তোমাদের অবস্থান হইবে চিরন্তন।”

কিংবা ভীতিপ্রদ বক্তব্যঃ

أفامتتم أن يمسف بِكُمْ جانب الْبّر “ভূখণ্ডের কোন এক দিক তোমাদের সহ ধ্বসিয়া যাওয়া সম্পর্কে তোমরা কি নিশ্চিন্ত হইয়া গেলে?”

অথবাঃ

أمِنْتُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يُخْسِفَ بِكُمُ الْأَرْضِ فَإِذَا هِيَ تَمُورُ – أَمْ أَمِنْتُمْ

مَنْ فِي السَّمَاءِ أَنْ يُرْسِلَ عَلَيْكُمْ حَاصِبًا – فَسَتَعْلَمُونَ كَيْفَ نَذِيرٌ 

“তোমরা কি ঊর্ধ্বজগতের সেই প্রবলতম সত্তার ব্যাপারে নির্ভিক হইলে, যিনি তোমাদিগকে অকস্মাৎ ভূমি সহ ধ্বসাইয়া দিবেন? তোমরা কি মহাকাশের সেই মহাপ্রতাপান্বিত সত্তার ব্যাপারে বেপরোয়া হইলে, যিনি মহাশূন্য হইতে কঙ্কর বৃষ্টি বর্ষণ করিবেন? শীঘ্রই এই সতর্কতার তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করিবে।”

কিংবা হুঁশিয়ারীমূলকঃ

فكلاً أَحَدنًا بذنبه “আমি প্রত্যেককেই পাপের জন্য পাকড়াও করি। অথবাঃ

أفَرَأَيْتَ إِنْ مَتَّعْنَاهُمْ سنينَ ثُمَّ جَاءَ هُمْ مَا كَانُوا يُوعَدُونَ – مَا أَغْنَى عَنْهُمْ مَا

كَانُوا يُمَتَّعُونَ

“তুমি কি দেখ নাই আমি বেশ কয়েক বৎসর তাহাদিগকে ফায়দা লুটিবার সুযোগ দিয়াছি। অতঃপর তাহাদের সামনে প্রতিশ্রুত ব্যাপার হাজির হইয়াছে। তখন ভোগ-বিলাসের উপকরণ তাহাদের কোন উপকারে আসে নাই।”

আল-কুরআনকে এইভাবে ভাব ও ভাষায় সুসমৃদ্ধ ও সুসজ্জিত করা হইয়াছে। ইহার বিষয় বৈচিত্র্য বিস্ময়কর। ভাষালংকারের ঔজ্জ্বল্য, উপদেশের প্রাচুর্য, যুক্তি প্রমাণের অজস্রতা ও তত্ত্বজ্ঞানের বহুলতা কুরআনকে গ্রন্থ জগতে অবিসংবাদীতা দান করিয়াছে। বিধি-নিষেধের বাণীসমূহকে অত্যন্ত ন্যায়ানুগ, কল্যাণকর, আকর্ষণীয় ও প্রভাবময় করা হইয়াছে ৷ ইব্‌ন মাসউদ (রা) সহ অনেক বিশেষজ্ঞ মনীষী বলিয়াছেন—’ইয়া আইউহাল্লাযীনা আমানূ’ শুনার সঙ্গে সঙ্গে মনোযোগের সহিত কান পাতিয়া পরবর্তী বক্তব্য শুন। কারণ, উহার পর হয় কোন কল্যাণের পথে ডাকা হইবে, নয় তো কোন অকল্যাণ হইতে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হইবে। আল্লাহ্ পাক বলিয়াছেনঃ

يَأْمُرُهُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَاهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُحِلُّ لَهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِم الْخَبَائِثَ وَيَضَعُ عَنْهُمْ اصْرَهُمْ وَالْأَغْلَالَ الَّتِي كَانَتْ عَلَيْهِمْ

‘(আল-কুরআন) তাহাদিগকে ন্যায় কাজের নির্দেশ দেয় ও অন্যায় কাজ করিতে নিষেধ করে এবং তাহাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ বৈধ করে ও অপবিত্র বস্তুসমূহ অবৈধ করে আর পায়ের বেড়ী ও গলার ফাঁস হইতে তাহাদিগকে মুক্তি দেয়।’

আল-কুরআনের কিয়ামত সম্পর্কিত আয়াতসমূহ সেই দিনের বিভীষিকাময় বর্ণনা, জান্নাতের সীমাহীন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিবরণ, জাহান্নামের অপরিসীম দুঃখ দুর্দশার চিত্র নেককারদের বিভিন্ন লোভনীয় পুরস্কার ও বদকারদের নানাবিধ ভয়াবহ শাস্তি, পার্থিব জগতের সহায়-সম্পদ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অসারতা ও পারলৌকিক জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের অবিনশ্বরতা ইত্যাকার শিক্ষা ও কল্যাণমূলক আলোচনায় ভরপুর। এই সব বর্ণনা মানুষকে ন্যায়ের পথে উদ্বুদ্ধ করে, হৃদয়কে সন্ত্রস্ত ও বিগলিত করে এবং শয়তানের প্ররোচনাসৃষ্ট অন্তরের কালিমা ধুইয়া-মুছিয়া সাফ করিয়া দেয়।

বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ মানুষের আস্থা লাভের জন্য প্রত্যেক নবীকে কিছু কিছু মু’জিযা দান করা হইয়াছে। আমার মু’জিযা হইল আল-কুরআন। তাই আমি আশা রাখি যে, অন্যান্য নবীর তুলনায় আমার উম্মতের সংখ্যা অধিক হইবে। (কারণ, অন্যান্য নবীর মু’জিযা তাহাদের ইন্তেকালের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হইয়াছে। পক্ষান্তরে আল-কুরআন মহানবী (সাঃ)-এর ইস্তেকালের পরেও বর্তমান রহিয়াছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত উহা বহাল থাকিবে।)

উপরোক্ত হাদীসে মহানবী (সাঃ)-এর উক্তি ‘আমার মু’জিযা হইল আল্লাহর প্রত্যাদেশ’-এর তাৎপর্য এই যে, তাঁহাকে প্রদত্ত আল-কুরআন সর্বকালের সকল মানুষের কাছে অবিসংবাদী গ্রন্থরূপে বিরাজ করিবে। কোন কালের কোন মানুষই ইহার শ্রেষ্ঠত্বের কাছে মাথা নত না করিয়া পারিবে না। এই অদ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য আর কোন আসমানী গ্রন্থের ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। তাই আল-কুরআন যুগে যুগে মহানবী (সাঃ)-এর নবূওতকেও সত্যায়িত করিয়া চলিবে। অবশ্য আল কুরআন ছাড়াও মহানবী (সাঃ)-এর অন্যান্য মু’জিযা রহিয়াছে। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।

আল-কুরআনের অবিসংবাদী শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াত ও মু’তাযিলা শাস্ত্রবিদগণ অনেক যুক্তি প্রমাণ তুলিয়া ধরিয়াছেন। তাহাদের বক্তব্যের সারকথা হইল এই, কুরআন মুলতই সৃষ্টিকর্তার অবতীর্ণ কিতাব বিধায় কোন সৃষ্টির পক্ষে উহার মত কিছু রচনা করা সাধ্যাতীত ব্যাপার। তাই উহার অপ্রতিদ্বন্দ্বীতা সুপ্রমাণিত সত্য। পক্ষান্তরে যদি তর্কের খাতিরে মানিয়া লওয়া হয় যে, কুরআন স্রষ্টার অবতীর্ণ গ্রন্থ নহে, তাই উহার মত কিছু রচনা করা কোন সৃষ্টির পক্ষে সম্ভব, তাহা হইলেও কুরআনের বারংবার চ্যালেঞ্জ সত্ত্বের উহার কট্টর বিরোধীরাও অদ্যাবধি উহার মত কিছু রচনা করিতে চরম অপারগতা প্রকাশ করায় কুরআনের অপ্রতিদ্বন্দ্বীতা সুপ্রমাণিত সত্যে পরিণত হইল। ইমাম রাযী এই প্রসঙ্গে কুরআনের ক্ষুদ্রতর সূরা ‘আল আসর’-এর অনুরূপ কিছু রচনা করিতেও বিরুদ্ধবাদীদের ব্যর্থতার কথা সবিস্তারে উল্লেখ করিয়াছেন।

আলোচ্য وَقُودوها النَّاسْ والحجارة আয়াতাংশের وقودها শব্দের, ও অক্ষরটি যবর দিয়া পাঠ করা হয়। তাই ইহার অর্থ হইতেছে ‘যাহা দ্বারা অগ্নি প্রজ্বলিত করা হয়।’ যেমন কাষ্ঠ। কুরআন পাকের অন্য আয়াতে বলা হইয়াছেঃ

وآممًا الْقَاسطُون فَكَانُوَا لجَهَنُمُ حطبا “জালিমগণ জাহান্নামের কাষ্ঠে পরিণত হইবে।”

আল্লাহ্ পাক অন্যত্র বলেনঃ

إنَّكُمْ وَمَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ حَصَبُ جَهَنَّمَ اَنْتُمْ لَهَا وَارِدُونَ – لَوْ كَانَ هؤلاء الهَةً مَّا وَرَدُوهَا وَكُلٌّ فِيْهَا خَالِدُونَ

“তোমরা এবং তোমাদের উপাস্যমণ্ডলী অবশ্যই জাহান্নামের কাষ্ঠে পরিণত হইবে। তোমরা সকলেই উহাতে নিক্ষিপ্ত হইবে। তোমাদের উপাস্যরা যথার্থ প্রভু হইলে কখনই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হইত না অথচ উহারা হইবে জাহান্নামের চিরস্থায়ী বাসিন্দা।”

এখানে حجارة বলিতে সুকঠিন বিশাল কালো গন্ধক পাথরকে বুঝানো হইয়াছে। উহা দ্বারা অগ্নি প্রজ্বলিত করা হইলে উহার উত্তাপ তীব্রতর ও স্থায়ী হয়। ইহা হইতে আল্লাহ্ পাক আমাদিগকে রক্ষা করুন।

আবদুল মালিক ইব্‌ন মাইসারাহ আয যারর্দ, আবদুর রহমান ইব্‌ন ছাবিত ও আমর ইব্‌ন মায়মূন ধারাবাহিকভাবে আবদুল্লাহ ইব্‌ন মাসঊদ (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ الحجارة অর্থ বিরাট কালো গন্ধক পাথর। আল্লাহ্ পাক আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির সময়ই কাফিরদের জন্য উহা সৃষ্টি করিয়া প্রথম আসমানে রাখিয়া দিয়াছেন।’ ইন জারীরও একই ভাষায় হাদীসটি বর্ণনা করেন। আবূ হাতিমও উহা উদ্ধৃত করেন। হাকিম স্বীয় ‘মুস্তাদরাক’-এ উহা বর্ণনা করিয়া বলেনঃ হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমের শর্তমাফিক হইয়াছে।

আস্ সুদ্দী আলোচ্য আয়াতাংশের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আবূ মালিক, আবূ সালেহ, ইব্‌ন আব্বাস ও মুরাহ ইবন মাসউদ ও একদল সাহাবা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত একটি হাদীস উদ্ধৃত করেন। উহাতে বলা হয়-আয়াতাংশের অর্থ হইল, ‘তোমরা সেই অনলকুণ্ড হইতে বাঁচিয়া থাক যাহার ইন্ধন হইবে মানুষ ও পাথর।” এখানে পাথর বলিতে কালো গন্ধক পাথরের কথা বুঝানো হইয়াছে। উহা দ্বারা আগুন প্রজ্বলিত করিয়া শাস্তি দেওয়া হইবে।

মুজাহিদ বলেনঃ মৃত লাশের দুর্গন্ধের চাইতেও গন্ধক পাথরের দুর্গন্ধ তীব্রতর হইবে। আবূ জা’ফর ইব্‌ন আলী বলেনঃ এখানে পাথর দ্বারা গন্ধক পাথর বুঝানো হইয়াছে। ইব্‌ন জুরায়জ বলেনঃ জাহান্নামে কালো গন্ধক পাথর থাকিবে। আমাকে আমর ইবন দীনার বলিয়াছেন-ইহা দ্বারা বিশাল কালো গন্ধক পাথরের কথা বলা হইয়াছে।

একদল ব্যাখ্যাকার বলেনঃ الحجارة বলিতে মূর্তি ও প্রতিমায় ব্যবহৃত পাথরের কথা বলা হইয়াছে। যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ

انُكُم وماتعيدون من دون الله حصب جهنم “নিশ্চয় তোমরা এবং আল্লাহ্ ব্যতীত তোমাদের অন্যান্য উপাস্য প্রভুরা জাহান্নামের কাষ্ঠ হইবে।

ইমাম কুরতুবী এই অভিমত ব্যক্ত করেন। ইমাম রাযীও এই অভিমতের প্রবক্তা। তাঁহারা উভয়ই এই ব্যাখ্যাকে প্রাধান্য দিয়াছেন। তাহারা বলেন-গন্ধক পাথর দ্বারা আগুন জ্বালানো কোন নতুন কথা নহে। সুতরাং এখানে প্রতিমা ও দেব-দেবীর আকার বিশিষ্ট পাথর হওয়াই যুক্তিযুক্ত।

অবশ্য তাহাদের এই যুক্তি যথাযথ নহে। কারণ, গন্ধক পাথরের জ্বালানো আগুন অন্যান্য বস্তুর সাহায্যে জ্বালানো আগুনের তুলনায় অনেক বেশী তীব্র। উহার উত্তপ্ততা ও দহন ক্ষমতা সর্বাধিক। সুতরাং প্রথমোক্ত অন্যান্য ব্যাখ্যাকারের অভিমতই গ্রহণযোগ্য। মূলত আয়াতের উদ্দেশ্য হইল জাহান্নামীদের জন্য প্রজ্বলিত অগ্নির উত্তপ্ততা ও দহন ক্ষমতার তীব্রতা বর্ণনা করা। সেক্ষেত্রে প্রতিমা-মূর্তির সাধারণ পাথরের চাইতে গন্ধক পাথর বহুগুণ বেশী কার্যকর। তাই প্রথমোক্ত ব্যাখ্যাই যুক্তিযুক্ত। আল্লাহ্ পাক বলেনঃ

كُلّمَا خبت زدنًا هم سَعيُرًا “যখন অগ্নি শিখার তীব্রতা কমিয়া যায়, তখন আমি উহা বাড়াইয়া দেই।”

ইমাম কুরতুবীও এই মতকে প্রাধান্য দিয়াছেন। তাঁহার মতে এখানে সেই পাথরকেই বুঝানো হইয়াছে যাহা আগুনের তীব্রতা ও দহন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কার্যকর। কারণ, জাহান্নামীদেরকে কঠোর শাস্তিদান এখানে উদ্দেশ্য। এই ব্যাপারে মহানবী (সাঃ)-এর নিকট হইতে বর্ণিত অনেক হাদীস পাওয়া যায়। একটি হাদীস এইঃ

كل مؤذ فى الثار ইহার অর্থ দুইরূপ বর্ণিত হইয়াছে। এক. ‘মানুষকে কষ্টদায়ক প্রত্যেকেই জাহান্নামে যাইবে।’ দুই. ‘জাহান্নামে প্রত্যেক শ্রেণীর কষ্টদায়ক বস্তু থাকিবে।’ অবশ্য হাদীসটি ত্রুটিমুক্ত ও সুপরিচিত নহে।

أعدت لِلْكَافْر ين আয়াতাংশের তাৎপর্য হইল এই যে, জাহান্নাম কাফিরদের জন্য তৈরি করিয়া রাখা হইয়াছে। এখানে أعدت এর অন্তর্গত সর্বনামটির ইঙ্গিত সুস্পষ্টতই মানুষ ও পাথর দ্বারা প্রজ্বলিত জাহান্নামের দিকে। অবশ্য উক্ত সর্বনামটি পাথরের স্থলাভিষিক্তও হইতে পারে। তখন অর্থ দাঁড়ায়, পাথরগুলি কাফিরদের শাস্তি প্রদানের জন্য তৈরি করিয়া রাখা হইয়াছে। ইব্‌ন মাসউদ (রাঃ) হইতে অনুরূপ একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। মূলত এই অর্থ দুইটির মধ্যে কোন পার্থক্য নাই। একটি অপরটির পরিপূরক ও পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। আগুন ছাড়া যেমন পাথর জ্বলে না, তেমনি পাথর ছাড়া আগুনের দহন ক্ষমতা বাড়ে না ৷ সুতরাং উভয় বস্তুইও কাফিরদের কঠোর শাস্তি বিধানের জন্য সৃষ্টি করা হইয়াছে। ইব্‌ন ইসহাক এই মর্মে একটি হাদীস মুহাম্মদ, ইকরামা, সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র ও ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিক সূত্রে বর্ণনা করেন। ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) أعدت للْكَافْرَيُنَ -এর ব্যাখ্যায় বলেন-কাফিরদের জন্য সেইগুলি প্রস্তুত রাখা হইয়াছে।

আলোচ্য আয়াতাংশ দ্বারা আহলে সুন্নত ওয়াল জামায়াতের ইমামগণ প্রমাণ দেন যে, ‘সৃষ্টির সূচনাকাল হইতেই জাহান্নাম তৈরি করিয়া রাখা হইয়াছে।’ জাহান্নাম যে বাস্তব আকারে বর্তমানে রহিয়াছে তাহার প্রমাণ অনেক হাদীস দ্বারাই পাওয়া যায়। যেমন-জান্নাত ও জাহান্নামের ঝগড়ার বর্ণনা, জাহান্নামের প্রার্থনা মোতাবেক উহাকে বৎসরে শীত ও গ্রীষ্মে দুই বার শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণের অনুমতি প্রদানের বর্ণনা ইত্যাদি। ইব্‌ন মাসউদ (রাঃ) হইতে বর্ণিত এক হাদীসে আছে, আমরা একটি বিকট শব্দ শুনিয়া মহানবী (সাঃ)-এর নিকট উহার কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেনঃ

“ইহা সত্তর বৎসর পূর্বে জাহান্নামের উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত পাথরের জাহান্নামে পতিত হওয়ার আওয়াজ।’ তেমনি সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণের কিংবা মি’রাজের ঘটনাবলী বর্ণনামূলক হাদীসসমূহেও প্রমাণ মিলে যে, আল্লাহ্ পাক জান্নাত ও জাহান্নাম তৈরি করিয়া রাখিয়াছেন। তবে মু’তাযিলাগণ অজ্ঞাতবশত ইহা স্বীকার করে না। অবশ্য স্পেনের কাজী মান্যার ইব্‌ন সাঈদ আল বালুতী ইহা স্বীকার করিয়াছেন। মু’তাযেলী হইয়াও তিনি জান্নাত-জাহান্নাম বর্তমান থাকিবার অভিমত সমর্থন করিয়াছেন।

 

বিশেষ জ্ঞাতব্য

فأنوا بسورة من مله আলোচ্য আয়াতাংশ ও সূরা ইউনুসের بسورة من مخْله আয়াতাংশের বক্তব্য হইতেই বুঝা যায় যে, কুরআনের এই চ্যালেঞ্জ উহার ছোট বড় যে কোন সূরার বেলায়ই প্রযোজ্য। কারণ, ব্যাকরণবিদদের মতে শর্তের সহিত অনির্দিষ্ট বিশেষ্য যুক্ত হইলে উহার যে কোন অংশের ক্ষেত্রেই উহা প্রযোজ্য, বিশেষ ক্ষেত্রে আবদ্ধ থাকে না। সুতরাং ছোট বড় সকল সূরাই যে অবিসংবাদিতার দাবীদার তাহা প্রমাণিত হইল। তাই এই ব্যাপারে ব্যাখ্যাকারগণ শ্রেণী নির্বিশেষে মতৈক্য পোষণ করেন।

ইমাম রাযী তাঁহার তাফসীর গ্রন্থে প্রশ্নোত্তর পদ্ধতিতে উহার মীমাংসা প্রদান করেন। তিনি বলেনঃ যদি প্রশ্ন করা হয় যে, فأنوا بسورة من مُمْله চ্যালেঞ্জের আওতায় সূরা আল আসর, সূরা কাওসার ও সূরা কাফিরূন-এর মত ক্ষুদ্র সূরা শামিল করা হইলে এই ধরনের কিংবা উহার কাছাকাছি সূরা রচনা করা কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব হইতে পারে। সেক্ষেত্রে এগুলিকে চ্যালেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত করা দীনের উপর অপবাদ চাপানোর নামান্তর নহে কি? ইহার জবাবে আমাদের বক্তব্য এই যে, এই সকল সূরা যদি ভাষালংকারের বিচারেও শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখিয়া চলে তাহা হইলেও আমাদের দাবীর সত্যতা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। অবশ্য এই জবাব আমাদের নিকট দুর্বলতর বিবেচিত হইতে পারে। উহার আরেক জবাব হইল এই, যদি তাহা সম্ভব বলিয়া আপাতত মানাও হয়, তথাপি উহার চরম বিরুদ্ধবাদীরাও উহা করিতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হওয়ায় আমাদের দাবীর সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। আমাদের প্রধান যুক্তি হইল এই যে, স্রষ্টার ছোট বড় কোন বাণীর সমকক্ষ বাণী সৃষ্টি করা কোন সৃষ্টির পক্ষে আদৌ সম্ভব নহে।

ইমাম শাফেঈ (রঃ) বলেন, মানুষ যদি শুধু সূরা আল কাওসার নিয়া চিন্তা-ভাবনা করে তাহা হইলেই কুরআনের যে কোন অংশের অবিসংবাদী হওয়া সম্পর্কে তাহারা নিশ্চিত হইতে পারে। আমর ইবনুল আস (রাঃ) হইতে আমাদের কাছে এই বর্ণনা পৌছিয়াছে যে, তিনি ইসলাম গ্রহণের পূর্বে একদল প্রতিনিধিসহ মুসায়লামাতুল কায্যাবের কাছে গিয়াছিলেন। মুসায়লামা তাহাকে প্রশ্ন করিল-তোমাদের মক্কার বন্ধুর নিকট সদ্য কি কোন ওহী নাযিল হইয়াছে? তিনি জবাব দিলেন-হ্যাঁ, তাহার নিকট অত্যন্ত অলংকারপূর্ণ এক অনুপম সূরা অবতীর্ণ হইয়াছে। সে প্রশ্ন করিল-উহা কি? তিনি জবাবে সূরা আল কাওসার পাঠ করিলেন। সে কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিল-আমার উপরও তদ্রূপ একটি সূরা নাযিল হইয়াছে। তিনি প্রশ্ন করিলেন-তাহা কোন সূরা? সে জবাবে পাঠ করিলঃ

يا وبر يا وبر – انما انت اذنان وصدر – وسائرك حقر فقر

“হে ইঁদুর! হে ইঁদুর! তোর আছে শুধু দুইটি কান ও বুক। আর তো সবই তোর নগণ্য ও হীন।”

উহা পাঠান্তে সে জিজ্ঞাসা করিল-সূরাটি কিরূপ হে আমর! তিনি জবাব দিলেন-আল্লাহর কসম! তুমি অবশ্যই জান যে, আমি নিশ্চয়ই তোমাকে মিথ্যাবাদী বলিয়া জানি।

(۲۵)

وَ بَشِّرِ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَهُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِهَا الۡاَنۡهٰرُ ؕ كُلَّمَا رُزِقُوۡا مِنۡهَا مِنۡ ثَمَرَۃٍ رِّزۡقًا ۙ قَالُوۡا هٰذَا الَّذِیۡ رُزِقۡنَا مِنۡ قَبۡلُ ۙ وَ اُتُوۡا بِهٖ مُتَشَابِهًا ؕ وَ لَهُمۡ فِیۡهَاۤ اَزۡوَاجٌ مُّطَهَّرَۃٌ ٭ۙ وَّ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ

২৫. যাহারা ঈমানদার ও নেক কাজ করিয়াছে, তাহাদিগকে সেই জান্নাতের সুসংবাদ দাও যাহার নিম্নভাগে ঝর্ণাধারা প্রবহমান। যখন তোমাদিগকে উহা হইতে ফলমূল খাইতে দেওয়া হইবে, তখন বলিবে, ইহা তো আমাদিগকে পূর্বেও দেওয়া হইত; দৃশ্যত তাহাদিগকে পূর্বানুরূপ ফলমূলই দেওয়া হইবে। সেখানে তাহাদের জন্য পূত-পবিত্র স্ত্রীগণ রহিয়াছে এবং তাহারা সেখানে অনন্তকাল অবস্থান করিবে।

তাফসীরঃ আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার ও রসূলের দুশমনদের কুফরী ও নিফাকের জন্য নির্ধারিত কঠোর শাস্তি ও লাঞ্ছনার বর্ণনা প্রদানের পরক্ষণেই স্বীয় বন্ধুদের ঈমানদারী ও নেক আমলের অশেষ মর্যাদা ও পুরস্কারের বর্ণনা প্রদান করিতেছেন। এই কারণেই কুরআন পাক ‘মাছানী’ নামে অভিহিত বলিয়া একদল আলিম অভিমত প্রকাশ করেন। এই অভিমতটি সঠিক । আমি যথাস্থানে সবিস্তারে ইহা আলোচনা করিব । উহাতে দেখাইব, কুরআনে সাধারণত ঈমানের পাশাপাশি কুফরীর, সৎ কাজের পাশাপাশি অসৎ কাজের, ভালর পাশাপাশি মন্দের, জান্নাতের পাশাপাশি জাহান্নামের এক কথায় পরস্পর বিপরীত বিষয়গুলি পাশাপাশি উল্লেখ করা হইয়াছে।

আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন-‘নেককার ঈমানদারদের খবর দাও, তাহাদের জন্য রহিয়াছে পাদদেশে ঝর্ণাধারা প্রবহমান জান্নাত।’ এখানে জান্নাতের অবস্থান ও উহার কিছু পরিচয় তুলিয়া ধরা হইয়াছে। বলা হইয়াছে, উহার বাগ-বাগিচা ও ঘর-বাড়ী বিরাজমান এবং সেইগুলির পাদদেশে ঝর্ণাধারা প্রবহমান রহিয়াছে।

হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে-জান্নাতের পাদদেশে প্রবহমান নহরগুলি (লেকের মতই) অগভীর হইবে, আর হাউজে কাওছারের দুই তীরে লালা-মতির গড়া বিরাট প্রাসাদ সাজানো রহিয়াছে। উহার মাটি মিশকে আম্বরের সুগন্ধে ভরপুর। উহার পথে বিছানো কাঁকরগুলো হইল লাল-জহরত, পান্না-চুন্নি সদৃশ। আমরা আল্লাহ্র কাছে উহার প্রত্যাশী। তিনি পরম করুণাময় ও অশেষ দানশীল।

ইব্‌ন আবূ হাতিম বলেন-আমাকে রবী’ ইব্‌ন সুলায়মান বর্ণনা করেন, তাঁহাকে আসাদ ইব্‌ন মূসা, তাঁহাকে আবূ ছওবান, তাঁহাকে আতা ইব্‌ন কুর্রা ও তাঁহাকে আব্দুল্লাহ ইব্‌ন জমরা হযরত আবূ হরায়রা (রাঃ) হইতে এই হাদীসটি শুনানঃ

“রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলিয়াছেন, জান্নাতের নহরগুলি টিলার তলদেশ কিংবা মিশকের পাহাড়ের পাদদেশে হইতে প্রবাহিত হয়।”

আবূ হাতিম ‘আরও বলেন-আমাদের নিকট আবূ সাঈদ ওয়াকী’ আ’মাশ হইতে, তিনি আবদুল্লাহ ইব্‌ন মুরাহ হইতে ও তিনি মাসরূক হইতে এই হাদীসটি শুনান; জান্নাতের নদী-নালা মিশকের পাহাড় হইতে প্রবাহিত হইতেছে।

كلما ر رْقُوًا منها من فمرة رَرّقًا قَالُوا هذا الذئ من قَيْلٌ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আল্লামা সুদ্দী তাঁহার তাফসীর গ্রন্থে হযরত ইবন মাসউদ (রাঃ) ও একদল সাহাবা হইতে পর্যায়ক্রমে মুরাহ, ইব্‌ন আব্বাস, আবূ সালেহ ও আবূ মালিক বর্ণিত এই বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেনঃ

“পূর্বেও আমাদিগকে ইহা দেওয়া হইয়াছে”–কথাটির তাৎপর্য এই যে, পার্থিব জগতের ফল-মূলের অনুরূপ ফলমূল জান্নাতে পাইয়া তাহারা বলিবে, ইহা তো আমরা দুনিয়াতেও পাইয়াছিলাম। কাতাদাহ এবং আবদুর রহমান ইব্‌ন যায়দ ইব্‌ন আসলামও এই ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ইন জারীরও এই ব্যাখ্যা সমর্থন করেন।

قَالُوًَا هذا الى رزقنًا من قَبْلُ এ আয়াতাংশের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইকরামা বলেন—ইহার অর্থ হইল, ‘গতকাল যাহা পাইয়াছিলাম, আজও তাহাই পাইলাম।’ রবী’ ইব্‌ন আনাস এই ব্যাখ্যার সমর্থক। উহার ব্যাখ্যায় মুজাহিদ বলেন-‘ইহা পূর্বের মতই দেখায়।’ ইন জারীরও এই ব্যাখ্যা সমর্থন করেন। অন্যান্য ব্যাখ্যাকার বলেন, জান্নাতে প্রদত্ত ফলমূলের পারস্পরিক সাদৃশ্য এত বেশী থাকিবে যে, ভিন্ন ভিন্ন ফলমূল দেখিয়াও জান্নাতীরা বলিবে, ইহাতো পূর্বেও পাইয়াছি।

وأونُوا به مَتشابهَا আয়াতাংশ সম্পর্কে সুনায়দ ইব্‌ন দাউদ বলেন-আমাদের কাছে মাসীসার শায়েখ আওযাঈর বরাতে ইয়াহিয়া ইব্‌ন কাছীরের এই বর্ণনাটি শুনানঃ জান্নাতীগণকে খাঞ্চাপূর্ণ আহার্য দান করা হইলে উহা ভক্ষণ করিবে। অতঃপর অন্য আহার্য প্রদান করা হইলে তাহারা বলিবে, এই বস্তুই তো আমাদিগকে পূর্বে দেওয়া হইত। তখন ফেরেশতাগণ বলিবেন-আকার-আকৃতি একরূপ হইলেও স্বাদ ও প্রকৃতি ভিন্ন।

ইমাম আবূ হাতিম বলেন-আমাদিগকে আমার পিতা, তাঁহাকে সাঈদ ইব্‌ন সুলায়মান ও তাঁহাকে আমির ইবন ইয়াসাফ ইয়াহিয়া ইব্‌ন কাছীর হইতে এই বর্ণনা শুনান : জান্নাতের তৃণ হইবে জাফরানী রঙের এবং উহার টিলাগুলি মিশকের ঘ্রাণে ভরপুর হইবে। গেলমানগণ খাঞ্চা ভরা ফল-মূল লইয়া জান্নাতীদের কাছে ঘুরিতে থাকিবে। জান্নাতীরা উহা হইতে আহার করিবে। দ্বিতীয়বার অনুরূপ ফল-মূল লইয়া আসিলে তাহারা বলিবে, ইহাতো তোমরা একটু আগেই আমাদিগকে খাওয়াইয়াছ। তখন গেলমানরা বলিবে—ইহা খাইয়া দেখুন, রঙ-রূপ এক দেখা গেলেও স্বাদ-স্বরূপ সম্পূর্ণ ভিন্ন। وَأُوتُوا بِهِ مُتَشَابِها -এর তাৎপর্য ইহাই।

وأونُوا به مَتشابهَا প্রসঙ্গে আবূ জা’ফর রাযী রবী’ ইব্‌ন আনাসের বরাত দিয়া আবুল আলীয়া হইতে বর্ণনা করেন : ‘জান্নাতের ফলমূলসমূহ বাহ্যিক দৃষ্টিতে পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ হইলেও স্বাদ হইবে সম্পূর্ণ ভিন্নতর।’ ইব্‌ন আবূ হাতিম, রবী’ ইব্‌ন আনাস ও সুদ্দী হইতেও অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়।

উক্ত আয়াতাংশের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইমাম ইব্‌ন জারীর সুদ্দীর সনদে বর্ণিত একটি হাদীস উদ্ধৃত করেন। ইবন মাসউদও একদল সাহাবা হইতে পর্যায়ক্রমে মুরাহ, ইব্‌ন আব্বাস, আ সালেহ, আবূ মালিক ও সুদ্দীর বরাতে বর্ণনা করেনঃ জান্নাতী ফলমূলের পারস্পরিক সাদৃশ্যতা হইবে বাহ্যিক আকার-আকৃতির, স্বাদ- প্রকৃতির নহে। ইব্‌ন জারীর এই মতই গ্রহণ করিয়াছেন।

ইকরামা বলেন-বেহেশতের ফলমূল দুনিয়ার ফলমূলের সহিত দৃশ্যত সামঞ্জস্যপূর্ণ হইবে বটে, কিন্তু দুনিয়ার ফলমূলের চাইতে বেহেশতের ফলমূল অনেক উত্তম হইবে।

সুফিয়ান ছাওরী আ’মাশ হইতে, তিনি আবূ জবিয়ান হইতে ও তিনি ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ ‘দুনিয়ার কোন বস্তুই জান্নাতের কোন বস্তুর মত হইবে না, কেবলমাত্র নাম ছাড়া। অন্য এক হাদীসেও ইহার সমর্থন মিলে। উহাতে বলা হইয়াছে, ‘দুনিয়ার কোন বস্তুই জান্নাতে পাওয়া যাইবে না, শুধু উহার নাম পাওয়া যাইবে।’ বর্ণনাটি আবূ মু’আবিয়া হইতে ছওরী ও ইব্‌ন আবূ হাতিমের মাধ্যমে ইবন জারীর উদ্ধৃত করেন। আলোচ্য আয়াতাংশ প্রসঙ্গে আবদুর রহমান ইব্‌ন যায়দ ইব্‌ন আসলাম বলেন- জান্নাতীরা দুনিয়ার ফলমূলের মতই জান্নাতী ফলমূল দেখিয়াও বলিতে পারিবে, উহা আঙ্গুর, ইহা আপেল ইত্যাদি। তাই তাহারা বলিবে, ইহাতো আমরা দুনিয়াতেও খাইয়াছি। সুতরাং জান্নাতের ফলমূল দৃশ্যত দুনিয়ার ফলমূলের মতই হইবে, তবে স্বাদ হইবে ভিন্নতর।

 لَهُمْ فَيّهًا أزواج مَُطَّهّرَةٌ আয়াতাংশ প্রসঙ্গে ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ)-এর বরাত দিয়া ইন আবূ তালহা বলেন- জান্নাতের দম্পতি সর্বপ্রকার অপবিত্রতা ও কষ্ট হইতে মুক্ত হইবে। মুজাহিদ বলেনঃ তাহারা ঋতুস্রাব, মল-মুত্র, সর্দি-কাশি, বীর্য-প্রসূতি ইত্যাকার সকল ঝঞ্ঝাট হইতে মুক্ত থাকিবে। কাতাদাহ বলেন- জান্নাতের দম্পতিগণ দৈহিক ও আত্মিক সর্ববিধ অপবিত্রতা হইতে মুক্ত থাকিবেন। তিনি অপর এক বর্ণনায় বলেনঃ তাহাদের ঋতুস্রাব কিংবা অন্য কোনরূপ কষ্ট-ক্লেশ থাকিবে না। আতা, হাসান, যিহাক, আবূ সালেহ, আতিয়্যা ও সুদ্দী প্রমুখ হইতেও অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায় ৷

ইবন জারীর বলেন- আমার কাছে ইউনুস ইব্‌ন আবদুল আ’লা ও ইব্‌ন ওহাব আব্দুর রহমান ইব্‌ন যায়দ ইব্‌ন আসলাম হইতে বর্ণনা করেনঃ জান্নাতের হুরগণ এমন পূত-পবিত্র হইবেন যে, তাহাদের কখনও ঋতুস্রাব হইবে না। হযরত হাওয়া (আঃ)-কে তদ্রূপ সৃষ্টি করা হইয়াছিল। তাই তিনি আল্লাহ্ নাফরমানী করিলে আল্লাহ্ পাক তাহাকে বলেনঃ আমি তোমাকে জান্নাতে পূত-পবিত্র করিয়া সৃষ্টি করিয়াছিলাম। শীঘ্রই তোমাকে এই (গন্দম) বৃক্ষের মতই ঋতু প্রভাবাধীন ও ফলপ্রসূ করিব। অবশ্য হাদীসটি অত্যন্ত দুর্বল (গরীব)।

হাফিজ আবূ বকর ইব্‌ন মারদুবিয়্যাহ বলেনঃ নবী করীম (সাঃ) হইতে পর্যায়ক্রমে আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ), আবূ নাজরাহ, কাতাদাহ, শু’বা আবদুল্লাহ ইব্‌ন মুবারক, আব্দুর রায্যাক ইবন উমর আল বাযীঈ, মুহাম্মদ ইব্‌ন উবায়দ আলকিন্দী, আহমদ ইব্‌ন মুহাম্মদ আল খাওয়ারী ও জা’ফর ইব্‌ন মুহাম্মদ ইব্‌ন হরবের বর্ণিত একটি হাদীস ইবরাহীম ইব্‌ন মুহাম্মদ আমাদের কাছে বর্ণনা করেন। উহাতে বলা হয়- ولَهُمْ فيهًَا آرواج مُطَهْرَةٌ আয়াতাংশ সম্পর্কে নবী করীম (সাঃ) বলেন, জান্নাতীরা মল-মূত্র, হায়েয-নিফাস, সর্দি-কাশি, থুথু-বমি ইত্যাকার ব্যাপার হইতে সম্পূর্ণ পূত-পবিত্র ও মুক্ত হইবে।

এই হাদীসটিও সনদের দিক দিয়া দুর্বল (গরীব)। অবশ্য হাকিম স্বীয় ‘মুস্তাদরাক সংকলনে মুহাম্মদ ইব্‌ন ইয়াকূব, আল হাসান ইব্‌ন আলী ইব্‌ন আফ্ফান ও মুহাম্মদ ইব্‌ন উবায়দের ধারাবাহিক সনদে উক্ত হাদীস উদ্ধৃত করিয়া বলেন- হাদীসটি ইমাম বুখারী ও মুসলিমের শর্তানুযায়ী বিশুদ্ধ। কিন্তু, তাঁহার এই দাবী পর্যালোচনা সাপেক্ষ বটে। কারণ, আব্দুর রায্যাক ইব্‌ন আমর আল বাযীঈ বলিয়াছেন, এই হাদীসের অন্যতম রাবী আবূ হাতিম ইব্‌ন হিব্বান আল বুস্তীর বর্ণনাকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করা বৈধ নহে।

এ ক্ষেত্রে আমার বক্তব্য এই যে, এই হাদীসের বর্ণনার সহিত ইতিপূর্বে উদ্ধৃত কাতাদার বর্ণিত হাদীসের সুস্পষ্ট মিল রহিয়াছে। وهم فيهًا خالدون আয়াতাংশের মর্ম হইল এই, জান্নাতীরা উহাতে অনন্তকাল অবস্থান করিবে এবং ইহাই সৌভাগ্যের পূর্ণতা বটে। এই স্থানের মতই ইহার নিয়ামতসমূহও চিরস্থায়ী। এখানে মৃত্যু ও বিলুপ্তির বিভীষিকা চিরতরে অন্তর্হিত। জান্নাতীগণ এই স্থান ও ইহার নিয়ামত হইতে কখনও বঞ্চিত হইবে না। এখানে অনন্তকাল পর্যন্ত তাহারা অজস্র নিয়ামত ভোগ করিতে থাকিবে। মহা মহীয়ান আল্লাহ্ তা’আলার দরবারে আমাদের ঐকান্তিক প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদিগকে জান্নাতীগণের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি অসীম দয়ালু ও অপরিসীম দাতা।

কুরআনে প্রদত্ত উপমা ও ইহার প্রতিক্রিয়া

(٢٦)

اِنَّ اللّٰهَ لَا یَسۡتَحۡیٖۤ اَنۡ یَّضۡرِبَ مَثَلًا مَّا بَعُوۡضَۃً فَمَا فَوۡقَهَا ؕ فَاَمَّا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا فَیَعۡلَمُوۡنَ اَنَّهُ الۡحَقُّ مِنۡ رَّبِّهِمۡ ۚ وَ اَمَّا الَّذِیۡنَ كَفَرُوۡا فَیَقُوۡلُوۡنَ مَا ذَاۤ اَرَادَ اللّٰهُ بِهٰذَا مَثَلًا ۘ یُضِلُّ بِهٖ كَثِیۡرًا ۙ وَّ یَهۡدِیۡ بِهٖ كَثِیۡرًا ؕ وَ مَا یُضِلُّ بِهٖۤ اِلَّا الۡفٰسِقِیۡنَ

(۲۷)

الَّذِیۡنَ یَنۡقُضُوۡنَ عَهۡدَ اللّٰهِ مِنۡۢ بَعۡدِ مِیۡثَاقِهٖ ۪ وَ یَقۡطَعُوۡنَ مَاۤ اَمَرَ اللّٰهُ بِهٖۤ اَنۡ یُّوۡصَلَ وَ یُفۡسِدُوۡنَ فِی الۡاَرۡضِ ؕ اُولٰٓئِكَ هُمُ الۡخٰسِرُوۡنَ

২৬. নিশ্চয় আল্লাহ্ তা’আলা মশা কিংবা তদুর্ধ্ব কিছু দ্বারা উদাহরণ দিতে লজ্জা পান না। অনন্তর যাহারা ঈমানদার, তাহারা জানেন, নিশ্চয় উহা তাহাদের প্রভুর তরফ হইতে আগত সত্য। পক্ষান্তরে যাহারা কাফির, তাহারা বলে, এই (তুচ্ছতম) উদাহরণ পেশের ভিতর আল্লাহর কি অভিপ্রায় রহিয়াছে? (এইভাবে) অনেককে উহা দ্বারা পথভ্রষ্ট রাখেন ও অনেককে আবার পথপ্রাপ্ত করেন। মূলত ফাসিকগণ ব্যতীত কাহাকেও পথভ্রষ্ট রাখেন না।

২৭. তাহারাই আল্লাহর সহিত সুদৃঢ় ওয়াদা করিয়া উহা ভঙ্গ করিয়াছে এবং আল্লাহর নির্দেশিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়াছে ও পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করিয়াছে। তাহারাই নিশ্চিত ক্ষতিগ্ৰস্ত।’

তাফসীরঃ ব্যাখ্যাকার আস্ সুদ্দী তাঁহার তাফসীর গ্রন্থে ইব্‌ন মাসউদ ও একদল সাহাবা (রাঃ) হইতে মুরা, ইব্‌ন আব্বাস, আবূ সালেহ্ ও আবূ মালিকের পর্যায়ক্রমিক একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেন। উহাতে বলা হয়- মুনাফিকদের উপমা প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাকের অবতীর্ণ। مَثلهم كَمَكْلٍ الّذى اسَتَوقَدٌ ثارًا আয়াত ও أو كصيب من السّماء فيه ظلّمات আয়াত সম্পর্কে মুনাফিকরা প্রশ্ন তুলিল, মহান আল্লাহ্ কখনও এই সব নগণ্য ও ক্ষুদ্র উপমা পেশ করিতে পারেন না। এই প্রশ্নের জবাবেই উপরোক্ত আয়াতদ্বয় অবতীর্ণ হয় ৷

মুআম্মার ও কাতাদাহর উদ্ধৃতি দিয়া আবদুর রায্যাক বলেনঃ

আল্লাহ্ পাক যখন পাক কালামে মাকড়শা ও মশা-মাছির উপমা পেশ করেন, তখন মুশরিকগণ বলিল, আল্লাহর কালামে মাকড়শা ও মশা-মাছির মত ক্ষুদ্র কীট-পতংগের উপমা দেওয়া হইবে কেন? তখন আল্লাহ্ পাক ان الله لأيستحى أن يُضرب مَقلاً ما بُعوضةً فَمَا فَوْقَهًا আয়াত নাযিল করেন।

কাতাদাহর বরাত দিয়া সাঈদ বলেন- আল্লাহ্ পাক সত্য প্রকাশের জন্য ছোট বড় যে কোন বস্তুর উল্লেখ করিতে সংকোচ বোধ করেন না। পাক কালামে মাকড়শা ও মশার উল্লেখ করা হইলে ভ্রান্ত লোকরা বলিল, এহেন ক্ষুদ্র বস্তু দ্বারা উপমা পেশ করার ভিতর আল্লাহ্ কি অভিপ্রায় থাকিতে পারে? তখন আল্লাহ্ তা’আলা ان الله لأيستّحى أن يضر ب مَقَّلاً ما يَعوضة فَمَا فَوْقَهَا আয়াত নাযিল করেন।

(আমার বক্তব্য) পূর্বোল্লেখিত কাতাদাহর বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, এই আয়াত মক্কায় অবতীর্ণ হইয়াছে। আসলে তাহা ঠিক নহে। পরে কাতাদাহর উদ্ধৃতি দিয়া সাঈদ যাহা বর্ণনা করেন তাহাই সঠিক মনে হইতেছে। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।

ইব্‌ন জারীরও মুজাহিদের বরাতে কাতাদাহ হইতে বর্ণিত দ্বিতীয় ভাষ্যের অনুরূপ ভাষ্য বর্ণনা করিয়াছেন। ইব্‌ন আবূ হাতিম বলেন- হাসান ও ইসমাঈল ইব্‌ন আবূ খালিদ হইতেও সুদ্দী ও কাতাদাহর অনুরূপ ভাষ্য বর্ণিত হইয়াছে।

আলোচ্য আয়াত প্রসঙ্গে আবূ জা’ফর রাযী রবী’ ইব্‌ন আনাসের উদ্ধৃতি দিয়া বলেন- আল্লাহ্ পার্থিব ভোগ বিলাসমত্ত দুনিয়াদার লোকদিগকে সতর্ক করার জন্য এই উদাহরণ পেশ করেন যে, মশা যতক্ষণ উপবাস থাকে, ততক্ষণ উহা বাঁচিয়া থাকে এবং যখনই সে আহার করিয়া মোটা-তাজা হয়, তখনই তাহার মৃত্যু হয়। উপমাটির তাৎপর্য এই যে, দুনিয়াদার মানুষ ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকিয়া যখন ফুলিয়া ফাঁপিয়া মোটা-তাজা হইতে থাকে, তখন অকস্মাৎ তাহাদের উপর আল্লাহর গজব পতিত হয়।

যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ فَلَمَا نسُوا مَاذْكّرَوَا به فَتَحَنًا علَيُهم أَبُوَاب كُل شىء ‘যখন তাহারা আমার উপদেশের কথা ভুলিয়া যায়, তখন তাহাদের জন্য আমি প্রত্যেকটি বস্তুর দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দেই ৷’

ইব্‌ন জারীরও অনুরূপ বর্ণনা করেন। ইব্‌ন আবূ হাতিম, রবী’ ইবন আনাস ও আবুল আলীয়া হইতে আবূ জা’ফর বর্ণিত হাদীসেও অনুরূপ অভিমতের সমর্থন মিলে।

আলোচ্য আয়াতের শানে নুযুল নিয়া যে বিভিন্ন মত দেখা যায়, তাহার কোটি সত্য তাহা আল্লাহ্ পাকই ভাল জানেন। তবে ইব্‌ন জারীর সুদ্দীর বিবরণকেই গ্রহণ করিয়াছেন। কারণ, তাহার বর্ণনা পূর্ববর্তী আয়াতের সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিলক্ষিত হয়। বস্তুত উক্ত আয়াতাংশের অর্থ হইল, আল্লাহ্ তা’আলা ছোট বড় যে কোন বস্তু দ্বারা উপমা পেশ করিতে সংকোচ বোধ করেন না। কেহ কেহ বলিয়াছেন, আল্লাহ্ তা’আলা তাহা বর্ণনা করিতে ভীত হন না।

এই আয়াতাংশে ما শব্দটি স্বল্পতা প্রকাশার্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। আরবী ব্যাকরণের ‘বদলের’ নিয়মমাফিক بعوضة শব্দটি জবরের স্থানে অবস্থান করিতেছে । আরবীতে لاض ر بن ضربا مأ অর্থ হইল ‘আমি অবশ্যই খুব অল্প মারিব।’ সুতরাং এখানে ما দ্বারা ক্ষুদ্রকায় বস্তু বুঝানো হইয়াছে। অথবা এখানে بعوضة শব্দটি অনির্দিষ্ট বিশেষ্য এবং بعوضة শব্দটি উহার বিশেষণরূপে আসিয়াছে। ইব্‌ন জরীরের মতে এখানে ما শব্দটি أسم موصوله (সংযোজক বিশেষ্য) এবং بعوضة শব্দটি তদনুসারে হরকত গ্রহণ করিয়াছে। আরবী ভাষায় ما ও من শব্দদ্বয় নিজ নিজ অবস্থানুসারে صله -কে হরকত প্রদান করে। কারণ, উহা কখনও نكره হয় এবং কখনও আবার معرفه হয়। হাস্সান বিন ছাবিতের একটি পংক্তিতে উহার ব্যবহার লক্ষ্যণীয়ঃ

يكفى بنا فضلا على من غيرنا – حب النبي محمدايانا

(মুহাম্মদ (সাঃ)-এর জন্য ভালবাসায় আমাদের অন্তর যে পরিপূর্ণ, অন্যান্যের উপর আমাদের মহত্ত ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য ইহাই যথেষ্ট।)

কাহারও মতে, এখানে জেরদায়ক শব্দ উহ্য থাকায় জবর বিশিষ্ট হইয়াছে। মূল বাক্যটি এইরূপ ছিলঃ

مَثَلاً مَّا بَيْنَ بَعُوضَةٌ إلى مَا فَوْقَهَا

ব্যাকরণবিদ কাসাঈ ও ফাররা এই অভিমত পোষণ করেন। যিহাক ও ইবরাহীম ইন আবলাহ পেশ দিয়া بعوضة পড়েন। ইব্‌ন জিন্নীর মতে يعوضة সংযোজক বিশেষ্য ما -এর صله হিসাবে বিরাজ করিতেছে। যেমন কালামে পাকে আছেঃ تماما على الذى احسن ‘পুণ্যবানকে পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হইবে।’

সিবুওয়াই বলেন, এখানে ما শব্দটি الذى শব্দের সমার্থক। সুতরাং ইহার অর্থ এই দাঁড়ায়, ‘সমালোচক তোমার নিকট যাহা বলে আমি তদ্রূপ নহি।

বস্তুত এখানে فما فوقها -এর অর্থ সম্পর্কে দুইটি মত দেখা যায়। প্রথম মত হইল এই, ক্ষুদ্রতা ও তুচ্ছতার দিক দিয়া ইহা হইতেও ক্ষুদ্রতর ও তুচ্ছতর বস্তুর উপমা দিতেও আল্লাহ্ তা’আলা সংকোচ বোধ করেন না। যেমন কেহ কাহারও কৃপণতা বা নীচতা সম্পর্কে কোন উপমা পেশ করিলে শ্রোতারা বলিয়া উঠে, সেই ব্যক্তি উহার চাইতেও অধম। কাসাঈ, আবূ উবায়দুল্লাহ প্রমুখ এই অভিমতের প্রবক্তা। হাদীস শরীফেও aage শব্দ ব্যবহৃত হইয়া অনুরূপ অর্থ প্রদান করিয়াছে। মহানবী (সাঃ) বলেনঃ

لو ان الدنيا تزن عند الله جناح بعوضة – لما سقى الكافر منها شربة ماء

(পার্থিব জগতের মূল্য আল্লাহ্ তা’আলার নিকট যদি মশার একটি ডানা সমতুল্য হইত, তাহা হইলেও তিনি কাফিরদিগকে উহার এক গ্লাস পানিও পান করিতে দিতেন না।)

দ্বিতীয় মত অনুসারে অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা ক্ষুদ্রতম মশা হইতে শুরু করিয়া উপরের যে কোন বস্তুর উপমা দিতে লজ্জিত হন না। এই মতটির প্রবক্তা হইলেন কাতাদাহ ও ইব্‌ দুআমা। আল্লামা ইব্‌ন জারীরও এই মত পছন্দ করিয়াছেন। মুসলিম শরীফে উদ্ধৃত হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ)-এর বর্ণিত এক হাদীসে এই মতের সমর্থন মিলে। মহানবী (সাঃ) বলেনঃ

مامن مسلم يشاك شوكة فما فوقها الا كتب له بها درجة ومحيت عنه بها خـطينت

(কোন মুসলমান একটি কাঁটা বিদ্ধ হইলে কিংবা উহা হইতে কোন বড় আঘাত পাইলে উহার বিনিময়ে তাহার গুনাহ মার্জনা হয় এবং আল্লাহ্র দরবারে তাহার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।)

মোটকথা উক্ত আয়াতাংশের তাৎপর্য হইল এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা মণ কিংবা উহার ছোট ও বড় যে কোন বস্তুর সাহায্যে উপমা পেশ করিতে দ্বিধান্বিত হন না। যেমন তিনি অন্যত্র বলেনঃ

يَاأيهَاالنّاس ضرب مكل فاستمعوا لَه ط ان الَّذينْ تدعون من دون الله

نْ يحْلْقَُا دُبَابًا و لَوْ إجمَسَعُوًا له م وإ يلبهم الدبَابُ شَيْنًا لأيَسْتْقدُو؛

مه ط ضعف الطالب والمطلوب

‘হে মানব! একটি উদাহরণ পেশ করা হইতেছে, মনোযোগ দিয়া শুন। আল্লাহকে ছাড়িয়া তোমরা যাহাদিগকে প্রভু বলিয়া ডাকিতেছ, তাহারা সকলে একত্রিত হইয়াও একটি মাছি সৃষ্টি করিতে পারিবে না। তেমনি মাছি তাহাদের কিছু ছিনাইয়া নিলেও তাহারা উহা ফেরৎ আনিবার ক্ষমতা রাখে না। বান্দা যেমন দুর্বল, মা’বুদও (তেমনি দুর্বল)। তিনি অন্যত্র বলেনঃ

مَثَلُ الَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ أَوْلِيَاءَ كَمَثَلِ الْعَنْكَبوتِ اتَّخَذَتْ بَيْتًا ط

وَإِنَّ أَوْهَنَ البيوت لَبَيْتُ العَنْكَبوتِ – لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ

(আল্লাহ্ ছাড়া যাহাদিগকে তাহারা অভিভাবকরূপে গ্রহণ করিয়াছে, তাহারা যেন মাকড়শা৷ মাকড়শার বানানো আশ্রয়গৃহটি অবশ্যই সর্বাধিক নাজুক। তাহারা যদি ইহা জানিত।)

তিনি আরও বলেনঃ

أَلَمْ تَرَ كَيْفَ ضَرَبَ اللهُ مَثَلاً كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرَةٍ طَيِّبَةٍ أَصْلُهَا ثَابِتُ وَفَرْعُهَا

في السَّمَاء – تُؤْتي أكلها كل حين بإذْنِ رَبِّهَا ط  وَيُضرِبُ اللهُ الأَمْثَالَ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ – وَمَثَلُ كَلِمَةٍ خَبِيْضَةٍ كَشَجَرَةٍ خَيْثَة ن جنتَتُنَّتْ مِنْ فَوْقِ الْأَرْضِ مَا لَهَا مِنْ قَرَارٍ يُثبِتُ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَوةِ

الدُّنْيَا وَفِي الآخِرَةِ وَيُضِلُّ الله الظالمين وقف وَيَفْعَلُ الله مايشاء 

‘তোমরা কি দেখ নাই কিভাবে আল্লাহ্ তা’আলা উদাহরণ পেশ করেন? কলেমা তায়্যিবা যেন একটি পবিত্র বৃক্ষ । উহার শিকড় সুপ্রতিষ্ঠিত ও শাখা-প্রশাখা নভোমণ্ডলী জুড়িয়া রহিয়াছে । আল্লাহ্র ইচ্ছায় প্রতি মুহূর্তে উহা ফল দান করে । আল্লাহ্ এই উপমা প্রদান মানুষের উপদেশ গ্রহণের জন্য । তেমনি অপবিত্র কলেমার উপমা হইল একটি অপবিত্র বৃক্ষ । উহা ভূমির উপরে ভাসমান। উহার কোনই স্থিরতা নাই। আল্লাহ্ তা’আলা ঈমানদারগণকে দুনিয়া ও আখিরাতে সুদৃঢ় বক্তব্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখেন এবং জালিমদিগকে পথভ্রষ্ট রাখেন। আল্লাহ্র যেমন ইচ্ছা তেমনই করেন।’

অন্যত্র তিনি বলেনঃ

ضرب اللهُ مَثَلاً عَبْدًا مَمْلُوكًا لايقدر عَلَى شَيْءٍ

আল্লাহ তা’আলা এমন এক পরাধীন ভৃত্যের উপমা পেশ করিলেন, স্বেচ্ছায় যাহার কিছুই করার ক্ষমতা নাই।’

তিনি আরও বলেনঃ

ضَرَبَ اللهُ مَثَلاً رَّجُلَيْنِ أَحَدُهُمَا أَبْكَمُ لاَ يَقْدِرُ عَلَى شَيْءٍ وَهُوَ كُلٌّ عَلَى مَوْلَهُ أيْنَمَا يُوجَهُهُ لا يَأْتِ بِخَيْرٍ ط هَلْ يَسْتَوى هُوَ لا وَمَنْ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ 

‘আল্লাহ্ পাক দুই ব্যক্তির উদাহরণ পেশ করিতেছেন। একজন বোবা ও বধির। সে কিছু করিতে পারে না, প্রভুর উপর বোঝা হইয়া আছে। অন্যজন ভাল কাজ করে ও ভাল কাজের নির্দেশ দেয়। উভয় কি সমান হইতে পারে?’

তিনি অন্যত্র বলেনঃ

ضَرَبَ لَكُمْ مَّثَلاً مِّنْ أَنْفُسِكُمْ ط هَلْ لَكُمْ مِنْ مَّا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ مِنْ شُرَكَاء فِيمَا رَزَقْنَاكُمْ

‘তোমাদের জন্য আল্লাহ্ পাক তোমাদের দ্বারাই উদাহরণ পেশ করিতেছেন ৷ আমি তোমাদিগকে যে সম্পদ দান করিয়াছি, তোমাদের ভৃত্যগণকে কি উহার অংশীদার মনে কর?” অন্যত্র তিনি বলেনঃ

ضرب الله مَقْلا رجلا فيه شركاء متشاكسون ‘আল্লাহ্ তা’আলা সেই ব্যক্তির উদাহরণ পেশ করিতেছেন, যাহার সমমানের অনেক ঝগড়াটে অংশীদার রহিয়াছে।’

তিনি আরও বলেনঃ

وتلك الأمثال نضربهًا للنّاس وما يَعَقَلَهًَا الا العلمون ‘এইসব উদাহরণ আমি মানুষের জন্য তুলিয়া ধরিয়াছি। তবে আলিম ছাড়া উহা কেহ বুঝিতে পারে না।’

আল-কুরআনে আরও অজস্র উদাহরণ বিদ্যমান। প্রথম যুগের কোন এক মনীষী বলিয়াছেন, আমি কুরআনের কোন উপমার তাৎপর্য অনুধাবনে ব্যর্থ হইলে অনুশোচনায় কাঁদিয়া ফেলি। কারণ, আল্লাহ্ পাক বলিয়াছেন, এইসব উদাহরণ আমি মানুষের জন্য পেশ করিয়াছি বটে। কিন্তু আলিম ছাড়া কেহ উহা বুঝিতে পারিবে না।

ان الله لأيستحى أن يُضرب ممقلا ما بعوضة فَمَا فَُوَقَها আয়াত প্রসঙ্গে মুজাহিদ বলেনঃ ঈমানদারগণ আল্লাহ্ তা’আলার যে কোন ছোট বড় উদাহরণের উপর ঈমান রাখে এবং উহা আল্লাহর তরফ হইতে প্রদত্ত বলিয়া বিশ্বাস করে। সেই সব উদাহরণ দ্বারা আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদিগকে পথ প্রদর্শন করেন।

فامًا الَّدْيْنَ امنوا فيعلمون أنه الحق من ربهم আয়াত প্রসঙ্গে কাতাদাহ বলেনঃ ‘ঈমানদারগণ জানে যে, এই উপমা তাহাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে অবতীর্ণ হইয়াছে। মুজাহিদ, হাসান ও রবী’ ইব্‌ন আনাস অনুরূপ ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছেন। আবুল আলীয়া উক্ত আয়াত সম্পর্কে বলেনঃ ঈমানদারগণ জানে যে, উহা আল্লাহর তরফ হইতে প্রদত্ত সঠিক উপমা ৷

 وأمًا الَّديِنْ كَفْروا فَيَقُوَلُوْنَ مَاذَا راد اللَّهُ بهذا مَقَّلاً আয়াতাংশের অনুরূপ আয়াত সূরা মুদ্দাচ্ছিরেও আসিয়াছে।

মাল্লাহ্ পাক বলেনঃ

 

وَمَا جَعَلْنَا أَصْحَابَ النَّارِ  َالا مَلائِكَةً وَمَا جَعَلْنَا عِدَّتَهُمْ إِلَّا فِتْنَةً لِلَّذِينَ كَفَرُوا لِيَسْتَيْقِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ وَيَزْدَادًا الَّذِينَ آمَنُوا إِيمَانًا وَلَا يَرْتَابَ الَّذِينَ أوتُوا الْكِتَابَ وَالْمُؤْمِنُونَ ، وَلِيَقُولُ الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مُرْضَ وَالْكَافِرُونَ – مَاذَا أَرَادَ اللَّهُ بِهَذَا مَثَلاً ط كَذَالِكَ يُضِلُّ اللهُ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَمَا ط يعلم جنود رَبَّكَ الَّا هُوَ

‘আমি জাহান্নামীদেরকে ফেরেশতা মুক্ত রাখি নাই এবং উহাদের সংখ্যাকে কাফিরদের দুর্ভাবনার ব্যাপারে পরিণত করিয়াছি। আহলে কিতাবগণও ইহা বিশ্বাস করে এবং ঈমানদারগণের ঈমান আরও বৃদ্ধি করে। এই বিষয়ে আহলে কিতাব ও ঈমানদারগণের কোন সংশয় নাই। কিন্তু ব্যাধিগ্রস্ত অন্তরের লোক ও কাফিররা প্রশ্ন তোলে, এই উপমা দ্বারা আল্লাহ্ তা’আলা কি বুঝাইতে চাহেন? এইভাবে ‘আল্লাহ্ তা’আলা যাহাকে ইচ্ছা পথভ্রষ্ট রাখেন এবং যাহাকে ইচ্ছা পথ দেখান। তোমার প্রতিপালকের সেনা-সৈন্যের হদিস তিনি ভিন্ন অন্য কাহারও জানা নাই।’

يُضل به كَثيرًا ويهدئ به كَشْيْرًا- وَمَايْضْل به الا الفاسقين আয়াত সম্পর্কে আস্ সুদ্দী তাঁহার তাফসীর গ্রন্থে ইবন মাসউদ ও একদল সাহাবা (রাঃ) হইতে পর্যায়ক্রমে মুরাহ, ইব্‌ন আব্বাস, আবূ সালেহ ও আবূ মালিক বর্ণিত এক হাদীস উদ্ধৃত করেন। উহাতে বলা হয়ঃ আয়াতে ‘বহু লোককে পথভ্রষ্ট রাখেন’ বক্তব্যটি মুনাফিকদের জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে। তেমনি ‘বহু লোককে পথ প্রদর্শন করেন’ বক্তব্যটি দ্বারা ঈমানদারগণকে বুঝানো হইয়াছে। আল্লাহ্ প্রদত্ত উপমাকে মিথ্যা জানার দরুন উহাদের ভ্রান্তি বাড়িয়া যায় এবং উহাদের অন্তরের ব্যাধি পূর্ণত্ব প্রাপ্ত হয়। ফলে উহারা অধিকতর বিভ্রান্ত হয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ্ দেওয়া উপমা বিশ্বাস করায় ঈমানদারগণের ঈমানে সংযোজন ঘটে এবং তাহাদের ঈমান প্রবলতর হয়। ফলে তাহারা আরও পথপ্রাপ্ত হয়। ইহাই আল্লাহ্ তা’আলার ভ্রান্ত করা ও পথ দেখানোর তাৎপর্য। আলোচ্য আয়াতের ‘ফাসিক ব্যতীত কাহাকেও পথভ্রষ্ট রাখেন না’ বক্তব্যটিও মুনাফিকদের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হইয়াছে।

وما يُضل به الا الْفُاسقين আয়াতাংশ প্রসঙ্গে আবুল আলীয়া বলেনঃ ফাসিক বলিতে মুনাফিকদের বুঝানো হইয়াছে। রবী’ ইব্‌ন আনাসও এই অভিমত প্রকাশ করেন। মুজাহিদের বরাত দিয়া ইবন জুরায়জ হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ এখানে ফাসিক অর্থ কাফির। কারণ, এই উপমার তাৎপর্য তাহারা বুঝিয়াও অস্বীকার করিতেছে।

وما يُضل به الأ الْفَاسقين আয়াতাংশ সম্পর্কে কাতাদাহ বলেনঃ আল্লাহ্ পাকের উপমা শুনিয়াও তাহারা মানে না বলিয়া ফাসিক আখ্যা পাইয়াছে। তাহাদের ফাসেকী কার্যের দরুন তাহাদিগকে পথভ্রষ্ট রাখা হইয়াছে।

ইব্‌ন আবূ হাতিম বলেনঃ আমাকে আমার পিতা, তাঁহাকে ইসহাক ইব্‌ন সুলায়মান, তাঁহাকে আবূ সিনান, তাঁহাকে আমর ইব্‌ন মুরাহ, তাঁহাকে মাসআব ইব্‌ন সা’দ ও তাহাকে তাঁহার পিতা সা’দ এই বর্ণনা শুনান যে, يُضل به كتير আয়াতাংশ দ্বারা খারেজী সম্প্রদায়কে বুঝানো হইয়াছে ৷

শু’বা আমর ইব্‌ন মুররাহ হইতে, তিনি মাসআব ইবন সা’দ হইতে ও তিনি সা’দ হইতে বর্ণনা করেন- ألَدِيْنَ ينْقُضوْن عَهدَ الله منْ َعْد ميْفَاقه আয়াতাংশ দ্বারা হরুরীয়াগণকে বুঝানো হইয়াছে।

সা’দ ইব্‌ন আবূ ওয়াক্কাসের সূত্রে বর্ণিত উক্ত হাদীসের সনদ যদিও শুদ্ধ, তথাপি ব্যাখ্যাটিকে শাব্দিক বলা যায় না, উহাকে মর্মগত ব্যাখ্যা বলা যাইতে পারে। কারণ, নাহরাওয়ানে যাহারা হযরত আলী (রাঃ)-এর দল ত্যাগ করিয়া খারেজী হইল, তাহারা উক্ত আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর আবির্ভূত হইয়াছে। সুতরাং এই আয়াতের মাধ্যমে খারেজীদের গুণ ও বৈশিষ্ট্য পাওয়া যাইতে পারে বটে, কিন্তু ইহার শানে নুযূল খারেজীরা নহে। ইমামের আনুগত্য পরিত্যাগ ও শরীয়ত প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব বর্জনের কারণে তাহাদিগকে উক্ত আয়াতের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত করা যাইতে পারে। আর এই কারণেই তাহাদিগকে খারেজী বলা হয়। আভিধানিক অর্থে আনুগত্য হইতে যাহারা খারিজ হয় তাহাদিগকে খারেজী বলে। আরবী পরিভাষায় ‘ফাসিক’ অর্থও আনুগত্য মুক্ত। উপরের খোসার বন্ধন মুক্ত হইয়া যখন শাঁস বাহির হয়, তখন আরবগণ বলেন, فسقت তাই আরবী ভাষায় ইঁদুরকে فويسقة বলা হয়। কারণ, ইহা মাটির আবরণ ভেদ করিয়া বাহিরে আসিয়া মানুষের ক্ষতি করে।

বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আয়েশা (রাঃ) হইতে বর্ণিত হাদীসে আছে, নবী করীম (সাঃ) বলেনঃ

خمس فواسق يقتان فى الحل والحرم – الغراب والحداة والعقرب والفارة والكلب والعقور 

‘পাঁচ শ্রেণীর অনিষ্টকর জীব হারাম শরীফে কিংবা বাহিরে যেখানে পাইবে হত্যা করিবে। উহা হইল কাক, চিল, বিচ্ছু, ইঁদুর ও কালো কুকুর।’

এই হাদীসের আলোকে বুঝা যায়, কাফির, মুনাফিক ও পাপী সব শ্রেণীই ফাসিক পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত। তবে কাফিরের পাপ ও অত্যাচার অধিক প্রকট ও প্রবল। তাই আলোচ্য আয়াতে ফাসিক বলিতে কাফিরগণকেই বুঝানো হইয়াছে। পরবর্তী আয়াতে বর্ণিত গুণাবলী ও উহার ভাষ্য হইতেও তাহাই প্রমাণিত হয়। যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ

الَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللهُ بِهِ أَنْ يُوْصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ هُمُ الْخَسِرُونَ 

‘যাহারা আল্লাহ্ সহিত অঙ্গীকার করার পর উহা ভঙ্গ করে ও আল্লাহ্ পাক যে সম্পর্ক বহাল রাখার নির্দেশ দেন তাহা ছিন্ন করে এবং ভূ-পৃষ্ঠে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে তাহারাই ক্ষতিগ্ৰস্ত।’ উপরে বর্ণিত বিশেষণগুলি কেবল কাফিরদেরই বৈশিষ্ট্য। মু’মিনদের বৈশিষ্ট্য ইহার বিপরীত।

যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ

أَفَمَنْ يَعْلَمُ أَنَّمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَّبِّكَ الْحَقُّ كَمَنْ هُوَ أَعْمَى ط إِنَّمَا يَتَذَكَّرُ أولُوا الأَلْبَابِ – الَّذِينَ يُوفُونَ بِعَهْدِ اللَّهِ وَلَا يَنْقُضُونَ الْمِيْثَاقَ – وَالَّذِينَ يَصِلُونَ ما أمر الله به أنْ يُوصَلَ وَيَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ وَيَخَافُونَ سُوء الحساب وَالَّذِيْنَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ ، أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدار 

‘যে ব্যক্তি তোমার প্রভুর নিকট হইতে তোমার কাছে অবতীর্ণ বাণীকে সত্য বলিয়া জানে, সে কি এই ব্যাপারে অন্ধ ব্যক্তির সমান হইতে পারে? শুধুমাত্র জ্ঞানীগণই উপদেশ গ্রহণ করে। যাহারা আল্লাহ্র সহিত কৃত ওয়াদা রক্ষা করে, অঙ্গীকার ভঙ্গ করে না, আল্লাহ্ নির্দেশিত সম্পর্ক বহাল রাখে এবং তাহাদের প্রতিপালককে ভয় করে ও সন্ত্রস্ত থাকে কঠিন শাস্তির ভয়ে …… পক্ষান্তরে যাহারা আল্লাহকে প্রদত্ত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, আল্লাহর নির্দেশিত সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং ভূ-পৃষ্ঠে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাহারাই অভিশপ্ত আর তাহাদের জন্য রহিয়াছে বড়ই নিকৃষ্ট নিরাস।’

এই আয়াতে কাফিরদের যে অঙ্গীকার ভঙ্গের কথা বলা হইয়াছে তাহা কোন্ অঙ্গীকার উহা লইয়া মতভেদ রহিয়াছে। একদল বলেন- আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার নবীর মাধ্যমে অবতীর্ণ কিতাবে মানুষকে যে সৎ কাজের নির্দেশ ও অসৎ কাজের নিষেধাজ্ঞা প্রদান করিয়াছেন, তাহা অমান্য করাকেই ‘অঙ্গীকার ভঙ্গ করা’ বলা হইয়াছে।

অপর দল বলেন, এখানে অঙ্গীকার ভঙ্গকারী ফাসিক বলিতে আহলে কিতাবের কাফির ও মুনাফিকদের বুঝানো হইয়াছে। কারণ, তাহারা তাওরাত-ইনজীলের বিধান মানিয়া চলার অঙ্গীকার করিয়াছিল। উহাতে মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আবির্ভাবের পর তাঁহাকে ও তাঁহার উপর অবতীর্ণ গ্রন্থকে মানিয়া চলার নির্দেশ রহিয়াছে। কিন্তু তাঁহার আবির্ভাবের পর তাঁহাকে ভালভাবে চিনিতে পারিয়াও মানিয়া নেয় নাই। ইহাকেই বলা হইয়াছে অঙ্গীকার ভঙ্গ করা। ইব্‌ন জারীর এই অভিমত পছন্দ করিয়াছেন। মাকাতিল ইব্‌ন হাইয়ানও এই অভিমত সমর্থন করিয়াছেন।

তৃতীয় দল বলেন- এখানে অঙ্গীকার ভঙ্গকারী ফাসিক বলিতে সকল কাফির, মুশরিক ও মুনাফিকদের বুঝানো হইয়াছে, কোন শ্রেণী বিশেষকে বুঝানো হয় নাই। কারণ, সকল মানুষের নিকট হইতে আল্লাহ্র একক প্রভুত্বকে মানিয়া চলার অঙ্গীকার নেওয়া হইয়াছিল। অথচ উহারা প্রাকৃতিক জগতের অজস্র নিদর্শন ও নবী রাসূলদের প্রদর্শিত অসংখ্য মু’জিযা দেখিয়াও আল্লাহ্ একক প্রভুত্ব মানিয়া নেয় নাই। ইহাই অঙ্গীকার ভঙ্গ করা।

মাকাতিল ইব্‌ন হাইয়ানের একটি বর্ণনা এই মতকে সমর্থন করে। ইমাম রাযীও এই মতের দিকে ঝুঁকিয়াছেন। তিনি বলেন, আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আল্লাহ্ কোন্ জিনিসের অঙ্গীকার নিয়াছেন? তাহার জবাবে বলিব, মানুষের জ্ঞানজগতে আল্লাহর একত্ববাদের যে প্রমাণ নিহিত রহিয়াছে, মানুষ তাহা মানিয়া চলিবে, এই অঙ্গীকারই আল্লাহ্ তা’আলা মানুষের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছেন।

যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ

وأشهدهم على أنه نفسسهم الست بربكم قَالُوَا بُلى ‘তাহারা নিজেদের অনুকূলে নিজেরাই সাক্ষী হইয়াছিল। প্রশ্ন করা হইল— আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নহি? সকলেই জবাব দিল- হ্যাঁ।’

অতঃপর তাহাদিগকে যত কিতাব প্রেরণ করা হইয়াছে, তাহাতেও অঙ্গীকার নেওয়া। হইয়াছে এবং বলা হইয়াছেঃ

أوفوا بعهدى أوف بعهدكم ‘তোমরা আমাকে প্রদত্ত অঙ্গীকার পূরণ কর, তোমাদিগকে প্রদত্ত অঙ্গীকার পূরণ করিব।’

চতুর্থ দল বলেন- আলোচ্য আয়াতে অঙ্গীকার ভঙ্গের ভাষ্য দ্বারা পৃথিবীতে আসার আগে মানুষের রূহসমূহ হইতে যে অঙ্গীকার আল্লাহ্ তা’আলা গ্রহণ করিয়াছিলেন, উহা ভঙ্গের কথা বুঝানো হইয়াছে। বাবা আদমের পৃষ্ঠদেশ হইতে আত্মাসমূহকে বাহির করার সময়ে আল্লাহ্ তাহাদের নিকট হইতে তাঁহার একক প্রভুত্ব মানিয়া লওয়ার অঙ্গীকার নেন। তিনি বলেনঃ

وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِنْ بَنِي آدَمَ مِنْ ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَى أَنْفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوا بَلَى 

‘অনন্তর তোমার প্রভু আদমের পৃষ্ঠদেশে তাহার বংশাবলী থাকা অবস্থায় তাহাদের নিকট হইতে অঙ্গীকার নিয়াছিলেন আর নিজেদের অঙ্গীকারের সাক্ষী তাহারা নিজেরাই ছিল- আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নহি? তাহারা সকলেই জবাব দিল- হ্যাঁ, আমরা সাক্ষ্য দিতেছি (তুমিই আমাদের একমাত্র প্রতিপালক প্রভু)।’

সুতরাং অলোচ্য আয়াতে এই অঙ্গীকার ভঙ্গের কথাই বলা হইয়াছে। মাকাতিল ইব্‌ন হাইয়ান এই মতকেও সমর্থন করিয়াছেন। ইব্‌ন জারীর তাঁহার তাফসীরে উপরে বর্ণিত সকল মতই উদ্ধৃত করিয়াছেন।

الَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِ ويَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ

يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ هُمُ الْخَسِرُونَ 

আয়াত প্রসঙ্গে আবূ জা’ফর রাযী রবী‘ ই আনাস ও আবুল আলীয়ার উদ্ধৃতি দিয়া বর্ণনা করেনঃ আল্লাহর সহিত কৃত ওয়াদা ভঙ্গ করা মুনাফিকদের কাজ আর মুনাফিকীর পরিচয় হইল নিম্নবর্ণিত ছয়টি চরিত্র।

তাহারা বিজিত অবস্থায় থাকিলেঃ এক. কথা বলিলে মিথ্যা বলে। দুই. ওয়াদা করিলে তাহা ভঙ্গ করে। তিন. আমানত রাখিলে খিয়ানত করে।

তাহারা বিজয়ী অবস্থায় থাকিলেঃ চার. আল্লাহকে প্রদত্ত অঙ্গীকার ভঙ্গ করে। পাঁচ. আল্লাহর নির্দেশিত সম্পর্ক ছিন্ন করে। ছয়. ভূ-পৃষ্ঠে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করে।

আল্লামা সুদ্দী তাঁহার তাফসীরে এই সূত্রে الذين ينقضون عهد الله من بعد ميِفاقه আয়াত প্রসঙ্গে বর্ণনা করেনঃ কুরআনের বিধি-নিষেধ পাঠ করা এবং উহাকে সত্য বলিয়া জানার পর উহাকে অস্বীকার ও অমান্য করাই হইতেছে অঙ্গীকার ভঙ্গ করা।

ويقطعون ما أمر الله به أن مُوصل আয়াতাংশের মর্ম হইতেছে রক্ত সম্পর্কের নিকটাত্মীয়দের সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করা, যাহা রক্ষা করার নির্দেশ রহিয়াছে। ইহা কাতাদাহ প্রদত্ত ব্যাখ্যা। এই আয়াতের মর্মের সহিত সামঞ্জস্যশীল অপর আয়াত এইঃ

فهل عسيتم أن تَولَيتم أن تَفُسدِوًَا فى الآرضٍ وتقطعوا أرحامكم  ‘তোমরা যদি ফিরিয়া যাও, তাহা হইলে পৃথিবীতে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করা ও তোমাদের রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করার আশু সম্ভাবনা নয় কি?’

ইবন জারীর এই ব্যাখ্যাকেই প্রাধান্য দিয়াছেন। অবশ্য উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইহাও বলা হয় যে, উহার বক্তব্য বিশেষ ধরনের সম্পর্ক বা অবস্থার সহিত সম্পৃক্ত নহে, বরং উহা সাধারণভাবে প্রযোজ্য। আল্লাহ্ পাক যত কিছুর সহিত সম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দিয়াছেন, উহার সহিত সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া আল্লাহ্ পাকের নির্দেশ অমান্য করাই এই আয়াতের তাৎপর্য।

هم الخاسرون আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় মাকাতিল ইব্‌ন হাইয়ান বলেনঃ তাহারা পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। যেমন কুরআন পাকের অন্যত্র বলা হইয়াছেঃ

أو لمك لَهُمْ اللَّعْنْةُ وَلَّهُمْ سوء الذار ‘তাহাদের জন্য রহিয়াছে অভিসম্পাত ও নিকৃষ্ট নিবাস।’

যিহাকের বর্ণনা, ইব্‌ন আব্বাস বলিয়াছেন- কুরআন পাকে মুসলমান ব্যতীত অন্যান্যদের যেখানেই خاسرون (ক্ষতিগ্রস্ত) বলিয়াছে, সেখানে কাফেরদিগকেই বুঝানো হইয়াছে। আর যেখানে উহা মুসলমানদের জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে, সেখানে পাপী মুসলমানকে বুঝানো হইয়াছে।

أو لمك هم الخسرون আয়াতাংশ প্রসঙ্গে ইব্‌ন জারীর বলেন, خاسر শব্দের বহুবচন خاسرون অর্থ তাহারা নিজেদের ক্ষতিসাধন করিয়াছে। কারণ, তাহারা নশ্বর পৃথিবীর লালসায় নিমজ্জিত ও আল্লাহ্ তা’আলার অনন্তকালীন রহমত হইতে নিজদিগকে বঞ্চিত করিয়াছে। যেমন কেহ ব্যবসায়ে নামিয়া মূলধন নষ্ট করিলে কিংবা উহাতে ঘাটতি সৃষ্টি করিলে বলা হয় যে, সে ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। তেমনি পরকালের পুঁজি আল্লাহর রহমত হইতে কাফির ও মুশরিকরা নিজদিগকে বঞ্চিত করিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। এই ধরনের ক্ষতিগ্রস্তকে আরবী ভাষায় خسر يخسر ‏ لحخسرانا ‏ خسارا শব্দমালায় ভূষিত করা হয়। কবি জারীর ইন আতিয়্যার কবিতায় আছেঃ

ان سليطافى الخسار انه * اولاد قوم خلقوا اقنه

‘কর্কশভাষী সর্বদাই ক্ষতিগ্রস্ত হর ৷ কারণ, মানব জাতির সন্তান-সন্ততিকে দাসরূপেই সৃষ্টি করা হইয়াছে।

পুনর্জীবনের প্রমাণ

(۲۸)

كَیۡفَ تَكۡفُرُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ كُنۡتُمۡ اَمۡوَاتًا فَاَحۡیَاكُمۡ ۚ ثُمَّ یُمِیۡتُكُمۡ ثُمَّ یُحۡیِیۡكُمۡ ثُمَّ اِلَیۡهِ تُرۡجَعُوۡنَ

২৮. তোমরা কিরূপে আল্লাহ্ তা’আলাকে অস্বীকার কর? অথচ তোমরা মৃত ছিলে; তিনিই তোমাদিগকে প্রাণ দান করিয়াছেন। তিনি আবার তোমাদিগকে মৃত করিবেন এবং পুনরায় তোমাদের জীবন দান করিবেন। অবশেষে তোমরা তাঁহার কাছেই প্রত্যাবর্তন করিবে ৷

তাফসীরঃ আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা স্বীয় অস্তিত্ব, মহাপরাক্রম, অসীম ক্ষমতা এবং সৃষ্টিকুলের স্রষ্টা ও নিয়ন্তা হওয়ার যুক্তি-প্রমাণ পেশ করিয়াছেন। তিনি ইরশাদ করেনঃ তোমরা কিরূপে সেই আল্লাহ্র অস্তিত্ব ও অপরিসীম ক্ষমতাকে অস্বীকার করিবে কিংবা তাঁহার অংশীদার বানাইয়া উপাসনা করিবে, যিনি তোমাদিগকে অস্তিত্বহীন অবস্থা হইতে অস্তিত্ববান করিয়াছেন এবং আবার অস্তিত্বহীন করিয়া পুনরায় অস্তিত্ববান করিবেন? কুরআন মজীদের অন্যত্র তিনি বলেনঃ

ام خلقوا من غير شىء أم هم الخالقون آم خَلّقُوا السموت والارض – بل لايوفَنْونْ

‘তাহারা কি কোন বস্তু ছাড়াই সৃষ্টি হইয়াছে, না তাহারা নিজেরাই নিজেদের স্রষ্টা? নভোমণ্ডলী ও পৃথিবী কি তাহারাই সৃষ্টি করিয়াছে? তাহা নহে, বরং তাহারা আস্থা স্থাপন করিতেছে না।’

তিনি অন্যত্র বলেনঃ

هل أتئ على الائسان حين من الذهر لم يَكُنْ شَيْمًا مَذَكُوْوًا নিশ্চয় মানুষের সৃজন পরিক্রমায় এমন একটি দিন থাকে যখন তাহারা উল্লেখযোগ্য কোন বস্তু ছিল না।’ কুরআনে এরূপ আরও বহু আয়াত বিদ্যমান। আব্দুল্লাহ ইব্‌ন মাসউদ (রাঃ) হইতে পর্যায়ক্রমে আবুল আহওয়াস, আবূ ইসহাক ও সুফিয়ান ছাওরী বর্ণনা করেনঃ হাশরের ময়দানে কাফিরদের বক্তব্য-

قَالُوَا رَبّنًا أمتْنًا انْنْتين وأحَيَيْنًا انْنْتَيْن فَاعَتَرفنًا بذتوبِنَا

 (হে আমাদের প্রতিপালক । আমাদিগকে দুইবার মৃত করিয়াছ এবং দুইবার জীবিত করিয়াছ। তাই আমরা আমাদের অপরাধ স্বীকার করিতেছি) এবং আলোচ্য وَكُنْتُمْ أَمُوَافًا فَأَحِيَاكُم م يَمِيْحكُمْ ثم يحييكم আয়াতাংশের বক্তব্যে পূর্ণ সামঞ্জস্য রহিয়াছে। ইব্‌ন জুরায়জ আতা হইতে ও তিনি আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেন যে, তিনি وكثتم أموانًا فأحياكم ّم يميتكم ثم يحييكم আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় বলেন- তোমরা তোমাদের পিতার পৃষ্ঠদেশে মৃতবৎ ছিলে, তখন তোমরা কোন বস্তুই ছিলে না। অতঃপর আল্লাহ্ পাক তোমাদিগকে সৃষ্টি করিলেন। তারপর আবার মৃত করিলেন। পুনরায় পুনরুত্থান দিবসে জীবিত করিবেন। সুতরাং এই আয়াতের বক্তব্যের সহিত أمتنا اننتين وأحبَينًا امْنْمَيْن আয়াতের বক্তব্য মিলিয়া যাইতেছে।

ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ)-এর উদ্ধৃতি দিয়া যিহাক বর্ণনা করেনঃ رَبنا أَمْنا اهْنْتَيِنَ وأ حَيَينًا أنْنْتَيْن আয়াতে মর্ম হইতেছে এই যে, তোমরা সৃষ্টি করার পূর্বে মাটি ছিলে অর্থাৎ মৃত ছিলে। অতঃপর তোমাদিগকে সপ্রাণ সৃষ্টি করা হইল। ইহা তোমাদের প্রথম জীবন। অতঃপর তোমাদের মৃত ’করা হইবে এবং তোমরা কবরে যাইবে। ইহা তোমাদের দ্বিতীয় মৃত্যু। অবশেষে পুনরুত্থান দিবসে তোমাদিগকে পুনরায় জীবিত করা হইবে। ইহা হইল তোমাদের দ্বিতীয় জীবন। আল্লাহ্ তা’আলা আলোচ্য আয়াতে এই দুইবার মৃত্যু ও দুইবার জীবিত হওয়ার কথা উল্লেখ করিয়াছেন।

আল্লামা সুদ্দী ‘আবূ মালিক হইতে, তিনি আবূ সালেহ হইতে, তিনি ইব্‌ন আব্বাস ও মুরাহ হইতে এবং তাহারা ইব্‌ন মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিক সনদে এবং আবুল আলীয়া, আল্ হাসান, মুজাহিদ, কাতাদাহ, আবূ সালেহ, যিহাক ও আতা আল খোরাসানী হইতে তাহাদের স্ব-স্ব সনদে আলোচ্য আয়াতের উপরোক্ত ব্যাখ্যা বর্ণনা করেন । সুদ্দী ও আবূ সালেহের উদ্ধৃতি দিয়া সুফিয়ান ছাওরী আলোচ্য আয়াত প্রসঙ্গে বলেন- কবরে তোমাদিগকে জীবিত করিবেন, আবার মৃত করিবেন৷

ইব্‌ন জারীর ইউনুস হইতে, তিনি ইব্‌ন ওহাব হইতে ও তিনি অব্দুর রহমান ইব্‌ন যায়দ ইব্‌ন আসলাম হইতে ধারাবাহিক সনদে বর্ণনা করেন- আল্লাহ্ তা’আলা মানুষকে প্রথম বাবা আদমের পৃষ্ঠদেশে সৃষ্টি করেন। সেখানে তিনি তাহাদের নিকট হইেেত আনুগত্যের স্বীকৃতি নেন। অতঃপর তাহাদিগকে মৃত করেন। অতঃপর মাতৃগর্ভে তাহাদিগকে সৃষ্টি করেন। অতঃপর তাহাদিগকে মৃত্যু দান করেন। বিচার দিবসে আবার তাহাদিগকে পুনরুজ্জীবিত করিবেন। ইহাই আল-কুরআনের قَالَوا رَبِنًا أمتنا امْنَتين وأحيينا امْنْتين আয়াতে বর্ণিত হইয়াছে। অবশ্য এই হাদীসটি ও পূর্বোক্ত হাদীসটি সনদের বিচারে ‘গরীব’ শ্রেণীভুক্ত। আলোচ্য আয়াত প্রসঙ্গে ইব্‌ন মাসউদ, ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) ও একদল তাবেঈনের যে সব বর্ণনা উদ্ধৃত করা হইয়াছে উহাই সঠিক ও বিশুদ্ধ। তাঁহাদের বর্ণনার সহিত নিম্ন আয়াতের মিল রহিয়াছে। আল্লাহ্ বলেনঃ كل اللهُ يُحِْيْكُمْ ْم يُميْتكُمْ هم َجْمَعُكُمْ إلى يَوْم القيامة لأرَيْبَ فِيْه ‘তুমি বল, আল্লাহ্ই তোমাদিগকে সপ্রাণ করিয়াছেন, অতঃপর তোমাদিগকে নিষ্প্রাণ করিবেন। অতঃপর তোমাদিগকে কিয়ামতের দিন একত্রিত করিবেন- সেই দিনটি সম্পর্কে কোনই সন্দেহ নাই।’

“মুশরিকদের উপাস্য দেব মূর্তিগুলিকেও আল্লাহ্ তা’আলা মৃত বলেনঃ

أموات غَيْرُ أَحياء ج وما يَشْمُرُوْن  উহারা সবাই মৃত, কেহই জীবিত নহে। উহাদের বোধশক্তি বলিতেও কিছু নাই।’

আল্লাহ্ পাক ভূমির জীবন-মৃত্যু সম্পর্কে বলেনঃ

وَأيَةً لَّهُمُ الأَرْضُ الْمَيْتَةُ : أَحْيَيْنَاهَا وَأَخْرَجْنَا مِنْهَا حَبًّا فَمِنْهُ يَأْكُلُونَ

‘আর তাহাদের জন্য মৃত-অনুর্বর ভূমিতেও নিদর্শন রহিয়াছে। উহাকে আমিই জীবিত-উর্বর ভূমি করিয়াছি এবং উহা হইতে বীজ-ফসলাদি উৎপন্ন করিয়াছি। তাহা হইতে সকলে আহার করে।’

মানুষের কল্যাণে আল্লাহর সৃষ্টি

(۲۹)

هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُم مَّا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ فَسَوَّهُنَّ سَبْعَ سَمُوتٍ ، وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

২৯. তিনিই তোমাদের জন্য পৃথিবীর সব কিছু সৃষ্টি করিয়াছেন। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করিলেন এবং উহা সপ্ত আকাশে বিন্যস্ত করিলেন। তিনি সর্ববিষয়ে সবিশেষ অবহিত।

তাফসীরঃ  পূর্ব আয়াতে আল্লাহ্ তা’আলা মানবের সৃষ্টি রহস্য ও তাহাদের ক্রমবিবর্তন ধারা বর্ণনার মাধ্যমে স্বীয় অসীম সৃজন কৌশল ও গোটা সৃষ্টি বিন্যাস ও নিয়ন্ত্রণের অপরিসীম ক্ষমতার প্রমাণ তুলিয়া ধরেন । অতঃপর আলোচ্য আয়াতে ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের সৃষ্টিতত্ত্ব ও উহাতে বিরাজমান বস্তুকুলকে স্বীয় অস্তিত্ব ও অসীম ক্ষমতার দ্বিতীয় প্রমাণ হিসাবে তুলিয়া ধরেন।

আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ্ পাক বলেন, পৃথিবীতে যাহা কিছু আছে সবই তিনি তোমাদের স্বার্থে সৃষ্টি করিয়াছেন । পৃথিবীর সৃষ্টি পূর্ণতায় পৌছাইয়া তিনি নভোমণ্ডলের দিকে মনোনিবেশ করেন এবং সপ্ত আকাশের বিন্যাস ঘটান। استوى অর্থ ইচ্ছা করিলেন বা মনোনিবেশ করিলেন। উহার صله হইল الى এবং فسوهن অর্থ বিভক্ত ও বিন্যস্ত করা। আয়াতাংশের অর্থ দাঁড়াইল, তিনি উহাকে সপ্ত আকাশে বিভক্ত ও বিন্যস্ত করিলেন । এখানে السماء শব্দটি اسم جنس (শ্রেণীবাচক বিশেষ্য)। তাই উহা দ্বারা আকাশমণ্ডলী বা সপ্ত আকাশের কথা বুঝানো হয়। وهو بكل شىء عليم বলিয়া তিনি জানাইয়া দিলেন, তাঁহার জ্ঞান সৃষ্টি জগতের প্রতিটি বস্তুকে বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে এবং আসমান যমীন সকল কিছু সম্পর্কেই তিনি পুরাপুরি অবহিত রহিয়াছেন। তিনি কুরআন পাকের অন্যত্র বলেনঃ ألا يَعَلَم مَنْ خَلَّقَ অর্থাৎ যিনি সৃষ্টিকর্তা তিনি কি অনবহিত ও বেখবর থাকেন?

সূরা ‘হা-মীম’ এ আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যা রহিয়াছে। যেমনঃ

قُلْ أَئِنَّكُمْ لَتَكْفُرُونَ بِالَّذِي خَلَقَ الْأَرْضَ فِي يَوْمَيْنِ وَتَجْعَلُوْنَ لَهُ أَنْدَادًا طَ ذلِكَ رَبُّ الْعَالَمِينَ – وَجَعَلَ فِيهَا رَوَاسِي مِنْ فَوْقِهَا وَبَارَكَ فِيهَا وَقَدْرَ فِيهَا

أقْوَاتَهَا فِي أَرْبَعَةِ أَيَّامٍ ، سَوَاءٌ لِلسَّائِلِينَ – ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ وَهيَ دُخَانُ فَقَالَ لَهَا وَلِلْأرْض انتيا طَوْعًا أَوْكَرْهًا قَالَتَا أَتَيْنَا طَائِعِينَ – فَقَضَاهُنَّ سَبْعَ سَمَاوَاتِ في يَوْمَيْنِ وَأَوْحَى فِي كُلِّ سَمَاء أَمْرَهَا وَزَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِمَصَابِيحَ وَحِفْظًا طَ ذَالِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيم –

‘তুমি বল, তোমরা কি সেই মহান সত্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করিতেছ কিংবা তাঁহার অংশীদার দাঁড় করাইতেছ যিনি দুই দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করিয়াছেন? তিনিই তো নিখিল সৃষ্টির প্রতিপালক । তিনি পাহাড় গাড়িয়া ভূপৃষ্ঠ স্থিতিশীল করিয়াছেন এবং পৃথিবীকে নানাবিধ দানে ধন্য করিয়াছেন। অতঃপর চারিদিনে উহা বিন্যস্ত করিয়া উর্বরা শক্তি দিয়াছেন। জিজ্ঞাসুদের জন্য উহাতে সন্তোষজনক সমাধান রহিয়াছে। অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করিলেন। তখন আকাশ ছিল বাষ্পাকার। তিনি আকাশ ও পৃথিবীকে বলিলেন- ইচ্ছায় কি অনিচ্ছায় আমার পরিকল্পিত রূপ পরিগ্রহ কর। তাহারা বলিল- আমরা স্বেচ্ছায় বাস্তব রূপ গ্রহণ করিতেছি। এইভাবে দুই দিনে অকাশকে সপ্ত খণ্ডে বিভক্ত ও বিন্যস্ত করা হইল এবং প্রত্যেক আকাশের কাজ নির্ধারণ করিয়া দেওয়া হইল। পৃথিবীর নিকটবর্তী আকাশকে নক্ষত্ররাজি দ্বারা সুসজ্জিত করা হইল এবং শয়তানের অনাচার প্রতিরোধের জন্য প্রহরার ব্যবস্থা হইল। এই হইল সেই মহাপরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ সত্তার সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা।’

এই আয়াতে বুঝা যায় যে, আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার সৃষ্টি পরিকল্পনার সূচনা করিয়াছেন পৃথিবী সৃষ্টি দ্বারা । অতঃপর সপ্ত আকাশ সৃষ্টির পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করিয়াছেন। যে কোন স্থাপত্য শিল্পের নিয়মই হইল এই যে, সর্বপ্রথম সৌধের নিম্নভাগের ভিত্তি স্থাপন করা। অতঃপর সৌধের উপরিভাগের কাজে হাত দেওয়া। আল্লাহর এই সৃষ্টি পরিকল্পনাও অনুরূপভাবে বাস্তবায়িত হইয়াছে। ব্যাখ্যাকারগণ এই আয়াতের তদ্রূপ ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছেন । এই ব্যাপারে যথাস্থানে সবিস্তারে আলোচনা করার ইচ্ছা রহিল ৷ এই প্রসঙ্গে আল্লাহ্ পাক অন্য বলেনঃ

وَأَنْتُمْ أَشَدُّ خَلْقًا أم السَّمَاءُ ، بَنَاهَا – رَفَعَ سَمْكَهَا فَسَوْهَا وَأَغْطَشَ لَيْلَهَا – وَأَخْرَجَ ضُحَاهَا . وَالْأَرْضَ بَعْدَ ذَالِكَ دَحَاهَا – أَخْرَجَ مِنْهَا مَاءَهَا وَمَرْعَها . وَالْجِبَالَ أَرْسَاهَا – مَتَاعًا لَّكُمْ وَلأَنْعَامِكُمْ .

“তোমাদিগকে সৃষ্টি করা কঠিন, না আকাশ বানানো কঠিন? আল্লাহ্ পাক উহার ব্যাপ্তিকে সুউচ্চ করিয়া উহাকে সুবিন্যস্ত করিয়াছেন। উহা হইতে দিবা-রাত্রি সৃষ্টি করিয়াছেন। অতঃপর পৃথিবীকে বিন্যস্ত করিয়াছেন এবং উহা হইতে পানির প্রস্রবণ ও গাছ-পালার উদ্ভব ঘটাইয়াছেন ৷ বিভিন্ন স্থানে পাহাড়-পর্বত স্থাপন করিয়াছেন। ইহা সবই তোমাদের ও তোমাদের পশুকুলের প্রয়োজনের বস্তু।’

এই আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার সৃজন কার্যের সূচনা আকাশ দ্বারা করিয়াছেন । বাহ্যত এই আয়াত ও আলোচ্য আয়াতের বক্তব্য বিপরীতমুখী দেখা যায়। মূলত দুই আয়াতে কোন বৈপরীত্য নাই ৷ কারণ, আমাদের আলোচ্য আয়াতের ثُمَّ সংযোজন শব্দটি خبر (সংবাদমূলক বক্তব্য)-এর সহিত সংশ্লিষ্ট, فعل (ক্রিয়া)-এর সহিত নহে। অর্থাৎ عطف হইয়াছে خبر -এর সহিত, فعل-এর সহিত নহে। সুতরাং এখানে ثم খবর পরিবেশনের সংযোগ রক্ষা করিতেছে, পূর্বাপর নির্ধারক হিসাবে কাজ করে নাই ! আরবীতে শব্দের নিছক সংযোগ কাজে ব্যবহৃত হওয়ার প্রচলন রহিয়াছে। যেমন কবি বলেনঃ

قل لمن ساد ثم ساد ابوه * ثم قد ساد قبل ذالك جده 

(যে লোক নেতা হইয়াছে, তাহার পিতাও নেতা ছিল, আর ইহার পূর্বে তাহার পিতামহও নেতা ছিল, তাহাকেই বল। )

উক্ত চরণে ثم শব্দটি পূর্বাপর না বুঝাইয়া নিছক সংযোগ রক্ষা করিয়াছে ও পুরুষানুক্রমিক নেতৃত্বের খবর পরিবেশনের কাজ দিয়াছে ৷

একদল ব্যাখ্যাকার আয়াতদ্বয়ের আপাত বৈসাদৃশ্য দূরীকরণার্থে -বলেন, এই আয়াতে পৃথিবীর সম্প্রসারণ ও বিন্যাস কার্যের বিবরণ দেওয়া হইয়াছে। উহা সৃষ্টির কথা বলা হয় নাই । সুতরাং আমাদের আলোচ্য আয়াতে প্রথমে পৃথিবী সৃষ্টি করিয়া পরে আকাশ সৃষ্টি এবং এই আয়াতে উহার পর পৃথিবীকে পরিপূর্ণরূপে বিন্যস্ত করা বুঝা যাইতেছে। ফলে কোন বৈপরীত্য ঘটিতেছে না।

কেহ কেহ বলেন, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করার পরপরই উহার সংস্থাপন কার্য করা হয়। এই অভিমতটি হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে আলী ইব্‌ন আবূ তালহা বর্ণনা করেন।

আস্ সুদ্দী স্বীয় তাফসীরে ইব্‌ন মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবা (রা) হইতে পর্যায়ক্রমে মুরাহ, ইব্‌ন আব্বাস, আবূ সালেহ ও আবূ মালিক হইতে বর্ণনা করেন- সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ্ তা’আলার আরশ পানির উপর সংস্থাপিত ছিল। পানির পূর্বে আল্লাহ্ পাক কোন বস্তুই সৃষ্টি করেন নাই । সুতরাং সৃজন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সর্বপ্রথম তিনি পানি হইতে বাষ্প সৃষ্টি করিলেন। উহা ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বলোকে উত্থিত হইল এবং উত্থিত বাষ্প ছাদরূপ পরিগ্রহ করিয়া আকাশে পরিণত হইল। এইজন্য উহার নাম হইল سماء (ঊর্ধ্বলোক)। অতঃপর পানি শুকাইয়া একটি ভূখণ্ড দেখা দিল। তখন উহাকে সপ্তখণ্ডে বিভক্ত করা হইল ৷ রবি-সোম দুই দিনে এই সপ্তখণ্ড সৃষ্টি হইল। অতঃপর পৃথিবীকে সেই মৎসের উপর স্থাপন করা হইল যাহার বর্ণনা সূরা ‘নূন ওয়াল কলম’-এ আসিয়াছে। মৎসটি পানির উপর এবং পানির নীচে সকাত জাতীয় পদার্থ বা পরিচ্ছন্ন মৃত্তিকা শিলা বিদ্যমান। মৃত্তিকা শিলার ধারক হইলেন ফেরেশতা। ফেরেশতা দণ্ডায়মান প্রস্তরের আস্তরের উপর এবং প্রস্তরের আস্তরটি বায়ুমণ্ডলের উপর ভাসমান রহিয়াছে ৷ লুকমান হাকীম এই প্রস্তর আস্তরের কথাই বলিয়াছেন । উহা আকাশ কিংবা পৃথিবীর কোথাও স্থাপিত নহে । মৎসটি নড়াচড়া করা মাত্র পৃথিবী কম্পিত হয় এবং ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়। তাই পৃথিবীকে পাহাড় চাপা দেওয়া হইল। ফলে পৃথিবী সুস্থির হইল। পর্বত তাই পৃথিবীর কাছে নিজের বড়াই করিয়া থাকে।

আল্লাহ্ পাক বলেনঃ وجَعلَنًا فى الآرض رواسى أن تميد بهم ‘আর পৃথিবীকে স্থিরভাবে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য পর্বতমালা স্থাপন করিয়াছি।’

পাহাড়-পর্বত, ফল-মূল, প্রাণীকুল, গাছপালা ইত্যাদি যাহা কিছু পৃথিবীর জন্য প্রয়োজন ছিল, সব কিছু তিনি মঙ্গল-বুধ এই দুই দিনে সৃষ্টি করিয়াছেন। এই কথাই আল্লাহ্ তা’আলা হা-মীম সূরা হইতে ইতিপূর্বে উদ্ধৃত-

قل أَمْنكُم لتكفرون بالذى خلق الآأرض فى يَومَين وتَجِعَلُوَن له أَنْدَادًا

 ذلك رب العالمين – وجعل فيها رواسى من قوقها وبارك فيهًا

আয়াতে প্রকাশ করিয়াছেন। অতঃপর وقدر فلها أَقُوَاحَهًَا আয়াতাংশে গাছপালা-তরুলতা ও উহার উপরিভাগস্থ বস্তুসমূহ সৃষ্টির কথা বলিয়াছেন। এই সব সৃষ্টি করিতে যে মোট চারদিন লাগিয়াছে তাহা তিনি ব্যক্ত করিলেন فى أربّعة أيام سواء لَلسَائْلينَ আয়াতাংশের মাধ্যমে। আলোচ্য ثُمَّ اسْتّوى الى السَّماء وهئ دخان আয়াতাংশের ধোঁয়া বা বাষ্প হইল পানির নিঃশ্বাস। উহা দ্বারা প্রথমে এক আকাশ ও পরে উহা হইতে সপ্ত আকাশ সৃষ্টি হইয়াছে । এই কাজ বৃহস্পতি-শুক্র দুই দিনে সম্পন্ন হইয়াছে। যেহেতু আকাশ ও পৃথিবীর সমগ্র সৃষ্ট বস্তুকে আল্লাহ্ তা’আলা শুক্রবারে একত্রিত করিয়াছেন, তাই উহার নাম ইয়াওমুল জুমুআ হইয়াছে ।

وأوحى فى كل سماء أَمْرها আয়াতাংশের মর্ম এই যে, আল্লাহ্ পাক প্ৰত্যেক আকাশে ফেরেশতা, নদ-নদী, বরফের পাহাড় ও নানাবিধ অজানা বস্তু সৃষ্টি করিয়াছেন । অতঃপর তিনি পৃথিবীর নিকটতর আকাশকে নক্ষত্ররাজি দ্বারা সুসজ্জিত করিয়া এক দিকে আকাশ ও পৃথিবীর শোভা বর্ধন ও অন্যদিকে শয়তানের অনাচার হইতে ঊর্ধ্বলোককে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করিয়াছেন। আল্লাহ্ তাঁহার পরিকল্পিত বস্তুসমূহ সৃষ্টি শেষে স্বীয় আরশের দিকে মনোনিবেশ করিলেন। যেমন তিনি বলেনঃ

خَلَقَ السّموؤت وَالْأَرْضُ فى سثة أَيامٍ ثم استوى عَلَى الْعَرْش “আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি কাজ ছয় দিনে সম্পন্ন করিয়া তিনি আরশের উপর মনোনিবেশ করিলেন। ”

তিনি আরও বলেনঃ   كل نتا وتقا ففتقنا هها وجعلن من الماء كلثىء هى “আকাশ ও পৃথিবী

উভয়ই বাষ্প ছিল । অতঃপর আমি উভয়কে পৃথকভাবে বিন্যস্ত করিয়াছি । অনন্তর আমি প্রত্যেক বস্তুকে পানি দ্বারা সপ্রাণ করিয়াছি।”

ইবন জারীর বলেন- আমাকে মুছান্না, তাঁহাকে আব্দুল্লাহ ইব্‌ন সালেহ, তাঁহাকে আবূ মা’শার, সাঈদ ইব্‌ন আবূ সাঈদ হইতে, তিনি আবদুল্লাহ ইব্‌ন সালাম হইতে এই বর্ণনা শুনান : আল্লাহ্ তা’আলা রবিবার সৃষ্টি কাজ আরম্ভ করেন এবং রবি-সোম দুইদিনে পৃথিবীর সপ্তখণ্ড সৃষ্টি করেন। পর্বতরাজি ও জীবিকার শক্তি ও উপকরণ সৃষ্টি করেন মঙ্গল-বুধ দুই দিনে। বৃহস্পতি ও শুক্রবারে সপ্ত আকাশ সৃষ্টি করেন। শুক্রবার দিন শেষভাগে তিনি অবসর হইলেন। তখনই কালবিলম্ব না করিয়া আদমকে সৃষ্টি করিলেন। সৃষ্টির এই শেষ সময়টিতেই সৃষ্টি ধ্বংসের কিয়ামত সংঘটিত হইবে

هو الّذئ خَلَّقَ ما فى الأرض جميعا আয়াত প্রসঙ্গে মুজাহিদ বলেনঃ আকাশ সৃষ্টির আগে আল্লাহ্ তা’আলা পৃথিবী সৃষ্টি করেন। পৃথিবী সৃষ্টির পর উহা হইতে ধোঁয়া উত্থিত হয়।

তাই আল্লাহ্ বলেনঃ

ثُمَّ استوى الى السماء وهى دخان فسواهن سيع سموت মুজাহিদ বলেনঃ সপ্ত আকাশ একটির উপর অপরটি এবং সপ্ত পৃথিবী একটির নিচে অপরটির অবস্থান ৷ এই আয়াত প্রমাণ করে, আকাশের পূর্বে পৃথিবী সৃষ্টি হইয়াছে। সূরা সাজদার আয়াতেও তাহাই বলা হইয়াছে । যেমনঃ

قُلْ أَئِنَّكُمْ لَتَكْفُرُونَ بِالَّذِي خَلَقَ الأَرْضِ فِي يَوْمَيْنِ وَتَجْعَلُوْنَ لَهُ أَنْدَادًا ط

ذلك رَبُّ الْعَالَمِينَ – وَجَعَلَ فِيهَا رَوَاسىَ مِنْ فَوْقِهَا وَبَارَكَ فِيهَا وَقَدْرَ فِيهَا أَقْوَاتَهَا فِي أَرْبَعَةِ أَيَّامٍ سَوَاءٌ لِلسَّائِلِينَ – ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاءِ وَهِيَ دُخَانُ فَقَالَ لَهَا وَلِلْأَرْضِ انْتِيَا طَوْعًا أَوْ كَرْهًا قَالَتَا أَتَيْنَا طَائِعِيْنَ – فَقَضَاهُنَّ سَبْعَ سموت فِي يَوْمَيْنِ وَأَوْحَى فِي كُلِّ سَمَاء أَمْرَهَاء وَزَيَّنَّا السَّمَاءُ الدُّنْيَا بمصابيح ، وَحِفْظا ، ذالك تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيم

উপরোক্ত আয়াতসমূহ প্রমাণ করে, পৃথিবী নভোমণ্ডলীর আগে সৃষ্টি করা হইয়াছে । আলিমদের ভিতর এই ব্যাপারে কোন মতভেদ নাই। কেবলমাত্র ইব্‌ন জারীর কাতাদাহ একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করিয়াছেন, যাহাতে বলা হইয়াছে যে, পৃথিবীর আগে নভোমণ্ডলী সৃষ্টি করা হইয়াছে। কুরতুবী তাঁহার তাফসীরে এই ব্যাপারে মন্তব্য করা হইতে বিরত রহিয়াছেন । কারণ অন্য আয়াতে বলা হইয়াছেঃ

أَأَنْتُمْ أَشَدُّ خَلْقًا أمِ السَّمَاء بَنَاهَا – وَرَفَعَ سَمْكَهَا فَسَوَّاهَا وَأَغْطَشَ لَيْلَهَا – وأَخْرَجَ ضُحَاهَا – وَالأَرْضَ بَعْدَ ذَالِكَ دَحَاهَا – أَخْرَجَ مِنْهَا مَاءَهَا وَمَرْعُهَا – وَالْجِبَالَ أَرْساها –

তাই তাহারা বলেন, এখানে সুস্পষ্টত বলা হইয়াছে, আকাশের পরে পৃথিবীর বিন্যাস সাধন করা হইয়াছে। বুখারী শরীফে বর্ণিত আছে, ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ)-এর কাছে হুবহু এই প্রশ্ন তোলা হইলে তিনি বলেন- আকাশের আগে পৃথিবী সৃষ্টি করা হইয়াছে। অবশ্য পৃথিবীর বিন্যাস সাধন করা হইয়াছে আকাশ সৃষ্টির পরে। পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কালের বহু আলিম এই প্রশ্নের অনুরূপ জবাবই প্রদান করিয়াছেন। আমিও সূরা নাযিআর ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ইহা লিপিবদ্ধ করিয়াছি। বিন্যাসের কথাটি আল্লাহ্ তা’আলার বক্তব্যে সবিস্তারে বলা হইয়াছে। যেমনঃ

وَالأَرْضَ بَعْدَ ذَالِكَ دَحَاهَا – أَخْرَجَ مِنْهَا مَاءَهَا وَمَرْعُهَا – وَالْجِبَالَ أَرْسَاهَا

এখানে বিন্যাসের ব্যাখ্যায় বলা হইয়াছে, পৃথিবীর আভ্যন্তরীণ উর্বরা শক্তিকে সক্রিয় করিয়া জীবন ও জীবিকা সৃষ্টির ব্যবস্থা করা হইয়াছে। প্রথমে পৃথিবীর সৃষ্টিসমূহকে পূর্ণতা দান করা হইয়াছে। অতঃপর পৃথিবীর বুকে পানির প্রস্রবণ ঘটাইয়া উর্বরা শক্তিকে চাঙ্গা করা হইয়াছে এবং জীবিকার জন্য বিবিধ প্রকারের রঙ-বেরঙের গাছ-পালা, ফল-ফসল সৃষ্টি করা হইয়াছে । তেমনি আবার আসমানের বিন্যাস সাধন করা হইয়াছে । উহাকে নক্ষত্র ও গ্রহ-উপগ্রহ দ্বারা সুসজ্জিত করা হইয়াছে। এই ব্যাপারে আল্লাহ্ই সর্বাধিক জ্ঞাত। ইব্‌ন আবূ হাতিম ও ইব্‌ন মারদুবিয়্যা স্ব স্ব তাফসীরে এই সব আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মুসলিম শরীফ ও নাসাঈ শরীফে বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন। ইব্‌ন জুরায়জের সনদে উহা বর্ণিত হইয়াছে।

তিনি বলেন- আমাকে ইসমাঈল ইব্‌ন উমাইয়া, আইউব ইব্‌ন খালিদ হইতে, তিনি উম্মে সালামার গোলাম আব্দুল্লাহ্ ইব্‌ন রাফে’ হইতে ও তিনি আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ

“রাসূল (সাঃ) আমার হস্ত ধারণ করিয়া বলিলেন- আল্লাহ্ তা’আলা শনিবার মাটি সৃষ্টি করিলেন, রবিবারে পাহাড় সৃষ্টি করিলেন, সোমবারে গাছ-পালা সৃষ্টি করিলেন, মঙ্গলবারে অপ্রিয় বস্তু সৃষ্টি করিলেন, বুধবারে আলো সৃষ্টি করিলেন, বৃহস্পতিবারে প্রাণীকুল সৃষ্টি করিলেন এবং আদমকে শুক্রবার আসরের পর সৃষ্টি করিলেন। উহা ছিল শুক্রবার দিবসের শেষ প্রহর অর্থাৎ আসর ও মাগরিবের মধ্যবর্তী সময়।’

সহীহ মুসলিমের শর্তে হাদীসটি ‘গরীব’ শ্রেণীভুক্ত। আলী ইবনুল মাদীনী হাদীসটির নির্ভরযোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলিয়াছেন। ইমাম বুখারী ও কতিপয় হাদীস সংরক্ষকও একই অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন। তাহারা উহাকে কা’বের বক্তব্য বলিয়া স্থির করিয়াছেন। আবূ হুরায়রা (রাঃ) কা’ব আল-আহবার হইতে উহা শুনিয়াছেন। কোন কোন বর্ণনার সহিত ইহার কিছু কিছু সাদৃশ্য থাকার কারণে হাদীসটিকে ‘মারফূ’ করিয়া ফেলিয়াছেন । ইমাম বায়হাকী এই অভিমত লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন।

মানুষের কল্যাণে আল্লাহর সৃষ্টি

(٣٠)

وَ اِذۡ قَالَ رَبُّكَ لِلۡمَلٰٓئِكَۃِ اِنِّیۡ جَاعِلٌ فِی الۡاَرۡضِ خَلِیۡفَۃً ؕ قَالُوۡۤا اَتَجۡعَلُ فِیۡهَا مَنۡ یُّفۡسِدُ فِیۡهَا وَ یَسۡفِكُ الدِّمَآءَ ۚ وَ نَحۡنُ نُسَبِّحُ بِحَمۡدِكَ وَ نُقَدِّسُ لَكَ ؕ قَالَ اِنِّیۡۤ اَعۡلَمُ مَا لَا تَعۡلَمُوۡنَ

৩০. অনন্তর তোমার প্রভু ফেরেশতাদের সমাবেশে যখন বলিলেন, নিশ্চয় আমি পৃথিবীতে খলীফা সৃষ্টি করিতে যাইতেছি, তাহারা বলিল, আপনি কি তাহাদিগকে সৃষ্টি করিবেন যাহারা সেখানে ফিতনা-ফাসাদ করিবে ও রক্তপাত ঘটাইবে? অথচ আমরাই তো আপনার গুণগান ও পবিত্রতা বর্ণনা করিতেছি। তিনি (তোমার প্রভু) বলিলেন, নিশ্চয় আমি তাহাও জানি যাহা তোমরা জান না।

তাফসীরঃ আল্লাহ্ তা’আলা বনী আদমের উপর অজস্র অনুগ্রহ প্রদর্শন করিয়াছেন। এখানে তিনি তাঁহার প্রিয়তম রাসূলের নিকট অন্যতম অনুগ্রহের সংবাদ পরিবেশন করিতেছেন। তাহা হইল আদ; সৃষ্টির প্রাক্কালে তিনি তাঁহার সর্বোচ্চ পরিষদের বিষয়টি যথারীতি উত্থাপন ও পর্যালোচনা করিয়া প্রসঙ্গটিকে সর্বাধিক গুরুত্ব ও মর্যাদা প্রদান করিয়াছেন।

وَاذْ قَالَ رَبك للْمُلئكّة অর্থাৎ হে মুহাম্মদ! তুমি সেই দিনের কথা স্মরণ কর, যেদিন মানব সৃষ্টি প্রসঙ্গটি আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতাদের সামনে উত্থাপন করিলেন এবং তাহা লইয়া ফেরেশতাদের সহিত তাঁহার বাদানুবাদ হইল। অতঃপর তুমি তোমার জাতির কাছে এইসব ঘটনা বর্ণনা কর।

ইন জারীর বলেন- আরবী ভাষাবিদ আবূ উবায়দা মনে করেন, উক্ত বাক্যে أن শব্দটি অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয়। আসল বাক্যটি হইবে وقأل رَبك

অতঃপর ইন জারীর আবূ উবায়দার উক্ত বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেন। ইমাম কুরতুবী বলেন, সকল তাফসীরকারই আবূ উবায়দার বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। আয্ যুজাজ বলেন, ইহা আবূ উবায়দার চরম দুঃসাহস ও ধৃষ্টতা। انَّىّ جاعل فى الْأَرْض خَليْفَةٌ অর্থাৎ তাহারা যুগ যুগ ধরিয়া বংশ ও গোত্র পরম্পরায় একে অপরের স্থলাভিষিক্ত হইয়া চলিবে।

যেমন আল্লাহ্ পাক অন্যত্র বলেনঃ

هو الّذى جَعَلَكُم خلائف الأرض ‘তিনিই তোমাদিকে (পালানুক্রমে) পৃথিবীর উত্তরাধিকারী বানাইবেন।’ তিনি অন্যত্র বলেনঃ

وَيَجْعَلُكُمْ خُلَفَاء الآرض “অনন্তর তিনি তোমাদিগকে পৃথিবীর খলীফা বানাইবেন।

তিনি অন্যত্র বলেনঃ

ولو نشاء لَجَعلْنًَا منْكُم مَلأنْكَةَ فى الآرض يَخَْلْفُوْنَ ‏ “যদি আমি ইচ্ছা করিতাম, অবশ্যই তোমাদের স্থলে ফেরেশতা সৃষ্টি করিতাম যেন তাহারা পৃথিবীতে খিলাফত করে।”

তিনি আরও বলেনঃ

فَخْلّفْ من بَعْدهِمْ خَلْفَ ‘তাহাদের পরে অন্যদল খিলাফত করিল।”খলীফা’ শব্দটিকে ‘খুলাইফা’ পড়ার ব্যাপারটি খুবই বিরল । আল্লামা যামাখশারী প্রমুখ উহার উল্লেখ করিয়াছেন । যায়দ ইব্‌ন আলী হইতে ইমাম কুরতুরী অনুরূপ পাঠের একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করিয়াছেন।

‘খলীফা’ পরিভাষাটি শুধুমাত্র হযরত আদম (আঃ)-এর জন্য নির্দিষ্ট নহে। অবশ্য তাফসীরকারদের একদল এই অভিমত পোষণ করেন। ইমাম কুরতুবী ইব্‌ন আব্বাস ও ইব্‌ন মাসউদ (রাঃ) সহ সকল ব্যাখ্যাকারদের বরাত দিয়া অনুরূপ অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন বটে, কিন্তু উহা বিতর্কিত মত। অধিকাংশের মতে পরিভাষাটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে । ইমাম রাযী তাঁহার তাফসীরে এই মত ব্যক্ত করিয়াছেন। অন্যান্য-তাফসীরকারও এই মত সমর্থন করিয়াছেন।

প্রকাশ্যত বুঝা যায়, ‘খলীফা’ বলিতে শুধুমাত্র আদম (আঃ)-কে বুঝানো হয় নাই ; বরং আদম জাতিকে বুঝানো হইয়াছে। কারণ, ফেরেশতারা ফিতনা-ফাসাদ ও রক্তারক্তির কথা বলিয়া বনী আদমের কথাই বুঝাইয়াছেন, হযরত আদম (আঃ)-এর কথা বুঝান নাই ।

এখন প্রশ্ন জাগে, তাঁহারা উহা বুঝিলেন কি করিয়া? জবাবে বলা যায়, হয় তাহারা বিশেষ জ্ঞানের সাহায্যে বুঝিতে পারিয়াছেন, অন্যথায় মানব প্রকৃতির সহজাত প্রবৃত্তির আলোকে তাহারা উহা বুঝিয়া লইয়াছেন। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা মানব সৃষ্টির উপাদান হিসাবে বিশেষ পদ্ধতিতে প্রস্তুত মাটির কথা উল্লেখ করিয়াছেন। সুতরাং অনুরূপ মাটির সৃষ্ট মানুষের স্বভাব যাহা হইতে পারে তাহাই ফেরেশতারা ব্যক্ত করিয়াছেন । কিংবা যেহেতু মানুষকে খলীফা বলা হইয়াছে । খলীফার কাজ হইল ঝগড়া-বিবাদের মীমাংসা করা এবং রক্তারক্তি ও অন্যায়-অনাচার রোধ করা। সুতরাং ফেরেশতারা বুঝিতে পারিয়াছেন যে, আদম সন্তানদের ভিতর সেই সব কার্য সংঘটিত হইবে।

ইমাম কুরতুবী বলেন, ইহাও হইতে পরে যে, তাহরা ইহার পূর্বেকার জাতির উপর কিয়াস করিয়া উহা উপলব্ধি করিয়াছেন। আমি একটু পরেই এতদসম্পর্কিত তাফসীরকারদের বিভিন্ন মত সবিস্তারে আলোচনা করিব।

এই প্রসঙ্গে ফেরেশতারা যাহা কিছু বলিয়াছেন, তাহা প্রতিবাদের জন্য নহে; বনী আদমের প্রতি ঈর্ষার কারণেও নহে । কোন কোন তাফসীরকার সেরূপ ধারণার শিকার হইয়াছেন ৷ কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদিগকে সৃষ্টিই করিয়াছেন এরূপ স্বভাবের করিয়া যে, আল্লাহ্ তা’আলার অনুমতি ছাড়া তাহারা কখনও তাঁহার সামনে মুখ খোলেন না। এখানেও যখন তাহাদিগকে জানানো হইল নতুন সৃষ্টির কথা, তখন সে ব্যাপারে তাহাদের স্বভাবতই সব কিছু জানার কৌতুহল জাগিয়াছিল।

কাতাদাহ বলেন, তাহারা যে বনী আদমের ঝগড়া-ফাসাদ ও রক্তারক্তির আগাম কথা উত্থাপন করিলেন, তাহা উক্ত সৃষ্টির তত্ত্ব ও রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য করিয়াছেন। তাহারা যেন বলিতে চাহিয়াছেন, হে আমাদের প্রতিপালক প্রভু! তাহাদিগকে সৃষ্টির করার পেছনে আপনার কোন্ উদ্দেশ্য রহিয়াছে যে, আপনি তাহাদের ফাসাদ ও রক্তারক্তি সম্পর্কে জানা সত্ত্বেও তাহাদিগকে সৃষ্টি করিবেন? যদি আপনার উদ্দেশ্য হয় ইবাদত, তাহা হইলে কি আমাদের ইবাদতে কোন ত্রুটি পরিলক্ষিত হইয়াছে?

তাই ফেরেশতাদের أَتَجَعل فيهًا من يُفُسد فيّْهًَا وَيُسفك الدّمَاء প্রশ্নের জবাবে আল্লাহ্ পাক জানাইলেন, ابَى أعلّم ما لأتَعلمون অর্থাৎ তোমরা যে সব খারাপ দিক উল্লেখ করিয়াছ, উহা ছাড়া অনেক ভাল দিক রহিয়াছে যাহা শুধু আমিই জানি, তোমরা জান না । আমি অনতিকাল পরেই তাহাদের ভিতর নবী সৃষ্টি করিব, তাহাদের মধ্য হইতে রাসূল মনোনীত করিব, তাহাদের মধ্যে সিদ্দীক, শহীদ, নেককার, আবিদ, যাহিদ, আওলিয়া, আবরার, মুকাররাব, আলিম, আল্লাহ্ভীরু, আল্লাহ্ প্রেমিক প্রভৃতি সৃষ্টি হইবে।

সহীহ হাদীসে রহিয়াছে যে, যখন ফেরেশতারা বান্দার আমল লইয়া ঊর্ধ্বজগতে আল্লাহ পাকের দরবারে পৌঁছেন, তখন আল্লাহ পাক সব কিছু জানা সত্ত্বেও প্রশ্ন করেন- আমার বান্দাদিগকে কোন্ অবস্থায় রাখিয়া আসিয়াছ? তাহারা সমস্বরে জবাবে বলেন- আমরা গিয়া তাহাদিগকে নামাযে পাইয়াছি এবং আসার সময় নামাযে রাখিয়া আসিয়াছি । ইহার কারণ এই যে, তাহারা একদল ফজরে আসে এবং আসরে চলিয়া যায় এবং অন্যদল আসরে আসে এবং ফজরে চলিয়া যায়। যেমন রাসূল (সাঃ) বলেনঃ

يرفع اليه عمل الليل قبل النهار وعمل النهار قبل الليل

অর্থাৎ আল্লাহ পাকের দরবারে রাতের আমল দিনের আগইে এবং দিনের আমল রাতের আগেই পৌছিয়া থাকে৷

আল্লাহ পাকের জবাব— ابّى أعلّم ما لأتَعلّمُوْن -এর ইহাই যথাযথ তাফসীর । একদল বলেন, উহার তাফসীর এই যে, আদম জাতিকে সৃষ্টি করার পিছনে আমার ব্যাপক উদ্দেশ্য ও হিকমত রহিয়াছে। তোমরা যাহা বলিয়াছ, উহা ছাড়া আরও যে অজস্র ভাল দিক রহিয়াছে তাহা তোমাদের জানা নাই।

একদল তাফসীরকার বলেন, ফেরেশতাদের وحن نُسيّح بحْمُْدك وَنْفَرسٌ لك বাক্যাংশের জবাবে আল্লাহ পাক انى أعلّم ما لأتَعْلَمُوْن বলিয়াছেন। অর্থাৎ তোমরা ইবাদতের কথা বলিতেছ, অথচ তোমাদের বড় আবেদ ইবলীসের খবর তোমরা রাখ না।

একদল তাফসীরকার বলেন, ফেরেশতাদের উভয় বক্তব্যের জবাবে আল্লাহ্ তা’আলা أعلم ما لا تَعْلّمُوَنَ বলিয়াছেন। কেননা উক্ত পূর্ণ বক্তব্যে বনী আদমের স্থলে তাহাদের পৃথিবীতে বসবাসের অভিলাষ ব্যক্ত হইয়াছে। তাই আল্লাহ তা’আলা বলিলেন, তোমরা আকাশের উপযোগী এবং আকাশে অবস্থানই তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক । অথচ তোমরা তাহা বুঝিতে পাইতেছ না ৷ ইমাম রাযী প্রদত্ত কতিপয় ব্যাখ্যার ইহা অন্যতম । আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।

তাফসীরকারদের পর্যালোচনা

ইবন জারীর বলেন- আমাকে আর হাসান ইব্‌ন আল কাসিম, তাহাকে হাজ্জাজ, জারীর ইব্‌ন হাযেম ও মুবারক হইতে তাহারা হাসান ও আবূ বকর হইতে ও তাহারা কাতাদাহ হইতে বর্ণনা করেনঃ

وان قَالَ ربك للْمَلئكّة انَىْ جاعل فى الأرْض لخَليْفَة অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতাগণকে বলিলেন- আমি ইহা করিতে যাইতেছি। অন্য কথায় তিনি কি করিতে মনস্থ করিয়াছেন, তাহাদিগকে তাহা অবহিত করিলেন মাত্র।

ইব্‌ন আবূ হাতিম বর্ণনা করেন – আস্ সুদ্দী বলেন, আদম সৃষ্টির ব্যাপারে ফেরেশতাদের অভিমত চাওয়া হইয়াছে। কাতাদাহ হইতেও অনুরূপ বক্তব্য পাওয়া যায়।

উপরোক্ত ব্যাখ্যাদ্বয়ের মধ্যে আমার মতে প্রথমটিই উত্তম। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ।

فى الأرأض -এর ব্যাখ্যায় ইব্‌ন আবূ হাতিম বলেন- আমাদিগকে আমার আব্বা, তাঁহাকে আবূ সালামা, তাঁহাকে হাম্মাদ ইব্‌ন আতা ইব্‌ন সায়েব, আবদুর রহমান ইব্‌ন সাবিত হইতে বর্ণনা করেনঃ

“রাসূল (সাঃ) বলিয়াছেন, মক্কা হইতে পৃথিবীর বিস্তার শুরু হইয়াছে। মক্কার ঘরে প্রথম তাওয়াফ করেন ফেরেশতাগণ। তখন আল্লাহ্ তা’আলা বলেন- আমি পৃথিবীতে খলীফা বানাইতে চাই অর্থাৎ মক্কায়।”

হাদীসটি মুরসাল। উহার সূত্রও দুর্বল। উহাতে ‘মুদরাজ’ বিদ্যমান। অর্থাৎ বর্ণনার ভিতর “অর্থাৎ মক্কায়” কথাটি বর্ণনাকারীর নিজস্ব । আল্লাহ সর্বজ্ঞ। ইহা সুস্পষ্ট যে, ‘আরদ’ শব্দটির অর্থ ব্যাপক।

خَليفت শব্দের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আস্ সুদ্দী তাঁহার তাফসীরে আবূ মালিক হইতে, তিনি আবূ সালেহ হইতে, তিনি ইব্‌ন আব্বাস হইতে, তিনি মুরাহ আল হামদানী হইতে এবং তিনি ইব্‌ন মাসউদ ও একদল সাহাবা (রাঃ) হইতে নিম্ন বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেনঃ

“আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতাগণকে বলিলেন, নিশ্চয় আমি পৃথিবীতে খলীফা সৃষ্টি করিতে যাইতেছি । তখন ফেরেশতারা বলিলেন- হে আমাদের প্রতিপালক! সেই খলীফা কিরূপ হইবে? তিনি বলিলেন- “তাহার সন্তান-সন্ততি হইবে এবং তাহারা ঝগড়া-ফাসাদ ও হিংসা-বিভেদে লিপ্ত হইয়া একে অপরকে হত্যা করিবে।”

ইবন জারীর বলেন, এই প্রেক্ষিতে আয়াতের ব্যাখ্যা হইবে এই যে, ‘খলীফা’ জ্বিন-ইনসানের ভিতর আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে তাঁহার বিধান মোতাবেক ইনসাফ কায়েম করিবেন। তাই প্রথম খলীফা হইলেন আদম (আঃ) এবং পরবর্তী খলীফারা হইলেন তাঁহার সেইসব উত্তরাধিকারী যাহারা আল্লাহ্ বিধান মতে বনী আদমের ভিতর ইনসাফের অনুশাসন কায়েম করিবেন। পক্ষান্তরে যাহারা হিংসা-বিভেদ ও রক্তারক্তি অনুসরণ করিবে, তাহারা আল্লাহ্র খলীফা হওয়ার যোগ্যতা হারাইবে।

ইব্‌ন জারীর বলেন, এখানে আল্লাহ্ তা’আলার ব্যবহৃত ‘খলীফা’ শব্দের অর্থ হইল যুগের পর যুগ ধরিয়া বংশ পরম্পরায় একে অপরের স্থলাভিষিক্ত হইয়া চলা। তিনি বলেন خليفة শব্দটি فعيلة ওযনে সৃষ্ট। অর্থ হইল স্থলাভিষিক্ত বা উত্তরাধিকারী। কেহ যদি কোন ব্যাপারে কাহারও পরে তাহার স্থলাভিষিক্ত হয়, তাহা হইলে বলা হয়, অমুক অমুকের খলীফা হইয়াছে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা সম্প্রদায়গত খিলাফত প্রসঙ্গে বলেনঃ

تم جَعَلنَاكُمْ خَلاَئْفَ فى الأرْض من بَعْدهم لنَتُظْر كَيْف تَعْمَلُون “অতঃপর তোমাদিগকে তাহাদের স্থলাভিষিক্ত করিয়াছি এই জন্য যে, তোমরা কি কাজ কর তাহা দেখিব।”

এই কারণেই শাসকবর্গের প্রধান ব্যক্তিকে ‘খলীফা’ বলা হয়। কারণ, তিনি পূর্ববর্তী শাসক প্রধানের স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি পূর্ববর্তী শাসকের দায়িত্ব পালন করেন বলিয়া তাহাকে খলীফা বলা হয়।

ইবন জারীর বলেন- انَّىْ جاعل فى الْآررْض خَليْفَةً আয়াত প্রসঙ্গে মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক বলিতেন, ‘এখানে আল্লাহ পাক বলেন যে, পৃথিবীতে তাহারা একের পর এক বসবাস করিবে এবং পৃথিবী আবাদ করিবে, অথচ তাহারা তোমাদের কেহ নহে ৷ ‘

ইন জারীর বলেন, আমাকে আবূ কুরায়েব, তাঁহাকে উসমান ইব্‌ন সাঈদ, তাঁহাকে বাশার ইব্‌ন আম্মারা, আবূ রওক হইতে, তিনি যিহাক হইতে ও তিনি ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে এই বর্ণনা শুনানঃ

‘ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) বলেন, পৃথিবীতে প্রথম বসবাসকারী সম্প্রদায় হইল জ্বিন জাতি। তাহারা অবশেষে পৃথিবীতে ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করিল এবং রক্তপাত ঘটাইয়া চলিল ৷ এমনকি পরস্পর ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হইল। তিনি বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা তখন ইবলীসের নেতৃত্বে একটি বাহিনী পাঠাইলেন তাহাদিগকে ধ্বংস করার জন্যে। ফলে ইবলীস ও তাহার সঙ্গীরা তাহাদিগকে পাইকারীভাবে হত্যা করিল। অল্প সংখ্যক জ্বিন সমুদ্রের নির্জন দ্বীপে ও পাহাড়ের নির্জন গুহায় আত্মগোপন করিয়া বাঁচিয়া গেল। অতঃপর আদম জাতিকে সৃষ্টি করিলেন এবং বিশেষভাবে তাহাদিগকে পৃথিবীর বাসিন্দা করিলেন। তাই আল্লাহ্ তা’আলা ঘোষণা করিলেনঃ

إنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً

সুফিয়ান আছ ছাওরী আতা ইব্‌ন সায়েব হইতে ও তিনি ইব্‌ন ছাবিত হইতে বর্ণনা করেনঃ

إِنِّي جَاعِلُ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً قَالُوا أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ

আয়াত দ্বারা মূলত বনী আদমকেই বুঝানো হইয়াছে।

আবদুর রহমান ইব্‌ন যায়দ ইব্‌ন আসলাম বলেনঃ আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতাগণকে বলিলেন- আমি পৃথিবীতে নতুন এক মাখলূক সৃষ্টি করিতে মনস্থ করিয়াছি এবং সেখানে তাহাকে আমার খলীফা বানাইব। তখন শুধু ফেরেশতারাই তাঁহার সামনে মাখলূক হিসাবে ছিলেন। কিন্তু পৃথিবীতে সেরূপ কোন মাখলূক ছিল না। তাই ফেরেশতারা আরয করিলেন,

أتَجْعَلُ فِيْهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاء 

ইতিপূর্বে আস্ সুদ্দীর বর্ণনা উদ্ধৃত হইয়াছে। তিনি ইব্‌ন আব্বাস, ইব্‌ন মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবা (রাঃ) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতাগণকে আদম সন্তানরা কি করিবে না করিবে তাহা জানাইলে তখন তাহারা উপরোক্ত বক্তব্য পেশ করেন।

কিছু আগেই যিহাকের এক বর্ণনায় বলা হইয়াছে, তিনি ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেন যে, যেহেতু জ্বিন জাতি পৃথিবীতে ফাসাদ ও রক্তারক্তি সৃষ্টি করিয়াছিল, তাই তাহার উপর কিয়াস করিয়া ফেরেশতারা উপরোক্ত বক্তব্য পেশ করেন।

ইব্‌ন আবূ হাতিম বলেনঃ আমাকে আমার পিতা, তাহাকে আলী ইব্‌ন মুহাম্মদ আত্তানাফেসী, তাহাকে আবূ মু’আবিয়া, আ’মাশ হইতে, তিনি বুকায়ের ইবনুল আখনাস হইতে, তিনি মুজাহিদ হইতে ও তিনি আবদুল্লাহ ইব্‌ন আমর (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেন- বনী আদমের আগমনের আগে দুই হাজার বৎসর কাল জ্বিন জাতি পৃথিবীতে বসবাস করে । অতঃপর তাহাদের ভিতর ফিতনা-ফাসাদ ও রক্তারক্তি সৃষ্টি হওয়ায় আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার ফেরেশতা বাহিনী পাঠাইলেন। তাঁহারা তাহাদিগকে ব্যাপকভাবে ধ্বংস করিলেন এবং অবশিষ্টরা সমুদ্রের নির্জন দ্বীপে গিয়া আত্মগোপন করিল । তখন আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতাগণকে বলিলেনঃ أنَى جاعل فى الآرض خليفة উহার প্রেক্ষিতে ফেরেশতারা প্রশ্ন করিলেনঃ

 أتَجعل فيها من يُفُسد فيها ويُسفك الرْمَاء জবাবে আল্লাহ্ তা’আলা বলিলেনঃ ابّى أعلّم مالاتعلمون 

انَى جاعل فى الآرض خليّفة হইতে انى أعلّم ما لاتعلمون পর্যন্ত আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে আবুল আলীয়া বলেন, আল্লাহ্ তা’আলা মঙ্গলবার ফেরেশতা, বুধবারে জ্বিন ও শুক্রবারে আদমকে সৃষ্টি করেন”। জ্বিন জাতি যখন বিদ্রোহী হইল, তখন ফেরেশতাগণ পৃথিবীতে অবতরণ করিয়া তাহাদিগকে হত্যা করিলেন। কারণ পৃথিবীকে তাহারা ফাসাদপূর্ণ করিয়াছিল । তাই তাহারা উহার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলার সমীপে আরয করিলেন- আপনি কি পৃথিবীতে এমন জাতি সৃষ্টি করিবেন যাহারা জ্বিন জাতির মত ফিতনা-ফাসাদ সৃষ্টি করিবে এবং তাহাদের মতই রক্তপাত ঘটাইবে ?

ইব্‌ন আবূ হাতিম বলেনঃ আমাকে হাসান ইব্‌ন মুহাম্মদ ইবনুস সাবাহ, তাঁহাকে সাঈদ ইব্‌ন সুলায়মান, তাঁহাকে মুবারক ইব্‌ন ফুষালা ও তাঁহাকে আল-হাসান বর্ণনা করেন যে, ফেরেশতাগণকে আল্লাহ্ তা’আলাঃ ايْى جاعل فى الأَرْضٍ خَليفة বক্তব্য দ্বারা ইহাই বুঝাইয়াছেন যে, “নিশ্চয় আমি ইহা করিতে যাইতেছি।’ ফলে তাহারা তাহাদের প্রভুর কথার উপর ঈমান আনিল । তখন তাহাদিগকে কিছু ইলম দান করা হইল এবং কিছু ইল্‌ম হইতে তাহাদিগকে দূরে রাখা হইল ৷ তাই তাহারা প্রাপ্ত ইমের ভিত্তিতে আরয করিলেন,

أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ

তখন আল্লাহ্ পাক জবাব দিলেনঃ انى أعلم ما لأتَعَلْمُوْنَ

আল-হাসান বলেন- জ্বিন জাতি পৃথিবীতে ফাসাদ ও রক্তপাত ঘটাইয়াছিল । তাই আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদের অন্তরে এই কথা উদ্রেক করিলেন যে, শীঘ্রই উহা আবার ঘটিবে। সুতরাং তাহারা যাহা জানিত, তাহাই মুখে প্রকাশ করিল।

আবদুর রায্যাক মুআম্মার হইতে ও তিনি কাতাদাহ হইতে أتجعل فيها من يُفُّسد فِيهًا وَيَسْفك الرَّمَاءً  আয়াতাংশের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন- আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতাগণকে এই জ্ঞান দান করিয়াছেন যে, পৃথিবীতে বসবাসকারী সৃষ্ট জীবেরা ফাসাদ ও রক্তারক্তি করিবে। এই কারণেই তাহারা উক্ত প্রশ্ন তুলিতে পারিয়াছিলেন।

ইব্‌ন আবূ হাতিম বলেন, আমাকে আমার পিতা, তাঁহাকে হিশাম আর রাযী, তাঁহাকে ইবনুল মুবারক মারূফ অর্থাৎ ইব্‌ন খুরবৃজ আল মক্কী হইতে এবং তিনি আবূ জা’ফর মুহাম্মদ ইব্‌ন আলী হইতে বর্ণনাকারীর বরাতে বর্ণনা করেন যে, আবূ জা’ফর বলেনঃ

“আস সাজল’ নামক এক ফেরেশতা আছেন। তাহার দুই সহচর হইলেন হারুত ও মারূত । তাহারা প্রতিদিন তিনবার লাওহে মাহফুজের দিকে তাকাইবার অনুমতি ছিল । একদিন তিনি এমন সময়ে দৃষ্টিপাত করিলেন যখন তাহার জন্য অনুমতি ছিল না। তখন তিনি আদম সৃষ্টি ও সংশ্লিষ্ট ব্যাপারসমূহ অবলোকন করিলেন এবং সংগোপনে হারূত-মারূতকে উহা জ্ঞাত করিলেন। অতঃপর যখন আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতাদের কাছে আদম সৃষ্টির অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলেন, তখন তাহারা দুইজন উক্ত প্রশ্ন উত্থাপন করেন। হাদীসটি ‘গরীব’।

আবূ জা’ফর মুহাম্মদ ইব্‌ন আলী ইব্‌ন আল হুসাইন আল-বাকেরের বর্ণনা হিসাবে যদি ইহাকে শুদ্ধও বলা হয়, তথাপি বলিতে হয়, তিনি আহলে কিতাব হইতে উহা বর্ণনা করিয়াছেন। সুতরাং উহাতে ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক । তাই উহা প্রত্যাখ্যান করা অপরিহার্য । আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।

তাহা ছাড়া এই বর্ণনায় দেখা যায়, প্রশ্নকারী ফেরেশতা ছিলেন মাত্র দুইজন। উহা আয়াতের তাৎপর্যের পরিপন্থী । ফলে উহা অধিকতর অগ্রহণযোগ্য ৷ কারণ, আয়াত হইতে বুঝা যায়, সমবেত সকল ফেরেশতাই প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন। ইব্‌ন আবূ হাতিমের এক বর্ণনায়ও ইহাই প্ৰমাণিত হয়।

ইব্‌ন আবূ হাতিম বলেন, আমাকে আমার পিতা, তাঁহাকে হিশাম ইব্‌ন আবূ উবায়দাহ্, তাঁহাকে আবদুল্লাহ ইব্‌ন ইয়াহিয়া ইব্‌ন আবূ কাছীর এই বর্ণনা শুনান যে, আমি আমার পিতাকে বলিতে শুনিয়াছি, প্রশ্নকারী ফেরেশতার সংখ্যা ছিল দশ হাজার। সহসা আল্লাহর তরফ হইতে আগুন আসিয়া তাহাদিগকে জ্বালাইয়া ফেলিল।

এই বর্ণনা ও পূর্ব বর্ণনাটির মত ইসরাঈলী বর্ণনা । তাই উহা গ্রহণের অযোগ্য। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।

ইব্‌ন জুরায়জ বলেন- একদল ব্যাখ্যাকার বলেন যে, আল্লাহ্ ফেরেশতাদের আদম সৃষ্টি হইতে উদ্ভূত সকল পরিস্থিতি বর্ণনার পর তাহাদিগকে আলোচনা করার অনুমতি দিলে তাহারা উক্ত বক্তব্য উত্থাপন করেন। তাহারা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেন, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি তাহাদের সৃষ্টিকর্তা হওয়া সত্ত্বেও তাহারা কি করিয়া আপনার নাফরমান সাজিবে? এরূপ নাফরমান জাতিকে আপনি কেন সৃষ্টি করিবেন? তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদিগকে এই জবাব দিয়া আশ্বস্ত করিলেন যে, তোমরা তাহাদের বিষয়ে কিছু কথা জানিয়া থাকিলেও অনেক কিছুই তোমরা জান না । আমি তাহাদের বিষয়ে তোমাদের চাইতে অনেক বেশী কিছু জানি । তাহাদের ভিতর অনেক অনুগত বান্দাও সৃষ্টি হইবে।

ইবন জারীর বলেন, অপর একদল ব্যাখ্যাকার বলেন যে, ফেরেশতারা এই ব্যাপারে অজানা বিষয় জানার জন্য উক্ত প্রশ্ন উত্থাপন করিয়াছিলেন। তাহারা যেন বলিলেন- হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদিগকে সম্যক অবহিত করুন। সুতরাং ইহা অস্বীকারের উদ্দেশ্যে নহে; বরং অবগতির উদ্দেশ্যে। ইব্‌ন জারীর এই মতটি পছন্দ করিয়াছেন। কাতাদাহ হইতে সাঈদ বর্ণনা করেন. আল্লাহ্ পাকের বক্তব্য  وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَئِكَةِ إِنِّي جَاعِلُفى الْأَرْض خَليْفَةُ আদম সৃষ্টির ব্যাপারে ফেরেশতাদের মতামত যাচাইয়ের জন্য ব্যক্ত করা হইয়াছে। তাই তাহারা أتجعل فيها مَنْ يُفُسد”فيْهًا وَيسُفك الدمَاء এই অভিমত ব্যক্ত করিলেন। কারণ, তাহারা জানিতেন, আল্লাহ্ পাকের নিকট ফিতনা-ফাসাদ ও খুন-খারাবীর চাইতে ঘৃণ্য কাজ আর কিছুই নাই। পক্ষান্তরে তাঁহার প্রিয় কাজ হইল ইবাদত। তাই তাহারা ومحن تسبح بحمدك ونْقَوس لَك বলিয়া তাহাদের বক্তব্যের উপসংহার টানিলেন। আল্লাহ্ তা’আলা জবাবে বলিলেন إنِّي أَعْلَمُ مَا لا تَعْلَمُونَ নিশ্চয় আমি তাহাও জানি যাহা তোমরা জান না। অর্থাৎ আল্লাহ পাকের ইলমে রহিয়াছে যে, এই ‘খলীফা’ হইতে আম্বিয়া, রাসূল, নেককার ইত্যাকার জান্নাতী লোক সৃষ্টি হইবে ।

তিনি আরও বলেন, ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে আমাদিগকে নিম্নোক্ত বর্ণনা শুনানো হইয়াছে। তিনি বলিয়াছেনঃ

‘ফেরেশতারা যখন বলিলেন যে, আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের চাইতে কোন মর্যাদাশীল ও উত্তম জীব সৃষ্টি করেন নাই এবং আমাদের চাইতে তাঁহার কোন সৃষ্টিই জ্ঞানী নহে, তখন আল্লাহ্ তা’আলা আদমকে সৃষ্টি করিয়া তাহাদিগকে পরীক্ষায় ফেলিলেন। আল্লাহ্ তা’আলা সকল সৃষ্টিকেই এরূপ পরীক্ষায় ফেলেন— যেমন আসমান ও যমীনকেও তিনি আনুগত্যের পরীক্ষার সম্মুখীন করিয়াছিলেন। আল্লাহ পাক তাই বলিলেনঃ

انْتيًا طوعا أو كَرهًا قَالَنَا أَتَيْنَا طائعين “(হে আকাশ ও পৃথিবী!) ইচ্ছায় হউক কি অনিচ্ছায়, আনুগত্য কর। তাহারা বলিল, আমরা স্বেচ্ছায় অনুগত হইলাম।”

ونبحن تسبح بحمدك ونقدس لَك আয়াত সম্পর্কে কাতাদাহ হইতে মুআম্মারের সূত্রে আবদুর রায্যাক বর্ণনা করেনঃ তাসবীহ বলিতে তাসবীহ পাঠ এবং তাকদীস বলিতে সালাত বুঝিতে হইবে।

আস্ সুদ্দী আবূ মালিক হইতে, তিনি আবূ সালেহ হইতে, তিনি ইব্‌ন আব্বাস ও মুরা হইতে, তাঁহারা ইব্‌ন মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবা (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ

ونحن تسبح بحمدك ونقوس لك অর্থাৎ ফেরেশতারা বলিতেছেন, আপনার জন্য আমরা সালাত আদায় করিতেছি।

উক্ত আয়াতের তাৎপর্য সম্পর্কে মুজাহিদ বলেনঃ আমরা আপনার মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করিতেছি।

যিহাক বলেন- তাকদীস অর্থ পবিত্রতা বর্ণনা।

ونحن تسبح بحمدك ونقوس لك আয়াতের তাৎপর্য সম্পর্কে মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক বলেন, অর্থাৎ আমরা আপনার নাফরমানী করিতেছি না এবং আপনার অপছন্দনীয় কোন কাজ করিতেছি না।

ইব্‌ন জারীর বলেন, তাকদীস অর্থ মহত্ত্ব ও পবিত্রতা বর্ণনা করা। উহা হইতেই তাহাদের বক্তব্য ‘সুব্বুহুন কুদ্দুসুন’ এর উৎপত্তি হইয়াছে। সুব্বুহুন অর্থ তাঁহার নিষ্কলুষতা বর্ণনা এবং কুদ্দুসুন অর্থ তাঁহার পবিত্রতা ও মহত্ত্ব বর্ণনা । এই কারণে পবিত্র ঘরকে ‘বায়তুল মুক্কাদাস’ বলা হয়। সুতরাং ফেরেশতাদের বক্তব্য ونحن تسبح بحمدك অর্থ মুশরিকরা আপনার নামের সহিত যে সব কথাগুলি যুক্ত করিতেছে, উহা হইতে আমরা আপনার নিষ্কলুষতা ও বিমুক্ততা বর্ণনা করিতেছি। আর ونْفَرس لك অর্থ কাফিররা আপনার অস্তিত্ব ও গুণাবলীর সহিত যে নীচ ধ্যান-ধারণা ও ইতর আচার-আচরণমূলক কথাবার্তার সংযোজন ঘটাইতেছে, তাহা হইতে আমরা আপনার পবিত্রতা ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করিতেছি।

সহীহ মুসলিমে হযরত আবূ যর (রাঃ) হইতে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সাঃ)-কে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করিল, উত্তম বাক্য কোনটি? তিনি জবাবে বলিলেন- আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতাদের জন্য যাহা পছন্দ করিয়াছেন তাহাই উত্তম এবং তাহা হইল— ‘সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহী’।

আবদুর রহমান ইব্‌ন কারাত হইতে ইমাম বায়হাকী বর্ণনা করেন- ‘মি’রাজের রাত্রিতে রাসূল (সাঃ) ঊর্ধ্বাকাশে যে তাসবীহ শুনিয়াছেন তাহা হইল- ‘সুবহানাল আলিয়্যিল আ’লা, সুবহানাহু ওয়া তা’আলা।’

قال انْى أعلم ما لاتعلمون আয়াত সম্পর্কে কাতাদাহ বলেন- তাঁহার ইলমে এই কৃথা বিদ্যমান ছিল যে, এই খলীফার মধ্য হইতে নবী-রাসূল, নেককার বান্দা ও জান্নাতী লোক সৃষ্টি হইবে।

উক্ত আয়াতের রহস্যাবলী সম্পর্কে ইব্‌ন মাসউদ, ইব্‌ন আব্বাস ও অন্যান্য সাহাবা (রাঃ) এবং তাবেঈন (রঃ) যাহা কিছু বলিয়াছেন শীঘ্রই তাহা আলোচিত হইবে।

ইমাম কুরতুবী প্রথম এই আয়াতের ভিত্তিতে ‘খলীফা’ নির্বাচনকে ওয়াজিব বলিয়াছেন। খলীফার কাজ হইবে জনগণের ঝগড়া-বিবাদের মীমাংসা করা ও তাহাদের বিরোধ-বিসম্বাদ দূর করা । তাহা ছাড়া মজলুমের সহায়তা করা, দণ্ডবিধি চালু করা, অন্যায়-অনাচার বিলোপ করা ইত্যাকার গুরুত্বপূর্ণ কার্যসমূহ খলীফা ছাড়া কেহ করিতে পারে না । ওয়াজিব কার্য সম্পাদনের জন্য যে ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য শর্ত হইয়া দাঁড়ায় তাহাও ওয়াজিব।

আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের একদল বলেন- ইমামত কুরআন সুন্নাহ দ্বারা নির্ধারিত হইতে হইবে । হযরত আবূ বকর (রাঃ)-এর ইমামত সেইভাবে নির্ধারিত হইয়াছে। তাহা ছাড়া স্বয়ং রাসূল (সাঃ) তাঁহাকে নামাযের ইমামত দিয়া সেই ইঙ্গিত প্রদান করিয়াছেন । তাই অপরদল বলেন, রাসূলে খোদা (সাঃ)-এর ইঙ্গিতও খিলাফত লাভের জন্য দলীল হইতে পারে । অথবা খলীফায়ে রাসূল যাহাকে মনোনীত করেন, তিনি খলীফা হইতে পারেন। হযরত আবূ বকর (রাঃ) হযরত উমর ফারূক (রাঃ)-কে মনোনীত করেন। অথবা নেককারদের শূরা দ্বারা নির্বাচিত হইতে পারেন। যেমন উমর ফারূক (রাঃ) ছয়জন প্রধান সাহাবার শূরা মনোনীত করিয়াছিলেন এবং তাঁহারা হযরত উসমান (রাঃ)-কে খলীফা নির্বাচন করেন। অথবা জাতির ‘আহলুল হল ওয়াল আকদ’ অর্থাৎ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বাইয়াত গ্রহণ কিংবা তাহাদের প্রদত্ত দায়িত্বের বলে যে কোন একজনের বাইয়াত গ্রহণের দ্বারা খলীফা নির্বাচিত হইতে পারে । যেমন হযরত আলী (কঃ) সেইভাবে খলীফা নির্বাচিত হইয়াছেন। যখন এইভাবে কেহ খলীফা নির্বাচিত হন, তখন অধিকাংশ ইমামের মতে তাহার আনুগত্য ওয়াজিব হইয়া যায়। ইমামুল হারামাইন বলেন, ইহার উপর উম্মতের ইজমা হইয়া গিয়াছে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। যদি কেহ জবরদস্তির মাধ্যমে খিলাফতের মসনদ অলংকৃত করেন, তাহা হইলেও উম্মতের ঐক্য বহাল রাখা ও রক্তারক্তি হইতে উম্মতকে রক্ষার জন্য তিনি বৈধ খলীফা হিসাবে স্বীকৃত হইবেন । ইমাম শাফেঈ এই মতের সপক্ষে দলীল পেশ করিয়াছেন।

খিলাফত বৈধ হবার জন্য কি সাক্ষী প্রয়োজন? এই প্রশ্নে ইমামদের ভিতর মতভেদ দেখা দিয়াছে। একদল বলেন, সাক্ষী শর্ত নহে। অপরদল বলেন, সাক্ষী শর্ত; তবে দুইজন সাক্ষীই যথেষ্ট ।

আল জুবাঈ বলেন, চারিজন সাক্ষী এবং প্রস্তাবক ও প্রস্তাবিত লইয়া মোট ছয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তির উপস্থিতি ওয়াজিব। তাঁহার দলীল হইল হযরত উমর (রাঃ)-এর মনোনীত ছয় সদস্য বিশিষ্ট মজলিসে শূরা। সেখানে চারিজন সাক্ষী ছিলেন, তাহা ছাড়া ছিলেন প্রস্তাবক আবদুর রহমান ইব্‌ন আওফ ও প্রস্তাবিত হযরত উসমান (রাঃ)। এই মতটি বিতর্কিত। আল্লাহই ভাল জানেন ।

খলীফা হওয়ার জন্য ওয়াজিব হইল পুরুষ হওয়া, বয়স্ক হওয়া, বুদ্ধিমান হওয়া, মুসলমান হওয়া, ইনসাফগার হওয়া, মুজাহিদ হওয়া, দূরদর্শী হওয়া, যুদ্ধোপযোগী স্বাস্থ্যবান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণক্ষম সুস্থ বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া। ইহাই বিশুদ্ধ মত। কেহ কুরায়শ হওয়া শর্ত করিয়াছেন (সম্ভবত উহা সাময়িক শর্ত)। তবে হাশেমী হওয়া এবং নিষ্পাপ ও ত্রুটিমুক্ত হওয়া শর্ত নহে । ইহা শিয়া ও রাফেজীদের প্রদত্ত শর্ত।

ইমাম বা খলীফা যদি কোন পাপ কার্য করেন, তাহা হইলে কি তাহাকে পদচ্যুত করা হইবে? ইহা লইয়াও মতভেদ সৃষ্টি হইয়াছে। বিশুদ্ধ মত ইহাই যে, পদচ্যুত করা যাইবে না। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলিয়াছেনঃ

الا ان تروا كفروا بواحا عندكم من الله فيه برهان

অর্থাৎ আল্লাহ্ পাকের নির্দেশিত প্রমাণের ভিত্তিতে সুস্পষ্ট কাফির হিসাবে না দেখা পর্যন্ত তোমরা খলীফার আনুগত্য মানিয়া চল ৷

খলীফা নিজে কি পদত্যাগ করিতে পারেন? এই ব্যাপারেও মতভেদ রহিয়াছে । ইমাম হাসান (রাঃ) স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করিয়া হযরত মুআবিয়া (রাঃ)-এর নিকট খিলাফতের দায়িত্ব অর্পণ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা তিনি বিশেষ কারণে করিয়াছিলেন এবং উহা প্রশংসিত ছিল। একই সঙ্গে দুইজন খলীফা হওয়া কিংবা দুইয়েরও অধিক হওয়া বৈধ নহে। কারণ, রাসূল (সাঃ) বলিয়াছেন-

من جاءكم وأمركم جميع يريد أن يفرق بينكم فاقتلوه كائنا من كان

অর্থাৎ যে ব্যক্তি তোমাদের ভিতর আসিয়া ঐক্য বিনষ্টকারী কার্যকলাপের নির্দেশ দেয়, তাহাকে হত্যা কর, সে যেই হউক না কেন।

ইহাই অধিকাংশের মত। ইমামুল হারামাইনকে বাদ দিলে ইহার উপর উম্মতের ইজমা প্ৰমাণিত হয় ৷ কারামাতীরা বলেন, একই সঙ্গে দুইজন খলীফা থাকা বৈধ। যেমন একই সঙ্গে হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত মুআবিয়া (রাঃ) খলীফা ছিলেন এবং উভয়ের আনুগত্য ওয়াজিব ছিল । একই সঙ্গে যখন একাধিক নবীর অবস্থান বৈধ ছিল, তখন একাধিক খলীফার অবস্থানও বৈধ কারণ, নবূওত তো সর্বসম্মতভাবেই খিলাফতের চাইতে বেশী মর্যাদা রাখে।

আবূ ইসহাক হইতে ইমামুল হারামাইন বর্ণনা করেন- তিনি দুই খলীফার যুগপৎ খিলাফত বৈধ বলিয়াছেন এই শর্তে যে, রাষ্ট্র খুব বড় হইবে ও অনেক এলাকার সন্নিবেশ ঘটিবে এবং দূরত্বের কারণে এক খলীফার পক্ষে উহা পরিচালনা করা দুরূহ হইয়া পড়িবে।

আমি বলিতেছি, ইহার উদাহরণ হইল সমসাময়িক কালে ইরাকের আব্বাসীয় খিলাফত, মিসরের ফাতেমী খিলাফত ও স্পেনের উমাইয়া খিলাফত। আমি ইনশাআল্লাহ ‘ কিতাবুল আহকাম’-এর শেষভাগে ইহা সবিস্তারে আলোচনা করিব।

(۳۱)

وَ عَلَّمَ اٰدَمَ الۡاَسۡمَآءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمۡ عَلَی الۡمَلٰٓئِكَۃِ ۙ فَقَالَ اَنۡۢبِـُٔوۡنِیۡ بِاَسۡمَآءِ هٰۤؤُلَآءِ اِنۡ كُنۡتُمۡ صٰدِقِیۡنَ

(۳۲)

قَالُوۡا سُبۡحٰنَكَ لَا عِلۡمَ لَنَاۤ اِلَّا مَا عَلَّمۡتَنَا ؕ اِنَّكَ اَنۡتَ الۡعَلِیۡمُ الۡحَكِیۡمُ 

(۳۳)

قَالَ یٰۤاٰدَمُ اَنۡۢبِئۡهُمۡ بِاَسۡمَآئِهِمۡ ۚ فَلَمَّاۤ اَنۡۢبَاَهُمۡ بِاَسۡمَآئِهِمۡ ۙ قَالَ اَلَمۡ اَقُلۡ لَّكُمۡ اِنِّیۡۤ اَعۡلَمُ غَیۡبَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ۙ وَ اَعۡلَمُ مَا تُبۡدُوۡنَ وَ مَا كُنۡتُمۡ تَكۡتُمُوۡنَ

৩১. অনন্তর তোমার প্রভু আদমকে সমস্ত কিছুর নাম শিখাইলেন। অতঃপর ফেরেশতাদের সামনে সেই সব বস্তু পেশ করিলেন এবং বলিলেন, আমাকে এইগুলির নাম যদি তোমরা (পূর্ব বক্তব্যে) সত্যবাদী হইয়া থাক।

৩২. তাহারা বলিল, তুমি পবিত্র, তুমি যতটুকু বিদ্যা দান করিয়াছ তাহা ছাড়া তো আমাদের কোন বিদ্যা নাই, তুমিই সর্বজ্ঞ ও শ্রেষ্ঠতম কুশলী।

৩৩. তোমার প্রভু বলিলেন, হে আদম! তাহাদিগকে এইগুলির নাম বল; যখন সে তাহাদিগকে উহার নাম বলিয়া দিল, তোমার প্রভু বলিলেন- ‘আমি কি তোমাদিগকে বলি নাই যে, নিশ্চয় আমি আকাশ ও পৃথিবীর সমস্ত অদৃশ্য বস্তুর খবর রাখি এবং তোমরা যাহা প্রকাশ কর কিংবা গোপন রাখ, তাহাও ভালভাবে জানি।’

তাফসীরঃ এখানে আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতাদের উপর আদমের শ্রেষ্ঠত্বের কথা তুলিয়া ধরিয়াছেন। বিদ্যায় আদমের কাছে ফেরেশতারা হার মানিয়াছেন। বস্তু নিচয়ের পরিচয় দিতে ফেরেশতারা অপারগ হইলে আদম তাহাদিগকে শিখাইয়া দিয়া শিক্ষাগুরুর মর্যাদায় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হইলেন।

এই বৈশিষ্ট্য লাভের ঘটনাটি ঘটিয়াছে ফেরেশতাদের আদমকে সসম্ভ্রমে প্রণতি জানাবার পরে। তথাপি পরের ঘটনাটি আল্লাহ্ তা’আলা এই জন্য আগে উল্লেখ করিলেন যে, ফেরেশতারা যে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণেই আদম সৃষ্টির রহস্য বুঝিতে ব্যর্থ হইয়া প্ৰশ্ন তুলিয়াছিলেন এবং আল্লাহ্ তা’আলা জবাবে তাহাদের জ্ঞানের যে সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করিলেন তাহার যথার্থতা প্রমাণ করা। আল্লাহ্ তা’আলা এই ঘটনার মাধ্যমে ফেরেশতাদের বুঝাইয়া দিলেন যে, তাঁহার সৃষ্ট খলীফা জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাহাদের উপর শ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী।

و علّم آم الأسماء كلها আয়াতাংশ সম্পর্কে আস্ সুদ্দী হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে জনৈক বর্ণনাকারীর বর্ণনার ভিত্তিতে বলেন- তিনি বলিয়াছেন, আল্লাহ্ তা’আলা আদম (আঃ)-কে তাহার সন্তান-সন্ততির প্রত্যেকের নাম এবং প্রত্যেকটি জীব-জন্তুর নাম যথা-গাধা ঘোড়া, উট ইত্যাদি শিক্ষা দিলেন।

ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যিহাক বর্ণনা করেন و علّم آم الأسماء كلها অর্থাৎ যেই সব নাম দ্বারা মানুষ একে অপরকে ও জীব-জন্তুর বিভিন্ন শ্রেণীকে চিনিতে পারে এবং আসমান, যমীন, ভূ-ভাগ, সমুদ্র, ঘোড়া, গাধা, ইত্যাদির পরিচয় লাভ করে, তাহাই আল্লাহ্ তা’আলা আদমকে শিক্ষা দিলেন।

ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে মাসউদ ইব্‌ন মা’বাদ, তাঁহার নিকট হইতে আসিম ইব্‌ন কুলাইব এবং তাঁহার নিকট হইতে ইব্‌ন আবূ হাতিম ও ইব্‌ন জারীর বর্ণনা করেনঃ و علّم آم الأسماء كلها অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা তাহাকে যাবতীয় আসবাবপত্র ও হাড়ি-পাতিলের নাম শিখাইলেন । এমনকি উদরোৎসারিত মরুৎ পর্যন্ত বাদ যায় নাই।

মুজাহিদ বলেনঃ و علّم آم الأسماء كلها অর্থাৎ তাহাকে তিনি পশু-পাখী সহ সকল কিছুর নাম শিখাইলেন।

সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র, কাতাদাহ প্রমুখ পূর্বসূরীরা উক্ত আয়াতাংশের তাৎপর্য সম্পর্কে বলেন- যাবতীয় কিছুর নাম শিখাইলেন ৷

রবী’ আশ্ শামী বলেন- নক্ষত্ররাজির নাম শিখাইলেন । আবদুর রহমান ইব্‌ন যায়দ বলেন- তাঁহার সকল সন্তান-সন্ততির নাম শিখাইলেন।

ইব্‌ন জারীরের অনুসৃত অভিমত হইল এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা আদম (আঃ)-কে সকল ফেরেশতার ও তাহার সকল সন্তান-সন্ততির নাম শিখাইয়াছেন। কারণ شم عرضهم আয়াতাংশে هم সর্বনামটি বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন জীবের জন্য ব্যবহৃত হয়। তাই তিনি উক্ত অভিমতকে প্রাধান্য দিয়াছেন।

অবশ্য هم সর্বনাম শুধু জ্ঞান-বুদ্ধিসম্পন্ন জীবের জন্য নির্দিষ্ট, তাহা জরুরী নহে। বুদ্ধি-বিবেকহীন প্রাণী বা বস্তুও উহার অন্তর্ভুক্ত হইতে পারে। আরবী ভাষায় ‘তাগলীব’ হিসাবে তাহা করা হয়। যেমন আল্লাহ্ পাক বলেনঃ

والله خلق كل دابة من ماء فمنهم من يمشى على بطنه ومثهم من يمشى على رجلين ومنهم من يمشى على اربع يخلق الله ما يشاء.ان الله على كل شبىء قدير

“আল্লাহ্ তা’আলা সকল প্রাণী সৃষ্টি করিয়াছেন পানি হইতে। উহাদের এক শ্রেণী পেটে ভর দিয়া চলে, অন্য শ্রেণী চলে দুই পায়ে ভর করিয়া এবং এক শ্রেণী চার পায়ে চলে । আল্লাহ যাহা যেরূপ ইচ্ছা সৃষ্টি করেন । নিশ্চয় আল্লাহ্ তা’আলা সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান।”

আব্দুল্লাহ ইব্‌ন মাসউদ (রাঃ) عرضهم এর স্থলে عرضها পাঠ করিতেন। উবাই ইব্‌ন কা’ব (রাঃ) উহাকে عرضها পাঠ করিতেন অর্থাৎ নাম সংশ্লিষ্ট বস্তুসমূহ।

বিশুদ্ধ মত ইহাই যে, আল্লাহ্ তা’আলা আদমকে সকল কিছুর নাম, শ্রেণী, গুণাবলী ও কার্যকলাপ সম্পর্কে অবহিত করিলেন। যেমন ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) বলিয়াছেন, উদরোৎসারিত মরুৎ পর্যন্ত বাদ পড়ে নাই। অর্থাৎ প্রত্যেক প্রাণী, বস্তু, শ্রেণী ও তাহাদের ছোট-বড় সর্ববিধ কার্যকলাপ সম্পর্কে তাহাকে জ্ঞান দান করা হইয়াছে।

এই কারণেই ইমাম বুখারী তাঁহার সহীহ সংকলনের ‘তাফসীর’ অধ্যায়ে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত হাদীসসমূহ উদ্ধৃত করিয়াছেন।

আমাকে মুসলিম ইব্‌ন ইবরাহীম, তাহাকে হিশাম, কাতাদাহ হইতে ও তিনি আনাস ইব্‌ন মালিক হইতে বর্ণনা করেনঃ

রাসূল (সাঃ) বলিয়াছেন- আল্লাহ্ তা’আলা বলিলেন, ‘আমার খলীফা।’

আমাকে ইয়াযীদ ইব্‌ন যরী’, তাহাকে সাঈদ, কাতাদাহ হইতে এবং তিনি আনাস ইব্‌ন মালিক (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ

‘রাসূল (সাঃ) বলিয়াছেন- কিয়ামতের দিন মু’মিনগণ সমবেত হইয়া বলাবলি করিবে, কেহ যদি আমাদের জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে সুপারিশ করিত। এতদুদ্দেশ্যে তাহারা আদম (আঃ)-এর কাছে গিয়া বলিবে- আপনি মানব জাতির পিতা। আল্লাহ পাক আপনাকে নিজের হাতে গড়িয়াছেন। তাঁহার ফেরেশতারা আপনাকে সিজদা করিয়াছেন। তিনি আপনাকে সকল কিছুর নাম শিখাইয়াছেন। সুতরাং আমাদের জন্য আপনার প্রভুর কাছে সুপারিশ করুন; অন্তত এখানে যেন আমরা শান্তিতে থাকিতে পারি। তিনি বলিবেন, “এখানে আমি তোমাদের কাজে আসিব না। তখন তিনি নিজের পাপ স্মরণ করিয়া লজ্জিত হইবেন। অতঃপর বলিবেন, তোমরা নূহ (আঃ)-এর কাছে যাও৷ তাহাকে আল্লাহ্ তা’আলা প্রথম রাসূল করিয়া দুনিয়াবাসীর কাছে পাঠাইয়াছেন । তখন তাহারা তাঁহার কাছে আসিবে। তিনিও বলিবেন, এখানে আমি তোমাদের কোন কাজে আসিব না। তিনি নিজেই না জানিয়া আল্লাহ্র কাছে পুত্রের জন্য সুপারিশের ভুলটি স্মরণ করিয়া লজ্জিত হইবেন। তাই তিনি বলিবেন- তোমরা খলীলুল্লাহর কাছে যাও। তাহারা তাঁহার কাছে আসিলে তিনিও বলিবেন- এখানে আমি তোমাদের কোন কাজে আসিব না। বরং তোমরা মূসা (আঃ)-এর কাছে যাও। তাঁহার সহিত আল্লাহ্ পাক সরাসরি কথা বলিয়াছেন এবং তাঁহাকে তাওরাত দান করিয়াছেন। তখন তাহারা তাঁহার নিকট যাইবে। তিনিও বলিবেন, এখানে তোমাদের জন্য আমি উপযুক্ত নহি এবং তিনি হত্যার অপরাধ ছাড়াই এক ব্যক্তিকে হত্যার জন্য নিজ প্রভুর কাছে লজ্জিত হইবেন। তখন তিনি বলিবেন, তোমরা ঈসা (আঃ)-এর কাছে যাও। তিনি একাধারে আবদুল্লাহ, রাসূলুল্লাহ, কলেমাতুল্লাহ ও রূহুল্লাহ। অতঃপর তাহারা তাঁহার কাছে যাইবে। তিনিও বলিবেন, এখানে তোমাদের জন্য আমি নহি। তোমরা আল্লাহর বান্দা মুহাম্মদ (সাঃ)-এর কাছে যাও। আল্লাহ তাঁহার পূর্বাপর অপরাধ মাফ করিয়া দিয়াছেন। অতঃপর তাহারা আমার কাছে আসিবে। তখন আমি আমার প্রভুর অনুমতি গ্রহণের জন্য যাইব। তিনি আমাকে শাফাআতের জন্য অনুমতি প্রদান করিবেন। আমি যখন আমার প্রভুর সন্দর্শন লাভ করিব, সঙ্গে সঙ্গে সিজদারত হইব এবং তাঁহার মর্জী মোতাবেক প্রার্থনা করিব। অতঃপর বলা হইবে- মাথা উঠাও। এবারে দাবী পেশ কর, মঞ্জুর হইবে; বক্তব্য পেশ কর, শোনা হইবে এবং শাফাআত কর, কবূল হইবে। তখন মাথা তুলিব। অতঃপর তাঁহারই প্রদত্ত শিক্ষানুসারে তাঁহার প্রশংসা বর্ণনা করিব। তারপর আমি শাফাআত করিব। উহা সীমিত সংখ্যায় মঞ্জুর হইবে। তাহাদিগকে আমি জান্নাতে পৌঁছাইব। আবার প্রভুর দরবারে আসিয়া সিজদাবনত হইব। তিনি অনুমতি দিলে পুনরায় শাফাআত করিব। তখন সীমিত সংখ্যক লোক মুক্তি পাইবে। তাহাদিগকে জান্নাতে পৌছাইয়া তৃতীয়বার প্রভুর দরবারে ফিরিয়া আসিব। তখনও অনুরূপ হইবে। চতুর্থবার আসিয়া সকলকেই মুক্ত করিব। অবশেষে কেবল তাহারাই জাহান্নামে থাকিবে যাহাদিগকে কুরআন গতিরোধ করিবে। অর্থাৎ কুরআন অস্বীকার করায় যে সব কাফির-মুশরিকের জন্য জাহান্নামের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়া ওয়াজিব হইয়াছে।

ইমাম বুখারী পূর্বোক্ত আয়াতাংশ প্রসঙ্গে উপরোক্ত হাদীসদ্বয় পেশ করিয়াছেন। ইমাম মুসলিম ও ইমাম নাসাঈ হিশাম ইব্‌ন আবূ আব্দুল্লাহ আদ্ দস্তওয়াইর বরাতে কাতাদাহ হইতে উহা বর্ণনা করেন। ইমাম মুসলিম, ইমাম নাসাঈ ও ইব্‌ন মাজাহ সাঈদ ইব্‌ন আবূ আরূবার সনদেও কাতাদাহ হইতে উক্ত বর্ণনা উদ্ধৃত করেন।

এই দীর্ঘ হাদীসটি এখানে উদ্ধৃত করার উদ্দেশ্য শুধু রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর এই বক্তব্যটুকুঃ

فيأتون ادم فيقولون انت أبو الناس خلق الله بيده واسجد لك ملائكت وعلمك اسماء كل شيء –

(অতঃপর তাহারা আদম (আঃ)-এর নিকট আসিয়া বলিল, আপনি মানব জাতির পিতা । আপনাকে আল্লাহ্ তা’আলা স্বহস্তে সৃষ্টি করিয়াছেন । তাঁহার ফেরেশতারা আপনাকে সসম্ভ্রমে প্রণতি জানাইয়াছেন। আল্লাহ্ তা’আলা আপনাকে সকল কিছুর পরিচয় শিখাইয়াছেন।)

এই হাদীস প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্ তা’আলা আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি জগতের সকল কিছুরই পরিচয় দিয়াছেন। অতএব তিনি বলিলেনঃ شم عرضهم على الْمَاذَمْكة অর্থাৎ‍ নামপদবাচ্য সকল কিছুই। যেমন আবদুর রায্যাক মুআম্মারের সনদে কাতাদাহ হইতে বর্ণনা করেন- অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা নামপদবাচ্য সকল কিছুই ফেরেশতাদের সামনে পেশ করিলেন অতঃপর বলিলেনঃ أَنْنْنُونى بأسماء هؤلاء ان كُنْنُم صدقيّْن (যদি সত্যবাদী হইয়া থাক, এইগুলির নাম বল।)

আস্ সুদ্দী তাঁহার তাফসীরে আবূ মালিক হইতে, তিনি আবূ সালেহ হইতে, তিনি ইব্‌ন আব্বাস ও মুরা হইতে, তাঁহারা ইব্‌ন মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবা (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ

وَعَلُمَ أدم الأسمَاء كُلّهَا আল্লাহ্ তা’আলা আদমকে সমগ্র সৃষ্টির পরিচয় জানাইয়া পরে উহা ফেরেশতাদের সামনে পেশ করিলেন।

ইব্‌ন জুরায়জ বলেন- ‘অতঃপর নাম নির্দেশিত সৃষ্টিসমূহ ফেরেশতাদের সামনে পেশ করিলেন।’

ইন জারীর বলেন- আমাদিগকে আল কাসিম, তাঁহাকে আল হুসাইন, তাঁহাকে আল হাজ্জাজ, জারীর ইব্‌ন হাযিম ও মুবারক ইব্‌ন ফুযালা হইতে, তাঁহারা আবূ বকর আল-হাসান ও কাতাদাহ হইতে বর্ণনা করেন; তাঁহাকে তিনি সকল কিছুর নাম শিখাইয়াছেন এবং প্রত্যেকটি বস্তুকে ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়া সেইগুলিকে শ্রেণীবদ্ধভাবে পেশ করা হইয়াছে।

أن كُنْكم صدقيُن আয়াতাংশ সম্পর্কে এই সনদেই আল-হাসান ও কাতাদাহ বলেন, আমি এমন কোন কিছু সৃষ্টি করি নাই যাহা সম্পর্কে তোমাদের ভালভাবে জানা নাই। তথাপি যদি তোমরা (তোমাদের প্রকাশিত অভিমতে) সত্য হইয়া থাক, তাহা হইলে সেইগুলির নাম বল।

ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যিহাক বর্ণনা করেনঃ أن كُنْكم صدقيُن অর্থ ‘যদি তোমাদের এই জানা সত্য হয় যে, আমি পৃথিবীতে ‘খলীফা’ সৃষ্টি করিব না।’

ইবন মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবা (রাঃ) হইতে ক্রমাগত ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) ও মুরা, আবূ সালেহ, আবূ মালিক ও আস্ সুদ্দী বর্ণনা করেনঃ

أن كُنْكم صدقيُن অর্থাৎ বনী আদম পৃথিবীতে ঝগড়া-ফাসাদ ও রক্তারক্তি করিবে বলিয়া তোমরা যে ধারণা করিয়াছ, তাহাতে যদি তোমরা সত্য হও।

ইন জারীর বলেন- এই ব্যাপারে হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ)-এর বিশ্লেষণই উত্তম। তিনি ইহার তাৎপর্য সম্পর্কে বলেনঃ

‘হে বক্তব্য পেশকারী ফেরেশতাবৃন্দ! তোমরা যে বলিলে, বনী আদম পৃথিবীতে ফিতনা-ফাসাদ রক্তারক্তি করিবে এবং বনী আদমের বদলে তোমাদের মধ্য হইতে খলীফা বানাইলে তাহার অনুগত থাকিয়া ইবাদত বন্দেগী করিবে, তাহা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে তোমাদের সামনে পেশকৃত বস্তুসমূহের নাম-পরিচয় বল। তোমরা এইগুলি সদা সর্বদা দেখা সত্ত্বেও যদি এই জ্ঞাত বস্তুসমূহের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হও, তাহা হইলে যেই ভাবী কার্যাবলী তোমরা জ্ঞাত নহ, তাহা সম্পর্কে তোমাদের বক্তব্য কি করিয়া সত্য হইতে পারে? আল্লাহ্ তা’আলার এই প্রচ্ছন্ন ধমকের সঙ্গে সঙ্গে ফেরেশতারা সমস্বরে বলিয়া উঠিলেনঃ

سسبحتك لأعلْمَ لَنَا الما عَلُمْتْنَا انك أنت العليم الحكيم অর্থাৎ হে সর্ববিষয়ের জ্ঞানাধার! হে সমগ্র সৃষ্টি ও কার্যাবলীর শ্রেষ্ঠতম কুশলী! তুমি যাহাকে ইচ্ছা জ্ঞান দান কর ও যাহাকে ইচ্ছা বঞ্চিত রাখ। এই ব্যাপারে তোমার হিকমতই অতুলনীয় ও ন্যায়ানুগ।

ইহা ফেরেশতাদের তরফ হইতে আল্লাহ্ তা’আলার পবিত্রতা ও নিষ্কলুষতা বর্ণনামূলক বক্তব্য। ইহার তাৎপর্য এই যে, তাঁহার মর্জী ছাড়া তাঁহার সার্বিক জ্ঞানের কিছুমাত্রও কেহ অর্জন করিতে পারে না এবং তিনি যাহা শিখান নাই, তাহা কেহ শিখিতে পারে না। তাই তাহারা সবিনয়ে বলিলেনঃ

سسبحتك لأعلْمَ لَنَا الما عَلُمْتْنَا انك أنت العليم الحكيم ইবন আব্বাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ইব্‌ন আবূ মুলাইকা, হাজ্জাজ, হাফস ইব্‌ন গিয়াস, আবূ সাঈদ আল আশাজ্জ ও ইব্‌ন আবূ হাতিম বর্ণনা করেনঃ

سبحأآن اللَّدِ সম্পর্কে ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) বলেন- উহা আল্লাহ পাকের সর্ববিধ গর্হিত ব্যাপার হইতে পবিত্রতা বর্ণনামূলক শব্দ। হযরত উমর (রাঃ) একদিন সহচর পরিবেষ্টিত হযরত আলী (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করিলেন- ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’ অর্থ তো জানি, কিন্তু ‘সুবহানাল্লাহ’ অর্থ কি? আলী (কঃ) উত্তর দিলেন- উহা আল্লাহ্ তা’আলার নিজের জন্য মনোনীত একটি বাক্য। উহা পাঠ করাকে তিনি অত্যন্ত পছন্দ করেন।

ইব্‌ন আবূ হাতিম বলেন- আমাকে আমার পিতা, তাঁহাকে ফুযায়ল ইবনু নযর ইব্‌ন আদী বর্ণনা করেন- এক বক্তি মায়মূন ইব্‌ন মিহরানকে ‘সুবহানাল্লাহ’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলেন- উহা এমন একটি নাম যাহা দ্বারা আল্লাহ্ তা’আলার মহত্ত্ব ও পবিত্রতা বর্ণিত হয়।

قَالَ يَادَمُ أنْبِتُهُمْ بِأَسْمَائِهِمْ فَلَمَّا أَنْبَاهُمْ بِأَسْمَائِهِمْ قَالَ أَلَمْ أَقُلْ لَكُمْ إِنِّي

أَعْلَمُ غَيْبَ السَّمَوتِ وَالْأَرْضِ وَأَعْلَمُ مَا تُبْدُونَ وَمَا كُنْتُمْ تَكْتُمُونَ

আয়াতের তাৎপর্য সম্পর্কে যায়দ ইব্‌ন আস্লাম বলেন- অর্থাৎ তুমি জিবরাঈল, তুমি মিকাঈল, তুমি ইসরাফীল, এইরূপ সমস্ত কিছুর নাম বলিতে গিয়া এমনকি কাকের নাম পর্যন্ত বলিলেন।

قال يادم أَنْبِسُهُم بأَسمَائهمم আয়াতাংশ প্রসঙ্গে মুজাহিদ বলেন- কবুতর ও কাক হইতে আরম্ভ করিয়া সমস্ত কিছুর নাম বলিলেন । সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র, আল-হাসান ও কাতাদাহ হইতেও অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়।

বস্তুসমূহের নাম পরিচয় শিক্ষা দানের ফলে যখন আদম (আঃ)-এর মর্যাদা ফেরেশতাদের উপরে প্রতিষ্ঠিত হইল, তখন আল্লাহ্ তা’আলা বলিলেনঃ

ألم أقل لكُم إِنِّي أَعْلَمُ غَيْبَ السَّمَوتِ وَالْأَرْضِ وَأَعْلَمُ مَا تُبْدُونَ وَمَا كُنتُمْ تَكْتُمُون

অর্থাৎ আমি কি তোমাদিগকে আগেই বলি নাই যে, আমি দৃশ্য কি অদৃশ্য, গোপন কি প্রকাশ্য সকল কিছুই সর্বাধিক জানি। যেমন তিনি অন্যত্র বলেনঃ

وان تَجَْهَر بالقول فَانَّه يَعُلَمُ السِر وأخفى “আর যদি তুমি প্রকাশ্যে কিছু বল, তাহা হইলে অবশ্যই তিনি অন্তর্নিহিত গোপন কথাও জানিতে পাইবেন।

তেমনি হুদহুদ পাখি সম্পর্কে সংবাদ প্রদান প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা সুলায়মান (আঃ)-কে বলিলেনঃ

الا يَسْجُدُ اللهَ الَّذِي يَخْرُجُ الْخَب في السمواتِ وَالْأَرْضِ وَيَعْلَمُ مَا تُخْفُونَ

وَمَا تُعْلِنُونَ – الله لا إلهَ إِلا هُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيم

“তাহারা কি সেই আল্লাহর উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হইবে না যিনি নভোমণ্ডল ও পৃথিবীতে লুক্কায়িত বস্তুর প্রকাশ ঘটাইয়াছেন এবং তোমরা যাহা প্রকাশ কর কিংবা গোপন রাখ তাহা যিনি জানেন । আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বূদ নাই । তিনি মহান আরশের অধিপতি।”

কেহ কেহ বলেনঃ وأعلم مانتبدون وما كنتم تَكْتمون অর্থাৎ আমি যাহা উল্লেখ করি নাই (বরং গোপন রাখিয়াছি)।

ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যিহাক বর্ণনা করেনঃ

وأعلم مانتبدون وما كنتم تَكْتمون অর্থাৎ আমি প্রকাশ্য ব্যাপারের মতই গোপনীয় ব্যাপার জানি। ইবলীস তাহার

অন্তরে যে দম্ভ ও অহংকার লুকাইয়া রাখিয়াছে তাহা আমি জানি।

ইবন মাসউদ ও একদল সাহাবা (রাঃ) হইতে ক্রমাগত ইব্‌ন আব্বাস, মুরা, আবূ সালেহ, আবূ মালিক ও আস্ সুদ্দী বর্ণনা করেনঃ

ফেরেশতাদের বক্তব্য أتَجِعل فيه مَنْ يُفْسدٌ فيّهًا وَيَسْفك الوّمَاء হইল তাহাদের প্রকাশ্য কথা এবং ইবলীসের অন্তরে যে অহংকার নিহিত রহিয়াছে তাহাই গোপন কথা।

সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র, মুজাহিদ, আস্ সুদ্দী, যিহাক ও ছাওরী উক্ত আয়াতের অনুরূপ তাৎপর্য ব্যক্ত করিয়াছেন; ইবন জারীর এই অভিমতই পছন্দ করিয়াছেন।

আবুল আলীয়া, রবী’ ইবন আনাস, আল-হাসান ও কাতাদাহ বলেনঃ ‘আমাদের চাইতে বিজ্ঞ ও মর্যাদাবান আল্লাহ পাকের আর কোন সৃষ্টি নহে’- ফেরেশতাদের এই আলোচনাই হইল উক্ত আয়াতে উল্লেখিত গোপন কথা।

রবী’ ই আনাসের বরাতে আবূ জা’ফর আর-রাযী বলেন- উক্ত আয়াতের প্রকাশ্য কথা হইল, ‘আপনি কি তাহাদিগকে সৃষ্টি করিবেন যাহারা পৃথিবীতে ঝগড়-ফাসাদ ও রক্তারক্তি করিবে?” পক্ষান্তরে উহার গোপন কথা হইল ফেরেশতাদের এই আলোচনা-আল্লাহ্ তা’আলার এমন কোন সৃষ্টি নাই যাহারা আমাদের চাইতে জ্ঞানী ও মর্যাদাবান।’ অবশেষে তাহারা জানিতে পাইলেন যে, আল্লাহ আদম (আঃ)-কে তাহাদের চাইতে জ্ঞানী ও মর্যাদাবান করিয়াছেন।

ইবন জারীর বলেন- আমাকে ইউনুস ও তাঁহাকে ইবন ওহাব, আবদুর রহমান ইব্‌ন যায়দ ইব্‌ন আসলাম হইতে ফেরেশতা ও আদম (আঃ) সম্পর্কিত কাহিনী প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন যে, ‘আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতাগণকে বলিলেন, যেভাবে তোমরা বস্তু নিচয়ের নামসমূহ জান না, তেমনি তোমরা বনী আদমের ঝগড়া-ফাসাদের ব্যাপারটি জানিলেও তাহাদের মধ্যে যে বহু অনুগত বান্দা হইবে তাহা তোমরা জান না। কারণ, নাফরমানীর ব্যাপারটি তোমাদিগকে জানিতে দিলেও ফরমাবরদারীর দিকটা তোমাদের কাছে গোপন রহিয়াছে।

যায়দ ইবন আসলাম আরও বলেন- আল্লাহ্ তা’আলা আগেই নাফরমানদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত করিয়া রাখিয়াছেনঃ

لا ملف جهنم من الجنّة والنّاس أجم جمعين “অবশ্যই আমি (নাফরমান) জ্বিন ও ইনসান দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করিব।”

অথচ ফেরেশতারা তাহাও জানিতেন না। অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা আদমকে যাহা দান করিয়াছেন তাহা দেখিতে পাইয়া আদমের শ্রেষ্ঠত্ব মানিয়া লইলেন।

ইন জারীর বলেনঃ وأعلم ماتبدون এই ব্যাপারে ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ)-এর অভিমতই উত্তম। তিনি বলেন- অর্থাৎ আমি আমার আসমান ও যমীনের সকল গায়বী ব্যাপারে ইলমের সাহায্যে তোমরা যাহা বলিয়াছ আর যাহা গোপন করিয়াছ, সকল কিছুই ভালভাবে জানিয়াছি। বনী আদমের যে নাফরমানীর কথা বল তাহা যেমন জানি, তেমনি জানি তোমাদের মধ্যকার ইবলীসের নাফরমানী ও অহংকারের কথাও। তিনি আরও বলেনঃ

ইবলীসের গোপন মনোভাবটি সকলকে জড়াইয়া বলার রীতি আরবী ভাষায় বিদ্যমান। তাহারা দলের দু’একজন নিহত কিংবা পরাজিত হইলে বলে قتل الجيش وهزموا

তেমনি আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ ان الّديْنَ مُنَادُونَكَ من وراء الْحُجّرَات “নিশ্চয় তোমাকে যাহারা হুজরার পিছন হইতে ডাকে। ”

এখানে উদ্দিষ্ট মাত্র একজন। তিনি বনূ তমীমের লোক। সেইভাবে وأعلم ماتبدون وما كُنْكُمْ تَكْتّمُوَن আয়াতটিও শুধু ইবলীসের জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে।

(٣٤)

 وَإِذْ قُلْنَا لِلْمَلَكَةِ اسْجُدُ وَالأدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيسَ أَبَى وَاسْتَكْبَرَة وَ كَانَ مِنَ الْكَفِرِينَ

৩৪. অতঃপর যখন আমি ফেরেশতাগণকে বলিলাম, ‘আদমকে সিজদা কর’, তখন ইবলীস ভিন্ন সকলেই সিজদা করিল। সে দম্ভভরে অস্বীকার করিল এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হইল।

তাফসীরঃ এখানে আল্লাহ্ তা’আলা আদম (আঃ)-কে যে শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টির মর্যাদা দিয়া বনী আদমের উপর বিরাট অনুগ্রহ করিয়াছেন তাহাই বর্ণিত হইয়াছে। ফেরেশতাগণের প্রতি আদম (আঃ)-কে সিজদা করার নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’আলা বনী আদমকে এই মর্যাদায় ভূষিত করিয়াছেন। বহু হাদীসেও এই ব্যাপারটি বর্ণিত হইয়াছে। উপরে আলোচিত শাফাআতের হাদীসেও এবং ঘটনার উল্লেখ রহিয়াছে। হযরত মূসা (আঃ) সম্পর্কিত নিম্ন হাদীসটিতেও উহা বর্ণিত হইয়াছেঃ

رب ارنى ادم الذي اخرجنا و نفسه من الجنة فلما اجتمع به قال انت ادم

الذي خلقه الله بيده ونفخ فيه من روحه واسجد له ملائكته …. الحديث .

(প্ৰভু হে! আমাকে আদম (আঃ)-কে দেখান যিনি নিজেকে ও আমাদের সকলকে জান্নাত হইতে বাহির করিয়াছেন। যখন তাহারা একত্রিত হইলেন তখন মূসা (আঃ) বলিলেন, আপনি সেই আদম (আঃ) যাহাকে আল্লাহ্ তা’আলা স্বহস্তে সৃষ্টি করিয়া তাহাতে রূহ ফুঁকিয়া দিয়াছিলেন এই তাঁহার ফেরেশতারা তাঁহাকে সিজদা করিয়াছিলেন? আল-হাদীস)।

ইনশাআল্লাহ কিছু পরে হাদীসটি সবিস্তারে আলোচিত হইবে। ইব্‌ন জারীর বলেনঃ

আমাকে আবূ কুরায়ব, তাঁহাকে উসমান ইব্‌ন সাঈদ, তাঁহাকে বাশার ইব্‌ন আম্মারা, আবূ রউফ হইতে, তিনি যিহাক হইতে ও তিনি ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেন- ইবলীস ফেরেশতাদেরই একটি গোত্রভুক্ত ছিল । তবে তাহারা ছিল আগুনের সৃষ্টি। এই গোত্রটিকে জ্বিন বলা হইত। তাহার নাম ছিল হারিছ। সে জান্নাতের খাজাঞ্চী ছিল। তিনি আরও বলেন, এই গোত্র ছাড়া অন্য সব ফেরেশতারা ছিলেন নূরের সৃষ্টি। কুরআনে বর্ণিত জ্বিনরা অগ্নিশিখা হইতে সৃষ্টি। উহা ঊর্ধ্বগামী হয় এবং প্রজ্বলিত আগুন হইতে উদ্গত হয়। পক্ষান্তরে মানুষ মাটির সৃষ্টি। পৃথিবীতে প্রথম বাসিন্দা ছিল জ্বিন জাতি। তাহারা পৃথিবীতে যখন চরম ফিতনা-ফাসাদ ও রক্তারক্তি সৃষ্টি করিল এবং মারামারি কাটাকাটিতে লিপ্ত হইল, তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার ফেরেশতা বাহিনীর সঙ্গে সদলবলে ইবলীসকেও পাঠাইলেন। ইবলীসের দলও জ্বিন ছিল। তাহারা যুদ্ধ করিয়া পৃথিবীর জ্বিন জাতিকে ধ্বংস করিল এবং অবশিষ্টরা সমুদ্রের নির্জন দ্বীপে ও পাহাড়ের গুহায় পালাইয়া প্রাণ বাঁচাইল। এই বিজয় ইবলীসের মনে অহংকার সৃষ্টি করিল। সে মনে মনে বলিল, আমি যাহা করিলাম তাহা আর কেহ কখনও করিতে পারে নাই। আল্লাহ্ তা’আলা তাহার মনের এই অবস্থা জানিতে পাইলেন। কিন্তু ফেরেশতাগণকে তাহা জানান নাই। তখন আল্লাহ্ তা’আলা ফেরেশতাগণকে বলিলেনঃ

انَى جاعل فى الأرض خَليْفَة (আমি পৃথিবীতে খলীফা সৃষ্টি করিতে যাইতেছি।)

ফেরেশতারা জবাবে বলিলেনঃ

أَتَجْعَلُ فِيهَا مَنْ يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاءَ (كـمـا افـسـد الجن وسفكت

الدماء وانما بعثنا عليهم لذالك) –

“আপনি কি পৃথিবীতে তাহাদিগকে সৃষ্টি করিবেন যাহারা পৃথিবীতে ফাসাদ ও রক্তপাত ঘটাইবে, যেভাবে জ্বিন জাতি ঘটাইয়াছে? অথচ আমরা তো তাহাদিগকে শায়েস্তা করার জন্যই এখানে প্রেরিত হইয়াছি।

আল্লাহ্ তা’আলা প্রত্যুত্তরে বলিলেনঃ انى أعلّم ما لآ تَعْلَمُوْنَ অর্থাৎ আমি ইবলীসের অন্তরের খবব রাখি যাহা তোমরা জান না। তাহার অন্তর দম্ভ ও অহংকারে পূর্ণ হইয়াছে।

অতঃপর তিনি আদম সৃষ্টির জন্য মাটি আনিতে বলিলেন। আল্লাহ্ তা’আলা আদমকে ‘লাযিব’ মাটি দ্বারা সৃষ্টি করিলেন। ‘লাযিব’ বলা হয় পবিত্র ছানা মাটিকে। মাটিকে ছানিয়া খামীরার মত আঁটালো ও শক্ত করাকে ‘হামাইম মাসনূন’ বলা হয়। আল্লাহ্ তা’আলা সেই মাটি দ্বারা নিজ হাতে আদমকে সৃষ্টি করিলেন। মাটির দেহ সৃষ্টি করিয়া চল্লিশ দিন রাখিয়া দিলেন। তখন ইবলীস আসিয়া তাহাকে লাথি মারিয়া ওলট-পালট করিয়া দেখিত যে, কোথাও ফাঁপা রহিয়াছে কিনা। যেহেতু উহা من صلصال كلفخار ছিল অর্থাৎ দোআঁশ মাটির গড়া পাত্রবৎ ছিল, তাই উহা আঘাত পাইয়া আওয়ার্জ করিত। তখন ইবলীস উহার মুখ দিয়া ঢুকিয়া মলদ্বার দিয়া বাহির হইত এবং মলদ্বার দিয়া ঢুকিয়া মুখ দিয়া বাহির হইত। অতঃপর বলিত, তুমি কোন বস্তুই নহ। কারণ, তোমাকে নগণ্য এঁটেল মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হইয়াছে ৷ আমি যদি তোমার উপর কর্তৃত্ব পাই, তাহা হইলে অবশ্যই আমি তোমাকে অমান্য করিব। অতঃপর যখন আল্লাহ তাহার ভিতর প্রাণ প্রবিষ্ট করাইলেন, উহা যেহেতু মাথার দিক হইতে প্রবিষ্ট হইয়াছে, তাই পূর্ণ দেহ তখনও সক্রিয় হয় নাই। শুধু সর্বাঙ্গে গোশত ও রক্ত সৃষ্টি হইতেছিল। যখন প্রাণ নাভি পর্যন্ত পৌছিল, তখন আদম (আঃ) নিজ দেহের দিকে তাকাইয়া অবাক হইলেন এবং তখনই উঠার জন্য চেষ্টা করিলেন, কিন্তু তাহা পারিলেন না। তাই আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

و كان الانسان عجولا “মানুষ বড়ই তাড়াহুড়া প্রিয় সৃষ্টি।” (১৭ : ১১) অর্থাৎ ভাল-মন্দ কোন ক্ষেত্রেই তাহার ধৈর্য থাকে না।

অবশেষে যখন সর্বাঙ্গে প্রাণ সঞ্চারিত হইল, তখন তিনি হাঁচি দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ পাকের ইঙ্গিত ‘আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল আলামীন’ বলিলেন। জবাব আল্লাহ পাক বলিলেন, “য়্যারহামুকাল্লাহু য়্যা আদম।’

অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা ইবলীস ও তাহার সঙ্গী ফেরেশতাগণকে (আকাশে অবস্থানকারী ফেরেশতাগণকে নহে) হুকুম দিলেন- ‘আদমকে সিজদা কর।’ তখন ইবলীস ছাড়া সকল ফেরেশতাই সিজদা করিলেন, শুধু ইবলীস দম্ভভরে উহা অস্বীকার করিল। যখন তাহার অন্তরে অহংকার ও বড়াই জাগ্রত হইল, তখন সে বলিল, আমি তাহাকে সিজদা করিব না। আমি তো তাহা হইতে উত্তম। আমি তাহার বয়ঃজ্যেষ্ঠ। সৃষ্টির দিক দিয়াও আমি অধিক শক্তিশালী। তাহাকে মাটি দ্বারা সৃষ্টি করা হইয়াছে এবং আমাকে সৃষ্টি করা হইয়াছে আগুন দ্বারা। আর আগুন মাটি হইতে শক্তিশালী।

ইবলীস যখন সিজদা দিতে অস্বীকার করিল, আল্লাহ্ তা’আলা তখন তাহাকে ইবলীস বলিয়া আখ্যা দিলেন অর্থাৎ সমস্ত কল্যাণ হইতে বিদূরিত ও বঞ্চিত করিলেন। অনন্তর তাহার নাফরমানীর শাস্তিস্বরূপ তাহাকে বিতাড়িত শয়তানে পরিণত করিলেন।

অতঃপর এইসব বস্তু ইবলীসের সঙ্গী অগ্নিসৃষ্ট ফেরেশতাদের সামনে পেশ করিয়া আল্লাহ্ তা’আলা বলিয়াছেন, ‘আমি পৃথিবীতে খলীফা সৃষ্টি করিব না, তোমাদের এই ধারণা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে এইগুলির নাম বল।’

উক্ত ফেরেশতারা যখন জানিতে পাইলেন যে, না জানিয়া শুনিয়া ভবিষ্যতের গায়বী কথা বলায় আল্লাহ্ তা’আলা নারাজ হইয়াছেন, তখন তাহারা সবাই বলিলেন- আল্লাহ ছাড়া কেহ গায়বী কথা জানে এরূপ অপবিত্র ধারণা হইতে আমরা আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করিতেছি। মূলত আপনি যাহা শিখাইয়াছেন তাহা ছাড়া আমাদের অন্য কোন জ্ঞান নাই। আপনি তো যাহা শিখাইবার তাহা আদমকে শিখাইয়াছেন। তখন তিনি বলিলেন- হে আদম, তাহাদিগকে এইগুলির নাম বলিয়া দাও। যখন আদম (আঃ) সেইগুলির নাম বলিয়া দিলেন, তখন আল্লাহ্ তা’আলা বলিলেন- হে প্রশ্নকারী ফেরেশতাকুল! আমি কি বলি নাই যে, আমি আসমান যমীনের সকল গায়েবী খবর খুব ভালভাবেই জানি এবং আমি ছাড়া তাহা আর কেহ জানে না ৷ তাই তোমরা যাহা প্রকাশ কর তাহা যেমন জানি, তেমনি জানি তোমরা যাহা প্রকাশ কর না তাহাও। অর্থাৎ ইবলীসের অন্তর্নিহিত দম্ভ ও অহংকারের খবরও রাখি।

উপরোক্ত হাদীসটি গরীব। ইহার ভিতরে এমন কিছু কথা আছে যাহা প্রশ্নাতীত নহে। মশহুর তাফসীরে এই সনদে হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে হাদীস বর্ণিত হইয়াছে।

আস্ সুদ্দী তাঁহার তাফসীরে আবূ মালিক হইতে, তিনি আবূ সালেহ হইতে, তিনি ইব্‌ন আব্বাস ও মুরা হইতে, তাঁহারা ইবন মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবা (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ

“আল্লাহ্ তা’আলা যখন তাঁহার পছন্দনীয় সৃষ্টি সম্পন্ন করিয়া আরশে সমাসীন হইলেন, তখন ইবলীসকে আসমান ও যমীনের আধিপত্য প্রদান করিলেন। সে ফেরেশতা ছিল। জান্নাতের খাজাঞ্চীখানার দায়িত্ব তাহার উপর ন্যস্ত ছিল বলিয়া তাহাকে জ্বিন বলা হইত ৷ এই বিশাল দায়িত্বভার তাহার অন্তরে এই গর্ব সৃষ্টি করিল যে, ফেরেশতাদের উপর তাহার শ্রেষ্ঠত্ব রহিয়াছে বলিয়াই আল্লাহ্ তা’আলা তাহাকে এত বড় দায়িত্ব দিয়াছেন। অন্তর্যামী ইহা জানিতে পাইয়া ফেরেশতাগণকে ডাকিয়া বলিলেন- অবশ্যই আমি পৃথিবীতে খলীফা সৃষ্টি করিব। তাঁহারা প্রশ্ন করিলেন, প্রভু হে, সেই খলীফা কিরূপ হইবে? তিনি বলিলেন, তাহার সন্তান-সন্ততি হইবে, তাহারা পারস্পরিক হিংসায় লিপ্ত হইয়া একে অপরকে হত্যা করিবে। তাহারা তখন বলিলেন, পরোয়ারদেগার, আপনি কেন এরূপ ফাসাদ ও রক্তারক্তি সৃষ্টিকারী খলীফা পৃথিবীতে পাঠাইবেন? আমরাই তো আপনার প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনার জন্য রহিয়াছি। তিনি বলিলেন, নিশ্চয় আমি তাহাও জানি যাহা তোমরা জান না। অর্থাৎ তোমাদের ইবলীসের অবস্থাও জানি।

অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা পৃথিবী হইতে মাটি আনার জন্য জিবরাঈল (আঃ)-কে পাঠাইলেন। পৃথিবী বলিল, তুমি আমাকে মাটি কমাইয়া সংকুচিত করিবে, ইহা হইতে আল্লাহর কাছে পানাহ্ চাই। তখন জিবরাঈল (আঃ) মাটি না নিয়া ফিরিয়া আসিলেন এবং আরয করিলেন, পরোয়ারদেগার, পৃথিবী তোমার কাছে পানাহ্ চাওয়ায় আমি তাহাকে পানাহ্ দিয়াছি। অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা মিকাঈল (আঃ)-কে পাঠাইলেন। তাঁহার কাছেও পৃথিবী অনুরূপ বলায় তিনিও ফিরিয়া আসিলেন এবং জিবরাঈল (আঃ)-এর মত একই ওজর পেশ করিলেন। অতঃপর মালিকুল মউত আযরাঈল (আঃ)-কে পাঠানো হইল। তাঁহার কাছেও পৃথিবী পূর্বানুরূপ বলিল। তখন তিনি বলিলেন, ‘আমিও আল্লাহ্ তা’আলার কাছে তাঁহার হুকুম পালন না করিয়া ফিরিয়া যাওয়া হইতে পানাহ চাহিতেছি। এই বলিয়া তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের লাল, সাদা, কালো ইত্যাদি রঙের মাটি একত্র করিয়া লইয়া ‘গেলেন। এই কারণে আদম সন্তানগণ বিভিন্ন রঙের হইয়াছে।

অতঃপর মাটিক ছানিয়া খামীরা বানানো হইল এবং ফেরেশতাগণকে বলা হইল— আমি মাটি দ্বারা মানুষ গড়িতেছি। যখন সঠিকভাবে গড়া হইবে এবং উহাতে আমি প্রাণ সঞ্চার করিব, তখন তোমরা উহাকে সিজদা করিবে। আয়াতঃ

إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ طِينٍ – فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ ساجدين

অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা নিজ হাতে আদমকে গড়িলেন। উদ্দেশ্য ইবলীস যেন আদম সৃষ্টির ব্যাপার লইয়া কোনরূপ অহংকারের সুযোগ না পায়। আদমের দেহ গড়িয়া চল্লিশ বছর রাখিয়াছিলেন। ফেরেশতারা তাহা দেখিয়া চমকিয়া উঠিল। তাহাদের মধ্যে ইবলীস বেশী অস্থির হইল। সে যখন উহার পাশ দিয়া যাইত, তখন আঘাত করিত। সঙ্গে সঙ্গে উহা পাতিল, হাঁড়ির মত আওয়াজ করিত। তখন সে বলিত, মাটি ছানিয়া ইহা কি বস্তু বানানো হইয়াছে? অতঃপর সে উহার মুখ দিয়া ঢুকিয়া পশ্চাৎদ্বার দিয়া বাহির হইত। অতঃপর ফেরেশতাগণকে বলিত, ইহা হইতে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। তোমাদের প্রভু অভাবমুক্ত এবং ইহা পেট সর্বস্ব। যদি আমি ইহার উপর আধিপত্য লাভ করি, তাহা হইলে ধ্বংস করিয়া ফেলিব।

অতঃপর যখন আল্লাহ্ তা’আলা আদমের দেহে প্রাণ সঞ্চারের ইচ্ছা করিলেন, তখন ফেরেশতাগণকে বলিলেন- যখন আমি উহাতে আমার প্রাণ হইতে প্রাণ সঞ্চার করিব, তখন তোমরা উহাকে সিজদা করিবে। যখন উহার রূহ মস্তিষ্কে প্রবিষ্ট হইল, তখন আদম হাঁচি দিলেন। তখন ফেরেশতারা তাঁহাকে ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলিতে বলিলেন, তিনি আলহামদু লিল্লাহ বলিলেন। আল্লাহ্ তা’আলা বলিলেন- য়্যারহামুকা রব্বুকা। যখন তাহার চক্ষুদ্বয়ে প্ৰাণ সঞ্চারিত হইল, তখন তিনি বেহেশতের ফল-মূল দেখিতে পাইলেন। যখন তাঁহার পেটে প্রাণ প্রবিষ্ট হইল, তখন ক্ষুধার্ত হইয়া জান্নাতের ফল-মূল খাইতে উদ্যোগী হইলেন। অথচ তখনও তাঁহার পদদ্বয়ে প্রাণ সঞ্চারিত হয় নাই। তাই আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

خلق الانسان من عجلٍٍ (মানুষকে তাড়াহুড়া-প্রিয় করিয়া গড়া হইয়াছে। তখন একমাত্র ইবলীস ছাড়া সকল ফেরেশতা সিজদা করিলেন। সে দম্ভভরে অস্বীকার করিল এবং কাফির হইল। আল্লাহ্ তা’আলা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন- আমার নির্দেশ সত্ত্বেও কোন্ বস্তু তোমাকে আমার স্বহস্তে গড়া সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সিজদা হইতে বিরত রাখিয়াছে? সে জবাব দিল- আমি তাহা হইতে উত্তম। তুমি যাহাকে মাটি দিয়া গড়িয়াছ, তাহাকে আমি সিজদা করিতে পারি না। আল্লাহ্ তা’আলা তখন তাহাকে বলিলেনঃ

اخْرُجُ مِنْهَا فَمَا يَكُونُ لَكَ

 (জান্নাত হইতে বাহির হইয়া যাও। উহা তোমার জন্য নহে।)

তারপর বলিলেনঃ

إن تَتَكْبَّرَ فيّْهًا فَاخْرَج انَّكَ.من الصاغريْنَ (জান্নাতে থাকিয়া যদি তুমি বড়াই কর, তাহা হইলে বাহির হইয়া যাও এবং লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভুক্ত হও।)

অতঃপর তিনি আদম (আঃ)-কে সকল কিছুর পরিচয় শিখাইয়া সেইগুলি ফেরেশতাদের নিকট পেশ করিয়া বলিলেন- বনী আদম দুনিয়াতে শুধু ফিতনা-ফাসাদ আর খুন-খারাবী করিবে, তোমাদের এই জানা যদি সত্য হয় তাহা হইলে এইগুলির পরিচয় দাও।

তখন তাহারা বলিলেন- আপনি পবিত্র। আপনি যাহা শিখাইয়াছেন তাহা ছাড়া আমাদের আর কোন বিদ্যা নাই। নিশ্চয় আপনি সর্বজ্ঞ ও শ্রেষ্ঠতম কুশলী।

আল্লাহ্ তা’আলা তখন বলিলেন, হে আদম! তুমি তাহাদিগকে এইগুলির পরিচয় বলিয়া দাও । যখন সে তাহাদিগকে উহা বলিয়া দিল, তখন তিনি ফেরেশতাদিগকে বলিলেন- আমি কি তোমাদিগকে বলি নাই যে, নিশ্চয় আমি আসমান যমীনের অদৃশ্য খবর রাখি এবং তোমরা যাহা প্রকাশ কর ও গোপন রাখ, সকল কিছুই আমি ভালভাবে জানি।

বর্ণনাকারী বলেন- তাহাদের প্রকাশ্য কথা হইল, ‘আপনি কি পৃথিবীতে তাহাদিগকে সৃষ্টি করিবেন যাহারা ফাসাদ ও রক্তারক্তি করিবে?’ আর তাহাদের অপ্রকাশ্য কথা হইল ইবলীসের অন্তরে লুকানো অহংকার।

আস্ সুদ্দীর তাফসীরে উক্ত সাহাবায়ে কিরামের বরাতে উদ্ধৃত এই হাদীসটি মশহুর বটে; কিন্তু ইহার ভিতর কিছু কিছু ইসরাঈলী বর্ণনা রহিয়াছে। সম্ভবত ইহাতে ‘মুদরাজ’ অর্থাৎ বর্ণনাকারীর কিছু বক্তব্যও প্রবিষ্ট হইয়াছে যাহা সাহাবাদের বক্তব্য নহে। অথবা উহা পূর্ববর্তী কোন গ্রন্থ হইতে তাঁহারা গ্রহণ করিয়াছেন। হাকিম তাঁহার ‘মুস্তাদরাক’ সংকলনে একই সনদে উহা উদ্ধৃত করিয়া বলিয়াছেন- হাদীসটি বুখারীর শর্ত পূরণ করিয়াছে।

মোটকথা আল্লাহ্ তা’আলা যখন আদম (আঃ)-কে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাগণকে নির্দেশ দিলেন, তখন ইবলীসও সেই নির্দেশের আওতায় ছিল। যদিও সে নূরসৃষ্ট ফেরেশতা ছিল না। তথাপি ফেরেশতাদের এক গোত্রভুক্ত ছিল এবং কার্যত তাহাদের সদৃশ ছিল । সুতরাং উক্ত নির্দেশ তাহার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল এবং এই কারণেই তাঁহার নির্দেশ অমান্যটি নিন্দনীয় হইয়াছে। এই ব্যাপারে ইনশাআল্লাহ ال ابليس كان من الجن فَفُسق عن أمر ر به আয়াতের তাফসীরে আমি সবিস্তারে আলোচনা করিব।

এই কারণে মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক খাল্লাদ হইতে, তিনি আতা হইতে, তিনি তাউস হইতে ও তিনি ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ ‘ইবলীস নাফরমান হওয়ার আগে ফেরেশতা ছিল। তাহার নাম ছিল আযাযীল। তবে সে পৃথিবীর বাসিন্দা ছিল। ইলম ও ইজ্জতের ফেরেশতাকুল শ্রেষ্ঠ ছিল। ইহাই তাহাকে অহংকারী করিল। ফেরেশতাদের জ্বিন গোত্রে সে জন্ম নিয়াছে।

অন্য এক রিওয়ায়েতেও খাল্লাদ আতা হইতে, তিনি তাউস হইতে, তিনি মুজাহিদ হইতে ও তিনি আব্বাস (রাঃ) হইতে অনুরূপ বর্ণনা করেন।

ইব্‌ন আবূ হাতিম বলেন, আমাকে আমার পিতা, তাঁহাকে সাঈদ ইব্‌ন সুলায়মান, তাঁহাকে উবায়দ অর্থাৎ ইবনূল আওয়াম, সুফিয়ান ইব্‌ন হুসাইন হইতে, তিনি ইয়ালী ইব্‌ন মুসলিম হইতে, তিনি সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র হইতে ও তিনি ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ ইবলীসের নাম ছিল আযাযীল। সে ফেরেশতাদের সর্দার ও চারিপাখা বিশিষ্ট ছিল। অতঃপর ইবলীস হইল।

সুনায়দ হাজ্জাজ হইতে ও তিনি ইব্‌ন জুরায়জ হইতে বর্ণনা করেন যে, ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) বলিয়াছেনঃ ইবলীস ফেরেশতাদের সর্বমান্য সর্দার ছিল। সে বেহেশতের কোষাধ্যক্ষ ছিল। আসমান-যমীনের উপর তাহার পূর্ণ আধিপত্য ছিল।

যিহাক ও অন্যান্য বর্ণনাকারীও হযরত ইবন আব্বাস (রাঃ) হইতে অনুরূপ বর্ণনা করেন।

আত তাওআমার ভৃত্য সালেহ ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেন- ফেরেশতাদের জ্বিন নামে একটি গোত্র আছে। ইবলীস সেই গোত্রের ফেরেশতা। আসমান ও যমীনে তাহার আধিপত্য ছিল। যখন সে নাফরমান হইল, তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাহা লোপ করিয়া তাহাকে বিতাড়িত শয়তানে পরিণত করিলেন।

এই বর্ণনাটি ইন জারীরের। সাঈদ ইব্‌ন মুসাইয়্যেব হইতে কাতাদাহ বর্ণনা করেন- ইবলীস পয়লা আকাশের ফেরেশতাদের সর্দার ছিল।

ইন জারীর বলেন- আমাকে মুহাম্মদ ইব্‌ন বাশার, তাহাকে আলী ইব্‌ন আবূ আদী, তিনি আওফ হইতে, তিনি আল হাসান হইতে বর্ণনা করেন- ইবলীস কখনও ফেরেশতা ছিল না ৷ মাটির সৃষ্টি আদমের মতই সে হইল অগ্নিসৃষ্ট জ্বিন। অর্থাৎ মানুষ যেরূপ ফেরেশতা নহে, জ্বিন ও তেমনি ফেরেশতা নহে।

আল-হাসান হইতে ইহা বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত। আবদুর রহমান ইব্‌ন যায়দ আসলামও অনুরূপ বর্ণনা করেন।

শহর ইব্‌ন হাওশাব বলেন- ফেরেশতারা যেই জ্বিন জাতিকে ধ্বংস করিয়াছে, ইবলীস তাহাদেরই একজন। ফেরেশতারা তাহাকে লুকাইয়া আসমানে লইয়া গিয়াছিল। ইব্‌ন জারীরও ইহা বর্ণনা করেন।

সুনায়দ ইব্‌ন দাউদ বলেন- আমাকে হাশিম, তাহাকে আবদুর রহমান ইব্‌ন ইয়াহিয়া, মূসা ইবন নুসায়র ও উসমান ইব্‌ন সাঈদ ইব্‌ন কামিল হইতে, তাহারা সা’দ ইব্‌ন মাসউদ হইতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেনঃ

“ফেরেশতারা যখন জ্বিনদের সহিত লড়াই করিতেছিল, ইবলীস তখন শিশু ছিল। তখন ফেরেশতারা তাহাকে সঙ্গে নিয়া গেলেন যেন সে তাহাদের সংশ্রবে ইবাদতগার হয় । কিন্তু আদমকে যখন সিজদা করার হুকুম আসিল, তখন সে অস্বীকার করিয়া বসিল।

তাই আল্লাহ্ তা’আলা বলিলেনঃ

الا ابليس كان من الجن (ইবলীস ছাড়া (সকলেই সিজদা করিল)। সে ছিল জ্বিন। ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ক্রমাগত ইকরামা, জনৈক ব্যক্তি, শরীক, আবূ আসিম, মুহাম্মদ ইবন সিনান ও ইব্‌ন জারীর বর্ণনা করেনঃ

“আল্লাহ্ তা’আলার সৃষ্ট এক শ্রেণীকে তিনি নির্দেশ দিলেন, আদমকে সিজদা করার জন্য। তাহারা অস্বীকার করিলে তিনি আগুন পাঠাইয়া তাহাদিগকে ভস্মীভূত করিলেন। অতঃপর আরেকদল সৃষ্টি করিয়া তাহাদিগকেও অনুরূপ আদেশ করায় তাহারাও অস্বীকার করিল। তাই তাহাদিগকেও আগুনে ভস্মীভূত করা হইল। অবশেষে তাহাদিগকে আবার সৃষ্টি করিয়া অনুরূপ আদেশ করিলে তাহারা সকলেই সিজদা করিল। শুধু ইবলীস অস্বীকার করিল। মূলত সে অস্বীকারকারী সৃষ্টিরই একজন ছিল।

এই হাদীসটি শুধু ‘গরীব’ই নহে, ইহার সূত্র ও ত্রুটিপূর্ণ। এই সনদে একজন অজ্ঞাতনামা বর্ণনাকারী রহিয়াছে। এই ধরনের সূত্র কখনও দলীল হইতে পারে না। আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ। ইব্‌ন আবূ হাতিম বলেন- আমাকে আবূ সাঈদ আল আশাজ্জ, তাঁহাকে আবূ উসামা, তাঁহাকে সালেহ হাইয়ান ও তাঁহাকে আবদুল্লাহ ইব্‌ন বুরাইদা বলেনঃ

وكان من الكفرين অর্থাৎ যাহারা অস্বীকার করিয়া ভস্মীভূত হইয়াছে।

আবুল আলীয়া হইতে রবী’ ও তাহার নিকট হইতে আবূ জামির (রাঃ) বলেনঃ

وكَان من الكفرين অর্থ, অর্থাৎ নাফরমানদের একজন।

وكَان من الكفرين আয়াতাংশের তাৎপর্য সম্পর্কে আস্ সুদ্দী বলেন- সেইদিন যাহাদিগকে আল্লাহ্ তা’আলা ধ্বংস করেন নাই তাহারা এবং তাহাদের পরবর্তী বংশধরগণ। মুহাম্মদ ইব্‌ন কা’ব আল-করযী বলেন- আল্লাহ্ তা’আলা ইবলীসকে প্রথমে কুফরীর উপরে সৃষ্টি করেন। অতঃপর ফেরেশতার সাহচর্যে ভাল কাজ করে। অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা তাহাকে মূল অবস্থায় ফিরাইয়া দেন। তাই আল্লাহ্ তা’আলা বলিলেনঃ وكَان من الكفرين অর্থাৎ সে আগেও কাফির ছিল।

وان قُلْنَا للْمَلئكّة اسجدوا ادم আয়াত সম্পর্কে কাতাদাহ বলেন- আনুগত্য ছিল আল্লাহর জন্য এবং সিজদা ছিল আদমের জন্য। ফেরেশতাগণকে দিয়া সিজদা করাইয়া আল্লাহ্ আদমকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় ভূষিত করিলেন। একদল বলেন- উক্ত সিজদা ছিল সম্মানের সিজদা (ইবাদতের সিজদা নহে)। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

وَرَفَعَ أَبْوَيْهِ عَلَى الْعَرْشِ وَخَرُّوا لَهُ سُجَّدًا

‘সে (ইউসুফ) তাহার পিতামাতাকে সিংহাসনে উঠাইল এবং তাহারা সকলেই সিজদাবনত হইল।’

এই সিজদা অতীতের উম্মতদের জন্য শরীয়তসম্মত ছিল। আমাদের এই উম্মতের জন্য উহা নিষিদ্ধ হইয়াছে।

মু’আয (রাঃ) বলেন- সিরিয়ায় গিয়া দেখিলাম, সেখানে উলামায়ে কিরাম ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে সিজদা দানের প্রচলন রহিয়াছে। তাই বলিলাম- ইয়া রাসূলাল্লাহ! সিজদা লাভের বেশী যোগ্য তো আপনি। রাসূল (সাঃ) বলিলেন- না। যদি আমি মানুষের জন্য মানুষকে সিজদা দান বৈধ করিতাম, তাহা হইলে স্ত্রীর জন্য স্বামীকে সিজদা দানের নির্দেশ দিতাম। কারণ, সে অধিকতর হকদার।

ইমাম রাযী উপরোক্ত ব্যাখ্যাকেই প্রাধান্য দিয়াছেন। একদল বলেন- সিজদা ছিল আল্লাহ্ তা’আলার জন্য এবং আদম (আঃ)-কে কিবলা বানানো হইয়াছিল। যেমন আল্লাহ্ পাক বলেনঃ 

أقم الصلوة لدلُوك الشّمس (সূর্য ঢলিয়া পড়িলে নামায পড়।

অবশ্য এই উপমাটি প্রশ্নাতীত নহে। মূলত প্রথম মতটিই উত্তম। আদমকে সিজদা দেওয়া হইয়াছে সম্মান প্রদর্শন ও প্রণতি জ্ঞাপনের জন্য এবং উহার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত সম্পন্ন হইয়াছে। ইমাম রাযী তাঁহার তাফসীরে এই মতটির উপর জোর দিয়াছেন এবং বিপরীত মত দুইটিকে দুর্বল প্রতিপন্ন করিয়াছেন। কারণ, কিবলা বানানোর মধ্যে মর্যাদা প্রকাশের ব্যাপার অনুপস্থিত। দ্বিতীয়ত, শুধুমাত্র বিনয় প্রকাশের জন্য মাটিতে মাথা ঠেকানোর ব্যাপারটিও দুর্বল।

فُسَجَدوا الا ابليُس أبلى وَاسَتَكْيَرَ وَكَانَ من الكفر ين আয়াত সম্পর্কে কাতাদাহ বলেন- আল্লাহ্ তা’আলা আদমকে যে মর্যাদা দান করিলেন, আল্লাহর দুশমন ইবলীসের উহাতে হিংসার উদ্রেক হইল। সে বলিলঃ আমি অগ্নিসৃষ্ট আর সে হইল মৃত্তিকাসৃষ্ট। আদি পাপ হইল অহংকার। অহংকারের কারণেই সে আদমকে সিজদা করিতে অস্বীকার করিল।

আমি বলি সহীহ হাদীসে আছেঃ

لا يدخل الجنة من كان في قلبه مثقال حبة من خردل من كبر

অর্থাৎ যাহার অন্তরে সরিষা বরাবর অহংকার আছে সে বেহেশতে যাইবে না। ইবলীসের অন্তর কুফর, হিংসা ও অহংকারপূর্ণ ছিল। এই কারণেই সে আল্লাহর রহমতের দরবার হইতে বিতাড়িত হইল।

কোন কোন আরবী ভাষাবিদ বলেনঃ وكان من الكفرين অর্থাৎ وصار من الكافرين (সে কাফির হইল)। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ فكان من المفرقين (সে নিমজ্জিতদের অন্তর্ভুক্ত হইল) কিংবা فَتَكُون من الظلمين তাহা হইলে তোমরা আত্মপীড়ক হইবে)। কবি বলেনঃ

يتيهاء قفر والمطى كائها * قطاالحزن قد كانت فراخا بيوضها

এখানেও صارت অর্থে كانت লওয়া হইয়াছে।

ইবন ফাওরাক বলেন- উহার তাৎপর্য হইল এই যে, তাহার কুফরী আল্লাহর ইলমে বিদ্যমান ছিল। ইমাম কুরতুবী এই মতটিকে প্রাধান্য দিয়াছেন এবং এখানে তিনি একটি মাসআলার উল্লেখ করিয়াছেন। আমাদের আলিমগণ বলেনঃ নবী ছাড়া যাহারা কারামাত ও অলৌকিক ব্যাপার প্রদর্শন করিয়া থাকে, তাহা তাহাদের ওলী হওয়ার দলীল হয় না। কোন কোন সূফী ও রাফেযী বিপরীত মত পোষণ করেন। তেমনি অলৌকিক ব্যাপার প্রদর্শন ঈমানের পরিপূর্ণতারও দলীল নহে। ইবলীস বহু অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হইয়াও কাফির ছিল।

এক্ষেত্রে আমার অভিমত হইল— এই ওলী ছাড়াও অন্য কেহ অলৌকিক ব্যাপার প্রদর্শন করিতে পারে। এমনকি কাফির, ফাসিক দ্বারাও উহা সম্ভব । ইব্‌ন সাইয়াদ কাফির হইয়াও তাহা করিয়াছিল।

فَارْتّقب يَوْمْ تأت السماء بدخان مَبِيْنٍ আয়াতটি নাযিল হইলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উহা প্রকাশ না করিয়া ইবন সাইয়াদকে প্রশ্ন করিলেন- বল তো আমার অন্তরে কি লুকানো রহিয়াছে? সে তক্ষুণি জবাব দিল ‘আদ্ দুখ’। তেমনি সে যখন ক্রুব্ধ হইত তখন তাহার দেহ স্ফীত হইয়া পথ রুদ্ধ করিয়া-ফেলিত। আবদুল্লাহ ইবন উমর (রাঃ) তাহাকে হত্যা করেন। বহু হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত যে, দজ্জাল অনেক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হইবে। তাহার নির্দেশে আকাশ বৃষ্টি বর্ষণ করিবে, পৃথিবী শস্য উৎপন্ন করিবে, খনিগুলি খনিজদ্রব্য উৎক্ষিপ্ত করিবে, এমনকি সে এক যুবককে হত্যা করিয়া পুনর্জীবিত করিবে ইত্যাদি।

ইউনুস ইব্‌ন আব্দুল আ’লা আস্ সদফী বলেন, ইমাম শাফেঈ (রঃ)-কে বলিলাম যে, লায়ছ ইব্‌ন সা’দ বলেন- তুমি যদি কোন ব্যক্তিকে পানির উপর দিয়া হাঁটিতে কিংবা হাওয়ায় উড়িতে দেখ, তাহা হইলেও কুরআন সুন্নাহর সহিত তাহার কার্যকলাপ না মিলাইয়া উহাতে মুগ্ধ হইও না। ইমাম শাফেঈ (রঃ) বলিলেন- লায়ছ ইব্‌ন সা’দ (রঃ) ঠিকই বলিয়াছেন, তবে কিছু কম বলিয়াছেন।

ইমাম রাযী প্রমুখ সিজদাকারীগণ সম্পর্কে আলিমদের দুইটি মত উদ্ধৃত করিয়াছেন। আদম (আঃ)-কে সিজদা দানের নির্দেশ কি শুধু পৃথিবীর ফেরেশতাগণের জন্য নির্দিষ্ট ছিল, না আকাশ ও পৃথিবীর সকল ফেরেশতার জন্য ছিল? যদিও একদল আলিম শুধু পৃথিবীর ফেরেশতাদের জন্য উক্ত নির্দেশ নির্দিষ্ট বলিয়া অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন, তথাপি উহা দুৰ্বল অভিমত। পাক কালামের প্রকাশ্য বক্তব্য সকল ফেরেশতাকে উক্ত নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত করিয়াছে। যেমনঃ

فسجد الْملائكَة كُلَّهُمْ أجمعون الا ابليس (একমাত্র ইবলীস ছাড়া সকল ফেরেশতাই সমবেতভাবে সিজদা প্রদান করিয়াছে।)

উক্ত নির্দেশটি ব্যাপক হওয়ার পক্ষে চারিটি যুক্তিযুক্ত কারণ রহিয়াছে। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।

আদম (আ)-এর পরীক্ষা ও পদস্খলন

(٣٥)

وَقُلْنَا يَا دَمُ اسْكُنْ اَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ وَكُلَا مِنْهَا رَغَدًا حَيْثُ شِئْتُمَاء وَلَا تَقْرَبَا هذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُونَا مِنَ الظَّلِمِينَ

(٣٦)

فَازَلَهُمَا الشَّيْطَنُ عَنْهَا فَأَخْرَجَهُمَا مِمَّا كَانَا فِيهِ وَقُلْنَا اهْبِطُوا بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ وَلَكُمْ فِي الْأَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَ مَتَاعُ إِلَى حِينٍ

৩৫. আমি বলিলাম, ‘হে আদম! তুমি সস্ত্রীক জান্নাতে বসবাস কর ও মুক্তভাবে তোমাদের যাহা ইচ্ছা উহা হইতে ভক্ষণ কর। তবে এই গাছটির কাছেও যাইও না ৷ তাহা হাইলে তোমরা আত্মপীড়কদের দলভুক্ত হইবে।

৩৬. অতঃপর শয়তান তাহাদের পদস্খলন ঘটাইল। অবশেষে তাহাদিগকে তাহাদের নিবাস হইতে বহিষ্কার করিল। আমি বলিলাম, ‘তোমরা সকলেই পরস্পর শত্রুরূপে অবতরণ কর। অনন্তর তোমাদের জন্য পৃথিবীতে কিছুদিন অবস্থান ও উহার সম্পদ ভোগ নির্ধারিত হইল।’

তাফসীরঃ আল্লাহ্ তা’আলা আদম (আঃ)-কে কিরূপ মর্যাদা দিয়াছিলেন, এখানে সেই সংবাদ প্রদান করেন। আদম (আঃ)-কে আল্লাহর নির্দেশে ইবলীস ছাড়া সকল ফেরেশতাই সিজদা করিলেন। অতঃপর তিনি আদম (আঃ)-এর সস্ত্রীক অবস্থানের জন্য জান্নাত নির্ধারণ করিলেন এবং জান্নাতের যেখান হইতে যাহা ইচ্ছা মুক্তভাবে খাওয়ার জন্য অনুমতি দিলেন যেন যত যাহা ইচ্ছা তৃপ্তি মিটাইয়া খাইতে পারে।

হাফিজ আবূ বকর ইব্‌ন মারদুবিয়্যা মুহাম্মদ ইব্‌ন ঈসা আদ দামেগানী হইতে, তিনি সালামা ইব্‌ন ফযল হইতে, তিনি মিকাঈল হইতে, তিনি লায়ছ হইতে, তিনি ইবরাহীম আততায়মী হইতে, তিনি তাঁহার পিতা হইতে ও তিনি আবূ যর (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ

আবূ যর (রাঃ) বলেন- আমি প্রশ্ন করিলাম, হে আল্লাহর রাসূল, আদম (আঃ) কি নবী ছিলেন? তিনি জবাব দিলেন- হ্যাঁ, তিনি নবী ও রাসূল ছিলেন। আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার সহিত প্রকাশ্যে সরাসরি কথা বলিতেন। যেমনঃ أسكن أنث وزوجك الْحِخّة এর (তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর।)

আদম (আঃ) কোন্ জান্নাতে ছিলেন তাহা লইয়া মতভেদ দেখা দিয়াছে। সেই বেহেশত কি আকাশে বিদ্যমান, না পৃথিবীর কোথাও? অধিকাংশের মত উহা আকাশে। ইমাম কুরতুবী মু’তাযিলা ও কাদরিয়াদের মত উদ্ধৃত করিয়া বলেন- উহা পৃথিবীতে। ইনশাআল্লাহ সূরা আ’রাফে শীঘ্রই উহার সবিস্তার আলোচনা আসিতেছে।

আয়াতের বর্ণনাভঙ্গী বলিয়া দিতেছে, আদম (আঃ)-এর বেহেশতে প্রবেশের আগেই হাওয়া (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হইয়াছে। মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক উহার ব্যাখ্যাদান প্রসঙ্গে বলেন- আল্লাহ্ তা’আলা ইবলীসকে অভিশপ্ত করার পর আদম (আঃ)-এর দিকে মনোনিবেশ করিলেন। তিনি তাঁহাকে সকল কিছুর নাম পরিচয় জ্ঞাত করিলেন। অতঃপর বলিলেন- তাহাদিগকে এইগুলির নাম বলিয়া দাও… ইত্যাদি। বর্ণনাকারী বলেন- অতঃপর আদমকে তন্দ্রাচ্ছন্ন করা হইল এবং তাঁহার বাম পাঁজর হইতে একখানা হাড় নিয়া সেই স্থানটি গোশ্তপূর্ণ করা হইল। তখনও আদম নিদ্রিত ছিলেন। ইত্যবসরে উক্ত হাড় দ্বারা তাহার স্ত্রী হাওয়া (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হইল এবং তাহাকে যথাযথ রূপ দান করা হইল যেন আদম তাহার সাহচর্যে পরিতৃপ্ত থাকেন। যখন তাঁহার তন্দ্রাচ্ছন্নতা কাটিল এবং নিদ্রা হইতে জাগ্রত হইলেন, তখন হাওয়া (আঃ)-কে তাঁহার পাশে উপবিষ্ট দেখিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলিলেন আমার গোশত, আমার রক্ত ও আমার স্ত্রী।

এই সব বক্তব্য আহলে কিতাব ও আহলে ইলম যথা ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) প্রমুখ হইতে সংগৃহীত হইয়াছে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

তাহাকে দেখিয়া তিনি তৃপ্ত হইলেন। আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদিগকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করিলেন। তাই তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করিলেন- হে আদম, তুমি সস্ত্রীক জান্নাতে বসবাস কর এবং সেখান হইতে যাহা খুশী খাও। তবে এই গাছটির কাছেও যাইও না। তাহা হইলে জালিমদের অন্তর্ভুক্ত হইবে।

একদল বলেন, আদমের জান্নাতে প্রবেশের পর হাওয়াকে সৃষ্টি করা হইয়াছে। যেমন আস্ সুদ্দী আবূ মালিক হইতে, তিনি আবূ সালেহ হইতে, তিনি ইব্‌ন আব্বাস হইতে, তিনি মুররাহ্ হইতে, তিনি ইব্‌ন মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবা (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেন- ইবলীসকে জান্নাত হইতে বহিষ্কার করা হইল এবং আদমকে জান্নাতে রাখা হইল। তিনি সেখানে নিঃসঙ্গ চলাফেরা করিতেন, সাহচর্য ও তৃপ্তি দানের জন্য কোন স্ত্রী ছিল না। একবার গভীর নিদ্রামগ্ন হইলেন এবং জাগিয়া তাঁহার মাথার পাশেই এক নারীকে বসা দেখিতে পাইলেন। তাহাকে আদমেরই পাঁজরের হাড় হইতে আল্লাহ্ তা’আলা সৃষ্টি করিয়াছেন। আদম (আঃ) তাহাকে প্রশ্ন করিলেন, তুমি কে? হাওয়া (আঃ) বলিলেন- নারী। আদম (আঃ) প্রশ্ন করিলেন- কেন তোমাকে সৃষ্টি করা হইল? হাওয়া (আঃ) বলিলেন- আমার দ্বারা তৃপ্তি লাভের জন্য।

যেসব ফেরেশতারা ঘটনা প্রত্যক্ষ করিতেছিলেন, তাহারা প্রশ্ন করিলেন- হে আদম! উহার নাম কি? তিনি বলিলেন- হাওয়া। তাহারা বলিলেন- হাওয়া কেন হইল? তিনি জবাব দিলেন- উহা (حى) জীবিত কিছু হইতে সৃষ্টি বিধায় এই নাম হইয়াছে ৷

আল্লাহ্ তা’আলা তখন বলিলেনঃ

يَادَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ وَكُلاَ مِنْهَا رَغَدًا حَيْثُ شِئْتُمَا

ولا تَفْربًا هذه الشجرة অর্থাৎ আদমের জন্য আল্লাহ্র তরফ হইতে ইহা ছিল পরীক্ষা। উহা কোন্ বৃক্ষ তাহা লইয়া মতভেদ সৃষ্টি হইয়াছে। আস্ সুদ্দী অন্য এক রাবীর বরাতে ইন আব্বাস (রাঃ) হইতে এই হাদীস বর্ণনা করেন যে, আদম (আঃ)-এর জন্য যে গাছ নিষিদ্ধ হইল, তাহা আঙ্গুর গাছ। সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র আস্ সুদ্দী, আশ শা’বী, জা’দাহ ইব্‌ন হুবায়রাহ ও মুহাম্মদ ইব্‌ন কয়সও এই মত পোষণ করেন।

আস্ সুদ্দী আবূ মালিক হইতে, তিনি আবূ সালেহ হইতে, তিনি ইব্‌ন আব্বাস ও মুরাহ হইতে এবং তাঁহারা ইবন মাসউদ ও একদল সাহাবা (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেন- নিষিদ্ধ বৃক্ষটি হইল আঙ্গুর বৃক্ষ। ইয়াহুদীদের ধারণা- নিষিদ্ধ গাছটি গম গাছ।

ইব্‌ন জারীর ও ইব্‌ন আবূ হাতিম বলেনঃ আমাদিগকে মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসমাঈল ইব্‌ন সামারা আল আহমাসী, তাঁহাকে আবূ ইয়াহিয়া, তাঁহাকে আবূ নযর আবূ উমর আল খারায- ইকরামা হইতে, তিনি ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ নিষিদ্ধ গাছটি হইল সরিষা গাছ।

ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে পর্যায়ক্রমে সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র, মিনহাল ইব্‌ন আমর, আল-হাসান ইব্‌ন আম্মারা, ইবনুল আয়নিয়া ও আব্দুর রায্যাক বর্ণনা করেন- উহা সরিষা গাছ।

মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক জনৈক আলিম হইতে, তিনি হাজ্জাজ হইতে, তিনি মুজাহিদ হইতে

ও তিনি ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন- উহা গম গাছ।

ইব্‌ন জারীর বলেন, আমাকে মুছান্না ইবন ইবরাহীম, তাঁহাকে মুসলিম ইব্‌ন ইবরাহীম, তাঁহাকে আল কাসিম, তাঁহাকে বনু তমীমের এক ব্যক্তি বর্ণনা করেনঃ

ইবন আব্বাস (রাঃ) আবুল জুলদকে প্রশ্ন লিখিয়া পাঠাইলেন যে, কোন্ গাছ আদমের জন্য নিষিদ্ধ ছিল এবং কোন্ গাছের কাছে গিয়া তিনি তওবা করেন? তিনি জবাবে লিখিয়াছেন- প্রথমটি হইল সরিষা গাছ আর দ্বিতীয়টি হইল যয়তুন গাছ।

হাসান বসরী, ওহাব ইব্‌ন মুনাব্বিহ, আতিয়া আল আওফী, আবূ মালিক, মুহারিব ইব্‌ন দিছার ও আব্দুর রহমান ইব্‌ন আবূ লায়লাও অনুরূপ ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছেন।

মুহাম্মদ ইব্‌ন ইসহাক কোন এক ইয়ামানবাসী হইতে ও তিনি ওহাব ইব্‌ন মুনাব্বিহ হইতে বর্ণনা করেন- উহা গম গাছ। তবে উহা জান্নাতের বিশেষ ধরনের গম গাছ।

সুফিয়ান ছাওরী হেসীন হইতে ও তিনি আবূ মালিক হইতে বর্ণনা করেন- উহা খেজুর গাছ।

মুজাহিদের বরাত দিয়া ইব্‌ন জারীর বলেন, উহা তীন গাছ। কাতাদাহ ও ইব্‌ন জুরায়জ ও অনুরূপ বলিয়াছেন।

রবী’ ইব্‌ন আনাসের বরাতে আবুল আলীয়া হইতে আবূ জা’ফর আর-রাযী বলেন- উহা সেই বৃক্ষ যাহার ফল খাইলে অপবিত্রতা সৃষ্টি হয় এবং জান্নাতে অপবিত্রতা নিষিদ্ধ।

আবদুর রায্যাক বলেন- আমাকে উমর ইব্‌ন আবদুর রহমান ইবন মিহরান বলেনঃ আমি ওহাব ইব্‌ন মুনাব্বিহকে বলিতে শুনিয়াছি যে, আল্লাহ্ তা’আলা আদম (আঃ)-কে সস্ত্রীক বেহেশতে বসবাসের অনুমতি দিয়া যে গাছটির ফল খাইতে নিষেধ করিলেন, উহা শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট গাছ ছিল এবং ফেরেশতারা উহার ফল খাইয়া অমরত্ব লাভ করিত।

উক্ত গাছ সম্পর্কে তাফসীর গ্রন্থসমূহে উপরোক্ত ছয়টি মত দেখা যায়। ইমামুল আল্লামা আবূ জা’ফর ইব্‌ন জারীর (রঃ) বলেনঃ সঠিক কথা এই আল্লাহ্ তা’আলা আদম-হাওয়া (আঃ)-কে জান্নাতের নির্দিষ্ট একটি গাছের ফল খাইতে নিষেধ করিয়াছিলেন এবং তাঁহারা তাহা খাইয়াছিলেন। সেইটি কোন্ গাছ তাহা আমরা জানি না। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা কুরআনে এমন কোন প্রমাণ রাখেন নাই যদ্বারা বান্দারা উহার নাম জানিতে পারে। এমনকি সহীহ হাদীস হইতেও উহার প্রমাণ মিলে না। অবশ্য কেহ বলেন, গম গাছ; কেহ বলেন, আঙ্গুর গাছ; কেহ বলেন তীন গাছ ইত্যাদি। সুতরাং উহার যে কোন একটি হইতে পারে। তবে উহা জানিয়া যেমন কোন উপকার হয় না, তেমনি না জানিলেও কোন ক্ষতি হয় না। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। ইমাম রাযী এইভাবে তাঁহার তাফসীরে সংশয়ের সমাধান পেশ করিয়াছেন এবং ইহাই সঠিক কথা।

فَأَرلَّهُمَا الشَيْطنُ عَنْهًا আয়াতাংশের ها সর্বনামটি দ্বারা বেহেশত বুঝানো যাইতে পারে। তখন উহার অর্থ দাঁড়ায় فأز لَّهُمَا অর্থাৎ শয়তান তাহাদিগকে বেহেশতচ্যুত করিল। আসিম অনুরূপ পাঠ করিতেন। অথবা উহা দ্বারা নিকটতম বিশেষ্যটি বুঝানো যাইতে পারে ৷ তাহা হইল شجرة তখন অর্থ দাঁড়ায়, সেই গাছের কারণে তাহারা বেহেশতচ্যুত হইল। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা অন্যত্র বলিয়াছেনঃ يؤفك عنه من إفك এখানেও সর্বনাম কারণের সাথেই সংযুক্ত হইয়াছে।

তাই আল্লাহ্ তা’আলা বলিলেনঃ

فاخر جهما مما كانا فيه অর্থাৎ সুশোভন পরিচ্ছদ, আরামপ্রদ বাসস্থান, সুস্বাদু আহার্য ও সর্বাধিক সুখকর দ্রব্য হইতে তাহারা বঞ্চিত হইল।

وَقُلْنَا اهْبِطُوا بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ – وَلَكُمْ فِي الْأَرْضِ مُسْتَقَرُّ وَمَتَاعٌ إِلَى حين

অর্থাৎ অবস্থান, জীবিকা ও জীবন সীমিত ও নির্দিষ্ট হইবে। তারপর কিয়ামত সংঘটিত হইবে।

পূর্বসূরী তাফসীরকার আস্ সুদ্দী, আবুল আলীয়া, ওহাব ইব্‌ন মুনাব্বিহ প্রমুখ বিভিন্ন সনদে ইসরাঈলী বর্ণনা হইতে সাপ-ইবলীসের চমকপ্রদ কিসসা, ইবলীসের কৌশলে বেহেশতে প্রবেশ ও কুমন্ত্রণা প্রদানের কাহিনী সবিস্তারে বিবৃত করিয়াছেন। ইনশা আল্লাহ আমি উহা সূরা আ’রাফে বর্ণনা করিব। আল্লাহ পাক তওফীক দিবার মালিক।

ইব্‌ন আবূ হাতিম বলেন- আমাকে আলী ইব্‌ন আল-হাসান ইব্‌ন আশকাব, তাঁহাকে আলী ইব্‌ন আসিম, সাঈদ ইব্‌ন আবূ আরূরা হইতে, তিনি কাতাদাহ হইতে, তিনি আল হাসান হইতে ও তিনি উবাই ইবন কা’ব হইতে বর্ণনা করেনঃ

“উবাই ইব্‌ন কা’ব বলেন- রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলিয়াছেন যে, আল্লাহ্ তা’আলা আদম (আঃ)-কে দীর্ঘদেহী ও সতেজ খেজুর বৃক্ষের মত দীর্ঘ ঘন কেশ বিশিষ্ট করিয়া গড়িয়াছেন। যখন তিনি নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করিলেন, তখন আল্লাহ্ তাঁহাদের আচ্ছাদন উন্মুক্ত করিলেন। সেদিন প্রথম তাঁহার নগ্নতা প্রকাশ পাইল। যখন তিনি তাহা দেখিতে পাইলেন, তখন লজ্জায় জান্নাতে ছুটাছুটি শুরু করিলেন। ফলে তাঁহার দীর্ঘচুল গাছে জড়াইয়া গেল। তিনি যখন উহা ছাড়াইবার জন্য টানাটানি করিতেছিলেন, তখন আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহাকে বলিলেন- হে আদম! তুমি আমার নিকট হইতে পালাইতেছ? তিনি সহজ জবাব দিলেন- হে আমার প্রতিপালক! তাহা নহে, আমি লজ্জায় পালাইয়া ফিরিতেছি।

ইব্‌ন আবূ হাতিম বলেন- আমাকে জা’ফর ইব্‌ন আহমদ ইব্‌ন হাকাম আল করশী, তাঁহাকে সুলায়মান ইব্‌ন মনসূর ইব্‌ন আম্মার, তাঁহাকে আলী ইব্‌ন আসিম- সাঈদ হইতে তিনি কাতাদাহ হইতে ও তিনি উবাই ইব্‌ন কা’ব হইতে বর্ণনা করেন যে, উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) বলেনঃ

রাসূল (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘আদম (আঃ) নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খাইয়াই ছুটিতে লাগিলেন। তখন জান্নাতের গাছের সহিত তাহার চুল জড়াইয়া গেল। অমনি গায়বী আওয়াজ হইল- হে আদম! আমার নিকট হইতে পালাইতেছ? তিনি বলিলেন- আপনার লজ্জায় পালাইতেছি। তখন ; আল্লাহ পাক বলিলেন- হে আদম! তুমি আমার প্রতিবেশ হইতে বাহির হইয়া যাও। আমার ইজ্জতের কসম! আমার নাফরমান আমার প্রতিবেশী হইতে পারে না। তোমার মত আদম সৃষ্টি করিয়া যদি আমি পৃথিবী ভরিয়াও ফেলি আর তাহারা সবাই তোমার মত নাফরমান হয়, তাহা হইলে আমি তাহাদিগকে নাফরমানের নিবাসে ঠাঁই দেব।’

হাদীসটি ‘গরীব’ ও উহার সূত্রে কিছুটা বিচ্ছিন্নতাও রহিয়াছে। এমনকি কাতাদাহ ও উবাই ইব্‌ন কা’ব (রাঃ)-এর সাক্ষাৎকার অসম্ভব মনে করা হয়।

হাকিম বলেন- আমাকে আবূ বকর ইব্‌ন বাকবিয়া, মুহাম্মদ ইব্‌ন আহমদ ইব্‌ন নযর হইতে, তিনি মু’আবিয়া ইবন আমর হইতে, তিনি আম্মারা ইবন আবূ মুআবিয়া আল বাজালী হইতে, তিনি যায়েদাহ হইতে, তিনি সাঈদ ইবন জুবায়র হইতে ও তিনি ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ

‘হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) বলেন- আদম (আঃ) আসর হইতে মাগরিব পর্যন্ত যতটুকু সময় ততটুকু জান্নাতে ছিলেন।’

হাকিম বলেন, যদিও বুখারী মুসলিমে হাদীসটি উদ্ধৃত হয় নাই, তথাপি তাঁহাদের শর্তানুযায়ী উহা বিশুদ্ধ।

আবদুর রহমান ইব্‌ন হুমায়দ তাঁহার তাফসীরে উল্লেখ করেন- আমাকে রওহ, হিশাম হইতে, তিনি আল হাসান হইতে বর্ণনা করেনঃ আদম (আঃ) পৃথিবীর দিন হিসাবে একশ ত্রিশ বছর জান্নাতে ছিলেন।

রবী’ ইব্‌ন আনাস হইতে আবূ জা’ফর আর রাযী বর্ণনা করেনঃ আদম (আঃ) নয় কি দশ ঘটিকায় জান্নাত হইতে বহির্গত হন। তাঁহার হাতে ছিল জান্নাতী বৃক্ষের একটি শাখা ও মাথায় ছিল জান্নাতী পাতায় গড়া তাজ।

اهبطوا منْهًا جَميْعًا আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় আস্ সুদ্দী বলেনঃ ‘তাঁহারা সবাই পৃথিবীতে অবতরণ করিলেন। আদম (আঃ) ‘হাজরে আসওয়াদ’ ও জান্নাতের গাছের পাতা নিয়া ভারত উপমহাদেশে অবতরণ করেন। তিনি উক্ত গাছের পাতা ভারতময় ছড়াইয়া দেন। উহা হইতেই সুগন্ধী পাতার গাছ জন্ম নেয়। জান্নাত ত্যাগের সময় দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তিনি সেই পাতাগুলি ছিঁড়িয়াছিলেন।

ইমরান ইবল আয়নিয়া আতা ইবনুস সায়েব হইতে, তিনি সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র হইতে ও তিনি ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ

‘আদম (আঃ) ভারত উপমহাদেশের ‘দহনা’ নামক স্থানে অবতরণ করেন ৷’

ইব্‌ন আবূ হাতিম বলেন- আমাকে আবূ যরআ, তাঁহাকে উসমান ইব্‌ন আবূ শায়বা, তাঁহাকে জারীর, আতা হইতে, তিনি সাঈদ হইতে ও তিনি ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বৰ্ণনা করেনঃ ‘আদম (আঃ) মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী, ‘দহনা’ নামক স্থানে অবতরণ করেন।’

হাসান বসরী (রঃ)-এর সনদে ইব্‌ন আবূ হাতিম বলেনঃ ‘আদম (আঃ) ভারতে, হাওয়া (আঃ) জিদ্দায় ও ইবলিস বসরার কাছাকাছি দস্তামিসানে ও সাপটি ইস্পাহানে অবতরণ করে।’

মুহাম্মদ ইব্‌ন আবূ হাতিম বলেন- আমাকে মুহাম্মদ ইব্‌ন আম্মার ইবনুল হারিছ, তাঁহাকে মুহাম্মদ ইব্‌ন সাঈদ ইব্‌ন সাবিক, তাঁহাকে উমর ইব্‌ন আবূ কয়স- আবায়র ইব্‌ন আদী হইতে ও তিনি ইব্‌ন উমর (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ

‘আদম (আঃ) সাফায় ও হাওয়া (আঃ) মারোয়ায় অবতরণ করেন।’

রিজা ইব্‌ন সালমাহ বলেনঃ ‘আদম (আঃ) হাঁটু ভর করিয়া নিচু মাথায় নামিলেন এবং ইবলীস আকাশের দিকে মাথা তুলিয়া আঙ্গুল মটকাইতে মটকাইতে অবতরণ করিল।’

আবদুর রায্যাক বলেন যে, মুআম্মার বলিয়াছেন- আমাকে আওফ, কুসামা ইবন যুহায়র হইতে ও তিনি আবূ মূসা হইতে বর্ণনা করেনঃ ‘আল্লাহ্ তা’আলা যখন আদম (আঃ)-কে জান্নাত হইতে নামাইয়া দিলেন, তখন তাহাকে সকল কারিগরী বিদ্যা শিখাইয়া দিলেন এবং পথের সম্বল হিসাবে বেহেশতের কিছু ফলমূল দিলেন। উহা দুনিয়ার ফলমূলের মতই ছিল। তবে দুনিয়ার ফল নষ্ট হয়, উহা নষ্ট হয় না।’

ইমাম যুহরী আব্দুর রহমান ইব্‌ন হরমুয়ুল আ’রাজের সনদে আবূ হুরায়রা (রাঃ)-এর বর্ণনা উদ্ধৃত করেন। তিনি বলেনঃ

রাসূল (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘সর্বোত্তম দিন শুক্রবার। সেইদিন আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হইয়াছে, সেইদিন তাঁহাকে বেহেশতে রাখা হইয়াছে এবং সেইদিনই তাঁহাকে বেহেশত হইতে বাহির করা হইয়াছে।’ মুসলিম ও নাসাঈ হাদীসটি উদ্ধৃত করিয়াছেন।

আর্ রাযী বলেন— এই আয়াতটিতে নাফরমানের জন্য বিভিন্ন কঠোর সতর্কবাণী রহিয়াছে। কারণ, প্রথমত লক্ষ্যণীয় যে, আদম (আঃ)-এর একটিমাত্র পদস্খলনের জন্য কত বড় শাস্তি প্রদান করা হইল। তাই কবি বলেনঃ

 يا ناظرا يرنو بعینی راقد * ومشاهدا اللامر غير مشاهد

تصل الذنوب الى الذنوب وترتجي * درج الجنان ونيل فوز العابد

انسيت ربك حين اخرج ادما * منها الى الدنيا بذنب واحد

অর্থাৎ হে দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি! চোখ খুলিয়া সজাগ দৃষ্টিতে ঘটনা প্রবাহ হইতে শিক্ষা গ্রহণ কর। পাপের পর পাপ করিয়া চলিতেছ আর জান্নাতের সাফল্য অর্জনের আশা করিতেছ? তোমার প্রভু এত প্রিয় আদমকে একটি মাত্র পাপের জন্য জান্নাত হইতে তাড়াইয়া দিলেন। ইবনুল কাইয়্যেম বলেনঃ

 ولكننا سبی العدو فهل ترى * نعود الى اوطننا ونسلم 

অর্থাৎ তুমি কি দেখিতেছ, এখানে আমরা শত্রুর হাতে বন্দী রহিয়াছি? এখন দেখ, কখন আমরা নিরাপদে আমাদের স্বদেশে ফিরিতে পারি।

আর-রাযী বলেন যে, ফতহুল মুসেলী বলিয়াছেনঃ ‘আমরা জান্নাতের বাসিন্দা ছিলাম, শয়তান আমাদিগকে বন্দী করিয়া দুনিয়ায় আনিয়াছে। তাই এখানে আমাদের জন্য দুঃখ-দুশ্চিন্তা ছাড়া আর কিছুই নাই। যতদিন আমরা যেখান হইতে বহিষ্কৃত হইয়াছি সেখানে ফিরিয়া না যাইব, ততদিন আমাদের শান্তি নাই।’

জমহুর উলামা বলেন যে, আদম (আঃ)-কে আসমানে অবস্থিত বেহেশতে রাখা হইয়াছিল, তাহা হইলে ইবলীস কি করিয়া আবার সেখানে প্রবেশ করিল? উহার এক জবাব হইল এই— আদম (আঃ) যে বেহেশতে ছিলেন উহা পৃথিবীতেই ছিল। আকাশে নহে। আমাদের ‘আল-বিদায়া-নিহায়া’ কিতাবে তাহা সবিস্তারে আলোচিত হইয়াছে। জমহুর উলামার পক্ষ হইতে উহার কয়েকটি জবাব দেওয়া হইয়াছে। এক, বৈধ ও সম্মানজনকভাবে তাহার জান্নাতে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল বটে, অবৈধ চোরাপথে অবমাননাকরভাবে প্রবেশ সম্ভব ছিল। তাই তাওরাতে দেখিতে পাই, ইবলীস সাপের মুখে লুকাইয়া জান্নাতে ঢুকিয়াছে। একদল বলেন, জান্নাতের দরজার বাহিরে থাকিয়া আদমকে কুমন্ত্রণা দিয়াছে। অন্য দল বলেন- সে পৃথিবীতে থাকিয়াই আদম-হাওয়াকে জান্নাতে কুমন্ত্রণা দিয়াছে। যামাখশারী প্রমুখ এই জবাব দিয়াছেন। ইমাম কুরতুবী এই প্রসঙ্গে সাপ ও উহা হত্যা সম্পর্কিত বেশ কিছু হাদীস একত্র করিয়াছেন। হাদীসগুলি উত্তম ও কল্যাণপ্রদ।

আদম (আ)-এর তাওবা

(۳۷)

فَتَلَقَّى آدَمُ مِنْ رَّبِّهِ كَلِمَتِ فَتَابَ عَلَيْهِ ، إِنَّهُ هُوَ التَّوَابُ الرَّحِيمُ

৩৭. ‘অতঃপর আদম তাহার প্রভুর নিকট হইতে কয়েকটি কথা শিখিল, তারপর তাহার তওবা কবুল হইল । নিশ্চয় তিনি সর্বাধিক মার্জনাকারী, শ্রেষ্ঠতম দয়ালু।’

তাফসীরঃ উক্ত কথা কয়টি সম্পর্কে কেহ কেহ বলেন, কালাম পাকের নিম্ন আয়াতেই উহার ব্যাখ্যা রহিয়াছেঃ

قَالاً رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَّمْ تَغْفِرْلَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَسِرِينَ

অর্থাৎ তাহারা দুইজন বলিল, হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা আমাদের উপর জুলুম করিয়াছি। যদি তুমি ক্ষমা না কর ও দয়া না কর, তাহা হইলে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত হইব।

মুজাহিদ, সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র, আবুল আলীযা, রবী’ ইব্‌ন আনাস, আল-হাসান, কাতাদাহ, মুহাম্মদ ইবন কা’ব আল করবী, খালিদ ইবন মা‘দান, আতা আল-খোরাসানী ও আব্দুর রহমান ইব্‌ন যায়দ ইব্‌ন আসলাম ‘কালিমাতিন’-এর অনুরূপ ব্যাখ্যা বর্ণনা করিয়াছেন।

বনূ তামীমের এক ব্যক্তির সনদে আবূ ইসহাক আস সাবীঈ বর্ণনা করেন যে, উক্ত ব্যক্তি বলেনঃ আমার কাছে ইব্‌ন আব্বাস (আঃ) আসিলে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, আদম (আঃ)-কে তাঁহার প্রভু কোন্ কথা শিখাইয়াছিলেন? তিনি বলিলেন- হজ্জ সম্পর্কিত কথা।

সুফিয়ান ছাওরী বলেন, আব্দুল আযীয ইব্‌ন রযী’ বলিয়াছেন, উবায়দ ইবন উমায়র হইতে এক ব্যক্তি বর্ণনা করেন (অন্য রিওয়ায়েতে মুজাহিদ) যে, তিনি বলেনঃ

‘আদম (আঃ) বলিলেন- হে আমার প্রতিপালক! আমি যে ভুল করিয়াছি তাহা কি আমার সৃষ্টির পূর্বেই আপনি লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন, না আমি আমার তরফ হইতে নিজেই এই অপরাধের সূত্রপাত করিয়াছি? আল্লাহ্ পাক জবাব দিলেন- উহা তোমার সৃষ্টির পূর্বেই লিপিবদ্ধ ছিল। আদম (আঃ) বলিলেন- আপনি যেহেতু উহা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, তাই আপনিই আমাকে মার্জনা করুন। ইহার পরিপ্রেক্ষিতেই আল্লাহ্ পাক বলিলেনঃ

فَتَلَقَّى آدَمُ مِنْ رَّبِّهِ كَلِمْتَ فَتَابَ عَلَيْهِ

আস সুদ্দী এক ব্যক্তির সনদে ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ)-এর এই বর্ণনা উদ্ধৃত করেনঃ

আদম (আঃ) বলিলেন- ‘হে আমার প্রতিপালক! আপনি কি নিজ হাতে আমাকে গড়েন নাই? উত্তর আসিল- হ্যাঁ। অতঃপর প্রশ্ন করিলেন- আপনার প্রাণ হইতে কি আমার প্রাণ ফুঁকিয়া দেন নাই? উত্তর আসিল- হ্যাঁ। আবার প্রশ্ন করিলেন- আমি হাঁছি দিলে আপনি কি ‘য়্যারহামুকুমুল্লাহ’ (আল্লাহ্ তোমাকে রহম করিবেন) বলেন নাই এবং আপনার সেই রহম কি আপনার গযব অতিক্রম করে নাই? উত্তর আসিল- হ্যাঁ। প্রশ্ন করিলেন- আমি যে ইহা করিব, তাহা কি আপনি পূর্বে লিখিয়া রাখেন নাই? উত্তর আসিল- হ্যাঁ। তখন আদম প্রশ্ন করিলেন— আমি যদি তওবা করি, তাহা হইলে কি আপনি আবার আমাকে জান্নাতে ঠাই দিবেন? উত্তর আসিল- হ্যাঁ।

আল আওফী, সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র ও সাঈদ ইব্‌ন মা‘বাদও হযরত আব্বাস (রাঃ) হইতে অনুরূপ বর্ণনা করেন। হাকিমও তাঁহার মুস্তাদরাকে সাঈদ ইবনে জুবায়রের সনদে ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে অনুরূপ বর্ণনা উদ্ধৃত করেন। তিনি বলেন, যদিও সহীহদ্বয়ে উহা উদ্ধৃত হয় নাই, তথাপি উহার সূত্র সহীহ। আস্ সুদ্দী ও আতিয়্যা আল আওফীও অনুরূপ ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছেন । ইব্‌ন আবূ হাতিম এই প্রসঙ্গে তাহার কাছাকাছি একটি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি বলেনঃ

আমাকে আলী ইব্‌ন আল হুসাইন ইব্‌ন আশকাব, তাহাকে আলী ইবন আসিম- সাঈদ ইব্‌ন আবূ আরূবা হইতে, তিনি কাতাদাহ হইতে, তিনি আল-হাসান হইতে ও তিনি উবাই ইবন কা’ব (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন- আদম (আঃ) বলিলেন, হে প্রভু, আমি যদি তওবা করি, তাহা হইলে কি আপনি আমাকে জান্নাতে ফিরাইয়া নিবেন? প্রভু বলিলেন— হ্যাঁ। এই প্রেক্ষিতেই তিনি বলিলেন- فَتَلَقَى ادَمْ من ريه كلطت هَتَاب عَلَيْهِ

হাদীসটি গরীব। উহাতে ছিন্নসূত্রতা বিদ্যমান।

فَدَلْفَى ادم مْنْ ريه كلمت فَتَاب عَلَيْهُ আয়াত সম্পর্কে আবুল আলীয়া হইতে রবী— ইব্‌ন আনাসের সনদে আবূ জা’ফর আব্বাসী বর্ণনা করেনঃ

‘আদম (আঃ) যখন অপরাধ করিয়া ফেলিলেন, তখন বলিলেন, “হে আমার প্রতিপালক! যদি তওবা করিয়া ঠিক হই, তাহা হইলে কি করিবেন? তিনি বলিলেন- তখন তোমাকে জান্নাতে নিব।’ এই সেই কথাগুলি। ইহা ছাড়াও নিম্ন আয়াতটি উহার অন্তর্ভুক্তঃ

قَالاً رَبَّنَا ظَلَمْنَا اَنْفُسَنَا وَإِنْ لَّمْ تَغْفِرْلَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخُسِرِينَ

উক্ত আয়াত সম্পর্কে মুজাহিদ হইতে ইব্‌ন নাজীহ বর্ণনা করেন যে, উক্ত কলেমাগুলি নিম্নরূপঃ

 اللهم لا اله الا انت سبحانك وبحمدك رب اني ظلمت نفسی فتب على انك خير الغافرين

اللهم لا اله لا انت سبحانك وبحمدك رب انی ظلمت نفسي وارحمنى انك خير الراحمين

اللهم لا اله الا انت سبحانك وبحمدك رب اني ظلمت نفسي فاغفر لي انك انت التواب الرحيم

(আয় আল্লাহ্! তুমি ছাড়া কোন মা’বূদ নাই । তুমিই পবিত্র। প্রশংসা তোমারই, আমি আমার উপর জুলুম করিয়াছি। অনন্তর তুমি আমাকে মার্জনা কর, নিশ্চয় তুমি সর্বোত্তম মার্জনাকারী। আয় আল্লাহ্! তুমি ছাড়া কোন প্রভু নাই; তোমারই পবিত্রতা ও প্রশংসা বর্ণনা করি, আমি আমার উপর অত্যাচার করিয়াছি। অতএব তুমি আমাকে দয়া কর, নিশ্চয় তুমি সর্বোত্তম দয়ালু। আয় আল্লাহ্! তুমি ছাড়া কোন উপাস্য নাই। পবিত্রতা ও প্রশংসা তোমারই। আমি আত্মপীড়ক হইয়াছি। তুমি আমার তওবা কবুল কর, নিশ্চয় তুমি শ্রেষ্ঠতম তওবা কবুলকারী।

أنَّهُ هو التّواب الرحيه অর্থাৎ নিশ্চয় তিনি তাহাকে ক্ষমা করেন যে ব্যক্তি তাঁহার কাছে ক্ষর্মা চায় ও তাঁহার নিকট ফিরিয়া আসে।

যেমন আল্লাহ্ পাক বলেনঃ

ألم يَعلَمُوَا أن الله هو يَقْبّلُ الكّويَة عَْ عباده তাহারা কি জানে না যে, নিশ্চয় আল্লাহ্ তা’আলা বান্দাগণের তওবা কবূল করেন?

তিনি অন্যত্র বলেনঃ

ومن يعمل سوء أو يَظلم نَفْسَه ‘যে ব্যক্তি পাপ কাজ করিয়াছে কিংবা আত্মপীড়ন করিয়াছে।’

তিনি আরও বলেনঃ

ومن تاب وَعمل صالهًا ‘যে ব্যক্তি তওবা করিয়াছে এবং ভাল কাজ করিয়াছে।

উক্ত আয়াতসমূহ প্রমাণ দেয় যে, আল্লাহ্ তা’আলা পাপ মার্জনা করেন, তওবাকারীর তওবা কবুল করেন এবং ইহা সৃষ্টির উপর তাঁহার করুণা ও বান্দার উপর তাঁহার অনুগ্রহ। তিনি ছাড়া কোন প্রভু নাই। তিনিই একমাত্র তওবা কবূলকারী ও শ্রেষ্ঠতম দয়ালু।

(۳۸)

قُلْنَا اهْبِطُوا مِنْهَا جَمِيعًا فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِى هُدًى فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَاهُمْ يَحْزَنُونَ

 (۳۹)

وَالَّذِيْنَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِايْتِنَا أُولَبِكَ اَصْحَبُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَلِدُونَ

৩৮. আমি বলিলাম, ‘তোমরা সকলেই উহা (জান্নাত) হইতে নামিয়া যাও। অতঃপর অবশ্যই তোমাদের নিকট আমার হিদায়েত পৌঁছিবে। অনন্তর যাহারা আমার হিদায়েত অনুসরণ করিল, তাহাদের না পরকালের কোন ভয়ের কারণ আছে, না তাহারা (ইহকালে) দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইবে।’

৩৯. পক্ষান্তরে যাহারা কুফরী করিল এবং আমার বাণীসমূহকে মিথ্যা বলিল, তাহারাই নরক সহচর; তথাকার তাহারা চিরবাসিন্দা।

তাফসীরঃ আদম, হাওয়া ও ইবলীসকে ঊর্ধ্বজগত হইতে পৃথিবীতে নামাইয়া দেওয়ার সময়ে কি বলিয়া সতর্ক করা হইয়াছিল, আল্লাহ্ তা’আলা এখানে সেই তথ্য পরিবেশন করিতেছেন। এই সতর্কতার লক্ষ্য হইল তাহাদের সন্তান-সন্ততি। নিশ্চয় আল্লাহ্ তা’আলা শীঘ্রই তাহাদের নিকট কিতাব নাযিল করিবেন ও নবী-রাসূল পাঠাইবেন।

আবুল আলীয়া বলেনঃ الهدى অর্থাৎ নবী-রাসূল, কালাম ও নিদর্শনাবলী।

মুকাতিল ইব্‌ন হাইয়ান বলেনঃ الهدى অর্থাৎ মুহাম্মদ (সাঃ)। আল-হাসান বলেনঃ الهدى অর্থাৎ আল-কুরআন। এতদুভয় মতই বিশুদ্ধ এবং আবুল আলীয়ার মতটি ব্যাপক অর্থবোধক।

فمن تبع هدى অর্থাৎ যে ব্যক্তি আমার অবতীর্ণ কিতাবসমূহ ও প্রেরিত নবী-রাসূলগণকে অনুসরণ করিল। فلا خوف ‏ عليهم অর্থাৎ আখিরাতের ব্যাপারসমূহে তাহাদের ভয় নাই।

و لاهم يحزنون অর্থাৎ পৃথিবীতে যাহা হারায় তাহার জন্য তাহাদের দুশ্চিন্তা দেখা দেয় না। সূরা ‘ত্বা-হা’য় আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

قَالَ اهْبْطَا مِنْهَا جَمِيعًا بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ فَإمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَى فَلا يُضِلُّ وَلا يُشقى .

‘তিনি বলিলেন, তোমরা উভয় একত্রে নামিয়া যাও পরস্পর শত্রুরূপে। অতঃপর অবশ্যই তোমাদের কাছে আমার হিদায়েত পৌঁছিবে। যে ব্যক্তি হিদায়েত অনুসরণ করিল, সে পথ হারাইবে না, কষ্টেও পড়িবে না।’

ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) বলেন- উক্ত আয়াতে يضل অর্থ দুনিয়ায় পথভ্রষ্ট হইবে না এবং يشقى অর্থ আখিরাতে কষ্টে পড়িবে না।

তিনি অন্যত্র বলেনঃ

وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنْكًا وَنَحْشُرُهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعمى –

‘যে ব্যক্তি আমার যিকির হইতে বিরত থাকিল, তাহার জন্য জীবিকা সংকীর্ণ হইবে এবং কিয়ামতের দিন তাহারা অন্ধে পরিণত হইবে।’

ঠিক এইভাবেই আল্লাহ্ তা’আলা এখানেও বলিলেনঃ

وَالَّذِيْنَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِأَيْتِنَا أُولَئِكَ أَصْحُبُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خُلِدُونَ

অর্থাৎ জাহান্নামের স্থায়ী বাসিন্দা হইবে এবং উহা হইতে কখনও মুক্তি পাইবে না, উহাতে স্বস্তিও পাইবে না।

এই প্রসঙ্গে ইব্‌ন জারীর একটি হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন। উহা দ্বিমুখী সূত্রের। তিনি আবূ সালামা সাঈদ ইব্‌ন ইয়াযীদ হইতে, তিনি আবূ নাযরাতুল মানজার ইব্‌ন মালিক ইব্‌ন কিতআহ হইতে ও তিনি সাঈদ (সা’দ ইব্‌ন মালিক ইবন সিনান আল-খুদরী) হইতে বর্ণনা করেনঃ

রাসূল (সাঃ) বলিয়াছেন, স্থায়ী জাহান্নামীরা সেখানে জীবন্ত অবস্থায় কাটাইবে। কিন্তু যাহারা পাপের কারণে সাময়িক দোযখে যাইবে, তাহাদের উপর মৃত্যুর যবনিকাপাত ঘটিবে যতক্ষণ না শাফাআতের মাধ্যমে মুক্তিলাভ ঘটে।

দ্বিতীয় اهباط শব্দের ব্যবহার দ্বারা মূলত প্রথমবার হইতে ব্যতিক্রমধর্মী বক্তব্য পেশ করা হইয়াছে। একদল মনে করেন, উহা তাগাদা ও জোর দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে। যেমন, কাহাকেও জোর দিয়া উঠিতে বলিলে বলা হয়, উঠ। অন্যদল বলেন, প্রথম اهباط বলা হইয়াছে জান্নাত হইতে পৃথিবীর আকাশে নামার জন্য এবং দ্বিতীয় اهباط বলা হইয়াছে, পৃথিবীর আকাশ হইতে পৃথিবীতে নামার জন্য। প্রথম মতটিই বিশুদ্ধ। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।

error: Content is protected !!