সূরা বাকারার তাফসীর শুরু
(١)
المّ
১. আলিফ-লাম-মীম।
তাফসীরঃ হুরূফে মুকাত্তা’আতঃ কুরআনের সূরাসমূহের শুরুতে অবস্থিত স্বতন্ত্র অক্ষরগুলি সম্পর্কে তাফসীরকারগণ বিভিন্ন মত পোষণ করেন।
একদল বলেন, উহা আল্লাহ্ পাকের বিশেষত সংকেতসূচক। উহার অর্থ ও তাৎপর্য একমাত্র তিনিই জানেন। তাই উহার অর্থ তাঁহার হস্তেই ন্যস্ত থাকিবে। কোন মানুষ উহার ব্যাখ্যা প্রদান করিবে না। ইমাম কুরতুবী তাঁহার তাফসীর গ্রন্থে ইহাই বলিয়াছেন। তিনি হযরত আবূ বকর, হযরত উমর, হযরত উসমান, হযরত আলী, হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ) প্রমুখ এক কথায় সকলেরই এই মত বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।
আমের আশ্ শা’বী, সুফিয়ান আছ ছাওরী, আর রবী’ ইবন খায়ছাম প্রমুখও উক্ত অভিমতের সমর্থক। আবূ হাতিম ইব্ন হাব্বানের মতও ইহাই।
অপর দল উহার ব্যাখ্যা প্রদান করেন। ব্যাখ্যা প্রদানের ক্ষেত্রে অবশ্য তাঁহারা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করিয়াছেন। আবদুর রহমান ইব্ন যায়দ ইব্ন আসলাম বলেন, উহা সংশ্লিষ্ট সূরার নাম । আল্লামা আবুল কাসিম মাহমুদ ইবন উমর আয্যামাখশারী তাঁহার তাফসীরে বলেন, উক্ত মতই অধিকাংশের মত। বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ সিবওয়াইর মতে উহার সমর্থনে দলীল রহিয়াছে। সহীহদ্বয়ে আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণিত আছে, রাসূল (সাঃ) শুক্রবার ফজরের নামাযে ‘আলিফ-লাম-মীম-আস্ সাজ্দা’ ও ‘হাল আতা আলাল ইনসান’ পাঠ করিতেন।
সুফিয়ান আছছাওরী বলেন, মুজাহিদ হইতে ইব্ন আবূ নজীহ বর্ণনা করেন যে, তিনি বলিয়াছেন- “আলিফ-লাম-মীম, হা-মীম, আলিফ-লাম-মীম-সোয়াদ ও সোয়াদ ইত্যাদি কুরআনের কুঞ্জী। আল্লাহ্ তা’আলা উহা দ্বারা কুরআনের দ্বারোদ্ঘাটন করিয়াছেন।” মুজাহিদ হইতে অন্যরাও অনুরূপ বর্ণনা উদ্ধৃত করেন। মুজাহিদের অন্য এক বর্ণনা. ইব্ন আবূ নজীহ হইতে শিবলী ও তাঁহার নিকট হইতে আবূ হুযায়ফা মূসা ইব্ন মাসউদ এইরূপ বর্ণনা করেন তিনি বলিয়াছেন-আলিফ-লাম-মীম কুরআনের অন্যতম নাম। কাতাদাহ এবং যায়দ ইব্ন আসলামও তাহাই বলেন। এই মতটি আবদুর রহমান ইব্ন যায়দ ইবন আসলামের মতের সহিত সামঞ্জস্যশীল। ‘কুরআনের নাম’ ও ‘সূরার নাম’ এই দুই মতে মূলত পার্থক্য নাই। কারণ, কুরআনের সূরাও কুরআন নামে অভিহিত হইতে পারে।
অবশ্য উক্ত মতটি অবাস্তব। কারণ, আলিফ-লাম-মীম-সোয়াদ বলিতে সম্পূর্ণ কুরআন বুঝায় না। উহা বলিলে সূরা আ’রাফই বুঝায়। সুতরাং সূরার নাম আর কুরআনের নাম এক কথা নহে। আল্লাহ্ সর্বাধিক জ্ঞাত।
এক দল বলেন, উহা আল্লাহ্ তা’আলার নাম। আশ্ শা’বী বলেন-আল্লাহ্ তা’আলার সাংকেতিক নামে সূরা শুরু করা হইয়াছে। সালেম ইব্ন আবদুল্লাহ ও ইসমাঈল ইব্ন আবদুর রহমান (আসুদ্দী উল-কবীর) উক্ত একই কথা বলিয়াছেন। আস্ সুদ্দী হইতে শু’বা বর্ণনা করেন, আমার কাছে এই খবর পৌঁছিয়াছে যে, ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলিয়াছেন, ‘আলিফ-লাম-মীম’ আল্লাহ্ তা’আলার একটি প্রধান নাম। শু’বার হাদীসের বরাত দিয়া ইব্ন আবূ হাতিম তাহাই বর্ণনা করেন। ইব্ন জারীর বিন্দার হইতে, তিনি ইব্ন মাহদী হইতে, তিনি শু’বা হইতে বর্ণনা করেন যে, শু’বা বলেন- ‘আমি সুদ্দীকে হা-মীম, তোয়া-সীন ও আলিফ-লাম-মীম’ সম্পর্কে প্রশ্ন করায় তিনি বলেন, ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলিয়াছেন উহা আল্লাহ্র বিশেষ নাম। ইবন জারীর বলেন, আমাকে যথাক্রমে মুহাম্মদ ইবনুল মুছনী, আবু নু’মান ও শু’বা ইসমাঈল আস্-সুদ্দী হইতে ও তিনি মুররাহ্ আল-হামদানী হইতে এই বৰ্ণনা শুনান যে, মূর্রা আল হামদানী বলেন, আবদুল্লাহ বলিয়াছেন, হযরত আলী ও ইব্ন আব্বাস হইতেও অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায় ।
ইব্ন আব্বাস হইতে আলী ইব্ন আবূ তালহা বর্ণনা করেন, তিনি বলিয়াছেন যে, উহা কসম বিশেষ । আল্লাহ্ তা’আলা উহা দ্বারা কসম করিয়াছেন। মূলত উহা আল্লাহ্র নাম ৷ ইকরামা হইতে যথাক্রমে খালিদ আল হিজা, ইব্ন আলীয়া, ইব্ন জারীর ও ইব্ন আবূ হাতিম বর্ণনা করেন যে, ইকরামা বলিয়াছেন ‘আলিফ-লাম-মীম, একটি শপথ বাক্য।’ ইন জারীর ও ইব্ন আবূ হাতিম শরীক ইব্ন আবদুল্লাহ হইতে, তিনি আতা ইবনুস সায়েব হইতে, তিনি আবুয্ যোহা হইতে ও তিনি ইব্ন আব্বাস হইতে বর্ণনা করেন-আলিফ-লাম-মীম অর্থ ‘আনাল্লাহু আ’লামু’ (আমি আল্লাহ্ অধিক জ্ঞাত)। সাঈদ ইব্ন জুবায়রও এইরূপ বলিয়াছেন।
আসুদ্দী আবূ মালেক ও আবূ সালেহ হইতে ইব্ন আব্বাসের এক বর্ণনা এবং মুররাতুল হামদানী ইব্ন মাসউদের এবং অন্য এক সাহাবীর বর্ণনা উদ্ধৃত করেন। উহাতে বলা হয় ‘আলিফ-লাম-মীম’ বর্ণ বিশেষ এবং আল্লাহ্ তা’আলার নাম।
আবূ জা’ফর আর্ রাযী রবী’ ইবন আনাস হইতে, তিনি আবুল আলীয়া হইতে বর্ণনা করেন-আল্লাহ্ পাকের কালামে ‘আলিফ-লাম-মীম’ অক্ষর তিনটি আরবী ঊনত্রিশ অক্ষরেরই অন্তর্ভুক্ত অক্ষর। তবে উহাতে সব রকম স্বাদই নিহিত। উহার প্রত্যেক অক্ষরই আল্লাহ্র নামের কুঞ্জী। উক্ত অক্ষরের প্রত্যেকটিই আল্লাহ্ নি’আমাত ও আযাবের পরিচায়ক। উহাতে কোন জাতির আবির্ভাবকাল ও আয়ুষ্কাল সম্পর্কিত তত্ত্বও বিদ্যমান। ঈসা ইবন মরিয়ম (আঃ) সবিস্ময়েঃ বলিলেন-আমার কাছে অত্যন্ত আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, মানুষ তাঁহার নাম দ্বারা কথা বলে ও তাঁহার রুজী খাইয়া বাঁচে, তারপরও কি করিয়া তাঁহার বিদ্রোহী হয়? ইব্ন আবূ হাতিম বলেন, ‘আলিফ’ তাঁহার আল্লাহ্ নামের আদি অক্ষর, ‘লাম’ আল্লাহর লতীফ (মেহেরবান) নামের এবং ‘মীম’ আল্লাহ্র ‘মজীদ’ (মহীয়ান) নামের প্রথম অক্ষর। ‘আলিফ দ্বারা ‘আলাউল্লাহ’ (আল্লাহর নি’আমত) ‘লাম’ দ্বারা ‘লুতফুল্লাহ’ (আল্লাহ্ কৃপা ও ‘মীম’ দ্বারা ‘মাজদুল্লাহ’ (আল্লাহ্ মহানুভবতা) প্রকাশ পায় । তাহা ছাড়া ‘আলিফ’ দ্বারা এক বছর, ‘লাম’ দ্বারা ত্রিশ বছর ও ‘মীম’ দ্বারা চল্লিশ বছর বুঝায়।
ইব্ন জারীরও অনুরূপ বলিয়াছেন। অতঃপর তিনি এই সমস্ত বক্তব্য পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করিয়া সবগুলির সমন্বয় সাধন করিয়াছেন। মূলত এইগুলি পরস্পর বিরোধী নহে। উহা একই সঙ্গে সূরার নাম, ও আল্লাহ্র নাম দুইটিই হইতে পারে। ইহা যেন আল্লাহ্র নামেই সূরার নাম রাখা হইল। উহার প্রত্যেকটি অক্ষরই তাঁহার নাম ও গুণের পরিচায়ক। আল্লাহ্ তা’আলা অনেক সূরাই তাঁহার হাম্দ, তাসবীহ ও তা‘জীমমূলক আয়াত দ্বারা শুরু করিয়াছেন। তিনি আরও বলেন-উক্ত অক্ষরগুলির দ্বারা কোথাও আল্লাহ্র নাম, কোথাও তাঁহার গুণ, কোথাও বা তাঁহার নির্ধারিত কোন কাল ইত্যাদি বুঝানো হইলে কোনই অসুবিধা দেখা দেয় না। যেমন রবী’ ইব্ন আনাস আবুল আলীয়া হইতে বর্ণনা করেন-একই শব্দ স্থান বিশেষ ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হইতে পারে। ‘উম্মত’ শব্দটি কুরআনে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। ‘উম্মত’ শব্দ দ্বারা দীন বুঝানো হইয়াছে। যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ
انا وجدنا أباءنًا على أمّة “(মুশরিকরা বলে) নিশ্চয় আমরা বাপ-দাদাকে এই দীনের উপর পাইয়াছি,”
কুরআনে ‘অনুগত’ অর্থে উহার ব্যবহারের উদাহরণ এইঃ
ان ابْرَاهِيْمْ كَانَ أُمَّة قَاننًا لله حَنِيْفًا وَلمْ يلك من الْمُشْركَيّنَ
ইবরাহীম আল্লাহর অনুগত ও একনিষ্ঠ সত্যানুসারী ছিল। সে আদৌ মুশরিক ছিল না।”
কুরআনে ‘দল’ অর্থে ‘উম্মত’ ব্যবহারের নমুনাঃ
وجد عليه أمة من النّاس يسقون একদল মানুষকে সেখানে তৃষ্ণা নিবারণে রত দেখিতে পাইল।”
আল্লাহ্ পাক এক জায়গায় ‘জাতি বা সম্প্রদায়’ অর্থও নিয়াছেনঃ
و لقد بعثنًا من كل أمة رسولا “আমি প্রত্যেক জাতি বা সম্প্রদায়ের কাছে রাসূল পাঠাইয়াছি।”
কখনও তিনি উহ্য ‘কাল’ অর্থে ব্যবহার করিয়াছেন। যেমনঃ
وفَال الذى نجا مده ما وادكريعد أمَّةٍ “দুইজনের মধ্যকার মুক্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি কিছুকাল বিস্মৃতির পর বলিল।”
এখানে ‘উম্মত’ শব্দের ‘কাল’ অর্থ গ্রহণই সঠিক মত। সুতরাং উক্ত অক্ষরগুলিও এইরূপ বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হইতে পারে।
ইব্ন আবূ হাতিমের সমগ্র বিশ্লেষণের ইহাই সারকথা। কিন্তু আবূল আলীয়ার অভিমতের সহিত ইহার মিল নাই। আবূল আলীয়া মনে করেন, উক্ত অক্ষর একই সঙ্গে বিভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে বটে, কিন্তু ‘উম্মত’ কিংবা এই ধরনের শব্দ বিভিন্ন কার্যে ব্যবহৃত একই সঙ্গে নহে; বরং পৃথক পৃথক স্থানে অবস্থানুসারে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে । উহার একই সঙ্গে বিভিন্ন অর্থ গ্রহণ সম্ভবপর নহে। এই প্রশ্নে উসূলবিদদের বিভিন্ন মত রহিয়াছে। তাহা সবিস্তারে আলোচনার স্থান ইহা নহে । আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ
তারপর ‘উম্মত’ শব্দটি উহার প্রতিটি অর্থ প্রকাশ করে পরিবেশ ও পরিস্থিতির চাহিদার সহিত সঙ্গতি রাখিয়া । কিন্তু উক্ত অক্ষরগুলি একই সঙ্গে বিভিন্ন নামের সম মর্যাদায় অর্থ প্রদান করে। চিন্তা-ভাবনা ছাড়া ব্যাপারটি বোধগম্য হইবার নহে । এই ব্যাপারে মতভেদ সৃষ্টি হইয়াছে এবং নির্দ্বিধায় অনুসরণের মত কোন সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নাই। বিভিন্ন অর্থবোধক অক্ষরের যে একই সঙ্গে পরিবেশ-পরিস্থিতির ইঙ্গিত ছাড়াই সকল অর্থ সমভাবে প্রকাশের ক্ষমতা রহিয়াছে তাহা সুপ্রমাণিত সত্য নহে। যেমন কবি বলেনঃ
قلنا قفى لنا فقالت قاف – لاتحسبى انا نسينا الايجاف
‘আমরা বলিলাম, দাঁড়াও। সে বলিল, দাঁড়াইতেছি। ভাবিও না, গর্ত ভুলিয়াছি। অন্য কবি বলেনঃ
ما للظلم عال كيف لايا – ينقد عنه جلده اذا يا
ইন জারীর বলেন-এখানে কবি যেন বলিতে চাহেন, যখন এই কাজ করিবে, তখন যে উহা করিবে তাহার জন্য ‘ইয়া’ যথেষ্ট হইবে।
অপর কবি বলেনঃ
بالخير خيرات وان شرا فا – ولا اريد الشر الا ان تا
“ভাল করিলে ভাল পাইবে, মন্দ করিলে মন্দ পাইবে। তুমি মন্দ না চাহিলে আমি মন্দের ইচ্ছা রাখি না।’-কবি এখানে ‘ফা’ অক্ষর ‘ফাশাররুন’ এবং ‘ওয়া’ অক্ষর ‘তাশাও’ অর্থে গ্রহণ করিয়াছেন।
বলাবাহুল্য, এই অর্থ পরিবেশ-পরিস্থিতির চাহিদা মোতাবেকই গ্রহণ করা হইয়াছে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
ইমাম কুরতুবী প্রসঙ্গত এই হাদীস পেশ করেনঃ
مَنْ أَعَانَ عَلَى قَتْلِ مُسْلِمٍ بِشِطْر كَلِمَةٍ …… الحديث .
সুফিয়ান ইহার ব্যাখ্যায় বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোন মুসলমান হত্যার জন্য সামান্য কথা দিয়া ও সাহায্য করে অর্থাৎ اقتل (হত্যা কর) শব্দের শুধু اق বলে, তাহা হইলেও উপরোক্ত হাদীসের নির্দেশিত ব্যবস্থার আওতায় আসিবে।’
খাসীফ বলেন-মুজাহিদ বলিয়াছেন, সূরার শুরুতে অবস্থিত প্রতিটি মুকাত্তাআত হরফই নির্দিষ্ট হরুফে হিজা। কোন কোন আরবী ভাষাবিদ উহাদের হরুফুল মু’জাম বলিয়াছেন। কিছু উল্লেখ করাই অবশিষ্টগুলির জন্য যথেষ্ট বিধায় অবশিষ্টগুলির উল্লেখ বর্জন করা হয়। যেমন কেহ বলিল, যে, আমর ‘আলিফ’ ‘বা’ ‘তা’ ‘ছা’ লিখে। উহার অর্থ সে আটাশটি হরুফুল মু’জামের সকলই লিখে। তবে প্রথম কয়েকটি উল্লেখ করাই যথেষ্ট বিধায় অবশিষ্টগুলির উল্লেখ বর্জিত হইয়াছে। উক্ত বিশ্লেষণ ইবন জারীরের।
আমার মতে সূরার শুরুতে উল্লেখিত অক্ষর মোট চৌদ্দটি। অবশিষ্ট অক্ষরের পুনরাবৃত্তি বাদ দিয়া উহা ব্যবহৃত হইয়াছে। অক্ষরগুলি হইল- আলিফ-লাম-মীম, সোয়াদ-রা, ক্বাফ-হা-ইয়া-আইন, তোয়া-সীন, হা-কাফ-নূন। এইগুলি শব্দাকারে একত্র করিলে বাক্যরূপ হয় نص حكيم قالع له سر এইগুলি মোট অক্ষরের অর্ধেক। যেগুলি উল্লেখ করা হইয়াছে, অবশ্যই উহা বর্জিতগুলি হইতে উত্তম।
ইহা অক্ষরগুলির শব্দ ও পদ প্রকরণের বর্ণনা মাত্র। আল্লামা যামাখশারী বলেন-উপরোক্ত চৌদ্দটি অক্ষর উচ্চারণগত দিক হইতে অর্থাৎ ধ্বনিতত্ত্ব বিচারে যে কয়টি শ্রেণীবিভাগ আরবী বর্ণমালার ক্ষেত্রে রহিয়াছে তাহার সবগুলিই জুড়িয়া আছে। যেমন, মাহমুসাত ওয়াল মাজহুরাত-আর রুখওয়াত ওয়াশ শাদীদাহ-আল মুবাকাত ওয়াল মাফতুহাত-আল মুস্তালিয়াত ওয়াল মুনখাফায়াত-আল কলকলা। তিনি এইগুলি সবিস্তারে বিশ্লেষণের পর বলেন-সেই মহান সত্তার পবিত্রতা বর্ণনা করি যাঁহার প্রত্যেকটি কাজেই নিহিত রহিয়াছে অজস্র কলাকৌশল । এই সীমিত জিনিসের বিশ্লেষণও অতি ব্যাপক হয়। ইহা হইতেই বিষয়টির মাহাত্ম্য উপলব্ধি করা যায়। কেহ কেহ সকল কথার সারসংক্ষেপ এই বলিয়াছেন-আল্লাহ্ পাক এই অক্ষরগুলি অহেতুক প্রয়োগ করেন নাই। কেবল মূর্খরাই বলিতে পারে যে, এই সব অর্থহীন অক্ষর প্রয়োগ কুরআনে ঘটিয়াছে। ইহা চরম ভ্রান্তিপূর্ণ ধারণা। এই ভ্রান্তির অবসানের জন্যই অক্ষরগুলির অর্থ ও তাৎপর্য বলা হইয়াছে। সেইগুলির মধ্য হইতে নির্দোষগুলি গ্ৰহণ যোগ্য। অন্যথায় এই ব্যাপারে চুপ থাকাই ভাল মনে করিয়াছি। আমাদের শেষ কথা হইলঃ
أمنًا به كل من عند رَبَنَا “আমাদের প্রভুর নিকট হইতে যাহা কিছু আসে তাহার সকল কিছুর উপরই ঈমান আনিয়াছি।
উলামায়ে কিরামও এই ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন অর্থ ও তাৎপর্যের উপর একমত হইতে পারেন নাই। তাহাদের বিভিন্ন মতের যাহার কাছে যেই মত সঠিক ও সুপ্রমাণিত মনে হয়, সে তাহা গ্রহণ করিতে পারে। অন্যথায় সত্য সুস্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত এক্ষেত্রে চুপ থাকাই শ্রেয়।
যাহারা মনে করেন যে, সূরার শুরুতে প্রযুক্ত উক্ত অক্ষরগুলির নিজস্ব কোন অর্থ নাই এবং সেই উদ্দেশ্যে প্রযুক্তও হয় নাই, তাহাদের মতও বিভিন্ন। তাহাদের একদল বলেন, শুধু সূরাকে বৈশিষ্ট্য ও পরিচিতি প্রদানের জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে। এই অভিমত উদ্ধৃত করেন ইমাম ইব্ন জারীর। এই মতটি দুর্বল। কারণ, উক্ত অক্ষরগুলি ছাড়াও সূরার পার্থক্য ও বিভক্তি সুস্পষ্ট এমন সূরাও আছে যাহার শুরুতে উহা ব্যবহৃত হয় নাই। কোন সূরায়, পড়ায় এবং কোন সূরায় লিখায় বিসমিল্লাহ দিয়া শুরুর ব্যবস্থা রহিয়াছে।
তাহাদের অন্যদল বলেন-উহা দ্বারা শুরুর মাধ্যমে শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণই উদ্দেশ্য। মুশরিকরা কুরআন শুনিত না এবং অপরকেও না শোনার জন্য উপদেশ দিত। কারণ, উহা শুনিলেই আকৃষ্ট হইত। এই মতও ইব্ন জারীর উদ্ধৃত করেন। ইহাও দুর্বল অভিমত। কারণ, এই যুক্তি সত্য হইলে সকল সূরায়ই উহা প্রযুক্ত হইত। অন্তত অধিকাংশ সূরায় অবশ্যই হইত। তাহা তো হয় নাই। আরেক কথা, শ্রোতার মনোযোগের জন্য হইলে শুধু সূরার শুরুতে ক্লে, যে কোন আয়াতের শুরুতে উহার প্রয়োগ ঘটিতে পারিত। তাহা ছাড়া যে সকল সূরায় উহা সংযুক্ত হইয়াছে যথা আল-বাকারা ও আলে ইমরান, তাহা মাদানী সূরা এবং মদীনায় মুশরিকদের মনোযোগ আকর্ষণের ব্যাপারটি ছিল অনুপস্থিত। সুতরাং এই যুক্তি ভ্রান্তিকর।
তাহাদের অপর দল বলেন, কুরআনের উচ্চতম মর্যাদা ও অপরিসীম তাৎপর্যময়তা প্রকাশের জন্যই সূরা শুরুর উক্ত অক্ষরগুলি ব্যবহৃত হইয়াছে। কোন সৃষ্টি যেন উহার মোকাবিলা করিতে না পারে। কারণ, উক্ত মুকাত্তাআত হরূফের তাৎপর্য উদ্ধার কোন মানুষের পক্ষে সম্ভবপর হইবে না। এই অভিমত হইল ইমাম রাযীর। তিনি তাঁহার তাফসীরে ইহা মুবারাদের বরাতে সবিস্তারে তুলিয়া ধরিয়াছেন। বিশেষজ্ঞদের এই সম্পর্কিত অভিমতও তিনি একত্রিত করিয়াছেন ৷ ইমাম কুরতুবী, বিখ্যাত ব্যাকরণবিদ ফার্রা ও ভাষাবিদ কুতরাব হইতেও এই অভিমত উদ্ধৃত করেন। আল্লামা যামাখশারী তাঁহার ‘তাফসীরে কাশ্শাফে’ উহার পুনরাবৃত্তি করেন এবং উহার জোর সমর্থন জোগান। আশ্ শায়খ আবুল আব্বাস ইমাম ইব্ন তায়মিয়া এই অভিমতই সমর্থন করেন। আমার শায়খ হাফিজ ও মুজতাহিদ আবুল হুজ্জাজ আল মিযী আমাকে তাঁহার এই অভিমত অবহিত করেন।
আল্লামা যামাখশারী বলেন-উক্ত চতুর্দশ অক্ষর একসঙ্গে কুরআনের সূরাতে না আনার পিছনে হিকমত আছে। তাহা এই, বিভিন্ন সূরাতে বারবার আসায় আলংকারিক দিক হইতেও সুন্দর হইয়াছে। ফলে উহার স্থায়িত্ব ও কল্যাণকারিতা বৃদ্ধি পাইয়াছে। কুরআনে বেশ কিছু কাহিনীকে স্থায়ীভাবে ফলপ্রসূ করার জন্য বারংবার উল্লেখ করা হইয়াছে।
কখনও অক্ষরগুলি স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র ব্যবহৃত হইয়াছে, যেমন ص – ن – ق ; কখনও দুই অক্ষর মিলিয়া প্রয়োগ করা হইয়াছে, যেমন حم ; কখনও আবার তিন অক্ষর এক সঙ্গে ব্যবহার করা হইয়াছে, যেমন الم ; কখনও চার অক্ষর মিলাইয়া প্রযুক্ত হইয়াছে, যেমন المر - المص ; কোথাও আবার পাঁচ অক্ষর এক সঙ্গে ব্যবহার করা হইয়াছে, যেমন كهعيصض حمعسق । কারণ আরবী ভাষায় এক, দুই, তিন, চার ও পাঁচ অক্ষরের শব্দই বাক্যে’ ব্যবহারের রীতি ‘রহিয়াছে। উহার বেশী অক্ষরের শব্দ ব্যবহারের রীতি নাই।
আমি বলিতেছি, এই কারণে যে সকল সূরা ‘হরূফে মুকাত্তাআত’ দ্বারা শুরু হইয়াছে, তাহাতে অবশ্যই কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব, উহার মু’জিযা ও মাহাত্ম্য বর্ণিত হইবে। অনুরূপ স্থানগুলি পাঠ করিলেই এই সত্যটি জানা যাইবে। ঊনত্রিশটি সূরায় মুকাত্তাআত হরূফ ব্যবহৃত হইয়াছে । যেমন, আল্লাহ্ বলেনঃ
الم – ذالك الكتّاب لأريُب فيه ‘আলিফ-লাম-মীম। এই কিতাব সংশয় মুক্ত। অন্যত্র আল্লাহ্ বলেনঃ
الم – الله لا اله الا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ ، نَزَّلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَيْنَ يَدَيْه.
‘আলিফ-লাম-মীম। আল্লাহ্ এক। তিনি ছাড়া কোন প্রভু নাই। তিনি চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী। তিনি তোমার নিকট যে কিতাব অবতীর্ণ করিয়াছেন উহা সত্য এবং তোমার সম্মুখে অন্য যে সব কিতাব রহিয়াছে তাহার সত্যতা ঘোষণাকারী।’
তিনি অন্যত্র বলেনঃ
المص – كتَابُ أنْزلَ إِلَيْكَ فَلاَ يَكُنْ فِي صَدْرِكَ حرج ِمَنْهُ
আলিফ-লাম-মীম-সোয়াদ। তোমার নিকট কিতাব অবতীর্ণ হইল। উহা হইতে তোমার অন্তরে কোন জটিলতা দেখা দিবে না।’
الر – كِتَابُ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسُ مِن الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِ رَبِّهِمْ
‘আলিফ-লাম-রা। আমি তোমার নিকট কিতাব অবতীর্ণ করিয়াছি যেন উহা মানুষকে তাহাদের প্রভুর ইচ্ছায় অন্ধকার হইতে আলোর পথে বাহির করিয়া নেয়।’
অন্যত্র তিনি বলেনঃ
اله تَتزيل الكثّاب لآريب فيه من رب الْعَالمِيْن ‘আলিফ-লাম-মীম। রব্বুল আলামীনের তরফ হইতে কিতাবের অবতরণের ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নাই।’
আল্লাহ্ তা’আলা আরও বলেনঃ
حم ج تَنْرِيْلٌ مِّنَ الرَّحْمنِ الرَّحِيمِ
‘হা-মীম। পরম দাতা ও অশেষ করুণাময়ের তরফ হইতে কিতাবের অবতরণ ঘটিয়াছে।
তিনি অন্যত্র বলেনঃ
‘হা-মীম। পরম দাতা ও অশেষ করুণাময়ের
حم ج عسق – كَذَالِكَ يُوحِي إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ اللهُ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
‘হা-মীম-আইন-সীন-কাফ। এভাবে অত্যন্ত প্রতাপান্বিত ও মহা কুশলী আল্লাহ্ তোমার নিকট ওহী নাযিল করেন এবং তোমার পূর্ববর্তীদের নিকটও।
উপরোক্ত আয়াতসমূহ ও অনুরূপ অন্যান্য আয়াত প্রমাণ করে যে, উপরে বর্ণিত অভিমত সঠিক। অবশ্য গভীর অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন লোকের জন্য উহা সহজেই বোধগম্য হয়। আল্লাহ্ই সৰ্বজ্ঞ।
যাহারা অক্ষরগুলিকে কালনির্দেশক মনে করেন এবং উহা হইতে তাহারা দুর্যোগ, দুর্বিপাক ও ঘটনা প্রবাহের কাল নির্ণয় করেন, তাহাদের দাবী অসার। তাহারা বেঘাটে নামিয়াছেন। এই প্রসঙ্গে বর্ণিত হাদীসও যঈফ। সহীহ মানিয়া লইলে উহা দ্বারাও তাহাদের মতবাদ বাতিলের প্রমাণ মিলে। কিতাবুল মাগাযী প্রণেতা মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক ইব্ন ইয়াসার বর্ণনা করেন-আমাকে আল কালবী আবূ সালেহ হইতে ইব্ন আব্বাসের বরাত দিয়া জাবির ইব্ন আব্দুল্লাহ ইব্ন রুবাবের এই হাদীস শুনাইয়াছেনঃ
‘একদা আবূ ইয়াসার ইব্ন আখতাব একদল ইয়াহুদী সহকারে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর দরবারে আসেন। তখন তিনি সূরা বাকারার ‘অ’লিফ-লাম-মীম-যালিকাল কিতাবু লারায়বা ফীহ’ আয়াত পাঠ করিতেছিলেন। তারপর সে তাহার ভাই হুয়াই ইব্ন আখতাবের কাছে আসিল। সেও তখন একদল ইয়াহুদী পরিবৃত্ত ছিল। তখন সে তাহার ভাইকে বলিল, জান, আল্লাহ্র কসম, আমি মুহাম্মদকে আল্লাহর অবতীর্ণ আয়াত ‘আলিফ-লাম-মীম-যালিকাল কিতাবু লারায়বা ফীহ’ পড়িতে শুনিয়াছি। হুয়াই ইব্ন আখতাব প্রশ্ন করিল, তুমি উহা নিজের কানে শুনিয়াছ? সে জবাব দিল, হ্যাঁ। (বর্ণনাকারী বলেন) অতঃপর হুয়াই ইব্ন আখতাব সমবেত ইয়াহুদী সমভিব্যহারে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর কাছে গেল। তাহারা তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল-সে কি আপনার উপর অবতীর্ণ ‘আলিফ-লাম-মীম-যালিকাল কিতাবু লারায়বা ফীহ’ আয়াত পাঠ করিতে শুনিয়াছে? জবাবে রাসূল (সাঃ) বলিলেন- হ্যাঁ। তখন সে প্রশ্ন করিল, উহা লইয়া কি আপনার নিকট আল্লাহর তরফ হইতে জিবরাঈল আসিয়াছিল? তিনি বলিলেন- হ্যাঁ। তখন সে বলিল, অতীতের যত নবীর কাছে ওহী পাঠানো হইয়াছে, কাহাকেও তাহাদের জাতি ও রাষ্ট্রের আয়ুষ্কাল সম্পর্কে জানানো হয় নাই। এই বলিয়া সে দাঁড়াইয়া তাহার দলের মধ্যে গেল এবং বলিল, আলিফে এক, লামে ত্রিশ ও মীমে চল্লিশ মিলিয়া মোট একাত্তর বৎসর। তোমরা কি এমন নবীর দীন কবূল করবে যাহার উম্মত ও হুকুমতের আয়ুষ্কাল মাত্র একাত্তর বৎসর? তারপর সে রাসূল (সাঃ)-এর কাছে আসিয়া প্রশ্ন করিল, হে মুহাম্মদ! আপনার কাছে ইহা ছাড়াও কি কোন আয়াত আসিয়াছে? তিনি জবাব দিলেন-হ্যাঁ। সে প্রশ্ন করিল, তাহা কি? তিনি বলিলেন, আলিফ-লাম-মীম-সোয়াদ। সে বলিল-ইহা তো অধিকতর ভারী ও দীর্ঘ। আলিফে এক, লামে ত্রিশ, মীমে চল্লিশ ও সোয়াদে নব্বই মিলিয়া একশত একষট্টি বৎসর হইল ৷ আবার সে প্রশ্ন করিল, হে মুহাম্মদ! আরও কোন আয়াত আসিয়াছে কি? তিনি জবাব দিলেন-হ্যাঁ। সে জিজ্ঞাসা করিল তাহা কি? তিনি বলিলেন, আলিফ-লাম-মীম-রা। সে বলিল, ইহা তো আরও ভারী ও লম্বা হইল। আলিফে এক, লামে ত্রিশ, রা-এ দুইশত, মোট দুইশত একত্রিশ বৎসর হইল। সে পুনরায় প্রশ্ন করিল, হে মুহাম্মদ! আপনার কাছে আরও আয়াত আসিয়াছি কি? তিনি জবাব দিলেন-হ্যাঁ। সে প্রশ্ন করলি, উহা কি? তিনি বলিলেন, আলিফ-লাম-মীম-র। সে বলিল-ইহা তো অনেক ভারী ও দীর্ঘ হইয়া গেল। আলিফে এক, লামে ত্রিশ, মীমে চল্লিশ ও র-এ দুইশত, মোট দুইশত একাত্তর হইয়া গেল। হে মুহাম্মদ। আমাদের কাছে ব্যাপারটা ঘোলাটে হইয়া গেল। আপনাদের আয়ুষ্কাল কি সর্বোচ্চটি, না সর্বনিম্নটি তাহা বুঝা গেল না। অতঃপর সে দলবলকে বলিল, ইহার নিকট হইতে চল। আবূ ইয়াসার তখন তাহার ভাই হুয়াই ইবন আখতাব ও দলবলকে বলিল-হয়ত মুহাম্মদ ও তাহার উম্মতের জন্য উক্ত সকল সংখ্যা মিলাইয়া মোট সাত শত চারি বৎসর আয়ুষ্কাল নির্ধারিত হইয়াছে। তাহারা বলিল-আমাদের কাছে ব্যাপারটি ঘোলাটে হইয়া দাঁড়াইয়াছে।
এই প্রেক্ষিতেই একদল মনে করেন-
هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ مِنْهُ آيَاتٌ مُحْكَمَاتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُمُتَشَابِهَاتٌ
আয়াতটি উক্ত দলের উক্ত মন্তব্য উপলক্ষে নাযিল হইয়াছে। অবশ্য উপরোক্ত হাদীসের মূল বর্ণনাকারী মুহাম্মদ ইবন সায়েব আল কলবী হইতে বর্ণিত একক সূত্রের হাদীস কখনও দলীল হিসাবে গ্রহণ করা হয় না । তাহা ছাড়া এই হাদীসকে নির্ভরযোগ্য ধরা হইলে কুরআনে ব্যবহৃত চৌদ্দটি মুকাত্তাআত হরফই গণনা করিতে হইবে। তাহা হইলে আয়ুষ্কাল অনেক দীর্ঘ হইয়া যাইবে। তারপর পুনরাবৃত্তি গণনায় আনিলে তো আরও বেশী দীর্ঘ হইবে। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ ও সর্বশ্রেষ্ঠ।
(۲)
ذلِكَ الكِتبُ لا رَيْبَ فِيهِ : هُدًى لِلْمُتَّقِينَ
২. ‘এই কিতাব সংশয় মুক্ত; মুত্তাকীদের পথ প্রদর্শক।’
তাফসীরঃ ইন জারীর বলেনঃ ইব্ন আব্বাস (রা) বলিয়াছেন, তমা আঃ অর্থ ‘এই কিতাব।’ তাহা ছাড়া মুজাহিদ, ইকরামা, সাঈদ ইবন জুবায়র, আস সুদ্দী, মাকাতিল, ইব্ন হাইয়ান, যায়দ ইব্ন আসলাম ও ইব্ন জুরায়জও এই মত পোষণ করেন। তাঁহারা বলেন, زالك নিকট ও দূর উভয় ইঙ্গিতবহ বিধায় আরবরা هذا অর্থেও ব্যবহার করে এবং একটির স্থলে অবাধে অপর শব্দটি ব্যবহার করে। তাহাদের বাগবিধিতে এই রীতি সুপ্রচলিত। ইমাম বুখারী (রঃ) মুআম্মার ইবনুল মুছান্না হইতে এবং তিনি আবূ উবায়দা হইতে অনুরূপ অভিমতই উদ্ধৃত করিয়াছেন।
আল্লামা যামাখশারী (রঃ) বলেন ‘যালিকা’ শব্দ দ্বারা পূর্বোক্ত ‘আলিফ-লাম-মীম’-এর দিকে ইঙ্গিত করা হইয়াছে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলিয়াছেন لآ فارض ولأبكْر عَوَان نْبَيْنَذَالك (এখানে শেষোক্ত ‘যালিকা’ পূর্বোক্ত আয়াতাংশের দিকে ইঙ্গিত করিতেছে) কিংবা ذالكم حَكْمٌ الله يَحْكُمْ بَيْنْكُمْ (এখানে প্রথমোক্ত ‘যালিকুম’ পূর্বোক্ত আয়াতাংশের দিকে ইঙ্গিত করিতেছে) অথবা’ ذَالَكُم الله (এখানেও প্রথমোক্ত ‘যালিকুম’ পূর্বোক্ত আয়াতাংশের দিকে ইঙ্গিত করিতেছে)। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
ইমাম কুরতুবী সহ একদল তাফসীরকার বলেন, زا لك দ্বারা আল-কুরআনের দিকে ইশারা করা হইয়াছে। কারণ, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট উহা নাযিলের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হইয়াছিল। কেহ বলিয়াছেন, উহার ইঙ্গিত তাওরাতের দিকে। কেহ বলেন, ইঞ্জীলের দিকে। এভাবে দশটি মত পাওয়া যায়। কিন্তু অধিকাংশের মতেই উহা দুর্বল। আল্লাহ্ই সৰ্বজ্ঞ।
‘আল-কিতাব’ অর্থ ‘আল-কুরআন’। ইব্ন জারীর প্রমুখ ‘যালিকাল কিতাবু’ দ্বারা ‘তাওরাত-ইঞ্জীল’ বুঝানোর যে অভিমত উদ্ধৃত করিয়াছেন, উহা অবাস্তব কথা ও অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর। কেবলমাত্র অজ্ঞরাই এইরূপ অর্থ গ্রহণ করিতে পারে।
الريب অর্থ الشك (সংশয়, সন্দেহ)। আসুদ্দী আবূ মালিক ও আবূ সালেহ হইতে এবং তাহারা ইব্ন আব্বাস ও ইব্ন মুর্রা আল হামদানী হইতে এবং তাঁহারা ইব্ন মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবা হইতে এই বর্ণনাই শুনিয়াছেন যে, لاريب فيه অর্থ لاشك فيه (উহাতে সন্দেহ নাই)। আবূ দারদা, ইব্ন আব্বাস, মুজাহিদ, সাঈদ ইব্ন জুবায়র, আবূ মালিক, ইন উমরের খাদেম নাফে’, আতা, আবুল আলীয়া, রবী’ ইব্ন আনাস, মাকাতিল ইব্ন হাইয়ান, আদ্দী, কাতাদাহ্ ও ইসমাঈল ইব্ন আবূ খালেদেরও এই মত। ইব্ন আবূ হাতিম বলেন—ইহার বিরোধী কেহ আছেন বলিয়া আমার জানা নাই।
কখনও الريب ব্যবহৃত হয় التهمة (অপবাদ) অর্থে। যেমন করি জামীল বলেনঃ
بثينة قالت جميل اربتنى – فقلت كلانا يابثين مريب
(বুছায়ানা অভিযোগ করিল-হে জামীল। তুমি আমাকে অপবাদ দিয়াছ। আমি জবাবে বলিলাম-হে বুছায়ানা। আমরা উভয়ই উভয়কে অপবাদ দিয়াছি।)
উহা কখনও ‘প্রয়োজন’ অর্থে আসে। যেমন অপর কবি বলেনঃ
قضينا من تهامة كل ريب – وخيبر ثم اجمعنا السيوفا
‘তেহামা ও খায়বার প্রান্তরেই আমরা সব প্রয়োজন মিটাইলাম। অতঃপর আমরা তরবারি গুটাইয়া নিলাম।’
তাই আয়াতটির অর্থ দাঁড়ায় এই যে, এই কিতাবের অর্থাৎ কুরআনের ব্যাপারে কোনই সন্দেহ সংশয় নাই। ইহা নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ্র নিকট হইতেই অবতীর্ণ হইয়াছে। যেমন সূরা সাজ্দায় আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
الم – تَدْريُلُ الكتاب لأرَيُْب فيه من رب الْعَالَمِيْنَ “রব্বুল আলামীনের তরফ হইতে এই কিতাবের অবতরণের ব্যাপারে কোনই সন্দেহ নাই।”
একদল বলেন, উক্ত আয়াতে زالك الكمّاب উদ্দেশ্য এবং لأريب فيه উহার নৈয়াৰ্থক বিধেয় এবং অর্থ দাঁড়ায় এই যে, এই কিতাবের ভিতরে সন্দেহের কোন ব্যাপার নাই বিধায় তোমরা উহাতে কোনরূপ সংশয় পোষণ করিও না।
একদল কিরাআত বিশেষজ্ঞ لأريب বলিয়া থামেন এবং فيه هدى لِلْمَحّقَيِنَ পড়েন মূলত উত্তম হইল ও বলিয়া থামা। কারণ, তখন هدى কুরআনের গুণবাচক বিশেষ্য হয়। ফলে فيه هدى হইতে لآر يب فيه অধিকতর অলংকার সম্মত হয়।
আরবী ভাষার বাগবিধি মতে هدى গুণবাচক হিসাবে ‘মারফূ’ হইতে পারে, আবার অবস্থা প্রকাশক হিসাবে ‘মানসূব’ও হইতে পারে। এখানে ‘হিদায়েত’-কে ‘মুত্তাকীর’ জন্য নির্দিষ্ট করা হইয়াছে। যেমন আল্লাহ্ পাক বলেনঃ
قُلْ هُوَ الَّذِينَ آمَنُوا هُدًى وَشِفَاءٌ ، وَالَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ فِي أَذَانِهِمْ وَقَرٌ وَهُوَ
عَلَيْهِمْ عَمَى ، أُولَئِكَ يُنَادَوْنَ مِنْ مَكَان بَعِيد
“বল, উহা (কুরআন) ঈমানদারের জন্য পথ প্রদর্শক ও রোগ বিদূরক এবং বেঈমানদের জন্য বধিরত্ব ও অন্ধত্ব প্রদায়ক। তাই তাহারা (যেন) পরস্পরকে দূরবর্তী স্থান হইতে সম্বোধন করে।”
তিনি অন্যত্র বলেনঃ
وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاء وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ ، وَلَايَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلا خسارا
“অনন্তর আমি কুরআন হইতে যাহা নাযিল করি, তাহা ঈমানদারদের জন্য শেফা ও রহমত । অবশ্য জালিমদের উহাতে ক্ষতি বৃদ্ধি পাওয়া ছাড়া কোনই লাভ হয় না।”
এই সকল আয়াত প্রমাণ করে যে, কেবলমাত্র ঈমানদাররাই কুরআন দ্বারা উপকৃত হইবে, অন্য কেহ নহে। কারণ, কুরআন নিজেই حدى বা পথ প্রদর্শক। তাই উহা অনুসরণকারীই শুধু পথপ্রাপ্ত হইবে। যেমন, আল্লাহ্ বলেনঃ
يَا أَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاء لِمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى
وَرَحْمَةً لِّلْمُؤْمِنينَ
“হে মানব। তোমাদের সামনে প্রভুর তরফ হইতে উপদেশ গ্রন্থ পৌছিয়াছে। উহা তোমাদের (আত্মিক রোগের জন্য) দাওয়াই বিশেষ। ঈমানদারদের জন্য উহা হিদায়েত ও রহমতস্বরূপ।”
আস্সুদ্দী আবূ মালিক ও আবূ সালেহ হইতে, তাঁহারা ইব্ন আব্বাস ও মুরাহ আল-হামদানী হইতে এবং তাহারা ইবন মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবা হইতে বর্ণনা করেনঃ مرى لَلْمُتُقَيْن অর্থ মুত্তাকীদের আলোস্বরূপ। আবূ রওক যিহাক হইতে ও তিনি ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ মুত্তাকী হইল সেই সকল ঈমানদার যাহারা শিরক পরিহার করিয়া আল্লাহ্র অনুগত থাকিয়া নেক আমল করে।
ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে পর্যায়ক্রমে সাঈদ ইব্ন জুবায়র, ইকরামা, যায়দ ইব্ন ছাবিতের গোলাম মুহাম্মদ আবূ মুহাম্মদ ও মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক বর্ণনা করেনঃ মুত্তাকী সেই সকল লোক যাহারা আল্লাহর শাস্তির ভয়ে তাঁহার নিষেধাজ্ঞাগুলি এড়াইয়া চলে এবং তাঁহার রহমতের আশায় আদেশসমূহ মানিয়া চলে।
সুফিয়ান আছ ছাওরী জনৈক ব্যক্তির মাধ্যমে আমাশের এই অভিমত উদ্ধৃত করেনঃ মুত্তাকী হইতে হইলে আল্লাহ্ যাহা হারাম করিয়াছেন তাহা বর্জন কর এবং যাহা ফরয করিয়াছেন তাহা আদায় কর।
আবূ বকর ইব্ন আইয়াশ বলেন-আ’মাশ আমাকে মুত্তাকীর অর্থ জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি যাহা জানি তাহা বলিলাম। তিনি বলিলেন-আল কালবীকে জিজ্ঞাসা কর। আমি আল কালবীর কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন-যাহারা কবীরা গুনাহ এড়াইয়া চলে তাহারা মুত্তাকী। আমি এই জবাব আ’মাশের কাছে বিবৃত করিলাম। তিনি বলিলেন-অবশ্য এই ধরনেরই। মোটকথা তিনি উহা অস্বীকার করিলেন না।
কাতাদাহ বলেন-মুত্তাকীর গুণ স্বয়ং আল্লাহ্ বলিয়া দিয়াছেন। তাহা হইল الّْذِينيؤمئون بالقيب ويقيمون الصّلوة এবং উহার পরবর্তী অংশ। ইমাম ইব্ন জারীর এই অভিমত গ্রহণ করিয়া বলেন, উক্ত আয়াতসমূহে সব কিছুই অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে। যথা অদৃশ্য বস্তুতে বিশ্বাস, নামায কায়েম ইত্যাদি।
আতিয়া আস সাফী হইতে আতিয়া ইব্ন কয়স ও রবীআ ইব্ন ইয়াযীদ, তাহাদের নিকট হইতে আবদুল্লাহ, তাহার নিকট হইতে আবূ আকীল আবদুল্লাহ ইব্ন আকীল ও তাহার নিকট হইতে ইমাম তিরমিযী ও ইমাম ইবন মাজাহ (রঃ) বর্ণনা করেনঃ
রাসূল (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘কোন বান্দাই মুত্তাকী গণ্য হইবে না যতক্ষণ পাপ কাজের ভয়ে পাপের কাছাকাছি কাজও পরিহার না করিবে।’ ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে ‘হাসান গরীব’ বলিয়াছেন।
ইব্ন আবূ হাতিম বলেন-আমাকে আমার পিতা আবদুল্লাহ ইব্ন ইমরান হইতে, তিনি ইসহাক ইব্ন সুলায়মান আর-রাযী হইতে, তিনি মুগীরা ইব্ন মুসলিম হইতে ও তিনি মায়মূন আবূ হামযাহ হইতে বর্ণনা করেন যে, মায়মূন বলিয়াছেন, আবূ ওয়ায়েলের সঙ্গে বসা ছিলাম। তখন মাআযের অন্যতম সহচর আবূ আফীফ সেখানে হাজির হইল। তাহাকে দেখিয়া সাকীফ ইবন সালামা বলিয়া উঠিলেন, হে আবূ আফীফ। মু’আয ইব্ন জাবালের কোন বর্ণনা কি আমাদিগকে শুনাইবেন না? তিনি বলিলেন-হ্যাঁ। আমি তাহাকে বলিতে শুনিয়াছি, “কিয়ামতের দিন এক জায়গায় সকলকে আবদ্ধ করিয়া জিজ্ঞাসা করা হইবে, মুত্তাকীরা কোথায়? তখন মুত্তাকীরা রহমানুর রহীমের এক বাহুতে দণ্ডায়মান হইবে। আল্লাহ্ তা’আলা ও তাহাদের মাঝখানে পর্দা থাকিবে না এবং তিনিও তখন অদৃশ্য থাকিবেন না।’ আমি তখন প্রশ্ন করিলাম, মুত্তাকী কাহারা? তিনি জবাব দিলেন-‘যাহারা শিরক ও মূর্তিপূজা হইতে বাঁচিয়া থাকে এবং নিষ্ঠার সহিত আল্লাহর ইবাদত করে তাহারাই জান্নাতে যাইবে।’ কখনও الهدى শব্দটি স্থিতিশীল দৃঢ় ঈমানের অন্তরকে বুঝানোর জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে। তবে বান্দার অন্তরে ঈমানের স্থিতিশীলতা ও দৃঢ়তা সৃষ্টি একমাত্র আল্লাহ্ পাকের কুদরতে হইতে পারে।
কারণ, তিনি বলেনঃ
انك لاتهدى من أحبيت ‘নিশ্চয় তুমি যাহাকে পছন্দ করিবে তাহাকেই হিদায়েতের আলো প্রদান করিতে পারিবে না।’
তিনি অন্যত্র বলেনঃ
ليس عليك هداهه “তাহাদের হিদায়েত লাভের জিম্মাদারী তোমার উপরে নহে।
অন্যত্র তিনি বলেনঃ
من يُضلل اللهُ فَلَا هَادِيَ لَهُ ‘আল্লাহ্ যাহার বিভ্রান্তি মঞ্জুর করিবেন তাহার আর কোন পথ প্রদর্শক জুটিবে না ৷
আল্লাহ্ পাক আরও বলেনঃ
من يهد الله فهو المهتد ج ومن يضلل فلن تجد له وليا مرشدا “আল্লাহ্ যাহাকে পথ দেখান সে পথপ্রাপ্ত হয়। আর তিনি যাহার বিভ্রান্তি মঞ্জুর করেন, কখনও তাহার জন্য তুমি অভিভাবক ও পথ প্রদর্শক পাইবে না।’
এই সব আয়াত প্রমাণ করে, অন্তরে স্থিতিশীল ঈমান সৃষ্টি করা আল্লাহ্র কাজ এবং উহা করার ক্ষমতা কোন বান্দার নাই।
কখনও উক্ত শব্দ দ্বারা সত্য প্রকাশ ও উহার ব্যাখ্যাদানের অর্থ গ্রহণ করা হয়। এই অর্থে সত্যের দিকে ইঙ্গিত দান ও উহার জন্য দলীল প্রদানই হিদায়েত। আল্লাহ্ বলেনঃ
وانك لَتْهْدىْ الى صراط مُسَْتَّقِيُم “আর নিশ্চয় তোমার পথ প্রদর্শন সরল পথের দিকেই।
অন্যত্র তিনি বলেনঃ
انما أَنْت منذر وَلكُل قَوْم هاد “তুমি শুধুই সতর্ককারী এবং প্রত্যেক জাতির জন্যই পথ প্রদর্শক থাকে।”
তিনি আরও বলেনঃ
وأمًا فود فَهَدِيَنَاهُم فَاسْتَحَبُوا الْعَمى على الهدى “ছামূদ জাতিকে আমি হিদায়েত দান করিয়াছিলাম। কিন্তু তাহারা হিদায়েতের বদলে অন্ধত্ব পছন্দ করিল।”
তিনি অন্যত্র বলেনঃ
وهديناه التُجدين “আমি তাহাদিগকে ভাল-মন্দ দুইটি পথ প্রদর্শন করিয়াছি। النجدين শব্দের ‘ভাল-মন্দ পথদ্বয়’ অর্থই উত্তম। আল্লাহ্ই ভাল জানেন।
তাকওয়ার আসল অর্থ হইল খারাপ কাজ হইতে বাঁচিয়া থাকা। মূলত উহা ছিল وقوى ও الوقاية কবি নাবেগা বলেনঃ
سقطه النصيف ولم ترد اسقاطه – فتناولته واتقتنا باليد
ইনসাফের পতন হইল, যদিও তুমি তার পতন চাও না। অগত্যা আমাদের হাত খানাপিনা বাঁচাইয়াই চলিল।’
অন্য কবি বলেন-
فالقت قناعا دونه الشمس واتقت – باحسن موصولين كف ومعصم
“সে ওড়না উড়াইয়া সূর্য কিরণ আড়াল করিল এবং এভাবে স্বীয় হাত ও তালু দিয়া সুন্দরভাবে নিজকে বাঁচাইল।’
বর্ণিত আছে, উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) উবাই ইব্ন কা’ব (রাঃ)-কে ‘তাকওয়া’ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করিলেন, আপনি কি কণ্টকাকীর্ণ পথে চলিয়াছেন? তিনি জবাবে বলিলেন-হ্যাঁ। উবাই প্রশ্ন করিলেন-তখন আপনি কি করেন? তিনি উত্তর দিলেন-সতর্কতার সহিত কাঁটার আঁচড় হইতে শরীর ও কাপড় বাঁচাইয়া চলি। উবাই (রাঃ) বলিলেন—উহাই তাকওয়া। .
ইবনুল মু’তায তাঁহার কবিতায় এই অর্থেই উহা ব্যবহার করেন। যেমনঃ
خل الذنوب صغيرها – وكبيرها ذاك التقى
واصنع كماش فوق ارض – الشوك يحذر مايري
لا تحقون صغيرة – ان الجبال من الحصى
“ছোট বড় সব পাপ ছাড়, উহাই তাকওয়া। কণ্টকাকীর্ণ পথ চলিতে পথিক যে সতর্কতা অবলম্বন করে, তাহাই কর। ছোট পাপ উপেক্ষা করিও না। নিশ্চয় ক্ষুদ্র কাঁকর হইতে পাহাড়ের সৃষ্টি।”
একদা আবূ দারদা এই চরণ আবৃত্তি করেনঃ
يريد المرء ان يوّتى مئأه * ويأبى الله الا ماارادا
يقول المرء فائدتى ومالى * وتقوى اللّه افضل ما استفادا
“মানুষের কামনা যে, তাহার মনস্কাম পূর্ণ হউক। কিন্তু আল্লাহ্ যাহা চান না, তাহা হয় না। মানুষ বলিতে থাকে, আমার স্বার্থ, আমার সম্পদ। অথচ সকল স্বার্থ ও সম্পদের চাইতে তাকওয়া উত্তম।”
সুনানে ইব্ন মাজাহ্য় আবূ উমামা (রাঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছে যে, রাসূল (সাঃ) বলিয়াছেনঃ মানুষের সেরা উপকারী তাকওয়া, উহার পর নেককার স্ত্রী। স্বামী তাহাকে দেখিলে তৃপ্ত হয়। তাহাকে সে হুকুম করিলে তামিল করে। কোন কসম করিলে তাহা পূর্ণ করে। স্বামীর অবর্তমানে তাহার সম্পদ ও নিজের সতীত্বকে হেফাজত করে।
(۳)
الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلوةَ وَمِمَّا رَزَقْنهُمْ يُنْفِقُونَ
৩. যারা অদৃশ্য বস্তুর উপর ঈমান আনে এবং তাহারা সালাত কায়েম করে আর আমি তাহাদিগকে যে রুযী দিয়াছি তাহা হইতে বিতরণ করে।
তাফসীরঃ হযরত আবদুল্লাহ হইতে পর্যায়ক্রমে আবূল আওয়াস, আবূ ইসহাক, আ’লা ইবনুল মুসাইয়াব ইব্ন রাফে’ ও আবূ জা’ফর আর-রাযী বর্ণনা করেন যে, তিনি বলিয়াছেন-সত্যকে স্বীকার করাই ঈমান। আলী ইব্ন তালহা প্রমুখ ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেন-তাহারা ঈমান আনে অর্থ তাহারা সত্যকে স্বীকার করে। ইমাম যুহরী হইতে মুআম্মার বর্ণনা করেন—ঈমান অর্থ আমল করা। রবী’ ইবন আনাস হইতে আবূ জা’ফর আর-রাযী বলেন—ঈমান আনা অর্থ আল্লাহকে ভয় করা।
ইব্ন জারীর বলেন—ঈমান বিল গায়েবের উত্তম ব্যাখ্যা ইহাই যে, কথায়, বিশ্বাসে ও কাজে উহার পূর্ণ প্রতিফলন। আল্লাহকে ভয় করার যে ঈমান তাহার অর্থ হইল মুখের স্বীকৃতিকে কাজে পরিণত করা। ঈমান এমন একটি শব্দ যাহার অর্থ আল্লাহ্কে, তাঁহার কিতাবকে ও তাঁহার রাসূলকে বিশ্বাস করা এবং এই বিশ্বাসকে কথায় ও কাজে প্রতিফলিত করা।
আমার মতে, আভিধানিক অর্থে ঈমান হইল নিছক সত্যের স্বীকৃতি বা আস্থা স্থাপন । কুরআনেও আল্লাহ্ পাক এই অর্থে ঈমান শব্দটি ব্যবহার করিয়াছেন। যেমন তিনি বলেনঃ
يُؤُمنُون باللّه ويُؤمن للْمُوّمنين “সে আল্লাহর উপর এবং ঈমানদারদের উপর আস্থা রাখে।”
তেমনি তিনি হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর পিতার কাছে তাঁহার ভাইদের বক্তব্য উদ্ধৃত করেনঃ
وما أت بمومن لَنَا ولو كنا صادقين “আপনি আমাদের উপর আস্থা আনিতেছেন না। অথচ আমরা সত্যবাদী ছিলাম।”
তেমনি আল্লাহ্ পাক আমলের সঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে ঈমানের উল্লেখ করেনঃ
الا ادبن امنا وعَملُوا الصّالحَات “যাহারা সত্যকে স্বীকার করিয়াছে এবং ভাল কাজ করিয়াছে, তাহারা নহে।”
অবশ্য যখন শরীয়তের পরিভাষায় ব্যাপক অর্থে ঈমানের ব্যবহার ঘটে, তখন অন্তরে বিশ্বাস করা, মুখে স্বীকার করা ও কাজে পরিণত করার অর্থই প্ৰকাশ পায়।
অধিকাংশ ইমামই এই মতের অনুসারী। ইমাম শাফেঈ, ইমাম আহমদ ইব্ন হাম্বল, আবূ উবায়দা প্রমুখ অধিকাংশ ইমামের ইজমা হইল-‘কওল ও আমলই ঈমান এবং উহার হ্রাস-বৃদ্ধি আছে।’ এই মর্মে আমরা বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থের প্রথম ভাগে স্বতন্ত্রভাবে এই প্রসঙ্গে সবিস্তারে আলোচনা করিয়াছি। আল্লাহ্ পাকেরই প্রশংসা করি এবং তাঁহারই কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতেছি।
ঈমানকে যাহারা خشية (ভয়) অর্থে ব্যবহারের পক্ষপাতী তাহারা দলীল হিসাবে আল্লাহ্ পাকের নিম্ন বাণীসমূহ পেশ করেনঃ
ان الّذين يحشون رَبَهُم بِالْعَيْب “নিশ্চয় যাহারা তাহাদের অদৃশ্য প্রভুকে ভয় করে।
তিনি অন্যত্র বলেনঃ
من خشى الرحمن بِالْقَيْب وجاء بقلب مَنيُب “যে বা যাহারা অদৃশ্য রহমানকে ভয় করিল এবং বিনীত হৃদয়ে উপস্থিত হইল।”
তাহাদের মতে خشية (ভয়) ঈমান ও ইলমের সারবস্তু। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ انما يَخْشَى الله من عباده الْعُلَمَاءْ “একমাত্র আলিম বান্দারাই আল্লাহকে ভয় করে।”
তাহাদের একদল বলেন—ঈমানদাররা প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে উভয়ভাবে আস্থা স্থাপন করে এবং তাহাদের ঈমান মুনাফিকের ঈমানের মত নহে। মুনাফিক সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক বলেনঃ
وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا ط وَإِذَا خَلَوْا إِلَى شَيَاطِينِهِمْ قَالُوا إِنَّا
مَعَكُمْ – إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِءُونَ
“তাহারা যখন ঈমানদারদের দেখা পায়, তখন বলে, আমরা তো ঈমান আনিয়াছি। পক্ষান্তরে যখন তাহাদের শয়তান সহচরদের সঙ্গে সংগোপনে মিলিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা তোমাদের সাথে আছি। আমরা ঈমানদারের সহিত ঠাট্টাকারী বৈ নহি।”
তিনি আরও বলেনঃ
اذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُونَ قَالُوا نَشْهَدُ َانَّكَ لَرَسُولُ اللَّهِ – وَاللهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ
لَرَسُولُهُ – وَاللهُ يَشْهَدُ أَنَّ الْمُنَافِقِينَ لَكَاذِبُونَ
“যখন তোমার নিকট মুনাফিকরা আসে, তখন বলে, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহ্র রাসূল। আল্লাহ্ তো জানেন অবশ্যই তুমি তাঁহার রাসূল। তাই আল্লাহ্ সাক্ষ্য দিতেছেন, নিশ্চয়ই মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী।
এই প্রেক্ষিতে আয়াতের অন্তর্গত بالغيب কথাটি حال বা অবস্থা প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত হইয়াছে। অর্থাৎ মানুষ হইতে যাহা অদৃশ্য অবস্থায় বিরাজ করিতেছে।
অবশ্য এখানে ব্যবহৃত الغيب -এর তাৎপর্য নিয়া পূর্বসূরীদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়াছে। মূলত তাহাদের সবগুলি মতই সঠিক। উহার তাৎপর্যের আওতায় সবগুলিই পড়ে।
আয়াতের يؤمذاون بالغيب -এর তাৎপর্য সম্পর্কে আবূ জা’ফর আর-রাযী রবী’ ইন আনাসের বরাত দিয়া আবুল আলীয়ার এই বর্ণনা উদ্ধৃত করেন : উহার তাৎপর্য হইল আল্লাহ্ উপর, ফেরেশতার উপর, আসমানী গ্রন্থসমূহের উপর, রাসূলদের উপর, আখিরাতের উপর, জান্নাত-জাহান্নামের উপর, আল্লাহর সমীপে উপস্থিতির উপর, মরণোত্তর জীবনের উপর, পুনরুত্থানের উপর, এক কথায় এই সকল অদৃশ্য জিনিসের উপর ঈমান আনা। কাতাদাহ ইব্ন দুআমাও এই মত পোষণ করেন।
আস্সুদ্দী আবূ মালিক ও আবূ সালেহ হইতে এবং তাহারা ইব্ন আব্বাস ও মুরাহ আল-হামদানীর বরাতে ইবন মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবা হইতে এই বর্ণনা উদ্ধৃত করেনঃ الغيب বলিতে বান্দার দৃষ্টির অগোচরে অবস্থিত বস্তু তথা জান্নাত-জাহান্নাম সহ কুরআনে বর্ণিত অদৃশ্য বিষয়সমূহকে বুঝায়।
মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক মুহাম্মদ ইব্ন আবূ মুহাম্মদ হইতে, তিনি ইকরামা অথবা সাঈদ ইব্ন জুবায়র হইতে ও তিনি ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেন بالغيب অর্থ আল্লাহর তরফ হইতে যাহা কিছু আসিয়াছে।
সুফিয়ান আছ ছাওরী আসিম হইতে ও তিনি যর হইতে বর্ণনা করেনঃ الغيب অর্থ আল-কুরআন। আতা ইব্ন আবূ রুবাহ বলেন-আল্লাহর উপর যে ঈমান আনে সে অবশ্যই অদৃশ্য বস্তুর উপর ঈমান আনিল। ইসমাঈল ইব্ন আবূ খালিদ বলেন : গায়েবের উপর ঈমান আনা অর্থ ইসলামের নির্দেশিত অদৃশ্য বস্তুর উপর ঈমান আনা ৷ যায়দ ইবন আসলাম বলেন : গায়েবের উপর ঈমান অর্থ তকদীরের উপর বিশ্বাস স্থাপন। এই সকল অভিমত পরস্পর সন্নিহিত এবং তাৎপর্যগতভাবে একই। কারণ, উপরোক্ত সকল অদৃশ্য বস্তুর উপর ঈমান আনা ওয়াজিব।
সাঈদ ইব্ন মনসূর বলেন-আমার কাছে আবূ মুআবিয়া আ’মাশ হইতে, তিনি আম্মার ইবন উমায়র হইতে এবং তিনি আব্দুর রহমান ইব্ন ইয়াযীদ হইতে বর্ণনা করেনঃ
“আমরা আব্দুল্লাহ ইব্ন মাসউদের কাছে বসা ছিলাম। সেখানে রাসূল (সাঃ)-এর সাহাবাদের উপর কি কি অবস্থা গিয়াছে তাহার বর্ণনা চলিতেছিল। তখন আব্দুল্লাহ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) বলিলেন-মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ব্যাপারটি আমাদের কাছে তো প্রকাশ্য ব্যাপার ছিল ৷ মহান অদ্বিতীয় মা’বূদের শপথ! তাঁহাকে না দেখিয়া যাহারা ঈমান আনিবে, তাহাদের ঈমানের চাইতে উত্তম ঈমান কাহারো নহে। অতঃপর তিনি-
الم – ذلِكَ الْكِتُبُ لاَرَيْبَ فِيهِ – هُدًى لِلْمُتَّقِينَ – الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيمُونَ الصَّلوة وَمِمَّا رَزَقْتُهُمْ يُنْفِقُونَ – وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَبِالْآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ – أُولَئِكَ عَلَى هُدًى مِّنْ رَّبِّهِمْ وَأُولَئِكَ هُمُ المفلحون পর্যন্ত তিলাওয়াত করিলেন।
ইব্ন আবূ হাতিম ও ইব্ন মারদুবিয়্যা অনুরূপ বর্ণনা করেন। হাকিম তাঁহার ‘মুস্তাদরাক সংকলনে আ’মাশের সূত্রে উহা বর্ণনা করেন। অতঃপর বলেন, ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী হাদীসটি সহীহ। অবশ্য তাঁহারা উহা উদ্ধৃত করেন নাই।
ইমাম আহমদ উক্ত হাদীসের সম তাৎপর্যের একটি হাদীস বর্ণনা করেন। বর্ণনাটি ইব্ন মুহায়রীযের। তাঁহার নিকট হইতে পর্যায়ক্রমে খালিদ ইব্ন সুরাইক, আসাদ ইব্ন আব্দুর রহমান, আওয়াঈ ও আবুল মুগীরার মাধ্যমে তাঁহার কাছে পৌঁছে। ইব্ন মুহায়রীয বলেনঃ আমি আবূ জুমআকে বলিলাম, রাসূল (সাঃ) হইতে আপনার শুনা একটি হাদীস আমার কাছে বর্ণনা করুন। তিনি বলিলেন, হাঁ। আমি তোমাকে একটি উত্তম হাদীস শুনাইব। আমরা একদিন রাসূল (সাঃ)-এর সহিত নাশতা করিতেছিলাম । আমাদের সংগে আবূ উবায়দা ইবনুল জার্রাহ। ছিলেন। তিনি আরয করিলেন-‘হে আল্লাহর রাসূল। আমরা আপনার সাক্ষাতে ঈমান আনিয়াছি এবং আপনার সঙ্গে থাকিয়া জিহাদ করিয়াছি। সুতরাং আমাদের চাইতে উত্তম কেহ হইবে কি? তিনি বলিলেন-হ্যাঁ। তোমাদের পরে যাহারা আমাকে না দেখিয়া ঈমান আনিবে তাহারা উত্তম।’
আবূ বকর ইব্ন মারদুবিয়্যা ভিন্ন সূত্রে তাহার তাফসীর গ্রন্থে অনুরূপ বর্ণনা উদ্ধৃত করেন। সালেহ ইবন জুবায়র হইতে মুআবিয়া ইব্ন সালেহ ও আব্দুল্লাহ ইব্ন সালেহ এবং আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ হইতে ইসমাঈল ও আব্দুল্লাহ ইব্ন জা’ফর তাঁহার কাছে উহা বর্ণনা করেন। বর্ণনাটি এইঃ
সালেহ ইবন জুবায়র বলেন-একদা বায়তুল মুকাদ্দাসে নামায আদায় উপলক্ষে রাসূল (সাঃ)-এর সহচর আবূ জুমআ আনসারী (রাঃ) আমাদের মাঝে আসিলেন। আমাদের সঙ্গে তখন রিজা ইব্ন হায়াত (রাঃ) ছিলেন। তিনি যখন আমাদের মধ্য হইতে চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন, আমরাও তাঁহাকে আগাইয়া দেওয়ার জন্য সঙ্গে গেলাম । তাঁহাকে আগাইয়া দিয়া যখন ফিরিয়া আসিতে উদ্যত হইলাম, তখন তিনি বলিলেন-নিশ্চয় তোমাদিগকে আমি এক উদ্দীপনামূলক বিনিময় হিসাবে রাসূল (সাঃ)-এর একটি হাদীস শুনাইতে চাই। আমরা বলিলাম-আল্লাহ্ আপনাকে রহম করুন। আপনি উহা শুনান। তিনি বলিলেন- আমরা রাসূল (সাঃ)-এর সঙ্গে ছিলাম। আমাদের সঙ্গে মু’আয ইব্ন জাবাল (রাঃ)-ও ছিলেন। উহা ছিল অন্তরঙ্গ পরিবেশে উত্তম সাহচর্য। তাই আমরা বলিলাম- হে আল্লাহর রাসূল। এমন কোন মানব গোষ্ঠী আছে কি যাহারা আমাদের চাইতে বেশী সওয়াবের অধিকারী? আমরা আল্লাহ্র উপর ঈমান আনিয়াছি এবং আপনার অনুসরণ করিতেছি। তিনি বলিলেন-ইহাতে তোমাদের অসুবিধা কি? তোমাদের মাঝে আল্লাহর রাসূল বিদ্যমান এবং আসমান হইতে অহরহ ওহী নাযিল হইতেছে। কিন্তু তোমাদের পরবর্তী যেই মানব গোষ্ঠী উহা গ্রন্থাকারে পাইয়া ঈমান আনিবে এবং উহার বিধি-নিষেধ মানিয়া চলিবে, তাহারা তোমাদের দ্বিগুণ সওয়াব পাইবে।”
এই হাদীসটি তিনি ভিন্ন সূত্রেও বর্ণনা করেন। যুমরাতা ইব্ন রবীআ মারযূফ ইব্ন নাফে’ হইতে, তিনি সালেহ ইব্ন জুবায়র হইতে ও তিনি আবূ জুমআ হইতে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেন।
এই হাদীস দ্বারা বিভিন্ন অবস্থায় আমলের সওয়াবে বিভিন্নতা প্রমাণিত হয়। এই প্রশ্নে হাদীসবেত্তাদের ভিতর মতান্তর রহিয়াছে। আমি বুখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থের প্রথম দিকে উহা সবিস্তারে আলোচনা করিয়াছি। পরবর্তীদের প্রশংসা এই বিশেষ ক্ষেত্রেই নির্ধারিত। সাধারণভাবে পূর্বসূরীরা উত্তম।
অনুরূপ আরেকটি হাদীস হাসান ইব্ন উরফা আল-আবদী বর্ণনা করেন। তিনি বলেন- আমার কাছে ইসমাঈল ইব্ন আইয়াশ আল হেসী আলমুগীরা ইব্ন কয়স আত্ তামিমী হইতে, তিনি আমর ইব্ন শুআয়ব হইতে, তিনি তাঁহার পিতা হইতে ও তিনি তাঁহার দাদা হইতে বর্ণনা করেনঃ একদা রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমাদের নিকট কাহাদের ঈমান বিস্ময়কর? সাহাবারা জবাব দিলেন-ফেরেশতাদের। তিনি বলিলেন-তাহাদের ঈমান না আনার কোন প্রশ্নই নাই। কারণ, তাহারা আল্লাহর সমীপে রহিয়াছেন। তাহারা বলিলেন-নবীগণের। তিনি বলিলেন—তাঁহাদের ঈমান না আনার প্রশ্নই আসে না। কারণ তাহাদের নিকট ওহী নাযিল হয়। তাহারা বলিলেন- তাহা হইলে আমাদের। তিনি বলিলেন-তোমাদের ঈমান না আনার কি কারণ থাকিতে পারে? আমি স্বয়ং তোমাদের সামনে দীপ্যমান। অতঃপর তিনি বলিলেন-জানিয়া রাখ, আমার কাছে তাহাদের ঈমান বিস্ময়কর যাহারা তোমাদের পরে আসিবে এবং গ্রন্থাকারে আল্লাহ্র কিতাব পাইয়া ঈমান আনিবে ও উহার বিধি-বিধান আমল করিবে।
আবূ হাতিম আর রাযী বলেন-আল মুগীরা ইব্ন কয়স আল বসরীর হাদীস ‘মুনকার’ বলিয়া অভিহিত হয় ৷
আমার বক্তব্য এই যে, আবূ ইয়ালা তাঁহার মুসনাদে, ইব্ন মারদুবিয়্যাহ তাঁহার তাফসীরে এবং হাকিম তাঁহার ‘মুস্তাদরাক’ সংকলনে মুহাম্মদ ইব্ন হামিদ হইতে, তিনি যায়দ ইব্ন আসলাম হইতে, তিনি তাহার পিতা হইতে, তিনি উমর (রাঃ) হইতে ও তিনি রাসূল (সাঃ) হইতে অনুরূপ কিংবা উহার কাছাকাছি হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। হাকিম উহার সূত্রকে সহীহ বলিয়াছেন। তবে সহীহদ্বয়ে উহা উদ্ধৃত হয় নাই। আনাস ইব্ন মালিক (রাঃ) হইতেও ‘মারফু হাদীস’ হিসাবে অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
ইব্ন আবূ হাতিম বলেন-আমার কাছে আমার পিতা, তাহার কাছে আবদুল্লাহ ইব্ মুহাম্মদ আল মুসনাদী তাহার কাছে ইসহাক ইবন ইদরীস সরাসরি বর্ণনা করেন এবং ইবরাহীম ইবন জা’ফর ইব্ন মাহমুদ ইবন সালামা আনসারী ও জা’ফর ইব্ন মাহমুদ তাহার দাদী বুদায়লা হইতে খরব পৌঁছান যে, বুদায়লা বলিয়াছেনঃ ‘আমি জোহর কি আসর নামায হারিছা মসজিদে আদায় করিতেছিলাম। ঈলিয়া মসজিদ (বায়তুল মুকাদ্দাস) আমাদের কিবলা ছিল । সবেমাত্র দুই রাকাআত পড়িয়াছি, এমন সময় খবর আসিল, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) কিবলা পরিবর্তন করিয়া বায়তুল হারামের দিকে মুখ করিয়াছেন। আমরা সঙ্গে সঙ্গে ঘুরিয়া গেলাম। এবং মেয়েদের জায়গায় পুরুষ ও পুরুষের জায়গায় মেয়েরা ঠাঁই নিল। তারপর আমরা বাকী দুই রাকআত নামায বায়তুল হারামকে কিবলা করিয়া আদায় করিলাম।
ইবরাহীম বলেন-বনূ হারিছার এক ব্যক্তি আমাকে বলিয়াছেন যে, রাসূল (সাঃ) এই খবর শুনিয়া বলিলেন—“তাহারাই অদৃশ্য বস্তুর উপর ঈমান আনিল।’
হাদীসটি একই সূত্রে বর্ণিত বিধায় ‘গরীব’ শ্রেণীভুক্ত।
হযরত আব্বাস (রাঃ) বলেন, ويَقَيْمُونَ الصّلوة অর্থাৎ আরকান-আহকাম সহকারে সালাত কায়েম করে।
ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যিহাক বর্ণনা করেন, ইকামাতে সালাত বলিতে রুকূ’, সিজদা, তিলাওয়াত, খুশূ ও কিবলামুখী হওয়া পূর্ণ করাকে বুঝায়।
কাতাদাহ বলেন-ইকামাতে সালাত হইল উহার ওয়াক্ত, ওযূ, রুকূ’ ও সিজদার হেফাজত করা ৷
মাকাতিল ইব্ন হাইয়ান বলেন- সালাত কায়েমের অর্থ হইল উহার ওয়াক্তের হিফাজত, উহার জন্য পবিত্রতা অর্জনে পূর্ণতা, উহার রুকূ-সিজদা সুসম্পন্ন করা, উহাতে কুরআন তিলাওয়াত করা, তাশাহহুদ পড়া ও নবী (সাঃ)- এর উপর দরূদ পাঠ করা। এই হইল ইকামাতে সালাত।
আলী ইব্ন তালহা প্রমুখ ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেন- وَممًا رَرَفْنْهُمٌ ينفقون অর্থাৎ তাহাদের সম্পদের যাকাত প্রদান করে।
আস্ সুদ্দী আবূ মালিক ও আবূ সালেহ হইতে তাঁহারা ইব্ন আব্বাস (রাঃ) ও মুর্রাহ হামদানী হইতে এবং তাঁহারা ইব্ন মাসউদ (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম হইতে وَممًا رَرَفْنْهُمٌ ينفقون -এর অর্থ বর্ণনা করেন, ‘পরিবার-পরিজনের জন্য খরচ করা।’ অবশ্য এই অভিমত যাকাত ফরয হওয়ার পূর্বেকার।
যিহাক হইতে জুয়ায়র বর্ণনা করেন-এখানে ‘খরচ করা’ অর্থ সামর্থ্যানুযায়ী আল্লাহ্ ওয়াস্তে দান করা এবং কৃচ্ছতা অনুসরণ করা। অতঃপর সূরা তওবার সপ্ত আয়াতে নির্ধারিত সাদকা ফরয হয় এবং উহার ফলে এই অনির্ধারিত দানের বিধান বাতিল হয়।
কাতাদাহ বলেন- وَممًا رَرَفْنْهُمٌ ينفقون অর্থ আল্লাহ্ তোমাদিগকে যাহা দান করিয়াছেন তাহা সবই খরচ কর। কারণ, এই সম্পদ তোমার কাছে আমানত ও ঋণস্বরূপ আসিয়াছে। হে আদম সন্তান। অচিরেই এই সম্পদ ও তোমার ভিতর বিচ্ছেদ ঘটিবে।
ইবন জারীর এই অভিমত গ্রহণ করিয়াছেন যে, এই আয়াতাংশ দ্বারা যাকাত ও পারিবারিক খরচপত্র উভয়ই বুঝানো হইয়াছে। তিনি আরও বলেন-এই আয়াতের উত্তম ব্যাখ্যা হইল পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় প্রয়োজনের সকল খাতে উহা খরচ করা। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, গরীব-দুঃখী ও রাষ্ট্রীয় চাহিদার সকল ক্ষেত্রে খরচের জন্যই আল্লাহ্ তা’আলা উহা সাধারণভাবে উল্লেখ করিয়াছেন। তবে সব ধরনের খরচের মধ্যে যাকাত অধিক প্রশংসিত ও উত্তম।
এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা যে বহুবার সালাতের সহিত ইনফাকের উল্লেখ করিয়াছেন তাহা এই জন্য যে, সালাত হইল আল্লাহ্ প্রতি বান্দার কর্তব্য ও আল্লাহ্ জন্য নির্ধারিত ইবাদত। আল্লাহর একত্ব ঘোষণা, তাঁহার প্রশংসা করা, তাঁহার উপর নির্ভর করা ইত্যাদি উক্ত নির্ধারিত ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। পক্ষান্তরে ইনফাক হইল বান্দার প্রতি বান্দার কর্তব্য। আর্থিক সাহায্যের মাধ্যমে বান্দার কল্যাণ সাধনই ইহার লক্ষ্য। এই ক্ষেত্রে উত্তম হইল দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন, গোত্রীয় লোকজন ও চাকর-চাকরাণীগণ। তারপর পাড়া-প্রতিবেশী ও অন্যান্য দেশবাসী। এই ধরনের সকল ওয়াজিব খাত ও যাকাতের ফরয খাত ইনফাক ফী সাবীলিল্লাহর অন্তর্ভুক্ত।
এই কারণে সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে হযরত ইবন উমর (রাঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছে যে, রাসূল (সাঃ) বলেন-ইসলামের ভিত্তি হইল পাঁচটি যেমন-(১) কলেমা (২) নামায (৩) রোযা (৪) হজ্জ ও (৫) যাকাত । এই সম্পর্কে বহু হাদীস বর্ণিত হইয়াছে।
আরবদের পরিভাষায় সালাত অর্থ দোআ। কবি আল আশা বলেনঃ
لها حارس لا يبرح الدهر بيتها – وان ذبجب صلى عليها وزمزما وقابلها الريح في دنها – وصلى علىی دنها و ارتسم
কবি আরও বলেনঃ
تقول بنتي وقد قربت مرتحلا – يارب ذنب ابى الاوصاب والوجعا عليك مثل الذي صليت فاغتمضي – نوما فان لجنب المرء مضطجعا
(٤)
وَالَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا اُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ و بالآخِرَةِ هُمْ يُوقِنُونَ
৪. আর যাহারা তোমার ও তোমার পূর্ববর্তীদের নিকট যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে তাহার উপর বিশ্বাস রাখে এবং পরকালের উপর সুদৃঢ় আস্থা স্থাপন করে ৷
তাফসীরঃ ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলেন- والَذين يؤمكون بما أَنْزل اليك وما أَنْزل অর্থাৎ আল্লাহ্র তরফ হইতে যাহা তোমার নিকট আসিয়াছে ও যাহা তোমার পূর্ববর্তী রাসূলদের নিকট আসিয়াছে তাহার উপর ঈমান রাখে এবং রাসূলদের মধ্যে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করে না ও তাহাদের নিকট তাহাদের প্রভুর তরফ হইতে যাহা আসিয়াছে তাহা লইয়া ঝগড়া করে না। আর وبالاخرة هم يُوقكُون অর্থ পুনরুত্থান, কিয়ামত, জান্নাত, জাহান্নাম, হিসাব, মীযান এই সকল কিছুর উপর দৃঢ় আস্থা স্থাপন করে। আখিরাতের নাম আখিরাত এই জন্য রাখা হইয়াছে যে, উহা পার্থিব জীবনের পরে আসিবে।
এই আয়াতে কাহাদের গুণ বর্ণনা করা হইয়াছে তাহা লইয়া ব্যাখ্যাকারীদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হইয়াছে। ইহাতে কি পূর্ববর্তী আয়াতে যাহাদের গুণ বর্ণনা করা হইয়াছে তাহাদেরই গুণ বর্ণিত হইয়াছে, না অন্য কোন দলের? অন্যদল হইলে তাহারা কাহারা?
ইব্ন জারীর এই ব্যাপারে তিনটি মত উদ্ধৃত করিয়াছেন। এক, প্রথমে যাহাদের গুণ বর্ণনা করা হইয়াছে, দ্বিতীয়বারেও তাহাদেরই গুণ বর্ণিত হইয়াছে। তাহারা হইল সকল স্তরের মু’মিন, হোক আরব মু’মিন কিংবা আহলে কিতাব সহ অন্যান্য মু’মিন। এই মতের প্রবক্তা হইলেন মুজাহিদ, আবুল আলীয়াহ, রবী‘ ইব্ন আনাস ও কাতাদাহ। দুই. তাহারা একই দল এবং তাহারা আহলে কিতাবের মু’মিনগণ। প্রথমোক্ত দল ও দ্বিতীয় দলের গুণ বর্ণনার মাঝখানে তা, ব্যবহার করিয়া বিভিন্ন ধরনের গুণ বর্ণনা করা হইয়াছে। যেমনঃ
سَبِّحِ اسمَ رَبِّكَ الأعْلَى – الَّذِي خَلَقَ فَسَوَّى وَالَّذى قَدْرَ فَهُدًى وَالَّذِي أَخْرَجَ
المرعى فَجَعَلَهُ غُثَاء أحوى
“তোমার সর্বোন্নত প্রভুর তাসবীহ পাঠ কর, যিনি সৃষ্টি করিয়া সামঞ্জস্য দান করিয়াছেন; যিনি প্রকৃতি নির্ধারণ করিয়া তদনুসারে পথের দিশা দিয়াছেন এবং যিনি তৃণগুল্মের উদ্গম ঘটাইয়াছেন। অতঃপর উহা কৃষ্ণবর্ণ বিশুষ্ক করিয়াছেন।”
জনৈক কবির কাব্যেও এইরূপ প্রয়োগ রহিয়াছে । যেমনঃ
الى الملك القوم وابن الهمام – وليث للكتيبة في المزدحم
এখানেও একই মওসুফের বিভিন্ন সিফাতের একটির সহিত অন্যটির সংযোগের জন্য واو ব্যবহার করা হইয়াছে।
তিন. প্রথমোক্ত আয়াতে বর্ণিত গুণাবলীর অধিকারী আরব মু’মিনগণ এবং পরবর্তী আয়াতে বর্ণিত গুণাবলীর অধিকারী হইল আহলে কিতাব অর্থাৎ ইয়াহুদী ও নাসারা মু’মিনগণ। আস্ সুদ্দী তাঁহার তাফসীরে ইব্ন আব্বাস (রা), ইবন মাসউদ (রা) ও অন্যান্য বহু সাহাবার এই অভিমত উদ্ধৃত করিয়াছেন। ইব্ন জারীর (র)-ও এই মত গ্রহণ করিয়াছেন। তিনি ইহার সমর্থনে আল্লাহ্ পাকের এই বাণী পেশ করেনঃ
وَإِنَّ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَمَنْ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِمْ ﺨﺍﺸﻌﯾﺯ
“আহলে কিতাবের ভিতর এমন লোকও রহিয়াছে যাহারা আল্লাহ্র উপর ঈমান রাখে এবং তোমাদের ও তাহাদের উপর যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে তাহার উপর ঈমান রাখে। তাহারা আল্লাহকে ভয় করে।”
অন্যত্র আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
الَّذِينَ أَتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِهِ هُم بِهِ يُؤْمِنُونَ – وَإِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ قَالُوا أَمَنَّا بِهِ إِنَّهُ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّنَا إِنَّا كُنَّا مِنْ قَبْلِهِ مُسْلِمِينَ – أُولَئِكَ يُؤْتُونَ أَجْرَهُمْ مَرَّتَيْنِ بِمَا صَبَرُوا وَيَدْرَؤُونَ بِالْحَسَنَةِ السَّيِّئَةَ وَ مِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ
“পূর্বে যাহাদিগকে কিতাব প্রদান করা হইয়াছে, তাহারা তাহার উপর ঈমান রাখে। যখন তাহাদের কাছে (কুরআন) পড়া হয়, তখন বলে, আমরা উহার উপরও ঈমান আনিলাম । উহা আল্লাহ্র তরফ হইতে প্রেরিত সত্য, আমরা ইহার পূর্বেও মুসলমানই ছিলাম । এই লোকদের দ্বিগুণ সওয়াব দেওয়া হইরে। কারণ, তাহারা সহিষ্ণুতা দেখাইয়াছে এবং খারাপটি বদলাইয়া ভালটি গ্রহণ করিয়াছে। আর তাহাদিগকে আমি যাহা কিছু রুযী দান করিয়াছি তাহা (আমার নির্দেশিত পথে) খরচ করে।”
ইহার সমর্থনে সহীহদ্বয়ের শা’বী বর্ণিত হাদীস রহিয়াছে। ইমাম শা’বী আবূ বুরদা হইতে ও তিনি আবূ মূসা হইতে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেন-তিন দলকে দ্বিগুণ সওয়াব দেওয়া হইবে। এক, আহলে কিতাবের যে ব্যক্তি তাহার নবীর উপর ও আমার উপর ঈমান আনিয়াছে। দুই, যে গোলাম আল্লাহ্ হক ও তাহার মালিকের হক দুইটিই যথাযথভাবে আদায় করে। তিন, যে ব্যক্তি নিজ দাসীকে আদব-কায়দা ভালভাবে শিখাইয়া আযাদ করত বিবাহ দিয়া দিল।
ইমাম ইবন জারীর (রঃ) তাঁহার মতের সমর্থনে যে দলীল পেশ করিয়াছেন, উহার সহিত কুরআনের পূর্বাপর বর্ণনারও সম্পর্ক রহিয়াছে। এই সূরার শুরুতে আল্লাহ্ তা’আলা মু’মিন ও কাফিরের পরিচয় দিয়াছেন। সেখানে যেভাবে তিনি কাফিরের দুই শ্রেণী দেখাইয়াছেন, কাফির ও মুনাফিক, তেমনি মু’মিনের দুই শ্রেণী দেখাইলেন-আরব মু’মিন ও কিতাবী মু’মিন।
এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য এই যে, মুজাহিদের অভিমতই সুস্পষ্ট। তিনি ছাওরী হইতে, তিনি জনৈক ব্যক্তি হইতে ও তিনি মুজাহিদ হইতে অভিমতটি উদ্ধৃত করেন। তাহা ছাড়া একাধিক ব্যক্তি ইব্ন আবূ নাজীর বরাত দিয়া মুজাহিদের অভিমতটি বর্ণনা করেন। মুজাহিদ বলেনঃ
“সূরা বাকারার প্রথম চারি আয়াতে মু’মিনদের গুণাবলী বর্ণনা করা হইয়াছে, পরবর্তী দুই আয়াতে কাফিরের চরিত্র বর্ণনা করা হইয়াছে, পরবর্তী তের আয়াতে মুনাফিকের পরিচয় প্রদান করা হইয়াছে ৷ প্রথম চারি আয়াতে সাধারণত প্রত্যেক মু’মিনের গুণাবলী বর্ণনা করা হইয়াছে, সে আরবী কি কিতাবী কি আজমী কি মানব কি জ্বিন যাহাই হউক না কেন। উক্ত গুণাবলী আলাদা আলাদা বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করা ঠিক হইবে না। প্রত্যেকের জন্যই উক্ত গুণাবলী অপরিহার্য। কারণ, এক দলের জন্য ঈমান বিল গায়েব, সালাত ও যাকাত শর্ত করা হইবে এবং রাসূল (সাঃ) এবং পূর্ববর্তী রাসূলদের নিকট অবতীর্ণ কিতাবের উপর ও আখিরাতের উপর ঈমান আনা শর্ত করা হইবে না, ইহা ঠিক হইতে পারে না। কারণ আল্লাহ্ তা’আলা প্রত্যেক মু’মিনের জন্য উক্ত গুণাবলীর সবগুলিই শর্ত করিয়াছেন। যেমন তিনি বলেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَمِنُوا بِاللَّهِ وَرَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي نَزَّلَ عَلَى رَسُولِهِ وَالْكِتَابِ الَّذِي أُنْزِلَ مِنْ قَبْلُ
“হে মু’মিনগণ। আল্লাহ্, তাঁহার রাসূল, রাসূলের উপর অবতীর্ণ গ্রন্থ, এমনকি পূর্ববর্তী রাসূলগণের উপর অবতীর্ণ গ্রন্থাবলীর উপর ঈমান আন।”
তিনি অন্যত্র বলেনঃ
وَلَا تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِلَّا الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ
وَقُوْلُوْا أَمَنَّا بِالَّذِي أُنْزِلَ إِلَيْنَا وَأُنْزِلَ إِلَيْكُمْ وَالْهُنَا وَإِلَهُكُمْ وَاحِدٌ
“আহলে কিতাবদের সহিত উত্তম পন্থায় তর্ক করিও। তবে তাহাদের জালিমদের কথা স্বতন্ত্র। তাহাদিগকে এই কথা বল যে, আমাদের উপর যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে এবং তোমাদের উপর যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে, উহার সব কিছুর উপর আমরা ঈমান আনিয়াছি এবং আমাদের প্রভু ও তোমাদের প্রভু তো একজনই।”
তিনি অন্যত্র বলেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ أوتُوا الْكِتَابَ أمِنُوا بِمَا نَزَّلْنَا مُصَدِّقًا لِمَا مَعَكُمْ
“হে আহলে কিতাব। আমি এখন যাহা অবতীর্ণ করিয়াছি তাহার উপর ঈমান আন। উহা তো তোমাদের কিতাবেরও সত্যতা ঘোষণা করিতেছে।”
আল্লাহ্ তা’আলা আরও বলেনঃ
قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَسْتُمْ عَلَى شَيْءٍ حَتَّى تُقِيمُوا التَّوْرَاةَ وَالإِنْجِيلَ وَمَا أنْزِلَ إِلَيْكُم مِن رَّبِّكُمْ
“বল, হে আহলে কিতাব, তোমাদের কোন ভিত্তিই নাই যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা তাওরাত, ইঞ্জীল ও এখন তোমাদের সম্মুখে যাহা অবতীর্ণ হইল তাহা কায়েম না করিবে।”
এই সবগুলি একত্র করিয়াও আল্লাহ্ তা’আলা মু’মিনদের জানাইয়া দিয়াছেন। তিনি বলেনঃ
أمَنَ الرَّسُولُ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْهِ مِنْ رَّبِّهِ وَالْمُؤْمِنُونَ – كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِ وَرُسُلِهِ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ رُسُلِهِ
“রাসূল তাহার প্রভুর তরফ হইতে তাহার উপর অবতীর্ণ কিতাবের উপর ঈমান আনিয়াছে এবং মু’মিনগণও। তাহারা সকলেই আল্লাহর উপর, তাহার ফেরেশতার উপর, তাঁহার কিতাবের উপর ও তাঁহার রাসূলদের উপর ঈমান আনিয়াছে। (তাহারা বলে) আমরা তাঁহার রাসূলদের মধ্যে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করি না।”
অন্যত্র তিনি বলেনঃ
وَالَّذِيِنَ أمَنُوا بالله ورسلع ولم يَفْرَقُوا بين أحد مِنْهم “আর যাহারা আল্লাহর উপর ও তাঁহার রাসূলদের উপর ঈমান আনিয়াছে এবং তাহাদের মধ্যে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করে নাই।”
এই সমস্ত আয়াতে একটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, সকল মু’মিনই আল্লাহ্ তা’আলা, তাঁহার রাসূলগণ ও তাঁহার কিতাবসমূহের উপর ঈমান আনয়ন করিয়া থাকেন। তবে আহলে কিতাবদ্বয়ের মু’মিনদের বৈশিষ্ট্য রহিয়াছে। কারণ, তাঁহারা পূর্ববর্তী কিতাবের সকল কিছুর উপর যেরূপ ঈমান আনিয়াছিল, তেমনি এই কিতাবের সকল কিছুর উপর ঈমান আনিয়াছে। তাই তাহারা দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী। পক্ষান্তরে অন্য মু’মিনগণ তাহাদের কিতাবের তো সকল কিছুর উপর ঈমান আনিয়াছে কিন্তু পুর্ববর্তী কিতাবের উপর মোটামুটিভাবে ঈমান রাখে। যেমন-সহীহ বুখারীতে আছে,-‘আহলে কিতাব যদি তোমাদের কাছে কিছু বর্ণনা করে তাহা হইলে মিথ্যা বলিও না, সত্যও বলিও না। এই কথা বল, আমাদের উপর যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে এবং তোমাদের উপর যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে, আমরা উহার উপর ঈমান রাখি।’
অবশ্য কখনও আবার অন্য মু’মিনেরও মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পূর্ণতম ও ব্যাপকতম ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণের ফলে আহলে কিতাবের দীক্ষিত মু’মিনের চাইতে ঈমানের পাল্লা ভারী হইয়া থাকে। তাহার ফলে কিতাবী মু’মিনের প্রাপ্ত দ্বিগুণ সওয়াবও অন্য মু’মিনরা অতিক্রম করিয়া থাকে। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
(٥)
أوليكَ عَلى هُدًى مِّنْ رَّبِّهِمْ وَأُولَبِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
৫. তাহারা তাহাদের প্রভুর নির্দেশিত হিদায়েতের উপর রহিয়াছে এবং তাহারাই সাফল্যমণ্ডিত।
তাফসীরঃ আল্লাহ্ পাকের বাণী أو لحك অর্থ পূর্বোক্ত গুণাবলী যথা অদৃশ্য বস্তুতে ঈমান, সালাত কায়েম, আল্লাহ্ প্রদত্ত রুযী বিতরণ, রাসূল (সাঃ) ও পূর্ববর্তী রাসূলদের উপর অবতীর্ণ কিতাবসমূহ ও আখিরাতের উপর দৃঢ় বিশ্বাস। মূলত হারাম কার্যাবলী হইতে বাঁচিয়া নেক কাজ করার শক্তি ও যোগ্যতা অর্জনের জন্য উক্ত গুণাবলী অপরিহার্য। আল্লাহর বাণী على هدى অর্থ আল্লাহর তরফ হইতে প্রেরিত আলো, বর্ণনা ও প্রজ্ঞা। আয়াতাংশ وأولئك هم الْمُفْلحُون অর্থ ইহ ও পারলৌকিক সাফল্য অর্জন। মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক ইব্ন মুহাম্মদ ইব্ন আবূ মুহাম্মদ হইতে, তিনি ইকরামা হইতে, তিনি সাঈদ ইব্ন জুবায়র হইতে ও তিনি হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ
أو لك على هدى من يهم অর্থাৎ আল্লাহ্ প্রেরিত নূর ও উহার ধারক কুরআনের উপর স্থিতি লাভ। আর أولئك هم المفلحون অর্থাৎ তাহারা বাঞ্ছিত বস্তু পাইল এবং অবাঞ্ছিত বস্তু হইতে রেহাই পাইল।
ইবন জারীর বলেনঃ أو لمك على هدى من ريهم -এর তাৎপর্য হইল এই যে, তাহারা তাহাদের প্রভুর তরফ হইতে প্রাপ্ত আলো ও দলীলের সাহায্যে দৃঢ়তা সহকারে সঠিক পথে চলার শক্তি অর্জন করিয়াছে। আর أو نك هم المفلحون অর্থাৎ তাহারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হইয়াছে এবং আল্লাহ্, রাসূল ও কিতাবের উপর ঈমান আনিয়া নেক আমল করার মাধ্যমে তাহারা যাহা কিছু আশা করিয়াছে, তাহা পাইয়াছে। অর্থাৎ জান্নাতের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার যোগ্যতা লাভ করিয়াছে ও আল্লাহ্ তাঁহার দুশমনদের জন্য যে জাহান্নাম তৈয়ার করিয়া রাখিয়াছেন, তাহা হইতে রেহাই লাভ করিয়াছে।
ইব্ন জারীর অন্য এক দলের এই অভিমত উদ্ধৃত করেন যে, أو لمك ইঙ্গিতবহ পদটির পুনরাবৃত্তিমূলক اولك على هدى من ربّهم ও أو لمك هم ١ مفلحؤن দ্বারা আহলে কিতাবদের ইয়াহুদী মু’মিন ও নাসারা মু’মিনদের দিকে ইঙ্গিত করা হইয়াছে। এই অভিমত যে ঠিক নহে, তাহা পূর্বেই বলা হয়াছে। বরং উহা আরবী, আজমী, কিতাবী অকিতাবী সর্বস্তরের ঈমানদারের প্রতি ইঙ্গিতবহ। উক্ত অবস্থায় والذين يؤمنون بما أنْزل اليك পূর্বের সহিত সম্পর্কহীন হইয়া ‘মুবতাদা’ হিসাবে মারফূ’ বিশিষ্ট হয় এবং উহার ‘খবর’ হিসাবে أولخك مهم المُفلحؤن আসে। কিন্তু গ্রহণযোগ্য মত আস সুদ্দী উদ্ধৃত করেন। তিনি আবূ মালিক হইতে, তিনি আবূ সালেহ হইতে, তিনি ইব্ন আব্বাস ও মুাহ আল হামদানী হইতে এবং তাঁহারা ইব্ন মাসউদ (রা) ও অন্যান্য সাহাবা হইতে বর্ণনা করেন الّذين يؤمنون بِالْعَيْب হইল আরব মু’মিনগণ এবং وَالدِيْنَ يُوْمِنُوْنَ بمًا أئزل الَيْكَ وَمَا نل من مَبْلكَ হইল কিতাবী মু’মিনগণ এবং উভয় গ্রুপকে একত্র করিয়া বলা হইল أولخك على هُدًى مِّنْ رَّبِّهِمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ পূর্বেই বলা হইয়াছে, মু’মিনদের জন্য চারি আয়াতে বর্ণিত সকল গুণাবলী সর্বপ্রকারের মু’মিনের থাকিতে হইবে। কাতাদাহ, রবী’ ইব্ন আনাস ও আবুল আলীয়া মুজাহিদ হইতে এই অভিমত উদ্ধৃত করিয়াছেন। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
ইব্ন আবূ হাতিম বলেন-আমাকে আমার পিতা, তাঁহাকে ইয়াহিয়া ইবন উসমান ইবন সালেহ আল মিসরী, তাঁহাকে তাঁহার পিতা ও তাঁহাকে ইব্ন লাহিআ বলেন-আমাকে উবায়দুল্লাহ ইবনুল মুগীরা ও আবুল হায়ছাম সুলায়মান ইব্ন আব্দুল্লাহ হইতে এবং তাহারা আবদুল্লাহ ইবন উমরের বরাতে নবী করীম (সাঃ) হইতে এই হাদীস শুনানঃ
একদিন নবী করীম (সাঃ)-কে বলা হইল-হে আল্লাহর রাসূল। আমরা কুরআন হইতে তিলাওয়াত করি এবং আশান্বিত হই। আবার এমন কিছু আয়াত তিলাওয়াত করি যাহাতে নিরাশ হইয়া পড়ি। তখন তিনি বলিলেন-আমি কি তোমাদের কাহারা জান্নাতী ও কাহারা জাহান্নামী তাহা বলিব? সবাই বলিল, হ্যাঁ, হে আল্লাহ্র রাসূল বলুন। তখন তিনি ‘আলিফ-লাম-মীম যালিকাল কিতাবু’ হইতে ‘মুফলিহুন’ পর্যন্ত পাঠ করিয়া বলিলেন-ইহারা জান্নাতী। আমি আশা করি, তোমরা তাহাদের দলে। অতঃপর তিনি ‘ইন্নাল্লাযীনা কাফারূ’ হইতে ‘আযাবুন আজীম’ পর্যন্ত পাঠ করিয়া বলিলেন—ইহারা হইল জাহান্নামী। তাহারা বলিল-হে আল্লাহর রাসূল। আমরা তাঁহাদের মত নহি। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলিলেন-হ্যাঁ ৷
( ۶ )
اِنَّ الَّذِیۡنَ كَفَرُوۡا سَوَآءٌ عَلَیۡهِمۡ ءَاَنۡذَرۡتَهُمۡ اَمۡ لَمۡ تُنۡذِرۡهُمۡ لَا یُؤۡمِنُوۡنَ
৬. নিশ্চয় যাহারা কাফির তাহাদিগকে সতর্ক কর বা না কর একই কথা, তাহারা ঈমান আনিবে না।
তাফসীরঃ أن الّْذين كفروا অর্থাৎ সত্য যাহাদের নিকট আচ্ছাদিত রহিয়াছে। আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদের ক্ষেত্রে এই বিধান লিপিবদ্ধ করিয়াছেন যে, তাহাদিগকে সতর্ক করা আর না করা সমান কথা, তাহারা কিছুতেই ঈমান আনিবে না।
যেমন আল্লাহ্ তা’আলা অন্যত্র বলেনঃ
إنَّ الَّذِينَ حَقَّتْ عَلَيْهِمْ كَلِمَةً رَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ وَلَوْ جَاءَتْهُمْ كُلُّ آيَةٍ حَتَّى يَروا الْعَذَابَ الْأَلِيم
“নিশ্চয় যাহাদের ব্যাপারে তোমার প্রভুর কথা বাস্তব হইয়া ধরা দিয়াছে, তাহাদের কাছে যাবতীয় নিদর্শন হাজির হইলেও তাহারা ঈমান আনিবে না, যতক্ষণ না তাহারা স্বচক্ষে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রত্যক্ষ করিবে।”
আল্লাহ্ পাক আহলে কিতাবের ইসলাম দুশমনদের সম্পর্কে বলেনঃ وَلَمْن أنَيت الَّذْيْنَ أونُوا الكتاب بكل ايّة ما تَبعوا قَبُِلَتَكَ “আহলে কিতাবদের নিকট যদি তুমি সকল প্রমাণাদিও সমুপস্থিত কর, তবু তাহারা কিছুতেই তোমার কিবলা অনুসরণ করিবে না।”
অর্থাৎ যাহার পাপী হওয়ার ব্যাপারটি আল্লাহ্ তা’আলার কিতাবে লিপিবদ্ধ হইয়াছে, তাহা নেক্কার হওয়ার ভাগ্য হইবে না। তেমনি তিনি যাহার বিভ্রান্তি মঞ্জুর করিয়াছেন, তাহার জন্য কেহ পথ প্রদর্শক হইতে পারে না। তাই তাহাদের জন্য তুমি দুঃখ করিও না। তুমি তাহাদের কাছে তোমার রিসালাতের জিম্মাদারী আদায় কর। যাহারা তোমার ডাকে সাড়া দিবে, তাহারাই সৌভাগ্য লাভ করিবে আর যাহারা সাড়া দিল না, তাহাদের জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইও না। “তোমার কাজ আমার বাণী পৌঁছানো আর আমার কাজ হিসাব-নিকাশ লওয়া। তুমি সতর্ককারী মাত্র আর আল্লাহ্ তা’আলাই সকল ব্যাপারের অভিভাবক। ”
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ)-এর বরাত দিয়া ‘আলী ইব্ন আবূ তালহা আলোচ্য আয়াতের তাৎপর্য সম্পর্কে বলেন-রাসূল (সাঃ) চাহিতেন যেন সকল লোক ঈমান আনে এবং তাঁহার নির্দেশিত হিদায়েতের পথ অনুসরণ করে। তাই আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহাকে জানাইয়া দিলেন, আল্লাহ্ পাকের ইলমে হিদায়েত লাভের সৌভাগ্য যাহাদের রহিয়াছে তাহারাই ঈমান আনিবে। আর যাহাদের সেই সৌভাগ্য নাই তাহারা ঈমান আনিবে না।
মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক বলেন-আমাকে মুহাম্মদ ইব্ন আবূ মুহাম্মদ ইকরামা কিংবা সাঈদ ইবন জুবায়র হইতে ও তিনি ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ ان الَدمِنَ كَفَروا অর্থাৎ তোমার নিকট যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে তাহা যাহারা অস্বীকার করে এবং বলে, আমরা আমাদের উপর তোমার পূর্বেই যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে তাহার উপর ঈমান রাখি। سواء عَلَيْهدٌ ءأنذر نهم أم لم تنذر هم لأيؤّمنون অর্থাৎ তাহারা তোমাকে অস্বীকার করিয়া নিজেদের কিতাবই অস্বীকার করিয়াছে। কারণ, তাহাদের কিতাবে তোমার উল্লেখ রহিয়াছে। তাহাদের নিকট হইতে যে পাক্কা ওয়াদা গ্রহণ করা হইয়াছিল তাহারা তাহার বিরোধী হইয়াছে। তাহারা যখন নিজেদের উপর ও তোমার উপর অবতীর্ণ উভয় কিতাব অস্বীকার করিতেছে, তখন তাহারা তোমার সতর্কতার প্রতি কি করিয়া কর্ণপাত করিবে? তাহারা তো জানিয়া শুনিয়াই কুফরী করিতেছে।
আবূ জা’ফর আর রাযী রবী’ ইব্ন আনাস হইতে ও তিনি আবুল আলীয়া হইতে বর্ণনা করেন-আলোচ্য আয়াতদ্বয় আহযাবের যুদ্ধের সেই সব নেতা সম্পর্কে আসিয়াছে যাহাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ পাক বলেনঃ
ألَمْ تَرَى إِلَى الَّذِينَ بَدَّلُوا نِعْمَةَ اللهِ كُفْرًا اَحَلُّوْا قَوْمُهُمْ دَارَ الْبَوَارِ – جَهَنَّمَ يَصْلَوْنَهَا
“তুমি কি তাহাদের দেখ নাই যাহারা আল্লাহ্ প্রদত্ত নি’আমতকে কুফরীর বিনিময়ে বদল করিয়াছে…..ইত্যাদি।
আলোচ্য আয়াতের অর্থ ‘আলী ইব্ন তালহা হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যাহা বর্ণনা করিয়াছেন তাহাই সঠিক ও সুস্পষ্ট। আমি উহা ইতিপূর্বে উদ্ধৃত করিয়াছি। অবশিষ্ট আয়াতের তাৎপর্যও উহাতে ব্যক্ত হইয়াছে। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
এই প্রসঙ্গে ইব্ন আবূ হাতিম একটি বর্ণনা প্রদান করেন। তিনি বলেন-আমাকে আমার পিতা, তাহাকে ইয়াহিয়া ইব্ন উসমান ইব্ন সালেহ আল মিসরী, তাহাকে তাহার পিতা ও তাহাকে ইব্ন লাহি‘আ বলেন-আমাকে উবায়দুল্লাহ ইবনুল মুগীরা ও আবুল হায়ছাম সুলায়মান ইব্ন আবদুল্লাহ হইতে এবং তাহারা আবদুল্লাহ ইবন উমর (রাঃ) হইতে রসূলে পাক (সাঃ) সম্পর্কিত নিম্ন ঘটনাটি বর্ণনা করেনঃ
একদা নবী করীম (সাঃ)-এর কাছে আরয করা হইল-হে আল্লাহর রাসূল। আমরা কুরআনের কিছু আয়াত তিলাওয়াত করিয়া অত্যন্ত আশান্বিত হই; আবার কিছু আয়াত তিলাওয়াত করিয়া নিরাশ হইয়া পড়ি। তখন তিনি বলিলেন-আমি কি তোমাদিগকে জান্নাতী ও জাহান্নামীর পরিচয় দিব? সকলেই বলিল-হ্যাঁ, দিন। তখন তিনি ইন্নাল্লাযীনা কাফার হইতে ‘লায়্যু’মিনূন’ পর্যন্ত পাঠ করিয়া বলিলেন-ইহারা জাহান্নামী। তাহারা বলিল-‘হে আল্লাহ্র রাসূল! আমরা তাহাদের মত নহি।’ তিনি বলিলেন-হ্যাঁ।
পাক কালামের لأيؤّْمنون পূর্বে বিষয়ের তাকীদজনিত বাক্য سواء عَلَيْهمٌ ءأنذر تهم أم لم تنذرهم لأيؤمنون অর্থাৎ তাহারা সর্বাবস্থায়ই কাফির থাকিবে। তাই আল্লাহ্ لأيؤْمنُون বলিয়া উহাতে তাকীদ সংযোগ করিলেন। لأيؤْمنُون আবার খবরও হইতে পারে। তখন ان الّذيِن كَفْروًا হইবে মুবতাদা। সেক্ষেত্রে سَوَاءٌ عَلَيْهِم انذرتهم أم لم تنذر هم এ বাক্যটি জুমলা-ই-মু’তারাযা (বাক্যের মধ্যে স্বতন্ত্র বাক্য) হইবে। আল্লাহ্ই সৰ্বজ্ঞ।
(۷)
خَتَمَ اللّٰهُ عَلٰی قُلُوۡبِهِمۡ وَ عَلٰی سَمۡعِهِمۡ ؕ وَ عَلٰۤی اَبۡصَارِهِمۡ غِشَاوَۃٌ ۫ وَّ لَهُمۡ عَذَابٌ عَظِیۡمٌ
৭. আল্লাহ্ তাহাদের অন্তরে ও কর্ণকূহরে মোহর লাগাইয়াছেন ও তাহাদের চক্ষে ছানি পড়িয়াছে এবং তাহাদের জন্য মহাশাস্তি রহিয়াছে।
তাফসীরঃ আস্ সুদ্দী বলেনঃ حكم الله অর্থ আল্লাহ্ সীল মারিয়াছেন। কাতাদাহ বলেন-তাহাদের উপর শয়তান প্রভাব বিস্তার করায় তাহারা শয়তানের অনুগত হইয়াছে। তাই আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদের অন্তরে ও কর্ণকুহরে মোহর লাগাইয়াছেন এবং চক্ষে তাহাদের পর্দা পড়িয়াছে। ফলে তাহারা সঠিক পথ দেখিতে পায় না, সঠিক কথা শুনিতে পায় না ও সঠিক ব্যাপার বুঝিতে পায় না ৷
ইব্ন জুরায়জ বলেন-মুজাহিদ বলিয়াছেন, خَتَمَ اللّٰهُ عَلٰی قُلُوۡبِهِمۡ অর্থাৎ পাপের কালিমা অন্তরের চারিদিক ছাইয়া ফেলিয়াছে। ফলে উহা মোহরের কাজ দিতেছে। ইবন জুরায়জ বলেন-অন্তর ও কর্ণকুহরের জন্য মোহর শব্দ ব্যবহারের প্রচলন রহিয়াছে। ইবন জুরায়জ আরও বলেন-আমাকে আবদুল্লাহ ইব্ন কাছীর বর্ণনা করেন যে, তিনি মুজাহিদকে বলিতে শুনিয়াছেন, الران শব্দটি الطبع হইতে সহজতর ও الطبع শব্দ اقفال হইতে সহজতর এবং اقفال কুরআনে ব্যবহৃত তিন শব্দের ভিতরে কঠিনতর অর্থ প্রকাশ করে।
আ’মাশ বলেন-মুজাহিদ আমাদিগকে তাঁহার হাত দেখাইয়া বলিলেন-অন্তরটিও এইরূপ অর্থাৎ হাতের তালুর মতই। যখন বান্দা কোন পাপ করে তখন একটি অঙ্গুলি বন্ধ হইয়া যায়। এইভাবে পর পর পাপ করিতে থাকিলে একে একে পাঁচটি আঙ্গুল বন্ধ হইয়া মুষ্টিবদ্ধ হয়। ফলে সেই হাতের তালুতে আর কিছুই ঢুকিতে পারে না। ইহাকেই বলে অন্তরে মোহর মারা।
ইব্ন জারীর আবূ কুরাইব হইতে, তিনি ওকী’ হইতে, তিনি আ’মাশ হইতে ও তিনি মুজাহিদ হইতে অনুরূপ বর্ণনা শুনান।
ইবন জারীর বলেন যে, কেহ কেহ বলেন, خَتَمَ اللّٰهُ عَلٰی قُلُوۡبِهِمۡ বাক্যটির দ্বারা আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদের অহংকার ভরে ঘাড় ফিরানোর খবর দিলেন। সত্যের ডাক শুনিয়াও তাহারা দম্ভভরে ঘাড় ফিরাইয়া নিল। ফোন বলা হয়, অমুক ইহা যেন শুনিতেই পায় না । ইহা তখনই বলা হয়, যখন কেহ কথা শুনিতেই রাযী হয় না এবং দম্ভভরে অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া রাখে।
ইন জারীর বলেন-উক্ত অভিমত ঠিক নহে। কারণ আল্লাহ্ তা’আলা তো খবর দিলেন তাহাদের অন্তরে ও কর্ণ কুহরে তাঁহারই মোহর মারার।
এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য এই, ইমাম ইব্ন জারীরের এই অভিমত খণ্ডনের জন্য আল্লামা যামাখশারী সুদীর্ঘ বহাস করিয়াছেন। তিনি আয়াতটির পাঁচটি ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছেন। উহার প্রত্যেকটিই অত্যন্ত দুর্বল। তাহার মু’তাযেলী ধ্যান-ধারণা তাঁহাকে এই ধরনের ভুল ব্যাখ্যা দানে উৎসাহিত করিয়াছে। আল্লাহ্ তা আলা স্বয়ং বান্দার অন্তরে মোহর লাগাইলেন ইহা তাঁহার কাছে খারাপ লাগিয়াছে। আল্লাহ্ তা’আলা খারাপ কিছু করিতে পারেন না বলিয়া তিনি সেই সব ব্যাখ্যার আশ্রয় লইয়াছেন ৷ অথচ তিনি যদি আল্লাহ্ তা’আলার এই বাণীগুলি বুঝিতে চেষ্টা করিতেন তাহা হইলে অনুরূপ ভুল করিতেন না। যেমনঃ
فَلَمَّا زاغوا أَرَاغَ الله قلوبهم “তাহারা যখন অন্তর বাঁকা করিল তখন আল্লাহ্ তা‘আলাও তাহাদের অন্তর বাঁকা করিয়া দিলেন।”
অন্যত্র তিনি বলেনঃ
وَنُقَلِبُ أَفْئِدَهُمْ وَأَبْصَارَهُمْ كَمَا لَمْ يُؤْمِنُ بِهِ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَنَذَرْهُمْ فِي طُغْيَانِهِمْ يعمهون
“আমি তাহাদের অন্তর ও চক্ষু এমনভাবে ফিরাইয়া দেই যেন তাহারা প্রথম হইতেই ঈমান আনে নাই এবং তাহাদিগকে তাহাদের অবাধ্যতার ক্ষেত্রে এমন সুযোগ দেই, যেন তাহারা উধভ্রান্তের মত চক্কর খাইতে থাকে।”
এই ধরনের আয়াতগুলি প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্ তা’আলা নিজেই অন্তরসমূহে মোহর মারিয়াছেন। ফলে তাহারা হিদায়েতপ্রাপ্ত হয় না। ইহাই সঠিক বিচার। যেহেতু সে জানিয়া শুনিয়া সত্য ত্যাগ করিয়া বাতিলের অনুসরণ করিতেছে, তাই আল্লাহ্ তা’আলা তাহার ব্যাপারে ইনসাফ করিয়াছেন। ইহা তাঁহার কোন খারাপ কাজ নহে, ইনসাফ তো সুন্দর কাজ। তিনি যদি এইটুকু জানিতে ও বুঝিতে পারিতেন তাহা হইলে যাহা বলিয়াছেন তাহা বলিতেন না। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
ইমাম কুরতুবী বলেন-উম্মতের ইজমা এই তাৎপর্যের উপরে যে, আল্লাহ্ তা’আলা স্বয়ং কোন কোন বান্দার সজ্ঞাত কুফরীর অপরাধে তাহার অন্তরে সীল মারিয়া দেন। যেমন তিনি বলেনঃ
بل طبع الله عليها بكفرهم “বরং আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদের কুফরীর কারণে তাহাদের অন্তরে ছাপ মারিয়া দেন।”
তিনি প্রসঙ্গত অন্তর পরিবর্তনের تقليب القلوب হাদীস উদ্ধৃত করেন। ইহাতে বলা হইয়াছে—“হে অন্তর পরিবর্তনকারী! তুমি আমার অন্তরকে তোমার দীনের উপর স্থির করিয়া দাও।”
তিনি হযরত হুযায়ফা (রাঃ)-এর হাদীসও উদ্ধৃত করেন। হযরত হুযায়ফা (রাঃ) নবী করীম (সাঃ)-এর এই বর্ণনা শুনানঃ
“নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘ফিতনা অন্তরের উপর বেষ্টনীর কাজ করে। উহা প্রভাব গ্রহণকারী অন্তরকে ধাপে ধাপে বিন্দু বিন্দু কালো দাগের আস্তরে আবদ্ধ করিয়া দেয়। যে অন্তর ফিতনার প্রভাব অস্বীকার করে, উহা সমগ্র অন্তরকে শুভ্র সমুজ্জ্বল করিয়া দেয়। ফলে কোন দিনই ফিতনা তাহারা ক্ষতি করিতে পারে না। পক্ষান্তরে ফিতনা গ্রহণকারীরা সেই মসীলিপ্ত অন্তরটি উপুড় করা কলসের মত ভাল-মন্দ চিনার ও গ্রহণের সম্পূর্ণ অযোগ্য হইয়া যায়।” (অসমাপ্ত)
ইবন জারীর বলেন- এই প্রশ্নে আমার কাছে এই হাদীসের বর্ণনাটি যথাযথ মনে হয়। আমাকে মুহাম্মদ ইব্ন বিশার, তাহাকে সাফওয়ান ইব্ন ঈসা, তাহাকে আজলান কা’কা’ হইতে, তিনি আবূ সালেহ হইতে এবং তিনি আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ
“রাসূল (সাঃ) বলিয়াছেন- কোন মু’মিন যখন একটি পাপ করে, তখন তাহার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে। যদি তওবা করে ও অনুতপ্ত হয়, তখন উহা মুছিয়া যায়। পক্ষান্তরে যদি পাপ বাড়িতেই থাকে, তখন কালো দাগ বৃদ্ধি পাইয়া অন্তর গ্রাস করিয়া ফেলে। উহাই অন্তরের মরিচা। যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ
كلا بَلْ سكته ران على قُلُوْبِهِمْ ما كَانُوَا يُكُسِبون “কখনই তাহা নহে; বরং তাহাদের পাপাচারের কারণে অন্তরে তাহাদের মরিচা পড়িয়া গিয়াছে।”
এই হাদীসটি উক্ত বর্ণনাসহ ইমাম তিরমিযী ও ইমাম নাসাঈ কুতায়বা ও লায়ছ ইব্ন সা’দ হইতে উদ্ধৃত করেন। উহা ইব্ন মাজাহ উদ্ধৃত করেন হিশাম ইব্ন আম্মার হইতে এবং তিনি হাতিম, ইসমাঈল ও ওয়ালিদ ইব্ন মুসলিম হইতে এবং তাহারা উহা বর্ণনা করেন মুহাম্মদ ইব্ন আজলান হইতে। ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে ‘হাসান সহীহ’ বলিয়াছেন।
ইবন জারীর বলেন- রাসূল (সাঃ) বলিয়াছেন, পাপ যখন অন্তরে প্রবিষ্ট হয়, তখন অন্তরকে তালাবদ্ধ করিয়া দেয়। তখনই উহাতে আল্লাহর তরফ হইতে মোহর লাগিয়া যায়। ফলে সেই অন্তরে ঈমান প্রবেশের কোন রাস্তা থাকে না। আর কুফরও উহা হইতে বাহির হইতে পারে না। ইহাই মোহর লাগানো ও ছাপ মারা যাহা আল্লাহ্ তা’আলা حَكَمْ اللّهُ عَلَى قُلُوْبِهِمْ وَعلى سمعهم আয়াতে প্রকাশ করিয়াছেন।
মোহর লাগানো ও সীল মারা পাত্র হইতে উহা না ভাঙ্গিয়া যে কোন কিছু ঢুকানো ও বাহির করা যায় না, তাহা তো সকলেই দেখিয়া থাকে। তেমনি মোহার লাগানো ও সীল মারা অন্তরেও উহার সীল ও মোহর অপসারণ না করা পর্যন্ত ঈমান ঢুকিতে কিংবা কুফর বাহির হইতে পারে না।
حَكَمْ اللّهُ عَلَى قُلُوْبِهِمْ وَعلى سمعهم -এর পর পূর্ণ বিরতি হইবে এবং ইহা একটি পূর্ণ বাক্য। কারণ মোহর বা সীল শুধু অন্তর ও কর্ণকূহরের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। অর্থ পর্দা বা আবরণ যাহা চক্ষুর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
আস্ সুদ্দী তাঁহার তাফসীর গ্রন্থে আবূ মালিক হইতে, তিনি আবূ সালেহ হইতে, তিনি ইব্ন আব্বাস ও মুরা আল-হামদানী হইতে ও তাঁহারা ইব্ন মাসউদ (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবা হইতে বর্ণনা করেনঃ حَكَمْ اللّهُ عَلَى قُلُوْبِهِمْ وَعلى سمعهم অর্থ তাহারা বুঝিতে পায় না, শুনিতেও পায় না এবং তাহাদের চোখে পর্দা সৃষ্টি করায় তাহারা দেখিতেও পায় না।
ইব্ন জারীর বলেন- আমাকে মুহাম্মদ ইব্ন সা’দ তাঁহাকে তাঁহার পিতা, তাঁহাকে তাঁহার চাচা হুসায়ন ইব্ন হাসান তাঁহার পিতা ও তাঁহার পিতা তাহার দাদা হইতে এবং তিনি ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে এই বর্ণনা শুনানঃ আলোচ্য আয়াতের অর্থ হইল, “আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদের অন্তরে ও কর্ণকুহরে মোহর লাগাইয়াছেন এবং তাহাদের চক্ষে পর্দা ফেলিয়াছেন।” তিনি আরও বলেন- আমাকে কাসিম, তাঁহাকে হুসায়ন ইব্ন দাউদ, তাঁহাকে হাদ্দাদ ইব্ন মুহাম্মদ আল আ‘ওয়ার ও তাঁহাকে ইব্ন জুরায়জ বর্ণনা করেন যে, তিনি বলিয়াছেনঃ মোহর হইল অন্তর ও কর্ণে এবং পর্দা হইল চক্ষে। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা অন্যত্র বলেনঃ
فان يُشاء الله يختم على قَلْبِك “আল্লাহ্ যদি চাহিতেন তাহা হইলে তোমার অন্তরে তিনি মোহর লাগাইয়া দিতেন।”
তাই তিনি বলেন, মোহর হইল অন্তর ও কর্ণে এবং চক্ষে হইল পর্দা।
ইবন জারীর বলেন- কেহ কেহ جعل ক্রিয়াকে উহ্য ধরিয়া غشاوة শব্দটিকে নসবযুক্ত করেন। যেমন কুরআনের حور عين আয়াতাংশেও এইরূপ প্রয়োগ দেখা যায়। কবি বলেনঃ
ْ علفتها تبنا وماء ياردا – حتى شتت همالة عيناها
এই চরণে سقيتها উহ্য থাকিয়া ماء باردا -কে নসবযুক্ত করিয়াছে।
অন্যত্র কবি বলেনঃ
ورأيت زوجك في الوغى – متقلدا سيفا ورمحا
এই চরণে معتقلا শব্দ উহ্য থাকিয়া ر محا শব্দকে নসবযুক্ত করিয়াছে।
সূরার প্রথম চারি আয়াতে মু’মিনদের গুণাবলী বর্ণনা করার পর পরবর্তী আলোচ্য দুই আয়াতে কাফিরের পরিচয় তুলিয়া ধরিয়া এখন আল্লাহ্ তা’আলা মুনাফিকের অবস্থা বর্ণনা করিতেছেন। মুনাফিকদের মুখে থাকে ঈমান ও অন্তরে বিরাজ করে কুফর। যেহেতু এই ব্যাপারটি ধরিতে সাধারণ মানুষের অসুবিধা হয়, তাই ইহার আলোচনা দীর্ঘতর হইয়াছে। মুনাফিকের বিভিন্ন চরিত্র ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য ও উপমা দিয়া প্রকাশ করা হইয়াছে। তদুপরি সূরা ‘বারাআত’ ও সূরা আল-মুনাফিকূন’ মুনাফিকদের ব্যাপারেই অবতীর্ণ হইয়াছে। তাহা ছাড়া সূরা ‘নূর’ সহ অন্যান্য সূরায় তাহাদের পরিচয় তুলিয়া ধরা হইয়াছে যেন মু’মিনরা মুনাফিকদের সহিত মিশিয়া না যায় এবং তাহাদের প্রতারণা হইতে বাঁচিয়া থাকিতে পারে।
মুনাফিকদের পরিচয় ও দৃষ্টান্ত
(۸)
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آمَنَّا بِاللهِ وَبِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَا هُم بِمُؤْمِنِينَ
(٩)
يُخْدِعُونَ اللهَ وَالَّذِينَ آمَنُوا وَمَا يَخْدَعُونَ إِلَّا أَنْفُسَهُمْ وَمَا يَشْعُرُونَ
৮. একদল মানুষ বলে, ‘আমরা আল্লাহ্ ও আখিরাতের উপর ঈমান আনিয়াছি’; অথচ তাহারা মু’মিন নহে।
৯. তাহারা আল্লাহ্ এবং মু’মিনদেরকে ধোঁকা দেয়। মূলত তাহারা নিজেদেরকেই ধোঁকা দেয়; অথচ তাহারা তাহা বুঝে না।
তাফসীরঃ নিফাক হইল খারাপ ভাব লুকাইয়া রাখিয়া ভাল ভাব প্রকাশ করা। উহা কয়েক প্রকারের। এক, বিশ্বাসগত। ইহার অধিকারী জাহান্নামের স্থায়ী বাসিন্দা হইবে। দুই, কর্মগত। উহা শ্রেষ্ঠতম পাপ। ইনশাআল্লাহ্ যথাস্থানে উহা সবিস্তারে আলোচিত হইবে।
ইব্ন জুরায়জ বলেন- মুনাফিকের কথা ও কাজ পরস্পর বিরোধী। তাহার বাহিরের সহিত ভিতরের মিল নাই। সে মুখে একরূপ, মনে অন্যরূপ। তাহার প্রকাশ্য দিক ও অপ্রকাশ্য দিক বিপরীতমুখী। নিফাকের পরিচয়বাহী সূরা মদীনায় অবতীর্ণ হওয়ার কারণ এই যে, মক্কায় নিফাক ছিল না। সেখানকার অবস্থা ইহার বিপরীত ছিল। যাহারা ভিতরে মু’মিন ছিল তাহাদেরও অনেকে প্রকাশ্যে কুফরী ভাব দেখাইতে বাধ্য হইত। অতঃপর যখন রাসূল (সাঃ) মদীনায় হিজরত করিলেন এবং আওস ও খাযরাজ গোত্রের আনসারগণ তাহাদের সঙ্গী হইলেন, তখন তাহারা জাহেলী যুগের আরব মুশরিকদের মতই মূর্তিপূজা করিত। মুসলমানদের সঙ্গে আহলে কিতাবের ইয়াহুদীগণও পূর্ব পুরুষের রীতির উপর বহাল থাকিয়া চুক্তিবদ্ধ মিত্ররূপে যুক্ত হইল। তাহাদের তিন গোত্র ছিল। খাযরাজদের মিত্রগোত্র বনু কায়নুকা এবং আওসদের মিত্র গোত্র বনূ নজীর ও বনূ কুরায়জা।
রাসূল (সাঃ) যখন মদীনায় আগমন করিলেন, আওস ও খাযরাজ গোত্রের অনেকেই তখন ইসলাম গ্রহণ করিল। কিন্তু ইয়াহুদী গোত্রসমূহের আব্দুল্লাহ ইব্ন সালাম সহ কম সংখ্যক লোকই ইসলাম গ্রহণ করিল। তখনও নিফাক জন্ম নেয় নাই। কারণ, তখনও মুসলমানদের এমন প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখা দেয় নাই যাহা কাহারও ভয়ের কারণ হইতে পারে। তখনও রাসূল (সাঃ) ও তাঁহার সহচরবৃন্দ ইয়াহুদী গোত্র ও মদীনার পার্শ্ববর্তী আরব গোত্রগুলির সহায়তার উপর নির্ভরশীল ছিলেন। যখন বদরের গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ ঘটিয়া গেল এবং আল্লাহ্ তা’আলা তাঁহার বাণীর বাস্তবায়ন ঘটাইলেন ও ইসলাম-মুসলিমের মর্যাদা সমুন্নত করিলেন, আব্দুল্লাহ ইব্ন উবাই ইবন সলূল তখন মুখ খুলিল। সে মদীনার সর্বাধিক প্রভাবশালী নেতা ছিল। খাযরাজ গোত্রের হইয়াও সে জাহেলী যুগে আওস ও খাযরাজ উভয় গোত্রের সরদার ছিল। তাহারা এমনকি তাহাকে মদীনার অধিপতি করার খেয়ালে ছিল। ইত্যবসের কল্যাণবাহী ইসলাম আসিল। তাহাদের অনেকেই ইসলাম গ্রহণ করিয়া উহাতে নিমগ্ন হইল। ইহাতে তাহার অন্তর্দাহ দেখা দিল। আশাহত হইয়া সে মুসলিম বিদ্বেষী হইল। বদর যুদ্ধ সংঘটিত হইবার পর সে ঘাবড়াইল এবং প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করিল। তাহার গোত্রীয় সঙ্গীদেরও সে সেভাবে ইসলাম গ্রহণের পরামর্শ দিল। তাহাদের সঙ্গে আহলে কিতাবেরও কিছু লোক মুসলমান হইল। এখান হইতেই মদীনা ও উহার আশে পাশের এলাকায় মুনাফিক মুসলমান সৃষ্টি হইল।
পক্ষান্তরে মুহাজিরদের ভিতরে কোন মুনাফিক ছিল না। তাঁহারা তো ইসলামের জন্য হিজরত করিয়া আসিয়াছেন। ইহা নহে যে, হিজরত করিতে তাহাদিগকে কেহ বাধ্য করিয়াছে। তাঁহারা স্বেচ্ছায় নিজেদের সর্বস্ব ত্যাগ করিয়া আসিয়াছেন। তাহাদের ঘর-বাড়ী, স্ত্রী-পুত্র, সহায়-সম্পদ সকলই বিসর্জন দিয়া আসিয়াছেন শুধু পরকালে আল্লাহ্র কাছে উহার বিনিময় লাভের আশায়।
মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক বলেন- আমার কাছে মুহাম্মদ ইব্ন আবূ মুহাম্মদ ইকরামা কিংবা সাঈদ ইব্ন জুবায়র হইতে ও তিনি ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَقُولُ آمَنَّا بِاللَّهِ وَبِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَمَا هُمْ بِمُؤْمِنِينَ
অর্থাৎ আউস ও খাযরাজ গোত্রের মুনাফিক ও তাহাদের অনুসারীবৃন্দ।
এভাবেই অন্যান্য ব্যাখ্যাদাতাগণ হইতেছেন আবুল ‘আলীয়া, আল-হাসান, কাতাদাহ ও আস্ সুদ্দী। মু’মিনগণ যেন ধোঁকায় না পড়ে তাই আল্লাহ্ তা’আলা মুনাফিকদের ব্যাপারে সতর্ক করিয়া দিলেন। মুনাফিকদের আবির্ভাবে মুসলমানরা ভীষণ ফাসাদে পড়িয়া গেলেন। যাহাদের ঈমানদার বলিয়া বিশ্বাস হয়, মূলত তাহারাই কাফির, ইহা হইতে বিপদের কথা আর কি হইতে পারে? তাই আল্লাহ্ তা’আলা আলোচ্য আয়াতে জানাইয়া দিলেন যে, তাহারা সামনে যতই ঈমানের কথা বলুক, পিছনে তাহারা অন্যরূপ। তিনি অন্যত্র বলেনঃ
إذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُونَ قَالُوا نَشْهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ اللهِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ انَّكَ لَرَسُولُهُ
অর্থাৎ তাহারা এই কথাটি শুধু তোমার সামনে আসিলে বলে, মূলত তাহারা ইহা বলে না। তাই তাহারা দুইবার তাকীদমূলক শব্দ إن ও ل ব্যবহার করিয়াছে। তেমনি তাহারা যদিও জোর দিয়া বলে যে, আল্লাহ্ ও আখিরাতের উপর তাহারা ঈমান আনিয়াছে, মূলত ইহা সত্য নহে। উক্ত আয়াতে যেইভাবে আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদের প্রদত্ত সাক্ষ্যকে মিথ্যা বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন, তেমনি আলোচ্য আয়াতেও তিনি জানাইয়া দিলেন- মূলত তাহারা মু’মিন নহে।
আয়াতাংশ و يُحدعون الله وَالَّدَيْنُ امنَوا অর্থাৎ তাহারা ভিতরে কুফরী বিশ্বাস নিয়া বাহিরে যে ঈমানের কথা বলিতেছে, তাহা এই বোকা ধারণা নিয়া যে, তাহারা আল্লাহ্ তা’আলাকে ধোঁকায় ফেলিয়া তাঁহার নিকট হইতে ফায়দা লুটিতে পারিবে। কারণ, মু’মিনদের কিছু লোককে এইভাবে ধোঁকা দিয়া ফায়দা লুটিয়াছে। আল্লাহ্ তা’আলা এই প্রেক্ষিতে বলেনঃ
يَوْمَ بَبْعَثُهُمُ اللهُ جَمِيعًا فَيَحْلِفُونَ لَهُ كَمَا يَحْلِفُونَ لَكُمْ وَيَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ عَلَى شَيْءٍ أَلَا إِنَّهُمْ هُمُ الْكَاذِبُونَ
“আল্লাহ্ তা’আলা যেদিন তাহাদের সকলকে একত্রিত করিবেন, তখন তাহারা আল্লাহ্ কাছেও হলফ করিয়া বলিবে, যেভাবে তোমাদের কাছে হলফ করিয়া বলিতেছে। তাহারা মনে করিবে, তাহাদের একটা ভিত্তি হইল। জানিয়া রাখ, তাহারাই নিশ্চিতভাবে কাফির।” তাই তাহাদের ধারণার ভ্রান্তি আল্লাহ্ তা’আলা এইভাবে তুলিয়া ধরিলেন-
وما يخدعون الا أنفسهم وما يشعرون অর্থাৎ তাহারা এই চাতুর্য দ্বারা নিজেদেরই ধোঁকা দিতেছে, অন্য কাহাকেও নহে। অথচ তাহারা তাহা বুঝিতেছে না।
আল্লাহ্ অন্যত্র বলেনঃ
ان المُنافقين يُخَادِعُونَ اللهَ وَهُوَ خَادِعُهم “নিশ্চয় মুনাফিকরা আল্লাহকে ধোঁকা দেয়, মূলত তাহারা নিজেদেরকেই ধোঁকা দেয়।”
একদল কিরাআতবিদ و مايخدعون الا أنفسهم পড়েন। অর্থগত দিক হইতে উহাতে কোন তারতম্য হয় না।
ইব্ন জারীর বলেন- যদি কেহ প্রশ্ন তোলে যে, মুনাফিকরা আল্লাহ্ এবং মু’মিনদের কি করিয়া ধোঁকা দেয়? তাহারা তো বাঁচার জন্য মনের বিপরীত কথা মুখে বলিয়া থাকে। জবাবে বলা যায়, আরবে বাঁচার জন্যও যদি কেহ এরূপ বলে তাহাকেও প্রতারক বলিয়া আখ্যায়িত করা হয়। সুতরাং ভাষারীতি অনুসারে ঠিকই হইয়াছে। দুনিয়ায় নিরাপত্তার জন্য তাহারা আল্লাহ্ ও মু’মিনদের প্রতারণামূলক কথা শুনাইতেছে। মূলত উহা তাহাদের পরকালের নিরাপত্তা চরমভাবে বিঘ্নিত করিতেছে বিধায় তাহারা নিজেদেরকেই প্রতারিত করিতেছে। তাহারা বাহ্যিক ঈমানের কথা বলিয়া আশা করিতেছে, পরকালেও তাহারা পার পাইবে এবং উহার সকল সুবিধা ভোগ করিবে। কিন্তু গিয়া দেখিবে সম্পূর্ণ বিপরীত ব্যাপার। আল্লাহ্র অসন্তুষ্টি ও কঠিন শাস্তি তাহাদিগকে অসহনীয় দুঃখ-দুর্দশার শিকার করিবে। সুতরাং তাহাদের মন যাহা বুঝাইয়াছিল তাহা তাহাদের কাছে চরম প্রতারণা হইয়া ধরা দিবে। ভাল আশা করিয়া গিয়া মন্দ পাওয়াই তো প্রতারিত হওয়া। খারাপ কাজ করিয়া ভাল আশা করাটাই তো প্রতারণামূলক ব্যাপার। এই কারণেই বলা হইয়াছেঃ
وَمَايَخْدَعُوْنَ الأ أَنْفْسَهُمْ وَمَايَشعرون ইব্ন আবূ হাতিম বলেন- আমাদিগকে ‘আলী ইব্ন মুবারক এই খবর পৌঁছাইয়াছেন যে, যায়দ ইব্ন মুবারককে মুহাম্মদ ইব্ন ছওর ইন জারীর হইতে يخادعون الله -এর নিম্ন ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করেনঃ
يخادعون الله অর্থাৎ প্রকাশ্যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলিয়া বেড়ায় যেন তাহাদের জান-মাল রক্ষা পায়, কিন্তু ভিতরে তাহারা বিপরীত বিশ্বাস রাখে।”
সাঈদ ইব্ন কাতাদাহ আলোচ্য আয়াতদ্বয় সম্পর্কে বলেনঃ ‘অনেকের মতেই মুনাফিকের মূল চরিত্র হইল কপটতা। অর্থাৎ মুখে স্বীকার করা ও অন্তরে অস্বীকার করা, কথার বিপরীত কাজ করা, সকালে এক রকম ও সন্ধ্যায় আরেক রকম হওয়া, জো বুঝিয়া নৌকা ছাড়া এবং হাওয়া বুঝিয়া বাদাম উড়ানো।
(١٠)
فِیۡ قُلُوۡبِهِمۡ مَّرَضٌ ۙ فَزَادَهُمُ اللّٰهُ مَرَضًا ۚ وَ لَهُمۡ عَذَابٌ اَلِیۡمٌۢ ۬ۙ بِمَا كَانُوۡا یَكۡذِبُوۡنَ
১০. তাহাদের অন্তর ব্যাধিগ্রস্ত, আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদের ব্যাধি বাড়াইয়া দিলেন। আর তাহাদের জন্য রহিয়াছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। কারণ তাহারা মিথ্যা বলিত।
তাফসীরঃ আস্ সুদ্দী আবূ মালিক হইতে, তিনি আবূ সালেহ হইতে, তিনি ইব্ন আব্বাস ও মুরা আল-হামদানী হইতে ও তাঁহারা ইবন মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবা হইতে বর্ণনা করেনঃ فئ قُلُوْبِهِمْ مّرْضُ অর্থাৎ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বা সংশয় এবং هَرَادَهُمْ اللّهُ مَرَضًا অর্থাৎ দ্বিধা-দ্বন্দ্ব বাড়াইয়া দিলেন।
ইব্ন ইসহাক মুহাম্মদ ইব্ন আবূ মুহাম্মদ হইতে, তিনি ইকরামা অথবা সাঈদ ইব্ন জুবায়র হইতে ও তিনি ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ فى قُلُوبِهمٌ رض অর্থ সন্দেহ রোগ। মুজাহিদ, ইকরামা, হাসান বসরী, আবুল আলীয়া, রবী’ ইবন আনাস ও কাতাদাহ এই মতই পোষণ করেন।
ইকরামা ও তাউস বলেনঃ فى قُلُوبِهمٌ رض অর্থাৎ রিয়া। ইব্ন আব্বাসের বরাতে যিহাক বর্ণনা করেনঃ فى قُلُوبِهمٌ رض অর্থাৎ নিফাক এবং فَرَادَهُم اللّهُ مَرَضًا অর্থাৎ নিফাক বাড়াইয়া দিলেন। ইহা প্রথমোক্ত ব্যাখ্যার অনুরূপ।
আবদুর রহমান ইব্ন যায়দ, ইব্ন আসলাম বলেন- فئ قُلُوْبهِمْ مُرْض অর্থাৎ দীনি ব্যাধি, শারীরিক ব্যাধি নহে। তাহারা মুনাফিক আর তাহাদের ব্যাধি হইল সেই সংশয় যাহা
তাহাদিগকে ইসলামে ঢুকাইয়াছে। فَرَادَهُم اللّهُ مَرَضًا অর্থাৎ তাহাদের رجس (মনঃপীড়া) বাড়াইয়া দিয়াছেন। অতঃপর তিনি পড়িলেনঃ
فَامَّا الَّذِينَ آمَنُوا فَزَادَتْهُمْ اِيْمَانًا وَهُمْ يَسْتَبْشِرُونَ – وَاَمَّا الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَّرَضٌ فَزَادَتْهُمْ رِجْسًا إِلَى رِجْسِهِمْ
“যাহারা মু’মিন, তাহাদের ঈমান বাড়িয়া গিয়াছে এবং তাহারা মহা আনন্দিত। পক্ষান্তরে যাহাদের অন্তরে ব্যাধি রহিয়াছে, তাহাদের মনঃপীড়ার সহিত আরও অন্তর্জালা সংযুক্ত হইয়াছে।”
তিনি বলেন, উহার অর্থ ক্ষতির উপর ক্ষতি এবং ভ্রান্তির উপর ভ্রান্তি । আবদুর রহমান (রঃ) ইহাকে ‘হুস্ন’ (ভাল কাজ) বলিয়াছেন। কারণ, উহা যথাযথ কর্মফল। পূর্বসূরীদের মত ইহাই। আল্লাহ্ পাকের কালামে ইহার আরও দলীল আছে। যেমনঃ
والّذين اهتدوا زادهم هدى وأتاهم تقواهه “যাহারা হিদায়েত গ্রহণ করিয়াছে, তাহাদের হিদায়েতের মাত্রা বাড়াইয়া দিয়াছেন এবং তাহারা পরহেযগার হইয়াছে” আয়াতাংশ بما كانوا يكُذبون কে يكذبون পড়া হয়। মুনাফিকদের এইরূপ দুইটি চরিত্রই ছিল। তাহারা নিজেরা তো মিথ্যা বলিত, অপরকেও মিথ্যাবাদী বলিত।
ইমাম কুরতুবী ও অন্যান্য তাফসীরকার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জানিতে পাইয়াও কেন মুনাফিকদের হত্যা করেন নাই, এই প্রশ্নের জবাবে সহীহদ্বয়ে উদ্ধৃত হাদীসটি পেশ করেন। উহাতে বর্ণিত আছে, রাসূল (সাঃ) হযরত উমর (রা)-কে বলেন, ‘মুহাম্মদ তাহার সঙ্গীদের হত্যা করেন, এই কথা আরবরা বলাবলি করুক তাহা আমি পছন্দ করি না।’ তিনি ভয় পাইতেন যে, ইহার ফলে বহু আরব ইসলাম গ্রহণ হইতে বিরত থাকিবে। কারণ, মুনাফিকরা প্রকাশ্যে মুসলমান নামে পরিচিত। তাহাদের অন্তরের কুফরী আল্লাহ্ তা’আলাই জানেন, সাধারণ মানুষ জানে না। সুতরাং কি কারণে তাহাদের হত্যা করা হইল তাহা বুঝানো কঠিন হইবে। এই ভুল বুঝাবুঝির ফলে সাধারণ আরবরা ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে দ্বিধান্বিত হইয়া পড়িবে৷ তাহারা বলিয়া বেড়াইবে, মুহাম্মদ তাহার সঙ্গীদেরও কখন কি কারণে হত্যা করে তাহা কেহ জানিতে পারে না।
ইমাম কুরতুবী বলেন- আমাদের আলিম সম্প্রদায়ের ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞের অভিমত ইহাই। মুনাফিকদের অন্তরের কলুষতা জানা সত্ত্বেও তিনি তাহাদের সহিত সম্প্রীতি বজায় রাখিয়া চলিতেন। ইব্ন আতিয়্যা বলেন- ইমাম মালিকের অনুসারীবৃন্দের নীতি ইহাই। মুহাম্মদ ইবনুল জুহুম কাজী ইসমাঈল আবহারী ও ইবনুল মাজেশুন এই মতের ভিত্তিতে দলীল পেশ করিয়াছেন। একটি দলীল এই, ইমাম মালিক (রঃ) বলেন- রাসূল (সাঃ) উম্মতকে ইহাই জানাইয়া দিলেন যে, বিচারক কখনও তাহার জানার উপর ভিত্তি করিয়া রায় দিবে না।
ইমাম কুরতুবী বলেন- অন্যান্য মাসআলায় মতভেদকারী সর্বস্তরের আলিম এই ব্যাপারে একমত যে, বিচারক নিজের অবগতির উপর ভিত্তি করিয়া রায় দিবেন না। তিনি বলেন- ইমাম শাফেঈ (রঃ)-ও ইহা হইতে দলীল গ্রহণ করিয়াছেন যে, রাসূল (সাঃ) মুনাফিকদের অন্তরের কথা জানা সত্ত্বেও মুখে ইসলাম প্রকাশ করায় তাহাদের হত্যা কার্য হইতে বিরত ছিলেন। কারণ, বিচার অন্তরের কথার ভিত্তিতে হইবে না, হইবে মুখের কথার ভিত্তিতে। সহীহদ্বয় ও অন্যান্য হাদীস সংকলনে ইহার সমর্থনে বহু হাদীস বর্ণিত হইয়াছে। যেমন রাসূল (সাঃ) বলেনঃ
“আমি (অবিশ্বাসী) লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য আদিষ্ট হইয়াছি। যতক্ষণ তাহারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ না বলিবে, ততক্ষণ যুদ্ধ চলিবে। যখন উহা বলিবে, তখন আমার হাত হইতে তাহাদের রক্ত ও সম্পদ নিরাপদ হইবে। হ্যাঁ, কিসাসের প্রশ্ন ভিন্ন। আর তাহাদের অন্য কোন ব্যাপার থাকিলে উহার হিসাব তাহারা আল্লাহর কাছে দিবে।”
উক্ত হাদীসের তাৎপর্য এই, যখনই কেহ মুখে কলেমা বলিবে, তখন তাহাকে মুসলমান ধরা হইবে এবং সে ইসলামী বিধানের আওতায় আসিবে। অন্তরে তাহার যাহাই থাকুক না কেন। যদি উহা ভাল হয়, পরকালেও উহার সুফল পাইবে। যদি অন্তর খারাপ হয়, তাহা হইলে দুনিয়ায় মুসলমান হিসাবে বিবেচিত হইয়াও কোন লাভ হইবে না। ত্রুটিপূর্ণ ঈমানের কারণে তাহারা চরম শাস্তি পাইবে। যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ
يُنَادُونَهُمْ أَلَمْ نَكُنْ مَّعَكُمْ قَالُوا بَلى ولكنَّكُمْ فَتَنْتُمْ أَنْفُسَكُمْ وَتَرَبَّصْتُمْ وَارْتَبْتُمْ وَغَرَّتْكُمُ الأمَانِى حَتَّى جَاءَ أَمْرُ الله
“(বিপন্ন মুনাফিকরা) মু’মিনদের ডাকিয়া বলিবে, আমরা কি তোমাদের সঙ্গী ছিলাম না? তাহারা বলিবে- হ্যাঁ, কিন্তু তোমরাই তোমাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রাখিয়া বিপদগ্রস্ত করিয়াছ এবং তোমাদের ভ্রান্ত প্রত্যাশা তোমাদিগকে প্রতারিত করিয়াছে। এখন তো আল্লাহ্ ফয়সালা আসিয়া গিয়াছে।”
তাহারা হাশরের মাঠে একত্রে উঠিলেও যখন আল্লাহ্র ফয়সালা জারী হইবে, তখন বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িবে। বিভিন্ন হাদীসে আছে, তাহারা মু’মিনদের সহিত আল্লাহ্ তা’আলার নিকট সিজদাবনত হইতে ব্যর্থ হইবে।
একদল অবশ্য বলেন- যেহেতু রাসূল (সাঃ) বিদ্যমান ছিলেন, তাই তাহাদের ক্ষতি সাধনের সুযোগ ছিল না বিধায় তাহাদের নিফাক জানা সত্ত্বেও হত্যা করা হয় নাই। কিন্তু নবী করীম (সাঃ)-এর পরে অবস্থা অন্যরূপ বিধায় যাহাদের নিফাক প্রকাশ হইয়া যাইবে এবং সকল মুসলমানও জানিতে পাইবে, তাহাদিগকে হত্যা করিতে হইবে। ইমাম মালিক (রঃ) বলেন- রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যুগের মুনাফিকরা এই যুগের কাফির।
এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য এইঃ কোন মুসলমানের কুফরী প্রকাশ পাইলে, তাহার হত্যার ব্যাপারে আলিমদের বিভিন্ন মত রহিয়াছে। তাহাকে কি তওবা করিতে বলা হইবে, না সঙ্গে সঙ্গে হত্যা করা হইবে? তাহার কুফরী কি একবার প্রকাশ পাইলেই হইবে, না বারংবার প্রকাশ পাইতে হইবে? তাহার স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলামে প্রত্যাবর্তন কিংবা ভয়ে ইসলামে প্রত্যাবর্তন, ইহার কোটির কি বিধান? এইরূপ বিভিন্ন প্রশ্নের সমাধানের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন অভিমত রহিয়াছে। উহা তাফসীরে আলোচনার স্থান নহে। ফিকাহ গ্রন্থই উহা আলোচনার উপযুক্ত স্থান ৷
জরুরী আলোচনা
যাহারা বলেন, রাসূল (সাঃ) কিছুসংখ্যক মুনাফিক সম্পর্কে অবহিত ছিলেন, তাহাদের দলীল হুযায়ফা ইব্ন ইয়ামান (রাঃ)-এর হাদীস। উহাতে চৌদ্দজনের কথা বলা হইয়াছে। তাহারা তবূক যুদ্ধের সময়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে গভীর অন্ধকারে কূপে ফেলিয়া হত্যার ষড়যন্ত্র করিয়াছিল। আল্লাহ্ তা’আলা ওহীর মাধ্যমে এই ষড়যন্ত্র ফাঁস করিয়া দেন। হুযায়ফা (রাঃ)-কে তাহাদের নাম জানানো হইয়াছে। তবে উপরে বর্ণিত হিকমতের কারণেই হয়ত তাহাদের হত্যা করা হয় নাই, কিংরা অন্য কারণেও হইতে পারে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ। তাহাদের ছাড়া অন্য মুনাফিকদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَمِمَّنْ حَوْلَكُمْ مِّنَ الأَعْرَابِ مُنَافِقُونَ وَمِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ مَرَدُوا عَلَى النِّفَاقِ لا تعلمهم نَحن نعلمهم
“তোমাদের চতুষ্পার্শ্বে আরব মুনাফিকরা রহিয়াছে, মদীনার নিফাক বিশিষ্টরাও রহিয়াছে ।
তুমি তাহাদিগকে চিন না, আমি চিনি।”
অন্যত্র তিনি বলেনঃ
لئن لم ينته المُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مُرْضَ وَالْمُرْجِفُونَ في المدينة لَنُغْرِيَنَّكَ بِهِمْ ثُمَّ لاَ يُجَاوِرُونَكَ فِيهَا إِلَّا قَلِيلاً – مَلْعُؤْنِيْنَ أَيْنَمَا تُقِفُوا أَخِذُوا وقتلُوا تَقْتِيلاً
“মুনাফিকরা যদি ব্যাধিগ্রস্ত অন্তর নিয়া মদীনায় ফিতনা সৃষ্টি হইতে বিরত না হয়, তাহা হইলে অবশ্যই আমি ইহার প্রতিকার করিব। ফলে তাহাদের নগণ্য লোকই মদীনায় তোমার কাছে ঠাঁই পাইবে । তাহারা অভিশপ্ত। যেখানেই যাইবে পাকড়াও হইবে এবং ঢালাওভাবে হত্যা করা হইবে।”
এই আয়াত প্রমাণ করে যে, রাসূল (সাঃ) তাহাদিগকে সরাসরি চিনিতেন না। তবে তাহাদের বর্ণিত চরিত্রাবলীর আলোকে তিনি কিছু কিছু লোককে চিহ্নিত করিয়াছেন। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَلَوْ نَشَاءُ لَا رَيْنَاكَهُمْ فَلَعَرفْتَهُمْ بِسِيمَاهُمْ وَلَتَعْرِفَنَّهُمْ فِي لَحْنِ الْقَوْلِ
“আমি ইচ্ছা করিলে তোমাকে তাহাদের চেহারা দেখাইয়া দিতে পারি। তবে তুমি অবশ্যই তাহাদের কথা ও কাজে চিনিতে পারিবে।”
সর্বাধিক খ্যাত মুনাফিক হইল আব্দুল্লাহ ইব্ন উবাই ইব্ন সলূল। যায়দ ইব্ন আরকাম (রাঃ) মুনাফিক সম্পর্কিত আয়াতের গুণাবলীর আলোকে তাহার ব্যাপারে রাসূল (সাঃ)-কে সাক্ষ্যদান সত্ত্বেও রাসূল (সাঃ) অন্যান্য সাহাবা সহ তাহার জানাযা আদায় করেন। একদা হযরত উমর (রাঃ) তাহার ব্যাপারে পদক্ষেপের প্রশ্ন তুলিলে রাসূল (সাঃ) বলিলেন- ‘আরবরা বলাবলি করিবে যে, মুহাম্মদ তাহার সঙ্গী হত্যা করে, আমি ইহা পছন্দ করি না।’ অন্য রিওয়ায়েতে আছে- তাহার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া বা না নেয়ার অধিকার আমাকে দেওয়া হইয়াছে। আমি পদক্ষেপ না নেয়া পছন্দ করিয়াছি।’ আরেক রিওয়ায়েতে আছেঃ আমি যদি জানিতাম, তাহার জন্য সত্তর বারের বেশী ক্ষমা চাহিলে সে ক্ষমা পাইবে, তাহা হইলে তাহাও করিতাম।’
(١١)
وَإِذَا قِيلَ لَهُم لَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ قَالُوا إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ
(١٢)
اَلاَ اِنّهُمْ هُمُ الْمُفْسِدُونَ وَلَكِنْ لا يَشْعُرُونَ
১১. আর যখন তাহাদিগকে বলা হয়, ‘পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করিও না, তাহারা বলে, আমরা তো মীমাংসাকারী।’
১২. খবরদার! নিশ্চিতভাবে তাহারাই ফাসাদ সৃষ্টিকারী, কিন্তু তাঁহারা তাহা বুঝে না।
তাফসীরঃ আস্ সুদ্দী তাঁহার তাফসীর গ্রন্থে আবূ মালিক হইতে তিনি আবূ সালেহ হইতে, তিনি ইব্ন আব্বাস ও মুরাতুত তাইয়েব আল হামদানী হইতে এবং তাঁহারা ইব্ন
মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবা (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেন, واذًا قيل لهم لا تفسدوا فى الْأرض فَالُوَا انّمَا نَحْنْ مُصلحُؤن অর্থাৎ মুনাফিকবৃন্দ আর لا تَفُسدوا فى الأراض কুফরী ও নাফরমানী কাজ।
আবূ জা’ফর রবী’ ইব্ন আনাস ও তিনি আবুল আলীয়া হইতে বর্ণনা করেন واذا قيل لهم لآ نُفْسدا فى الأرأض প্রতি অর্থাৎ পৃথিবীতে নাফরমানী ছড়াইও না। তাহাদের কাজটি ছিল আল্লাহর নাফরমানী করা। কারণ, পৃথিবীতে যাহারা আল্লাহর নাফরমানী করে তাহারাই ফাসাদ সৃষ্টি করে। মূলত আল্লাহ্ কথা শুনা ও মানার ভিতরেই পৃথিবীর শান্তি শৃঙ্খলা নিহিত।
রবী’ ইব্ন আনাস ও কাতাদাহরও এই মত। ইব্ন জুরায়জ মুজাহিদ হইতে বর্ণনা করেনঃ واذًا قيل لَهُم لا تفسدوا فى الأرض অর্থাৎ যখন তাহারা আল্লাহ্ নাফরমানী করিয়া ফিরে, তখন তাহাদিগকে বলা হয়, এই সকল কাজ করিও না । তাহারা জবাবে বলে, ‘আমরা তো হিদায়েতের উপর থাকিয়া মীমাংসাকারীর কাজ করিতেছি।’
ওয়াকী’, ঈসা ইব্ন ইউনুস ও ইছাম ইব্ন আলী আ’মাশ হইতে, তিনি মিনহাল ইব্ন আমর হইতে, তিনি উব্বাদ ইব্ন আব্দুল্লাহ আল আসাদী হইতে ও তিনি হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ তিনি আলোচ্য প্রথম আয়াত সম্পর্কে বলেন, এই আয়াতের চরিত্র সম্পন্ন লোক পরে আর আসে নাই।
ইবন জারীর বলেন- আমাকে আহমদ ইবন উসমান ইব্ন হাকীম, তাঁহাকে আবদুর রহমান ইব্ন শরীক, তাঁহাকে তাঁহার পিতা আ’মাশ হইতে ও তিনি যায়দ ইব্ন ওহাব প্রমুখ হইতে ও তাঁহারা সালমান ফারসী (রাঃ) হইতে আলোচ্য প্রথম আয়াত সম্পর্কে এই বর্ণনা উদ্ধৃত করেনঃ তাহারা আর আসে নাই।
ইবন জারীর বলেন- সালমান (রাঃ) হয়ত ইহাই বুঝাইতে চাহিয়াছেন যে, উক্ত আয়াতে বর্ণিত চরিত্রের অধিকারী মহা ফাসাদ সৃষ্টিকারী মুনাফিক নবী করীম (সাঃ)-এর যমানায় ছিল। আমাদের যমানায় সেইরূপ জঘন্য চরিত্রের লোক অনুপস্থিত।
ইন জারীর আরও বলেন- মুনাফিকরা আল্লাহ্র নাফরমানী করিয়া পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করে। তাহাদের সংশয়, তাহাদের অবৈধ কার্যকলাপ, বৈধ ও অপরিহার্য কাজ বর্জন এবং দীনের মৌলিক ধ্যান-ধারণায় সন্দেহ পোষণ ইত্যাদিই মস্ত ফাসাদ সৃষ্টিকারী। কারণ, মৌলিক বিশ্বাসে সংশয়ীদের কোন আমলই কবূল হয় না। তজ্জন্য চাই শর্তহীন দৃঢ় বিশ্বাস। তাহারা নিজেদের সংশয়ী মন লইয়া মু’মিনদের ব্যাপারে ভ্রান্ত প্রচারণা চালায়। কাফির বন্ধুদের কাছে মু’মিনদের গোপন ব্যাপারগুলি ফাঁস করিয়া দেয়। এই সব হইল জঘন্য ফাসাদের কাজ। সুযোগ মাত্রই তাহারা মু’মিনদের ভিতরে থাকিয়া তাহাদের সর্বনাশ সাধন করে। অথচ এই কাজগুলিকে তাহারা মনে করে, খুব ভাল কাজ করিতেছে, মু’মিন ও কাফিরের বিরোধে আপোষ মীমাংসার কাজ করিতেছে।
হাসানও তাহাই বলেন। তিনি বলেন, পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টির বড় কাজই হইল কোন মু’মিনের কাফিরের সহিত বন্ধুত্ব রাখা। যেমন আল্লাহ বলেনঃ
وَالَّذِينَ كَفَرُوا بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْض الأتَفْعَلُوهُ تَكُنْ فِتْنَةٌ فِي الْأَرْضِ وَفَسَادُ كَبِير
তাফসীরে ইব্ন কাছীর “কাফিররা পরস্পর বন্ধু। তোমরাও যদি তাহা না হও (বরং মু’মিন ও কাফিরে বন্ধুত্ব স্থাপন কর) তাহা হইলে পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি হইবে এবং উহা হইবে মস্ত বড় ফাসাদ।”
তাই আল্লাহ তা’আলা মু’মিন ও কাফিরের বন্ধুত্ব নাকচ করিয়া দিলেন। তিনি বলেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذينَ آمَنُوا لا تَتَّخِذُوا الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاء مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ أتُريدُونَ أَن تَجْعَلُوا الله عَلَيْكُمْ سُلْطَانًا مُّبِينًا
“হে মু’মিনগণ । তোমরা মু’মিন ভিন্ন কোন কাফিরকে বন্ধু বানাইও না । তোমরা কি চাও, আল্লাহর সকাশে তোমাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট দলীল দাঁড় করাইতে?”
তিনি অন্যত্র বলেনঃ
إِنَّ الْمُنَافِقِينَ فِي الدَّرْكِ الأَسْفَلِ مِنَ النَّارِ وَلَنْ تَجِدَ لَهُمْ نَصِيرًا
“নিশ্চয় মুনাফিকরা জাহান্নামের নিম্নতম স্তরে ঠাঁই পাইবে। কখনও তাহাদের জন্য তুমি মদদগার পাইবে না। ”
মুনাফিকদের মৌখিক ঈমান যেহেতু মু’মিনদিগকে ধোঁকায় ফেলে, তাই নিফাকের ফাসাদ সুস্পষ্ট। কারণ, তাহারা প্রতারণামূলক চটকদার কথা বলিয়া মু’মিনদের ভুলায় এবং মু’মিনদের ভিতরের কথা নিয়া কাফির বন্ধুদের বন্ধুত্ব রক্ষা করে। যদি তাহারা পূর্বাবস্থায় বহাল থাকিয়া থাকে, তাহা হইলে তো তাহাদের ক্ষতি ভয়াবহ। পক্ষান্তরে যদি তাহারা ইখলাসের সহিত ঈমান আনিয়া থাকে এবং কথা ও কাজে এক হয়, তাহাতেও তাহারা কাফিরের সহিত বন্ধুত্বের কারণে কল্যাণ ও মুক্তি পাইবে না। তাই আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
واذًا قيل لهم لاتفسدوا فى الأآرض فقَالَوَا انَّمَا نحن مصلحون
অর্থাৎ আমরা মু’মিন ও কাফিরের সেতুবন্ধ হিসাবে কাজ করিতেছি যেন উভয় দলের মধ্যে আপোষ ও শান্তি বজায় রাখিতে পারি।
মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক মুহাম্মদ ইব্ন আবূ মুহাম্মদ হইতে, তিনি ইকরামা অথবা সাঈদ ইব্ন জুবায়র হইতে, তিনি ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে আলোচ্য আয়াতের নিম্নরূপ তাৎপর্য বর্ণনা করেনঃ
অর্থাৎ আমরা মু’মিন ও আহলে কিতাব এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে আপোষ চাহিতেছি। ইহার জবাবেই আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
آلا احْهُمْ هُمْ الْمُفْسدون ولكن لأيَشعرون “খবরদার ! নিশ্চিতভাবে তাহারাই ফাসাদ সৃষ্টিকারী, কিন্তু তাহারা তাহা বুঝিতেছে না।”
অর্থাৎ জানিয়া রাখ, তাহারা যাহাকে নির্ভরযোগ্য ভাবিতেছে এবং যে কাজকে আপোষের কাজ মনে করিতেছে, উহাই আসলে ফাসাদের মূল। কিন্তু তাহাদের বোকামীর কারণে তাহারা উহার ফাসাদ হওয়াটা ঠিক পাইতেছে না।
(۱۳)
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ أمِنُو كَمَا أمَنَ النَّاسُ قَالُوا أَنُؤْمِنُ كَمَا أمَنَ السُّفَهَارُه اَلاَراِنَّهُمْ هُمُ السُّفَهَاءُ وَلكِنْ لا يَعْلَمُونَ
১৩. আর যখন তাহাদিগকে বলা হয়, ‘অন্যান্য লোকের মত তোমরাও ঈমান আন। তাহারা বলে, ‘নির্বোধদের মত কি আমরাও ঈমান আনিব?’ জানিয়া রাখ, তাহারাই নির্বোধ। কিন্তু তাহারা তাহা জানে না।
তাফসীরঃ আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, যখন মুনাফিকদিগকে বলা হয়, অন্যান্য লোক যেইভাবে আল্লাহর উপর, ফেরেশতার উপর, কিতাবের উপর, রাসূলের উপর, মরণোত্তর পুনরুত্থানের উপর, এক কথায় জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদি যত কিছু মু’মিনদিগকে জানানো হইয়াছে উহার সকল কিছুর উপর ঈমান আনিয়াছে, তোমরাও সেইভাবে ঈমান আন এবং আল্লাহর রসূলের অনুগত হইয়া শরীআতের সকল বিধি-নিষেধ মানিয়া চল, তখন তাহারা বলে, আমরা কি নির্বোধদের (সাহাবায়ে কিরামের) মত ঈমান আনিব (আল্লাহর লা’নত হউক)?
আবুল ‘আলীয়া ও আস্ সুদ্দী অনুরূপ ব্যাখ্যা নিজ নিজ তাফসীর গ্রন্থে ইব্ন আব্বাস (রাঃ), ইবন মাসউদ (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম হইতে উদ্ধৃত করিয়াছেন । রবী’ ই আনাস আবদুর রহমান ইব্ন যায়দ ইব্ন আসলাম প্রমুখ অনুরূপ ব্যাখ্যা বর্ণনা করেন। তাহারা আরও বলেন- মুনাফিকরা বলিতে চাহে, আমরা কি নির্বোধদের সমপর্যায়ে নামিয়া গিয়া একাকার হইব?
سفيه শব্দের বহুবচন سفهاء যেমন حكيم শব্দের বহুবচন حكماء এবং حليم শব্দের বহুবচন حلماء ‘সফীহ’ শব্দের অর্থ নির্বোধ, দুর্বল চিন্তা ও ভাল-মন্দ সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানের অধিকারী। এই কারণেই আল্লাহ্ তা’আলা নারী ও বালকদিগকে ‘সুফাহা’ আখ্যা দিয়াছেন। যেমন তিনি বলেনঃ
ولأتُؤْنُوا السَّفَاء أَموَالَكُم الّتى جَعَل الله لَكُم قيامًا “নির্বোধদের হাতে তোমাদের সম্পদ দিও না যাহা আল্লাহ্ তা’আলা তোমাদের জীবন ধারণের জন্য সৃষ্টি করিয়াছেন।”
সর্বস্তরের আলিম এখানে ‘সুফাহা’ অর্থ করিয়াছেন নারী ও বালক। আল্লাহ্ তা’আলা মুনাফিকদের উত্তরে তাহাদের ব্যবহৃত শব্দটিই ফেরত দিয়াছেন। পরন্তু ألا انهم هم السفَبَاء বলিয়া অত্যধিক জোরের সহিত নির্বুদ্ধিতাকে তাহাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করিয়া দিলেন, ولكنَلأيعلمون বলিয়া তিনি জানাইয়া দিলেন, তাহাদের নির্বুদ্ধিতা এমনই চরম যে, তাহাদের নিজেদের অবস্থা সম্পর্কেও খবর নাই। ফলে তাহারা অন্ধত্বের চূড়ায় পৌঁছিয়াছে এবং হিদায়েত হইতে বহু দূরে চলিয়া গিয়াছ।
(١٤)
وَإِذَا لَقُوا الَّذِينَ آمَنُوا قَالُوا آمَنَّا وَإِذَا خَلَوْا إِلَى شَيْطِينِهِمْ، قَالُوا إِنَّا مَعَكُمْ إِنَّمَا نَحْنُ مُسْتَهْزِءُونَ
(١٥)
اللهُ يَسْتَهْزِئُ بِهِمْ وَيَمدُّهُمْ فِي طُغْيَانِهِم يَعْمَهُونَ
১৪. যখন তাহারা মু’মিনদের সহিত মিলিত হয়, তাহারা বলে, ‘আমরা মু’মিন।’ আর যখন তাহারা তাহাদের শয়তান নেতাদের সহিত সংগোপনে মিলিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয় আমরা তোমাদের সঙ্গী, আমরা কেবল তামাশা করিতেছি।
১৫. আল্লাহ্ তা‘আলাও তাহাদের সহিত তামাশা করিতেছেন এবং তাহাদের নাফরমানীর রশি ঢিল দিয়াছেন যেন তাহারা উদভ্রান্তের মত ঘুরপাক খায়।”
তাফসীরঃ আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, যখন উক্ত মুনাফিকরা মু’মিনগণের সহিত সাক্ষাৎ করে, তখন বলে, আমরা ঈমান আনিয়াছি, অথচ তাহাদের অন্তর নিফাক, জালিয়াতি ও কপটতাপূর্ণ থাকে এবং মু’মিনদের কাছে প্রতারণামূলকভাবে ঈমানের কথা, বন্ধুত্বের কথা ও সংহতির কথা বলে। তাহাদের উদ্দেশ্য হইল মু’মিনদের সুযোগ-সুবিধা ও গনীমতের সম্পদে শরীক হওয়া। واذا خَلوا الى شيطينهم অর্থাৎ চলিয়া গেলে এবং একান্তে মিলিত হইলে। এখানে خلوا ব্যবহৃত হইয়াছে। انصرفو অর্থে এবং الى -এর সহিত متعدى হইয়াছে। ফলে গোপন দায়িত্ব পালনের পর প্রত্যাবর্তনের অর্থ প্রকাশ করিতেছে। অবশ্য কেহ কেহ الى এখানে অর্থে مع ব্যবহৃত হইয়াছে বলিয়া অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন। তবে প্রথম মতটিই উত্তম। ইমাম ইব্ন জারীরের বক্তব্য তাহাই।
আস্ সুদ্দী আবূ মালিক হইতে বর্ণনা করেন, خلوا অর্থ مضعوا (গমন করে) এবং شياطينهم অর্থ ইয়াহুদী ও মুশরিক সর্দার ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। আস্ সুদ্দী তাঁহার তাফসীরে আবূ মালিক হইতে, তিনি আবূ সালেহ হইতে, তিনি ইব্ন আব্বাস ও মুরা আল হামদানী এবং তাঁহারা ইব্ন মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ واذًا خَلُوَا الى شيطينهم অর্থাৎ কাফির নেতৃবৃন্দের নিকট যখন যায়।
যিহাক হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ واذًا خَلُوَا الى شيطينهم অর্থাৎ যখন তাহারা তাহাদের সঙ্গীদের সহিত মিলিত হয়। তাহারাই তাহাদের কুমন্ত্রণাদাতা শয়তান।
মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক মুহাম্মদ ইব্ন আবূ মুহাম্মদ হইতে, তিনি ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ واذًا خَلُوَا الى شيطينهم অর্থাৎ ইয়াহুদী। তাহারাই রাসূল (সাঃ)-এর রিসালাত প্রাপ্তি ও ওহী মিথ্যা বলিয়া থাকে।
মুজাহিদ বলেনঃ واذًا خَلُوَا الى شيطينهم দ্বারা তাহাদের মুনাফিক ও মুশরিক সহচরবৃন্দের কথা বুঝানো হইয়াছে।
কাতাদাহ বলেনঃ واذًا خَلُوَا الى شيطينهم বলিয়া তাহাদের মুশরিক ও পাপিষ্ঠ নেতাদের কথা বুঝানো হইয়াছে।
আবূ মালিক, আবুল আলীয়া, আস্ সুদ্দী রবী’ ইব্ন আনাস প্রমুখ উহার অনুরূপ তাফসীর করিয়াছেন।
ইবন জারীর বলেন, পথভ্রষ্টকারী সকল কিছুকেই শয়তান বলা হয়। উহা জ্বিনও হইতে পারে, মানুষও হইতে পারে। যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ
وَكَذَالِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِي عَدُوًّا شَيَاطِينَ الإِنْسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَى بعض زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا
“এভাবেই প্রত্যেক নবীর জন্য আমি জ্বিন ও মানব শয়তানকে দুশমন বানাইয়া দেই। তাহারা একদল অপর দলের ভিতর কথা ছড়ায় এবং চটকদার কথা বলিয়া ধোঁকা দেয়।”
আল্ মুসনাদে আবূ যর (রাঃ) হইতে বর্ণিত আছে- নবী করীম (সাঃ) বলেন, আমরা জ্বিন ও ইনসান শয়তান হইতে আশ্রয় চাহিতেছি। আমি প্রশ্ন করিলাম, হে আল্লাহর রাসূল! ইনসান ও কি শয়তান হয়? তিনি বলিলেন, হ্যাঁ।
انا معكم আয়াতাংশ সম্পর্কে মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক মুহাম্মদ ইব্ন আবূ মুহাম্মদ হইতে, তিনি ইকরামা কিংবা সাঈদ ইব্ন জুবায়র হইতে ও তিনি ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ উহার তাৎপর্য হইল, তোমরা যাহার উপর আছ, আমরাও তাহার উপর আছি। আর نما نحن مستهز نون -এর তাৎপর্য হইল, সেই সম্প্রদায়ের সহিত আমরা শুধু তামাশা করিতেছি বা খেলা করিতেছি।
যিহাক ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ
قَالُوا انما نحن مستهزشون অর্থাৎ ‘রাসূলের সহচরদের সহিত হাসি-তামাশা করিতেছি।’ রবী‘ ইব্ন আনাস এবং কাতাদাহও এই ব্যাখ্যা বর্ণনা করেন ৷
আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদের এই ছলা-কলার জবাবে বলেনঃ
الله يَسسْتَهْرَى بهم وَيْمدُهُمْ فى طفْيَانِهِم يَعْمَهُوْنَ ইব্ন জারীর ইহার ব্যাখ্যায় বলেন- আল্লাহ্ কিয়ামতের দিন তাহাদের এই ঠাট্টার জবাব দিবেন। যেমন তিনি বলেনঃ
يَوْمَ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْظُرُونَا نَقْتَبِس مِنْ نُورِكُمْ قِيْلَ ارْجِعُوا وَرَاءَكُمْ فَالْتِمْسَوْا نُوراً ، فَضُرِبَ بَيْنَهُمْ بِسُوْر لَهُ بَابٌ ، بَاطِنُهُ فِيهِ الرَّحْمَةُ وَظَاهِرُهُ مِنْ قَبْلِهِ الْعَذَابُ
‘মুনাফিক নর-নারী সেই দিন মু’মিনদিগকে বলিবে, একটু আস্তে চল, তোমাদের আলোকে আমাদিগকেও চলিতে দাও। জবাবে বলা হইবে, তোমাদের পিছনে দেখ, সেখান হইতে আলো নাও। তাহারা পিছনে দেখা মাত্র উভয়ের মাঝখানে দেয়াল দাঁড়াইয়া যাইবে। উহার অভ্যন্তর ভাগে থাকিবে রহমত ও বহির্ভাগে থাকিবে আযাব।”
তিনি অন্যত্র বলেনঃ
وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّمَا نُمْلِي لَهُمْ خَيْرٌ لأَنفسهِمْ إِنَّمَا نُمْلِي لَهُمْ ليَزْدَادُوا اثما
“আর অবিশ্বাসীরা কখনও যেন ধারণা না করে যে, তাহাদের কল্যাণের জন্য আমি তাহাদিগকে সময় সুযোগ দিতেছি; আমি তো তাহাদিগকে পাপ বৃদ্ধির সুযোগ দিতেছি।”
এইসব আয়াত এবং অনুরূপ অন্যান্য আয়াতে কাফির ও মুশরিকদের সহিত আল্লাহ্ তা’আলার ‘ইস্তিহার’ (ঠাট্টার) স্বরূপ বর্ণনা করা হইয়াছে। ইহার বিভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করা হইয়াছে। এই প্রসঙ্গে خديعة مكر سخرية ইত্যাদি পরিভাষা ব্যবহৃত হইয়াছে। ইব্ন জারীর বলেনঃ একদল বলেন, يستهزئٌ بهم বলা হইয়াছে মুনাফিকদের সতর্কীকরণের জন্য। তাহাদের পাপাচারকে ভর্ৎসনা করার জন্যই অনুরূপ পরিভাষার প্রয়োগ ঘটিয়াছে। ইব্ন জারীর আরও বলেন, ধোঁকা বা উপহাস শব্দটির ব্যবহার এইভাবে ঘটিয়াছে যে, কোন ধোঁকাবাজ ধোঁকা দিতে ব্যর্থ হইয়া পাকড়াও হইলে যেমন পাকড়াওকারী বলিয়া থাকে, ধোঁকা দিতে আসিয়া তুমি নিজেই ধোঁকা খাইলে, ইহাও তেমনি। কেহ উপহাস করিতে গিয়া নিজেই উপহাসের পাত্র হইলে যাহা হয়, ইহাও তাহাই। এই আলোকেই আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
و مَكَروا ومَكَرٌ اللَّهُ والله خَيّْرُ الْماكرينَ “আর তাহারা কূটচক্রান্ত করিল এবং আল্লাহ্ তাহাদের কূটচক্রান্ত ব্যর্থ করিলেন। অনন্তর আল্লাহ্ তা’আলা সর্বোত্তম কূটচক্র প্রতিবিধায়ক।”
আল্লাহ্ তা’আলার ‘ইস্তিহযা-ও এই অর্থে। কারণ, মকর বা ইস্তিহযা আল্লাহ্ পাকের কাজ নহে। আল্লাহ্ পাকের কাজ উহার প্রতিবিধান করা। এই প্রতিবিধান করাটাই তাহাদের জন্য উক্ত অর্থ প্রদান করিতেছে।
অন্য একদল বলেন- আল্লাহ্ তা’আলার বাণী انّمَا نَحْنْ – أللهُ يُسنْتَهْرَىُ بْهِمْ مُستَهزِسُون
ও يُحَادعُوْنَ الله وهو حَادِعَهُم এবং فيسخرون منهم سخر اللّه منهم কিংবা نسو الله فنسيهم অথবা অনুরূপ কোন বাণী মূলত প্রতিকার প্রতিবিধান অর্থে আসিয়াছে। তাহাদের উক্ত কার্যাবলীর যথাবিহীত শাস্তি তাহারা ভোগ করিবে, ইহাই উক্ত আয়াতসমূহের তাৎপর্য। একই শব্দের দুই অর্থে ব্যবহারের নজীর কুরআনে অন্যত্র বিদ্যমান । যেমন جزاء سَيفّة سَيمّة مكلها কিংবা قمَن اعتّدى فاعْتّدوا عليه আয়াতদ্বয়ে প্রথমোক্ত শব্দদ্বয়ের অর্থ জুলুম ও দ্বিতীয়োক্ত শব্দদ্বয়ের অর্থ ইনসাফ। এখানে سيكة ও عدوان পাশাপাশি দুইবার ব্যবহৃত হইয়া দুই অর্থ প্রকাশ করিতেছে ৷ এই ধরনের শব্দগুলি কুরআনে প্রয়োগভেদে ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে।
ইবন জারীর আরও বলেন- একদল লোক বলেন, আলোচ্য আয়াত আল্লাহ্ তা’আলার তরফ হইতে মুনাফিকদের ব্যাপারে খবর হিসাবে অবতীর্ণ হইয়াছে। উহাতে তাহারা কি করিতেছে এবং উহার স্বাভাবিক ফল তাহারা কি পাইবে তাহা বলা হইয়াছে। তাহা এই যে, তাহারা তাহাদের মন্ত্রণাদাতাদের কাছে গিয়া বলে, আমরা তোমাদের নীতিতেই অটল থাকিয়া মুহাম্মদ ও তাহার উপর অবতীর্ণ ওহী মিথ্যা বলিয়া বিশ্বাস করিতেছি। তবে আমরা তাহাদের কাছে গিয়া যাহা বলিয়াছি তাহা ঠাট্টা হিসাবে বলিয়াছি। তাই আল্লাহ্ তা’আলা জানাইলেন, ইহার ফলে তাহারা পার্থিব জীবনে জান-মালের নিরাপত্তা পাইবে বটে, কিন্তু পরকালে তাহারা বিপরীত ফল দেখিয়া নিজেরাই ঠাট্টার শিকার হইবে। তাহারা চরম লাঞ্ছনা ও শাস্তি ভোগ করিবে।
অবশেষে ইব্ন জারীর উক্ত শব্দাবলীর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গ বলেন- ধোঁকা, উপহাস, খেল-তামাশা, কূটচক্রান্ত ইত্যাদি শাব্দিক অর্থে আল্লাহ্ পাকের তরফ হইতে ব্যবহার হইতে পারে না। ইহা সর্বসম্মত অভিমত। হ্যাঁ, উহা প্রতিদান, প্রতিবিধান ও জবাব অর্থে পরোক্ষভাবে ব্যবহৃত হওয়ায় দোষ নাই। তিনি বলেন- আমার এই বক্তব্যের সমর্থনে ইবন আব্বাস (রাঃ)-এর বর্ণনা পাওয়া যায়। আমাকে আবূ কুরায়ব, তাঁহাকে আবূ উসমান, তাঁহাকে বাশার আবূ রওক হইতে এবং আবূ রওক যিহাক হইতে ও যিহাক ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বৰ্ণনা করেনঃ الله يُستهزئ بهم অর্থাৎ ‘তাহাদের তামাশার প্রতিদানমূলক তামাশা। فى طغيانهم يعمهون আয়াতাংশ সম্পর্কে আস্ সুদ্দী আবূ মালিক হইতে, তিনি আবূ সালেহ হইতে, তিনি মুরা আল হামদানী হইতে ও তিনি ইব্ন মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবা (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ
উহার তাৎপর্য হইল, তাহাদিগকে ঢিল দেওয়া, সময় দেওয়া। মুজাহিদ বলেন- তাহাদিগকে বাড়াইয়া দেওয়া। যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ
اَيَحْسَبُونَ أَنَّمَا نُمِدُّهُمْ بِهِ مِنْ مَالٍ وَبَنِينَ نُسَارِعُ لَهُمْ فِي الْخَيْرَاتِ طَ بَلْ لا يَشْعُرُونَ
“তাহারা কিভাবে যে, তাহাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আমি বাড়াইয়া দিতেছি তাহাদের কল্যাণের জন্য? বরং তাহারা বুঝিতেছে না।”
অতঃপর তিনি বলেনঃ سنستدر جهم من حيث لا يعلّمون “শীঘ্রই আমি এমনভাবে রশি টান দিব যে,
তাহারা কোথা হইতে কি হইল তাহা জানিতেই পাইবে না।”
একদল বলেন, পাপের বর্ণনার পরে নি’আমাত লাভের বর্ণনা মূলত প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা। যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ
فَلْمّا نْسُوًا ما ذُكرؤا به فَتَحْنًا عَلَيْهِمْ أبواب كُلّ شىء حَنَّى اذا فرحوا بما أوثوا أخذنا هم بَغْتّة فَاذًا هم مبلسون
“যখন তাহারা সকল উপদেশ ভুলিয়া যায়, তখন সকল সুযোগ-সুবিধার দুয়ার আমি খুলিয়া দেই। যখন তাহারা ইহাতে উল্লসিত হয়, অমনি অকস্মাৎ তাহাদিগকে পাকড়াও করি। ফলে তাহারা হতভম্ভ হয়।”
অতঃপর বলেনঃ
فقطع دابر الَْقَوْمٍ الَّدَيْنَ ظَلَمُوا والحمد لله رب العالمين “এইভাবে জালিম জাতির সমূলে উচ্ছেদ ঘটে এবং সমস্ত প্রশংসা নিখিল সৃষ্টির প্রতিপালক একমাত্র আল্লাহঃ তা’আলার জন্যই।”
ইব্ন জারীর বলেন- সঠিক ব্যাখ্যা এই, ‘আমি তাহাদিগকে পাপ পথে সুযোগ দিয়া বিভ্রান্তির চরমে পৌঁছার জন্য বাড়াইয়া দিব।
যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَنُقَلِبُ أَفْئِدَتْهُمْ وَأَبْصَارَهُمْ كَمَا يُؤْمِنُوا بِهِ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَنَذَرُهُمْ فِي طُغْيَانِهِمْ يعمهون
“আমি তাহাদের অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ বিপরীতমুখী করিয়া দিব, কারণ তাহারা শুরু হইতেই ঈমান আনে নাই এবং তাহাদিগকে লাগামহীন করিব যেন তাহাদের সীমালঙ্ঘনের ক্ষেত্রে তাহারা ঘুরপাক খাইয়া মরে।”
الطغيان অর্থ কোন কিছুতে সীমালঙ্ঘন করা। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
انا لما طفى الماء حَمَلْنَاكُم فى الجاريّة “পানি যখন সীমা ছাড়াইল, তখন তোমাদিগকে আমি নৌকায় তুলিলাম।”
ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যিহাক বর্ণনা করেনঃ فِي طُغْيَانِهِمْ يَعْمَهُونَ এ অর্থ তাহারা তাহাদের কুফরীর আবর্তে ঘুরপাক খাইয়া ফিরিবে। আস্ সুদ্দী নিজস্ব সনদে সাহাবা হইতে অনুরূপ ব্যাখ্যা দান করেন। আবুল ‘আলীয়া, কাতাদাহ, রবী’ ইব্ন আনাস, মুজাহিদ, আবূ মালিক ও আব্দুর রহমান ইব্ন যায়দ, অনুরূপ ব্যাখ্যা প্রদান করেন এবং বলেন-তাহাদের কুফরী ও গোমরাহীর আবর্তে তাহারা পেরেশান হইয়া ঘুরিয়া মরিবে।
ইব্ন জারীর বলেনঃ العمه অর্থ বিভ্রান্তি। যখন কেহ পথ হারায়, তখন বলা হয় عمه قلان يدهه عمها و عموها অমুক চরমভাবে বিভ্রান্ত হইয়াছে ।
তিনি আরও বলেন فى طغيانهم يُعمهون অর্থ তাহারা তাহাদের বিভ্রান্তি, কুফরী, ইতরামী ও হিংসার পংকিলতায় নিমজ্জিত হইয়া মাথা খুঁড়িয়া মরিবে এবং বাহির হইয়া আসার পথ খুঁজিয়া পাইবে না। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদের অন্তরে মোহর মারিয়াছেন, তদুপরি সীল লাগাইয়াছেন। তাহাদের চোখ পর্দা পড়িয়া অন্ধ হওয়ায় হিদায়েতের পথ দেখিতে পায় না ও সঠিক পথের সন্ধান পায় না।
কেহ কেহ বলেন, عمى হইল চোখের অন্ধত্ব ও عمه হইল অন্তরের অন্ধত্ব। কালামে পাকে অন্তরের অন্ধত্বের জন্য عمى -ও ব্যবহৃত হইয়াছে। যেমনঃ
فَإِنَّمَا لا تَعْمَى الأَبْصَارُ وَلَكِنَّ تَعْمَى الْقُلُوبُ الَّتِي فِي الصُّدُورِ
“অনন্তর নিশ্চয় তাহাদের চোখ অন্ধ হয় নাই, অন্ধ হইয়াছে তাহাদের বুকে লুকানো অন্তরগুলি।”
এক্ষেত্রে আমার বক্তব্য এই, ‘আমহুন’ শব্দের বহুবচন ‘উমহুন’ এবং চূড়ান্ত বহুবচন হইল ‘উমাহাউ’। যেমন কাহারও উট নিরুদ্দেশ হইলে বলা হয় زهب ابله العمهاء তাহার উট হারাইয়া গিয়াছে।
(١٦)
أُولَبِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُا الضَّلَلَةَ بِالْهُدَى ، فَمَا رَبِحَتْ تِجَارَتُهُمْ وَمَا كَانُوا مُهْتَدِينَ
১৬. উহারাই হিদায়েতের বিনিময়ে গোমরাহী খরিদ করিল। তাই তাহাদের বাণিজ্য লাভজনক হইল না এবং তাহারা পথপ্রাপ্ত হইল না।
তাফসীরঃ হযরত ইবন মাসউদ (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) হইতে পর্যায়ক্রমে ইব্ন আব্বাস (রাঃ) ও মুরা আল-হামদানী, আবূ সালেহ, আবূ মালিক ও তাঁহার নিকট হইতে আস্ সুদ্দী নিজ তাফসীর বর্ণনা করেন।
أؤ لخك الَدْيِنَ اشتّروا! الضَللة بالمدى অর্থঃ ‘উহারা গোমরাহী গ্রহণ করিল ও হিদায়েত বর্জন করিল।’ হযরত ইব্ন আব্বাস (রা) হইতে পর্যায়ক্রমে সাঈদ ইব্ন জুবায়র কিংবা ইকরামা, মুহাম্মদ ইব্ন আবূ মুহাম্মদ ও ইব্ন ইসহাক বর্ণনা করেন।
أؤ لخك الَدْيِنَ اشتّروا! الضَللة بالمدى অর্থঃ ঈমানের বিনিময়ে কুফরী খরীদ করা।
মুজাহিদ বলেনঃ ঈমান আনিয়া পুনরায় কাফির হইল।
কাতাদাহ বলেনঃ সুপথ ছাড়িয়া যাহারা ভ্রান্তপথ পছন্দ করিল।
কাতাদাহর এই বক্তব্যের সহিত আল্লাহ্ পাকের এই আয়াতের মিল রহিয়াছেঃ
فَاما تُمود فَهَدَيْنَاهُم فَأْستَحَبُوًا الْعمى عَلَّى الهدى “অথচ ছামূদ গোত্রকে আমি হিদায়েত দান করিয়াছিলাম। অতঃপর তাহারা হিদায়েত ছাড়িয়া অন্ধত্ব পছন্দ করিল।’
এই ব্যাপারে তাফসীরকারদের মূল বক্তব্য পূর্বেই বর্ণিত হইয়াছে। তাহা এইঃ মুনাফিকরা হিদায়েতের বদলে গোমরাহী গ্রহণ করিল । তাহারা সত্য পথের বিনিময়ে ভ্রান্তপথ কিনিল। মূলত أؤ لخك الَدْيِنَ اشتّروا! الضَللة بالمدى আয়াতের অর্থ ইহাই যে, তাহারা হিদায়েতের মূল্যে গোমরাহী কিনিল। এইদল ঈমান আনয়নকারী মুনাফিক হইতে পারে, বেঈমান মুনাফিকও হইতে পারে। ঈমান আনিয়া ঈমানের বদলে আবার কুফরী ক্রয়কারীদের সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেনঃ
ذالك بِأَنَّهُمْ امَنُوًا كُمّ كَفْرَوَا فَطْبِعْ على قُلُوْبهمْ
ذالك بِأَنَّهُمْ امَنُوًا كُمّ كَفْرَوَا فَطْبِعْ على قُلُوْبهمْ “ইহা এই জন্য যে, তাহারা ঈমান আনিয়া আবার কাফির হইল। তাই তাহাদের অন্তরসমূহে সীল মারিয়া দেওয়া হইল।”
মুনাফিকদের আরেকদল হইল যাহারা হিদায়েতের উপরে গোমরাহীকে প্রাধান্য দিয়া তাহাই অনুসরণ করিতেছে। মোটকথা তাহাদের বিভিন্ন শ্রেণী রহিয়াছে। তাই আল্লাহ্ বলেন, فما رب بحت تجار تهم و ما كَانْوًا مهتدين অর্থাৎ এই ব্যবসায়ে তাহারা মুনাফা পাইল না এবং তাহাদের ছলাকলা তাহাদিগকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে ব্যর্থ হইল।
ইব্ন জারীর বলেন-আমাকে বশীর, তাঁহাকে ইয়াযীদ, তাঁহাকে কাতাদাহর বরাতে সাঈদ বর্ণনা করেন—কাতাদাহ বলিয়াছেনঃ আল্লাহর কসম! তোমরা অবশ্যই দেখিতেছ, তাহারা সঠিক পথ ছাড়িয়া ভুল পথে চলিয়া গিয়াছে, দল ছাড়িয়া তাহারা বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছে, নিরাপত্তা ছাড়িয়া তাহারা বিপদ মাথায় লইয়াছে, সুন্নাত ছাড়িয়া তাহারা বিদ্আত অনুসরণ করিয়াছে ইত্যাদি। কাতাদাহ হইতে পর্যায়ক্রমে সাঈদ, ইয়াযীদ ইব্ন যরী’ ও ইব্ন আবূ হাতিমও এই বর্ণনা শুনান।
(١٧)
مَثَلُهُمْ كَمَثَلِ الَّذِي اسْتَوْقَدَ نَارًا فَلَمَّا أَضَاءَتْ مَا حَوْلَهُ ذَهَبَ اللهُ بِنُورِهِمْ وَتَرَكَهُمْ فِي ظُلمتِ لا يُبْصِرُونَ
(۱۸)
صُمٌّۢ بُكۡمٌ عُمۡیٌ فَهُمۡ لَا یَرۡجِعُوۡنَ
১৭. তাহাদের উপমা হইল সেই দলের মত, যে দলটি আগুন জ্বালাইল। অতঃপর যখন দলটির চতুর্দিক আলোকিত হইল, আল্লাহ্ তা’আলা তখন সেই আলো তুলিয়া নিলেন, আর তাহাদিগকে অন্ধকারে ছাড়িয়া দিলেন, তাহারা দেখিতে পাইতেছে না।
১৮. তাহারা বধির, বোবা, অন্ধ, ফিরিতেও পারিতেছে না।
তাফসীরঃ আরবী ভাষায় مثل -কে مثل বলা হয়। উহার বহুবচনে امثال হয়। আল্লাহ্ পাক বলেনঃ
وتلك الأمفال تَضربها للنّاس وما يعقلها الا الْعَالمُوت “আর এই সকল উপমা যাহা মানুষের জন্য উপস্থাপিত হয় তাহা আলিমগণ ছাড়া কেহ বুঝিতে পায় না।’
যাহারা হিদায়েতের বিনিময়ে গোমরাহী ক্রয় করিয়াছে, আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদের অবস্থা প্রকাশের জন্য এই উপমা প্রদান করিয়াছেন। তাহারা যেন দৃষ্টিশক্তির বিনিময়ে অন্ধত্ব ক্রয় করিল। ইহা যেমন এক ব্যক্তি আগুন জ্বালাইয়া চতুর্দিক আলোকিত করিয়া আশে পাশের সব কিছু দেখিতেছিল। তারপর হঠাৎ আগুন নিভিয়া গেল। ফলে সে অধিকতর অন্ধকারে নিপতিত হইল। এখন আর কিছুই দেখিতে পায় না। তাই পথও চলিতে পারে না। এই অবস্থায় সে যেন বোবা, বধির ও অন্ধের মত যথাবস্থায় দণ্ডায়মান রহিল। যেখান হইতে আসিয়াছে সেখানেও ফিরিয়া যাইতে পারিতেছে না।
ঠিক এই অবস্থাই মুনাফিকদের। তাহারা হিদায়েতের আলো বিক্রয় করিয়া গোমরাহীর অন্ধকার ক্রয় করিয়াছে। সঠিক পথের চাইতে ভ্রান্তপথ পছন্দ করিয়াছে। এই উপমা প্ৰমাণ করে যে, তাহারা ঈমান আনয়নের পর পুনরায় কাফির হইয়াছে। আল্লাহ্ তাআলা অন্য আয়াতে তাহা উল্লেখ করিয়াছেন। আল্লাহ্ই সর্বজ্ঞ।
আমি যাহা বর্ণনা করিলাম, তাহা ইমাম রাযী তাঁহার তাফসীরে আস্ সুদ্দীর বরাত দিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি বলেন-এখানে ব্যবহৃত উপমাটি অত্যন্ত যথাযথ হইয়াছে। কারণ, তাহারা ঈমান আনিয়া প্রথমে আলো অর্জন করিল। পরবর্তীকালে নিফাক অনুসরণ করিয়া আলো হারাইয়া অন্ধকারে নিমজ্জিত হইল। অর্থাৎ তাহারা চরম পেরেশানারীর মধ্যে হাবুডুবু খাইতে লাগিল। কারণ দীনের ক্ষেত্রে পেরেশানীর চাইতে বড় পেরেশানী আর কিছুই নাই।
ইবন জারীর মনে করেন, এই উপমার উপমিত মুনাফিকগণ কখনই ঈমান আনে নাই। তাহার দলীল এই আয়াতঃ
ومن النَّاسِ مَن يَقُولُ آمَنَّا بِالله وَبِالْيَوْمِ الآخر وَمَاهُم بِمُؤْمِنِينَ
এখানে আল্লাহ্ তা’আলা জানাইয়া দিলেন যে, মুনাফিকগণ আদৌ মু’মিন নহে। সুতরাং তাহাদের ঈমান আনার প্রশ্ন কোথায়?
আসলে সঠিক ব্যাপার এই যে, আল্লাহ্ তা’আলা এই উপমা তাহাদের নিফাক ও কুফর উভয় অবস্থার জন্য তুলিয়া ধরিয়াছেন। সুতরাং তাহাদের সাময়িক ঈমান অর্জনের ব্যাপারটির ইহাতে কোন অন্তরায় দেখা দেয় না । পরে অবশ্য এই ঈমান বিলুপ্ত হইয়াছে এবং তাহাদের অন্তরে সীল মারা হইয়াছে। ইন জারীর প্রাসঙ্গিক এই আয়াতটি উদ্ধৃত করেন নাই। যেমন ;
ذَالك بأنْهم أمنُوا شم كُفَروا فطبع على قلوبهم فَهُم لأيَفْقَهُون
“তাহা এই জন্য যে, তাহারা ঈমান আনিয়া পুনরায় কাফির হইল, তাই তাহাদের অন্তরে সীল মারা হইল, তাই তাহারা বুঝিতে পায় না!”
এই কারণেই অনুরূপ উপমা আসিয়াছে। তাৎপর্য এই, মুখে কলেমা আওড়াইয়া তাহারা দুনিয়ার জীবন আলোকিত করিল। কিন্তু কিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তির অন্ধকারে তাহারা নিমজ্জিত হইবে। তেমনি দলকে বহুবচনের বদলে একবচনে ব্যবহারও ঠিক হইয়াছে। কারণ, কুরআনের অন্যত্রও এরূপ ব্যবহার দেখা যায়। যেমনঃ
رَتَيْتَهُمْ يَنْظُرُونَ إِلَيْكَ تَدُورُ أَعْيُهُم كَالَّذِي يُغْشَى عَلَيْهِ مِنَ الْمَوْتِ
অর্থাৎ তাহাদের চোখ ছানাবড়া হওয়ায় মনে হইতেছে তাহাদের উপর মৃত্যু চাপিয়া বসিয়াছে ৷ এখানেও বহুবচনের বিনিময়ে একবচন ব্যবহৃত হইয়াছে ৷ দলের একজনকে বলিয়া পূর্ণ দলকে বুঝানোর অন্যতম নজীর এইঃ
ماخلقكم و لأبعتكم الأ كَنَفْس واحدة “তোমাদের সৃজন ও পুনরুত্থান একজনের সৃজন ও পুনরুত্থানের মতই।”
তিনি অন্যত্র বলেনঃ
“তাহাদের ‘তাওরাত’ বহনের উপমা হইল গাধার বোঝা বহনের মত।”
مثَلُ الَّذين حملوا التَّورةَ ثُمَّ لَم يَحْمِلُوهَا كَمَثَلِ الْحِمَارِ يَحْمِلُ أَسْفَارًا
“তাহাদের ‘তাওরাত’ বহনের উপমা হইল গাধার বোঝা বহনের মত।”
একদল বলেন- مَثَل الّذئ اسَْتْوْفَد نَار মূলত ছিল مثل قصتهم كقصة الذين استوقد نار ا অপর দল বলেন-অগ্নি প্রোজ্জ্বলক এখানে দলের পক্ষ হইতে আগুন জ্বালাইল। আরেক দল বলেন- الذى এখানে الذين অর্থ প্রকাশের জন্য আসিয়াছে। যেমন কবি বলেনঃ
وان الذى حانت بفلج دماءهم – هم القوم كل القوم يا ام خالد
এই প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হইল এই, আলোচ্য আয়াতেও দেখিতে পাই আল্লাহ্ তা’আলা একবচন ব্যবহার করিয়া বহুবচনের অর্থ গ্রহণ করিয়াছেন। তাই তিনি একবচনে فمااضائت ماحوله এর জবাবে বহুবচনে ذهب الله بشو رهم ব্যবহার করিয়াছেন। তেমনি وَتَرَكَهُمْ فى ظلمت لأيُبْصِرُونَ আয়াতাংশেও বহুবচনই ব্যবহৃত হইয়াছে। তেমনি صم بكم عمى এর পর فهم لايرجعون ব্যবহার করা হইয়াছে। আরবী ভাষায় এই ধরনের বাক্য সর্বাধিক আলংকারিক বলিয়া বিবেচিত । আয়াতাংশ ذهب الله يُوْمِمْ অর্থ যেই আলো তাহাদের কল্যাণ সাধন করিতেছিল তাহা তুলিয়া লওয়া হইল এবং তাহাদের জন্য অবশিষ্ট রহিল ক্ষতিকর ধোঁয়া ও দহন। আর ونهَكهُم فى ظَلَمت অর্থাৎ যেই সংশয়, কুফর ও নিফাকের অন্ধকারে তাহারা ছিল আবার সেইখানেই নিক্ষিপ্ত হইল। لايبصر ون অর্থাৎ এখন আর তাহারা কল্যাণের পথ দেখিতে পায় না, উহা চিনিতেও পারে না। এই চরম দুর্গত অবস্থায় তাহারা صم অর্থাৎ কল্যাণের কথা শুনিতে পায় না, بكم অর্থাৎ তাহারা কল্যাণের কোন কথা বলিতে পারে না, عمى অর্থাৎ তাহারা বিভ্রান্তির অন্ধকারে থাকায় কল্যাণের পথ দেখিতে পায় না। এই অবস্থায় আল্লাহ্ বলেনঃ
فَانَّهَا لأتَعْمَى الآَبْصَار ولكن تَعْمَى الْقَُلُوْبْ الّتى فى الصدور ‘অবশ্য তাহাদের চোখ অন্ধ হয় না, অন্ধ হইয়াছে তাহাদের বুকে নিহিত অন্তরসমূহ।’
সুতরাং لاير جعون অর্থাৎ তাহারা যেই সত্য পথে ছিল উহাতে আর ফিরিয়া যাইতে পারিতেছে না । কারণ, সুপথের বিক্রয়মূল্যে তাহারা বিপথ ক্রয় করিয়াছে।
আমাদের বক্তব্যের সমর্থনে পূর্বসূরীদের বক্তব্য
ইব্ন মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবা (রাঃ) হইতে পর্যায়ক্রমে ইব্ন আব্বাস (রাঃ) ও মুরা আল হামদানী, আবূ সালেহ ও আবূ মালিকের বর্ণনার বরাতে আস্ সুদ্দী তাঁহার তাফসীরে বর্ণনা করেনঃ فَلَما أضاءت مَاحَولَه অর্থাৎ মদীনায় দলে দলে লোক যখন নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট ইসলাম গ্রহণ করিল, তখন তাহারাও ইসলামে প্রবেশ করিল। অতঃপর তাহারা মুনাফিক হইল। এই ব্যাপারটি সেই ব্যক্তির মত যে লোক আগুন জ্বালাইয়া চারিদিক আলোকময় করত ভাল-মন্দ দেখিয়া নিজেকে বাঁচাইয়া চলার ব্যবস্থা করিল । হঠাৎ আগুন নিভিয়া গেল। এখন আর সে ভাল-মন্দ দেখিতে পায় না এবং নিজেকে বাঁচাইয়াও চলিতে পারে না। মুনাফিকদের এই দশা। তাহারা শির্কের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। যখন ইসলাম গ্রহণ করিল, ভাল, মন্দ, হালাল, হারাম সবকিছু চিনিতে পাইল। তারপর আবার যখন কাফির হইল, ভাল, মন্দ ও হালাল, হারাম বোধ হারাইল।
ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে আওফী বলেন-নূর হইল তাহাদের মুখে উচ্চারিত ঈমানের কথা এবং জুলমাত হইল তাহাদের মুখের কুফরী ও নিফাকের বাক্যাবলী। তাহারা হিদায়েতে ছিল এবং পরে তাহারা পথ হারাইয়াছে।
মুজাহিদ বলেনঃ فَلَمًا أضاءت ماحولة বলিতে মু’মিনের সঙ্গে হিদায়েতের দিকে তাহাদের অগ্রসর হওয়াকে বুঝায়।
আতা আল খোরাসানী বলেন- مَفْلّهُمٌ كَمَخْل اذى اسَحَوْفَدَ نار আয়াতাংশ হইল মুনাফিকদের উদাহরণ। তাহারা বাহ্যিক দৃষ্টিতে ভাল-মন্দ দেখে ও চিনে বটে; কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি অন্ধ হওয়ায় তাহা কবূল করিতে পারে না। ইকরামা, হাসান, সুদ্দী, রবী’, ইবান প্রমুখ হইতে ইব্ন আবূ হাতিম অনুরূপ ব্যাখ্যা উদ্ধৃত করেন।
আবদুর রহমান ইবন যায়দ ইবন আসলামও আলোচ্য আয়াতাংশের অনুরূপ ব্যাখ্যা দান করেন। তিনি প্রসঙ্গত আরও বলেন-যখন তাহারা ঈমান আনিল, তাহাদের অন্তরে ঈমানের আলো জ্বলিল, যেভাবে আগুন জ্বালাইলে চারিদিক আলোকিত হয়। তারপর যখন কাফির হইল, আল্লাহ্ তা’আলা তাহাদের ঈমানের আলো বিলুপ্ত করিলেন, যেভাবে আগুন নিভিয়া গেলে আলো বিলুপ্ত হয়। ফলে তাহারা অন্ধকারে পতিত হইয়া কিছুই দেখিতে পাইল না ৷
ইব্ন জারীরের বক্তব্যের সমর্থনে হযরত আব্বাস (রাঃ) হইতে একটি বর্ণনা ‘আলী ইব্ন আবূ তালহা উদ্ধৃত করেন। তিনি বলেন আলোচ্য উপমাটি আল্লাহ্ পাক মুনাফিকদের জন্য প্রদান করিয়াছেন। তাহারা মুখে ইসলামের কথা বলিয়া মুসলমানরূপে গণ্য হয়। তাহাদের সমাজে বিবাহ-শাদী করে। তাহাদের সম্পত্তির ওয়ারিস হয়। তাহাদের গনীমতের মালের অংশ পায়। যখন মুনাফিকদের মৃত্যু হয়, সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা তাহার এই সম্মান ও অধিকার লোপ করেন। ঠিক আগুন নিভিয়া গেলে যেভাবে আলো লোপ করা হয় তেমনি।
আবুল ‘আলীয়া হইতে পর্যায়ক্রমে রবী’ ইব্ন আনাস ও আবূ জা’ফর আর রাযী বর্ণনা করেন-আলোচ্য উপমার তাৎপর্য এই যে, আগুন নিভিয়া গেলে যেভাবে আলো চলিয়া যায়, তেমনি মুনাফিকের ঈমানের আলো কুফরীতে প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়। যখন মুনাফিক মুখে কলেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ উচ্চারণ করে, তখন সে আলো পায়। যখন আবার সংশয় জাগে, অমনি অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত হয়।
যাহ্হাক বলেন ذهب اللَّهُ بتر هُمْ অর্থাৎ তাহারা ঈমানের কথা বলিয়া যে নূর অর্জন তাহা আল্লাহ্ তুলিয়া নেন।
আবদুর রাযযাক মা’মারের বরাতে কাতাদাহ হইতে বর্ণনা করেনঃ مَُلَْهُمْ كَمَكّْل الذى أاسَمَوقَّدَ ثَارًا فَلَمّا أَضّاءَت مَاحَوَُلَهَ আয়াতের তাৎপর্য এই যে, কলেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ তাহাদিগকে আলো জোগাইল। দুনিয়ায় মু’মিন সাজিল। উহার ফলে তাহাদের পানাহার জুটিল। তাহাদের বিবাহ-শাদীর ব্যবস্থা হইল। জীবন-সম্পদের নিরাপত্তা হইল। যখন মারা যাইবে, আল্লাহ্ তা’আলা সেই আলো কাড়িয়া নিয়া তাহাদিগকে চরম অন্ধকারে নিক্ষেপ করিবেন। ফলে তাহারা কিছুই দেখিতে পাইবে না।
উক্ত আয়াত সম্পর্কে সাঈদ কাতাদাহ হইতে বর্ণনা করেনঃ মুনাফিকরা ‘লাইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলিয়া দুনিয়ার জীবন আলোকময় করে। মু’মিনদের সঙ্গে বিবাহ-শাদী করে। তাহাদের গনীমতের সম্পদের ভাগ পায়। তাহাদের সম্পত্তির ওয়ারিস হয়। তাহাদের হাতে জান-মাল নিরাপত্তা পায়। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে মুনাফিক এই পার্থিব আলো হইতে বঞ্চিত হয়। কারণ, তাহার অন্তরে ঈমান নাই। তাহার আমলও সঠিক নহে।
ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ‘আলী ইব্ন আবূ তালহা বর্ণনা করেনঃ وَتْرَكُهُمْ فى ظُلّمْت لأيبصر ون অর্থাৎ মৃত্যুর পরবর্তী আযাবের অন্ধকারে।
ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে পর্যায়ক্রমে সাঈদ ইব্ন জুবায়র কিংবা ইকরামা, মুহাম্মদ ইব্ন মুহাম্মদ ও মুহাম্মদ ইব্ন ইসহাক বর্ণনা করেনঃ وَتَرَكَهُمَ فى ظُلّمْت অর্থাৎ তাহারা কুফরীর অন্ধকার ছাড়িয়া ঈমানের আলোকে আসিয়া সব কিছু দেখিতে পাইতেছিল। অতঃপর আবার কুফরী ও নিফাক গ্রহণ করিয়া সেই আলো নিভাইয়া দিল। ফলে হিদায়েতের পথ দেখিতে পায় না এবং সত্যের উপর কায়েম হইতে পারিতেছে না।
আস সুদ্দী তাঁহার তাফসীরে স্বসনদে বর্ণনা করেন- وشركهم فى ظلمّت অর্থাৎ তাহাদের নিফাকীর অন্ধকারে।
হাসান বসরী বলেন- وتركهم فى ظلمت لأَييْصرون অর্থাৎ মৃত্যুর পর মুনাফিকদের বদ আমলগুলি অন্ধকার হইয়া দেখা দিবে। কোন নেক আমল সে পাইবে না যাহা প্রমাণ দিবে যে, সে কলেমা-গো ছিল। আস্ সুদ্দী স্বসনদে বর্ণনা করেন- صم بكم عمى অর্থাৎ তাহারা বধির, বোবা ও অন্ধ।
ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ‘আলী ইব্ন আবূ তালহা বর্ণনা করেনঃ صم بكم عمى অর্থাৎ তাহারা হিদায়েতের কথা শুনে না, সুপথ দেখে না এবং উহা বুঝেও না। আবুল আলীয়া ও কাতাদাহ ইব্ন দুআমাও এই মত ব্যক্ত করেন ৷
فهم لآير جعون আয়াতাংশ সম্পর্কে ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বলেন, হিদায়েতের পথে ফিরিবে না।
আস্ সুদ্দী স্বসনদে বলেন— فهم لآير جعوان অর্থাৎ তাহারা ইসলামে ফিরিয়া আসিবে না। রবী’ ইব্ন আনাসও অনুরূপ বলেন। لآير جعون সম্পর্কে কাতাদাহ বলেন-তাহারা তওবা করিবে না আর উপদেশও লাভ করিবে না।
(۱۹)
اَوۡ كَصَیِّبٍ مِّنَ السَّمَآءِ فِیۡهِ ظُلُمٰتٌ وَّ رَعۡدٌ وَّ بَرۡقٌ ۚ یَجۡعَلُوۡنَ اَصَابِعَهُمۡ فِیۡۤ اٰذَانِهِمۡ مِّنَ الصَّوَاعِقِ حَذَرَ الۡمَوۡتِ ؕ وَ اللّٰهُ مُحِیۡطٌۢ بِالۡكٰفِرِیۡنَ
(٢٠)
یَكَادُ الۡبَرۡقُ یَخۡطَفُ اَبۡصَارَهُمۡ ؕ كُلَّمَاۤ اَضَآءَ لَهُمۡ مَّشَوۡا فِیۡهِ ٭ۙ وَ اِذَاۤ اَظۡلَمَ عَلَیۡهِمۡ قَامُوۡا ؕ وَ لَوۡ شَآءَ اللّٰهُ لَذَهَبَ بِسَمۡعِهِمۡ وَ اَبۡصَارِهِمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَلٰی كُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ
১৯. ‘অথবা আকাশের মেঘ-বৃষ্টির মত যাহাতে অন্ধকার, বজ্র ও বিদ্যুৎ বিদ্যমান। তাহারা মৃত্যুর (বজ্রের) ভয়ে কানে আঙ্গুল দেয়। আর আল্লাহ্ তা’আলা কাফিরদিগকে বেষ্টন করিয়া আছেন।
২০. যখন বিদ্যুৎ চমকায়, তাহাদের চোখের জ্যোতি লইয়া যায়। যখন আলো দেয় তখন তো চলে, আঁধার হইয়া গেলেই দাঁড়াইয়া থাকে। আল্লাহ যদি চাহিতেন, অবশ্যই তাহাদের শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি লোপ পাইত। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান।’
তাফসীরঃ ইহা মুনাফিকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর জন্য দ্বিতীয় উপমা। এই শ্রেণীর মুনাফিকরা কখনও ইসলামকে সত্য ভাবে, কখনও সংশয়ে ভোগে। তাহাদের অন্তরসমূহ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ও বিশ্বাস-অবিশ্বাসে দোদুল্যমান। الصيب অর্থ বৃষ্টি। ইব্ন মাসউদ, ইব্ন আব্বাস, অন্যান্য সাহাবাবৃন্দ, আবুল আলীয়া, মুজাহিদ, সাঈদ ইব্ন জুবায়র, আতা, হাসান বসরী, কাতাদাহ, ‘আতিয়া আওফী, ‘আতিয়া খোরাসানী, আস্ সুদ্দী ও রবী’ ইবন আনাস এই মত ব্যক্ত করিয়াছেন।
যিহাক বলেন, الصيب অর্থ মেঘ। কিন্তু বৃষ্টি অর্থই খ্যাত হইয়াছে। উহা আকাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থায়ই বর্ষিত হয়। অন্ধকারাচ্ছন্নতাই সংশয়, অবিশ্বাস ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ر عد অর্থ বজ্র, যাহার গর্জন অন্তরে ভয়ের উদ্রেক করে। মুনাফিকদের জন্য অত্যধিক ভীতিপ্রদ ও কম্পন সৃষ্টিকারী। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ يحسبون كل صيحة عليهم প্রত্যেকটি বজ্রই তাহাদের উপর পড়িবে।’ আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَيَحْلِفُونَ بِاللَّهِ إِنَّهُمْ لَمِنْكُمْ ، وَمَاهُمْ مِنْكُمْ ولكِنَّهُمْ قَوْمُ يُفْرَقُونَ – لَوْ يَجِدُونَ مَلْجَاءً أَوْ مَغَارَاتِ أَوْ مُدَّخَلاً تَوَلَّوْا اِلَيْهِ وَهُمْ يَجْمَحُونَ
“তাহারা আল্লাহর নামে শপথ করিয়া বলে, অবশ্যই তাহারা তোমাদের লোক। অথচ তাহারা তোমাদের লোক নহে। অধিকন্তু তাহারা বিভেদ সৃষ্টিকারী দল। যদি তাহারা আশ্রয় পাইত, পাইত কোন গুহা কিংবা প্রবেশস্থল, সেইদিকে ছুটিয়া যাইত এবং উহাতেই ঢুকিয়া পড়িত।”
والبرق অর্থ বিদ্যুৎ ঝলক যাহা এই শ্রেণীর মুনাফিকের অন্তরে মাঝে মধ্যে চমকায় অর্থাৎ ঈমানের আলো দেখা দেয়। তাই আল্লাহ্ তা’আলা বলেন-
يَجْعَلُوْنَ أَصَابِعَهُمٌ فى أذائهمْ مِّنْ الصّواعق حَذر الْمَوْت وَاللَّهُ مُحِيْط بالْكَافرين
অর্থাৎ এই অবস্থায় তাহারা মৃত্যুভয়ে ভীত হইয়া পড়ে। মৃত্যু তখন তাহাদের কাছে বজ্রতুল্য মনে হয়। তাহারা কানে আঙ্গুল দিয়া মরণোত্তর জীবনের সুকঠিন শাস্তির কথা এড়াইতে চায়। অথচ আল্লাহর অসীম ক্ষমতা ও ইচ্ছার বাহিরে যাইবার কোন ক্ষমতাই তাহাদের নাই। আল্লাহ্ তা’আলা অন্যত্র বলেনঃ
هَلْ أَتَاكَ حَدِيثُ الْجُنُود – فِرْعَوْنَ وَثَمُودَ – بَلِ الَّذِينَ كَفَرُوا فِي تَكْذِيْب وَاللَّهُ من ورائهم محيط
“তুমি কি ফিরআউন ও ছাদের বাহিনীর ঘটনা শুনিয়াছ? তাহারা অবিশ্বাসী থাকিয়া দীনকে মিথ্যা বলিয়াছিল। অথচ আল্লাহ্ তা’আলা পিছন হইতে তাহাদিগকে ঘিরিয়া রাখিলেন।”
এইরূপ এক প্রসঙ্গেই তিনি বলেনঃ يَكَادَ البرق يُخطف أبصارهم
অর্থাৎ সেই (ঈমানী) বিদ্যুতের কাঠিন্য ও শক্তি তাহাদের চোখে অন্ধকার নামাইয়া আনে। আর তাহাদের দুর্বল দৃষ্টিশক্তি ও শিথিল ঈমান তাহা সহ্য করিতে পারে না।
ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ‘আলী ইব্ন আবূ তালহা বর্ণনা করেনঃ بكاد الْبَرق يخطف أبصار هم অর্থাৎ কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াতে মুনাফিকদের নাম না বলিলেও তাহাদের সকল পরিচয় ও চক্রান্ত তুলিয়া ধরায় তাহারা চোখে অন্ধকার দেখিতেছে।
ইবন ইসহাক বলেন-আমাকে মুহাম্মদ ইব্ন আবূ মুহাম্মদ ইকরামা অথবা সাঈদ ইব্ন জুবায়র হইতে, তিনি ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেন بَِكاد الْبَِرق نخطفبَ أبصار هم অর্থাৎ সত্যের অত্যুজ্জ্বল আলোর ঝলকানি। যখন উহা চমকায় তখন চলে আর যখন লোপ পায় তখন থমকিয়া দাঁড়ায়। মানে, যখন ঈমানের আলো জাগে এবং সেই আলোকে কোন আমল দেখে তো উহা অনুসরণ করে। কিন্তু যখন আবার সংশয় মাথাচাড়া দেয়, তখন অন্ধকার দেখিতে পায় এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া থামিয়া যায় ৷
ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ‘আলী ইব্ন তালহা বর্ণনা করেনঃ ومن النّاس مَنْ يعْبُدُ اللّهَ على حَرْف فَانْ أصابَه خَيْرُ ن اطمأن به অর্থাৎ মুনাফিকরা যখন ইসলামের বিজয় দেখিতে পায়, তখন নিশ্চিন্ত মনে আগাইয়া আসে। আর যখন ইসলামের উপর কোন বিপদাপদ দেখে, অমনি থমকিয়া দাঁড়ায় এবং কুফরীর দিকে প্রত্যাবর্তন করে। যেমন আল্লাহ্ বলেনঃ
ومِنَ النَّاسِ مَنْ يَعْبُدُ اللَّهَ عَلَى حَرْفٍ فَإِنْ أَصَابَهُ خَيْرُ نِ اطْمَأَنَّ بِهِ
“একদল লোক (ইসলামের) কিনারায় দাঁড়াইয়া আল্লাহর ইবাদত করে। যখন তাহারা ভাল অবস্থা দেখে তখন নিশ্চিন্ত হয়।”
ইবন আব্বাস (রাঃ) হইতে পর্যায়ক্রমে সাঈদ ইব্ন জুবায়র কিংবা ইকরামা, মুহাম্মদ ইব্ন আবূ মুহাম্মদ ও ইব্ন ইসহাক বর্ণনা করেনঃ
كُلّمَا أضاءَلَهُمْ مَّشًَا فيه واذًا أظلم علَّيهم قَامُوا অর্থাৎ যখন সত্য চিনিতে পায়, তখন তাহা নিয়া কথা বলে এবং অনুসরণও করে। কিন্তু যখন তাহাদের সংশয়ী মন কুফরের দিকে ঝুঁকিয়া পড়ে, তখন হতভম্ব হইয়া দাঁড়াইয়া যায়।
আবুল আলীয়া, হাসান বসরী, কাতাদাহ, রবী’ ইব্ন আনাস ও আস্ সুদ্দী নিজস্ব সনদে সাহাবায়ে কিরাম হইতে উহার অনুরূপ ব্যাখ্যা বর্ণনা করেন। ইহাই সঠিক ও সর্বাধিক পরিচিত ব্যাখ্যা । আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ।
কিয়ামতের দিনেও আল্লাহ্ তা’আলা ঈমানদারগণকে প্রত্যেকের ঈমান অনুসারে নূর বা আলো প্রদান করিবেন । তাহারা নিজ নিজ প্রাপ্ত নূরের আলোকে পথ চলিবে । নূরের কম বেশীর উপর চলার দ্রুততা ও মন্থরতা নির্ভর করিবে। একদল এমন হইবে যাহারা কখনও আলো পাইবে, কখনও অন্ধকারে থাকিবে । একদল পথ চলিতে চলিতে হঠাৎ থামিয়া যাইবে । খালেস মুনাফিকরা আদৌ আলো পাইবে না। তাহাদের ঈমানের নূর তখন নির্বাপিত থাকিবে।
যেমন আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
يَوْمَ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ لِلَّذِينَ آمَنُوا أَنْظُرُونَا نَقْتَبِس مِنْ نُّورِكُمْ، قبل ارْجِعُوا وَرَاءَكُمْ فَالْتَمِسُوا نُوراً
“সেইদিন মুনাফিক নর-নারীরা ঈমানদারগণকে বলিবে আমাদিগকেও একটু দেখ, তোমাদের আলোতে আমাদিগকেও চলিতে দাও। বলা হইবে, তোমরা তোমাদের পিছনে ফিরিয়া আলো জোগাড় কর।’
মু’মিনদের সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
يَوْمَ تَرَى الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ يَسْعَى نُورُهُمْ بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ يُشْرَاكُمُ الْيَوْمَ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ .
“সেইদিন ঈমানদার নর-নারী দেখিতে পাইবে, তাহাদের সামনে ও ডানে শুধু আলো আর আলো ছড়াইয়া রহিয়াছে। আজ তোমাদের জন্য সুখবর। তাহা হইল নিম্নভাগে ঝর্ণাধারা প্রবহমান জান্নাত।”
আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
يَوْمَ لآيُخْرِى الله التَبِى وَالَذِيْنَ أسَنُوَا مَمَهُ ُوْرْهُمْ يَسُعى بَيْنَ أَيْدِيِْمْ وَبِأَيْمَانِهمْ يَقوْنُوْنْ ّنا آدْممْ لَنَا ُْرَنَا وَاغْفرْكنَا تك عَلى كل شئء قدي
“সেইদিন আল্লাহ্ তা’আলা নবী ও ঈমানদারগণকে লাঞ্ছিত করিবেন না। তাহাদের সামনে ও ডাইনে নূর ছড়াইয়া থাকিবে। তাহারা বলিবে, হে আমাদের পরোয়ারদিগার! আমাদের নূর পরিপূর্ণ করিয়া দাও এবং আমাদিগকে ক্ষমা কর। নিশ্চয় তুমি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
প্রাসঙ্গিক হাদীসসমূহ
সাঈদ ইব্ন আবূ আরুবা কাতাদাহ হইতে বর্ণনা করেনঃ يوم تَرى الْمُوُمنيْنَ و الْموّمنَات আয়াতটি সম্পর্কে নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- মু’মিনদের কাহারাও নূর এত বেশী হইবে যে, মদীনা হইতে এডেন পর্যন্ত স্থান আলোকময় হইবে। কাহারও নূর আবার এত কম হইবে যে, শুধু দুই কদম স্থান আলোকিত হইবে। ইন জারীর ও ইব্ন আবূ হাতিম ইমরান ইব্ন দাউদ আল কাত্তান হইতে ও তিনি কাতাদাহ হইতে অনুরূপ বর্ণনা উদ্ধৃত করেন।
মিনহাল ইব্ন আমর কায়স ইবনুস সুকান হইতে, তিনি আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ প্রত্যেক ঈমানদারকে তাহার ঈমান অনুপাতে নূর প্রদান করা হইবে। কেহ একটা খেজুর বৃক্ষ আলোকিত করার মত নূর পাইবে। কেহ আবার তাহার বৃদ্ধাঙ্গুলি পরিমাণ নূর পাইবে যাহা কখনও জ্বলিবে, কখনও নিভিবে।
ইব্ন জারীর ইব্ন মুছান্না হইতে, তিনি ইব্ন ইদরীস হইতে, তিনি তাহার পিতা হইতে তিনি মিনহাল হইতে অনুরূপ বর্ণনা করেন।
ইব্ন আবূ হাতিম বলেনঃ আমাকে আমার পিতা, তাঁহাকে মুহাম্মদ ইব্ন আলী ইব্ন মুহাম্মদ আত্ তানাফেযী ও তাঁহাকে ইব্ন ইদরীস বলেন-আমার পিতা মিনহাল ইব্ন আমর হইতে, তিনি কায়স ইবনুস সুকান হইতে ও তিনি আব্দুল্লাহ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ نور هم يسعى بين أيديهم অর্থাৎ নিজ নিজ আমল মোতাবেক। কেহ পথ চলিবে পাহাড় পরিমাণ নূর সামনে নিয়া, কেহ খেজুর গাছ পরিমাণ নূর নিয়া এবং ন্যূনতম পরিমাণ হইবে একটি বৃদ্ধাঙ্গুলির সমান নূর। কখনও উহা প্রোজ্জ্বল হইবে, কখনও উহা নির্বাপিত হইবে।
ইব্ন আবূ হাতিমও বলেন-আমাকে মুহাম্মদ ইব্ন ইসমাঈল আল-আহমাযী, তাঁহাকে আবূ ইয়াহিয়া আল হাম্মানী, তাঁহাকে উকবা ইবনুল য়্যাকজান, তাঁহাকে ইকরামা এবং তিনি ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেন-কিয়ামতের দিন এমন কোন তাওহীদ বিশ্বাসী হইবে না যাহাকে নূর দেওয়া হইবে না। তবে মুনাফিকের নূর নির্বাপিত হইবে, উহা দেখিয়া মু’মিনরা ঘাবড়াইয়া গিয়া বলিয়া উঠিবে-হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য পূর্ণ নূর প্রদান করুন।
আয্ যিহাক ইব্ন মুযাহিম বলেন-কিয়ামতের দিন দুনিয়ায় ঈমানদার বলিয়া পরিচিত ছিল এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকেই নূর দেওয়া হইবে। কিন্তু যখন পথপ্রান্তে পৌছিবে, তখন মুনাফিকের নূর নিভিয়া যাইবে। তখন ঈমানদারগণ ঘাবড়াইয়া বলিবে-হে আমাদের প্রতিপালক প্রভু! আমাদিগকে পূর্ণ পথ চলিবার নূর প্রদান করুন।
উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে স্থিরিকৃত হইল যে, মানুষ কয়েক শ্রেণীতে বিভক্ত। খালেস মু’মিন। সূরা বাকারার প্রথম চারি আয়াতে তাহাদের পরিচয় দেওয়া হইয়াছে। খালেস কাফির। তাহাদের বর্ণনা পরবর্তী দুই আয়াতে প্রদত্ত হইয়াছে মুনাফিক। তাহারা দুই শ্রেণীর। খালেস মুনাফিক। আগুন জ্বালানোর উপমা দিয়া তাহাদের পরিচয় তুলিয়া ধরা হইয়াছে। দ্বিধাগ্রস্ত মুনাফিক। কখনও ঈমানের আলোকে প্রদীপ্ত হয়, কখনও কুফরীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। তাহাদিগকে বজ্র ও বিদ্যুতের উপমা দিয়া চিহ্নিত করা হইয়াছে। প্রথমোক্ত দলের অবস্থা হইতে তাহাদের মুনাফেকীর অবস্থা লঘুতর।
এই বর্ণনার সহিত সূরা নূরের বর্ণনার কোন কোন দিকের মিল রহিয়াছে। সেখানে মু’মিনদের উপমা বর্ণনা করা হইয়াছে। মু’মিনের অন্তরে আল্লাহ্ তা’আলা যে হিদায়েতের নূর সৃষ্টি করিয়াছেন, উহাকে কাঁচের চিমনী পরিবৃত্ত প্রদীপের সহিত উপমা দিয়াছেন এবং সেইটিকে উপমা দিয়াছেন উজ্জ্বল নক্ষত্রের সহিত। উহাই মু’মিনের অন্তরের যথার্থ রূপ। দীপ্ত ঈমান ও নির্ভেজাল পরিচ্ছন্ন শরীঅতের স্থায়ী প্রভাব উহাকে অনুরূপ করিয়াছে। শীঘ্রই এই ব্যাপারে ইনশাআল্লাহ্ বিস্তারিত আলোচনা আসিতেছে।
অতঃপর সেই সব কাফির বান্দার উপমা প্রদান করা হইয়াছে, যাহারা মনে করে তাহাদেরও ধর্মীয় ভিত্তি রহিয়াছে। আসলে তাহাদের কোনই ভিত্তি নাই। তাহারাই ‘জাহিলে মুরাক্কাব’ অর্থাৎ ভেজাল মূর্খ। তাহাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেনঃ
وَالَّذِينَ كَفَرُوا اَعْمَالُهُمْ كَسَرَابِ بَقِيْمَة يُحْسَبُهُ الظَّمْانُ مَاءً حَتَّى إِذَا جَاءَهُ لَمْ يَجِدهُ شَيْئًا
‘কাফিরদের আমলগুলি হইল মরীচিকার মত। তৃষ্ণার্ত ব্যক্তি দেখিয়া পানি মনে করে। যখন কাছে আসে, তখন কিছুই পায় না।”
অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা কাফিরের দ্বিতীয় দলের উপমা দিলেন। তাহারা হইল নিৰ্ভেজাল মূর্খ।
তাহাদের সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেনঃ
أو كظلمات في بَحْرٍ تُجِي يُغْشَاهُ مَوْجٌ فَوْقِهِ سَحَابٌ ظُلُمَاتٌ بَعْضُهَا فَوْقَ بَعْدِ إِذَا أَخْرَجَ يَدَاهُ لَمْ يَجِدْ يَرَاهَا وَمَنْ لَّمْ يَجْعَلِ اللَّهُ لَهُ نُورًا فَمَا لَهُ مِنْ نُّورٍ
“অথবা সেই গভীর সমুদ্র গর্ভের অন্ধকারের মত ঢেউয়ের পর ঢেউয়ে যাহার উপরিভাগ আচ্ছন্ন রহিয়াছে এবং তাহার উপরে কালো মেঘ, আঁধারের উপর আঁধার-হাত বাহির করিলেও দেখা যায় না। আল্লাহ্ যাহাকে আলো যোগান নাই, তাহার কোন আলো থাকে না ৷ ”
কাফিরকে এখানে দুইভাগে বিভক্ত করা হইয়াছে। অনুসৃত কাফির ও অনুসারী কাফির। সূরা হজ্জের শুরুতে তাহাদের বর্ণনা রহিয়াছে। যেমনঃ
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُجَادِلُ فِي اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَ يَتَّبِعُ كُلَّ شَيْطَانٍ مَّرِيدٍ
“একদল মানুষ না জানিয়া আল্লাহর ব্যাপারে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে এবং অন্ধভাবে প্রতি ক্ষেত্রে বিতাড়িত শয়তানকে অনুসরণ করে।”
অতঃপর তিনি বলেনঃ
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُجَادِلُ فِي اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَلَا هُدًى وَلَا كِتَابٍ مُّنِيرٍ
“একদল মানুষ না জানিয়া আল্লাহ্র ব্যাপারে ঝগড়া করে। না তাহারা হিদায়েতের উপর আছে, না আছে তাহাদের কোন আলোদায়ক গ্ৰন্থ।”
সুরা ওয়াকিআর শুরুতে ও শেষভাগে তিনি মু’মিনদের শ্রেণীভাগ দেখাইয়াছেন। এই সূরায় তিনি মু’মিনদের দুইভাগে বিভক্ত করিয়াছেন। সাবেকূন বা মুকাররাবূন ও আসহাবে ইয়ামীন বা আবরার।
এসব আয়াতের সারকথা হইল এইঃ মু’মিন দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। প্রথম শ্রেণী হইলেন ‘মুকাররাবীন’ বা আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী প্রিয় বান্দাগণ। দ্বিতীয় শ্রেণীতে আছেন ‘আবরার’ বা সাধারণ স্তরের নেককার বান্দাগণ। তেমনি কাফিররাও দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। প্রথম শ্ৰেণী হইল কুফরের দিকে আহ্বানকারী বিশিষ্ট কাফির দল। দ্বিতীয় শ্রেণীতে রহিয়াছে কুফর অনুসরণকারী সাধারণ কাফিররা। মুনাফিকদেরও দুই শ্রেণী রহিয়াছে। প্রথম শ্রেণীর মুনাফিক সেই সব কট্টর মুনাফিক যাহাদের অন্তরে ঈমানের লেশমাত্র নাই। দ্বিতীয় শ্রেণীর মুনাফিকের অন্তরে কিছু ঈমান থাকিলেও নিফাকের সকল চরিত্র তাহাদের মধ্যে বিদ্যমান। যেমন বুখারী ও মুসলিম শরীফে আবদুল্লাহ ইবন উমর (রাঃ) হইতে বর্ণিত রহিয়াছেঃ
‘মহানবী (সাঃ) বলিয়াছেন-তিনটি চরিত্র যাহার মধ্যে রহিয়াছে সে কট্টর মুনাফিক। আর যাহার মধ্যে উহার একটি চরিত্র পাওয়া যাইবে, সে তাহা বর্জন না করা পর্যন্ত তাহাকে মুনাফিক চরিত্রের লোক বলিতে হইবে। সেই চরিত্র তিনটি হইল (১) যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে (২) যখন সে অঙ্গীকার করে, ভঙ্গ করে (৩) যখন সে আমানত রাখে, খেয়ানত করে।’
এই হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মানুষের মধ্যে যেমন ঈমানী চরিত্র বিদ্যমান থাকে, তেমনি মুনাফিকী চরিত্রও বিদ্যমান থাকিতে পারে। ইহা যেমন আকীদা-বিশ্বাসে দেখা দিতে পারে, তেমনি দেখা দিতে পারে আমল-আখলাকে। কুরআন পাকের বিভিন্ন আয়াত দ্বারা ইহাই প্রমাণিত হয় এবং পূর্বসূরী আলিমগণ এই অভিমতই পোষণ করিতেন। ইতিপূর্বে এই ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত করা হইয়াছে এবং ভবিষ্যতে উহা ইনশাআল্লাহ্ সবিস্তারে আলোচনার ইচ্ছা রহিল।
হযরত আবূ সাঈদ (রাঃ) হইতে যথাক্রমে আবূ নযর ও আবূ মুআবিয়া, শায়বান, লায়ছ, আমর ইব্ন মুররাহ, আবুল বুখতারী ও ইমাম আহমদ বর্ণনা করেনঃ
‘মহানবী (সাঃ) বলিয়াছেন-মানুষের আত্মা চারি শ্রেণীতে বিভক্ত। প্রথম শ্রেণীর আত্মা প্রদীপের মত উজ্জ্বল এবং হীরকের মত স্বচ্ছ ধবধবে। দ্বিতীয় শ্রেণীর আত্মা আবৃত ও রুদ্ধ । তৃতীয় শ্রেণীর আত্মা অন্ধত্বের রোগে আক্রান্ত ও চতুর্থ শ্রেণীর আত্মা ঈমান ও নিফাকের সংমিশ্রণে ঘোলাটে বর্ণ। প্রথম শ্রেণীর আত্মা মু’মিনদের যাহা ঈমানের নূরে দীপ্ত-সমজ্জ্বল। দ্বিতীয় শ্রেণীর আত্মা কাফিরদের যাহাতে আলো প্রবেশের কোন পথ নাই। তৃতীয় শ্রেণীর আত্মা কট্টর মুনাফিকদের যাহা ইসলামের আলো পাইয়াও প্রত্যাখ্যান করিয়াছে। চতুর্থ শ্রেণীর আত্মা সাধারণ মুনাফিকদের যাহাতে ঈমানের আলো ও কুফরীর অন্ধকারের সংমিশ্রণ ঘটিয়াছে । ঈমানের উদাহরণ হইল সেই সবুজ শসাটি যাহা পবিত্রতম পানির আর্দ্রতা লাভ করিয়া দিন দিন বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইতে থাকে। আর মুনাফিকীর উদাহরণ হইল সেই বিষ ফোঁড়া বা ক্ষতস্থানটি যাহা হইতে অহরহ পুঁজ ও রক্ত প্রবাহিত হয়। সুতরাং এই দুইটি মৌল জিনিসের মধ্যে যেইটি .বিজয়ী হয়, সেইটি অপরটির উপর প্রভাব বিস্তার করিয়া থাকে।’ উক্ত হাদীসের সনদ বিশুদ্ধ ও উত্তম।
উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ্ পাক বলেনঃ
وَلَوْشَاءَ اللهُ لَذَهَبَ بِسَمْعِهِمْ وَأَبْصَارِهِمْ إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা ইচ্ছা করিলে তাহাদের শ্রবণ শক্তি ও দৃষ্টি শক্তি হরণ করিয়া তাহাদিগকে বধির ও অন্ধ করিয়া রাখিতে পারেন। অবশ্যই আল্লাহ্ তা’আলা সকল কিছুর উপর ক্ষমতা রাখেন।
ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হইতে যথাক্রমে ইকরামা বা সাঈদ ইব্ন জুবায়র, মুহাম্মদ ইব্ন আবূ মুহাম্মদ, ও ইব্ন ইসহাক বর্ণনা করেনঃ
‘হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) ولوشاء الله لذهب بس بسمعهم وأبصارهم আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় বলিয়াছেন যে, সত্যের পরিচয় পাইয়াও যখন তাহারা উহা বর্জন করিল, তখন আল্লাহ্ ইচ্ছা করিলে তাহাদের শ্রবণ শক্তি ও দৃষ্টিশক্তি হরণ করিতে পারেন। আর انْ الله عَلَى كل شئاء قدي এর মর্ম সম্পর্কে তিনি বলেন যে, আল্লাহ্ শাস্তিদান কিংবা ক্ষমা প্রদর্শন উভয় ব্যাপারেই পূর্ণ ক্ষমতাবান।
ইমাম ইবন জারীর বলেনঃ ‘আল্লাহ্ পাক এখানে নিজেকে সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান বলিয়া এই কারণে উল্লেখ করিয়াছেন যে, মুনাফিকগণ যেন তাঁহার শাস্তি প্রদানের সম্ভাবনায় ভীত হইয়া পথে আসে। তাঁহার শাস্তি যে তাহাদিগকে চতুর্দিক হইতে বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে তাহা তিনি এখানে তাহাদের অবহিত করিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি যে তাহাদের অন্ধ ও বধির করার ক্ষমতা রাখেন তাহা স্মরণ করাইয়া দিয়া তাহাদিগকে ভীতি প্রদর্শন করিয়াছেন । এখানে قدير শব্দ قادر অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। যেমন عليم বলিয়া عالم অর্থ গ্রহণ করা হয়।
ইন জারীর ও তাঁহার অনুসারী ব্যাখ্যাকারগণ বলেন-আলোচ্য আয়াতের উদাহরণ দুইটি দ্বারা এক শ্রেণীর মুনাফিকের কথাই বুঝানো হইয়াছে । এখানে أوكصيب من السسّماء আয়াতাংশে ١و শব্দটি ‘ও’ বা ‘এবং’ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে।
যেমন কালামে মজীদের-
ولاً شطع مثهم نما أو كفور (তাহাদের পাপ ও কুফরী অনুসরণ করিও না।)
আয়াতে ١و শব্দ ‘ও’ বা ‘এবং’ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। অথবা এই আয়াতে ١و শব্দটি ‘ইচ্ছা’ ও ‘মর্জী’ অর্থে ব্যবহার করা হইয়াছে। অর্থাৎ মুনাফিকদের জন্য বর্ণিত উদাহরণদ্বয়ের তোমার ইচ্ছা মাফিক প্রথম উদাহরণ অথবা দ্বিতীয় উদাহরণ বর্ণনা কর।
ইমাম কুরতুবী বলেন-এখানে ١و শব্দটি ‘সমতুল্য’ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। যেমন আরবী ভাষায় বলা হয়, جالس الحسن او اين سيرين (হাসানের নিকট উপবিষ্ট হওয়া ইব্ন সিরীনের নিকট বসার সমতুল্য।) আল্লামা যামাখশারীও এই ব্যাখ্যা প্রদান করিয়াছেন। সেক্ষেত্রে অর্থ দাঁড়ায়, উহাদের জন্য এই দুই উদাহরণের যেইটিই ব্যবহার কর, করিতে পার । কারণ, একটি অপরটির সমতুল্য এবং উভয়টিই তাহাদের জন্য যথার্থ।
আমার (ইব্ন কাছীরের) মতে উদাহরণগুলির প্রত্যেকটি মুনাফিকদের শ্রেণী অনুসারে প্রযোজ্য হইবে। কেননা তাহাদের অবস্থাভেদে তাহারা বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত। যেমন আল্লাহ্ তা’আলা সূরা তওবায় ومنهم ومنهم ومنهم বলিয়া উহাদের বিভিন্ন শ্রেণীর অবস্থা ও চারিত্রিক বিভিন্নতা তুলিয়া ধরিয়াছেন। সুতরাং উপরোক্ত উদাহরণদ্বয় উহাদের দুই শ্রেণীর অবস্থা ও চরিত্রের সহিত সাদৃশ্য রাখে। যেমন সূরা নূরে অনুসারী কাফির ও অনুসৃত কাফিরের বর্ণনা প্রথমে والّذين كفرواأعمالهم كسراب بقيعة (কাফিরদের কাজ মরুর বুকের মায়া মরীচিকার মত) আয়াতে এবং পরে أو كَظلُمَات فى بَخْر لَجَىّ (অথবা সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালার মধ্যকার প্রগাঢ় অন্ধকারের মত) আয়াতে প্রদান করা হইয়াছে। সূরা নূরের এই আয়াতদ্বয়ের প্রথম আয়াতে নেতৃস্থানীয় অনুসৃত কাফিরের উদাহরণ বর্ণনা করা হইয়াছে এবং দ্বিতীয় আয়াতে গণ্ডমুর্খ অনুসারী কাফিরের উদাহরণ পেশ করা হইয়াছে।