২৮৬ আয়াত, ৪০ রুকূ’, মাদানী

।। দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে ৷।

সূরা বাকারার ফযীলত সম্পর্কিত বর্ণনাসমূহ

ইমাম আহমদ (রঃ) বলেন-আমাকে আরেম, তাহাকে মু’তামার, তাহাকে তাহার পিতা, তাঁহাকে এক ব্যক্তি তাহার পিতা হইতে, তাহাকে মা’কিল ইব্‌ন ইয়াসার বর্ণনা করেনঃ

‘রাসূল (সাঃ) বলিয়াছেন, আল-বাকারা কুরআনের শীর্ষভাগে অবস্থিত সর্বোন্নত চূড়া। উহার প্রত্যেকটি আয়াতের সঙ্গে আশিজন ফেরেশতা অবতীর্ণ হইয়াছেন। ‘আল্লাহু লাইলাহা ইল্লাহু আল হাইয়্যুল কাইয়্যুম’ শীর্ষক আয়াতটি আরশের নীচ হইতে বাহির করিয়া সূরা বাকারায় শামিল করা হইয়াছে। সূরা ইয়াসীন কুরআনের হৃদয় সদৃশ। যে ব্যক্তি আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি ও পারলৌকিক সুফল লাভের জন্য উহা পাঠ করে, সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়। মৃত্যুপথযাত্রীর সামনে সূরাটি পড়িও।’

এই সনদটি শুধু ইমাম আহমদই উদ্ধৃত করিয়াছেন। তাঁহার উদ্ধৃত অপর এক সনদে তিনি বলেনঃ আমাকে আরেম, তাঁহাকে আব্দুল্লাহ ইব্‌ন মুবারক, তাহাকে সুলায়মান আত্তায়মী, তাঁহাকে আবূ উসমান (হিন্দী নহে), তাঁহাকে তাঁহার পিতা ও তাঁহাকে মা’কিল ইব্‌ন ইয়াসার বর্ণনা করেনঃ

‘নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন-‘সূরাটি মরণাপন্ন ব্যক্তির সম্মুখে পাঠ করিও।’ অর্থাৎ সূরা ইয়াসীন।

এই হাদীসের সনদে পূর্বোক্ত সনদের বেনামী ব্যক্তির নাম ব্যক্ত হইয়াছে এবং এই সনদে আবূ দাউদ, নাসাঈ ও ইব্‌ন মাজাহ হাদীসটি উদ্ধৃত করিয়াছেন।

ইমাম তিরমিযী হাকীম ইবন জুবায়রের সূত্রে নিম্ন হাদীসটি উদ্ধৃত করেন। হাকীম ইব্‌ন জুবায়র (জঈফ) আবূ সালেহ হইতে, তিনি তাহার পিতা হইতে, তিনি আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ

‘রাসূল (সাঃ) বলিয়াছেন-প্রত্যেকটি বস্তুর শীর্ষ আছে। আল-কুরআনের শীর্ষ হইল সূরা বাকারা এবং উহাতে শ্রেষ্ঠতম আয়াত (আয়াতুল কুরসী) বিদ্যমান।’

সহীহ মুসলিম, তিরমিযী, নাসাঈ ও মুসনাদে আহমদে বর্ণিত হইয়াছে যে, সুহায়ল ইব্‌ন আবি সালেহ তাঁহার পিতা হইতে ও তিনি আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ

‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলিয়াছেন-“তোমাদের ঘরগুলিকে কবরে পরিণত করিও না। নিশ্চয় যেই গৃহে সূরা বাকারা তিলাওয়াত হয়, সেই গৃহে শয়তান প্রবেশ করে না।’

ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে ‘হাসান সহীহ’ বলিয়াছেন। আবূ উবায়দ আল কাসিম ইব্‌ন সালাম বলেনঃ আমাকে ইব্‌ন আবূ মরিয়ম, তাহাকে ইব্‌ন লাহীয়াহ, তাহাকে ইয়াযীদ ইব্‌ন আবূ হাবীব, তাহাকে সিনান ইব্‌ন সা’আদ ও তাহাকে আনাস বিন মালিক (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সাঃ) বলিয়াছেনঃ

‘নিশ্চয় শয়তান যেই গৃহে সূরা বাকারা পড়িতে শোনে, সেই গৃহ হইতে বাহির হইয়া যায়।’

সিনান ইব্‌ন সা’আদ কিংবা সা’আদ ইব্‌ন সিনানকে ইব্‌ন মাঈন নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী বলিয়াছেন। কিন্তু তাঁহাদের হাদীসকে আহমদ ইব্‌ন হাম্বল (রঃ) প্রমুখ ‘মুনকার’ বলিয়াছেন।

আবূ উবায়দ বলেন-আমাকে মুহাম্মদ ইব্‌ন জা—ফর, তাহাকে শু‘বা, তাহাকে সালাম ইব্‌ন কোহায়েল, তাহাকে আবুল আহওয়াস ও তাহাকে আবদুল্লাহ ইব্‌ন মাসউদ (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ

‘কোন ঘরে সূরা বাকারা পড়িতে শুনিলে শয়তান অবশ্যই সেই ঘর হইতে পলায়ন করে।’ বর্ণনাটি ইমাম নাসাঈ ‘আল ইয়াওম ওয়াল লাইলা’ গ্রন্থে উদ্ধৃত করিয়াছেন। হাকিম তাঁহার ‘মুস্তাদরাক’ এ উহা শু’বার সূত্রে উদ্ধৃত করিয়া বলেন, হাদীসটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হইয়াছে। অবশ্য উহা সহীহাইনে উদ্ধৃত হয় নাই ৷

ইব্‌ন মারদুবিয়্যা বলেন-আমাকে আহমদ ইব্‌ন কামিল, তাহাকে আবূ ইসমাঈল তিরমিযী, তাঁহাকে আইয়ুব ইব্‌ন সুলায়মান ইব্‌ন বিলাল, তাহাকে আবূ বকর ইব্‌ন আবূ উয়ায়স, তাহাকে মুহাম্মদ ইব্‌ন আজলান, তাহাকে আবূ ইসহাক, তাহাকে আবুল আহওয়াস ও তাহাকে আব্দুল্লাহ ইব্‌ন মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, রাসূল (সাঃ) বলিয়াছেনঃ

‘তোমাদের কাহাকেও যেন এইরূপ দেখিতে না পাই যে, পায়ের উপর পা চড়াইয়া গান করিতেছ এবং সূরা বাকারা পাঠ ছাড়িয়া দিয়াছ। নিশ্চয় শয়তান সেই ঘর হইতে পালায় যে ঘরে সূরা বাকারা পাঠ করা হয়। নিকৃষ্টতম ঘর সেইটি যেখানে কুরআন তিলাওয়াত হয় না।’

ইমাম নাসাঈ তাঁহার ‘আল ইয়াওমু ওয়াল লাইলাহ্’ নামক সংকলন গ্রন্থে মুহাম্মদ ইব্‌ নসর হইতে ও তিনি আইয়ুব ইবন সুলায়মান হইতে অনুরূপ বর্ণনা প্রদান করেন।

ইমাম দারেমী তাঁহার সনদে ইবন মাসউদ (রাঃ)-এর এই বক্তব্য উদ্ধৃত করেনঃ

‘এমন কোন ঘর হয় না যেখানে সূরা বাকারা তিলাওয়াত হইলে শয়তান হাওয়া ছাড়িতে ছাড়িতে পালায় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্যেকটি বস্তুর শীর্ষভাগ আছে এবং আল-কুরআনের শীর্ষভাগ হইল আল-বাকারা। তেমনি প্রত্যেকটি বস্তুরই নির্যাস আছে এবং আল কুরআনের নির্যাস হইল বৃহদায়তন সূরাগুলি।’

ইমাম শা’বীর সূত্রে বর্ণিত হইয়াছেঃ আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রাঃ) বলেন-“রাত্রিকালে যে ব্যক্তি সূরা বাকারার দশটি আয়াত তিলাওয়াত করে, সেই ঘরে সেই রাত্রিতে শয়তান প্রবেশ করে না। আয়াত দশটি হইল, সূরা বাকারার শুরুর চারি আয়াত, আয়াতুল কুরসী, উহা পরবর্তী দুই আয়াত ও সূরার শেষ তিন আয়াত।’ অপর এক বর্ণনায় আছে-সেই রাত্রিতে সেই বাড়ির বাসিন্দাগণকে শয়তান কিংবা কোন অনভিপ্রেত বস্তু কোন ক্ষতি করিতে পারে না। উক্ত আয়াতসমূহ পড়িয়া পাগলের উপর ফুঁক দিলে পাগল ভাল হয়।

সহল ইব্‌ন সা’আদ (রাঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলিয়াছেন-প্রত্যেকটি বস্তুর চূড়া আছে এবং আল-কুরআনের চূড়া হইল সূরা বাকারা। অনন্তর যে ব্যক্তি কোন রাত্রে তাহার গৃহে উহা তিলাওয়াত করে, শয়তান তিন রাত্রি পর্যন্ত সেই ঘরে প্রবেশ করে না। যদি কেহ তাহার ঘরে দিনে উহা পাঠ করে, তাহা হইলে তিন দিন অবাধ্য শয়তান সেই ঘরে ঢোকে না। ”

বর্ণনাটি আবুল কাসিম আত-তাবারানী, আবূ হাতিম ও ইব্‌ন হিব্বান নিজ নিজ সহীহ সংকলনে উদ্ধৃত করেন। ইব্‌ন মারদুবিয়্যা উহা আল আযরাক ইব্‌ন আলী হইতে, তিনি হাসান ইবন ইবরাহীম হইতে, তিনি খালিদ ইব্‌ন সাঈদ আল মাদানী হইতে, তিনি আবূ হাযেম হইতে ও তিনি সহল হইতে বর্ণনা করেন। ইবন হিব্বানের মতে খালিদ ইবন সাঈদ আল মাদায়নী’ (আল মাদানী নহে)।’

তিরমিযী, নাসাঈ ও ইব্‌ন মাজাহ্ আবদুল হামীদ ইব্‌ন জা’ফর হইতে, তিনি সাঈদ আল মাকরাবী হইতে, তিনি আবূ আহমদের গোলাম আতা হইতে এবং তিনি আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ

“রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটি ক্ষুদ্র দল অভিযানে পাঠাইতে গিয়া প্রত্যেককে কুরআন পাক হইতে তিলাওয়াত করিতে বলিলেন। তখন যে যাহা জানিত তাহাই পাঠ করিল। তিনি তখন এক তরুণের কাছে গিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন-তোমার কতটুকু জানা আছে? সে বলিল, আমি ‘অমুক অমুক আয়াত ও সূরা বাকারা জানি। তিনি সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিলেন-সূরা বাকারা তোমার মুখস্থ আছে? সে বলিল-হ্যাঁ। তিনি বলিলেন—যাও, তুমিই এই অভিযানে নেতৃত্ব দিবে। তখন একজন সম্ভ্রান্ত প্রধান ব্যক্তি বলিলেন-আল্লাহর কসম! আমি সূরা বাকারা এইজন্য মূখস্থ করি নাই যে, উহা আমল করিতে পারিব না। রাসূল (সাঃ) বলিলেন-কুরআন শিখ ও উহা পাঠ কর ৷ যে ব্যক্তি কুরআন শিখে, পাঠ করে ও উহা আমল করে সে হইল সুগন্ধি বিচ্ছুরক মিশ্বকপূর্ণ পাত্রের মত। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি কুরআন শিখিয়া আমল করে না, সে যেন মিকপূর্ণ সুগন্ধিবিহীন আবদ্ধ পাত্র।’

উপরোক্ত বর্ণনাটি ইমাম তিরমিযী উদ্ধৃত করিয়া বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ।’ তারপর উহা তিনি লায়ছ হইতে, তিনি সাঈদ হইতে, তিনি আবূ আহমদের গোলাম আতা হইতে ‘মুরসাল হাদীস’ হিসাবে বর্ণনা করেন। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

ইমাম বুখারী বলেন-লায়ছ বলিয়াছেন যে, আমাকে ইয়াযীদ ইবনুল হাদী, তাঁহাকে মুহাম্মদ ইব্‌ন ইবরাহীম ও তাঁহাকে উসায়দ ইব্‌ন হুযায়র (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ

‘তিনি এক রাত্রে সূরা বাকারা তিলাওয়াত করিতেছিলেন। তাঁহার পাশেই তাঁহার ঘোড়াটি বাঁধা ছিল । হঠাৎ ঘোড়াটি লাফালাফি জুড়িয়া দিল। তিনি তিলাওয়াত বন্ধ করিলেন। ঘোড়াটিও স্থির হইয়া দাঁড়াইল। তখন আবার তিলাওয়াত শুরু করিলেন। ঘোড়াটি আবার লাফাইতে লাগিল। তিনি তিলাওয়াত বন্ধ করিয়া তাকাইলেন। ঘোড়াটিও সুস্থ হইয়া দাঁড়াইল। তিনি আবার তিলাওয়াত শুরু করিতেই ঘোড়া আবার লাফানো শুরু করিল। তাঁহার পুত্র ইয়াহিয়া ঘোড়ার কাছাকাছি ঘুমাইতেছিল। তাঁহার ভয় হইল, পুত্রের গায়ে ঘোড়ার পায়ের আঘাত লাগিবে। তাই তিনিই পুত্রকে তুলিয়া আনিতে গেলেন। তখন একবার আকাশের দিকে তাকাইলেন এবং যাহা দেখার তাহা দেখিলেন। ভোর হওয়া মাত্র তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে গিয়া আনুপূর্বিক ঘটনা বর্ণনা করিলেন। রাসূল (সাঃ) শুনিয়া বলিলেন-‘তুমি তিলাওয়াত বন্ধ করিলে কেন?’ তিনি বলিলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল ! ইয়াহিয়া আঘাত পাইবে এই ভয়ে বন্ধ করিয়াছি। কারণ, সে ঘোড়াটির কাছাকাছি ছিল। আমি তাহাকে সরাইতে গিয়া আকাশের দিকে তাকাইলাম। দেখিলাম, একটি ছায়াপথে যেন সারিবদ্ধ দীপমালা জ্বলজ্বল করিতেছে। উহা ভালভাবে দেখার জন্য বাহির হইলাম। তখন উহা শূন্যে মিলাইয়া গেল।’ রাসূল (সাঃ) বলিলেন-তুমি কি জান উহা কি ছিল? তিনি বলিলেন-না। রাসূল (সাঃ) বলিলেন-তাহারা ছিলেন একদল ফেরেশতা। তোমার তিলাওয়াতের সুরে আকৃষ্ট হইয়া আসিয়াছিলেন। যদি তুমি সকাল পর্যন্ত তিলাওয়াত করিতে তাহা হইলে তাঁহারাও সকাল পর্যন্ত ‘থাকিতেন। লোকজন তাঁহাদিগকে দেখিতে পাইত এবং ফেরেশতাগণও তাহাদের দৃষ্টির আড়ালে যাইতেন না।’ ইমাম আবূ উবায়দ আল কাসিম ইবন সালাম তাঁহার ‘ফাযায়েলুল কুরআন’ গ্রন্থে এই বর্ণনাটি আবদুল্লাহ ইব্‌ন সালেহ ও ইয়াহিয়া ইবন বুকায়র লায়ছ হইতে বর্ণনা করেন। উসায়দ ইব্‌ন হুযায়র (রাঃ) হইতে উহা ভিন্ন সূত্রেও বর্ণিত হইয়াছে। আল্লাহই সব ব্যাপারে সর্বাধিক জ্ঞাত।

ছাবিত ইব্‌ন কয়স ইব্‌ন শিমাস (রাঃ)-এর ক্ষেত্রেও এইরূপ ঘটনা ঘটিয়াছে এবং আবূ উবায়দ বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেন। তিনি বলেনঃ আমাকে ইবাদ ইব্‌ন ইবাদ, তাঁহাকে জারীর ইব্‌ন হাযিম, তাহাকে তাহার চাচা জারীর ইবন ইয়াযীদ বলিয়াছেন যে, তাহাকে মদীনার প্রবীণ ব্যক্তিরা বর্ণনা করিয়াছেন-তাহারা রাসূল (সাঃ)-এর খিদমতে হাজির হইয়া আরয করিলেন, ‘আপনি কি দেখিতে পাইয়াছেন যে, ছাবিত ইব্‌ন কয়স ইব্‌ন শিমাসের গৃহটি সারারাত্রি দীপমালার আলোকে ঝলমল করিতেছিল?’ রাসূল (সাঃ) জবাবে বলিলেন- ‘সম্ভবত সে সূরা বাকারা পড়িয়াছিল।’ বর্ণনাকারী বলেন, তখন আমি ছাবিতকে এই সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেন-হ্যাঁ, আমি সূরা বাকারা পড়িয়াছিলাম।

এই সনদটি উত্তম। অবশ্য কিছুটা অস্পষ্টতা বিদ্যমান। হাদীসটি ‘মুরসাল’। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

 

সূরা আলে ইমরানসহ সূরা বাকারার ফযীলত সম্পর্কিত বর্ণনা

ইমাম আহমদ বলেন-আমাকে আবু নাঈম, তাহাকে বাশার ইব্‌ন মুহাজির, তাহাকে আব্দুল্লাহ ইব্‌ন বুরাইদ তাহার পিতা বুরাইদা এই বর্ণনা শুনাইয়াছেনঃ

‘আমি নবী করীম (সাঃ)-এর দরবারে বসা ছিলাম। আমি শুনিতে পাইলাম, তিনি বলিতেছেন-‘সূরা বাকারা শিখ। উহা গ্রহণে বরকত ও বর্জনে আক্ষেপ মিলে। উহার উপর বাতিল শক্তির কোন ক্ষমতা চলে না।’ বর্ণনাকারী বলেন, তারপর তিনি কিছুক্ষণ চুপ থাকিলেন। অতঃপর বলিলেন-‘সূরা আল-বাকারা ও সূরা আলে ইমরান শিখ। কারণ, উহারা দুইটি আলোকপিণ্ড। কিয়ামতের দিন উহাদের পাঠকমণ্ডলীকে শামিয়ানা, মেঘপুঞ্জ কিংবা পাখীর ঝাঁকের মত মাথার উপরে আসিয়া ছায়া দিবে। কিয়ামতের দিন কুরআন পাঠক কবর হইতে উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে কুরআন এক তরুণের বেশে তাহার সামনে হাজির হইয়া বলিবে-আমাকে চিনিয়াছ কি? সে বলিবে-না, আমি তোমাকে চিনি না। তখন সেই তরুণ বলিবে-আমি তোমার সহচর কুরআন। আমি তোমাকে দিনের ক্ষুৎপিপাসা ও রাতের নিদ্রা হইতে বঞ্চিত রাখিয়াছিলাম। প্রত্যেক ব্যবসায়ী তাহার ব্যবসার পিছনে লাগে। আজ সকল ব্যবসা তোমার পেছনে জড়ো হইয়াছে। তারপর তাহার ভানে প্রশস্ত রাজ্য এবং বামে স্থায়ী নিকেতন জান্নাত প্রদত্ত হইবে। তাহার মস্তকে মহামর্যাদার মুকুট স্থাপন করা হইবে। তাহার পিতামাতাকে এমন পোষাকে অলংকৃত ও সজ্জিত করা হইবে পৃথিবীবাসী তাহাদের সামনে কখনও যাহা উপস্থিত করিতে পারে না । তাহারা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিবে-আমাদিগকে কেন ইহা পরানো হইল? জবাব আসিবে-তোমাদের সন্তানের কুরআন তিলাওয়াতের জন্য। অতঃপর তাহাদিগকে বলা হইবে : কুরআন তিলাওয়াত করিতে করিতে জান্নাতের সিঁড়ির ধাপগুলি অতিক্রম করিয়া উপরে উঠিতে থাক।’ যত ঊর্ধ্বে গিয়া তাহার তিলাওয়াত শেষ হইবে তত ঊর্ধ্বে তাহার কক্ষ নির্ধারিত থাকিবে। তিলাওয়াত ধীরে চলুক কি দ্রুত, ফল একইরূপে পাইবে।

ইব্‌ন মাজাহ বাশার ইব্‌ন মুহাজির হইতে এই হাদীসের অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করিয়াছেন। ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী হাদীসটি ‘হাসান’ শ্রেণীভুক্ত। কারণ, ইমাম মুসলিম বাশারের হাদীস উদ্ধৃত করিয়াছেন। ইব্‌ন মাঈন তাহাকে ছিকাহ রাবী বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন। ইমাম নাসাঈ বলেন, তাহার হাদীস গ্রহণে দোষ নাই। অবশ্য ইমাম আহমদ তাহার বর্ণিত এই হাদীসকে ‘মুনকার’ বলিয়াছেন। তবে তাহার হাদীস ‘মু‘তাবার বটে, কিন্তু ঊহাতে কখনও অদ্ভুত ঘটনার সমাবেশ ঘটে। ইমাম বুখারী বলেন, তাহার কোন কোন হাদীসের বিরোধিতা করা হইয়াছে ৷ আবূ হাতিম আর রাযী বলেন, তাহার হাদীস উদ্ধৃত করা হয়, কিন্তু উহা দলীল হিসাবে কখনও পেশ করা হয় না। ইব্‌ন আদী বলেন, তাহার বর্ণিত হাদীস অনুসৃত হয় না। দারা কুতনী বলেন, তাহার হাদীস সবল নহে।

আমি বলিতেছি, তাহার এই হাদীসের কোন কোন অংশের সমর্থন অন্য হাদীসে মিলে। আবূ উমামা আল বাহেলীর হাদীস এক্ষেত্রে উল্লেখ্য। ইমাম আহমদ বলেন-আমাকে আব্দুল মালেক ইব্‌ন উমর, তাহাকে হিশাম, তাহাকে ইয়াহিয়া ইব্‌ন আবূ কাছীর, তাহাকে আবূ সালাম ও তাহাকে আবূ উমামা বর্ণনা করেনঃ

سمعت رسول الله صلعم يقول اقرءوا القرآن فانه شافع لاهله يوم القيامة اقرءوا الزهراوين البقرة وآل عمران فانهما يأتيان يوم القيامة كانهما عمامتان أو كانهما غيايتان أو كانهما فرقان من طير صواف يحاجان عن اهلهما يوم القيامة ثم قال اقرءوا البقرة فان اخذها بركة وتركها حسرة لا تستطيعها البطلة 

‘আমি নবী করীম (সা)-কে বলিতে শুনিয়াছি যে, ‘কুরআন পড়। কিয়ামতের দিন কুরআন উহার পাঠকদের জন্য শাফাআতকারী হইবে। তোমরা যুগ্ম আলোকপিণ্ড অর্থাৎ আল্ বাকারা ও আলে ইমরান তিলাওয়াত কর। কিয়ামতের দিন উহারা দুই খণ্ড মেঘ কিংবা শামিয়ানা কিংবা পাখীর ঝাঁক হইয়া পাঠকারীর মাথার উপর ছায়া দিবে।’ অতঃপর তিনি বলেন, ‘সূরা বাকারা পড়। উহা গ্রহণে বরকত ও বর্জনে দুঃখ দেখা দেয় এবং কোন যাদুকর উহার উপর প্রভাব বিস্তার করিতে পারে না।’

ইমাম মুসলিমও ‘সালাত’ অধ্যায়ে মুআবিয়া ইব্‌ন সালামের অনুরূপ একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেন। মুআবিয়া ইবন সালাম তাহার ভাই যায়দ ইব্‌ সালাম হইতে, তিনি তাহার দাদা আবূ সালাম হইতে, তিনি আবূ উমামা সদী ইব্‌ন আজলান আল বাহেলী হইতে অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করেন।

উক্ত হাদীসে উল্লেখিত ‘আয যহরাওয়ান’ অর্থ আলোকপিণ্ডদ্বয়। ‘আল গায়ায়াত’ অর্থ উপরে ছায়াদায়ক শামিয়ানা। ‘আল-ফুরক’ অর্থ খণ্ড বস্তু। ‘আস্ সাওয়াফ’ অর্থ ঝাঁক বাঁধা। ‘আল্‌ বুতলাত’ অর্থ যাদু। ‘লা তাস্তাতী’হা’ অর্থ উহা আয়ত্ত করিতে পারে না। কেহ বলেন, উহার পাঠকের উপর প্রভাব বিস্তার করিতে পারে না। আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত।

আন্ নাওয়াস ইবন সিম্‌আনের হাদীসও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। ইমাম আহমদ বলেন-আমাকে ইয়াযীদ, তাহাকে ওয়ালিদ ইব্‌ন মুসলিম, তাঁহাকে মুহাম্মদ ইব্‌ন মুহাজির, তাঁহাকে ওয়ালিদ ইবন আবদুর রহমান আল জারশী ও তাঁহাকে জুবায়র ইবন নফীর বর্ণনা করেন যে, আমাকে আন্ নাওয়াস্ ইব্‌ন সিমআন বলেনঃ

‘আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-কে বলিতে শুনিয়াছি, কিয়ামতের দিন কুরআন ও উহার বাআমল পাঠকদের একত্রিত করা হইবে। সূরা বাকারা ও সূরা আলে ইমরান তাহাদের অগ্রভাগে থাকিবে। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তখন এমন তিনটি উদাহরণ পেশ করিলেন যাহা আমি ভুলি নাই। তিনি বলিলেন-সূরা দুইটি দুই খণ্ড মেঘ, শামিয়ানা কিংবা দুই ঝাঁক পাখীর মত পাঠকদের মাথার উপর থাকিয়া ছায়া দান করিবে।’

ইমাম মুসলিম উক্ত বর্ণনাটি ইসহাক ইব্‌ন মনসূর হইতে, তিনি ইয়াযীদ ইব্‌ন আব্দে রব্বিহি হইতে উদ্ধৃত করেন। ইমাম তিরমিযী উহা আল ওয়ালিদ ইব্‌ন আবদুর রহমান আল জারশী হইতে উদ্ধৃত করিয়া বলেন-হাদীসটি ‘হাসান গরীব’ শ্রেণীভুক্ত।

আবূ উবায়দ বলেন-আমাকে হাজ্জাজ, তাহাকে হাম্মাদ ইব্‌ন সালামা, তাহাকে আবদুল মালিক ইবন উমায়র বর্ণনা করেন যে, আমাকে যতদূর মনে পড়ে হাম্মাদ আবূ মুনীর হইতে ও তিনি তাহার চাচা হইতে এই বর্ণনা শুনানঃ

‘এক ব্যক্তি সূরা বাকারা ও সূরা আলে ইমরান পড়িল। যখন সে নামায শেষ করিল, কা’ব তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কি সূরা বাকারা ও সূরা আলে ইমরান পড়িয়াছ ? সে বলিল-হ্যাঁ। কা’ব বলিলেন, যাঁহার মুঠায় আমার প্রাণ তাঁহার শপথ। নিশ্চয় উহার ভিতর আল্লাহ্র এমন নাম রহিয়াছে যেই নামে কোন কিছু প্রার্থনা করিলেই কবূল হয়। লোকটি বলিল-উহা কোন্ নাম আমাকে বলুন। তিনি বলিলেন, আল্লাহর কসম ! আমি তোমাকে তাহা বলিব না। কারণ, আমার ভয় হয় তুমি তাহা দ্বারা এমন কিছু প্রার্থনা করিবে যাহা তোমার, নয় তো- আমার ধ্বংসের কারণ হইয়া দাঁড়াইবে। আমাকে আবদুল্লাহ ইব্‌ন সালেহ, তাঁহাকে মুআবিয়া ইব্‌ন সালেহ, তাঁহাকে সালেহ ইবন আমের বর্ণনা করেন যে, তিনি আবূ উমামাকে বলিতে শুনিয়াছেন-‘তোমাদের এক ভাই স্বপ্নে দেখিল, মানুষ দল বাঁধিয়া পাহাড়ের উপত্যকায় বিচরণ করিতেছে। পাহাড়ের শীর্ষদেশে দুইটি সবুজ বৃক্ষ হইতে গায়েবী আওয়াজ আসিতেছে, “তোমাদের মধ্যে সূরা বাকারার পাঠক আছে কি ? তোমাদের ভিতরে সূরা আলে ইমরানের পাঠক আছে কি ?” বর্ণনাকারী বলেন, ‘এক ব্যক্তি বলিল, হ্যাঁ। অমনি বৃক্ষ দুইটি তাহার দিকে ফলসহ ঝুঁকিয়া পড়িল। তখন সে উহার সহিত ঝুলিয়া পড়িল। তাহাকে লইয়া গাছ দুইটি আবার পাহাড়ের চূড়ায় উঠিয়া গেল।’

আমাকে আব্দুল্লাহ ইব্‌ন সালেহ মুআবিয়া ইব্‌ন সালেহ হইতে ও তিনি আবূ ইমরান হইতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, আমি উম্মে দারদাকে বলিতে শুনিয়াছিঃ

এক ব্যক্তি নিয়মিত কুরআন পাঠ করিত। একবার সে তাহার প্রতিবেশির উপর চড়াও হইয়া তাহাকে হত্যা করিল। ফলে সেও পাকড়াও হইল এবং নিহত হইল। সেই হইতে প্রতিদিন তাহার নিকট হইতে একটি করিয়া সূরা বিচ্ছিন্ন হইতে লাগিল। শেষ পর্যায়ে অবশিষ্ট রহিল আল-বাকারা ও আলে ইমরান। এক সপ্তাহ পর আলে ইমরান বিদায় নিল। আল-বাকারা পরবর্তী সপ্তাহও অপেক্ষা করিল। তখন উহাকে বলা হইলঃ

ما ببدل القول لدى وما أنا بظلام للعبيد ‘আমার বাণীর কোন পরিবর্তন নাই। আমি কোন বান্দার উপর জুলুম করি না।’ অতঃপর সূরা বাকারাও বিশাল মেঘখণ্ডে রূপান্তরিত হইয়া বিদায় নিল।’

আবূ উবায়দ বলেন-‘আমার মনে হয়, সূরা দুইটি তাহার সঙ্গে কবরে থাকিয়া তাহাকে বিপদাপদ হইতে রক্ষা করিতেছিল। উহারা তাহারা শেষ প্রহরী হিসাবে কাজ করিতেছিল।’

তিনি আরও বলেন-আমাকে আবূ মাসহার আল্ গাচ্ছানী সাঈদ ইব্‌ন আব্দুল আযীয আত্তামূখী হইতে বর্ণনা করেন যে, ইয়াযীদ ইবনুল আসওয়াদ আল জারশী বলিতেন-‘যে ব্যক্তি দিবাভাগে সূরা বাকারা ও সূরা আলে ইমরান পাঠ করে সে নিফাক হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাঁচিয়া থাকে এবং যে ব্যক্তি সূরা দুইটি রাত্রে পাঠ করে সে ফজর পর্যন্ত নিফাক হইতে বাঁচিয়া থাকে।’ বর্ণনাকারী বলেন-ইয়াযীদ প্রতিদিন ও প্রতিরাতে কুরআনের অন্যান্য অংশ ছাড়াও সূরা দুইটি পাঠ করিতেন।

আমাকে ইয়াযীদ ওরাকা ইব্‌ন আয়াস হইতে, তিনি সাঈদ ইব্‌ন জুবায়র হইতে বর্ণনা করেন যে, সাঈদ বলিয়াছেন, উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বলেন-‘যে ব্যক্তি আল-বাকারা ও আলে ইমরান রাত্রি বেলায় পাঠ করে, সে অনুগতদের তালিকাভুক্ত হয়।’

হাদীসটি ‘মাকতু’ (বিচ্ছিন্ন সূত্রের)। অবশ্য সহীহদ্বয়ে এই প্রমাণ মিলে যে, রাসূল (সাঃ) একই রাক’আতে সূরাদ্বয় (রাতের নামাযে) পাঠ করিতেন।

 

দীর্ঘ সাত সূরার ফযীলত সম্পর্কিত বর্ণনাসমূহ

আবূ উবায়দ বলেন-আমার নিকট হিশাম ইব্‌ন ইসমাঈল আদ্‌ দামেশকী, তাঁহার নিকট মুহাম্মদ ইব্‌ন শুআয়ব, তাঁহার নিকট সাঈদ ইব্‌ন বাশীর, তাঁহার নিকট কাতাদাহ, তাঁহার নিকট আবূল মালীহ, তাঁহার নিকট ওয়াইলা ইবনুল আসকা’ নবী করীম (সাঃ) হইতে নিম্নোক্ত বর্ণনা উদ্ধৃত করেনঃ

‘নবী করীম (সাঃ) বলেন-আমাকে তাওরাতের স্থলে সাতটি দীর্ঘ সূরা ও ইঞ্জীলের স্থলে দু’শ আয়াত বিশিষ্ট সূরা ও যবূরের স্থলে বারংবার পঠনীয় সূরাসমূহ প্রদান করা হইয়াছে এবং দীর্ঘ সূরাগুলি দিয়া আমাকে মর্যাদায় ভূষিত করা হইয়াছে।

হাদীসটি ‘গরীব’ ও ইহার অন্যতম রাবী সাঈদ ইব্‌ন বাশীর বিতর্কিত। অবশ্য আবূ উবায়দ উহা আব্দুল্লাহ ইব্‌ন সালেহ হইতে, তিনি লায়ছ হইতে, তিনি সাঈদ ইব্‌ন আবূ হিলাল হইতে বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সাঃ) অনুরূপ কথা বলিয়াছেন। আল্লাহ্ই ভাল জানেন।

অতঃপর তিনি (আবূ উবায়দ) বলেন-আমাকে ইসমাঈল ইব্‌ন জা’ফর, তাহাকে আমর ইবন ‘আবূ আমর (মতলব ইব্‌ন আব্দুল্লাহ ইব্‌ন হান্তাবের ভৃত্য), তাহাকে হাবীব ইব্‌ন হিন্দ আল-আসলামী, তাহাকে উরওয়া ও তাহাকে হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন-‘যে ব্যক্তি দীর্ঘ সাত সূরা পড়িল সে হৃষ্টচিত্ত হইল।’ এই হাদীসটিও ‘গরীব’ 1 হাবীব ইব্‌ন হিন্দ আসলামী হইলেন হাবীব ইব্‌ন হিন্দ ইব্‌ন আসমা ইব্‌ন হিন্দাব ইব্‌ন হারিছাল আসলামী। তাহার নিকট হইতে আমর ইব্‌ন আমর ও আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আবূ বুকরাতা হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। আবূ হাতিম আররাযী তাঁহার উল্লেখ করিয়াছেন এবং কোন ত্রুটির কথা বলেন নাই। আল্লাহ্ই সর্বাধিক জ্ঞাত।

ইমাম আহমদও উক্ত হাদীস সুলায়মান ইব্‌ন দাউদ ও হুসায়ন হইতে এবং তাহারা উভয়ে ইসমাঈল ইব্‌ন জা’ফর হইতে বর্ণনা করেন। ইহা ছাড়াও তিনি আবূ সাঈদ হইতে, তিনি সুলায়মান ইব্‌ন বিলাল হইতে, তিনি হাবীব ইব্‌ন হিন্দ হইতে, তিনি উরওয়া হইতে ও তিনি হযরত আয়েশা (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ

রাসূল (সাঃ) বলিয়াছেন-‘যে ব্যক্তি কুরআনের প্রথম সাত সূরা ধারণ করিল, সে পরিতুষ্ট হইল ৷’

ইমাম আহমদ বলেন-আমাকে হুসায়ন, তাহাকে ইব্‌ন আবূ যিনাদ, তাহাকে আল-আরাজ ও তাহাকে হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) রাসূল (সাঃ) হইতে উক্ত বর্ণনা শুনাইয়াছেন।

আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আহমদ বলেন-কিতাবে এইভাবে আছে। অথচ আমি দেখিতেছি ‘তিনি তাহার পিতা হইতে ও তিনি আল আ’রাজ হইতে’। আমার পিতা কি পূর্ব সনদে বেখেয়াল হইলেন, না উহাই ঠিক তাহা বলিতে পারি না। হাদীসটি ‘মুরসাল’।

ইমাম তিরমিযী বর্ণনা করিয়াছেন, নবী করীম (সাঃ) একটি ক্ষুদ্র অভিযান পাঠাইতে গিয়া সূরা বাকারা মুখস্থ করার কারণে এক কিশোরকে উক্ত অভিযানের নেতৃত্ব প্রদান করেন। তিনি বলিলেন—’যাও, তুমিই দলের নেতা।’ ইমাম তিরমিযী হাদীসটিকে সহীহ বলিয়াছেন।

আবূ উবায়দ বলেন-হাশীম আমার কাছে বর্ণনা করেন যে, আমাকে আবূ বাশার সাঈদ ইবন জুবায়র হইতে এই খবর পৌছাইয়াছেন যে, 

وَلَقَدْ آتَيْنَاكَ سَبْعًا مِنَ الْمَثَانِي

আয়াতের বারংবার পঠিতব্য সাত সূরা হইল সূরা বাকারা, সূরা আলে ইমরান, সূরা নিসা, সূরা মায়িদা, সূরা আন’আম, সূরা আ’রাফ ও সূরা ইউনুস।

মুজাহিদ বলেন, উহা দীর্ঘ সাত সূরা। মাকহুল, আতিয়া ইব্‌ন কয়স, আবূ মুহাম্মদ আল ফারেসী, শাদ্দাদ ইব্‌ন আওস, ইয়াহিয়া ইবনুল হারিস আয্ যিমারী প্রমুখও উক্ত আয়াতের অনুরূপ ব্যাখ্যা প্রদান করেন। উহার সংখ্যাগত বিন্যাসে সূরা ইউনুস সপ্তম সূরা।

 

সূরা বাকারা সম্পর্কিত জরুরী আলোনা

আল-বাকারা সর্বসম্মতভাবে মাদানী সূরা। ইহা প্রথম দিকে অবতীর্ণ সূরা সমূহের অন্যতম। অবশ্য-

وادقوا يوما تَرجَعون فيه الى اللّه আয়াতটি শেষদিকে অবতীর্ণ আয়াত বলিয়া মনে করা হয়। তেমনি সুদ সম্পর্কিত আয়াতগুলিও শেষ পর্যায়ের আয়াত।

খালিদ ইব্‌ন মা’দান বলেন-আল-বাকারা কুরআনের ছাউনি। একদল বিশেষজ্ঞ বলেন, সূরা রাকারায় এক হাজার সংবাদ, এক হাজার নির্দেশ ও এক হাজার নিষেধাজ্ঞা রহিয়াছে। উহার পরিসংখ্যান বিশারদরা বলেন-উহাতে দুইশত সাতাশিটি আয়াত, ছয় হাজার দুইশত একুশটি শব্দ ও পঁচিশ হাজার পাঁচ শত অক্ষর রহিয়াছে। আল্লাহ্ই ভাল জানেন।

হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ‘আতার বরাত দিয়া ইন জুরায়জ বর্ণনা করেন-সূরা বাকারা মদীনায় অবতীর্ণ হইয়াছে।

আব্দুল্লাহ ইব্‌ন জুবায়র হইতে যথাক্রমে মুজাহিদ ও খাসীফ বর্ণনা করেন, তিনি বলিয়াছেন-সূরা বাকারা মদীনায় অবতীর্ণ হইয়াছে।

ওয়াকিদী বলেন, আমাকে যিহাক উসমান ইব্‌ন আবুয্ যিনাদ হইতে, তিনি খারিজা ইন যায়দ ইব্‌ন ছাবিত হইতে ও তিনি তাহার পিতা যায়দ ইব্‌ন ছাবিত হইতে বর্ণনা করেনঃ সূরা বাকারা মদীনায় অবতীর্ণ হইয়াছে।

এইভাবে বহু আলিম, ইমাম ও মুফাস্সির সূরা বাকারাকে মাদানী বলিয়াছেন। এই ব্যাপারে কোন মতভেদ নাই।

ইব্‌ন মারদুবিয়্যা বলেন-আমাকে মুহাম্মদ ইব্‌ন মুআম্মার, তাহাকে আল হাসান ইব্‌ন আলী ইবনুল ওয়ালিদ আল ফারেসী ও তাঁহাকে খলফ ইব্‌ন হিশাম এবং অন্য সনদে আমাকে ঈসা ইব্‌ন মায়মূন, তাহাকে মূসা ইব্‌ন আনাস ইবন মালিক তাহার পিতা হইতে বর্ণনা করেনঃ

নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন-‘সূরা বাকারা, সূরা আলে ইমরান, সূরা নিসা ইত্যাকারের কুরআনের সূরাগুলির নামকরণ করিও না। বরং ‘গাভী সম্পর্কে যেই সূরায় আলোচিত হইয়াছে. কিংবা ‘ইমরান গোত্র সম্পর্কে যেই সূরায় আলোচিত হইয়াছে’ এইভাবে কুরআনের সূরাগুলির উল্লেখ কর।’

এই হাদীসটি ‘গরীব’ শ্রেণীভুক্ত। ইহা রাসূল (সাঃ)-এর বক্তব্য হইতে পারে না। কারণ, ঈসা ইব্‌ন মায়মূন হইল আবূ সালামাহ আল খাওয়াস। তাহার রিওয়ায়েত যঈফ এবং উহা কোন দলীল হইতে পারে না। পক্ষান্তরে সহীহদ্বয়ে ইব্‌ন মাসউদ (রাঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছেঃ বায়তুল্লাহ ডানে এবং মীনা বামে রাখিয়া ‘বাতনে ওয়াদী’ হইতে রাসূল (সাঃ) যখন শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করিতেছিলেন, তখন তাঁহার উপর ‘সূরা বাকারা’ অবতীর্ণ হয়।’ সহীহদ্বয়ে হাদীসটি উদ্ধৃত হইয়াছে।

ইব্‌ন মারদুবিয়্যাহ শু’বা হইতে, তিনি আকীল ইবন তালহা হইতে ও তিনি উতবা ইবন মারছাদ হইতে বর্ণনা করেনঃ একদা নবী করীম (সাঃ) সাহাবাদের বিলম্ব দেখিয়া ডাক দিলেন, ‘হে সূরা বাকারার সহচরবৃন্দ।’

আমার ধারণা হইতেছে, ইহা হুনায়নের যুদ্ধের ঘটনা। সেই দিন যখন ঘোরতর যুদ্ধে মুসলমানরা দিশাহারা ও বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িল, তখন তাহাদের নব উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য হযরত আব্বাসকে তিনি নির্দেশ দিলেন। তখন তিনি উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানাইলেন-“ইয়া আসহাবু শাজারা !’ অর্থাৎ ‘হে বাইআতে রিযওয়ান গ্রহণকারীগণ।’ অন্য বর্ণনায় বলা হইয়াছে ‘ইয়া আসহাবা সূরা আল-বাকারা।’ এই আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানগণ দৃঢ়তা ফিরিয়া পাইল এবং চতুর্দিক হইতে ছুটিয়া আসিল।

ইয়ামামার যুদ্ধেও এইরূপ ঘটিয়াছিল। মুসায়লামার বনূ হানীফা গোত্রের মরণপণ হামলায় মুসলমান সৈন্যরা পলায়নোন্মুখ হইলে আনসার ও মুহাজিরগণ পরস্পরকে এইরূপ সম্বোধন করিলেন-‘হে সূরা বাকারার সঙ্গীবৃন্দ।’ ইহার ফলে তাহারা নতুন প্রেরণায় উজ্জীবিত হইয়া যুদ্ধে জয়লাভ করিলেন। আল্লাহ্ পাক সকল সাহাবার উপরই সন্তুষ্ট রহিয়াছেন।

error: Content is protected !!