৭ আয়াত, ১ রুকূ, মক্কী
।। দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে ।।
সূরা ফাতিহার নাম ফাতিহা বা ফাতিহাতুল কিতাব এইজন্য রাখা হইয়াছে যে, উহা আল্লাহর কিতাব কুরআন মজীদের শুরুতে অবস্থিত এবং উহার দ্বারা সকল নামাযে কিরাআত আরম্ভ করা হয় فاتحة الكتاب (ফাতিহাতুল কিতাব) অর্থ গ্রন্থের অর্থ গ্রন্থের প্রারম্ভিকা।
উহার আরেক নাম উম্মুল কিতাব। ام الكتاب (উম্মুল কিতাব) অর্থ গ্রন্থ-জননী বা গ্রন্থের নির্যাস। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, অধিকাংশ আহলে ইলম উহাকে উক্ত নামে অভিহিত করিয়াছেন। কিন্তু হযরত হাসান ও ইবন সীরীন এই নাম পছন্দ করেন নাই। তাঁহারা বলেন, উম্মুল কিতাব হইতেছে লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত ফলক। হাসান বলেন, সুস্পষ্ট অর্থবোধক আয়াত (أيات محكمات) হইতেছে উম্মুল কিতাব। এইসব কারণেই তাঁহারা ‘উম্মুল কুরআন’ নামটি পছন্দ করেন নাই।
ইমাম তিরমিযী কর্তৃক হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণিত হইয়াছে— নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘আলহামদু লিল্লাহে রাব্বিল ‘আলামীন’ হইতেছে ‘উম্মুল কুরআন’ ‘উম্মুল কিতাব’ ‘আস্ সাবউল মাছানী’ ও ‘আল কুরআনুল আযীম’।
উক্ত হাদীসটি সহীহ। ইমাম তিরমিযী উহার সনদকে সহীহ বলিয়াছেন।
সূরাটির অপর নাম ‘আলহামদু’। উহার আরেক নাম ‘সালাত’। কারণ, নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, আল্লাহ্ তা’আলা বলেন, ‘সালাত’-কে আমার ও আমার বান্দাদের মধ্যে আধাআধি করিয়া ভাগ করিয়া লইয়াছি।’ বান্দা যখন বলো, الحمد لله رب الْعالمين তখন আল্লাহ্ বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা বর্ণনা করিয়াছে। (হাদীসে কুদসীর অংশ বিশেষ।)
হাদীসে উহার ‘সালাত’ নামে অভিহিত হইবার কারণ এই যে, উহা সালাতের একটি রুকন।(১)
সূরাটির অপর নাম الشهماء (আশশিফা ) অর্থাৎ আরোগ্যদাতা, আরোগ্যর উপায় বা আরোগ্য। কারণ, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলিয়াছেন, ফাতিহাতুল কিতাব সর্বপ্রকার বিষক্রিয়ার শিফা। উক্ত হাদীস হযরত আবূ সাঈদ (রাঃ) হইতে ইমাম দারামী কর্তৃক বর্ণিত হইয়াছে।
উহার আর এক নাম الرقية (আর রুকিয়্যাহ) অর্থাৎ যাহা পড়িয়া ফুঁক দেওয়া হয় ৷ কারণ, একদা হযরত আবূ সাঈদ (রাঃ) জনৈক সৰ্পদষ্ট ব্যক্তিকে সূরা ফাতিহা দ্বারা ঝাড়িয়া বিষমুক্ত করিলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কিরূপে জানিলে যে, উহা রুকিয়্যাহ? উক্ত হাদীসের সনদ সহীহ্ ।
শা’বী হযরত ইবন আব্বাস (রাঃ) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন, হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) উহাকে اساس القران (আসাসুল কুরআন) নাম দিয়াছেন, যাহার অর্থ কুরআনের ভিত্তি বা উহার মৌলিক অংশ। তেমনি তিনি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীমকে اساس الفاتحه (আসাসুল ফাতিহা) নাম দিয়াছেন।
সুফিয়ান ইবন উয়াইনিয়া সূরা ফাতিহাকে الواقية (আল-ওয়াকিয়া) নাম দিয়াছেন, যাহার অর্থ হইতেছে রক্ষক।
ইয়াহিয়া ইব্ন আবু কাছীর নাম দিয়াছেন الكافية (আল-কাফিয়া)। অর্থাৎ প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট। কারণ, উহা কুরআন মজীদের নির্যাস বিধায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। ফলে সমগ্র কুরআনের প্রয়োজন উহা পূরণ করিতে পারে। পক্ষান্তরে উহাকে বাদ দিয়া কুরআনের অবশিষ্টাংশ উহার প্রয়োজন মিটাতেই পারে না। যেমন, বিচ্ছিন্ন সনদের কোন কোন হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে, উম্মুল কুরআন অবশিষ্ট কুরআনের পরিবর্তে কাজ করিতে পারে। পক্ষান্তরে উহা ভিন্ন অন্যান্য অংশ উহার পরিবর্তে কাজ করিতে পারে না।
উহার এক নাম ‘আস্সালাত’ অর্থাৎ সালাতে অবশ্য পঠনীয় সূরা। উহার অপর নাম ‘আল্ কানস্’ (খনি, আকর)। আল্লামা যামাখশারী তাঁহার ‘আল কাশ্শাফ’ নামক তাফসীর গ্রন্থে উক্ত নাম দুইটি ব্যবহার করিয়াছেন।
হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ), কাতাদাহ ও আবুল আলীয়ার মতে সূরা ফাতিহা মক্কী সূরা। পক্ষান্তরে হযরত আবূ হুরায়রা (রা), আতা ইব্ন ইয়াসার ও যুহরীর মতে উহা মাদানী সূরা। কথিত আছে, উহা দুইবার নাযিল হইয়াছে। একবার মক্কা শরীফে ও একবার মদীনা শরীফে এই ব্যাপারে প্রথমোক্ত অভিমতই সঠিক ও গ্রহণযোগ্য। কারণ, সূরা ফাতিহা সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ
وَلَقَدْ اتَيْناكَ سَبْعًا من الْمَخْانِئُ وَالْقُرَان الْعَظي
“নিশ্চয় আমি তোমাকে বারংবার পঠনীয় সাতটি আয়াত ও মহা মর্যাদাশীল কুরআন প্রদান করিয়াছি।’(১) আল্লাহ্ই সৰ্বজ্ঞ।
ইমাম কুরতুবী বলেন, আবূ লায়ছ সমরকন্দী বর্ণনা করেন যে, সূরা ফাতিহার একার্ধ মক্কায় ও অপরার্ধ মদীনায় অবতীর্ণ হইয়াছে।
উক্ত বর্ণনা অযৌক্তিক, তাই অগ্রহণযোগ্য। সূরা ফাতিহার সাত আয়াত সম্পর্কে উম্মতের ইজমা রহিয়াছে। এই ইজমার বিরুদ্ধে মাত্র দুইজনের দুইটি মত দেখা যায়। এক, আমর ইব্ন
উবায়দ বলেন, উহাতে আটটি আয়াত রহিয়াছে। দুই. হুসায়ন জা’ফী বলেন, উহাতে ছয়টি আয়াত রহিয়াছে।
কূফা নগরীর অধিকাংশ কিরাআত বিশেষজ্ঞ, একদল সাহাবা ও তাবেঈ এবং পরবর্তী যুগের একদল বিশেষজ্ঞ বলেন, بسم الله الرحمن الرحيم সূরা ফাতিহার একটি পূর্ণ আয়াত।
পক্ষান্তরে মদীনার কিরাআত বিশেষজ্ঞ ও ফকীহগণ বলেন, উহা সূরা ফাতিহার পূর্বে বা প্রথমাংশে অবস্থিত বিধায় আদৌ কোন আয়াত নহে।
কেহ কেহ বলেন, উহা পূর্ণ আয়াত নহে, আয়াতের অংশ। এতদসম্পর্কিত আলোচনা আল্লাহ্ চাহেন তো যথাস্থানে সবিস্তারে আলোচিত হইবে। পরম করুণাময় আল্লাহ্ তা’আলার উপরে সকল কিছুই নির্ভরশীল।
সূরা ফাতিহার শব্দ সংখ্যা পঁচিশ এবং উহাতে একশত তেরটি অক্ষর রহিয়াছে। ইমাম বুখারী (রঃ) তাফসীর সংক্রান্ত অধ্যায়ে প্রথম দিকে বলিয়াছেনঃ
“সূরা ফাতিহাকে ام الكتب (উম্মুল কুতুব) নামে এই জন্য আখ্যায়িত করা হয় যে, উহা কিতাবসমূহের (কুরআনের সূরাসমূহের) প্রারম্ভে লিখিত এবং নামাযসমূহের প্রারম্ভে পঠিত হয়।”
কেহ কেহ বলেন, কোন ব্যক্তি বা বস্তু একাধিক ব্যক্তি বা বস্তুর একত্রকারী বা পরিচালক হইলে আরবী ভাষায় উক্ত বস্তু বা ব্যক্তিকে ام বলা হয়। এই কারণে মগজ বেষ্টনকারী মাথার খুলীকে বলা হয় ام الرأس (উম্মুর রা’স)। যে পতাকার নীচে সেনাবাহিনী সমবেত হয় উহাকে ام (উম্মুন) বলা হয়। ইন জারীর কবি যুর-রিম্মার নিম্নোক্ত পংক্তি স্বীয় বক্তব্যের সমর্থনে উল্লেখ করেনঃ
على راسه ام لنا نقتدى بها – جماع امور لیس نعصى لها امرا
“উহার (বর্শার) মাথার উপর আমাদের একটি পতাকা রহিয়াছে যাহাকে আমরা নেতা মানিয়া চলি। উহা আমাদের কার্যাবলী সুসংবদ্ধ ও সুশৃংখল করিয়া রাখে। আমরা উহার কোন নির্দেশ অমান্য করি না।’
ইন জারীর আরও বলেন, পবিত্র মক্কাকে উম্মুল কুরা (ام القرى) বলে। কারণ উহা সকল জনপদের সেরা জনপদ এবং অন্যান্য জনপদের জনমণ্ডলীকে একত্রে সমবেত করে। কেহ কেহ উক্ত নামকরণের কারণে এই বলেন যে, পৃথিবীর অন্যান্য জনপদ উক্ত জনপদ হইতেই বিস্তার লাভ করিয়াছে।
সূরা ফাতিহার নাম ফাতিহা (প্রারম্ভিকা) হইবার কারণ এই যে, উহা দ্বারাই কিরাআত আরম্ভ হয় এবং সাহাবাগণ প্রথম লিপিবদ্ধ কুরআন মজীদ উহা দ্বারাই আরম্ভ করিয়াছেন। উহার এক নাম السبع المثانى (আস্ সাবউল মাছানী) অর্থাৎ বারংবার পঠনীয় সাতটি আয়াত। উহা উক্ত নামকরণের কারণ উল্লেখ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞগণ বলিয়াছেন যে, উহা নামাযের বারংবার পঠিত হয় অর্থাৎ প্রতি রাক’আতেই উহা পাঠ করা হয়। অবশ্য المشانى শব্দের উপরোক্ত অর্থ ছাড়াও অন্য অর্থ রহিয়াছে। আল্লাহ্ চাহেন তো যথাস্থানে তাহা আলোচনা করা হইবে।
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে সাঈদ আল মাকবারী, ইব্ন আবূ যিব, হাশিম ইব্ন হুশায়ম, ইয়াযীদ ইব্ন হারূন ও ইমাম আহমদ (রঃ) বর্ণনা করেনঃ ‘নবী করীম (সাঃ) সূরা ফাতিহা সম্বন্ধে বলিয়াছেন যে, উহার নাম ‘উম্মুল কুরআন’ ‘আস্ সাবউল মাছানী’ ও ‘আল-কুরআনুল আযীম।’
ইমাম আহমদ উক্ত হাদীসটি উপরোল্লিখিত রাবী ইব্ন আবূ যিব হইতে উপরোক্ত সনদে এবং ইব্ন আমরের মাধ্যমে ভিন্ন সনদে বর্ণনা করিয়াছেন।
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে সাঈদ আল মাকবারী, ইব্ন আবূ যিব, ইব্ন ওয়াহাব, ইউনুস ইব্ন আব্দুল আ’লা ও ইমাম আবূ জা’ফর মুহাম্মদ ইব্ন জারীর তাবারী বর্ণনা করিয়াছেনঃ
নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন যে, সূরা ফাতিহার নাম ‘উম্মুল কুরআন’ ‘ফাতিহাতুল কিতাব’ ও ‘আস্-সাবউল মাছানী।’
হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে সাঈদ আল মাকবারী, নূহ ইব্ন আবূ বিলাল, আব্দুল হামীদ ইব্ন জা‘ফর, আল মুআফী ইব্ন ইমরান, ইসহাক ইব্ন আব্দুল ওয়াহিদ আল মুসলী, মুহাম্মদ ইব্ন গালিব ইব্ন হারিছ ও আহমদ ইবন মুহাম্মদ ইবন যিয়াদের বর্ণনা মতে হাফিজ আবূ বকর আহমদ ইবন মূসা ইব্ন মারদুবিয়্যাহ তাঁহার তাফসীর গ্রন্থে বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন, ‘আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন’ সাতটি আয়াতের সমষ্টি। উক্ত সাত আয়াতের একটি হইল ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।’ উহার নাম ‘আসাবউল মাছানী, উম্মুল কুরআন ও আল্ কুরআনুল আযীম।’
ইমাম দারা কুতনীও উপরোক্ত হাদীসটি স্বয়ং নবী করীম (সাঃ)-এর বাণী (حديثمر فوع) হিসাবে হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে অনুরূপভাবে বর্ণনা করিয়াছেন। উপরোক্ত হাদীসের সনদের সকল বর্ণনাকারীই নির্ভরযোগ্য।
ইমাম বায়হাকী হযরত আলী (কঃ), হযরত ইব্ন আব্বাস (রাঃ) ও হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণনা করেনঃ তাঁহারা وَلَقَد أتَيْنَاكَ سَيعًا من الْمَقَانى আয়াতের অন্তর্গত سبعًا من المثانى -এর ব্যাখ্যায় বলিয়াছেন যে, بسم اللّه الرحمن الرحيم সূরা ফাতিহার সাত আয়াতের এক আয়াত।’
উক্ত হাদীসের পূর্ণ বিবরণ بسم اللّه الرحمن الرحيم -এর ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বিবৃত হইবে। ইবরাহীম হইতে আ’মাশ বর্ণনা করেনঃ ‘একদা হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ) জিজ্ঞাসিত হইলেন- কুরআন মজীদের স্বীয় পাণ্ডুলিপিতে আপনি কেন সূরা ফাতিহা লিখেন নাই? তিনি জবাব দিলেন— যদি লিখিতাম তাহা হইলে প্রত্যেক সূরার শুরুতেই লিখিতাম।’
আবূ বকর ইব্ন দাউদ হযরত ইব্ন মাসউদের উপরোক্ত জবাবের ব্যাখ্যায় লিখিয়াছেন- অর্থাৎ যে স্থানে উহাকে নামাযে তিলাওয়াত করা হয়। (উল্লেখ্য, সাহাবাগণ নামাযে পঠনীয় অন্যান্য সূরাও প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত পড়িতেন। তাহার আগে অবশ্যই সূরা ফাতিহা পড়িতেন। অতএব প্রত্যেক সূরার পূর্ববর্তী স্থানই হইতেছে সূরা সালাতের তিলাওয়াতের বা লিপিবদ্ধ করার স্থান।)
হযরত ইব্ন মাসউদ (রাঃ) আরও বলেন, যেহেতু মুসলমানদের উহা কণ্ঠস্থ রহিয়াছে, তাই উহা লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন মনে করি নাই।
কেহ কেহ বলেন, ‘সূরা ফাতিহা’ সর্বপ্রথম নাযিল হইয়াছে। ইমাম বায়হাকী কর্তৃক সংকলিত ‘দালায়েলুন নবৃওত’ গ্রন্থে বর্ণিত হাদীসে অনুরূপ তথ্য বিবৃত হইয়াছে। ইমাম বাকিলানীও এতদসম্পর্কিত তিনটি অভিমতের একটি অভিমত হিসাবে উহা উল্লেখ করিয়াছেন।
কেহ কেহ বলেন, ‘সূরা মুদ্দাছির’ প্রথম অবতীর্ণ হইয়াছে। হযরত জাবির (রাঃ) হইতে বর্ণিত একটি সহীহ হাদীসে উক্ত তথ্য পাওয়া যায়।
অন্যদের মতে ‘সূরা আলাক’ প্রথম নাযিল হইয়াছে। শেষোক্ত অভিমতই সহীহ ও সঠিক। যথাস্থানে উহা প্রমাণসহ বিশদভাবে আলোচিত হইবে। আল্লাহ্ পাকের সাহায্য কামনা করিতেছি।