আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

أو لَمْ يَكْفِهِمْ آنا أَنْرَلْنَا عُلَيْكَ الكتّاب يُثْلى عَلَيْهِمْ (তাহাদের জন্যে কি ইহাই যথেষ্ট নহে যে, আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করিয়াছি- যাহা তাহাদের সম্মুখে পঠিত হইয়া থাকে।)

হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ সালামাহ ইব্‌ন আবদুর রহমান ইন শিহাব, উকায়েল, লায়ছ, ইয়াহিয়া ইব্‌ন বুকায়র ও ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘কোন নবী সুরের সহিত আল্লাহ্র কিতাব তিলাওয়াত করিলে আল্লাহ্ তা’আলা যেরূপ সন্তুষ্টি সহকারে উহা শুনিয়া থাকেন, অন্য কিছুই তিনি সেইরূপ সন্তুষ্টি সহকারে শুনেন না ।’ উক্ত হাদীসের জনৈক রাবী বলিয়াছেন যে, উক্ত হাদীসের يتغنى শব্দের তাৎপর্য হইতেছ ‘কুরআন মজীদ উচ্চৈঃস্বরে সুরেলা কণ্ঠে তিলাওয়াত করা।’ ইমাম বুখারী উহা উপরোক্ত রাবী ইব্‌ন শিহাব যুহরী হইতে উপরোক্ত ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং যুহরী হইতে ধারাবাহিকভাবে সুফিয়ান ইব্‌ন উয়াইনাহ ও আলী ইব্‌ন আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন মাদীনীর অধস্তন সনদাংশেও বর্ণনা করিয়াছেন। সুফিয়ান বলেন- উক্ত হাদীসে যে يتغنى بالقرآن (সে সুরের সহিত কুরআন তিলাওয়াত করে) শব্দগুচ্ছটি উল্লেখিত হইয়াছে, এইস্থলে উহার অর্থ হইবে ‘সে কুরআন মজীদে তৃপ্ত থাকে। ‘

ইমাম মুসলিম এবং ইমাম নাসাঈ উপরোক্ত হাদীস উপরোক্ত রাবী সুফিয়ান ইব্‌ন উয়াইনাহ হইতে উপরোক্ত অভিন্ন ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং অন্যরূপ বিভিন্ন অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন। উক্ত হাদীসের তাৎপর্য এই যে, কোন নবী শব্দ করিয়া সুরেলা কণ্ঠে যদি আল্লাহর কালাম তিলাওয়াত করেন, আল্লাহ্ তা’আলা সেই তিলাওয়াত করাকে যেরূপ সন্তুষ্টি সহকারে শ্রবণ করেন, অন্য কিছুই সেইরূপ সন্তুষ্টি সহকারে শ্রবণ করেন না। কারণ আম্বিয়ায়ে কিরামের অন্তরে আল্লাহ্ তা’আলার ভালবাসা ও ভীতি এবং উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী পরিপূর্ণ অবস্থায় বর্তমান থাকিবার ফলে তাহাদের তিলাওয়াতের সুরে এক মহিমাময় আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য বিদ্যমান থাকে। তিলাওয়াতের চরম উদ্দেশ্যও তাহাই। হযরত আয়েশা (রা) বলেন- মহান আহ্ সকল শব্দ ও কণ্ঠস্বর শুনিয়া থাকেন। আল্লাহ্ তা’আলা নেককার ও বদকার সকলের কণ্ঠস্বর শুনিলেও নেককার বান্দাদের কিরাআতের সুর ও শব্দকে তিনি মহা মর্যাদা দিয়া থাকেন। আল্লাহ্ তা’আলা বলেনঃ

وَمَا تَكُونُ فِي شَأْنٍ وَّ مَا تَتْلُوْا مِنْهُ مِنْ قُرْآنٍ وَلَا تَعْمَلُونَ مِنْ عَمَلٍ إِلَّا كُنَّا عَلَيْكُمْ شُهُودًا إِذْ تُفيضُونَ فِيهِ –

(তুমি যে কাজেই লিপ্ত থাকো না কেন এবং কুরআন মজীদের যে অংশই তিলাওয়াত করো না কেন, তোমাদের উক্ত কার্যে লিপ্ত থাকিবার কালে আমি তোমাদের নিকট উপস্থিত থাকি । ) বলাবাহুল্য, সাধারণ নেককারদের তিলাওয়াত আল্লাহ্ তা’আলার নিকট যত প্রিয়, আম্বিয়ায়ে কিরাম আলাইহিস সালামের তিলাওয়াত তদপেক্ষা অনেক অনেক বেশী প্রিয়। আলোচ্য হাদীসে তাহাই বর্ণিত হইয়াছে।

কেহ কেহ বলেন, আলোচ্য হাদীসে যে ازن (তিনি সন্তুষ্টি সহকারে শ্রবণ করেন)-শব্দটি উল্লেখিত হইয়াছে, এখানে উহার অর্থ হইবে ‘তিনি নির্দেশ প্রদান করিয়াছেন।’ তবে ইতিপূর্বেঃ ازن (তিনি সন্তুষ্টি সহকারে শ্রবণ করিয়া থাকেন) শব্দের যে অর্থ বর্ণনা করা হইয়াছে, উহাই এখানে উহার অধিকতর সঙ্গত অর্থ। হাদীসটির অন্যান্য শব্দের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া উহার অর্থ করিলে প্রথমোক্ত অর্থই যুক্তিসঙ্গত বলিয়া বিবেচিত হইবে। উহার একটি শব্দগুচ্ছ হইতেছে- يتغنى بالقران অর্থাৎ ‘যিনি সুবের সহিত শব্দ করিয়া (আল্লাহর কিতাব) তিলাওয়াত করেন।’ ইহাতে সহজেই বুঝা যায়, হাদীসটির প্রথমোক্ত তাৎপর্যই অধিকতর সঙ্গত। কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতেও তা শব্দটি ‘মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা ও পালন করা’ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছেঃ

إِذَا السَّمَاءُ انْشَقَّتْ – وَأَذِنَتْ لربها وحُقَّتْ – و إذا الْأَرْضُ مُدَّتْ – وَالْقَتْ مَا فِيهَا وَتَخَلَّتْ – وَأَذِنَتْ لربها وحُقَّتْ .

(যখন আকাশ ফাটিয়া যাইবে; আর উহা স্বীয় প্রতিপালক প্রভুর আদেশ মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করিবে ও উহা পালন করিবে এবং স্বীয় প্রভুর আদেশ মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা ও উহা পালন করা উহার জন্যে নির্ধারিত রহিয়াছে। আর যখন পৃথিবীকে প্রশস্ত করিয়া দেওয়া হইবে এবং উহা স্বীয় গর্ভে অবস্থিত বস্তুসমূহকে বাহিরে নিক্ষেপ করত উজাড় হইয়া পড়িবে। আর উহা স্বীয় প্রতিপালক প্রভুর আদেশ মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করিবে ও উহা পালন করিবে এবং স্বীয় প্রভুর আদেশ মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা ও উহা পালন করা উহার জন্যে নির্ধারিত রহিয়াছে।)

হযরত ফুযালা (রাঃ) হইতে সহীহ সনদে ইমাম ইব্‌ন মাজাহ কর্তৃক বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীসেও শব্দটি ‘মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা’ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। নবী করীম (সাঃ) বলেনঃ

الله اشد اذنا الى الرجل الحسن الصوت بالقرآن من صاحب القينة الى قينته

অর্থাৎ মালিক তাহার দাসীর কণ্ঠস্বরকে যতটুকু মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করিয়া থাকে, সুরেলা কণ্ঠে কুরআন মজীদ তিলাওয়াতকারী ব্যক্তির কণ্ঠস্বর আল্লাহ্ তা’আলা ততোধিক মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করিয়া থাকেন ৷

সুফিয়ান ইব্‌ন উয়াইনাহ يتغنى  শব্দ সম্বন্ধে বলিয়াছেন যে, উহার অর্থ হইবে ‘সে তৃপ্ত থাকে বা সে নিজেকে পার্থিব সম্পদের অভাব হইতে মুক্ত মনে করে।’ আবূ উবায়দ, কাসিম ইব্‌ন সাল্লাম প্রমুখ ব্যাখ্যাকারও অনুরূপ ব্যাখ্যা বর্ণনা করিয়াছেন। তবে উক্ত ব্যাখ্যা সঠিক নহে। এখানে উহা উক্ত শব্দের কষ্টকল্পিত ব্যাখ্যাই বটে। আলোচ্য হাদীসের জনৈক রাবী বলিয়াছেন, উহার অর্থ হইবে ‘সে শব্দ করিয়া সুরেলা কণ্ঠে তিলাওয়াত করে।’ হারমালা বলেন- একদা আমি সুফিয়ান ইব্‌ন উয়াইনাকে বলিতে শুনিলাম যে, উহার অর্থ হইবে সে নিজেকে পার্থিব সম্পদের অভাব হইতে মুক্ত মনে করে।’ ইমাম শাফেঈর নিকট আমি উহা ব্যক্ত করিলে তিনি বলিলেন- না, উহার অর্থ ঐরূপ নহে। ঐরূপ অর্থ বুঝাইবার প্রয়োজন থাকিলে আলোচ্য হাদীসে يتغنى শব্দের পরিবর্তে يتغانى শব্দ উল্লেখিত হইত । প্রকৃতপক্ষে উহার অর্থ হইবে- ‘সে সুরেলা কণ্ঠে তিলাওয়াত করে।’ মুযানী এবং রবী ও ইমাম শাফেঈ হইতে অনুরূপ ব্যাখ্যা বর্ণনা করিয়াছেন। হারমালা বলেন- আমি ইবন ওহাবকে বলিতে শুনিয়াছি- উহার অর্থ হইবে, ‘সে সুরের সহিত তিলাওয়াত করে ।

উপরে আলোচ্য হাদীসের যে সঠিক তাৎপর্য বর্ণিত হইল, তদনুযায়ী أولَهيكْفيمْ أَخاانز لنا عليك الكتاب الخ আয়াতকে বক্ষ্যমান পরিচ্ছেদের প্রথমদিকে উল্লেখ করা ইমাম বুখারীর পক্ষে প্রাসঙ্গিক হয় নাই।(১) কারণ, উদ্ধৃত আয়াতটিতে কুরআন মজীদ সুরের সহিত

তিলাওয়াত করিবার প্রসঙ্গ বর্ণিত হয় নাই । কাফিরগণ বলিত, মুহাম্মদের সত্যবাদিতার সমর্থনে । কেন তাহার প্রতি নিদর্শনসমূহ নাযিল হয় না? তাহাদের এই কথার উত্তরে আল্লাহ্ তা’আলা বলিতেছেন:

قُلْ إِنَّمَا الايت عِنْدَ اللهِ ، وَإِنَّما أنا نَذِيرٌ مُبِينُ – أَوَلَمْ يَكْفِهِمْ أَنَّا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ يُتْلَى عَلَيْهِمْ إِنَّ فِي ذلِكَ لَرَحْمَةً وَ ذِكْرَى لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ –

‘তুমি বল, নিদর্শনাবলী তো আল্লাহ্র নিয়ন্ত্রণে রহিয়াছে। আমি তো শুধু এক সুস্পষ্ট সাবধানকারী। তাহাদের জন্যে কি ইহাই যথেষ্ট নহে যে, আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করিয়াছি- যে কিতাব তাহাদের নিকট পঠিত হয়। যে জাতি সত্যকে বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত থাকে, তাহাদের জন্যে উহাতে নিশ্চয়ই রহমত ও উপদেশ রহিয়াছে।’ আলোচ্য আয়াতটিতে প্রমাণিত হইতেছে যে, কুরআন মজীদই প্রয়োজনীয় নিদর্শন হিসাবে যথেষ্ট। অর্থাৎ নবী করীম (সা) ছিলেন উম্মী (নিরক্ষর)। কুরআন মজীদের ন্যায় অনন্যসাধারণ মহাগ্রন্থ রচনা করা তাঁহার পক্ষে কোনক্রমে সম্ভবপর ছিল না। এমতাবস্থায় উক্ত গ্রন্থ তাঁহার প্রাপ্ত হওয়া তাঁহার সত্যবাদিতার এক মহা নিদর্শন বটে । এইরূপে অন্যত্র আল্লাহ্ তা’আলা বলিতেছেনঃ

وَمَا كُنْتَ تَتْلُوا مِنْ قَبْلِهِ مِنْ كِتَابٍ ولا تَخْطُهُ بِيَمِينِكَ إِذًا لَأَرْتَابَ المبطلون.

‘ইতিপূর্বে তুমি না কোন কিতাব পড়িতে আর না স্বীয় দক্ষিণ হস্ত দ্বারা উহা লিখিতে। উহা হইলে অবশ্য বাতিলপন্থীগণ সংশয় প্রকাশ করিবার সুযোগ পাইত ।’

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হইল যে, আলোচ্য হাদীসে সুরের সহিত কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিবার কথাই বলা হইয়া থাকুক, অথবা কুরআন মজীদের প্রাপ্তিতে পার্থিব সম্পদের অভাব হইতে নিজেকে মুক্ত মনে করিবার কথাই বলা হইয়া থাকুক, কোন অবস্থাতেই আলোচ্য আয়াত ইমাম বুখারীর এইস্থলে উদ্ধৃত করা সঠিক ও যুক্তিযুক্ত হয় নাই ৷

 
সুরের সহিত তিলাওয়াত প্রসঙ্গ

হযরত উকবা ইবন আমির (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আলী ইব্‌ন রুবাহ লখমী, কুব্বাছ ইব্‌ন রযীন, আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন সালেহ ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত উকবা ইবন আমির (রাঃ) বলেন- একদা নবী করীম (সাঃ) আমাদের নিকট আগমন করিলেন । আমরা তখন মসজিদে বসিয়া পরস্পরকে কুরআন মজীদ শিক্ষা দিতেছিলাম । তিনি বলিলেন- ‘তোমরা আল্লাহ্র কিতাবের ইলম হাসিল কর এবং উহাকে আঁকড়াইয়া ধর।’ রাবী বলেন- আমার মনে পড়ে, নবী করীম (সাঃ) আরও বলিলেন- وتغنوه (আর তোমরা উহা সুরের সহিত তিলাওয়াত কর)। অথবা উহা দ্বারা পার্থিব সম্পদের অভাব হইতে নিজেকে মুক্ত মনে কর।’ অতঃপর নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘যে সত্তার হস্তে আমার প্রাণ রহিয়াছে, তাঁহার কসম ! জলাশয়ে বাঁধা পশুকে ছাড়িয়া দিলে উহার পক্ষে ভাগিয়া যাওয়ার যতটুকু আশংকা থাকে, কুরআন মজীদের পক্ষে স্মৃতি হইতে চলিয়া যাইবার তদপেক্ষা অধিকতর আশংকা থাকে।’

হযরত উকবা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আলী, মূসা ইব্‌ন আলী, আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন সালেহ্ ও ইমাম আবূ উবায়দ পূর্বোল্লেখিত হাদীসের অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন । তবে পূর্বোল্লেখিত হাদীসে যেরূপ রাবীর সন্দেহ উল্লেখিত হইয়াছে, ইহাতে সেইরূপ কোন সন্দেহের উল্লেখ নাই । ইমাম নাসাঈও ‘ফাযায়িলুল কুরআন’ অধ্যায়ে উহা উপরোক্ত রাবী মূসা ইব্‌ন আলী হইতে উপরোক্ত ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং অন্যরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন । তিনি উহা উপরোক্ত রাবী কুব্বাছ ইব্‌ন রযীন হইতে উপরোক্ত ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং কুব্বাছ ইব্‌ন রযীন হইতে ধারাবাহিকভাবে আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন মুবারক প্রমুখ রাবীর অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন । উক্ত বর্ণনায় এইরূপ উল্লেখিত হইয়াছেঃ ‘একদা নবী করীম (সাঃ) আমাদের নিকট আগমন করিলেন। আমরা তখন কুরআন মজীদ পড়িতেছিলাম। তিনি আমাদিগকে সালাম দিলেন………….. …….।’ এতদ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কুরআন মজীদ তিলাওয়াত রত ব্যক্তিকে সালাম প্রদান করা অবৈধ বা অসঙ্গত নহে।

হযরত মুহাজির ইব্‌ন হাবীব হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ বকর ইব্‌ন আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন আবূ মরিয়াম, আবুল ইয়ামান ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘হে কুরআন মজীদের ধারকগণ! তোমরা কুরআন মজীদকে বালিশ বানাইও না; উহা যেভাবে তিলাওয়াত করা দরকার, সকাল-সন্ধ্যায় সেইভাবে তিলাওয়াত করিও; আর তোমরা উহা সুরের সহিত তিলাওয়াত কর অথবা তোমরা উহা দ্বারা নিজকে পার্থিব সম্পদের অভাব হইতে মুক্ত মনে করিও। আর উহাতে যাহা রহিয়াছে, তৎসম্বন্ধে ভালরূপে জ্ঞান লাভ করিও; ইহাতে আশা করা যায়, তোমরা কামিয়াব হইতে পারিবে।’ উক্ত হাদীসের সনদ বিচ্ছিন্ন ! অতঃপর ইমাম আবূ উবায়দ বলিয়াছেন, تقنوه ও تغئره উভয়ের অর্থ হইতেছে— তোমরা উহা দ্বারা নিজদিগকে পার্থিব সম্পদের অভাব হইতে মুক্ত মনে করিও এবং ট্রাকেই নিজেদের পার্থিব সম্পদ মনে করিও।

হযরত ফুযালা ইবন উবায়দ হইতে ধারাবাহিকভাবে ইসমাঈল ইব্‌ন উবায়দুল্লাহ্ ইব্‌ন আবূ মুহাজির, ইমাম আওযাঈ, আলী ইব্‌ন হামযাহ, হিশাম ইব্‌ন আম্মার ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘দাসীর মালিক উহার কণ্ঠস্বর যতটুকু মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করিয়া থাকে, আল্লাহ্ তা’আলা তদপেক্ষা অধিকতর মনযোগ সহকারে সুরেলা কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াতকারী বান্দার তিলাওয়াত শ্রবণ করিয়া থাকেন ।’ ইমাম আবূ উবায়দ বলেন- উক্ত হাদীসের সনদে কোন কোন মুহাদ্দিস, হযরত ফুযালাহ (রাঃ) এবং ইসমাঈল ইব্‌ন উবায়দুল্লাহর মধ্যে হযরত ফুযালার মুক্ত গোলাম মায়সারার নাম অন্যতম রাবী হিসাবে উল্লেখ করিয়াছেন। ইমাম ইবন মাজাহ উহা ইমাম আওযাঈ হইতে উপরোক্ত ঊর্ধ্বতন সনদাংশে (মায়সারার নামসহ) এবং ইমাম আওযাঈ হইতে ধারাবাহিকভাবে ওয়ালীদ, রাশেদ ইব্‌ন সাঈদ ও ইব্‌ন আবূ রাশেদের অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন । উক্ত হাদীসে যে ازن শব্দটি উল্লেখিত রহিয়াছে, ইমাম আবূ উবায়দ তৎসম্বন্ধে বলেন- উহার অর্থ হইতেছে ‘মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা।’

সায়েব হইতে ধারাবাহিকভাবে কাসিম ইবন মুহাম্মদ, আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন আবদুর রহমান ইব্‌ন আবূ মুলায়কা, সালমা ইব্‌ন ফযল, মুহাম্মদ ইব্‌ন হামীদ ও ইমাম আবুল কাসিম বাগবী বর্ণনা করিয়াছেন যে, সায়েব বলেন- একদা হযরত সা’দ (রাঃ) আমাকে বলিলেন, তুমি কি কুরআন মজীদের কিরাআত শিখিয়াছ? আমি বলিলাম- ‘হ্যাঁ।’ তিনি বলিলেন- উহা সুরের সহিত তিলাওয়াত করিও। কারণ, আমি নবী করীম (সাঃ)-কে বলিতে শুনিয়াছিঃ ‘তোমরা সুরের সহিত কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিও; আর তোমরা (উহা পড়িবার কালে) ক্রন্দন করিও। যদি ক্রন্দন করিতে না পারো, তবে চেহারায় ক্রন্দনের ভাব আনিতে চেষ্টা করিও।’

হযরত সা’দ ইব্‌ন আবূ ওয়াক্কাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবদুল্লাহ্ ইবন আবৃ নাহীক, আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন আবূ মুলায়কা, লায়ছ প্রমুখ রাবীর সনদে ইমাম আবূ দাউদ বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সা) বলিয়াছেন- ‘নিশ্চয় এই কুরআন মজীদ চিন্তা-ভাবনার বিষয় লইয়া নাযিল হইয়াছে! তোমরা যখন উহা তিলাওয়াত কর, তখন ক্রন্দন করিও। ক্রন্দন করিতে না পারিলে মুখে ক্রন্দনের ভাব আনিতে চেষ্টা করিও। আর তোমরা উহা সুরের সহিত তিলাওয়াত করিও, অথবা উহা দ্বারা নিজদিগকে পার্থিব সম্পদের অভাব হইতে মুক্ত মনে করিও। যে ব্যক্তি উহা সুরের সহিত তিলাওয়াত না করে অথবা উহা দ্বারা নিজেকে পার্থিব সম্পদের অভাব হইতে মুক্ত মনে না করে, সে ব্যক্তি আমার দলের অন্তর্ভুক্ত নহে।’ উক্ত হাদীসের সনদ সম্বন্ধে বলিবার মত অনেক কথা রহিয়াছে। এইস্থল উহা বলিবার স্থান নহে। আল্লাহ্ই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী।

উবায়দুল্লাহ্ ইব্‌ন আবু যায়দ হইতে ধারাবাহিকভাবে ইবন আবূ মুলায়কা, আবদুল জব্বার ইব্‌ন বিরদ, আবদুল আ’লা ইব্‌ন হাম্মাদ ও ইমাম আবূ দাউদ বর্ণনা করিয়াছেনঃ উবায়দ বলেন- একদা হযরত আবূ লুবাবা আমাদের নিকট দিয়া যাইতেছিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া আমরা তাঁহার পশ্চাতে চলিলাম। এক সময়ে তিনি স্বীয় গৃহে প্রবেশ করিলেন। আমরাও উহাতে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, তাঁহার গৃহ পুরাতন ও ভাঙ্গাচোরা; তাঁহার বৈষয়িক অবস্থায় দারিদ্র্যের ছাপ বিদ্যমান। আমরা তাঁহার নিকট আমাদের বংশ পরিচয় প্রদান করিলে তিনি বলিলেন- মোটা আয়ের ব্যবসায়ী সকল। অতঃপর তিনি বলিলেন— নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেনঃ ليس منا من لم يتغن بالقران ‘যে ব্যক্তি সুরের সহিত কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করে না সে ব্যক্তি আমাদের দলের অন্তর্ভুক্ত নহে।’ রাবী আবদুল জব্বার বলেন-আমি আমার উস্তাদ ইব্‌ন আবূ মুলায়কার নিকট জিজ্ঞাসা করিলাম, হে আবূ মুহাম্মদ ! তিলাওয়াতকারীর কণ্ঠস্বর মিষ্টি ও সুমধুর না হইলে সে কি করিবে? তিনি বলিলেন- যথাসম্ভব মধুর সুরে তিলাওয়াত করিবে।’ উক্ত সনদে উহা শুধু ইমাম আবূ দাউদ বর্ণনা করিয়াছেন । ইন আবূ মুলায়কা ও তাঁহার শিষ্যের প্রশ্নোত্তরে প্রমাণিত হয় যে, পূর্বযুগীয় আলিমগণ التغنى بالقران শব্দ দ্বারা কুরআন মজীদ সুরের সহিত তিলাওয়াত করা’ বুঝিতেন। হাদীসের ইমামগণ উহার ঐরূপ অর্থই বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম আবূ দাউদ কর্তৃক বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীস দ্বারাও উহাই প্রমাণিত হয়।

হযরত বারা ইব্‌ন আযিব (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবদুর রহমান ইব্‌ন আওসাজাহ, তালহা, আ’মাশ, জারীর, উসমান ইব্‌ন আবূ শায়বা ও ইমাম আবূ দাউদ বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সা) বলিয়াছেন- ‘স্বীয় কণ্ঠস্বর দ্বারা তোমরা কুরআন মজীদ সৌন্দর্যমণ্ডিত কর।’ উক্ত হাদীসের সনদ নির্ভরযোগ্য। ইমাম নাসায়ী এবং ইমাম ইব্‌ন মাজাহ উহা উপরোক্ত রাবী তালহা হইতে উপরোক্ত অভিন্ন ঊর্ধ্বতন সনদাংশে এবং তালহা হইতে ধারাবাহিকভাবে শু’বা প্রমুখ রাবীর ভিন্নরূপ অধস্তন সনদাংশে বর্ণনা করিয়াছেন । ইমাম নাসাঈ এবং ইব্‌ন হাব্বান, আবদুর রহমান ইব্‌ন আওসাজাকে বিশ্বস্ত রাবী বলিয়া আখ্যায়িত করিয়াছেন। ইয়াহিয়া ইব্‌ন সাঈদ আল কাত্তান হইতে ইদী বর্ণনা করিয়াছেন যে, ইয়াহিয়া বলেন- ‘আমি মদীনাবাসীগণের নিকট আবদুর রহমান ইবন আওসাজাহ সম্বন্ধে প্রশ্ন করিয়াছি। তাহারা তাহাকে বিশ্বস্ত লোক বলেন নাই।’ শু’বা হইতে ধারাবাহিকভাবে ইয়াহিয়া ইব্‌ন সাঈদ, আবূ উবায়দ ও কাসিম ইবন সালাম বর্ণনা করিয়াছেন যে, শু’বা বলেন- স্বীয় কণ্ঠস্বর দ্বারা কুরআন মজীদকে তোমরা সৌন্দর্যমণ্ডিত কর’- এই হাদীস বর্ণনা করিতে আইউব আমাকে নিষেধ করিয়াছেন। আবূ উবায়দ বলেন- আমার ধারণা এই যে, উক্ত হাদীসের অপব্যাখ্যা করিয়া লোকে শরীআত বিরোধী সুরে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিতে পারে, এই আশংকায়ই আইউব উহা বর্ণনা করিতে নিষেধ করিয়াছেন। আমি (ইবন কাছীর) বলিতেছি- উক্ত রাবী শু’বা তথাপি আল্লাহ্র উপর তাওয়াক্কুল করিয়া উক্ত হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। কারণ, ভ্রান্ত ব্যাখ্যার ভয়ে যদি হাদীস বর্ণনা করা পরিত্যক্ত হয়, তবে নবী করীম (সাঃ)-এর ‘সুন্নাহ’-এর বিপুল অংশের বর্ণনা পরিত্যক্ত হইয়া পড়িবে। ফলে মানুষ সুন্নাহর বিপুল অংশের জ্ঞান হইতে বঞ্চিত থাকিয়া যাইবে। শুধু সুন্নাহ নহে; বরং কুরআন মজীদের অনেক আয়াত বিকৃতরূপে ব্যাখ্যা হইয়া থাকে। তাই বলিয়া কি লোকদের নিকট হইতে উহা গোপন করিতে হইবে? আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি। তাঁহার উপর নির্ভর করি। ‘লা হাওলা ওয়ালা কুউওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ্।

হাদীসে যে সুরের সহিত কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিবার আদেশ রহিয়াছে উহার তাৎপর্য এই যে, কুরআন মজীদ বিনয় মিশ্রিত, আন্তরিকতাপূর্ণ ও মর্মস্পর্শী সুরের সহিত তিলাওয়াত করা কর্তব্য। হযরত আবূ মূসা হইতে ধারাবাহিকভাবে তৎপুত্র মূসা, আহমদ ইব্‌ন ইবরাহীম ও হাফিজ তাকী ইব্‌ন মুখাল্লাদ বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত আবূ মূসা (রাঃ) বলেন যে একদা নবী করীম (সাঃ) আমাকে বলিলেন- ‘ওহে আবূ মূসা ! গত রাত্রিতে আমি তোমরা কিরাআত যেরূপ মনোযোগ সহরে শ্রবণ করিয়াছি, তাহা যদি তুমি দেখিতে পাইতে! আমি আরয করিলাম- ‘আল্লাহ্র কসম! আমি যদি জানিতে পারিতাম যে, আপনি আমার কিরাআত শুনিতেছেন, তবে আপনার জন্যে উহা অত্যন্ত সুন্দর, মধুর ও হৃদয়স্পর্শী করিতাম।’ ইমাম মুসলিম উহা তালহা নামক রাবীর মাধ্যমে বর্ণনা করিয়াছেন। উহাতে এই অতিরিক্ত কথাটি রহিয়াছেঃ নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘তুমি নিশ্চয় আল্লাহ্ তা’আলার নিকট হইতে হযরত দাউদ (আঃ)-এর বংশধরদের একটি বাঁশী লাভ করিয়াছ।’ ইমাম বুখারী উহা যে পরিচ্ছেদে বর্ণনা করিয়াছেন, উহা সেই স্থানে শীঘ্রই উল্লেখিত হইবে। উক্ত হাদীসে উল্লেখিত হযরত আবূ মূসা (রা)-এর উক্তি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কুরআন মজীদের তিলাওয়াত কালে তিলাওয়াতের সুর মধুর ও হৃদয়স্পর্শী করিতে অত্যধিক চেষ্টা করা নিষিদ্ধ নহে। উক্ত হাদীস দ্বারা ইহাও প্রমাণিত হয় যে, ইয়ামানবাসী হযরত আবূ মূসা (রাঃ)-এর কণ্ঠস্বর ইয়ামানবাসীদের কণ্ঠস্বরের ন্যায় মধুর ছিল। উহাতে আল্লাহ্র ভয় ফুটিয়া উঠিত। আরও প্রমাণিত হয় যে, এই সব গুণ শরীআতের নিকট অভিপ্রেত গুণই বটে।

হযরত আবূ সালামা হইতে ধারাবাহিকভাবে ইব্‌ন শিহাব, ইউনুস, লায়ছ, আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন সালেহ ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত উমর (রাঃ) হযরত আবূ মূসা (রাঃ)-কে দেখিলে বলিতেন- হে আবূ মূসা! আমাদের প্রভুকে আপনি আমাদের হৃদয়ে স্মরণ করাইয়া দিন।’ হযরত উমর (রাঃ)-এর কথায় হযরত আবূ মূসা (রাঃ) তাঁহার নিকট বসিয়া কুরআন, মজীদ তিলাওয়াত করিতেন।

আবূ উসমান নাহদী হইতে ধারাবাহিকভাবে সুলায়মান তামীমী ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেন যে, আবূ উসমান বলেন- হযরত আবূ মূসা (রাঃ) নামাযে আমাদের ইমামতী করিতেন । আল্লাহর কসম ! আমি কখনও তাঁহার কণ্ঠস্বর হইতে মধুরতর কোন রাগ মানুষের কণ্ঠ হইতে নিঃসৃত কিংবা সেতারা সারিন্দা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র হইতে সৃষ্ট কোথাও শ্রবণ করি নাই। হযরত আয়েশা (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবদুর রহমান ইব্‌ন ছাবিত, জুমহী, হানযালা ইব্‌ন আবূ সুফিয়ান, ওয়ালীদ ইব্‌ন মুসলিম, আব্বাস ইবন উসমান দামেশকী ও ইমাম ইবন মাজাহ বর্ণনা করিয়াছেনঃ

হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ একদা রাত্রিতে ইশার পর নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট আসিতে আমার বিলম্ব হইল। নবী করীম (সাঃ)-এর নিকট আমার আসিবার পর তিনি বলিলেন- তুমি এতক্ষণ কোথায় ছিলে? আমি বলিলাম, আপনার জনৈক সাহাবীর কিরাআত শুনিতেছিলাম । তাহার কিরাআত ও কণ্ঠস্বরের ন্যায় কিরাআত ও কণ্ঠস্বর আমি আর কাহারও নিকট শুনি নাই। এতদশ্রবণে নবী করীম (সাঃ) আমার নিকট হইতে উঠিয়া গেলেন। আমি তাঁহার কথা শুনিবার উদ্দেশ্যে তাঁহার সহিত চলিলাম । কিছুক্ষণ পর তিনি আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন— এই ব্যক্তি হইতেছে ‘আবূ হুযায়ফার মুক্ত গোলাম সালিম (রাঃ)। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ তা’আলার প্রাপ্য যিনি আমার উম্মতের মধ্যে এইরূপ ব্যক্তিকে সৃষ্টি করিয়াছেন।’ উক্ত হাদীসের সনদ সহীহ।

বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফে হযরত জুবায়র ইবন মুতইম (রাঃ) হইতে বর্ণিত রহিয়াছেঃ হযরত জুবায়র (রাঃ) বলেন- ‘আমি নবী করীম (সাঃ)-কে মাগরিবের নামাযে সূরা তূর তিলাওয়াত করিতে শুনিয়াছি। তাঁহার কণ্ঠস্বর অপেক্ষা অধিকতর মধুর কণ্ঠস্বর অথবা তাঁহার কিরাআত অপেক্ষা অধিকতর মধুর কিরাআত আমি কাহারও নিকট শুনি নাই।’ কোন কোন রিওয়ায়েতে উল্লেখিত হইয়াছেঃ ‘আমি যখন নবী করীম (সাঃ)-কে এই আয়াত তিলাওয়াত করিতে শুনিলাম- آم خلقوا من غير شيئ أم هم الْخَالقُوْنَ আমাকে এ (তাহারা কি বিনা স্রষ্টায় সৃষ্ট হইয়াছে? অথবা তাহারা নিজেরাই কি স্রষ্টা?) তখন আমার মনে হইল, আমার হৃদযন্ত্র ফাটিয়া গিয়াছে।(১) এখানে উল্লেখ্য যে, হযরত জুবায়র (রাঃ) এই সময়ে মুশরিক ছিলেন। বদরের যুদ্ধের পর যুদ্ধ বন্দীদের মুক্তির বিষয়ে আলোচনা করিবার উদ্দেশ্যে মদীনায় প্রেরিত মক্কার কাফিরদের প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য হিসাবে তিনি মদীনায় আগমন করিয়াছিলেন । এই ঘটনার পর হযরত জুবায়র (রাঃ) মুসলমান হইয়া যান। আহা ! সেই মানব সন্তানটি কত বড় মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন যাহার কুরআন তিলাওয়াত ভ্রান্ত বিশ্বাসে অটল একজন মুশরিকের হৃদয়কে কাড়িয়া লইয়াছে।

প্রকৃতপক্ষে উত্তম কিরাআত হইতেছে হৃদয় উৎসারিত বিনয়, ভীতি ও ভালবাসার সংযোগে সৃষ্ট কিরাআত। হযরত তাউস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে লায়ছ, ইসমাঈল ইব্‌ন ইবরাহীম ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত তাউস (রাঃ) বলেন— ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে সর্বাপেক্ষা বেশী ভয় করে, তাহার তিলাওয়াতের সুর সর্বাপেক্ষা উত্তম।’ হযরত তাউস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে তৎপুত্র ইব্‌ন তাউস, ইব্‌ন জুরায়জ, সুফিয়ান কুবায়সা ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ হযরত তাউস (রা) বলেন- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে সর্বাপেক্ষা অধিক পরিমাণে ভয় করে, তাহার কিরাআতের সুর সর্বাপেক্ষা উত্তম।’ হযরত তাউস (রাঃ) হইতে

ধারাবাহিকভাবে ইব্‌ন তাউস ও হাসান ইব্‌ন মুসলিম, ইব্‌ন জুরায়জ, সুফিয়ান, কুবায়সা, ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ একদা নবী করীম (সাঃ) বলিলেন- ‘যাহার কিরাআত শুনিলে তোমার মনে হইবে যে, সে আল্লাহকে ভয় করে, তাহার কিরাআতের সুর মধুরতম। উক্ত রিওয়ায়েতের সনদ মুত্তাসিল (অবিচ্ছিন্ন) নহে। তবে অন্যরূপ সনদে উহা অবিচ্ছিন্নরূপে বর্ণিত হইয়াছে। হযরত জাবির (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ যুবায়র, মাজমা’, ইবরাহীম ইব্‌ন ইসমাঈল, আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন জা’ফর মাদানী, বিশর ইব্‌ন মাআজ, জারীর ও ইমাম ইব্‌ন মাজাহ বর্ণনা করেনঃ নবী করীম (সা) বলিয়াছেন- ‘যাহার কুরআন তিলাওয়াত শুনিলে আমাদের মনে হইবে যে, সে আল্লাহকে ভয় করে, তাহার কুরআন তিলাওয়াতের সুরই হইতেছে উত্তম।’ উক্ত রিওয়ায়েতের সনদ মুত্তাসিল হইলেও দুইজন রাবী আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন জা’ফর এবং তাহার উস্তাদ ইবরাহীম ইবন ইসমাঈল দুর্বল রাবী। আল্লাহ্ই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী আবদুল্লাহ্ ইব্‌ন জা’ফর হইতেছেন আলী ইবন মাদীনীর পিতা।

তিলাওয়াতের সুর সম্বন্ধীয় সারকথা এই যে, সুর কুরআন মজীদ সম্বন্ধে চিন্তা করিতে, উহার অর্থ ও মর্ম উপলব্ধি ও হৃদয়ঙ্গম করিতে, উহার প্রতি বিনয়াবনত হইতে এবং উহা মানিয়া চলিতে শ্রোতাকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে, সেই সুরই হইতেছে শরীআতের দৃষ্টিতে উত্তম ও মধুরতম সুর। শরীআত সেই সুরেই কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিতে মানুষকে আদেশ দিয়াছে। সেই সুরই হইতেছে মানুষের নিকট শরীআতের কাম্য ও অভিপ্রেত সুর।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আধুনিক যুগে উদ্ভাবিত বিভিন্ন গ্রাম ও বিভিন্ন তাল-লয়ের সুর ও রাগ-রাগিণী যাহা মানুষের চিন্তা ও অনুভূতিকে উচ্ছৃংখল ও নীতিহীন করিয়া দেয় এবং মানুষের মন-মগজের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত উহাকে আল্লাহ্, রাসূল, কুরআন ও আখিরাতের ভালবাসা হইতে শূন্য ও বঞ্চিত করে, তাহা কখনও কুরআন তিলাওয়াতের জন্যে অভিপ্রেত সুর ও রাগ-রাগিণী হইতে পারে না। মহান আল্লাহ্র বাণী কুরআন মজীদকে উক্ত সুর ও রাগ-রাগিনীর কলুষ হইতে মুক্ত ও পবিত্র রাখা আল্লাহ্-ভীরু মানুষের জন্য জরুরী ও অপরিহার্য। এই বিষয়ে পবিত্র সুন্নাহ্য় পথ নির্দেশনা রহিয়াছে। উহাতে এইরূপ সুর ও রাগ-রাগিনী হইতে কুরআন মজীদকে পবিত্র রাখিতে নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। হযরত হুযায়ফা ইবন ইয়ামান (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে আবূ মুহাম্মদ নামক জনৈক (অজ্ঞাত পরিচয়) বৃদ্ধ ব্যক্তি, হিসীন ইব্‌ন মালিক ফাযারী, বাকিয়াহ ইব্‌ন ওয়ালীদ, নাঈম ইব্‌ন হাম্মাদ, ইমাম আবূ উবায়দ, কাসিম ইবন সাল্লাম বর্ণনা করিয়াছেনঃ নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘তোমরা আরবদের সুর ও লাহানে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিও; ফাসিক সম্প্রদায় এবং ইয়াহুদী ও নাসারা জাতির সুর ও লাহানে উহা তিলাওয়াত করিও না। আমার পর অচিরেই একদল লোক আবির্ভূত হইবে। তাহারা কুরআন মজীদের শব্দে অতিরিক্ত বর্ণ আমদানী করত উহা কণ্ঠের মধ্যে ঘুরাইয়া ফিরাইয়া উচ্চারণ করিয়া উচ্ছৃংখল ও নীতিহীন সুরে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিবে। কুরআন মজীদ তাহাদের কণ্ঠের নিম্নে গমন করিবে না (উহা তাহাদের হৃদয়ে প্রবেশ করিবে না)। তাহাদের হৃদয় এবং তাহাদের আড়ম্বর ও জৌলুসে চমৎকৃত হৃদয় উভয়ই গোমরাহ ও বিভ্রান্ত।’ আলীম হইতে ধারাবাহিকভাবে যাযান, আবূ উমর, আবুল ইয়াকযান, উসমান ইবন উমায়র, শারীক, ইয়াযীদ, ইমাম আবূ উবায়দ, কাসিম ইবন সাল্লাম বর্ণনা করিয়াছেনঃ

‘আলীম বলেন- একদা আমরা একটি উপত্যকায় অবস্থান করিতেছিলাম। আমাদের সঙ্গে নবী করীম (সাঃ)-এর জনৈক সাহাবীও ছিলেন। রাবী ইয়াযীদ বলেন- আমার বিশ্বাস, আমার উস্তাদ উক্ত সাহাবীর নাম বলিয়াছেন- হযরত আবেস গিফারী। উক্ত সাহাবী দেখিলেন, মহামারী লাগিবার কারণে লোকজন উহার ভয়ে এলাকা ছাড়িয়া চলিয়া যাইতেছে। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন- ইহারা কাহারা? একজন বলিল- ইহারা মহামারী হইতে ভাগিয়া যাইতেছে ! তিনি বলিলেন- ওহে মহামারী ! আমাকে পাকড়াও কর। ‘লোকটি বলিল- আপনি মৃত্যু কামনা করিতেছেন? অথচ আমি নবী করীম (সাঃ)-কে বলিতে শুনিয়াছি— ‘তোমাদের কেহ যেন মৃত্যু কামনা না করে।’ তিনি বলিলেন— কতগুলি স্বভাব ও খাসলাত আমার যুগে মানুষের মধ্যে দ্রুতগতিতে ছড়াইয়া পড়িতেছে। উক্ত স্বভাব ও খাসলাতসমূহ নবী করীম (সাঃ)-এর উম্মতকে পাইয়া বসিতে পারে, তাঁহাকে এইরূপ আশংকা প্রকাশ করিতে শুনিয়াছি। উক্ত স্বভাব ও খাসলাতগুলি হইতেছেঃ ‘অপকৌশলে অপরকে অধিকার বঞ্চিত করিয়া সম্পাদিত ক্রয় বিক্রয়……………………(১); রক্ত সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং কুরআন মজীদকে গীতিকাব্যে পরিণত করা। তাহারা নিজেদের মধ্য হইতে এইরূপ এক ব্যক্তিকে ইমাম বানাইবে যে ব্যক্তি তাহাদের মধ্যে না হইবে বিজ্ঞতম, আর না হইবে উত্তম । তাহারা তাহাকে আগে বাড়াইয়া দিবে শুধু এই জন্যে যে, সে কুরআন মজীদ অপসুর ও বিকৃত লাহানে গাহিয়া তাহাদিগকে শুনাইবে। সে উহাই তাহাদের জন্যে করিবে।’ অতঃপর রাবী আরও দুইটি খাসলাত উল্লেখ করিয়াছেন। (আলোচ্য রিওয়ায়েতে উহা উহ্য রহিয়াছে।)

হযরত আবেস গিফারী (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে যাযান, উসমান ইবন উমায়র, লায়ছ ইব্‌ন আবূ সালীম, ইয়াকূব ইন ইবরাহীম এবং ইমাম আবূ উবায়দ নবী করীম (সাঃ) হইতে পূর্ব বর্ণিত হাদীসের অনুরূপ হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। জনৈক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি হইতে ধারাবাহিকভাবে আ’মাশ, ইবরাহীম, ইয়া’কুব ও ইমাম আবূ উবায়দ বর্ণনা করিয়াছেনঃ ‘একদা হযরত আনাস (রাঃ) জনৈক ব্যক্তিকে নব-উদ্ভাবিত আধুনিক রাগ-রাগিণীতে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিতে শুনিয়া উহার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করত উহা হইতে বিরত থাকিতে বলিলেন।’ সতর্কীকরণ সম্পর্কিত হাদীসের শ্রেণীভুক্ত উপরোক্ত সনদসমূহ সহীহ ও নির্ভরযোগ্য।(২) উক্ত রিওয়ায়েতসমূহ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আধুনিক উচ্ছৃংখলতাপূর্ণ সুরে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করা কবীরা গুনাহ। ইমামগণ উহা সুস্পষ্টরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা

২. উপরোক্ত রিওয়ায়েতসমূহের বক্তব্য বিষয় সহীহ ও গ্রহণীয় হইলেও উহাদের একটির সনদও সহীহ নহে। ইমাম ইবন কাছীর অবশ্য উহাদের একটি অপরটির সহায়ক ও শক্তি বৃদ্ধিকারক হইবার কারণে উহাদিগকে নির্ভরযোগ্য বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। একই বক্তব্য বিষয় একাধিক দুর্বল সনদে বর্ণিত হইলে মুহাদ্দিসগণ এইরূপ দুর্বল সনদসমূহকে নির্ভরযোগ্য বলিয়া আখ্যায়িত করিয়া থাকেন। কুরআন মজীদের তিলাওয়াতে সুর সংযোজন সম্পর্কিত মৌলিক কথা এই যে, যে সুরে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিলে কুরআন মজীদের তিলাওয়াত শ্রোতার হৃদয়ে আল্লাহ্র ভালবাসা ও ভয় হইতে উদ্ভূত বিনয় এবং প্রেরণা জাগরিত হয়, সেই সুরই কুরআন তিলাওয়াতের শারীআতসম্মত সুর। পক্ষান্তরে যে সুরে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিলে শ্রোতার মন ও মগজ কুরআন মজীদের বক্তব্য বিষয়ের প্রতি নিবিষ্ট হইবার পরিবর্তে সুরের মূর্ছনায় আবিষ্ট হইয়া উহা উপভোগ করিতেই নিরত হইয়া যায়, সেই সুর কুরআন তিলাওয়াতের শারীআত বিরোধী সুর। দেখা যাইতেছে, প্রতিটি সুর যেরূপ শারীআতসম্মত নহে, প্রতিটি সুর তেমনি শারীআত বিরোধীও নহে। বলাবাহুল্য, শরীআতসম্মত সুরে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করা হইলে উহা চিন্তাশীল হৃদয়বান মানুষের মন-মগজে আধ্যাত্মিক মহা আলোড়ন সৃষ্টি না করিয়া পারে না। এই পরিচ্ছেদের প্রথম দিকে বর্ণিত হাদীসে যে التغنى بالقران বাক্যাংশের উল্লেখ রহিয়াছে, উহার অর্থ হইতেছে কুরআন মজীদকে সুরের সহিত তিলাওয়াত করা। কিন্তু কোন কোন আলিম বলেন- উহার অর্থ

করিয়াছেন। আবার উপরোক্ত সুরে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করিতে গিয়া কেহ কেহ যদি কুরআন মজীদের শব্দে কোন বর্ণের হ্রাস বৃদ্ধি ঘটায়, তবে তাহার এই দ্বিমুখী বিকৃতি যে পূর্বোক্ত কবীরা গুনাহ অপেক্ষা জঘন্যতম কবীরা গুনাহের কার্য হইবে সে সম্বন্ধে বিজ্ঞ ইমামদের মধ্যে কোনরূপ মতভেদ নাই। আল্লাহ্ই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী।

(চলমান) হইতেছে কুরআন মজীদ লাভ করিবার পর পার্থিব সম্পদের অভাব হইতে নিজেকে মুক্ত মনে করা। তাহাদের এইরূপ অর্থ বর্ণনা করিবার কারণ এই যে, বর্তমান যুগে পার্থিব ভোগ-বিলাসে নিমগ্ন আধ্যাত্মিকতা বঞ্চিত জড়বাদী সমাজের অন্যতম প্রধান প্রিয় বিষয় হইতেছে গান বাজনা। উহা তাহাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হইয়া পড়িয়াছে। আর এই কারণেই একদল চরমপন্থী ফকীহ সকল প্রকারের গান-বাজনাকে সম্পূর্ণরূপে হারাম বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন। তাহারা জানেন যে, প্রতিটি সুরই মানুষের অনুভূতি ও চিন্তা শক্তিকে কলুষিত করে না। তথাপি কলুষময় সুরের কুপ্রভাব হইতে মানুষের আত্মা পবিত্র রাখিবার উদ্দেশ্যে তাহারা ঐরূপ ফতওয়া প্রদান করিয়াছেন । তাহারা জানেন যে, হযরত দাউদ (আঃ)-এর নিকট গীতিগ্রন্থ অবতীর্ণ হইয়াছিল । তিনি উহা গাহিয়া শুনাইবেন এই জন্যেই উহা তাঁহার নিকট অবতীর্ণ হইয়াছিল। হযরত দাউদ (আঃ) সুমধুর সুরে আল্লাহ্ তা'আলার মাহাত্ম্য ও পবিত্রতা বর্ণনা করিতেন। পক্ষীকুল উহা শুনিবার জন্যে তাঁহার নিকট জড়ো হইত। উহারা তাঁহার সুর অনুকরণ করিতে চেষ্টা করিত এবং উহা ঘুরাইয়া ফিরাইয়া গাহিত। আল্লাহ্ তা'আলা বলিতেছেনঃ والطّيْر مُحْشُوْرة كَل لَه أواب 'আর আমি তাহার জন্যে পক্ষীর দলকে একত্রিত করিয়াছিলাম। সবই তাঁহার নিকট প্রত্যাবর্তনকারী।' যুগ যুগ ধরিয়া দেখা গিয়াছে যে, তোতা বুলবুল প্রভৃতি পাখী মানুষের সুরেলা কণ্ঠের সুমিষ্ট গান শুনিবার জন্যে থামিয়া দাঁড়ায়। এমনকি প্রাণী বিশেষজ্ঞগণ বর্ণনা করিয়াছেন যে, কোন কোন কীট যেমন মৌমাছি, মধুর সুর শুনিয়া নাচিতে থাকে। কেহ কেহ গান শুনিবার কালে সাপকে নাচিতে দেখিয়াছেন। হযরত দাউদ (আঃ) বিভিন্নরূপ বাদ্যযন্ত্র বাজাইয়া উহার সুললিত সুরের সহিত তাল মিলাইয়া যবুর কিতাব তিলাওয়াত করিতেন। হযরত দাউদ (আঃ)-এর গীতিগ্রন্থ ব্যতীত বনী ইসরাঈলের প্রতি অক্কীর্ণ বলিয়া কথিত কিতাবসমূহের মধ্য হইতে কোন কিতাবেই আল্লাহ্ তা'আলার মাহাত্ম্য, পবিত্রতা ও প্রশংসা দেখিতে পাওয়া যায় না। উল্লেখযোগ্য যে, বনী ইসরাঈলের প্রতি অবতীর্ণ অন্যান্য আসমানী কিতাব বিকৃত হইয়া গেলেও উক্ত গীতসমূহ অবিকৃত রহিয়াছে । উক্ত গীতাবলীর শেষাংশে উহা সুরের সহিত গাহিবার নির্দেশ রহিয়াছে। আমরা অনেক খৃস্টান সাহিত্যিককে সুমধুর সুরের সহিত কুরআন মজীদ তিলাওয়াতকারী ব্যক্তির তিলাওয়াত শুনিতে আগ্রহী দেখিয়াছি। তাহারা মানুষের হৃদয়ে এইরূপ তিলাওয়াতের সুদূরপ্রসারী সুপ্রভাব ও সুপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি কবিরার অনন্য সাধারণ ক্ষমতার কথা স্বীকার করিয়াছেন ৷ সহীহ হাদীস দ্বারা জানা যায় যে, মক্কার মুশরিকগণ হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)-কে মসজিদুল হারামে সালাত আদায় করিতে দিত না। ইহাতে তিনি নিজ গৃহেই সালাত আদায় করিতেন। তাহারা দেখিল, সালাতে হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রাঃ)-এর কুরআন তিলাওয়াত শুনিবার জন্যে সর্বশ্রেণীর মানুষ বিশেষত নারী ও শিশুগণ তাঁহার নিকট জড়ো হয় এবং তাঁহার কিরাআত তাহাদের অন্তরে গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এই কারণে তাহাদের সিদ্ধান্ত হইল, তাহারা তাঁহাকে সালাতে শব্দ করিয়া কুরআন তিলাওয়াত করিতে বাধা দিবে। কোন কোন পাশ্চাত্য পণ্ডিত উপলব্ধি করিতে পারিয়াছেন যে, আরবের লোকদিগকে ইসলামের পতাকাতলে টানিয়া আনিবার পশ্চাতে নবী করীম হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সাঃ)-এর কুরআন তিলাওয়াতের

হযরত ইব্‌ন আব্বাস (রাঃ) হইতে ধারাবাহিকভাবে ইব্‌ন আবূ মুলায়কাহ, উবায়দুল্লাহ্ ইব্‌ন আখনাস, রওহ, মুহাম্মদ ইব্‌ন মুআম্মার ও হাফিজ আবূ বকর বায্যার বর্ণনা করিয়াছেন ;

(চলমান) بالقرآن নামক কবিতায় নিম্নোক্ত কয়টি চরণে শব্দের বিভিন্নরূপ ব্যাখ্যার সমাবেশ ঘটাইয়াছেন । তিনি ব্যাখ্যাকারদের সকল ব্যাখ্যাকেই সঠিক রাখিয়া কবিতাচরণ কয়টি দ্বারা হাদীসটির ব্যাখ্যা বর্ণনা করিয়াছেন । কবিতাচরণ কয়টি এইঃ تغن بالقرآن حسن به ـ الصوت حزينا جاهزار فم - واستغن عن كتب الالى طالبا غنى يدو النفس ثم الزم - অর্থাৎ সুমধুর সুরে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করো; বিনম্র, চিন্তাশীল ও অহংকার বর্জিত হইয়া উহা সুরেলা কণ্ঠে আবৃত্তি কর; আর পার্থিব সম্পদ লাভ করিবার সহায়ক কিতাবসমূহ হইতে অমুখাপেক্ষী হইয়া যাও। উহাতে বাহিরের এবং অন্তরের সকল অভাব হইতেই মুক্তি নিহিত রহিয়াছে। উহাতে সেই মুক্তি অন্বেষণ কর ও উহা আঁকড়াইয়া থাকো। অতঃপর হাফিজ ইব্‌ন হাজার বলেন- শীঘ্রই স্বতন্ত্র পরিচ্ছেদে সুমধুর সুরের সহিত সম্পর্কিত বিষয়সমূহ লইয়া আলোচনা করা হইবে। ইহাতে সন্দেহ নাই যে, মানুষের হৃদয় সুরবিহীন আবৃত্তির প্রতি যতটুকু পরিমাণে আকৃষ্ট হইয়া থাকে, সুরযুক্ত আবৃত্তির প্রতি তদপেক্ষা অধিকতর পরিমাণে আকৃষ্ট হইয়া থাকে ৷ কারণ, সুরের মধ্যে হৃদয় বিগলিত করিয়া দিবার এবং চক্ষু অশ্রুসিক্ত করিয়া দিবার মত দুর্নিবার সূক্ষ্ম শক্তি রহিয়াছে। সকল মাযহাবের ফকীহ ও আলিমগণ এই বিষয়ে একমত যে, সুললিত ও সুমিষ্ট কণ্ঠে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করা জায়েয ও শরীআতসম্মত। বরং কর্কশ ও রুক্ষ্ম সুরে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করা অপেক্ষা সুললিত ও সুমিষ্ট কণ্ঠে উহা তিলাওয়াত করা শ্রেয়তর। তবে সুর ও রাগ-রাগিণীর সহিত কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করা জায়েয ও শরীআতসম্মত কিনা এই বিষয়ে ফকীগণের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে ৷ আবদুল ওহাব মালিকী বলেন, ইমাম মালিক বলিয়াছেন যে, সুর ও রাগ-রাগিণীর সহিত কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করা হারাম । আবূ তাইয়েব তাবারী, ফিকাহবিদ মাওয়ার্দী এবং ইব্‌ন হামদান ও একদল ফকীহ হইতে অনুরূপ ফতওয়া বর্ণনা করিয়াছেন। মালিকী মাযহাবের ইবন বাত্তাল, কাযী ইয়ায ও ইমাম কুরতুবী; শাফেঈ মাযহাবের মাওয়ার্দী, বান্দানীজী ও ইমাম গাযযালী; হাম্বলী মাযহাবের আবূ ইয়ালা ও ইব্‌ন উকায়েল এবং হানাফী মাযহাবের 'যাখীরাহ' গ্রন্থের রচয়িতা উহা মাকরূহ ও অপছন্দনীয় বলিয়াছেন। পক্ষান্তরে ইব্‌ন বাত্তাল একদল সাহাবী ও তাবেঈ হইতে বর্ণনা করিয়াছেন যে, তাঁহারা উহা জায়েয ও শরীআত সম্মত বলিয়াছেন। ইমাম শাফেঈ হইতেও অনুরূপ অভিমত বর্ণিত হইয়াছে। ইমাম তাহাবী হানাফী মাযহাবের ফকীহগণ হইতে অনুরূপ ফতওয়া বর্ণনা করিয়াছেন । শাফেঈ মাযহাবের ফকীহ ফাওরানী 'ইবানাহ' নামক পুস্তকে বলেন- উহা জায়েয ও শরীআতসম্মত; বরং উহা মুস্তাহাব বটে । উপরে যে অভিমতের কথা বর্ণিত হইল, উহা ততক্ষণ প্রযোজ্য হইবে, যতক্ষণ না তিলাওয়াতের সুর ও রাগ-রাগিণী কোন শব্দ বা অক্ষরের উচ্চারণকে বিকৃত করিয়া দেয়। অন্যথায় উহা সর্ববাদীসম্মতরূপে নাজায়েয ও হারাম। আল্লামা নববী স্বীয় 'তিবইয়ান' পুস্তকে ফকীহগণের উপরোক্ত সর্বসম্মত রায়ের কথা উল্লেখ করিয়াছেন । তাঁহার বর্ণনা নিম্নরূপঃ “শব্দ ও অক্ষরের উচ্চারণে কোনরূপ বিকৃতি না ঘটাইয়া সুমধুর ও সুললিত কণ্ঠে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করা যে মুস্তাহাব এই বিষয়ে ফকীহগণ একমত। আবার তদ্রুপ তিলাওয়াতে শব্দ ও অক্ষরের উচ্চারণে কোনরূপ বিকৃতি আসিলে উহা যে হারাম হইবে এই বিষয়েও ফকীহগণ একমত । পক্ষান্তরে সুর ও রাগ-রাগিণীর সহিত কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করাকে ইমাম শাফেঈ একস্থানে জায়েয ও অন্যস্থানে মাকরূহ বলিয়াছেন। ইমাম শাফেঈর মতের এই বৈচিত্র্য সম্বন্ধে তাঁহার অনুসারীগণ বলিয়াছেন যে, একইরূপ তিলাওয়াতকে ইমাম শাফেঈ কখনও জায়েয আবার কখনও মাকরূহ বলিয়াছেন, ইহা ঠিক নহে; বরং তিনি দুইরূপ তিলাওয়াতের একটিকে জায়েয এবয়ং অন্যটিকে মাকরূহ বলিয়াছেন। সুর ও রাগ-রাগিণীর তাল ও লয়ের কারণে যদি শব্দ ও অক্ষরের উচ্চারণ বিকৃত হইয়া না পড়ে, তবে ইমাম শাফেঈর মতে উহা জায়েয। পক্ষান্তরে, সুর ও রাগ-রাগিণীর তাল ও লয়ে পড়িয়া যদি শব্দ ও অক্ষরের উচ্চারণ বিকৃত হইয়া পড়ে, তবে ইমাম শাফেঈর মতে উহা নাজায়েয ও হারাম।

নবী করীম (সাঃ) বলিয়াছেন- ‘যে ব্যক্তি কুরআন মজীদ সুরের সহিত তিলাওয়াত করে না’ (لم يتغنى بالقران) সে আমাদের দলের অন্তর্ভুক্ত নহে। অতঃপর হাফিজ আবূ বকর মন্তব্য করিয়াছেন যে, ‘আমাদের অভিমতের পক্ষে প্রমাণ হইতেছে ইতিপূর্বে আমি যে হাদীস বর্ণনা করিয়াছি তাহা। আর এই হাদীসের ব্যাপারে বলা যায় যে, উহার অন্যতম রাবী ইব্‌ন আবূ মুলায়কার সত্যবাদিতা সম্বন্ধে সনদ বিশেষজ্ঞ ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রহিয়াছে।

উক্ত হাদীস আবূ লুবাবাহ হইতে ইব্‌ন আবূ মুলায়কা ও তাঁহার নিকট হইতে আবদুল জব্বার ইব্‌ন বিরদ্ বর্ণনা করিয়াছেন। উহা সা’দ হইতে ইব্‌ন আবূ নুসায়েক, তাহার নিকট হইতে ইব্‌ন আবূ মুলায়কা, তাহার নিকট হইতে আমর ইব্‌ন দীনার ও লায়ছ বর্ণনা করিয়াছেন। উহা হযরত আয়েশা (রাঃ) হইতে পর্যায়ক্রমে আবূ মুলায়কা ও আসাল ইব্‌ন সুফিয়ান বর্ণনা করিয়াছেন। উহা হযরত ইব্‌ন যুবায়র (রা) হইতে যথাক্রমে ইব্‌ন আবূ মুলায়কা ও হযরত ইব্‌ন উমর (রাঃ)-এর মুক্ত গোলাম নাফে’ বর্ণনা করিয়াছেন। (দেখা যাইতেছে, উহার প্রতিটি সনদেই বিতর্কিত রাবী ইব্‌ন আবূ মুলায়কা উপস্থিত রহিয়াছে।)

ফিকাহবিদ মাওয়ার্দী ইমাম শাফেঈ হইতে বর্ণনা করিয়াছেন যে, ইমাম শাফেঈ বলেন- সুর ও রাগ-রাগিণীর সহিত কুরআন তিলাওয়াত করিতে গিয়া কেহ যদি শব্দ ও অক্ষরের উচ্চারণ বিকৃত করিয়া দেয়, তবে উহা নাজায়েয ও হারাম হইবে। হাম্বলী মাযহাবের ইব্‌ন হামদানও স্বীয় ‘রিআয়াহ' পুস্তকে (ইমাম শাফেঈ হইতে) অনুরূপ অভিমত বর্ণনা করিয়াছেন। শাফেঈ মাযহাবের ইমাম গায্যালী ও বান্দানীজী এবং হানাফী মাযহাবের 'যাখীরাহ' গ্রন্থের প্রণেতা বলেন- যে সুর ও রাগ-রাগিণীর কারণে কুরআন মজীদের শব্দের উচ্চারণ বিকৃত হইয়া যায় না, সেই সুর ও রাগ-রাগিণীর সহিত কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করা মুস্তাহাব। পক্ষান্তরে যে সুর ও রাগ-রাগিণীর কবলে পড়িয়া উহার শব্দের উচ্চারণ বিকৃত হইয়া যায়, সেই সুর ও রাগ-রাগিণীর সহিত উহা তিলাওয়াত করা নাজায়েয ও হারাম। রাফেঈ একটি অদ্ভুত বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি আমালী সারাখসী হইতে বর্ণনা করিয়াছেন যে, সুর ও রাগ-রাগিণীর সহিত কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করা সর্বাবস্থায় জায়েয ও শারীআতসম্মত । ইব্‌ন হামদান ও হাম্বলী মাযহাবের একদল আলিম হইতে অনুরূপ অভিমত বর্ণনা করিয়াছেন। উহা একটি স্বল্প সমর্থিত অভিমত। উহা গ্রহণযোগ্য নহে। সারকথা এই যে, দলীল প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মধুর কণ্ঠস্বরে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করা শরীআতের নিকট কাম্য ও অভিপ্রেত। কাহারও কণ্ঠস্বর মধুর না হইলে যথাসম্ভব মধুর কণ্ঠে তিলাওয়াত করিবার জন্যে তাহাকে চেষ্টা করিতে হইবে। ইতিপূর্বে বর্ণিত এতদসম্পর্কিত একটি হাদীসের অন্যতম রাবী ইব্‌ন মুলায়কা অনুরূপ কথাই বর্ণনা করিয়াছেন। ইমাম আবূ দাউদও সহীহ সনদে ইব্‌ন মুলায়কার মাধ্যমে উহা বর্ণনা করিয়াছেন। কণ্ঠস্বরকে শ্রুতিমধুর করিতে হইলে সুরবিধিও মানিয়া চলিতে হয়। কারণ, সুরবিধির অনুসরণ কর্কশ কণ্ঠস্বরকে সুমধুর করিয়া দিতে না পারিলেও উহা কণ্ঠস্বরের মধ্যে কিছুটা মাধুর্য আনিয়া দিতে পারে। আর এইরূপে একটি কর্কশ কণ্ঠস্বরের কর্কশতা উহা দ্বারা কিয়ৎ পরিমাণে দূরীভূত হয়। অবশ্য শব্দ ও অক্ষরের সঠিক ও শুদ্ধ উচ্চারণ হইতেছে অপরিহার্য বিষয়। সুর বা স্বরকে মধুর করিতে গিয়া যদি কেহ শব্দ ও অক্ষরের উচ্চারণ বিকৃত করিয়া দেয়, তবে তাহার সেই সুর ও স্বর হারাম ও শরীআত বিরোধী হইবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, যাহারা সুরবিধি পালনে তৎপর থাকে, তাহারা শব্দ তথা অক্ষরের উচ্চারণ-বিধি লঙ্ঘনেও তৎপর থাকে। সম্ভবত উক্ত কারণেই একদল ফকীহ সুর ও রাগ-রাগিনীর সহিত কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করা অপছন্দ করিয়াছেন। অবশ্য শব্দের উচ্চারণ শুদ্ধ ও সঠিক রাখিয়া সুরের সহিত কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করা যে শ্রেয়তর, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।
error: Content is protected !!