যুগের সঙ্গে পা মিলিয়ে আমাদের সমাজ কাঠামোর, আমাদের ‘সিস্টেম’ –এর শরিক শক্তিগুলো কুসংস্কারের বিরুদ্ধে হুংকার-টুংকার দিচ্ছে, এমন কি কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতেও এগিয়ে আসছে। বেতারে, দূরদর্শনে, পত্র-পত্রিকায় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, যুক্তির পক্ষে অনেক কিছু প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু সবটাই ‘বজ্র’ আঁটুনি ফস্কা গেরো’। এরা প্রত্যেকেই একই সঙ্গে যুক্তির পক্ষেও বলে, আধ্যাত্মিকতার পক্ষেও বলে। এইসব সরকারি ও বাণিজ্যিক প্রচারমাধ্যমগুলোর সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি- ‘কুসংস্কার’ ও ‘অধ্যাত্মবাদ’কে দুটি অসম্পর্কিত, ভিন্নতর বিষয় হিসেবে মানুষের সামনে নানাভাবে লাগাতার প্রচার রাখা। এরা চায় কুসংস্কার, অধ্যাত্মবাদী চিন্তার (যা ভক্তিবাদী ও বিশ্বাসবাদী চিন্তার জনক) মূলস্রোত বা অন্যতম মূল শিকড় আত্মার অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে।এরা জানে, আত্মার অমরত্বকে মানুষের চিন্তায় বাঁচিয়ে রাখতে পারলে কুসংস্কার বিদায়ের নামে যতই অলৌকিক বাবাদের রহস্য উন্মোচিত হতে থাক না, তবু বহু মানুষই ভাববে- এরা বুজরুক হলেও আধ্যাত্মিক শক্তিতে বলীয়ান, ঈশ্বরের শক্তিতে শক্তিমান মানুষও নিশ্চয়ই আছেন। আর বিভূতি দেখানো অবতার যদি নাও থাকেন, তাতেই বা কি প্রমাণিত হয়?

বিভূতি দেখানোকে ঘৃণা করা রামকৃষ্ণের মত অবতারও তো আছেন? (রামকৃষ্ণদেব বিবেকানন্দের কপালে আঙ্গুল ঠেকিয়ে যা দেখিয়েছিলেন, তার ব্যাখ্যা মনোবিজ্ঞানে থাকলেও অধ্যাত্মবাদীদের সংজ্ঞা অনুসারে তাকে বিভূতি না বলে উপায় কি? রামকৃষ্ণদেব যা করেছিলেন তেমনটি শুধু রামকৃষ্ণদেবের মত আধ্যাত্মিক নেতাদের পক্ষেই দেখানো সম্ভব, এমনটি যারা মনে করেন, তাঁরা মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের কাজ-কর্ম বিষয়ে ওয়াকিবহাল নন বলেই এমন ভুল ধারণা পোষণ করেন। অনেক মনোরোগ চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীর পক্ষেই কারুকে অলীক কিছু দেখানো, অলীক কিছু শোনানো ইত্যাদি সম্ভব, বিজ্ঞানের সাহায্যেই সম্ভব। জাহির করার তাগিদে নয়, বক্তব্যের প্রতি পাঠক-পাঠিকাদের প্রত্যয় আনতে বিনয়ের সঙ্গেই বলছি এমনটা বার বার ঘটাতে আমিও পারি। এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করার ইচ্ছে আছে ‘আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না’ নামে প্রকাশিতব্য বইটিতে।

আত্মা অমর হলে মৃত্যুর পর স্বর্গলাভের হাতছানি থাকে ; থাকে পরের জন্মে অপার সুখের প্রতিশ্রুতি। আর তার জন্য এই জন্মে যেটুকু করতে হয়, তা হল- হাঁসি মুখে গতজন্মের কর্মফলকে মেনে নেওয়া।

আমাদের সমাজে কাঠামোর শরিক শক্তিগুলো ও প্রচার-মাধ্যমগুলোর এমনতর বিচিত্র-দ্বিচারী ভূমিকার সঙ্গে কারও স্পষ্টতর পরিচয় না থাকলে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, বা আমার কথাকে ‘তিলকে তাল’ বানানো মনে হতে পারে ; কিন্তু এটাই বাস্তব সত্য। প্রচারমাধ্যমগুলোর কাজ-কর্মকে অনেক বছর ধরে খুব কাছ থেকে খুঁটিয়ে দেখার সুযোগ পাওয়ার সুবাদে আজ এই কথাগুলো বলা। একের পর এক তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা লিখতে একটা নধর বই-ই হয়ে যাবে। এখানে উদাহরণ হিসেবে সাম্প্রতিকতম ঘটনাটির কথা বলছি।

 

আকাশবাণীর করিশমা

৩০ আগস্ট ৯৮ আকাশবাণী কলকাতা ‘ক’ থেকে সকাল ৭-২০ মিনিটে আমার একটি কথিকা প্রচারিত হওয়ার কথা স্থানীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত হয়েছিল। কথিকার শিরোনাম ছিল, ‘বিজ্ঞান বনাম কুসংস্কার’। কিন্তু সেদিন কথিকাটি প্রচারিত হয়নি। কেন হয়নি? কারও রেকর্ডিং হয়নি। কেন রেকর্ডিং হয়নি? সে কথাতে আসছি এবার।

প্রথামত রেকর্ডিং-এর আগে ‘স্ক্রিপ্ট’টা পড়তে নেন আকাশবাণীর বিজ্ঞান বিভাগের সহ-প্রযোজক সুনীলরঞ্জন দত্ত। স্ক্রিপ্টের শুরুতে ছিল ‘বিজ্ঞান’ ও ‘কুসংস্কার’ শব্দ দুটির আভিধানিক সংজ্ঞা। যেখানে লিখেছিলাম, “কুসংস্কার শব্দের অর্থ-ভ্রান্ত ধারণা, যুক্তিহীন ধারণা, যুক্তিহীন ধর্মীয় বিশ্বাস”। এই অংশটি নিয়ে সুনীলবাবু আপত্তি জানালেন এবং “যুক্তিহীন ধর্মীয় বিশ্বাস”। এই অংশটি নিয়ে সুনীলবাবু আপত্তি জানালেন এবং “যুক্তিহীন ধর্মীয় বিশ্বাস”। এই অংশটি নিয়ে সুনীলবাবু আপত্তি জানালেন এবং “যুক্তিহীন ধর্মীয় বিশ্বাস” লাইনটা কাটতে বলে বললেন, যতগুলো অভিধানেই এ’কথা লেখা থাক না কেন, এমন কথা তাঁর প্রচার করতে দেবেন না।

প্রযোজক নুরুল আলম ইতিমধ্যে লেখাটায় তাঁদের পক্ষে অস্বস্তিকর কিছু আছে অনুমান করে স্ক্রিপ্টে নিজেও চোখ বুলিয়ে বললেন, “যেখানে এ’দেশে রাষ্ট্রপতি মাথা ন্যাড়া করে আসছেন ধর্মীয় বিশ্বাসে, সেখানে আমরা তারপর ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বলি কি করে?”

স্ক্রিপ্টের আরও একটি অংশে ছিল,

“ ‘কুসংস্কার মানি না’, বলতে পারাটা আজকাল স্মার্ট
হওয়ার ভান হয়ে দাঁড়িয়েছে, এঁদের অনেকেই বিশ্বাস
করেন- আত্মা অমর ! মা-বাবার মৃত্যুর পর তাই শ্রাদ্ধ
করেন, পিন্ড দেন। এই শ্রাদ্ধকারীদের অনেকেই আবার
‘ভূতে ভর’কে ‘গেঁয়ো ধারণা’ বলে নাক সিটকোন !”

সুনীলবাবু এক লাইনগুলো কাটতে বলে বলেন, ‘আজকে প্রাইমিনিস্টার স্পেশাল প্লেনে করে গিয়ে কি এক  মাতাজীর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান অ্যাটেন্ড করছেন ; সেখানে আমরা শ্রাদ্ধকে কুসংস্কার বলে প্রচার করতে পারি না।“

সুনীলবাবু আমার লেখা থেকে ধর্ম ও শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের কথা বাদ দিতে অনুরোধ করে বলেন, “আমাদের সাবজেক্টটা আছে ‘বিজ্ঞান বনাম কুসংস্কার’। আমরা যেটাকে হাইলাইট করি বারবার, সেটা যেমন- গ্রহণের সময় খাবার-দাবার ফেলে দেওয়া হয় ; আমরা বলছি, এটা ঠিক নয়। আমরা বলব- আজকে অমুক তারিখ পূর্ব দিকে যাত্রা নিষেধ বা পশ্চিম দিকে মাথা দিয়ে শুলে শরীর খারাপ হবে, এগুলো কুসংস্কার ; কারণ এই ধারণাগুলো বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে তৈরি হয়নি। আমি বলছি- এই কথাগুলোকে আপনি হাইলাইট করুন।“

নুরুল আলম অনুরোধ করলেন স্ক্রিপ্টে ওসব পাল্টে হাঁচি-টিকটিকি অযাত্রাদর্শন ইত্যাদি প্রসজ্ঞ আনতে। শ্রীআলমের মতে- এইসব কুসংস্কারই মানুষের বেশি ক্ষতি করছে। আত্মা অমর কি না, তাতে মানুষের ক্ষতি-বৃদ্ধি কি?

উত্তরে বলেছিলাম, আমি ওঁদের সঙ্গে একমত নই। আমি মনে করি- ‘আত্মা অমর’ এই চিন্তার সূত্র ধরেই কর্মফল, ভাগ্য, পরজন্ম, স্বর্গ-নরক, পরলোক, পরলোকের বিচারক ঈশ্বর ইত্যাদি অলীক বিশ্বাস টিকে আছে। তার ফলে বঞ্চিত মানুষ বঞ্চনার কারণ হিসেবে সমাজের দুর্নীতি চক্র কিছু মানুষ বা সিস্টেমকে দায়ী না করে দায়ী করেছেন ভাগ্য, কর্মফল ঈশ্বরের কৃপা না পাওয়া ইত্যাদিকেই। আরও একটা কথা কি জানেন, কোনও বড় মাপেরত মন্ত্রী-টন্ত্রী মঘা ত্র্যহস্পর্শ-হাঁচি-কাশি-টিকটিকির ডাক ইত্যাদি মানেন, খবর পেলে আপনারা তো রেকর্ডিং-এর পরেও তার প্রচার বন্ধ করে দেবেন। অতএব আমি আমার স্ক্রিপ্টটাই তুলে নিচ্ছি। প্রচার করতে চাইলে এই অপরিবর্তিত স্ক্রিপ্টই আপনাদের প্রচার করতে হবে।

ঘটনাটা জানার পর কেউ বলতে পারেন- সুনীলরঞ্জন এবং নুরুল আলম তো প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে মুখ খুলতেও পিছ-পা হননি ! আসলে এই সরকারের রেডিও পলিসির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে তো ওঁদের চাকরি করতে হবে !

এই জাতীয় বক্তব্যের উত্তরে জানাই, নুরুল আলম, সুনীলরঞ্জন সরকারি আমলা, যারা জানেন সরকারের চাওয়টাকে যে কোনও কৌশলে পাইয়ে দেওয়াটাই আমলার কার্যদক্ষতার মাপকাঠি। প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে কিছু বলে আমার আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে যদি আমাকেও সরকারি নীতি বা কৌশলকে কার্যকর করার কাজে লাগানো যেত- তাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষতির চেয়ে লাভের পরিমাণই হত ভারী। ক্ষতির কথাটা লেখাই আমার ভুল হয়েছে। ক্ষতিটা কোথায়? প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির এই জাতীয় কুসংস্কার পালনের খবরটা আমার কাছে নতুন নয়- এটা সুনীলবাবু, নুরুলবাবুর অজানা থাকার কথাও নয়। সুনীলবাবু ও নুরুলবাবু বাস্তবিকই আন্তরিকতার সঙ্গে রাষ্ট্রপ্রধানদ্বয়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে চাইলে আমার কাছে ফিসফিস না করে তাঁদের হাতের প্রচার মাধ্যমগুলোকেই কাজে লাগাতে সচেষ্ট হলেন না কেন? কেন উল্টে আমার বক্তব্যকে সেনসর’ করতে চাইলেন? কারণ একটিই- তাঁরা আমাদের সমাজ-কাঠামো বা ‘সিস্টেম’কে স্থিতিশীল ও গতিশীল রাখার প্রয়োজনীয় সহায়ক শক্তি। এ’ভাবেই সহায়ক শক্তিগুলো কাজ করে। কেউ কেউ ভাবতে পারেন- এই সরকারের ভূমিকাটাই এমন প্রগতিবিরোধী। অন্য সরকার এলে অন্য রকম হত।

এর উত্তরে জানাই- সমাজে অসাম্য থাকলে যে সরকারই আসুক এমনটাই ঘটে চলবে। এবং যতদিন ধরে ঘটে চলবে, ততদিন সাম্যও আসবে না।

‘সমাজ কাঠামো’ বা সমাজের ‘সিস্টেম’কে জানুন
সুন্দর সমাজ গড়ার স্বার্থে

এই অধ্যায়ের শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত যা বললাম, সেই বক্তব্যকে স্পষ্ট করে বুঝতে গেলে বুঝতেই হবে বর্তমানের এই অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে, যার প্রচলিত নাম ‘সিস্টেম’। আর অসাম্যের এই সমাজ কাঠামো বা ‘সিস্টেম’কে বুঝতে গেলে বুঝতে হবে এই সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক নীতির নিয়ন্তা ধনকুবের গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকার, প্রশাসন-পুলিশ-সেনাবাহিনী, প্রচার মাধ্যম ও বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্ক।

সাম্যের সমাজ গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে অসাম্যের এই সমাজ কাঠামো বা সিস্টেমকে ভাঙতেই হবে। সিটেমে আঘাত করার অর্থ কি, বর্তমান সরকারকে আঘাত করা? সরকারি কাজ-কর্মকে সমালোচনায় সমালোচনায় নাস্তানাবুদ করা? সরকারের বিভিন্ন কাজ-কর্মের বিরোধীতা করা?

না, শুধু তা নয়। সরকার যায়, সরকার আসে। রাজনৈতিক নেতারা গদিতে বসেন, আবার বিদায়ও নেন- কেউই অপরিহার্য নন। কিন্তু অসাম্যের এই সমাজ ব্যবস্থা টিকেই থাকে, রাজনৈতিক দল ও নেতাদের সাম্যের সমাজ গড়ার সমস্ত প্রতিশ্রুতিকে বিশাল এক ঠাট্টা ও ধাপ্পা বলে বার বার প্রমাণ করে দিয়েই টিকে থাকে। এই সমাজ কাঠামোর বজায় রেখে কোনও রাজনৈতিক দল বা নেতার সাধ্য নেই শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার মুখের কথাকে কাজে পরিণত করা। অসাম্যের এই সমাজ কাঠামোয় যে-ই শাসকের আসনে বসবে, সেই অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে, শোষণের সমাজ কাঠামোকে, দুর্নীতির সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রেখেই নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবে। সুতরাং শুধুমাত্র কোনও একটি সমাজ কাঠামোকে পাল্টে ফেলা যায় না, ‘সিস্টেম’কে বদলে দেওয়া যায় না। কারণ এরা রাম, শ্যাম, যদু কি মধু, যেই হোক, গদিতে পাছা ঠেকালেই বলে ‘হালুম’। তারপরই দুর্নীতির থাবা বসিয়ে গরিবের হাড়-মাংস চিবিয়ে খায়।

আমাদের দেশে শোষণ ও বৈষম্যের সমাজ-কাঠামো টিকে আছে দুর্নীতির হাত ধরে। সমাজ কাঠামোটা একটা বিশাল যন্ত্রের মত। এই যন্ত্র গতিশীল রয়েছে, কাজ করে চলেছে যন্ত্রের ভিতরের নানা আকারের চাকার ঘূর্ণনের সাহায্যে। একটি চাকা ঘোরা শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে চাকার দাঁতে দাঁত চেপে গতি পাচ্ছে আর একটি চাকা। তার থেকে আর একটি, তার থেকে আর একটি, আর একটি…। চলছে যন্ত্র। আমাদের সমাজ ব্যবস্থার গোটা যন্ত্রটি যে চলছে, তার নানা মাপের প্রতিটি চাকা ঘোরাচ্ছে দুর্নীতির দাঁত।

আমাদের সমাজ কাঠামোয় শোষণ দুর্নীতির সাহায্যে টিকে থাকলেও তত্ত্বগতভাবে অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থায় দুর্নীতি শোষণ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই দেশের আইনের মূল ধারাগুলো তৈরি করা সম্ভব, এবং প্রায়শই তেমনটা হয়।

আমার এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রশ্ন উঠে আসতেই পারে, উপরের পঙক্তি দু’টিতে আমি যে বক্তব্য রেখেছি, তাতে আপাত স্ব-বিরোধ আছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, আইন শোষকদের পক্ষে রচিত হলে আইন মেনেই তো শোষণ চলতে পারে। দুর্নীতি মানেই তো আইন না মানা- সেটা এ’দেশে চলছে কেন?

উত্তরটা কিন্তু সহজ ও সরল। দুনীয়ার ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতির মধ্য থেকে সংগ্রহ করলেই দেখতে পাবেন, উত্তন দেশে ধনীক শ্রেণী আমাদের দেশের তুলনায় অনেক বেশি স্বাবলম্বী। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সে দেশের শোষণ প্রক্রিয়া অনেক সুশৃঙ্খল, এ’দেশের মত ব্যাপক দুর্নীতির লুঠ-তরাজ নেই।

এ’দেশের সমাজ কাঠামোয় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে শোষক ও শোষিত দুই শ্রেণীই। দুর্নীতিগুলো কি ভাবে দুই বিপরীত শ্রেণীর মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে, কেন ছড়িয়ে পড়েছে, এ নিয়ে অতি সংক্ষেপে একটু আলোচনা করে নিই আসুন।

একঃ শোষক প শাসকশ্রেণী নিরপেক্ষতার মুখোশ পরার জন্য বা জনগণের লড়াইয়ের জন্য যেটুকু ছিটেফোঁটা অধিকারের প্রতিশ্রুতি শোষিত জনগণকে দিতে বাধ্য হয়, সেগুলো তারা নিজেরাই ভঙ্গ করে সমাজে দুর্নীতির পরিমণ্ডলের সাহায্য নিয়ে। সুতরাং এ’দিক দিয়ে দুর্নীতির পরিমণ্ডল টিকিয়ে রাখা তাদের পক্ষে অত্যন্ত জরুরি।

দুইঃ নির্দিষ্ট আইনকানুন মেনে শোষণ করে যত দ্রুত ধনী হওয়া সম্ভব, তার চেয়ে, অনেকগুণ তাড়াতাড়ি ধনী হওয়া সম্ভব আইন-কানুন ভেঙ্গে। এ’ভাবেই আম্বানি, হর্ষদ মেহেতাদের মত অখ্যাত মধ্যবিত্তরা কয়েক বছরে দেশের সেরা ধনী হয়ে উঠেছে। এ’ভাবেই উঠে আসছে ঝাঁক-ঝাঁক ধনী, যারা কয়েক বছর আগেও ছিল অজ্ঞাত কুলশীল। এ’ভাবেই ছাপড়ার বেড়ার ঘরে বাস করা রাজনৈতিক নেতা কয়েক বছরে কোটিপতি হয়েছে, কোটিপতি হয়েছে দাউদ ও রশিদের মত বস্তি থেকে উঠে আসা সমাজবিরোধীরা। এ’ভাবেই পুলিশ ও বিভিন্ন প্রশাসনের অনেক বড়-মেজ কর্তারা মধ্যবিত্তের খোলস ছেড়ে রাতারাতি কোটিপতি হয়েছে। এঁদের দ্রুত ধনী হয়ে ওঠার মূল-মন্ত্র একটিই- ‘দুর্নীতি’।

তিনঃ শোষিত শ্রেণীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তুঙ্গে উঠলে তাকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেবার জন্য প্রয়োজন হয় অবাধ বলপ্রয়োগ ও নিপীড়নের। আইনের কাঠামোর মধ্যে তা সম্ভব নয়। সুতরাং দুর্নীতির সাহায্য নিয়েই সেই অসম্ভবকে সম্ভব করা হয়।

এ’সবই শোষক ও তার সহায়ক শক্তির মধ্যেকার দুর্নীতি। কিন্তু শোষিতদের মধ্যেও যে দুর্নীতির ব্যাপক গণভিত্তি থাকে, তার কার্য-কারণ এ’বার সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।

একঃ শোষিতদের কাছে দুর্নীতির সুযোগ তীব্র শোষণের মধ্যেও খানিক ‘উপশম’ ও ‘আনন্দ’ –এর দখিনা হাওয়া বয়ে আনে। অচেনা লোক দেখে রিক্সাওয়ালা দু’টাকা ভাড়াকে চার টাকা বলে, ট্যাক্সি ড্রাইভার নতুন যাত্রী পেলে দু’কিলোমিটারের পথ যেতে কুড়ি কিলোমিটার ঘোরে, ‘ঋণ-মেলা’ থেকে ঋণ নিয়ে সুযোগ থাকলেও ঋণ শোধ করতে ব্যাঙ্কের দরজার দিকে আর পা মাড়ায় না অনেক গরিবই। এমন উদাহরণ অবিরল ধারায় হাজির করা যায়। এই ধরনের দুর্নীতি তাই অনেক সময় শোষিত মানুষদের শোষণজনিত ক্ষোভকে সাময়িকভাবে প্রশমিত করে। এই দুর্নীতি শোষিতদের প্রতিবাদের ও প্রতিরোধের গ্লানিময় বিকল্প হিসেবে কাজ করে। [ফলঃ স্থায়ী সমাধানের কষ্টকর সংগ্রাম থেকে বিচ্যুতি]

দুইঃ দমন-পীড়ন-শোষণের দুর্নীতি চালাতে শোষকদের যে লোকবলের প্রয়োজন হয়, তার একটা অংশ সংগ্রহ করা হয় শোষিতদের মধ্যে থেকেই। আর এটা সম্ভব হয়, শোষিতদের মধ্যে দুর্নীতির পরিমণ্ডল গড়ে তোলার ফলে। এই প্রক্রিয়ার ফলে আরও সুবিধে হল, এর ফলে শোষকশ্রেণী নিজেদের পরিবর্তে শোষিতদের ওই অংশকে জনগণের সামনে দমন-পীড়ন-দুর্নীতির মূর্ত প্রতীক হিসেবে তুলে ধরতে সমর্থ হয়, তাদের বিরুদ্ধে মাঝে-মধ্যে জোরাল বক্তব্য রাখা হয়, মাঝে-মধ্যে নেওয়া হয় জোড়াল ব্যবস্থা। এ’ভাবেই ভাঙ্গা হয় বে-আইনি মদের ঠেক, ধরা পড়ে কোটি টাকার সোনা কি হেরোইন, ভাঙ্গা হয় প্রমোটারের বেআইনি কন্সট্রাকশন। এ’সব ধরা পড়া দুর্নীতি শতাংশের একাংশও নয়। দুর্নীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি শোষকশ্রেণী এ’ভাবে শোষিতদের বিভ্রান্ত করে। [ফলঃ সংগ্রামের লক্ষ্যে বিভ্রান্তি তৈরি]

তিনঃ দুর্নীতির দ্বারা অতি সফলভাবে শোষিতশ্রেণীর মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত লোভ ও ভোগবাদের সংস্কৃতির পরিমণ্ডল গড়ে তোলা সম্ভব হয়। [ফলঃ শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে না গিয়ে শোষকশ্রেণীকে সাহায্য করে আগের গোছাতে ব্যস্ত হওয়া]

দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই মানেই অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াই নয়। জ্বলন্ত উদাহরণ তো সামনেই রয়েছে- শেষন ; টি. এন. শেষন। তিনি এ’দেশের নির্বাচন ব্যবস্থার নানা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ছেন। তাঁর এই লড়াই চালিয়ে যাওয়াকে অভিনন্দন জানিয়ে এবং সম্মান জানিয়েও আমরা বলতে পারি, তাঁর এই লড়াই কখনোই অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনও লড়াই নয়। বরং তাঁর এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াকু মেজাজের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে থাকা ঈশ্বর, অবতার, ভাগ্য, কর্মফল ইত্যাদিতে প্রবল বিশ্বাস বহু শোষিত মানুষকে বিভ্রান্ত করবে, লক্ষ্যচ্যুত করবে।

অনেক সময় দুর্নীতি সুশৃঙ্খল এবং শান্তিপূর্ণভাবে শোষণকে চালাতে দেয় না। অনেক সময় ব্যাপক দুর্নীতি জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভও তৈরি করে। ফলে অনেক সময় শোষকরা এবং তাদের তল্পিবাহকরাও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে বাধ্য হয়।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদের সঙ্গে আমাদের প্রতিবাদের পার্থক্যটাই তাই স্পষ্ট করে তোলা একান্তই জরুরি। শোষকশ্রেণী ও তাদের তল্পিবাকরা দুর্নীতির তথাকথিত বিরোধীতা করলেও অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে টিকিয়ে রেখেই তা করেন। আমরা দুর্নীতির বিরোধীতা করি, অসাম্যের সমাজ কাঠামোকে ভাঙ্গার লক্ষ্যে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মীদের বুঝতে হবে, কেন তাঁরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে তাঁদের অন্যতম প্রধান কর্তব্য বলে মনে করবেন।

এই চিন্তার আলোকে আসুন আমরা দেখি, শোষক ধনকুবের গোষ্ঠি যে সিংহাসনে বসে তাদের শোষণ চালায়, সেই সিংহাসনকে দাঁড় করিয়ে রাখা চারটি পায়ার ভূমিকা কে কি পালন করে চলেছে।

error: Content is protected !!