লন্ডন থেকে একটু দূরে এপিং বনভূমির কাছের এক পল্লীর গরিব কৃষকপরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন এক তরুণী, ফরাশি বিপ্লবের থেকেও বিপ্লবাত্মক, ১৭৯১-এ মাত্র ৩২ বছর বয়সে, মাত্র ৬ সপ্তাহে লিখেছিলেন ১৩ পরিচ্ছেদের একটি পারমাণবিক, এখন অমর বই : দি ভিন্ডিকেশন অফ দি ব্লাইট্স্ অফ ওম্যান, বেরিয়েছিলো। ১৭৯২-এ। সেদিন বিশ্বের একটি বড়ো পরিবর্তন ঘটেছিলো। লেখক মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্ট্, এক সময় নিন্দিত, এখন বন্দিত নারীবাদের জননীরূপে। জননী? শব্দটি ঠিক হলো? নারীবাদ কি জরায়ু থেকে উৎপন্ন? এ-প্রথাগত অভিধাটি আজো ব্যবহৃত হয়, তাঁর ক্ষেত্রেও হয়। মননশীল কিন্তু আবেগাতুর, বিয়েবিরোধী কিন্তু প্রেম ও পুরুষের জন্য কাতর, একই সঙ্গে অগ্নিশিখা ও অশ্রুবিন্দু, মেরি নারীবাদের জোয়ান অফ আর্ক, যিনি দেখা দিয়ে, জয় ক’রে, হয়েছিলেন ট্র্যাজেডি। ১৫৭ বছর পর দেখা দেন আরেক নারী, এবার ইংল্যান্ডে নয়, ফ্রান্সে, ১৯৮৯-এ দু-খন্ডে বেরোয় তাঁর ১০০০-এরও বেশি পৃষ্ঠার বইঃ ল্য দ্যকিয়েম সেক্সঃ দি সেকেন্ড সেক্সঃ দ্বিতীয় লিঙ্গ। তিনি সিমোন দ্য বোভোয়ার। তিনিও বন্দিত বিশশতকের নারীবাদের জননীরুপে; তাঁর বইয়ের পংক্তির পর পংক্তি থেকে জন্মেছে আধুনিক নারীবাদের বিচিত্র ধারা, অনুপ্রাণিত হয়েছেন পঞ্চাশ – ষাট ও পরের দশকগুলোর নারীবাদীরা! অ্যালিস শোয়ার্জার, দ্য বোন্ডোয়ারের এক সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী লিখেছেন, ‘পঞ্চাশ ও ষাটের তমসায়, যখন নব নারী আন্দোলন দেখা দেয় নি, তখন দ্বিতীয় লিঙ্গ ছিলো এক গুপ্ত সংকেতবিধির মতো, যার সাহায্যে আমরা নতুন নারীরা পরস্পরের কাছে বার্তা পাঠাতাম। আর সিমোন দ্য বোভোয়ার নিজে, তাঁর জীবন এবং তাঁর কর্ম, ছিলেন এবং আছেন এক প্রতীক হয়ে।’ জননী হওয়ার কোনো ইচ্ছে তার ছিলো না; মেরি তবু দুটি কন্যার জন্ম দিয়েছিলেন, দ্বিতীয়টি জন্ম দিতে গিয়ে চ’লে গিয়েছিলেন পৃথিবী থেকে, মাত্র ৩৮ বছর বয়সে। দ্য বোভোয়ার সন্তানে ও বিয়েতে বিশ্বাস করেন নি; মননশীলতায় তিনি মেরির থেকে প্রায়-বিপরীত মেরুর, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মননশীলতার প্রতিমূর্তি; কিন্তু ভেতরে ভেতরে মিল আছে তাদের; দ্য বোভোয়ার জাঁ-পল সাত্রের সাথে ৫১ বছর কাটিয়েছেন প্ৰেমবন্ধুত্বের সম্পর্কে, অন্য প্রেমেও পড়েছেন, মননশীল বই লেখার ফাঁকে অন্য প্রেমিককে লিখেছেন কাতর পত্র, গর্ভপাত করেছেন। দুজনেই তিরস্কৃত ও নন্দিত হয়েছেন বই প্রকাশের পর; বিরোধীরা মেরিকে বলেছে ‘পেটিকোটপরা হয়েনা’,‘দার্শনিকতাপরায়ণ সৰ্পিণী’; আর দ্য বোভোয়ারের বইয়ের একটি অংশ পত্রিকায় বেরোলে এক ফরাশি লেখক চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন যে তিনি লেখিকার যৌনাঙ্গের বিস্তৃত বিবরণ পেয়েছেন, এবং বই বেরোনোর পর ক্যাথলিকদের ধর্মীয় দুর্গ ভ্যাটিকান তার বই অনৈতিক’ বলে নিষিদ্ধ করে, এক মার্কিন সাংবাদিক অপভাষায় লেখেন লেখিকার যা দরকার, তা হচ্ছে একটা উৎকৃষ্ট সঙ্গম। মেরি প্রচণ্ড বিদ্রোহী, তিনি ভেঙে ফেলতে চেয়েছেন পুরুষের সভ্যতাকে, মুক্তি দিতে চেয়েছেন বন্দী নারীকে; দ্য বোভোয়ার প্রাজ্ঞ, সুধীর, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, কাব্যিক, ব্যাখ্যা ও উদ্ঘাটন করেছেন, অদৃশ্য জীবাণুর মতো পুরুষতন্ত্রের কাঠামোর ভেতরে ঢুকে তাকে জীৰ্ণ করেছেন। মেরি নারীবাদের জোয়ান অফ আর্ক হ’লে সিমোন দ্য বোভোয়ার নারীবাদের আইনস্টাইন। পুরুষের সাথেই তুলনা করতে হলো; তা-ই করতে হচ্ছে, কেননা দ্য বোভোয়ার, এবং সব নারীবাদীই, চান পুরুষের সাথে সাম্য; কেননা পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতায় সার্বভৌম পুরুষই প্রকাশ করে মানবপ্রজাতির সে-বৈশিষ্ট্য, যাকে দ্য বোভোয়ার বারবার বলেন- ‘ট্র্যান্সেন্ডেন্স’ : সীমাতিক্ৰমণতা, আর নারীকে আটকে রাখা হয়েছে ‘ইমানেন্স’-এ : সীমাবদ্ধতায়।
পুরোনাম সিমোন লুসি-এর্নেস্তিন-মারি-বেরত্রা দ্য বোভোয়ার, বিশ্ববিখ্যাত তিনি সিমোন দ্য বোভোয়ার (১৯০৮-১৯৮৬) নামে; তিনি দিয়ে গেছেন চিরকালের শ্রেষ্ঠ নামগুলোর একটি। দ্য বোভোয়ার জন্মেছিলেন প্যারিসে, ১৯০৮-এর ৯ জানুয়ারি মঁৎপারনাসের কাফে দ ল রঁতঁদের ওপরে। বাবা জর্জে বেরত্রা দ্যা বেরঁত্রা দ্য বোভোয়ার ছিলেন আইনজীবী, মা ফ্রাঁসোয়া ব্রাসেয়ো; দুজন ছিলেন দু-রক্ম। দ্য বোভোয়ার ছিলেন পিতাতামার জ্যেষ্ঠ সন্তান, আরেকটি বোন ছিলো তাঁর, তাঁকে অনেকটা পুত্ররূপেই পালম করেন পিতা। তিনি লিখেছেন, “বাবা গর্বের সাথেই বলতো : সিমোনের মগজ পুরুষের; সে পুরুষের মত চিন্তা করে; সে পুরুষ।’’ তিনি বেড়ে উঠেন প্যারিসের চতুর্দশ ‘আঁরোদিসঁমা’বা এলাকায়, যেখানে থেকেছেন প্রায় সারা জীবন। মা ছিলেন গোঁড়া ক্যাথলিক, বাৰা সন্দেহবাদী, প্যারিসীয়; এবং অল্প বয়সেই বোভোয়ার বুঝতে পেরেছিলেন চারপাশের পৱিস্থিতি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯১৪-১৯১৮) পরিবারের আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ হয়ে উঠলে দ্য বোভোয়ার দেখতে পান কী দুঃসহ ক্লাস্তিকার গৃহস্থালির কাজ করতে হয় তাঁর মাকে- যে-ক্লান্তির মর্মস্পশী বর্ণনা দিয়েছেন তিনি দ্বিতীয় লিংগ-এ; তখনই স্থির করেন কখনো গৃহিণী বা মা হবেন না। দ্বিতীয় লিংগ-এ এক তরুনীর কথা বলেছেন তিনি, যে মায়ের ক্লান্তিকর একঘেয়ে গৃহস্থালির কাজ দেখে ভয় পায় যে সেও বাঁধা পড়বে ওই নির্মম নিরর্থক নিয়তিতে, তখনি সে ঠিক করেন ফেলে সে কখনো মা আর গৃহিণী হবে না; ওই তরুণী দ্য বোভোয়ার নিজেই। ১৯২৯-এ ২১ বছর বয়সে সরবনে দর্শনে এগ্রিগেশন পরীক্ষায় পাশ করেন। তিনি; ফ্রান্সে এ-পর্যন্ত তিনিই সবচেয়ে কম বয়সে লাভ করেন। এ-ডিগ্রি। পরীক্ষায় জা-পল সার্ত্র হন প্রথম, তিনি দ্বিতীয়, এবং জড়িয়ে পড়েন প্রেমে, বন্ধুত্ত্বে, এক ব্যতিক্রমী সম্পর্কে, যারা কখনো পরস্পরকে ছেড়ে যান নি, কিন্তু অন্য কারো সাথে না জড়ানোর, শুদ্ধ একনিষ্ঠ দেহ ও মনের সতীত্বের বাধ্যবাধকতায়ও থাকেন নি। সার্ত্রের সাথে দেখা হওয়ার পর বোভোয়ারের জীবন বদলে যায় চিরকালের মতো, এ-সাক্ষাৎ বিশশতকের এক শ্রেষ্ঠ ঘটনা, হয়তো বদলে গিয়েছিলো সার্ত্রের জীবনও, কেননা দ্য বোভোয়ার অস্তিত্ববাদী দর্শনের ‘অপর’ বা আদার’ হয়ে থাকার মতো নারী ছিলেন না।
কিশোরী বোভোয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন যে-ত্রাতার, রাজকুমারের, তাকে তিনি পান সার্ত্রের মধ্যে, এক সুদৰ্শন রাজকুমারের বদলে এক দার্শনিক! বোভোয়ার লিখেছেন : ‘পনেরো বছর বয়সে আমি কল্পনা করেছিলাম যে-ভাবাদর্শ, সার্ত্র হুবহু মিলে যান তাঁর সাথেঃ তিনি আত্মার এমন সঙ্গী, যার মধ্যে আমি পেয়েছি আমার সমস্ত রিপু, যেগুলো এতো উত্তপ্ত হয়ে উঠতো যে পৌছোতো ভাস্থরতায়। তার সাথে আমি অংশীদার হতে পারতাম সব কিছুর।’ এখানে সম্মানসূচক সর্বনাম ব্যবহারের কারণ হচ্ছে ৫১ বছর প্রেমে, মানসিক ও শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে থাকার পরও তারা পরস্পরকে সম্বোধন করতেন ‘আপনি’সর্বনামে। অদ্ভুত লাগে, তাহলে তাদের প্ৰেম, চুম্বন, সঙ্গমও ছিলো দার্শনিক- এক ধরনের বিয়িং অ্যান্ড নাথঃনেস? একসাথে ছিলেন ৫১ বছর, ১৯২৯এ পরিচয় হওয়ার সময় থেকে ১৫ এপ্রিল ১৯৮০তে সার্ত্রের মৃত্যু পর্যন্ত। ঘনিষ্ঠতার পর তাৱা তাদের সম্পর্ক নিয়ে ভাবেন, ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ করেন অস্তিত্ববাদী রীতিতে, সিদ্ধান্তে পৌছেন অভিজ্ঞতা বাড়ানোর জন্যে কখনো কখনো ধরা দেবেন। ‘অনিশ্চিত’ বা ‘আকস্মিক’ বা ‘ঘটনাচক্ৰজাত’ বা ‘কান্টিঞ্জেন্ট’ প্রেমের কাছে, যা অনিবার্য নয়, নিতান্তু আকস্মিক, যা তারা দুজনেই করেছেন, এবং জানিয়েছেন। পরস্পরকে। সার্ত্র অবশ্য লুকোচুরি করেছেন। বিয়ে তাঁদের জন্য সুবিধাজনক হতো আর্থিকভাবে, কিন্তু তারা তা বেচে নেন নি; কেননা বিয়ে, এমনকি একত্রবাস, মানুষের জন্যে ক্ষতিকর, তাতে ‘এক’ আরেককে পরিণত করতে চায় ‘অপর’-এ, এক হয়ে উঠতে চায় কর্তা, অপরকে পর্যবসিত করতে চায় কর্মে। সার্ত্র একটি মেয়ে দত্তক নিয়েছিলেন, বোভোয়ার তাও নেন নি; তিনি যেমন নিজের জরায়ু থেকে একটি নকল দ্য বোভোয়ার প্রসব করতে চান নি, তেমনি চান নি সার্ত্রের একটি প্ৰতিলিপি। ১৯৩০-এর দশকের জন্যে তাঁদের সম্পর্ক ছিলো খুবই অসামাজিক, অপ্রথাগত। এতে বোভোয়ারের পরিবারে নানা গোলমাল দেখা দিয়েছিলো; তাঁরা একসাথেও থাকতেন না, লিভ টুগেদার করতেন না, কেননা এটাও এক ধরনের বিয়ে যা ধ্বংস করে মানুষকে; তবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় স্বল্পকাল একসাথে ছিলেন। পৃথকভাবে থাকতেন তাঁরা, সাধারণত হোটেলে সন্ধ্যায় দেখা করতেন, পড়তেন ও সমালোচনা করতেন পরস্পরের লেখা। যখন বিখ্যাত হয়ে উহেন তাঁরা সাহিত্যজগতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, তাঁদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা অসম্ভব হয়ে ওঠে তাঁদের পক্ষে; তখন তারা সকলের চোখ এড়ানোর জন্যে কাফের পর কাফে বদলাতে থাকেন। বোভোয়ার বেছে নিয়েছিলেন। নারীদের জন্যে প্রথাগত পেশাই, শিক্ষকতা: বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, খুবই ক্ষুদ্র এলাকায়, ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত মার্সেই ও রোয়েঁ-এ লিসে অর্থাৎ ফরাশি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দর্শন পড়াতেন কোন কোন প্লাতো আরিস্ততল? ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৩ পর্যস্ত শিক্ষকতা করেন প্যারিসে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি দেখা দেন অস্তিত্ববাদী আন্দোলনের এক প্রধান রূপে।
তিনি ঘটনা বর্ণনা করতে, দার্শনিক তত্ত্ব তৈরি করতে, এবং স্মৃতিচারণ করতে পছন্দ করতেন, যা তিনি নিন্দে করেছেন দ্বিতীয় লিঙ্গ-এ সীমাবদ্ধ, গৃহবন্দী, নারীদের এক প্রিয় ব্যাপার ব’লে: তিনি বর্ণনা করেছেন ছোটো মেয়ে বোভোয়ার মায়ের সাথে ভোরবেলা যাচ্ছে খ্রিস্টের নৈশভোজের পর্ব উদযাপনে, মাসে; এর মধুর স্মৃতি সত্ত্বেও স’রে আসেন। তিনি ধর্ম থেকে, দেখতে পান ধর্ম একটা ধ্যাপ্পা; বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন তাঁর বিদ্যালয়, ক্যুর আদেলি দেসির, কঠোর নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে, এবং কৈশোরেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন ধর্মে, এটা তাঁর ক্যাথলিক মা ও তাঁর মধ্যে সৃষ্টি করে একটি দেয়াল। মগজ থাকলে হৃদয় থাকবে না। কাম থাকবে না, এটা কোনো কথা নয়; বরং দেখা গেছে মগজি নারীরা প্ৰেমে-কামে অদ্বিতীয়, এটাও এক সৃষ্টিশীলতা; ১৫ বছর বয়সে তার মনে হয় তিনি প্রেমে পড়েছেন খালাতে ভাই শাঁপিনেলের, যে তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। ফ্রান্সের কয়েকজন শ্রেষ্ঠ লেখকের লেখার সাথে; তার মা ওসব বইয়ের আপত্তিকর পাতাগুলো পিন দিয়ে আটকে রাখতেন। শাপিনেলের সাথে প্ৰেম তেতো হয়ে ওঠে, যখন শপিনেলে তার বোহেমীয় জীবন ছেড়ে বিয়ে করে এক ধনী নারীকে, যে নিয়ে আসে একটা বড়ো মাপের পণ। পণের প্রসঙ্গ বারবার এসেছে দ্বিতীয় লিঙ্গ-এ; ফ্রান্সে এটা ছিলো, এবং তিক্তিভাবে ছিলো দ্য বোভোয়ারের মনে।
তিনি নিজের মধ্যে মিলিয়েছিলেন কর্ম ও জ্ঞানকে; তাই তিনি থেকেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কেন্দ্রে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় (১৯৩৯-১৯৪৫) তিনি নাটশি অবরোধের বিরুদ্ধে ফরাশি প্রতিরোধ আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন; এ-অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন লে মাদারে (১৯৫৪) উপন্যাসে। তাঁর উপন্যাস উপস্থাপন করে অস্তিত্ববাদী দর্শনের প্রধান সিদ্ধান্তগুলো, দ্য বোভোয়ার সাহিত্যজীবন শুরু করেছিলেন একগুচ্ছ উপন্যাস দিয়ে। তাঁর প্রথম উপন্যাস ল এভিতে (১৯৪৩: সে থাকতে এসেছে) এটিতে ব্যক্ত হয়েছে যে-দর্শন তা দেখা যায় দ্বিতীয় লিং-এ। এটিতে এক দম্পতির সাথে আরেকটি তরুণী বাস করে দীর্ঘকাল ধরে, এতে তাদের সম্পর্ক কী সূক্ষ্মভাবে ভেঙে পড়ে, তার রূপ দেখিয়েছেন তিনি; এবং দ্বিতীয় লিঙ্গ-এ যা দেখিয়েছেন পাতায় পাতায়। একটি সত্তার সাথে আরেকটি সত্তার সম্পর্কের সমস্যা, যাতে একটি সত্তা মৌলরুপে হয়ে উঠে খাদক, অন্যটি হয়ে ওঠে খাদ্য, শিকারী ও শিকার, এর বিকাশ ঘটে এ-উপন্যাসেই। এর ঘটনা এসেছে বোভোয়ার ও সার্ত্রের ব্যক্তিগত জীবন থেকেই, নিজের জীবনকে তিনি পরিণত করেন উপন্যাস : সার্ত্রের তরুনী ছাত্রী, ওলগা কোসাকিওইজ, থাকতো তাঁদের সাথে, থাকার মধ্যে ছিলো একটা প্রথাবিরোধী চুক্তি, যা রূপ নেয় উপন্যাসে। দ্বিতীয় উপন্যাসে, অন্যদের রক্ত-এ, আর ব্যক্তিগত জীবন নয়, বিষয় হয় দার্শনিক সমস্যা; এর নায়িকা হেলেন বেরত্রা যখন দেখে একটি ছোটো ইহুদি মেয়েকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে গোস্টাপোরা, সে তখন অংশ নেয়। ফ্রান্সে জর্মন অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধসংগ্রামে, এবং বিশ্বাস পোষণ কয়ে যে হিটলারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার একটিই উপায়ঃ হিংস্ৰতা। যে-অমানবিক হত্যাযজ্ঞ ঘটে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে, তাতে মৃত্যুর প্রতি নিবদ্ধ হয় তার সংবেদনশীলতা, এবং তিনি লেখেন সব মানুষই মরণশীল (১৯৪৬)। এর নায়ক অমর, সে তেরো থেকে বিশশতক পর্যন্ত সাতটি শতাব্দী ভ্ৰমণ করে; এবং উপন্যাসটি বুঝিয়ে দেয় যে অমরতা কোনো সমাধান নয়, মৃত্যু থেকেই উঠে আসে জীবনের অর্থ।
১৯৪৯-এ বেরোয় তাঁর ল্য দ্যজিয়েম সেক্সঃ দ্বিতীয় লিঙ্গ পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতায় অপর, অপ্রয়োজনীয়, খাদ্য, রুদ্ধ, সীমাবদ্ধ, বিকলাঙ্গ, দাসী ও কামসামগ্রির স্তরে থাকার জন্যে দণ্ডিত নারীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে অদ্বিতীয় গ্রন্থ; ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, ও শিল্পসৌন্দর্যে যা অতুলনীয়।
দ্বিতীয় লিঙ্গ-এর পর বোভোয়ার আক্কার ফিরে আসেন উপন্যাসে; লেখেন তার সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস লে মাঁদাঁরে (১৯৫৪: দি মান্ডারিন্স্ : মন্ত্রীরা)। ফরাশি মাদারে শব্দটি নেয়া হয়েছে সংস্কৃত ‘মন্ত্ৰিণ’ থেকে, তবে এটা এখন ঠিক মন্ত্রী বোঝায় না, বোঝায় শিক্ষিত অভিজাতদের। এটির জন্যে তিনি পান প্রি গকুর পুরস্কার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ফরাশি বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে তাদের ‘ম্যান্ডারিন’ মর্যাদা ছেড়ে রাজনীতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছিলো, এটি তার বিবরণে পূর্ণ। অনেকে মনে করে এটি লিখিত সার্ত্র, কাম্যু, ও তার নিজের সম্পর্ক নিয়ে, তবে দ্য বোভোয়ার তা স্বীকার করেন না, যদিও উপন্যাসের ঘটনাগুলোর সাথে মিল আছে তাদের জীবনের। তিনি চারটি দার্শনিক বইও লিখেছেন: এর একটি পুর ওঁয়ে মরাল দ্য ল অ্যামবিগুইতে (১৯৪৭; দ্ব্যৰ্থবোধকতার নীতিশাস্ত্ৰ)। ভ্ৰমণকাহিনীও লিখেছেন দুটি: লা লঁগ মার্শ: এসে সিইর ল চিন (১৯৪৭: দীর্ঘ যাত্ৰা); এবং যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ নিয়ে ল’আমেরিক অ জুত্র দ্য জুর (১৯৪৮ আমেরিকা: দিনের পর দিন)। তারপর বোভোয়ার লিখতে শুরু করেন স্মৃতিকথা, ভঙ্গিতে যেগুলো অভিনব; তাঁর আত্মজৈবনিক বই চারটি : মেমোয়ার দা’ওঁয়ে জোন ফ্রিই রাঁজে কুঁৎ (১৯৫৮; কৰ্তব্যপরায়ণ কন্যার স্মৃতিকথা), ল ফার্স দ্য ল’আজ (১৯৬০; যৌবনকাল, এটি উৎসর্গ করেন সার্ত্রের নামে) ল ফর্স দে শোজে (১৯৬৩:অবস্থার চাপ), এবং তু কঁৎ ফো (১৯৭২: সব বলা ও করা হয়ে গেছে))। এগুলো ব্যক্তিগত ব্যাপার পেরিয়ে হয়ে উঠেছে ১৯৩০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত ফরাশি বুদ্ধুজীবীদের জীবন ও মননের চিত্র। নারীবাদ ছাড়া তার বিশেষ আগ্রহের বিষয় জরায়ণ ও মৃত্যু: হাসপাতালে মায়ের মৃত্যু নিয়ে লেখেন ওয়ে মর্ত ত্রে দুসে (১৯৬৪: একটি খুব সহজ মৃত্যু), বৃদ্ধদের প্রতি সমাজের ঔদাসীন্য সম্পর্কে লেখেন লৈ ভেইয়স। (১৯৭০: বৃদ্ধকাল)। ১৯৮১তে লেলেখেন সার্ত্রের শেষ জীবনের বেদনাদায়ক বিবিরণ ল সেরেমোনি দে অদিয় (বিদায়: সার্ত্রের প্রতি চিরবিদায়)।
দ্বিতীয় লিঙ্গ সম্পর্কে কথা বলার আগে একটি ব্যাপার সম্পর্কে ভাবতে চাই, যা নারী ও পুরুষের জন্যে অশেষ গুরুত্বপূর্ণ, এবং ছিলো দ্য বোভোয়ারের জন্যেও, তা হচ্ছে প্রেম ও শরীর। শেষ জীবনে তাঁর এমন একটি ভাবমূৰ্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিলো যেনো তিনি বিশুদ্ধ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অকম্প্র মূর্তি, তাতে কোনো কামনা বাসনা হাহাকার অশ্রু নেই, তা কখনো কাপে না; তবে তিনি কোনো মর্মরে গঠিত মোমবাতি ছিলেন না। জ্ঞানের সাথে প্ৰেম কাম ক্ৰন্দনের কোনো বিরোধ নেই, বরং জ্ঞানীরা, সৃষ্টিশীলেরাই প্রেম কাম হাহাকারে হতে পারেন অদ্বিতীয়, আর সৃষ্টিশীল নারীরা প্রেমেকামে যে-চুড়ো ছোঁয়, তা পারে না একান্ত নারীধর্মী, সীমাবদ্ধ, পতিদের পরিচারিকা, ও কামসামগ্রি স্ত্রীরা। তারা ক্লান্ত সব কিছুতে, প্রেমেও, কামেও। প্রেম এবং কামও সৃষ্টিশীল ব্যাপার, তাঁর জন্যে প্রতিভা দরকার, তা শুধু যৌনাঙ্গের উত্তেজনা নয়, যদিও ওটা অবশ্যই থাকা দরকার, এবং সঙ্গে দরকার তীব্র মানবিক প্রতিভা; এটা দেখতে পাই সব প্রধান নারী ও পুরুষের মধ্যেই, দেখতে পাই মেরি ওলস্টোনক্রাফটে, যিনি কাঁপতেন প্রেমে ও কামে, দেখতে পাই সিমোন দ্য বোভোয়ারে; জাঁ-পল সার্ত্রের সাথে তিনি চিরসঙ্গীত্বে ছিলেন, তাতে অন্য প্রেমিকের জন্যে প্রেমে মন দুলতে, দেহে পুলক লাগতে তাঁর বাধে নি।
মেরি ছিলেন তীব্র প্রেমিকা, হয়তো প্রেমিকের পদতলে চুমো খেতে খেতে স্বপ্ন দেখতেন নারীমুক্তির; আমাদের বন্দিনী বিপ্লবী রোকেয়ার কথা জানা যায় না, তবে তাঁর চিঠিগুলো ভরে আছে কামহতাশার দীর্ঘশ্বাসে, কান পাতলেই সেগুলোর হাহাকার শোনা যায়। একটি বহুমূত্রগ্রস্ত বুড়োকে নিয়ে তাঁর দিনরাত্রিগুলোর কথা ভেবে আমরা শিউরে উঠি। দ্য বোভোয়ার অন্য বিশ্বের, সার্ত্রের সাথে ছিলো তাঁর আমৃত্যু সম্পর্ক, চুক্তি ছিলো তারা নিতে পারবেন অন্যান্য প্রেমিকপ্রেমিক। সার্ত্রের অনেক নারী ছিলো। বোভোয়ারও নিয়েছেন প্রেমিক, তাদের কথা তিনি লিখেছেনও; লিখেছেন। নেলসন অ্যালগ্রেন এবং পরে ক্লাদ লাঁজমান নামে আরেকজনের কথা; সমকামী সম্পর্কও তাঁর ছিলো; সম্প্রতি জানা গেছে মননশীলতার চূড়ান্তরূপ, রূপসী, দ্য বোভোয়ার ছিলেন পল্লীর রাখালী মেয়ের থেকেও আবেগপরায়ণ, রমণীয় ছিলেন অনারীবাদীরূপে যে ‘চিরন্তনী নারী’কে তিনি বাতিল করেছিলেন, সেটিকে টিকিয়ে রেখেছিলেন নিজেরই ভেতরে; ভাবতে কি পারি একটি পুরুষের জন্যে দ্য বোভোয়ার কাঁদছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, বা ভাবছেন তাঁর কাপড় ইন্ত্রি করার কথা, তাঁর জন্যে রান্নার বা ঘর সাজানোর কথা? ক-বছর আগে বেরিয়েছে বোভোয়ারের প্রেমপত্র বিলাভেড শিকাগো ম্যান : লেটার্স টু নেলসন অ্যালগ্লেন ১৯৪৭-৬৪। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত ১৭ বছর ধ’রে লেখা ৩০৪টি চিঠি! কে আলগ্নেন? এক গৌণ মার্কিন ঔপন্যাসিক। কাতর এসব চিঠি মনে করিয়ে দেয় জন মডেলটন মারিকে লেখা বিরহিণী ক্যাথেরিন ম্যান্সফিল্ডের চিঠিগুলোকে, যা উদ্ধৃত ক’রে দ্য বোভোয়ার দেখিয়েছেন প্রেমিকা কতোটা পাগল থাকে প্রেমিককে তাঁর প্রিয় জিনিশটি, এমনকি বক্ষবন্ধনীটি দেখানোর জন্যে। তাঁর চিঠিগুলোতে যা বিস্ময়কর, তা হচ্ছে প্রেমিকের প্রতি তাঁর অতিশয় আনুগত্য; প্রেমিককে তিনি ডেকেছেন ‘কুমির’ ‘পশু’ ও “আমার প্রিয়তম স্বামী”: নিজেকে বলেছেন “তোমার অনুগত আরব স্ত্রী, যে-আরব স্ত্রীর শোচনীয় রূপ এঁকেছেন তিনি দ্বিতীয় লিঙ্গ-এ। তিনি যখন লিখেছেন দ্বিতীয় লিঙ্গ, তখনই আলগ্রেনের কাছে লিখছিলেন কোমল, কাতর পল্লীবালার চিঠি; ১৯৪৯-এর এক সন্ধ্যায় আলগ্রেনকে লিখেছেন, ‘হায় বিধাতা! নারীরা যতো বই লিখেছে ও নারীদের সম্বন্ধে যতো বই লেখা হয়েছে, আমি সব পড়েছি এবং আমায় ঘেন্ন ধ’রে গেছে। আমি আমার আপন পুরুষ চাই!’ ১৭ বছর ধরে দ্য বোভোয়ার ইংরেজিতে, মাঝেমাঝে মধুর ভুল ইংরেজিতে, আলগ্রেনকে লিখেছেন প্রেমপত্র। তিনি রূপসী ছিলেন, তবে আলগ্রেনের সাথে দেখা হওয়ার আগে রূপ নিয়ে ভাবেন নি। ১৯৪৩-এ তাঁর একটি দাঁত পড়ৈ যায়, তিনি সেটি বাঁধান নি, কেননা তা খুবই ব্যয়বহুল ও ক্লান্তিকর ও নিরর্থক’; কিন্তু ১৯৪৮-এ, তিনি লিখেছেন, “তোমার জন্যে সপ্তাহে তিনবার আমি গেছি। দন্তচিকিৎসকের কাছে।” তিনি চেয়েছিলেন যাতে আলগ্রেন “পায় সম্পূর্ণ হাসিসহ একটি মেয়ে’। তাদের দেখা হয়। ১৯৪৭-এর ফেব্রুয়ারি মাসে: দা বোভোয়ার ৩৯, আলগ্রেন ৩৮। এর বারো বছর আগে বেরিয়েছিলো অ্যালগ্রেনের প্রথম উপন্যাস, তাতে টাকা বা খ্যাতি কিছুই আসে নি; ১৯৪৯-এ বেরোয় তাঁর সোনালি বাহুর পুরুষ, এটা তাকে কিছুটা অর্থ ও খ্যাতি এনে দেয়। দ্য বোভোয়ার তাকে সম্বোধন করেছেন ‘আমার চমৎকার, বিস্ময়কর, ও প্রিয় স্থানীয় তরুণ’, ‘আমার মূল্যবান, প্রিয়তম শিকাগোর পুরুষ’ এবং “আমার প্রিয়তম স্বামী। তাঁকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন আলগ্রেন; তাঁর প্রতি বিশ্বস্তু ছিলেন বছরখানেক! বোভোয়ার লিখেছেন; আমি এখন বুঝি ওটা ছিলো বোকামি, কেননা কোনো বাহুই উষ্ণ নয়, যখন তা থাকে সমুদ্রের ওপারে।’ তিনি প্যারিস ছাড়তে পারতেন, কিন্তু সার্ত্রকে নয়। আলগ্রেনকে লিখেছেন, ”তোমার সাথে আমৃত্যু দিনরাত কাটিয়ে আমি সুখ পাবো শিকাগোতে, প্যারিসে বা চিচিকাস্টেনেসোতে; তোমাকে আমি দেহে ও হৃদয়ে ও আত্মায় যতোটা ভালোবাসি, তাঁর চেয়ে বেশি ভালোবাসা সম্ভব নয়। কিন্তু যে আমার সুখের জন্যে সব কিছু করেছে, তাকে আঘাত দেয়ার থেকে বরং আমি মরে যাবো।” ৩৯ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি যতো পুরুষের সাথে ঘুমিয়েছেন, তাঁর থেকে বেশি ঘুমিয়েছেন নারীদের সাথে। সার্ত্রের সাথে তাঁর যৌনজীবন টিকেছে ন-বছর। বোভোয়ায় লিখেছেন : “তিনি সবখানেই উষ্ণ, প্রাণবন্ত পুরুষ, কিন্তু শয্যায় নয়। শিগগিরই বুঝতে পেরেছিলাম, যদিও আমার কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো না; এবং প্রেমিকপ্রেমিকা হিশেবে চালিয়ে যাওয়াকে একটু একটু ক’রে মনে হতে থাকে নিরর্থক, এবং এমনকি অশ্লীল।’
বিশশতকের প্রথমার্ধ ছিলো নারীদের জন্যে এক অন্ধকার মুক্তির সময়, মুক্তির কথা স্তব্ধ হয়ে গেছে, নারীদের ধাক্কিয়ে আবার ঢুকানো হচ্ছে ঘরসংসাড়ে, বড়ো ক’রে তোলা হয়েছে ‘নারী চিরন্তনী কে, ওই অন্ধকারের মধ্যে দিব্য অরুণের মতো দেখা দেয় দ্য বোভোয়ারের ল্য দাজিয়েম সেক্স (১৯৪৯: দ্বিতীয় লিঙ্গ); এটি হয়ে উঠে পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতায় নারীর পরিস্থিতির এক ধ্রুপদী দার্শনিক, সমাজতাত্ত্বিক, রাজনীতিক ভাষ্য, হয়ে ওঠে নবনারীদের মূলগ্রন্থ। ল্য দ্যজিয়েম সেক্সকে আপাতদৃষ্টিতে খুবই ভিন্ন মনে হয় মেরি ওলস্টোনক্রাফট্এর ভেন্ডিকেশন থেকে, অনেক জটিল অনেক প্রাজ্ঞ এ-বই মেরির বইটি থেকে, মেরির বইয়ের ক্রোধ ও আক্রমণ নেই এতে, এমনকি তিনি কোনো দাবিও জানান নি, তিনি ব্যাখ্যা ও উদঘাটন করেছেন নারীর পরিস্থিতি, তবে এতে চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে সে চিন্তাভাবনা, যার উন্মেষ ঘটেছিলো মেরির বইতে। মেরির আক্রমণের একটি বিষয় চিরন্তনী নারী ধারণা, যা পিতৃতন্ত্রের ধর্মে দর্শনে সাহিত্যে এবং সবকিছুতে এক ধ্রুব ব্যাপার বলে গৃহীত, মেরি তা বাতিল ক’রে দেন; দ্য বোভোয়ারের প্রধান বিষয় এটিই, তবে তিনি মেরির মতো আক্রমণ করেন। নি, ধর্ম পুরাণ মনোবিজ্ঞান সাহিত্য ঘেটে দেখান এর অসারত্ব। তিনি বলেছেন, “বিধানকর্তারা, পুরোহিতেরা, দার্শনিকেরা, লেখকেরা, এবং বিজ্ঞানীরা দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে নারীর অধীন অবস্থান স্থির হয়েছে স্বর্গে এবং মর্ত্যে এটা সুবিধাজনক। পুরুষের উদ্ভাবিত ধর্মগুলোতে প্রতিফলিত হয় আধিপত্যের এ-বাসনা।’
তাঁর বিষয় সভ্যতায় নারীর পরিস্থিতি; এটা তিনি ব্যাখ্যা করেছেন ‘অস্তিত্ববাদী নীতিশাস্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে’। তাঁর মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে আমরা মানুষ, কেননা আমরা পেরিয়ে যাই প্রকৃতিকে; মানুষ হওয়ার অর্থ ক্ৰমশ হয়ে ওঠা, বিকশিত হওয়া, আবিষ্কার করা, সৃষ্টি করা, জীবনের মূল্য শুধু বেঁচে থাকায় নয়, বরং জীবনকে নিরস্তুর বিকশিত করার মধ্যে। মানবমগুলিতে আছে দুটি লিঙ্গ : পুরুষ ও নারী; এর মাঝে পুরুষ ‘বদলে দেয় পৃথিবীর মুখমণ্ডল, সে নতুন যন্ত্রপাতি তৈরি করে, আবিষ্কার করে, সে গঠন করে ভবিষ্যতের রূপ’; আর এটাই তাকে ভিন্ন ক’রে তোলে পশুর থেকে। আমাদের সংজ্ঞা কী? কর্ম ও আকাংখাই সংজ্ঞায়িত করে আমাদের। প্রজননের মাধ্যমে কেউ মানুষ হয়ে উঠতে পারে না, হয়ে উঠতে হয় সৃষ্টি ও নির্মাণের মধ্য দিয়ে; তিনি বলেছেন, ‘স্ত্রীলিঙ্গ তাঁর প্রজাতির শিকার।’ পুরুষ নিজেকে মুক্ত ক’রে নেয় নিরর্থক জৈবিক পুনরাবৃত্তির কবল থেকে, নিরন্তর চেষ্টা করে নিজের জন্যে অধিকতর স্বাধীনতা সৃষ্টির। কিন্তু নারী? নারীর শোচনীয় ট্র্যাজেডি হচ্ছে ইতিহাসব্যাপী তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে আকাঙ্খা ও উচ্চাভিলাষের অধিকার থেকে, তাকে মানুষ হয়ে উঠতে দেয়া হয় নি। তিনি ব্যবহার করেছেন দুটি ধারণা : আত্ম (সেম্বফ) ও অপর (আদার), যে-দুটিকে তিনি মানবিক চেতনার জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। তাঁর মতে, প্রতিটি চেতনা বিরূপ অন্য প্রতিটি চেতনার প্রতি: একটি চেতনা নিজেকে ক’রে তোলে কর্তা, প্রয়োজনীয় বা অবধারিত, আর সে অন্য চেতনাকে ক’রে তোলে কর্ম, অপ্রয়োজনীয়, আকস্মিক! নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো পারস্পরিকতা রক্ষা করা হয় নি, পুরুষ নারীকে ক’রে তুলেছে চিরন্তন ‘অপর’, তাকে ক’রে তুলেছে কর্ম, কখনো কর্তা হয়ে উঠতে দেয় নি! তাই নারী হয়ে আছে প্রকৃতি, রহস্যময়ী, অ-মানুষ; মানুষ হিশেবে তাঁর মূল্য নেই, তাঁর মূল্য অমূর্ত ধারণার প্রতিরূপ হিশেবে। নারী যতো দিন নারী হয়ে থাকবে ততো দিন প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারবে না। তিনি অসামান্যরূপে ব্যাখ্যা করেছেন কিংবদন্তি বা পুরাণে এবং সাহিত্যে নারীর বাভমূর্তি; আক্রমণ করেছেন উৎপাদিত অসার নারীভাবমূর্তিকে। বলেছেন, ‘পুরুষের দাসী না হ’লেও নারী সময়ই আশ্রিত থেকেছে পুরুষের; এ-দুটি লিঙ্গ কখনো পৃথিবীকে সমভাবে ভোগ করেনি। তিনি অস্তিত্ববাদী দর্শন ব্যাবহার করেছেন, তাঁর দর্শন পুরোপুরি গহণযোগ্য নাও হ’তে পারে, কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যা নির্ভুল। তিনি দেখিয়েছেন যে প্রত্যেক সংস্কৃতিতেই পুরুষ নিজেকে ক’রে তুল্বছ্ব মানুষের পরম রূপ, অর্থাৎ পুরুষই মানুষ, আর নারী নিতান্তই নারী; পুরুষ হচ্ছে মানুষকে মাপার মানদণ্ড, নারীকে ওই মানদণ্ডে মেপে ঘোষণা করা হয়েছে নিকৃষ্ট বলে। দ্বিতীয় লিঙ্গ-এর প্রথম খণ্ডে তিনি অপূর্ব ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পুরুষের পক্ষপাতিত্বের; দেখিয়েছেন, ‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং হয়ে ওঠে”; অৰ্থাৎ পিতৃতন্ত্র ছাঁচে ঢালাই ক’য়ে উৎপাদনা করে একটি উপভোগ্য বস্তু : নারী। পুরুষ করে তুলেছে প্ৰভু; তিনি বলেছেন, ‘বহু শব্দ অনেক সময় ব্যবহৃত হয় চরম আক্ষরিক অর্থে, যেমন ফ্যালাস (শিশ্ন) শব্দটি বুঝিয়ে থাকে মাংসের সে-উত্থান, যা নির্দেশ করে পুরুষকে, তারপর এগুলোকে সম্প্রসারিত করা হয় সীমাহীনভাবে এবং দেয়া হয় প্রতীকী অর্থ, তাই শিশ্ন এখন বুঝিয়ে থাকে পৌরুষ ও তাঁর পরিস্থিতি। পুরুষতন্ত্র এমন ধারণা সৃষ্টি করেছে যে শিশ্নই সমস্ত ক্ষমতার উৎস। ধনাত্মকতা ও ঋণাত্মকতার, বা বৈপরীত্যের যে-ধারণা পরে প্রধান হয়ে ওঠে ভাষাবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ও অন্যান্য বিদ্যায়, তা তিনি চমৎকারভাবে প্রয়োগ করেন। নারী ও পুরুষ ব্যাখ্যায়; দেখান যে পুরুষতন্ত্র তৈরি করেছে একরাশ বিপৰীত ধারণা, যার একটি ধনাত্মক বা প্রয়োজনীয় বা কর্তা, আরেকটি ঋণাত্মক বা অপ্রয়োজনীয় বা কর্ম, যেমন : পুংলিঙ্গ : স্ত্রীলিঙ্গ, সংস্কৃতি : প্রকৃতি, মানুষ : পশু, উৎপাদন : প্রজনন, সক্রিয় : অক্রিয়; এগুলোর মধ্যে প্রথমটি শুভ, বিপরীতটি অশুভ, এবং পুরুষতন্ত্র প্রথমটি রেখেছে নিজের জন্যে, বিপরীতটি নারীর জন্যে। তিনি বাতিল করেছেন ‘চিরন্তনী নারীত্ব’কে, তবে তিনি পুরুষকেই মানবমগুলির প্রতিনিধি হিশেবে গ্ৰহণ করেছেন, এবং নারীর জন্যে চেয়েছেন পুরুষেরই গুণ, যেমন বহু আগে অন্ধকারতম অঞ্চলের এক নারীবাদী, রোকেয়া, পুরুষকে প্ৰচণ্ড আক্রমণ, নিন্দা, পরিহাসের পর বলেছিলেন, ‘আমাদের উন্নতির ভাব বুঝাইবার জন্য পুরুষের সমকক্ষতা বলিতেছি। নচেৎ কিসের সহিত এ উন্নতির তুলনা দিব? পুরুষের অবস্থাই আমাদের উন্নতির আদর্শ।’ রোকেয়া পুরুষকে বলেছেন অপদাৰ্থ দুশ্চরিত্র পাপিষ্ঠ শয়তান পাশবিক, দ্য বোভোয়ার এমন তিরষ্কার করেন নি; রোকেয়া বলেছিলেন, ‘পুরুষদের স্বার্থ ও আমাদের স্বাৰ্থ ভিন্ন নহে- একই। তাহদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই’; দ্য বোভোয়ার দ্বিতীয় লিঙ্গ-এর শেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, ‘বিদ্যমান বিশ্বের মাঝে মুক্তির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে পুরুষকেই। এ-পরম বিজয় লাভের জন্যে, এক দিকে, এটা দরকার যে পুরুষ ও নারীরা তাদের প্রাকৃতিক পার্থক্যকরণের সাহায্যে ও মাধ্যমে দ্ব্যর্থহীনভাবে দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করবে তাদের ভ্ৰাতৃত্ববোধ।’ রোকেয়ায় এ-ভ্রাতৃত্ববোধ নেই, রয়েছে একটা বিরোধ, কিন্তু দ্য বোভোয়ার চেয়েছেন নারী ও পুরুষের সাম্য ও প্রীতিপূর্ণ বিকাশ।
১৭৯২-এ মেরি ওলস্টোনক্র্যাফুটের ভিডিকেশন-এর পর থেকে অনেকেই কাজ করেন, বাস্তবে ও তাত্ত্বিকভাবে, নারীমুক্তির জন্যে; গ’ড়ে তোলান একটি মৌলিক চিন্তাধারা, যাকে আজ বলা হয় নারীবাদ, তাঁর মধ্যে যেমন রয়েছেন রামমোহন রায়, লুসি স্টোন, কেড়ি স্ট্যান্টন, সুজান অ্যান্থনি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, স্টুয়ার্ট মিল, হেনরিক ইবসেন, বেগম রোকেয়া, হোসা লুক্সেমবার্গ, ভার্জিনিয়া উল্ফ, এবং আরো অনেকে, যারাঁ বাস্তবিক ও তাত্ত্বিকভাবে তৈরি করেন নারীমুক্তির আন্দোলন। বিশশতকে নারীবাদের শ্রেষ্ঠ তাত্ত্বিক সিমোন দ্য বোভোয়ার; তিনি যখন দ্বিতীয় লিঙ্গ লেখেন, তখন তিনি ছিলেন একা, তখন ভুলেই যাওয়া হয়েছিল নারীকে; তবে দু-দশকের মধ্যেই অন্ধকার কাটে, দেখা দেয় নারীবাদের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ বা নবনারীবাদ, বেরোয় বেটি ফ্রাইডানের ফেমনিন মিস্টিক(১৯৬৩), কেইট মিলেটের সেক্সুয়াল পলিটিক্স (১৯৬৯); দেখা দেন জারমেইন গ্রিয়ার, মেরি এলমান, সান্ড্রা গিলবার্ট, ফাতিমা মেরনিসসি, নওএল এল সাদাওয়ি, এলেন সিজো, ল্যুস ইরিগার, ক্রিস্তেভা, টাইগ্রেস অ্যাটকিন্সন, শুলামিথ ফায়ারস্টোন, শিলা রোওবোথাম এবং বিশ্ব জুড়ে আরো অজস্ৰ, যারা বদলে দেন পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাধারার চরিত্র; এবং তঁরা কোনো-না-কোনোভাবে ঋণী সিমোন দ্য বোভোয়ারের কাছে। নারীবাদী আর কোনো পশ্চিমি প্রপঞ্চ নয়, এটা বিশ্বজনীন!
নারীবাদের বিশশতকের প্রধান প্রবক্তা, সিমোন দ্য বোভোয়ার কি ছিলেন। নারীবাদী? প্রশ্নটিই হাস্যকর মনে হ’তে পারে; এমন যে খ্রিস্ট কি ছিলেন খ্রিস্টান, মার্ক্স কি ছিলেন মার্ক্সবাদী? দ্য বোভোয়ার যখন, ১৯৪৯-এ, দ্বিতীয় লিঙ্গ লেখেন, তাঁর মনে হয়েছিলো সমাজতন্ত্রই নারীকে মুক্তি দেবে তাঁর দাসত্ব থেকে, তাই তখন তিনি নিজেকে মনে করেছেন একজন সমাজতন্ত্রবাদী, নারীবাদী নয়। কিন্তু এক সময় তাঁর ভুল ভাঙে, দেখতে পান সমাজতন্ত্র নারীকে মুক্তি দিচ্ছে না, ওটিও একটি পুংতন্ত্র। ১৯৭২-এ তিনি যোগ দেন ফ্রান্সের এমএলএফ-এ (নারীমুক্তি আন্দোলন), এবং প্ৰথমবারের মতো নিজেকে নারীবাদী বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘১৯৭০-এ এমএলএফ (নারীমুক্তি আন্দোলন) স্থাপিত হওয়ার আগে ফ্রান্সে যে-সব নারীসংঘ ছিলো, সেগুলো ছিলো সাধারণত সংস্কার ও আইনপস্থি। তাদের সাথে জড়িত হওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার হয় নি। তুলনায় নবনারীবাদ আমূল্যবাদী। দ্বিতীয় লিঙ্গ-এর শেষভাগে বলেছিলাম আমি নারীবাদী নই, কেননা আমি বিশ্বাস করতাম যে সমাজতান্ত্রিক বিকাশের সাথে আপনা-আপনি সমাধান হয়ে যাবে নারীর সমস্যা। নারীবাদী বলতে আমি বোঝাতাম শ্রেণীসংগ্ৰামনিরপেক্ষভাবে বিশেষ নারীসমস্যা নিয়ে লড়াইকে। আমি আজো একই ধারণা পোষণ করি। আমার সংজ্ঞায় নারীবাদীরা এমন নারী- বা এমন পুরুষ- যারা, সংগ্ৰাম করছেন নারীর অবস্থা বদলের জন্যে, সাথে থাকছে শ্রেণীসংগ্রাম; এবং তঁরা শ্রেণীসংগ্ৰামনিরপেক্ষভাবেও, সমাজের সমস্ত বদলের ওপর নির্ভর না করে, নারীর অবস্থা বদলের জন্যে সংগ্ৰাম করতে পারেন। আমি বলবো, এ-অর্থেই আমি আজ নারীবাদী, কেননা আমি বুঝতে পেরেছি যে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার আগে নারীর পরিস্থিতির জন্যে আমাদের লড়াই করতে হবে, এখানে এবং এখনই।’
সিমোন দ্যা বোভোয়ারের মৃত্যু হয় ১৪ আগস্ট, ১৯৮৬তে প্যারিসে; তখন তিনি হয়ে উঠেছিলেন নারীর সাম্য ও অধিকারের সংগ্রামের বিশ্বজনীন প্রতীক।
ল্য দ্যজিয়েম সেক্স : দ্বিতীয় লিঙ্গ বই কেমন? বলবো কি কি এটি আমার পড়া শ্রেষ্ঠ গদ্য বইগুলোর একটি; বলবো কি যদিও এ-দুটির মধেয় তুলনা চলে না, এটি ওয়ার অ্যান্ড পিস-এর থেকেও উৎকৃষ্ট? কেনো বল্বো না? তলস্তয় পৌরাণিক অনেকাংশ ক্ষতিকর ও অতিমূল্যায়িত, আর দ্য বোভোয়ার ভবিষ্যতের। তত্ত্ব, দর্শন, ব্যাখ্যা প্রভৃতির কথা ছেড়ে দিলেও থাকে অনন্য শিল্পিতা, সৌন্দর্য, অজস্র উৎকৃষ্ট কবিতার রুপক, উপমা, চিত্রকর জড়ো হয়ে আছে এ-বইয়ে, এর বর্ণনাগুলোতে আছে এমন নিবিড়তা, যা ক্ষণে ক্ষণে মন এবং ইন্দ্রিয়গুলোকে দেয় পরম শিহরণ, যদিও মূল আমি পড়িনি। আমি অনুবাদ করেছি এইচ এম পার্শলির অসামান্য ইংরেজি অনুবাদটি থেকে, তবে পুরোটা অনুবাদ করি নি, তাহলে হাজার পাতায় পৌছোতে হতো; অনুবাদ করেছি আমার প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো। আমি আন্তরিক থাকতে চেয়েছি পার্শলির প্রতি, যেমন তিনি চেয়েছেন। দ্য বোভোয়ারের প্রতি: কোথাও ভাবানুবাদ করি নি, মূলের মতোই উপস্থাপন করতে চেয়েছি বক্তব্য। অনুবাদে ভুগেছি নানা সমস্যায়, তার মধ্যে আছে পরিভাষা; তবে তা বড়ো নয়, ভঙ্গিটিই প্ৰধান সমস্যা। এবং সমস্যা সৰ্বনামের; ইংরেজিতে সর্বনামের পুং ও স্ত্রীলিঙ্গ রূপ রয়েছে, এবং রয়েছে বস্তু ও অবস্তুবাচক সর্বনাম, কিন্তু বাঙলা সর্বনাম লিঙ্গনিরপেক্ষ, এটা নারীবাদীদের কাছে সুখের হলেও অনুবাদকের জন্যে বড়োই অসুখের; হি’, ‘সি’র বিচিত্র রূপের, এবং ‘ইট’-এর কাজ শুধু ‘সে’ বা “তা’ দিয়ে কুলোনো যায় না; তাই অনেক সময় সর্বনামের বদলে বিশেষ্যই ব্যবহার করছি। পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণে সংশোধন করা হলো অনেক কিছু, এবং বাড়লো একশো পাতার মতো; এবং আর বাড়বে না।
হুমায়ূন আজাদ
৪ শ্রাবণ ১৪৩৮ : ১৯ জুলাই ২০০১
১৪ই ফুলার রোড
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা।
“দ্বিতীয় লিঙ্গ- সিমোন দ্য বোভোয়ার” প্রবন্ধ বা উপন্যাস সম্পর্কিত আপনার মন্তব্যঃ
প্রথম খন্ডঃ তথ্য ও কিংবদন্তি
ভাগ – ১: নিয়তি
♦ ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ
ভাগ – ২ : ইতিহাস
♦ পিতৃতান্ত্রিক কাল ও ধ্রুপদী মহাযুগ
♦ মধ্যযুগব্যাপী থেকে আঠারো শতকের ফ্রান্স পর্যন্ত
♦ ফরাশি বিপ্লব থেকেঃ চাকুরি ও ভোট
ভাগ – ৩ : কিংবদন্তি
দ্বিতীয় খন্ডঃ আজ নারীর জীবন
ভাগ – ৪ : গঠনের বছরগুলো
ভাগ – ৫ : পরিস্থিতি
ভাগ – ৬ : যথার্থ প্রতিপাদন
ভাগ – ৭ : মুক্তির অভিমুখে