বাবার অসংখ্য বাতিকের একটি হল-সাহিত্য-বাতিক। মাসে অন্তত দুবার বাসায় সাহিত্য বাসর নামে কী যেন হত। কী যেন হত বলছি এই কারণে যে, আমরা ছোটরা জানতাম না কী হত। আমাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। সাহিত্য চলাকালীন আমরা হৈচৈ করতে পারতাম না, উঁচু গলায় কথা বলতে পারতাম না, শব্দ করে হাসতেও পারতাম না। এর থেকে ধারণা হত, বসার ঘরে তারা যা করছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে একদিন খানিকটা শুনলাম। আমার কাছে পুরো ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হল। একজন খুব গম্ভীর মুখে একটা কবিতা পড়ল। অন্যরা তার চেয়েও গম্ভীর মুখে শুনল। তারপর কেউ বলল, ভালো হয়েছে, কেউ বলল মন্দ, এই নিয়ে তর্ক বেধে গেল। নিতান্তই ছেলেমানুষি ব্যাপার। একদিন একজনকে দেখলাম রাগ করে তার লেখা কুচি কুচি করে ছিড়ে ফেলে দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। অমি দুজন ছুটে গেল তাকে ধরে আনতে। ধরে আনা হল। বয়স্ক একজন মানুষ অথচ হাউমাউ করে কাঁদছে। কী অদ্ভুত কাণ্ড! কাণ্ড এখানে শেষ না। ছিড়ে কুচিকুচি করা কাগজ এরপর আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো হতে লাগল। সেই লেখা পড়া হল, সবাই বলল, অসাধারণ। এই হচ্ছে বাবার প্রাণপ্রিয় সাহিত্য বাসর।

সারাটা জীবন তিনি সাহিত্য সাহিত্য করে গেলেন। কতবার যে তিনি ঘোষণা করেছেন, এবার চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি সাহিত্যে মনোনিবেশ করবেন! চাকরি এবং সাহিত্য দুটো একসঙ্গে হয় না।

ট্রাংকে বোঝাই ছিল তার অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি। গল্প, কবিতা, নাটক, প্রর থরেথরে সাজানো। বাবার সাহিত্যপ্রেমের স্বীকৃতি হিসেবে আমাদের বসার গান বড় একটা বাঁধানো সার্টিফিকেট ঝোলানো, যাতে লেখা-ফয়জুর রহমান আহমেদকে সাহিত্য সুধাকর উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে।

এই উপাধি তাকে কারা দিয়েছে, কেন দিয়েছে কিছুই এখন মনে করতে পারছি না। শুধু মনে আছে বাঁধানো সার্টিফিকেটটির প্রতি বাবার মমতার অন্ত ছিল না। বাবার মৃত্যুর পর তাঁর সমাধিফলকে আমি এই উপাধি এবং শোকগাথায় রবীন্দ্রনাথের দুলাইন কবিতা ব্যবহার করি।

দূরদূরান্ত থেকে কবি-সাহিত্যিকদের হঠাৎ আমাদের বাসায় উপস্থিত হওয়া ছিল আরেক ধরনের ঘটনা। বাবা এঁদের কাউকে নিমন্ত্রণ করে আনাতেন না। তার সামর্থ্য ছিল না, তিনি যা করতেন তা হচ্ছে মনিঅর্ডার করে তাদের নামে পাঁচ টাকা বা দশ টাকা পাঠিয়ে কুপনে লিখতেন

জনাব,

আপনার ….কবিতাটি …. পত্রিকার…. সংখ্যায় পড়িয়া মনে বড় তৃপ্তি পাইয়াছি। উপহার হিসেবে আপনাকে সামান্য কিছু অর্থ পাঠাইলাম। উক্ত অথ গ্রহণ করিলে চিরকৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ থাকিব।

ইতি প্রতিভামুগ্ধ–
ফয়জুর রহমান আহমেদ
(সাহিত্য সুধাকর)

ঐ কবি নিশ্চয়ই তাঁর কাব্যের জন্যে নানান প্রশংসাবাক্য শুনেছেন, কিন্তু মনিঅর্ডারে টাকা পাওয়ার ব্যাপারটা না ঘটারই কথা। প্রায় সময়ই দেখা যেত, আবেগে অভিভূত হয়ে যশোহর বা ফরিদপুরের কোনো কবি বাসায় উপস্থিত হয়েছেন।

এমনিভাবে উপস্থিত হলেন কবি রওশন ইজদানী। পরবর্তীকালে তিনি খাতেমুন নবীউন গ্রন্থ লিখে আদমজী পুরস্কার পান। যখনকার কথা বলছি তখন তাঁর কবিখ্যাতি তেমন ছিল না।

আমার পরিষ্কার মনে আছে, লুঙ্গি-পরা ছাতা-হাতে এক লোক রিকশা থেকে নেমে ভাড়া নিয়ে রিকশাওয়ালার সঙ্গে তুমুল তর্ক জুড়ে দিয়েছেন। জানলাম, ইনি বিখ্যাত কবি রওশন ইজদানী। আমাদের বলে দেয়া হল যেন হৈচৈ না করি, চিৎকার না করি। ঘরে একজন কবি বাস করছেন। কবিতা লেখার মুডে থাকলে সেই মুডের ক্ষতি হবে।

দেখা গেল, কবি সারা গায়ে সরিষার তেল মেখে রোদে গা মেলে পড়ে ইলেন। আমাকে ডেকে বললেন–এই, মাথা থেকে পাকা চুল তুলে দে।

কবি-সাহিত্যিকরা আলাদা জগতে বাস করেন, মানুষ হিসেবে তারা অন্যরকম বলে যে প্রচলিত ধারণা আছে কবি রওশন ইজদানীকে দেখে আমার মনে হল ঐ ধারণা ঠিক না। তারা আর দশটা মানুষের মতোই, আলাদা কিছু না।

আমার আদর-যত্নে, খুব সম্ভব পাকা চুল তোলার দক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়ে তিনি আমাকে একদিন ডেকে বললেন, খাতা-কলম নিয়ে আয়, তোকে কবিতা লেখা শিখিয়ে দিই।

আমি কঠিন গলায় বললাম, আমি কবিতা লেখা শিখতে চাই না।

তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, তাহলে কী শিখতে চাস?

কিছুই শিখতে চাই না।

আসলেই তা-ই। শৈশবে কারওর কাছ থেকে আমি কিছুই শিখতে চাইনি। এখনও চাই না। অথচ আশ্চর্য, আমার চারপাশে যারা আছেন তারা ক্রমাগত আমাকে শেখাতে চান। অর্থনীতি, সমাজনীতি, দর্শন, ভাষা এবং বাংলা বানানের শিক্ষকরা আমার চারপাশে আছেন। পণ্ডিত ব্যক্তি থেকে শুরু করে আঠারো উনিশ বছরের তরুণী সবাই আমার শিক্ষক। সবাই আমাকে শেখাতে চান। হয়তো ভালোবাসা থেকেই চান, কিন্তু আমার কিছুই শিখতে ইচ্ছা করে না। জানতে ইচ্ছা করে না। জানবার কথা নামের একটি বই শৈশবেই ছিড়ে কুচিকুচি করে ফেলেছিলাম এই কারণেই।

error: Content is protected !!
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x