প্ল্যানচেটে আত্মা আনার কথা ওঠায় মনে পড়ে গেল দুটি ঘটনা। প্রথম যে ঘটনাটার কথা বলছি, সেটা ঘটেছিল ১৬ মে, ১৯৯২। গিয়েছি পাক্ষিক পত্রিকা ‘সানন্দা’ দপ্তরে। কথা প্রসঙ্গে সম্পাদক সহযোগী দীপান্বিতা ভট্টাচার্য জানালেন- আগামী সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনী হবে প্ল্যানচেট নিয়ে। তুমি তো প্ল্যানচেটে বিশ্বাসই কর না, বিশ্বাস কর না প্ল্যানচেটে আত্মা আসে, তারা উত্তর দেয়। আমরা প্ল্যানচেটে বিশ্বাসীদের কথাই এবার হাজির করব। তাই সংখ্যাটা প্ল্যানচেট নিয়ে হলেও এ ব্যাপারে তোমার কোনও সাহায্য নিচ্ছি না।

বললাম- কে বলল তোমাকে, আমি বিশ্বাস করি না। আমি নিজে বিভিন্ন প্ল্যানচেটের আসর বসিয়ে দেখেছি, কি অদ্ভুতভাবে মিডিয়ামদের হাত দিয়ে নানা প্রশ্নের উত্তর বেরিয়ে আসে।

– তুমি নিজে করে দেখছ?

– হ্যাঁ।

– করে দেখাতে পারবে?

– নিশ্চয়ই।

– করে দেখাবে?

– এখুনি।

অমনি মুহূর্তে সাজ-সাজ রব পড়ে গেল। সানন্দার সম্পাদকের ঘরেই প্ল্যানচেটের আসর বসানো হবে ঠিক হল। মুহূর্তে ছোট ঘরটি ভর্তি হয়ে গেল সানন্দার সাংবাদিক, চিত্রসাংবাদিক ও সম্পাদক সহযোগীদের ভিড়ে।

মিডিয়াম কে হবেন। এগিয়ে এলেন নিবেদিতা মজুমদার। কার আত্মাকে ডাকা হবে? ঠিক হল উত্তমকুমারের আত্মাকেই ডাকা হবে। সকলেই ব্যস্ত মানুষ। তাড়াতাড়ি উত্তর জানতে আগ্রহী। ঠিক হল, দর্শকরা প্রশ্ন করবেন এবং উত্তরগুলো আসবে ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’র মধ্য দিয়ে। একটা সাদা কাগজে একটা বৃত্ত আঁকলাম। তারপর গোটা বৃত্ত জুড়ে, পরিধি ছুঁয়ে এঁকে ফেললাম একটা যোগ চিহ্ন। বৃত্তটার চার ভাগের দুই বিপরীত দিকে লিখলাম ‘হ্যাঁ’ অপর দুই বিপরীত দিকে ‘না’। তারপর চেয়ে নিলাম একটি সুতো ও একটি আংটি। আংটিতে বেঁধে ফেললাম সুতো। এবার বৃত্ত আঁকা কাগজটা টেবিলে পেতে টেবিলের দু’প্রান্তে মুখোমুখি বসলাম আমি ও নিবেদিতা। আমার কথা মত নিবেদিতা তাঁর ডান হাতের কনুইটা টেবিলে রেখে তর্জনী ও বুড়ো আঙ্গুলের সাহায্যে আংটিবাঁধা সুতোটাকে এমনভাবে ধরলেন, যাতে আংটিটা ঝুলে রইল যোগ চিহ্নের কেন্দ্রে, অর্থাৎ বৃত্তেরও কেন্দ্রে।

এ’বার শুরু হল প্ল্যানচেটের দ্বিতীয় বা শেষ পর্যায়। প্রত্যেককে চুপ করতে বললাম। নিস্তব্ধ ঘর। ঘরে গোটাকয়েক ধূপকাঠি জ্বেলে দেওয়া হল। কথা বলছিলাম শুধু আমি- নিবেদিতা, এক মনে ভাতে থাকুন, উত্তমকুমারের কথা। গভীরভাবে ভাবতে থাকুন উত্তমকুমারের কথা। ভাবতে থাকুন উত্তমকুমারের আত্মা আসছে। উত্তমকুমারের আত্মা এলে আংটিটা আপনা থেকে দুলতে থাকবে- ‘হ্যাঁ’ লেখাকে নির্দেশ করে দুলতে থাকবে।

দু’মিনিট কাটল না, আংটি কেঁপে উঠল, তারপর দোলা শুরু করল। দুলতে লাগল ‘হ্যাঁ’ শব্দ দুটির দিকে। এরপর শুরু হল দস্তুরমত প্রশ্নবান। প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে উত্তরও মিলছে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’। একাধিক হাতের ছোট্ট খাতায় খসখস করে লেখা হচ্ছে প্রশ্ন ও উত্তর। ছবি তোলা হচ্ছে। এক সময় নিবেদিতার চোখ বুজে এল। নিবেদিতা এলিয়ে পড়ার আগে ধরে ফেললেন সুদেষ্ণা রায়। আমি গম্ভীর, মৃদু ও টানা-টানা সুরে বলতে লাগলাম- নিবেদিতা, এক মনে শুধু আমার কথা শুনতে থাকুন। উত্তমকুমারের আত্মা চলে গেছে। আপনি জেগে উঠছেন। আপনি জেগে উঠছেন। চোখ খুলুন। একটু একটু করে চোখ খুলুন।

চোখ খুললেন নিবেদিতা। বললেন, খুব ঘুম পাচ্ছে। অনিরুদ্ধ ধর ও শিবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় দৌড়লেন নিবেদিতার জন্য গরম দুধের পরিবর্ত হিসেবে গরম চা আনতে।

উপস্থিত সবার আগ্রহ তখন তুঙ্গে। তাঁরা আবার প্ল্যানচেটের আসর বসাতে চাইলেন। মিডিয়াম হিসেবে চাইলেন সুদেষ্ণাকে। সুদেষ্ণা ওঁদের চোখে প্রচণ্ড ব্যক্তিসম্পন্না মানুষ। মজা ভালই।

সুদেষ্ণা বসলেন। ঠিক হল সত্যজিৎ রায়ের আত্মাকে আনা হবে। নিবেদিতার সময় যা ঘটেছিল, তারই পুনরাবৃত্তি ঘটল। আবার প্রশ্নমালা। এমন অনেক প্রশ্ন এল, যেগুলো কৌতূহল থেকে উঠে আসা, কিন্তু কখনোই লেখায় প্রকাশ করা যায় না। উত্তরও আসতে লাগল।

প্রশ্নোত্তর পালা শেষ হতেই দীপান্বিতা বললেন- আত্মাকে দিয়ে রাইটিং-প্যাডে লেখানো যায় না?

বললাম- কেন যাবে না ; নিশ্চয়ই যায়।

রাইটিং-প্যাড এল। ডটপেন এল। এবারও সুদেষ্ণাই মিডিয়াম। আহ্বান করা হল রাজীব গান্ধীর আত্মাকে। এ’বার মিনিট দু’য়েক লাগল। কাঁপতে লাগল সুদেষ্ণার হাতের ডটপেন।

এবার ইংরেজিতে প্রশ্ন- রাজীব, আপনি কি এসেছেন? উত্তর এল- Yes. তারপর উত্তেজিত প্রশ্ন একের পর এক আসতেই লাগল। ডটপেন রাইটিং প্যাড থেকে না তুলে কাঁপা কাঁপা লেখায় উত্তর দিয়েই চললেন সুদেষ্ণা রায়।

উত্তরপর্ব শেষ হতে ওঁদের অভিজ্ঞতার উত্তেজনার আগুনে ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়ে সত্যি কথাটা বলে ফেললাম- এতক্ষণ যা হল সেটা আদৌ প্ল্যানচেট নয়, সম্মোহন। উত্তরগুলো আত্মা দেয়নি, দিয়েছে দুই মিডিয়ামের অবচেতন মন। আমি যখন প্ল্যানচেটে আত্মা এনে দেখাবার কথা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করেছি, তখন দুই মিডিয়ামই আমার কথায় প্রভাবিত হয়েছেন। প্রভাবিত হয়েছিলেন প্ল্যানচেটের আসরকে যেভাবে সাজিয়েছিলাম, যেভাবে পরিবেশটা তৈরি করেছিলাম, তার দ্বারাও। সবচেয়ে বড় কথা নিবেদিতা ও সুদেষ্ণা সচেতনভাবে অথবা অচেতনভাবে আত্মার অমরত্বে বিশ্বাস করতেন, বা আত্মা অমর, কি মরণশীল- এই নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন। ‘আত্মা মরণশীল’ যুক্তি ও বিজ্ঞানের সূত্র ধরে আসা প্রত্যয় তাঁদের চিন্তাতে দৃঢ়বদ্ধ থাকলে কখনো অলীক আত্মা তাঁদের উপর ভর করত না, যে ভরটা অবশ্যই একটা মানসিক অবস্থামাত্র- এর বাড়তি কিছু নয়। ‘ভূতে ভর’, ‘জীনে ভর’ বা ‘মনসার ভর’ ইত্যাদির জন্য কখনোই ভূত, জীন বা মনসার বাস্তব অস্তিত্বের প্রয়োজন হয় না, প্রয়োজন হয় সচেতন বা অচেতন মনের গভীরে ভূত, জিন, ঈশ্বরে বিশ্বাস বা দ্বিধা- “এদের বাস্তব অস্তিত্ব থাকলে থাকতেও বা পারে”। আত্মার অমরত্বে বিশ্বাসটা কোন ‘আনস্মার্ট’ হওয়ার ব্যাপার নয়। একটি মানুষ ছোটবেলা থেকে আত্মীয়-বন্ধু-শিক্ষক-বইপত্তর থেকে একটু একটু করে শিখেছেন, বিশ্বাসকে মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষে স্থান দিয়েছেন- আত্মা অমর ; এই বিশ্বাসের সঙ্গে স্মার্ট বা আনস্মার্ট হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই।

আমার প্রতি বিশ্বাস, আমি আত্মা এনে দেখাব- এই কথায় দ্বিধাগ্রস্থ মানসিক প্রতিক্রিয়া এবং পরিবেশগতভাবে ছোটবেলা থেকে গড়ে ওঠা আত্মার প্রতি বিশ্বাস বা আধা বিশ্বাস এই তিনের প্রভাবের ফলে আমি সহজেই নিবেদিতা ও সুদেষ্ণার মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষে ধারণা সঞ্চার করতে পেরেছি। আমি যে কথাগুলো বলেছি সে কথাগুলোকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘suggestion’ বা ‘নির্দেশ’ অথবা ‘ধারণাসঞ্চার’। suggestion বা ধারণাসঞ্চার সম্মোহনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক শর্ত বা আবশ্যিক প্রথম ধাপ। আত্মা আসছে- আমার এই সঞ্চারিত ধারণার প্রভাবে তাঁরা সম্মোহিত অবস্থায় নিজেদের অজ্ঞাতে উত্তর দিয়ে গেছেন।

এরপরই যে প্রশ্নটির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা অধিক- সেটা হল, তাহলে কি ধরে নেব, প্ল্যানচেটের আসরে সম্মোহনবিদের উপস্থিতি একান্তই প্রয়োজনীয়?

না, না, আদৌ তা নয়। আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী কেউ যদি সেই সঙ্গে বিশ্বাস করে বসেন- এই পদ্ধতিতে প্ল্যানচেটে আত্মা আনা সম্ভব, তবে সেই পদ্ধতি পালন করলে অজ্ঞাতে নিজের মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষে নির্দেশ পাঠান (যাকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘স্বনির্দেশ’ বা ‘auto-suggestion’) এবং নিজের অজ্ঞাতে সম্মোহিত হয়ে আত্মা তাঁর উপর ভর করেছে বলে বিশ্বাস করে বসেন। ফলে নিজের অজান্তেই উত্তর দিতে থাকেন, যেগুলো সাধারণ চোখে অস্বাভাবিক কান্ডকারখানা বলেই মনে হয়।

দ্বিতীয় যে ঘটনাটির উল্লেখ করছি, তাতে স্বনির্দেশ বা auto-suggestion -এ প্ল্যানচেটের বিষয়টা পরিষ্কার হবে বলে আশা করি।

error: Content is protected !!