স্টেট ব্যাঙ্ক কলকাতা মেইন ব্রাঞ্চের এক ডেপুটি ম্যানেজার পারিবারিক শান্তির আশায় বিখ্যাত তান্ত্রিক পাগলাবাবা (বারাণসী)-র দ্বারস্থ হন। তাঁর মতে এই তান্ত্রিক যে কোন কিছু অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার দ্বারা দেখতে পান। ধরুন, একজন কেউ জিজ্ঞেস করল, “বলুন তো আমার বাড়ান্দার টবে কি ফুলের গাছ লাগিয়েছি?” অথবা, “আমার স্ত্রীকে কেমন দেখতে বলুন তো?” অতীন্দ্রিয় অনুভূতির সাহায্যে তান্ত্রিক প্রশ্নকর্তার বাগানের ফুলের টব বা তাঁর স্ত্রী দেখতে পেতেন এবং লিখে ঠিক ঠিক উত্তর দিতেন। ডেপুটি ম্যানেজারের এই দেখাকে আমি অবিশ্বাস করিনি। কারণ, বর্তমানে পশ্চিম বাংলাতেই পাঁচজন তান্ত্রিকের খোঁজ পেয়েছি, যারা এই ধরনের নানা রকম প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম। প্রশ্নগুলো অনেক সময় অদ্ভুত ধরনেরও হতে পারে, যেমন, “বলুন তো আমার বাড়িতে ক’টা বেড়াল আছে?” বা “আমার পড়ার ঘরে কি ধরনের ফ্যান আছে দেখতে পাচ্ছেন? টেবিল ফ্যান না সিলিং ফ্যান?”
এইসব তান্ত্রিক বা ক্লেয়ারভয়ান্স (অতীন্দ্রিয় অনুভূতি) ক্ষমতার অধিকারীদের নানা রকম ছাপানো প্রচারপত্র বা জীবনীর বইতে তাঁদের গুণগ্রাহীদের তালিকায় যেসব বিখ্যাত বিজ্ঞানী, ডাক্তার লেখক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবিদের নাম দেখেছি, তাতে সত্যিই চমকে গিয়েছি। কৌশলের সাহায্যে এই খেলা আমিও সফলভাবে দেখাতে সক্ষম। জানলে আপনিও পারবেন। এও জানি কৌশল ব্যবহারের রাস্তা বন্ধ করে দিলে এইসব অতীন্দ্রিয় দৃষ্টির অধিকারীরা চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হবেন।
১৯৮৫-র ১৮ এপ্রিল আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের বিজ্ঞান বিভাগের একটি বিশেষ বেতার অনুষ্ঠানে আমি এমনি অতীন্দ্রিয় দৃষ্টির অধিকারী বলে বহুল প্রচারিত পাগলাবাবার (বারাণসী) মুখোমুখি হয়েছিলাম। পাগলাবাবা আকাশবাণী ভবনে ঢুকলেন চারটে গাড়িতে জনা পনেরো ভক্ত নিয়ে। আকন্ঠ পান করে ও পাগলামী করে একটা ‘তান্ত্রিক’ মার্কা ইমেজ তৈরি করে ফেললেন। আকাশবাণীর প্রচুর কর্মী জুটে গেলেন। এক একজন এক একটা প্রশ্ন করছিলেন। বিজ্ঞান বিভাগের প্রযোজকের রুমে জমিয়ে বসে বাবা লিখে উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঠিকঠাক উত্তর পেয়ে প্রত্যেকেই অবাক। পাগলাবাবা দাবী করলেন- এসব কথোপকথন রেকর্ড করা হোক। আমি বললাম, যা হবে স্টুডিওতে। এই মাছের বাজারে নয়। স্টুডিওতে (রেক্রডিং রুমে) তাঁকে লিখে উত্তর দিতে দিইনি। উত্তর দিতে হয়েছিল মুখে মুখে। আমার তরফ থেকে প্রশ্ন করার জন্যে হাজির করেছিলাম চিত্র- সাংবাদিক কল্যাণ চক্রবর্তী, প্রকাশক ময়ুখ বসু ও একাধারে চ্যাটার্ড ইঞ্জিনিয়ার ও প্রকাশক রঞ্জন সেনগুপ্তকে।
কল্যাণ প্রশ্ন করেছিলেন, “আমার সঙ্গের ক্যামেরাটার কটা ছবি তোলা হয়েছে।“
-“১৬ থেকে ১৭ টা।“ পাগলাবাবা বলেছিলেন।
ক্যামেরা ইন্ডিকেটারে দেখা গেল ছবি তোলা হয়েছে ৩০টা।
ময়ুখ জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমার মানিব্যাগে কত টাকা আছে?”
-“৭৭ টাকা।“
ব্যাগ খুলে দেখা গেল ২৭০ টাকা।
রঞ্জন জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আমার সিগারেটের প্যাকেটে ক’টা সিগারেট আছে।“
-“৭টা”।
সিগারেটের প্যাকেট খুলে দেখা গেল ন’টা সিগারেট রয়েছে।
‘অতীন্দ্রিয় দৃষ্টির অধিকারী’ তিনবারে তিনবারই ফেল করলেন। কেন বলুন তো? কারণ ওই একটিই, তাঁকে লিখে উত্তর দিতে দিইনি।
লিখে উত্তর দেওয়ার সময় সম্ভাব্য সব উত্তর লিখে রেখে তারপর প্রশ্নকর্তার কাছ থেকে উত্তরটা জেনে নিয়ে কাগজ ভাঁজ করে আঙ্গুলের কারসাজিতে আসল উত্তরটি ছাড়া বাঁকি সব উত্তরই ঢেকে দেওয়া হয়। ফলে প্রশ্নকর্তা দেখতে পান খাতাতে সঠিক উত্তরই লিখে রেখেছেন অতীন্দ্রিয় দৃষ্টির অধিকারী সাধকবাবাজি।
লিখে উত্তর দেওয়ার বিষয় নিয়ে আগেই দীর্ঘ আলোচনা করেছি। তাই এখানে সংক্ষেপে করলাম। এই খেলাই ঠিকমতো দেখাতে পারলে যারা দেখেন তাঁরা প্রত্যেকেই অবাক হয়ে যান। এই বিস্ময় আমি দেখেছি প্রতিষ্ঠিত চোখেই। যাদের দেখিয়ে অবাক করেছিলাম তাঁদের মধ্যে রয়েছেন, কলকাতা পুলিশের ডি.সি. হেডকোয়ার্টার সুবিমল দাশগুপ্ত, ডাঃ আবীরলাল মুখোপাধ্যায়, ডাঃ ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, কার্ডিওলজিস্ট ডাঃ রণধীর বসু, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাক শ্যামসুন্দর দে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিসিনের দুই অধ্যাপক ডাঃ জ্ঞানব্রত শীল ও ডাঃ সুখময় ভট্টাচার্য, আকাশবাণী কলকাতার বিজ্ঞান বিভাগের ডঃ অমিত চক্রবর্তী ও ডঃ সুভাষ সান্যাল, প্রাইস ওয়াটার-এর চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্ট কামাখ্যাপ্রসাদ সেনগুপ্ত, কবি সাধনা মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যিক শেখর বসু, রঞ্জন ভাদুড়ী, শ্যামলকান্তি দাশ এবং আরও অনেকেই। সুতরাং এই জাদু-কা-খেল ঠিকমতো পরিবেশে দেখিয়ে এইসব অতীন্দ্রিয় বাবারা যে বিখ্যাত বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাহিত্যিকদের সার্টিফিকেট পাবেন তাতে আর আশ্চর্যের কি!