গল্পটা শুনেছিলাম শ্রদ্ধেয় অগ্রজপ্রতিম সাহিত্যিক বনফুলের মুখে। তিনি আবার এটা শুনেছিলেন শরৎচন্দ্রের মুখে।
শরৎচন্দ্র তখন স্কুলে পড়েন। সেই সময় ভাগলপুরের আজমপুর ঘাটে এলেন এক আশ্চর্য সাধু। অসাধারণ নাকি তাঁর ক্ষমতা। পরনে গেরুয়া, মাথায় জটা, সারা গায়ে ছাইমাখা, ভাগলপুরময় দ্রুত খবরটা ছড়িয়ে পড়ল। কয়েক দিনের মধ্যেই আজমপুরের ঘাট দর্শনার্থীদের ভিড়ে জমজমাট হয়ে উঠল।
শোনা গেল, সাধুজি অনেকের দুরারোগ্য ব্যাধি সারিয়ে দিচ্ছেন, শূন্য থেকে খাবার বের করছেন, ঝোলা থেকে বের করছেন অসময়ের আম। সাধুজির কান্ডকারখানা দেখে অনেকেই টপাটপ দীক্ষাও নিয়ে নিচ্ছিলেন।
একদিন সাধুজির গঙ্গাপুজো করার ইচ্ছে হল। তাঁর ইচ্ছের কথা শিষ্যদের বলতেই শিষ্যরা পুজোর সব উপকরণ নিয়ে হাজির হল আজমপুর ঘাটে। সাধুজির নির্দেশে গঙ্গাতীরে পবিত্র জলের ধারে সাজানো হল ফল, ফুল, বাতাসা, পেঁড়া।
বেলা বারোটার সময় সাধুজি সবে পুজোয় বসবেন, এমন সময় একটা দারুণ কান্ড ঘটে গেল। কার কোম্পানির একটা বিরাট স্টিমার তখন রোজই ঐ সময় আজমপুর ঘাটের পাশ দিয়ে প্রচন্ড গর্জনে বিরাট বিরাট ঢেউ তুলে যেত। এ-দিন সেই প্রচন্ড ঢেউগুলো এসে হঠাৎই আছড়ে পড়ল গঙ্গামায়ের পুজোর নৈবদ্যর ওপর। মুহূর্তে নৈবেদ্য ভেসে গেল গঙ্গায়।
সাধুজি গেলেন খেপে- এত বড় স্পর্ধা। আমার গঙ্গামায়ের পুজো নষ্ট করা –ঠিক আছে কাল তুই ব্যাটা স্টিমার পালাবি কোথায়? এদিক দিয়েই তো যেতে হবে, তখন তোকে আস্ত গিলে খাব। হ্যাঁ, আজ আমি আমার এই সমস্ত ভক্তদের সামনে প্রতিজ্ঞা করছি, কাল সত্যিই তোকে গিলে খাব।
একজন শিষ্যের কাছে গুরুজির প্রতিজ্ঞাটা বোধহয় বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। সে জিজ্ঞেস করল, “গুরুজি, এ যে জাহাজের মতো পেল্লাই স্টিমার, খাবেন কি করে?”
গুরুজি এ-হোন সন্দেহে গর্জে উঠলেন, “কালকেই তা দেখতে পাবি বেটা। আমার প্রতিজ্ঞার কোনও নড়চড় হবে না।“
পুজো দেখতে আসা ভক্ত শিষ্যেরা পরম ভক্তিতে চেঁচিয়ে উঠল, “গুরুজি কি জয়।“
দেখতে দেখতে গুরুজির স্টিমার গেলার প্রতিজ্ঞার খবরটা ছড়িয়ে পড়ল ভাগলপুর ও তার আশেপাশে। পরদিন সকাল থেকেই আজমপুর গঙ্গার ঘাটে মেলা বসে গেল। বেলাও বাড়ে, লোকও বাড়ে।
সাধুজি ঘাটের কাছে ধুনি জ্বেলে গভীর ধ্যানে মগ্ন। বেলা বারোটা যখন বাজে-বাজে, তখন জনতা চিৎকার করে উঠল, “স্টিমার আসছে, স্টিমার আসছে।“
সাধুজির ধ্যান ভাঙ্গল এবার। চোখ মেলে তাকালেন। গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়িয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে চললেন গঙ্গার দিকে। কোমর জলে নেমে থামলেন সাধুজি। তারপর বাজখাঁই গলায় চেঁচালেন, “আয় বেটা জাহাজ, আজ তোকে গিলে খাব।“
সাধুজি যত চেঁচান, দর্শকদের সঙ্গে সঙ্গে শরৎচন্দ্রের বুক ঢিপঢিপ করে। কি বিরাট অঘটন ঘটে যাচ্ছে – ভাবতে গিয়ে আর থই পান না।
প্রচন্ড গর্জন তুলে স্টিমার এসে পড়ল। স্টিমারের ঢেউ আছড়ে পড়ল ঘাটে। সাধুজি হাঁ করে আমার যেই স্টীমারের দিকে এগোচ্ছেন, অমনি জনা-কয়েক শিষ্য জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধুজিকে ঘিরে কেঁদে পড়ল , “গুরুজি, জাহাজের কয়েক’শ নিরীহ যাত্রীদের আপনি বাঁচান। ওরা তো কোনও অপরাধ করেনি। হাজাজের দোষে ওদের কেন প্রাণ নেবেন?”
শিষ্যদের কান্নাভেজা অনুরোধে গুরুজির মন নরম হল। ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “তোদের জন্যেই জাহাজটা বেঁচে গেল।“
এ-ক্ষেত্রেও কিন্তু সাধুজির অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা প্রমাণিত হল না তাঁর শিষ্যদের জন্যে। অথবা এ-ও বলা যায়, গুরুজির বুজরুকি ধরা পড়ল না তাঁরই শিষ্যদের অভিনয়ে।